চোখ খুলতেই নিজেকে মাটিতে শোয়া অবস্থায় আবিষ্কার করলাম।উঠতে কোনো কষ্টই হলো না।অথচ আমি তো অনেক অসুস্থ ছিলাম।উঠেই দেখলাম আমার শরীরটা মাটিতে পড়ে আছে চেয়ার থেকে পরে।প্রচুর রক্ত পড়েছে।রক্ত গড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে।তারমানে কি আমি মারা গেছি।ওহ কি যে খুশি লাগছে না।

আল্লাহ আমার এই ইচ্ছাটা পূরণ করেছে।কিন্তু আমি যে মারা গেছি সেটা আব্বু আর ভাইয়া হয়ত জানে না।তারা যদি জানতে পারে আমি আর নেই তারা দুইজন অনেক খুশি হবে।আপদ বিদেয় হয়েছে।আমার আম্মু আমাকে জন্ম দিয়েই মারা জান।আমাকে দায়ি করে তার জন্য।

আব্বু আর আম্মু ভালোবেসে দুইজন বিয়ে করেছিল।আব্বু আম্মুকে প্রচন্ড ভালোবাসতো।পালিয়ে বিয়ে করেছিল বলে তাদের মেনে নেয় নি।এগুলো অবশ্য শুনেছিলাম আমার খালার থেকে।উনি আমাদের বাসায় কাজ করতেন।উনিই আমাকে ছোট থেকে বড় করেছেন।উনিই আমাকে শুধু ভালোবাসতেন।যখন বুঝতে শিখি তখন উনি মারা জান।ভাগ্যটা আমার এতই খারাপ যে কারো ভালোবাসাই আমার কপালে নেই।

তখন তাদের থেকে আরো বেশি অবহেলা পেতে থাকি।আব্বু আর ভাইয়া আমাকে ঘৃণা করে।তাদের মতে আমার জন্য আব্বু তার ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছে আর ভাইয়া ছোট বেলায় আম্মুর ভালবাসা পায় নি।তাই হয়তো আআমাকে তারা সহ্য করতে পারে না। আমরা এখন দুই ভাই আর আমাদের আব্বু।যদিও আমাকে তারা দেখতে পারে না।আমি যেন থেকেও নেই।আব্বু আর ভাইয়া কেউই আমার খবর রাখে না।আম্মু মারা জাওয়ার পর থেকেই আমাকে আব্বু আর রাফি ভাইয়া কেউই দেখতে ও সহ্য করতে পারে না।আমি তাদের দুই চোখের বিষ।আব্বু বা ভাইয়া কেউই আমার খেয়াল।রাখতো না।বাড়ির একটা ছোট ঘরে থাকতাম আমি।সারা দিন ঘরের ভিতরই কাটাতাম।আব্বু ছিল ভীষণ রাগী।যদিও রাগটা ছিল শুধুই আমার উপর।তাই ভয়ে কখনও কথা বলি নি।ভাইয়া কে অনেক ভালোবাসতো।ছোটবেলায় দেখতাম আব্বু এত্ত এত্ত চকলেট এনে ভাইয়াকে দিত।কিন্তু আমাকে দিত না।রাফি ভাইয়া ছাড়াও যে আরো একটা ছেলে আছে তাদের এটা সে বুঝতো না।ছোট বেলা থেকেই তাদের অবহেলায় বড় হয়েছি।অনেক কেদেছি ঘর বসে।কেন আমিও আম্মুর সাথে চলে গেলাম না।কেন আম্মু আমাকে একা ফেলে রেখে চলে গেলে।আমি কি এতই খারাপ যে কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না।কেন আমি মরে গেলাম না।ভাইয়াও মাঝে মাঝে বলে কেন আমি মারা যাই না।

একদিন আব্বু এক লোককে দিয়ে আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়।স্কুলের সবাইকে দেখতাম তাদের আব্বু অথবা আম্মু অথবা ভাইয়ারা নিয়ে যায় দিয়ে যায়।কিন্তু আমি একা একাই স্কুলে আসতাম,যেতাম।রাফি ভাইয়া যেত আব্বুর দামি গাড়িতে করে।এমনকি আব্বু কখনও নাম ধরে ডাকতো না।আমাকে ঈদে নতুন পোশাক কিনে দিত না।রাফি ভাইয়ার পুরানো পোশাক পড়তাম।খেতেও ডাকতো না।এভাবেই এ.এস.সি পাশ করলাম।আব্বু প্রথমে আমাকে কলেজে ভর্তি করাতে চায় নি।অনেক অনুরোধের পর ভাইয়া আব্বু কে এই কথা বলেছিল।পরে এক কলেজে ভর্তি হই।এখন সব অবহেলাই সহ্য হয়ে গিয়েছে।খুবই কম কথা বলি আমি।ছোট বেলা থেকেই অভ্যাস।কারো সাথেই কথা বলি না আমি।সবাই আমার থেকে দূরে থাকে।

হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম একটা মেয়ে আমাকে ক্লাসে তাকিয়ে থাকে।আমি তার দিকে তাকাই নি কখনও।একদিন আমাকে ও প্রপোজ করে।আমি না করে দেই।তাই ও আমাকে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলে।আর আমি নাকি ভাব দেখাই।

একদিন কলেজ গেট দিয়ে ঢুকছিলাম হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লাগে।দেখি ওই মেয়েটা।সাথে সাথে একটা ছেলে এসে আমার শার্টের কলার ধরে দুটো থাপ্পর দিয়ে বলে,ওই মেয়ে দেখলেই ধাক্কা মারতে ইচ্ছা করে?আমি বলি,আমি খেয়াল করি নি।খেয়াল করস নাই মানে।যা এইখান থেকে।ওই মেয়েটা আবারও কিছু খারাপ কথা বলল।আমি ক্লাস শেষ করে বাসায় চলে আসি।

আমি জানতাম না যে ওই মেয়েটা আব্বুর কলিগের মেয়ে।এইচ.এস.সি শেষ করে একটা ভার্সিটিতে চান্স পাই অনেক কষ্টে। সেখানে দেখি আবার ওই রাগি মেয়েটা।একদিন ইচ্ছা করেই আমাকে ভার্সিটির বড় ভাই দের কে দিয়ে মার খাওয়ায়।আমি নাকি ওকে ডিস্টার্ব করি।যদিওবা আমি কিছুই করি নি তাও ওর কাছে ক্ষমা চাই।

আব্বু একদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে।আমি তার অনেক সেবা-যত্ন করে সুস্থ করে তুলি।আমাকে কিছুটা ভালোবাসতে থাকে।

আমাদের বাসায় একদিন মেহমান আসে।জানতাম না কে এসেছে।আব্বু আমাকে ডাক দেয়।পরিচয় করে দেওয়ার জন্য।আমি উকি মেরে দেখছিলাম।দেখি যে ওই মেয়েটা ওর পরিবারের সাথে এসেছে।
আমাকে দেখেই ও বলে উঠে,
মেয়েটা:-তুই এখানে কেন?
ওর আব্বু:-কেন মা কি হয়েছে?
আব্বু:-ও কি করেছে?
মেয়েটা:-আব্বু তোমাকে বলেছিলাম না ভার্সিটিতে একটা ছেলে আমাকে ডিস্টার্ব করে।এই হচ্ছে সেই ছেলেটা।
ওর আব্বু:-ছিঃ আফজাল সাহেব আপনি ছেলেকে এই শিক্ষা দেন।
আব্বু:-আমি দুঃখিত।
আমি তখন কিছুই বলতে পারি নি।কারণ আব্বু আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করবে না।আব্বু উনাদের সামনেই আমাকে অনেক গুলা থাপ্পড় দিলেন।খুব কষ্ট হচ্ছিল তখন।তারা যাওয়ার পরেও আমাকে অনেক মারধর করে।তখন বলেছিল যে সত্যিই আমি ওকে ডিস্টার্ব করি নি।আব্বুর আমার কথা শুনে নি সেদিন।

সেদিন সাড়া রাত ঘুম হয়নি।শুধুই কেদেছি।এছাড়া যে আমার কোনো কিছুই করার নেই।হঠাৎ সেদিনকার মত প্রচন্ড মাথা ব্যাথা শুরু হল।অসহ্য ব্যাথায় জ্ঞান হারালাম।তারপরের দিন দুপুরে জ্ঞান ফিরল।সেইদিন এক ডাক্তারের কাছে দেখাতে গেলাম।সে কিছু পরিক্ষা করতে বলল।পরিক্ষার রিপোর্ট দেখে বললেন,
ডাক্তার:-আপনার বাড়িতে কে কে আছে?
আমি:-জি কেউ নেই?
ডাক্তার :-তাহলে আপনাকেই বলি….
আমি:-বলেন।
ডাক্তার:-আপনার ব্রেইন ক্যান্সার।লাস্ট স্টেজ।আপনি আর কিছু দিনের অতিথি।
আমি:-(মুখে হাসি ভাব এনে বলি)ধন্যবাদ।
তারপর চলে আসি।ডাক্তার আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

বাসায় এসে রাতের আকাশে তাকিয়ে বলি, আম্মু আমি আসছি কিছুদিনের ভিতর তোমার কাছে।অনেক মিস করেছি তোমাকে।আর মিস করব না।তোমার কাছে আসছি যে।

হঠাৎ করে আবার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা শুরু হয়।এবার নাক দিয়ে রক্ত পরতে শুরু করে।একটা কাগজে লিখলাম,”আব্বু আর ভাইয়া আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি।কিন্তু তোমরা তা বুঝলে না।ছোট বেলা থেকেই তোমাদের অবহেলায় বড় হয়েছি।আব্বু তুমি ভেবেছো আমার জন্য তুমি তোমার ভালোবাসা হারিয়েছো।তুমি বুঝনি যে আমি তোমাদের ভালোবাসার শেষ স্মৃতি।আমাকে কখনও ছেলে ভাবো নি।ভাইয়া ভেবেছো আমার জন্য তুমি আম্মুর ভালোবাসা,স্নেহ,মায়া-মমতা পাও নি।আমিও তো তোমার মত আম্মুর ভালোবাসা পাই নি।আর আব্বুর ভালোবাসা কি হয় সেটাও জানি ননা।আব্বু সত্যিই আমি ওকে ডিস্টার্ব করি নি।ওর প্রপোজাল গ্রহণ করি নি বলে ও একদিন ভুল বশত ধাক্কা লাগাতে ও এই মিথ্যা নাটকটি করেছিল।সত্যিই তোমাদের অনেক ভালোবাসি।অনেক বেশি।ভালো থেকো তোমরা।এই অপদার্থের জন্য কখনও তোমাকে আর কথা শুনতে হবে না আব্বু।আরো অনেক কথা ছিল।বলতে পারলাম না।কারণ আমার সময় যে শেষ।”লিখা শেষেই চোখ থেকে এক ফোটা জল ও অল্প রক্ত চিঠিতে পরলো।মুহূর্তেই সব অন্ধকার দেখলাম।চেয়ার থেকে মাটিতে পরে গেলাম।