“আরশান তোর ফোন বাজছে”
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সামনে পিছনে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম হলুদ পাঞ্জাবীতে আমাকে কেমন লাগছে তখনি শান্তর ডাক পড়লো। শান্ত, আরিয়ান, সিফাত ওরা সবাই বাগানে বসে গীটারে টুংটাং সূর তুলছে আর গান গাইছে, আমার ফোনটা ওদের হাতে বন্ধী আছে তাই তাড়াহুড়ো করে বাগানের দিকে ছুটলাম।

আমি আরশান। আব্বু, আম্মু, বড় বোন ফারিয়া, চাচ্চু, চাঁচি, চাচাতো ভাই আদিত্য আর চাচাতো বোন রোদেলা এই আমাদের পরিবার। আমার আরো একটা পরিবার আছে শান্ত, আরিয়ান, সিফাত আর অধরাকে নিয়ে ওরা সবাই আমার কলিজার টুকরো বন্ধু। শান্তর বোনের বিয়েতে গ্রামে এসেছি সবাই আর আজ রাতে গায়ে হলুদ।
সিফাত: বাব্বাহ্ এ আমি কাকে দেখছি?
আরিয়ান: যাই বলিস হলুদ পাঞ্জাবীতে তোকে খুব সুন্দর মানিয়েছে।
সিফাত: এই বিয়ে বাড়ির মেয়েরা আজ তোর প্রেমে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। (শালারা হাসছে দেখে ইচ্ছে হচ্ছে দেই দু একটা কিন্তু দিলাম না কারণ আগে দেখতে হবে কে ফোন করেছিল, আপু নয়তো?)
আমি: অনেক বকবক করেছিস এবার আমার ফোনটা কোথায় দে।
শান্ত: এইযে।
শান্তর থেকে ফোন এনে তাড়াতাড়ি কল লিস্ট চ্যাক করলাম আপু অনেক বার ফোন করেছিল, আজ তো আপু খুব রাগ করবে। তাড়াতাড়ি আপুকে কল ব্যাক করলাম।

আপু: কিরে ভাই এতক্ষণ ধরে কল দিয়ে যাচ্ছি ধরছিলি না কেন?
আমি: আপু কিছুক্ষণ পর তো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান তাই রেডি হচ্ছিলাম।
আপু: ভাই তুই এমনিতে যা সুন্দর একটু কম সাজগোজ করিস, বিয়ে বাড়ির মেয়েরা কিন্তু তোর প্রেমে হাবুডুবু খাবে তখন কাকে রেখে কাকে মন দিবি?
আমি: আপু শেষ পর্যন্ত তুইও শুরু করলি?
আপু: কেন আরিয়ানরা বুঝি খুব ক্ষেপিয়েছে?
আমি: হ্যাঁ, ভাগ্য ভালো অধরা গ্রামে আসেনি।
আপু: যাই বলিস অধরা মেয়েটা কিন্তু খারাপ না।
আমি: আপু ও আমার বন্ধু হয়। আর তুই তো জানিস এসব প্রেম টেম আমার ভালো লাগেনা।
আরিয়ান: আপুকে মিথ্যে বলা হচ্ছে? এখনি যদি কোনো রূপবতী তোর সামনে দিয়ে যায় তাহলে তো তার প্রেমে হাবুডুবু খাবি।
আমি: থামবি তুই?
শান্ত: কেন থামবে ও ভুল কিছু বলেছে নাকি?
আমি: তোদের আমি…
আপু: ভাই মারিস না ওদের ফাজলামো করতে দে। (এদিকে ওরা হাসাহাসি করছে আবার ফোনের ওপাশে আপু হাসছে রাগ কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছে তাই তাড়াতাড়ি ওদের সামনে থেকে চলে আসলাম)
আমি: হ্যাঁ আপু এবার বল।
আপু: ওদের কথা শুনা যাচ্ছে না কেন?
আমি: কারণ আমি ওদের রেখে রুমের দিকে যাচ্ছি।
আপু: ওহ!
আমি: আম্মু কি করছে রাতের খাবার খেয়েছে?
আপু: হ্যাঁ। আচ্ছা তুই বাসায় ফিরছিস কবে?
আমি: এইতো বিয়ে… (চোখ আটকে গেলো এক এলোকেশীর চুলের উপর, লম্বা দীঘল কালো চুল গুলো পুরো পিটময় ছড়িয়ে কোমড় ছাড়িয়ে একদম হাটুর কাছে গিয়ে থেমেছে। এতো সুন্দর চুল? কিন্তু মেয়েটা এই রুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কি করছে? আমি কি তাহলে ভুল করে অন্য কারো রুমে ঢুকে পড়লাম? আমাদের মানে শান্তর রুমে এই মেয়ে কে? চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম হ্যাঁ এটাই তো শান্তর রুম এইতো আমাদের চার বন্ধুর জিনিসপত্র)
আপু: ভাই কথা বলছিস না কেন কি হয়েছে?
আমি: দেখছি।
আপু: কি?
আমি: এক এলোকেশীকে।
আপু: কি? তোর মাথা ঠিক আছে তো? ভাই আমি কিন্তু শুনেছি গ্রামে ভূত পেত্নী থাকে।
আমি: আপু ও কোনো পেত্নী নয়, যদিও এখনো মুখ দেখিনি তবে আমার মন বলছে ও দেখতে খুব মায়াবতী হবে।
আপু: মায়াবতী?
“উফফ কিছুতেই হচ্ছে না বারবার লেপ্টে যাচ্ছে কাজলটা, আর দিবোই না” (নিজের উপর একরাশ বিরক্তি নিয়ে মেয়েটি পিছন ফিরে তাকালো, দরজায় আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হকচকিয়ে উঠে থমকে দাঁড়ালো। গায়ের রঙ কিছুটা চাপা, হাটু অব্ধি দীঘল কালো চুল, চোখ দুটু কাজল ছাড়াই হরিণীর চোখের মতো, নাকের আঘায় ছোট একটি তিলক, ঠোঁটে পিংক কালারের হালকা লিপস্টিক, কানের পাশে দুটু কাঠগোলাপ গাঁথা, কপালে ছোট একটি লাল টিপ, দু হাত ভর্তি লাল হলুদ রেশমী চুড়ি, পায়ে আলতা, লাল পাড়ের হলুদ শাড়ি সুবহানআল্লাহ্ খুব সুন্দর)
আপু: ভাই কথা বলছিস না কেন কি হয়েছে?
আমি: আপু আল্লাহর সৃষ্টি এতো সুন্দর? আমিতো প্রথম দেখায় ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।
আপু: মানে?
আমি: মায়াবতী…
“আপনি এই রুমে কি করছেন? আর নক করে ঢুকলেন না কেন?” (মেয়েটির কথায় যেন আমি স্তম্ভিত ফিরে পেলাম)
আমি: আপু রাখছি পরে কল দিচ্ছি।
আপু: ভাই এই ভাই শুন…
আপুর কথা না শুনে ফোন কেটে দিলাম।

মুগ্ধ নয়নে মায়াবতীর দিকে তাকিয়ে আছি, গভীর দুটু চোখে মায়া ভরা ওর।
“কি হলো কথা বলছেন না কেন”
মায়াবতীর কথায় আমার হুশ ফিরলো, মৃদু হেসে আস্তে আস্তে রুমের ভিতর ঢুকছি আর মায়াবতী ভয়ে চুপসে একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছে। আমি এগুচ্ছি আর মায়াবতী পিছিয়ে যাচ্ছে, ও পিছিয়ে গিয়ে টেবিলের সাথে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেলো। মায়াবতীর ভয় পেয়ে চুপসে যাওয়া মুখ দেখে মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিলাম, ওর কোমড়ের কাছ দিয়ে আমার হাত যাচ্ছে দেখে ও ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো। টেবিল থেকে আমার ঘড়িটা এনে মায়াবতীর দিকে তাকালাম ভয় পেয়ে চোখ দুটু বন্ধ করে ফেলেছে।
আমি: এইযে মায়াবতী। (আমার ডাক শুনে চোখ খুলে তাকালো আর আমার হাতে ঘড়ি দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো)
আমি: কি ভেবেছিলে প্রথম দেখায়…
যাহ্ ভয়ে পেয়ে হাতের কাজলের কৌটোটা ফেলে রেখেই দৌড়ে চলে গেলো, পাগলী একটা।

কাজলের কৌটোটা ফ্লোর থেকে তুলে হাতে নিলাম, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি কৌটোটার দিকে। আচ্ছা কাজল ছাড়াই তো মায়াবতীর চোখ দুটু হরিণীর চোখের মতো তাহলে এই কাজল দিলে পর ওই মায়া ভরা চোখ দুটি দেখতে ঠিক কতোটা সুন্দর হয়? নিশ্চয়ই ওই চোখ দুটির গভীরতা আরো বেড়ে যায় আরো বেশি মায়াময় হয়ে উঠে ওই হরিণী চোখ দুটু।
শান্ত: এই আরশান? (শান্তর ধাক্কায় চমকে উঠে কাজলের কৌটোটা লুকিয়ে পিছনে তাকালাম)
শান্ত: কিরে কতক্ষণ ধরে ডাকছি শুনছিসই না আর তোর হাতে ওটা কি ছিল কি লুকালি?
আমি: ককই কিকিছু নাতো।
শান্ত: কিছু তো একটা ব্যাপার আছেই নাহলে এভাবে তোতলাচ্ছিস কেন?
আমি: কিছু না অজতা ভাবছিস।
শান্ত: ঠিক আছে এবার বাইরে চল অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে।
আমি: হ্যাঁ আসছি।
শান্ত চলে গেছে, উফফ জোড় বাঁচা বেঁচে গেছি। একবার যদি ওরা এই কাজলের কৌটোটা দেখে তাহলে আমাকে হাজারটা প্রশ্ন করবে। কিন্তু আমি কি করে ভুলবো এই কৌটোর কথা? এই কাজলের কৌটোর মালিনী যে আমার মন কেড়ে নিয়েছে তাকে যে আমি প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছি। মায়াবতীকে দেখার পর থেকে আমার মনের ভিতর কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এই মায়াবতী কে কি তার পরিচয় সবকিছু আমাকে জানতে হবে। কৌটোটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কৌটোটা লুকিয়ে রেখে স্টেজের দিকে পা বাড়ালাম।

আরিয়ান: কিরে এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
আমি: এইতো রুমে আপুর সাথে ফোনে কথা বলছিলাম।
সিফাত: তুই কি কাউকে খুঁজছিস চারদিকে এভাবে চোখ বুলাচ্ছিস যে।
আমি: কোথায় কাউকে নাতো। (খুঁজছি তো বটেই, এক ঝাক মেয়েরা শান্তর বোনের পাশে আছে কিন্তু আমার মায়াবতীকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না)
আরিয়ান: এই আরশান কি হয়েছে তোর?
আমি: আরে কি হবে?
আরিয়ান: বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিস কোথায় যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছিস কি ব্যাপার?
আমি: শান্ত কোথায়?
সিফাত: তুই এতো মনোযোগ দিয়ে শান্তকে খুঁজছিলি আমিতো ভাবলাম ঐ এক ঝাক মেয়ে থেকে বুঝি…
আমি: মেয়ে দেখার অভ্যাস তোর তুই’ই দেখ আসছি আমি।
সিফাত: কোথায় যাচ্ছিস?
সিফাতের কথার জবাব না দিয়ে চারপাশে চোখ বুলাতে লাগলাম কোথায় যে হারিয়ে গেলো মেয়েটা।

খুঁজতে খুঁজতে বাগানের দিকে আসতেই হঠাৎ মায়াবতীকে পেয়ে গেলাম, একা দাঁড়িয়ে আছে। দেখে তো মনে হচ্ছে কারো জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু কার জন্য বয়ফ্রেন্ড নাতো? এক পা দু পা করে ওর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আর আমার হার্টবিট বেড়ে চলেছে মনে হচ্ছে এখনি ওর বয়ফ্রেন্ড এসে ওর হাত ধরে নিয়ে যাবে ওকে।
“এই হিমি এদিকে” কারো ডাকে ও পিছন ফিরে তাকালো আমিও তাকালাম এতো শান্তর ছোট বোন তারিন, তারমানে মায়াবতীর নাম হিমি? বাহ্ খুব সুন্দর নাম।
তারিন: কিরে ওদিকে ডাকছিলাম যাচ্ছিলি না কেন? এই নে তোর আইসক্রিম, এই রাতের বেলা আইসক্রিম খেয়ে যে কি মজা পাস বুঝিনা। (হিমির দিকে লক্ষ করলাম আইসক্রিম না নিয়ে বারবার আড়চোখে আমাকে দেখছে, ওর দুচোখে ভয় স্পষ্ট ফুঁটে ওঠেছে)
তারিন: আরে আরশান ভাইয়া তুমি এখানে বাকিরা কোথায়? (হঠাৎ তারিনের প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে উঠলাম)
আমি: না মানে ওদেরকেই তো খুঁজছিলাম। (হিমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমি ওকে আড়চোখে দেখছি, এর মধ্যে চোখে কাজলটাও দিয়ে নিয়েছে। আমার ধারণাই সত্যি কাজল পড়লে মেয়েটার মায়া ভরা হরিণী চোখ দুটু আরো মায়াবী হয়ে উঠে)
তারিন: দেখো হয়তো স্টেজের দিকে গীটার নিয়ে বসে আছে, আসছি। হিমি চল।
হিমি আমার দিকে একনজর তাকিয়ে তারিনের হাত ধরে তাড়াতাড়ি চলে গেল, আশ্চর্য এই মেয়ে আমাকে এতো ভয় পায় কেন?

ভোররাত, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ তবুও মেহমানদের গিজগিজ কমেনি। এতো মেহমানের সামনে তো আর ড্রিংক করা যায় না তাই চার বন্ধু পুকুরপাড়ে বসে এনজয় করছি।
শান্ত: আব্বু যদি একবার বুঝতে পারে তাহলে আমাকে বাড়ি ছাড়া করবে।
আমি: আসছে সাধু মানুষ, বিভিন্ন পার্টিতে যখন ড্রিংক করিস তখন বাবার কথা মনে পড়ে না?
সিফাত: তখন তো ওর বাবা মঙ্গল গ্রহে থাকে তাই ভুলে যায়। (সিফাতের কথায় সবাই একসাথে হেসে উঠলাম)
শান্ত: কিন্তু গ্রামে এসে তো কখনো এসব খাইনি।
আরিয়ান: তাতে কি হয়েছে আজ খাঁ, তোর বোনের বিয়ে আর তুই এনজয় করবি না? (আরিয়ান আমার দিকে গ্লাস এগিয়ে দিলো, আমি গ্লাস হাতে নিতেই কয়েকটা মেয়ের হাসির শব্দ শুনতে পেলাম)
আরিয়ান: এই রাতের বেলা এদিকে আবার কে আসছে?
শান্ত: তারিন হবে ওর বান্ধবীদের সাথে নিয়ে আসছে হয়তো।
সিফাত: এসব লুকাতে হবে?
শান্ত: না না তারিন জানে আমরা যে ড্রিংক করি।
আমি: তাহলে আর প্রবলেম কি? (গ্লাসে চুমুক দিতে যাবো তখনি দেখি সামনে হিমি, এখনি ওদের আসতে হলো? তাড়াতাড়ি গ্লাস ছুড়ে পুকুরে ফেলে দিলাম, প্রথম দিনেই হিমির সামনে খারাপ হয়ে গেলাম?)
শান্ত: কিরে কি হলো?
আমি: কতবার তোদের এসব ছাইপাঁশ খেতে বারণ করেছি আমার কথাই শুনিস না তোরা। (সবাই আমার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে আছে)
তারিন: ভাইয়া এখানে এসব আব্বু দেখলে কি হবে বুঝতে পারছ?
শান্ত: ওদের আমি আগেই বলেছিলাম এসব না আনতে।
আমি: হ্যাঁ আমিও বলেছিলাম।
তারিন: আব্বু দেখলে খুব রেগে যাবে এসব তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলো।
শান্ত: ঠিক আছে। (তারিন সবাইকে নিয়ে চলে যেতেই আরিয়ান এসে আমার হাত চেপে ধরলো)
আরিয়ান: এই শালা এতো ভালো হলি কবে? এসব আমাদের থেকে কে বেশি খায়?
আমি: খাইতো আমিই তবে এবার মনে হচ্ছে এসব ড্রিংক মারামারি ঝামেলা ছেড়ে দিতে হবে।
সিফাত: কি?
আমি: সবাই আমার দিকে এমন হা করে তাকিয়ে আছিস কেন?
শান্ত: ভাই তুই কি প্রেমে টেমে পড়েছিস? ব্যাপারস্যাপার একদম ভালো ঠেকছে না। (ফোন বেজে উঠলো, আম্মু এই ভোররাতে ফোন করেছেন বাসায় কোনো বিপদ হয়নি তো?)
শান্ত: কিরে এই সময় কে ফোন করলো?
আমি: আম্মু।

সবার থেকে কিছুটা দূরে এসে ফোন রিসিভ করলাম।
আমি: আম্মু কি হয়েছে?
আম্মু: কিছুনা এমনি ফোন করলাম।
আমি: এই ভোররাতে?
আম্মু: ছেলের কাছে ফোন দিতে বুঝি সময় অসময় লাগে? হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো ভাবলাম তুই ঠিক আছিস কিনা দেখি।
আমি: আম্মু তুমি আমাকে নিয়ে এতো ভাবো কেন? তুমি যতোটা ভাবো তার এক ভাগ যদি আব্বু আমাকে নিয়ে ভাবতেন তাহলে সত্যি আমি পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ হতাম।
আম্মু: বাদ দে না বাবা, এবার বল গ্রামে তোর কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাতো?
আমি: না আম্মু বরং এখানে আমি অনেক ভালো আছি।
আম্মু: এতো খুশির কারণ কি জানতে পারি?
আমি: অবশ্যই, আচ্ছা আম্মু আমি যদি তোমার জন্য একটা বৌমা নিয়ে আসি তাহলে কেমন হয়?
আম্মু: তারমানে এতোদিনে আমার ছেলে কাউকে পছন্দ করেছে, এই আমার বৌমা দেখতে কেমন?
আমি: মাশাআল্লাহ্‌ অনেক সুন্দর, তুমি হিমিকে পছন্দ করবে আমি শিওর।
আম্মু: নাম বুঝি হিমি?
আমি: হ্যাঁ।
আম্মু: প্রপোজ করেছিস?
আমি: না আজকেই তো মাত্র দেখলাম। তাছাড়া তোমার বৌমা আমাকে দেখলেই ভয় পায়।
আম্মু: একবার প্রপোজ করে নে দেখবি ভয়ডর সব হারিয়ে যাবে।
আমি: ঠিক আছে।
আম্মু: আর হ্যাঁ তোর ক্যামেরায় যেন আমার বৌমার অনেক গুলো ছবি থাকে।
আমি: ঠিক আছে আম্মু।
আম্মু: রাখছি।
আমি: লাভ ইউ আম্মু।
আম্মু: লাভ ইউ টু।
আম্মু ফোন রেখে দিতেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, আম্মুকে তো হিমির কথাটা বলে দিলাম যদিও জানি আম্মু আমার পছন্দকে কখনো অপছন্দ করবে না, এমন মা যে সবার ভাগ্যে জুটে না।

গাছের ডালপালা আর পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্য, আমি বাগানে দাঁড়িয়ে সকালের এই মুগ্ধ করা সূর্যোদয়কে ক্যামেরায় বন্ধি করছি। ফটোগ্রাফিটা আমি খারাপ পারি না তাইতো বাগানে ফুটা নানা রঙের ফুল আর সূর্যোদয় ক্যামেরায় বন্ধি করছি। সকালের মৃদু হাওয়া সাথে এমন মন্ত্রমুগ্ধকর সূর্যোদয়, পাখির কিচিরমিচির ডাক গ্রামে না আসলে বোধহয় এগুলো কখনো উপভোগ করা হতো না। মুগ্ধকর এই সকালের পরিবেশ দেখে নিজের অজান্তেই মিটিমিটি হাসছিলাম আর এটাসেটার ছবি তুলছিলাম হঠাৎ ক্যামেরায় চোখ আটকে গেলো, হিমি পুকুরপাড়ে বসে আছে। ক্যামেরা সরিয়ে হিমির দিকে তাকালাম, হিমি আনমনা হয়ে চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে, ওর দীঘল কালো চুল গুলো পিটময় ছড়িয়ে মাটিতে এসে পড়েছে। সকালের মিষ্টি বাতাস অবাধ্যের মতো বারবার হিমির চুল গুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে আর হিমি চোখেমুখে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বারবার চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে নিচ্ছে। যদিও জানি কারো অনুমতি না নিয়ে ছবি তোলা অন্যায় তবুও এখন তুলতে হচ্ছে আম্মুর জন্য, আম্মুর তো উনার বৌমাকে দেখার অধিকার নিশ্চয় আছে। গাছের আড়াল থেকে ঝটপট হিমির কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম, কোনো ছবিতে হিমি চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে, কোনো ছবিতে অবাধ্য চুল গুলোকে কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছে আবার কোনো ছবিতে হিমি পুকুরে ঢিল ছুড়ে মারছে।
আরিয়ান: কিরে একা একা মিটিমিটি হাসছিস যে কি আছে ক্যামেরায়? (হিমির ছবি গুলো দেখে নিজের অজান্তেই হাসছিলাম হঠাৎ আরিয়ানের কথায় হুশ ফিরলো)
আমি: ক্যামেরায় আবার কি থাকবে কিছু নেই তো।
আরিয়ান: তুই তো আবার ফটোগ্রাফিটা ভালোই পারিস থাকতেও তো পারে কোনো ছবি।
আমি: হ্যাঁ আছে তো এই সুন্দর সকাল, বাগানের নানা রঙের ফুল আর সূর্যোদয় এর ছবি।
আরিয়ান: ভাই তুই পারিসও।
সিফাত: এই তোরা ওখানে কি করছিস? (সিফাত আমাদের ডেকে গীটার হাতে নিয়ে এদিকেই আসছে, সিফাতের ডাক শুনে হিমি পিছন ফিরে তাকালো। আমাকে বোধহয় হিমি এখানে আশা করেনি তাই উঠে চলে যেতে চাইলো, পরক্ষণেই আবার কি যেন ভেবে না গিয়ে আবার বসে পড়লো)
সিফাত: কিরে ওদিকে কি?
আমি: কিছুনা।
সিফাত: কত সুন্দর সকাল দেখেছিস?
আমি: হুম, তবে একটু পর আর এই সৌন্দর্য থাকবে না। বিয়ে বাড়ির মেহমানরা সব গিজগিজ করতে শুরু করবে।
শান্ত: এখন যে সৌন্দর্য আছে সেটাকে আরো একটু সুন্দর করে তুলনা। (শান্ত এসেই বাগানে বসে পড়লো, শান্তকে দেখে আমরাও বসে পড়লাম)
সিফাত: আরশান কিন্তু চাইলেই ওর মিষ্টি কন্ঠের গান দিয়ে এই সুন্দর সকালটাকে আরো সুন্দর করে তুলতে পারে।
আরিয়ান: হ্যাঁ আরশান একটা গান প্লিজ!
হিমির দিকে তাকালাম বারবার আড়চোখে আমাকে দেখছে আর আমি তাকালেই তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। হিমি পুকুরপাড়ে বসে আছে আর আমরা বাগানে, দুজনের মধ্যে দূরত্বটা খুব একটা বেশি নয়। আমি গান গাইলে নিশ্চয় হিমি শুনতে পাবে আর ভালোবাসার মানুষকে গান শুনাতে কে না চায়? সিফাতের থেকে গীটার এনে হিমির দিকে তাকিয়েই গীটারে টুংটাং সূর তুললাম, হিমি আড়চোখে আমাকে দেখছে দেখে এক গাল হেসে গান শুরু করলাম…
প্রথম দেখে ভালোলাগা এলোমেলো মন
সময় যেন যাচ্ছে থেমে ভেবে সারাক্ষণ!
রোদের রঙে যাক মিশে ভালোলাগা সব
তোমায় পেলে আর কিছুই চায় না অনুভব!
তুমি এলে যেন অবাক শ্রাবণের সুখ
বলো চোখের যাক থেমে দেখে ঐ মুখ!
ভাসলো মেঘে পরাণ আমার উদাসী মন
কান পেতে শুনতে পাবে বুকের কাঁপন….

গান গাওয়ার মাঝখানে কখন যে হিমি উঠে চলে গেল বুঝতেই পারলাম না, উফফ এই মেয়েটা এমন কেন? গীটার রেখে উঠে দাঁড়ালাম চারদিকে চোখ বুলাচ্ছি কিন্তু হিমি তো কোথাও নেই।
শান্ত: কাকে খুঁজছিস? (হঠাৎ কাধে শান্তর হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলাম)
আমি: কাউকে না।
শান্ত: রাত থেকে লক্ষ করছি তুই বারবার অন্য মনস্ক হয়ে যাচ্ছিস আমাদের এড়িয়ে চলছিস কি হয়েছে বলতো।
সিফাত: আরশান তুই আমাদের থেকে কথা লুকাচ্ছিস? আগে তো কখনো এমন হয়নি। চার বন্ধু সবসময় মিলেমিশে চলেছি কোনো প্রবলেম হলে চার বন্ধু একসাথে সমাধান করেছি।
আরিয়ান: তোর কি কোনো প্রবলেম হয়েছে? (ওদের দিকে তাকিয়ে ভাবছি হিমির কথা কি এখন ওদের বলা ঠিক হবে? আমি প্রপোজ করার পর যদি হিমি না বলে দেয় তখন? কিন্তু এটাও তো সত্যি ওদের থেকে লুকানো ঠিক হচ্ছে না)
শান্ত: কিরে কি ভাবছিস?
আমি: আমি একটি মেয়েকে প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছি, জানিনা মেয়েটি রাজি হবে কিনা। কিন্তু বিশ্বাস কর তোরা আমি ওকে সত্যি অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। (একদমে কথা গুলো বলে থামলাম, ওরা সবাই আমার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে আছে)
আমি: এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন তোরা আমি কি কাউকে ভালোবাসতে পারিনা?
শান্ত: আমাদের আরশান প্রেমে পড়েছে। (তিনজন একসাথে এসে হুড়মুড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো)
সিফাত: এই ভাবি দেখতে কেমন?
আরিয়ান: ভাবির নাম কি?
শান্ত: মেয়ে কি আমাদের গ্রামের?
সিফাত: ভাবিকে প্রথম কোথায় দেখেছিস? তোর দিকে প্রথম কিভাবে তাকিয়েছিল?
আরিয়ান: নিশ্চয় তোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিল তাই না?
আমি: থামবি তোরা? এতো প্রশ্ন একসাথে করলে আমি উত্তর দিবো কিভাবে?
সিফাত: বলনা ভাবি দেখতে কেমন?
আমি: মায়াবতী।
শান্ত: আমাদের দেখাবি না?
আমি: হুম দেখাবো।
শান্ত: মেয়ে কি আমাদের গ্রামের?
আমি: তাতো জানিনা তবে তারিনের বান্ধবী হবে।
শান্ত: তারিনকে হেল্প করতে বলবো?
আমি: এখন না আগে আমি হিমির সাথে কথা বলতে চাই।
আরিয়ান: নাম হিমি?
আমি: হ্যাঁ, ক্যামেরায় ছবি আছে তো।
সিফাত: এর মধ্যে ছবিও তুলে ফেলেছিস? (মৃদু হেসে ওদের দিকে ক্যামেরা এগিয়ে দিয়ে চারপাশে আবারো চোখ বুলিয়ে নিলাম, নাহ আশেপাশে কোথাও নেই মায়াবতী)
আরিয়ান: ওয়াও চুল গুলো কি সুন্দর।
আমি: এই শালা একদম নজর দিবি না।
সিফাত: কিন্তু আরশান মেয়ে তো কালো।
আরিয়ান: হ্যাঁ কালো তো।
শান্ত: ওকে আমি ছিনি তারিনের বান্ধবী। আরশান ও কিন্তু খুব সাধারণ একটা পরিবারের মেয়ে, তোর পরিবার মানবে তো? বিশেষ করে তোর আব্বু মানবে তো? তোর আব্বুকে যতটুকু ছিনি আমরা মনে হয় না কোনো কালো সাধারণ মেয়েকে তোর বউ হিসেবে মেনে নিবে।
আমি: (নিশ্চুপ)
সিফাত: আরশান বুঝেশুনে পা বাড়াস, আমরা চাই না তুই কোনো কারণে কষ্ট পেয়ে কান্না কর।
আমি: যা হবার হবে আমি হিমিকেই চাই, হিমি ছাড়া আরশান আর কিচ্ছু বুঝে না বুঝতে চায়ও না।
শান্ত: ঠিক আছে তুই হিমির সাথে কথা বল আমরা সবসময় তোর পাশে আছি।
আমি: হুম।

হিমির সাথে কিভাবে কথা বলবো ও তো আমাকে দেখলেই ভয় পায়। হিমি কি আদৌ আমার প্রপোজে রাজি হবে? আচ্ছা হিমি যদি আমাকে ফিরিয়ে দেয়? ভাবতে পারছি না কিছু সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
সিফাত: কিরে রেডি হবি না?
আমি: (নিশ্চুপ)
সিফাত: মন খারাপ করে বসে আছিস কেন? হিমির সাথে আর দেখা হয়নি?
আমি: না সকালের পর আর ওকে দেখিনি।
সিফাত: চলে যায়নি তো?
আমি: কোথায় যাবে?
সিফাত: হতে পারে তুই ওকে ফলো করছিস বুঝতে পেরে বিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছে।
আমি: কি বলছিস এসব?
সিফাত: বাইরে গিয়ে দেখ সব মেয়েরা পরীর মতো সেজে কতো আনন্দ করছে, কই তোর হিমিকে তো কোথাও দেখতে পেলাম না। (সত্যিই তো হিমি যদি চলে গিয়ে থাকে তাহলে আমি ওকে কোথায় খুঁজবো?)
সিফাত: আরশান শুন।
সিফাতের ডাকে সাড়া না দিয়ে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।

সবখানে হিমিকে খুঁজলাম কিন্তু কোথাও পেলাম না, কোথায় যেতে পারে মেয়েটা? আচ্ছা যেখানে কনে সাজানো হচ্ছে সেখানে নয়তো হিমি? কিন্তু কোন রুমে কনে সাজানো হচ্ছে সেটাই তো জানিনা। এক এক করে সব রুম খুঁজতে শুরু করলাম হঠাৎ একটা রুমে চোখ আটকে গেলো, এইতো আমার মায়াবতী। চুলে বেলী ফুলের মালা দিচ্ছিল, আয়নায় আমাকে দেখে চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকালো। বাহ্ আজ আরো বেশি সুন্দর লাগছে মায়াবতীকে। গোলাপি পাড়ের কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি, কপালে গোলাপি রঙের ছোট একটি টিপ, হরিণী চোখ দুটুতে গাড়ো করে কাজল টানা, ঠোঁটে গোলাপি রঙের লিপস্টিক, নাকে নোলক, কানে ঝুমকো, হাতে গোলাপি রঙের কাঁচের চুড়ি আর চুলগুলো পিটময় ছড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে ফেললাম, কোনো মানবী এতো সুন্দর হয়? সত্যি ও কোনো মানবী তো? নাকি…
“আপনি এখানেও” হিমির প্রশ্নে চোখ খুলে তাকালাম, হরিণী চোখ দুটুতে ভয় ফুটে উঠেছে। বেলী ফুলের মালাটা হিমির হাত থেকে ফ্লোরে পড়ে গেছে দেখে মালাটা তুলে নিয়ে বিছানায় এসে বসলাম।
আমি: কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে? আমি তোমাকে কতো খুঁজেছি জানো? খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছি। (হিমি কিছু না বলে দৌড়ে চলে যেতে চাইলো তাড়াতাড়ি উঠে এসে ওর সামনে দাঁড়ালাম)
আমি: যেওনা তোমার সাথে আমার কথা আছে।
হিমি: কি কথা? (মাথা নিচু করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করলো, আমি কি কথা বলবো খুঁজে পাচ্ছি না ওর মিষ্টি কন্ঠ শুনে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে)
হিমি: কি কথা তাড়াতাড়ি বলুন আমাকে যেতে হবে।
আমি: তোমার নাম কি? (আমার প্রশ্ন শুনে হিমি মাথা তুলে আমার দিকে অবাক চোখে তাকালো তারপর একটুখানি হেসে বললো…)
হিমি: হিমাদ্রিতা হিমি। (কাল রাত থেকে সকাল পর্যন্ত হিমিকে একবারের জন্যও হাসতে দেখিনি, এখন ওর একটুখানি হাসি দেখে আমার সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কারো হাসি এতো সুন্দর হয়? হিমি হাসলে ওর বা গালে টোল পড়ে যা ওর মায়াময় মুখটাকে আরো বেশি মায়াবী করে তুলে)
হিমি: এবার আমি যাই।
আমি: তুমি আমাকে এতো ভয় পাও কেন আমি বাঘ না ভাল্লুক?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: যেতে দিবো এক শর্তে। (হিমি আমার কথা শুনে কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেলো)
হিমি: কি শর্ত?
আমি: যদি তোমার দীঘল কালো চুল গুলোতে এই মালাটা আমাকে পড়িয়ে দিতে দাও। (হিমি মাথা নিচু করে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো)
হিমি: মালাটা দিন আমি পড়ে নিবো।
আমি: তখন তো দেখলাম চেষ্টা করেও পারছিলে না, আমি পড়িয়ে দিলে সমস্যা কোথায়? (হিমি চলে যেতে চাইলো আবারো ওর সামনে এসে দাঁড়ালাম)
আমি: যতক্ষণ না মালা পড়িয়ে দিতে দিচ্ছ ততক্ষণ যেতে দিবো না।
হিমি: এইটা বিয়ে বাড়ি অনেক মানুষ আছে, কেউ যদি আমাদের দুজনকে এই ফাঁকা রুমে দেখে তাহলে…
আমি: কথা দিচ্ছি মালাটা পড়িয়েই চলে যাবো। (হিমি কিছুটা বিব্রত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, আমি ইশারায় ওকে আয়নার সামনে যেতে বললাম)

হিমি আয়নার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমি মালা হাতে ওর পিছনে দাঁড়ানো। মালা কি পড়াবো এতো কাছ থেকে ওর লম্বা চুলগুলো দেখে হা করে তাকিয়ে আছি। হিমি আমার দিকে দুটু ক্লিপ এগিয়ে দিলো, ক্লিপ হাতে নিয়ে ভাবছি কিভাবে মালা দেয় আমিতো জানিনা।
হিমি: পারেন না আবার নিজের জিদও ছাড়ছেন না। (হিমি মিটিমিটি হাসছে আর আমি মুগ্ধ হয়ে আয়নায় ওর হাসি দেখছি। আমার হাত থেকে একটা ক্লিপ নিয়ে মালার এক পাশ কানের পাশে গেঁথে নিলো, মালাটার অপর পাশ টেনে নিয়ে অন্য কানের পাশে ধরলো, বুঝলাম এখানে ক্লিপ দিয়ে আটকে দিতে হবে। ক্লিপ দিয়ে বেলী ফুলের মালাটা মায়াবতীর চুলে আটকে দিলাম, এই বেলী ফুলের মালা যেন ওর চুলের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিলো। আমি আয়নায় হিমিকে দেখছি আর ও মাথা নিচু করে মৃদু হাসছে। হঠাৎ মনে পড়লো হিমিকে কথা দিয়েছিলাম মালাটা পড়িয়েই চলে যাবো, তাই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। দরজার কাছে এসেই আবার পিছন ফিরে তাকালাম, হিমি আমাকে আবার দেখে ভয় পেয়ে গেলো। এক পা দু পা করে হিমির কাছে এসে ওর কানেকানে বললাম “এই দীঘল কালো চুল গুলো এভাবে ছেড়ে রেখো না কারো নজর লেগে যাবে” মুচকি হেসে বেরিয়ে আসলাম, হিমি হয়তো আমার চলে আসার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আর মনেমনে ভাবছে এ কেমন পাগল? হাহাহা।

গোধূলি সন্ধ্যা, বিয়ে মিটে গেছে এবার কনের বিদায়বেলা। সবাই জেরিন আপুকে গাড়িতে তুলে দিয়ে কাঁদছে। শান্ত খুব কাঁদছিল তাই ওকে নিয়ে আমরা পুকুরপাড়ে চলে এসেছি, শান্ত বসে বসে কেঁদেই চলেছে।
সিফাত: শান্ত আর কাঁদিস না প্লিজ!
আরিয়ান: আচ্ছা জেরিন আপুকে কি একেবারে শশুড় বাড়ি দিয়ে দিয়েছিস নাকি? আপু তো আসবেই আবার বিয়েই তো দিয়েছিস।
শান্ত: তোদের বোনের যখন বিয়ে হবে তখন বুঝবি কতোটা কষ্ট হয়, বুকটা কেমন শূন্য শূন্য লাগে।
আমি: তুই কি বলতে চাইছিস জেরিন আপু আমাদের বোন না?
শান্ত: আমি কি সেটা বলেছি? আমার কষ্ট হচ্ছে খুব।
আরিয়ান: আচ্ছা তারিন তো তোর কাছেই আছে তাহলে এতো কাঁদছিস কেন?
সিফাত: আরশান এই আরশান দেখ তোর হিমি। (সিফাতের আঙ্গুল অনুসরণ করে পুকুড়ের অন্য পাড়ে তাকালাম, হিমি একটা ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে)
আমি: আসছি আমি।
আরিয়ান: দাঁড়া আরশান, এতো রেগে যাচ্ছিস কেন? হয়তো ছেলেটা ওর কোনো আত্মীয় হবে।
সিফাত: আরশান এখানে ঝামেলা করার প্রয়োজন নেই।
শান্ত: আরে অজতা রাগ করছিস এই ছেলে তো হিমির চাচাতো ভাই। ঐ বাড়িটা হিমিদের। (শান্তর কথা শুনে দুহাতে মাথা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললাম, ধ্যাত অজতাই হিমিকে ভুল বুঝে রেগে গিয়েছিলাম)
সিফাত: ভাই তুই ফেঁসে গেছিস, এইটুকুতেই এতো রেগে গেলি? তুই তো মেয়ের প্রেমে পাগল হয়ে গেছিস।
ওরা হাসছে আমি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছি, সত্যিই আমি হিমির প্রেমে পাগল হয়ে গেছি। হিমিকে অন্যকারো সাথে দেখলে খুব রাগ হয় বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হয়, জানিনা কেন এমন হয়।

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে সবাই রুমে আসলাম। শান্তরা গীটার নিয়ে বসেছে, আমি জানালার কাছে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ভাবছি হিমির সাথে কথা বলার আগে আম্মুর সাথে একবার কথা বলা প্রয়োজন, আম্মুকে হিমির ছবি পাঠানো প্রয়োজন। আমার সবকিছু বলতে তো আম্মু আর আপু, এখন নাহয় ওরা দুজন হিমিকে পছন্দ করলে আমার সবকিছুর তালিকায় হিমিকে যুক্ত করবো। ফোনটা পকেট থেকে বের করে হিমির ছবি গুলো আপুর হোয়াটস এ্যাপে পাঠিয়ে দিলাম তারপর আপুকে কল দিলাম।
আপু: হ্যাঁ ভাই বল কেমন আছিস?
আমি: পরে বলবো, হোয়াটসএ্যাপে কিছু ছবি পাঠিয়েছি আম্মুকে দেখা তো।
আপু: কার ছবি।
আমি: আগে দেখ।
আপু: ঠিক আছে।

রুম থেকে বেরিয়ে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে আম্মুর ফোনের জন্য অপেক্ষা করছি, হঠাৎ অপক্ষার অবসান ঘটিয়ে আম্মু ফোন দিলো।
আমি: আম্মু দেখেছ?
আম্মু: এটাই হিমি?
আমি: হ্যাঁ।
আম্মু: মাশাআল্লাহ্‌ খুব সুন্দর।
আমি: আম্মু তোমার পছন্দ হয়েছে?
আম্মু: হ্যাঁ হবে না কেন? আর আমার ছেলের পছন্দ কি খারাপ হতে পারে?
আমি: আপুর পছন্দ হয়েছে?
আম্মু: হ্যাঁ হয়েছে।
আমি: কিন্তু কিভাবে সম্ভব? আম্মু আমিতো ভয় পাচ্ছিলাম কারণ হিমি কালো।
আম্মু: গাধা ছেলে এইটাকে কালো বলে না শ্যামলা বলে, আর শ্যামলা মেয়েরা খুব লক্ষী হয় মায়াবতী হয়। আমিতো চাই আমার বৌমা লক্ষী হবে।
আমি: আম্মু তুমি পছন্দ করে ফেলেছ আমি আর কাউকে পরোয়া করিনা।
আম্মু: আমাদের চোখে হিমি শ্যামলা হলেও এই শহরের চাকচিক্যতার ভীড়ে হিমিকে সবাই কালোই বলবে আর তোর আব্বু…
আমি: আম্মু প্লিজ ওই লোকটার সিদ্ধান্ত আমি জানতে চাই না। আমি হিমিকে ভালোবাসি আর তুমি হিমিকে পছন্দ করেছ এর চেয়ে বেশি কিছু জানার বা বুঝার প্রয়োজন আমার নেই।
আম্মু: রাগ করছিস কেন, এমন হুটহাট রেগে গেলে হিমি তো তোকে ভয় পাবেই। (আম্মু কষ্ট লুকিয়ে দিব্বি হাসছেন দেখে একটুও অবাক হলাম না কারণ আমি ছোট থেকেই আম্মুকে এভাবে কষ্ট লুকিয়ে হাসতে দেখছি)
আপু: আম্মু আমার কাছে দাও, ভাই?
আমি: হুম আপু বল।
আপু: প্রপোজ করবি না?
আমি: আগে হিমির মনের কথা বুঝার চেষ্টা করি তারপর।
আপু: কিন্তু তুই তো আগামীকাল চলে আসবি।
আমি: হ্যাঁ তাই তো ভুলেই গিয়েছিলাম।
“হিমি সাবধানে যাস” হঠাৎ তারিনের কন্ঠ শুনে সামনে তাকালাম, তারিন হিমিকে এগিয়ে দিয়ে ঘরে চলে গেল। মাঝখানে একটা পুকুর, আর এতোটা জায়গা হিমি একা যাবে এই রাতের বেলা?
আমি: আপু পরে ফোন করছি।
আপু: ভাই কি হয়েছে?
ফোন কেটে দিয়ে হিমির পিছু পিছু পুকুরপাড়ে আসলাম।

আমি: হিমি? (আমার ডাক শুনে হিমি ভয়ে আতকে উঠে পিছন ফিরে তাকালো, মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেওয়া। চাঁদের আলোতে হিমির ভয়ার্ত মুখ দেখে খুব হাসি পেলো, আচ্ছা ও আমাকে এতো ভয় পায় কেন?
হিমি: কেন আমার পিছনে পড়ে আছেন?
আমি: বুঝনা?
হিমি: বুঝতে চাই না, প্লিজ যান এখান থেকে।
আমি: চলো তোমাকে বাড়িতে দিয়ে আসি।
হিমি: আমার বাড়ি কাছেই আর আমি একা যেতে পারি অভ্যাস আছে, আপনি প্লিজ যান এখান থেকে।
আমি: কেন ভয় পাচ্ছ? আচ্ছা তুমি আমাকে এতো ভয় পাও কেন?
হিমি: আপনি খুব খারাপ মানুষ তাই।
আমি: কি করলাম আমি?
হিমি: এতো কথা বলার সময় নেই আপনি রুমে যান, এই রাতের বেলা কেউ আমাদের দেখলে সমস্যা হবে। (হিমি চলে যেতে চাইলো তাড়াতাড়ি ওর হাত ধরে ফেললাম)
আমি: হিমি আমি তোমাকে প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছি আমি খারাপ নই, তুমি শুধু শুধু আমাকে ভুল বুঝছ।
হিমি: আমার হাত ছাড়ুন প্লিজ!
আমি: আগামীকাল আমি চলে যাচ্ছি হিমি, আমি তোমার সিদ্ধান্ত জানতে চাই। আগামীকাল আমি সবার সামনে তোমাকে প্রপোজ করবো। আজ সারারাত তোমায় সময় দিলাম ভাবো ভেবে সিদ্ধান্ত নাও। তুমি রাজি হলে ভালো আর রাজি না হলে আমি আমার নিজের ক্ষতি করবো যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। (হিমি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, মৃদু হেসে ওর হাত ছেড়ে দিলাম)
আমি: এবার তুমি যেতে পারো, তবে আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো তুমি বাড়ি না পৌঁছানো পর্যন্ত।
হিমি বারবার পিছন ফিরে আমার দিকে তাকাচ্ছে আর এক পা দু পা করে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দুজন মানুষের কথা শুনতে পেলাম, হিমি ভয় পেয়ে আমার দিকে তাকালো। এইটা গ্রাম এখানে দুটু ছেলেমেয়েকে রাতেরবেলা একসাথে দেখা মানে অনেক কিছু ঘটে যাবে, কি করবো এখন? আমার জন্য হিমির গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগবে? হিমির দিকে তাকালাম ভয়ে কাঁদতেছে হাটতে পারতেছে না। হিমির হাত ধরে টান দিয়ে ওকে বড় একটি গাছের আড়ালে নিয়ে আসলাম। হিমি ভয় পেয়ে দুহাতে আমার টিশার্ট খামছে ধরে আমার বুকে মুখ গুঁজে দিলো, আমিও ওকে জড়িয়ে ধরলাম। বুঝিনা পাগলীটা অল্পতেই এতো ভয় পায় কেন।

কিছুক্ষণ পর হিমি আমাকে ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ালো।
হিমি: সরি আসলে তখন বড় ভাইয়া এদিকে আসছিল তাই খুব ভয় পেয়ে… (হিমির কোমড় জড়িয়ে ধরে ওকে আমার কাছে নিয়ে আসলাম, ওর তুথুনি ধরে মুখটা উপরে তুললাম। হিমি ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: আমিতো খারাপ ছেলে তাহলে আমার উপর এতোটা ভরসা করো কিভাবে? ভালোবাসা না থাকলে ভরসা করা যায় বুঝি?
হিমি দুচোখ বুজে মাথা নিচু করে ফেললো, ওর ওড়না টেনে মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিলাম। হিমি আমার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এক চিলতে চাঁদের আলো এসে হিমির মায়াবী মুখে পড়ে ওর মুখটা আরো বেশি মায়াবী করে তুলেছে আর আমি মুগ্ধ নয়নে ওর মায়াবী মুখ দেখছি…

হিমি হঠাৎ আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করে হাটা শুরু করলো, আমি পিছু ডাকলাম।
আমি: হিমি? (থমকে দাঁড়ালো তারপর পিছন ফিরে আমার দিকে তাকালো)
আমি: কিছু বললে না যে?
হিমি: হুট করে গ্রামে এসেছেন তো তাই সবকিছুই সুন্দর লাগছে, আবার যখন ইট পাথরের শহরে ফিরে যাবেন তখন এই গ্রামের কথা এই গ্রামের মানুষের কথা নিমিষেই ভুলে যাবেন।
আমি: তুমি আমায় ভুল বুঝছ আমি তোমাকে ভালোবাসি।
হিমি: এভাবে হুট করে ভালোবাসা হয় না যা হয় সেটা হলো ভালোলাগা। শহরের আধুনিক মেয়েদের ভীর থেকে এসে হঠাৎ করে গ্রামের সহজ সরল মেয়ে দেখেছেন তো তাই ভালো লেগেছে, আবার যখন শহরে ফিরে যাবেন তখন আধুনিকতার ভীরে এই গ্রামের মেয়েটাকে ভুলে যাবেন।
আমি: ভালোবাসা বলে আসেনা হিমি ভালোবাসা হুট করেই মনের অজান্তে হয়ে যায়। আর শহরের আধুনিক মেয়েদের কথা বলছ? আমার মন ছুঁতে পারলে তুমিই পেরেছ আধুনিক মেয়েরা পারেনি।
হিমি: ফিরে যান নিজের শহরে সব আস্তে আস্তে ভুলে যাবেন।
আমি: কি ভুলবো? কাকে ভুলবো? নিজেকে কখনো ভুলা যায়? আমিতো তোমার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি ভুলবো কিভাবে তোমায়?
হিমি: আমার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন? হাসালেন। আজ যদি আমাদের দুজনকে একসাথে গ্রামের মানুষ দেখে কাল সকালে বদনাম আমার হবে, আর আপনি? আপনি তো পালাবেন ঐ শহরে। এসব ক্ষণিকের ভালোলাগা ভালোবাসা নয়।
আমি: হিমি…
হিমি: যতো তাড়াতাড়ি পারেন এই গ্রাম ছেড়ে চলে যান, আমি চাইনা এই বিষয়টা লোকেরা মুখে মুখে বলুক।
আমি: যদি তোমাকে আমি কালই বিয়ে করতে চাই?
হিমি: আমার পড়াশুনা নিয়ে অনেক স্বপ্ন আছে, আমাকে নিয়ে আমার মা এবং ভাইদের অনেক স্বপ্ন। এসব ভালোবাসা আমার জন্য নয়।
আমি: যদি তোমার পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব দেই?
হিমি: হাত জোড় করছি প্লিজ এমনটা করবেন না, এমন করলে আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। (হিমি আমার সামনে দুহাত জড়ো করে কেঁদে দিলো, একহাতে ওর দুহাত ধরলাম অন্যহাতে ওর চোখের পানি মুছে দিলাম)
আমি: তোমার পরিবার জানবে না কিন্তু আমি তোমাকেও ভুলবো না, তোমার স্বপ্ন গুলো পূরণ হতে যতো দিন সময় লাগবে আমি ততোদিন তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। হিমি আমি তোমার জন্য সব করতে রাজি শুধু আমার থেকে দূরে থেকো না। আমরা রিলেশন চালিয়ে যাই কেমন? তোমার স্বপ্ন পূরণ করো তারপর নাহয় আমরা বিয়ে করবো, তাছাড়া আমারো তো পড়াশুনা শেষ হয়নি।
হিমি: আপনি একটা পাগল আপনাকে বুঝানোর সাধ্য আমার নেই।
আমি: পাগল ছিলাম নাতো তোমাকে দেখার পর থেকে তোমার প্রেমে পাগল হয়ে গেছি।
হিমি: ধ্যাত আমার হাত ছাড়ুন, আপনি থাকুন আপনার পাগলামি নিয়ে। (হিমি ঝটকা দিয়ে আমার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে হনহন করে হাটা শুরু করলো, হিমিকে শুনিয়ে জোড়ে বললাম…)
আমি: হিমি আমি তোমাকে আগামীকাল প্রপোজ করবো সবার সামনে, আজ সারারাত ভেবে তুমি সিদ্ধান্ত নিও। আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি হিমি।
হিমি: পাগল।
হিমি পিছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেই দৌড়ে চলে গেল, ওর মুখে পাগল ডাক শুনে মুচকি হেসে রুমের দিকে পা বাড়ালাম।

শান্ত: কিরে কোথায় ছিলি এতক্ষণ? (রুমে আসতেই শান্ত প্রশ্ন করলো, উত্তর না দিয়ে চেয়ার টেনে ওদের সামনে বসলাম। শান্ত আর আরিয়ান গান গাইছে, ওদিকে সিফাত চ্যাটিং এ ব্যস্ত)
আরিয়ান: আচ্ছা আমরা সকালে চলে যাচ্ছি তো?
সিফাত: হ্যাঁ সকাল নয়টার দিকে বেরিয়ে পড়বো।
আমি: আমি কাল যাচ্ছি না।
আরিয়ান: মানে?
শান্ত: তোদের তো কালই যাওয়ার কথা আর আমি দুদিন পর যাবো।
আমি: কাল আমি হিমিকে প্রপোজ করবো।
সিফাত: কি? (সিফাত ফোনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়েই ফিক করে হেসে দিলো)
আমি: মেয়েদের মতো গড়াগড়ি খেয়ে হাসছিস কেন?
সিফাত: শান্ত তুই জানতে চাইছিলি না আরশান এতক্ষণ কোথায় ছিল? আমি জানি ও কোথায় ছিল।
শান্ত: কোথায় ছিল আর কিভাবে জানিস আমরা তিনজন তো একসাথেই এই রুমে আছি।
সিফাত: ভালো করে ওর দিকে তাকিয়ে দেখ। (সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিজের শরীর দেখছি, বুঝতে পারছি না ওরা কি দেখে হাসছে। টিশার্ট এর দিকে নজর পড়তেই জিহ্বায় কামড় দিলাম, বুকের কাছে লিপস্টিক এর দাগ। এই দাগ লাগলো কিভাবে? হঠাৎ মনে পড়লো হিমি ভয় পেয়ে আমার বুকে মুখ গুঁজেছিল তখন হয়তো লেগেছে)
সিফাত: এবার বল কোথায় ছিলি তুই?
আরিয়ান: বাব্বাহ্ জল এতো দূর গড়িয়েছে আর আমরা কিছু জানিই না?
আমি: তোরা যা ভাবছিস তা নয়।
শান্ত: তাহলে কি? আরশান তোর টিশার্ট এ লিপস্টিক এর দাগ আসলো কিভাবে? আরশান ভুলে যাসনা এইটা গ্রাম, এখানে…
আমি: শান্ত তুই অজতা ভয় পাচ্ছিস তেমন কিছু না। আমি হিমির সাথে কথা বলছিলাম তখন দুজন লোকের কথা শুনতে পাই আর হিমি ভয় পেয়ে…
শান্ত: হিমি কিছু বলেছে?
আমি: হুম।
আরিয়ান: কি বলেছে? রাজি হয়েছে?
আমি: না, হিমি না করে দিয়েছে।
সিফাত: কি বলছিস?
আমি: তবুও আমি কাল ওকে প্রপোজ করব।
আরিয়ান: একবার যেহেতু না করে দিয়েছে আমার মনে হয় না কাল রাজি হবে।
আমি: দেখা যাক আজ কি সিদ্ধান্ত নেয়, এখন শুধু সকালের অপেক্ষা।

মেঘাচ্ছন্ন সকাল, পুকুরপাড়ে বসে আনমনা হয়ে পুকুরে ঢিল ছুড়ছি আর বারবার হিমিদের বাড়ির দিকে তাকাচ্ছি। হিমি কি সিদ্ধান্ত নিবে এইটা ভেবে সারারাত ঘুমাতে পারিনি ছটফট করেছি শুধু। কি যে হবে আজ…
শান্ত: কিরে এতো সকালে উঠে পড়লি আজ? (শান্তর কন্ঠ শুনে পাশ ফিরে তাকালাম, আমার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে শান্ত আমার পাশে বসলো)
শান্ত: টেনশন হচ্ছে? (চায়ের কাপে চুমুক দিতে যাচ্ছিলাম শান্তর কথা শুনে ওর দিকে তাকালাম)
শান্ত: তোর বোধহয় ঘুম হয়নি চোখ দুটু বিষণ লাল হয়ে আছে। (মৃদু হাসলাম)
আমি: কি করে ঘুম হবে? মায়াবতী যে আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
শান্ত: একটা কথা বলবো?
আমি: বল।
শান্ত: প্রপোজ করার জন্য যখন আজ থাকবি তাহলে প্লিজ আপুর বৌভাতে চল।
আমি: আমার এসব ভালো লাগছে না একা থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে।
শান্ত: যদি হিমি যায় তবুও যাবি না? (শান্তর দিকে অবাক চোখে তাকালাম)
শান্ত: তারিনের বেষ্ট ফ্রেন্ড হিমি, তারিন হিমিকে রেখে কখনো আপুর বাসায় যাবে না আমি নিশ্চিত।
আমি: আমি যাবো না কখন বললাম?
শান্ত: তুই সত্যি হিমির প্রেমে পাগল হয়ে গেছিস।
শান্ত হাসতে হাসতে চলে গেল। হিমিদের বাড়ির দিকে তাকালাম এই মেয়েটা কি একবারের জন্য বের হতে পারে না? ও কি বুঝেনা ওকে দেখার জন্য আমি সবসময় ছটফট করি? কবে যে মায়াবতী আমার ভালোবাসা বুঝবে।

তারিন: আরশান ভাইয়া আরশান ভাইয়া… (হিমির কাজলের কৌটোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম হঠাৎ তারিনের চেঁচামেচি শুনে কৌটো লুকিয়ে রুম থেকে বের হলাম)
আমি: তারিন কি হয়েছে?
শান্ত: তারিন আস্তে চেঁচামেচি কর, রুমে চল আমি তোকে সব বুঝিয়ে বলছি। (শান্ত তারিনের হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে আসলো পিছন পিছন আরিয়ান সিফাতও আসলো, তারিন এভাবে রেগে আছে কেন তবে কি হিমি তারিনকে সব বলে দিয়েছে?)
তারিন: ভাইয়া আমার হাত ছাড়ো।
শান্ত: ঠান্ডা মাথায় আমার কথা শুন।
তারিন: কি শুনবো হ্যাঁ? শহর থেকে দুদিনের জন্য গ্রামে এসে গ্রামের মেয়েদের মন নিয়ে খেলা করা…
শান্ত: তারিন চুপ কর।
তারিন: আরশান ভাইয়া তুমি হিমিকে কি বলেছ?
আরিয়ান: তারিন তুমি আরশানকে ভুল বুঝছ, আরশান তো হিমিকে ভালোবাসে।
তারিন: বড় লোকের ছেলেরা কখনো গ্রামের সাধারণ মেয়েদের ভালোবাসে না, সব আবেগ। শুনো আরশান ভাইয়া তোমার জন্য হিমি আজ কেঁদেছে সারা সকাল আমাদের বাড়িতে আসেনি, হিমি যদি তোমার কারণে আপুর বাসায় না যায় তাহলে কিন্তু…
শান্ত: তারিন চুপ কর বলছি। (শান্তর ধমক শুনে তারিন চুপ হয়ে গেল)
শান্ত: তুই সবটা না জেনে কেন আরশানকে ভুল বুঝছিস? আরশান তো হিমির কোনো ক্ষতি করেনি ভালোবেসেছে আর তো কিছু নয়, আর ভালোবাসা তো অন্যায় নয়।
তারিন: সত্যি ভালোবাসে? নাকি…
সিফাত: তারিন তুমি তো আমাদের প্রায় চার বছর ধরে ছিনো, এতোদিনে আরশানকে ছিনতে পারোনি? আরশান হিমিকে সত্যি ভালোবাসে।
শান্ত: হ্যাঁ তারিন আরশান হিমিকে সত্যি ভালোবাসে। হিমি তোর বেষ্ট ফ্রেন্ড আর আরশান খুব ভালো ছেলে হিমিকে ও অনেক সুখে রাখবে, তুই কি চাস না তোর বেষ্ট ফ্রেন্ড সুখে থাকুক?
আমি: তারিন আমি হিমিকে সত্যি অনেক ভালোবাসি। আর আমি হিমির আচরণে যতোটুকু বুঝেছি হিমিও আমাকে পছন্দ করে।
তারিন: কিন্তু ভাইয়া তোমাদের এই সম্পর্ক কেউ মেনে নিবে না, হিমির ভাইয়া কখনো মেনে নিবে না।
শান্ত: কোনো বড় ভাই’ই বোনের প্রেম মেনে নেয় না, কিন্তু যখন দুজনের ভালোবাসাটা সত্যি হয় তখন সবাই মানতে বাধ্য হয়। আগে তো ওদের দুজনকে এক হতে হবে তারপর নাহয় পরিবার নিয়ে ভাবা যাবে।
তারিন: কিন্তু…
আমি: তারিন প্লিজ তোমার সাহায্য ছাড়া কিছু সম্ভব না, আমাদের তুমি সাহায্য কর প্লিজ!
তারিন: হিমি রাজি হবে বলে আমার মনে হয় না।
শান্ত: তুই রাজি করাবি।
সিফাত: একবার ওদের দুজনকে এক করে দাও বাকিটা আমরা বুঝে নিবো। (তারিন আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে)
আরিয়ান: কি ভাবছ আরশান হিমিকে সত্যি ভালো রাখবে কিনা? আরশানকে আমরা ছিনি তুমি ওর উপর ভরসা করতে পারো।
তারিন: হিমি ভালো থাকবে এজন্য শুধু আমি রাজি হচ্ছি, তোমার জন্য যদি কখনো হিমির চোখে পানি আসে তাহলে…
আমি: একবার ভরসা করে দেখোই না।
তারিন: ঠিক আছে কি করতে হবে আমাকে?
আমি: হিমির সাথে আমার দেখা করিয়ে দিতে হবে।
তারিন: কিন্তু হিমি তো আমাদের বাড়িতে আসতে চাচ্ছে না।
আমি: আজ ওকে প্রপোজ করবো বলেছিলাম তাই হয়তো ভয় পেয়ে আসেনি।
তারিন: আপুর বাসায় যাওয়ার জন্য ওকে কতো করে বললাম কিন্তু ও কিছুতেই যেতে রাজি হচ্ছে না উল্টো বলছে আরশান ভাইয়া শহরে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত ও আমাদের বাড়িতে আসবে না।
আমি: হিমি যে কেন এতো ভয় পায়।
তারিন: হিমি ওর ভাইদের ভয় পায় আর এই ভয়ে ও হয়তো রিলেশনে জড়াতে রাজি হবে না।
আমি: তুমি শুধু একবার ওকে নিয়ে এসো বাকিটা আমি বুঝে নিবো।
তারিন: ঠিক আছে। (তারিন চলে গেল, ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। বারবার শুধু একটা কথাই আমার মাথায় ঘুরছে হিমি এখনি এতো জিদ ধরে বসে আছে প্রপোজ করার পর যদি ডাইরেক্ট না করে দেয়? কিছু ভাবতে পারছি না বড্ড ভয় হচ্ছে)
শান্ত: আরশান এতো টেনশন কেন করছিস?
আমি: বিশ্বাস কর তোরা আমি হিমিকে সত্যি অনেক ভালোবেসে ফেলেছি।
শান্ত: সেতো বুঝাই যাচ্ছে।
আমি: আচ্ছা আপুর শশুড় বাড়ি কোথায়?
শান্ত: আমাদের এখানকার শহরে, কেন?
আমি: ওখানে হোটেলে রুম বুক করা যাবে?
শান্ত: হ্যাঁ কিন্তু কেন?
আমি: আমি আপুর বাসায় গেলে হিমি যেতে চাইবে না তাই আমি যাবো না, আমি চাই না আমার জন্য হিমির আনন্দ নষ্ট হউক। আমি হোটেলে রুম বুক করে তোকে ফোনে জানিয়ে দিব তুই শুধু বৌভাত এর অনুষ্ঠান শেষে হিমি আর তারিনকে নিয়ে হোটেলে চলে আসবি।
আরিয়ান: তুই কি করতে চাইছিস বলতো।
আমি: আমার হিমিকে আমি প্রপোজ করবো সাদামাটা ভাবে করবো নাকি?
সিফাত: তো?
আমি: সারপ্রাইজ।
শান্ত: তোর মাথায় যে কি ঘুরছে, তুই সত্যি হিমির প্রেমে ফেঁসে গেছিস।
আমি: তুই শুধু ওদের নিয়ে আসিস।
শান্ত: ঠিক আছে।
হিমিকে আজ এমন সারপ্রাইজ দিব যে হিমি আমার প্রপোজ ফিরিয়েই দিতে পারবে না।

হোটেল রুমে বসে আছি আর ডায়মন্ড এর রিং এর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছি, এই রিংটা আমার হিমির আঙ্গুলে খুব সুন্দর মানাবে।
আরিয়ান: আমিতো ভাবতেই পারিনি আরশান এর মাথায় এতো সুন্দর একটা প্ল্যান ঘুরছিল।
সিফাত: ওর দ্বারা সব সম্ভব। (আরিয়ান আর সিফাত কথা বলতে বলতে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে)
আরিয়ান: কিরে তোর মনের মতো করে রুমটা সাজানো হয়েছে তো? (আরিয়ানের কথায় রুমের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম, কাঁচা ফুল দিয়ে পুরো রুমটা সাজানো হয়েছে চারদিকে ফুলের গন্ধ ছড়াছড়ি করছে, আমি মৃদু হেসে বললাম…)
আমি: একদম।
সিফাত: আচ্ছা তুই এতো টাকা পেলি কোথায় টাকা কি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলি?
আমি: না, আপুকে ফোন করে বলেছিলাম আমার একাউন্টে টাকা দিতে।
আরিয়ান: এতো জাঁকজমক ভাবে প্রপোজ? দোস্ত বিয়ের সময় কি করবি?
আমি: সব, আমার হিমি যেভাবে চাইবে সেভাবে বিয়ে হবে।
আরিয়ান: কিন্তু ওরা এখনো আসছে না কেন সন্ধ্যা কেটে রাত নেমে আসছে তো।
সিফাত: আকাশের অবস্থাও ভালো না ঝড় বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে, এখান থেকে শান্তদের গ্রাম কিন্তু মোটামুটি কিছুটা দূরেই।
আমি: ভয় নেই শান্ত গাড়ি নিয়ে আসবে আর আমরা সবাই সে গাড়িতে করেই ফিরে যাবো।
আরিয়ান: এতো কিছু করছিস এবার হিমি রাজি হলেই হলো।
আমি: হুম।

আনমনা হয়ে বসে আছি আর হিমিদের আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে যখন হিমি আসবে তখনি ওকে প্রপোজ করে আমার করে নিবো।
“আরশান” হঠাৎ শান্তর ডাক শুনে চমকে উঠলাম, শান্ত আর তারিন ভিতরে ঢুকলো। হিমি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে আর রুমের ভিতরে অবাক হয়ে চোখ বুলাচ্ছে। আমি উঠে হিমির কাছে আসলাম, আমাকে দেখে ও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। হিমির ভয় কাটানোর জন্য মৃদু হেসে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম।
আমি: এসো।
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: ভয় পাচ্ছ কেন এখানে তো তারিন আছে, এসো। (হিমি আমার হাত না ধরে রুমের ভিতর পা রাখলো আর ঠিক তখনি উপর থেকে গোলাপের পাপড়ি হিমির উপরে ছড়িয়ে পড়লো, হিমি অবাক চোখে পাপড়ি পড়ার দিকে তাকিয়ে আছে)
তারিন: ওয়াও কি সুন্দর করে সবকিছু সাজিয়েছ, আরশান ভাইয়া তুমি হিমিকে এতোটা ভালোবাস? (তারিনের প্রশ্ন শুনে হিমি আমার দিকে তাকালো তারপর তারিনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো)
হিমি: তারিন তুই আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছিস?
তারিন: আরে আরশান ভাইয়া তোকে প্রপোজ করবে তাই আমরা এখানে এসেছি, প্রপোজ করা হয়ে গেলেই আমরা ফিরে যাবো।
হিমি: তারিন তুইও?
তারিন: আরশান ভাইয়া তোকে সত্যি ভালোবাসেরে।
হিমি: কিন্তু…
শান্ত: আরশান একটু তাড়াতাড়ি কর প্লিজ বৃষ্টি নামলে গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে যেতে তোদেরই কষ্ট হবে।
হিমি: তারিন ফিরে চল আমি এখানে আর এক মুহূর্তও থাকবো না।
আমি: হিমি? (আমার ডাক শুনে হিমি পিছন ফিরে আমার দিকে তাকালো, পকেট থেকে রিংটা বের করে হিমির সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়লাম। হিমি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
“হিমি ভালোবাসা কাকে বলে আমি বুঝতাম না কখনো বুঝার চেষ্টাও করিনি, তোমাকে দেখার পর বুঝেছি।
ভালোবাসা কেমন হয় কতোটা গভীর হতে পারে জানতাম না, তোমাকে দেখার পর সেটা অনুভব করেছি।
শুনেছি কারো প্রেমে পড়ার জন্য নাকি কোনো কারণ লাগে না, বিশ্বাস করতাম না হাস্যকর মনে হতো। কিন্তু তোমাকে দেখার পর বুঝেছি প্রেমে পড়ার জন্য এক পলকের দেখাই যথেষ্ট।
হিমি আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি প্রথম দেখাতেই, আই লাভ ইউ মায়াবতী”
হিমি আমার হাতে থাকা রিং এর দিকে তাকিয়ে আছে, এখন শুধু হিমির হাত বাড়িয়ে দেওয়ার অপেক্ষা তারপর আমি ওর আঙ্গুলে রিংটা পড়িয়ে দিবো।
তারিন: কিরে হিমি হাতটা বাড়িয়ে দে আরশান ভাইয়া সেই কখন থেকে তোর সামনে হাটু গেড়ে বসে আছে।
হিমি: (নিশ্চুপ)
আরিয়ান: হিমি ভয় পেয়ো না বোন আমরা সবসময় তোমাদের সাথে আছি।
হিমি: (নিশ্চুপ)
সিফাত: পরিবারের ভয় পাচ্ছ? ওসব আমরা সামলে নিবো।
শান্ত: হিমি হাতটা বাড়িয়ে দে আরশান অপেক্ষা করছে তো। (হিমি আমার দিকে তাকালো তারপর হাত বাড়িয়ে আমার হাত থেকে রিংটা কেড়ে নিলো, ওর এমন আচরণে সবাই বেশ অবাক হলাম। হিমি রিংটা আমার হাতে দিয়ে হাত মুঠো করে দিলো, রিংটা মুঠোয় নিয়ে ওর দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে আছি)
হিমি: এসব ডায়মন্ড এর রিং আমাদের মতো সাধারণ মেয়েদের হাতে মানায় না। এতো ভালোবাসা এতো চাকচিক্যতা আমাদের মানায় না।
আমি: হিমি আমি তোমাকে ভালোবাসি তুমি যা চাইবে আমি তাই এনে দিব, বলো কি চাও।
হিমি: কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি না।
আমি: কেন? আমি দেখতে খারাপ? নাকি…
হিমি: আমি আপনাকে পছন্দ করি না, ভালোবাসি না আপনাকে। আমাকে আর ডিস্টার্ব করবেন না প্লিজ!
হিমি চেঁচিয়ে কথা গুলো বলে হনহন করে চলে গেল, আমার হাত থেকে রিংটা ফ্লোরে পড়ে গেলো। নিশ্চুপ হয়ে হিমির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি, দুচোখ বেয়ে বৃষ্টির মতো পানি ঝরছে। কি বলে গেলো হিমি এসব? আমার মনের ভিতর উলটপালট হয়ে যাচ্ছে, বারবার শুধু মনে হচ্ছে আমি হেরে গেছি, হেরে গেছে আমার ভালোবাসা…

ফ্লোরে বসে দুহাতে মাথা চেপে ধরে পাগলের মতো কাঁদছি, সবকিছু কেমন যেন মিথ্যে মনে হচ্ছে। অন্ধকার লাগছে চারপাশ, উলটপালট হয়ে যাচ্ছে বুকের ভিতরটা। হিমি এক নিমিষে আমার বাঁচার সব ইচ্ছে গলা টিপে মেরে ফেললো, আমি কিভাবে বাঁচবো এখন?
আরিয়ান: আরশান উঠ প্লিজ এভাবে কান্না করিস না।
সিফাত: আরে এক মেয়ে না বলেছে তো কি হয়েছে বাসায় ফিরে চল তোর পিছনে মেয়েদের লাইন লাগিয়ে দিবো।
আরিয়ান: চল না আরশান।
শান্ত: আরশান চল।
আমি: (নিশ্চুপ)
আরিয়ান: আরে ও ছাড়া দুনিয়ায় মেয়ে নেই নাকি? আমরা তোর জন্য আরেকটা মায়াবতী খুঁজে দিবো, চল এবার।
শান্ত: আরশান তারিন আর হিমি কিন্তু গাড়িতে একা আছে। (শান্তর কথা শুনে ওর দিকে তাকালাম)
শান্ত: হুম হিমি গাড়িতে আছে তারিনও আছে, চল ওরা একা।
আমি: হুম।

গাড়ির গ্লাস দিয়ে হিমির দিকে এক নজর তাকালাম, আমাকে দেখে হিমি মাথা নিচু করে ফেললো। চুপচাপ সামনের সিটে এসে বসলাম। গাড়ি চলছে তার গন্তব্যে, আমি গ্লাস নামিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি আর ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করছি। হঠাৎ হিমিকে দেখতে ইচ্ছে হলো, সাহস করে পিছনে তাকালাম। হিমিও জানালা দিয়ে আনমনা হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।

মাঝরাত, ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ফিরে এসে কারো সাথে কোনো কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে পড়েছিলাম, শুয়া থেকে উঠে বসলাম। হিমি কি বাড়ি চলে গেছে? সকালে তো আমরা চলে যাবো হিমিকে বোধহয় আর একনজর দেখতেও পারবো না। বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। টিনের চালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে আমি আনমনা হয়ে বৃষ্টি দেখছি, ঠান্ডা বাতাস বইছে মাঝেমাঝে বৃষ্টির ছিটা এসে আমার গায়ে পড়ছে, মন খারাপের রাতে এই ঝুম বৃষ্টি বেশ ভালো লাগছে। হঠাৎ বারান্দার অপর প্রান্তে চোখ পড়লো, হিমি দাঁড়িয়ে আছে সেটা রুম থেকে আসা আবছা আলোতে বেশ ভালোভাবে বুঝা যাচ্ছে। আশ্চর্য এতো রাতে হিমি বারান্দায় কি করছে? আর ও বাড়িতে যায়নি কেন? হিমির কাছে যাবো কি যাবো না ভাবতে ভাবতে এসেই পড়লাম, ওর পাশে এসে দাঁড়ালাম। হিমি হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি স্পর্শ করছিল আমাকে দেখে চমকে উঠে চলে যেতে চাইলো।
আমি: হিমি দাঁড়াও। (হিমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো)
আমি: ভোরের আলো ফুটলেই তো চলে যাবো, আর কেউ তোমাকে বিরক্ত করবে না। আজকেই আমাদের শেষ দেখা, আমার পাশে একটু দাঁড়াবে প্লিজ! (হিমি এসে মাথা নিচু করে আমার পাশে দাঁড়ালো)
আমি: বাড়ি ফিরে যাওনি যে?
হিমি: বৃষ্টির জন্য আটকে গেছি। (চমকে উঠে হিমির দিকে তাকালাম, হিমির কন্ঠ এমন ধরে আসছে কেন? হিমি কাঁদছে কেন?)
আমি: কাঁদছ কেন তুমি?
হিমি: নাতো।
আমি: আমি প্রপোজ করাতে কাঁদছ তুমি? আমি আর তোমাকে বিরক্ত করবো না কেঁদো না প্লিজ!
হিমি: সবসময় এতো বেশি বুঝেন কেন? (হিমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো তাড়াতাড়ি ওর হাত ধরে ফেললাম)
হিমি: হাত ছাড়ুন।
আমি: আগে বলো কাঁদছ কেন?
হিমি: আমি কাঁদলে আপনার কি? (হিমির এই কথায় প্রচন্ড রাগ হলো, জানে আমি ওকে ভালোবাসি তারপরও এমন প্রশ্ন করতে পারলো? টান দিয়ে ওকে আমার কাছে নিয়ে আসলাম, এক হাতে ওর হাত ধরে আছি আর অন্যহাতে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরলাম)
আমি: কতোটা ভালোবাসি জানোনা? নাকি বুঝেও না বুঝার ভাণ করছ?
হিমি: হাত ছাড়ুন লাগছে।
আমি: লাগুক। (রাগে ওর হাত আরো জোড়ে ছেপে ধরলাম সাথে সাথে ওর হাতের কয়েকটা কাঁচের চুড়ি ভেঙ্গে গেলো)
হিমি: আহ! ছাড়ুন বলছি।
হিমির হাত ছেড়ে দিলাম ও দৌড়ে রুমে চলে গেলো, আমিও চুপচাপ রুমের দিকে পা বাড়ালাম।

রুমে আসতেই হাতের দিকে নজর পড়লো, আমার হাতে রক্ত আসলো কিভাবে? তবে কি ভাঙ্গা চুড়িতে হিমির হাত কেটে গেছে? দৌড়ে হিমির রুমে আসলাম, হিমি বিছানায় বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে পাশে তারিন ঘুমে। দরজা লাগিয়ে দিলাম, কট করে একটা শব্দ হলো হিমি চমকে উঠে পাশ ফিরে তাকালো।
হিমি: আপনি? আবার এসেছেন? চলে যান প্লিজ কেউ দেখলে আমার গায়ে কলঙ্কের দাগ লেগে যাবে।
আমি: তোমার হাতটা দেখি। (ওর হাত আমার হাতের মুঠোয় আনলাম অনেকটা জায়গা কেটে গেছে রক্ত ঝরছে)
আমি: তোমার হাত তো কেটে গেছে, সরি হিমি আমি ইচ্ছে করে…
হিমি: এতো টুকু কাটাতে কিছু হবে না আপনি যান প্লিজ!
আমি: যাবো না। (হিমি হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তারিনকে ডাক দিলো, তারিন উঠে আমাকে দেখে চমকে উঠলো)
তারিন: আরশান ভাইয়া?
আমি: হিমির হাত কেটে গেছে ওকে এভাবে রেখে আমি অন্য রুমে শুয়ে শান্তি পাবো না, ব্যান্ডেজ করার মতো কিছু থাকলে দাও।
তারিন: দাঁড়াও দিচ্ছি।

হিমির হাতের বাকি চুড়ি গুলো খুলে বিছানায় রাখলাম, ব্যান্ডেজ করছি আর হিমি বারবার চোখমুখ কুঁচকে আমার হাত চেপে ধরছে। দু তিন জায়গায় কেটে গেছে, না বুঝে আমার মায়াবতীকে কতোটা কষ্ট দিয়ে ফেললাম।
হিমি: লাগছে, ছাড়ুন আর ব্যান্ডেজ করতে হবে না।
আমি: আর একটু।
তারিন: আরশান ভাইয়া তুমি কাঁদছ কেন?
আমি: নাতো।
তারিন: হিমি কাঁদছে বলে তুমিও কাঁদছ? তোমাকে যতো দেখছি ততোই অবাক হচ্ছি, কেউ এতোটা ভালো বাসতে পারে?
আমি: চুড়ি গুলো এভাবে ভেঙ্গে যাবে আমি বুঝতে পারিনি আমাকে ক্ষমা করে দিও প্লিজ! (কথা গুলো বলতে বলতে হিমির দিকে তাকালাম, হিমি আমার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে)
আমি: আসছি। (দরজার কাছে আসতেই বুকটা কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগছে পিছন ফিরে তাকালাম, হিমি দাঁড়িয়ে আছে আর আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হিমির দুচোখে পানি ছলছল করছে, দৌড়ে এসে হিমিকে বুকের সাথে ঝাপটে ধরলাম)
আমি: ভালোবাসি মায়াবতী, তোমাকে ছাড়া থাকতে অনেক কষ্ট হবে, ভুলতে পারবো না কখনো তোমাকে।
তারিন: হিমি তুই এমন পাগলকে কি করে যে না করে দিলি বুঝতে পারছি না, এমন ভালোবাসা কেউ ইচ্ছে করে হারায়? (হিমি চুপচাপ আমার বুকের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছে ছুটে যাওয়ার জন্য কোনো চেষ্টা করছে না। হিমির আচরণে মনে হয় ও আমাকে ভালোবাসে কিন্তু…)
তারিন: তোমরা রোমান্স করো আসছি আমি।
আমি: যেও না আমি চলে যাচ্ছি। (হিমিকে ছেড়ে চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই বিছানায় রাখা চুড়ি গুলোর উপর নজর পড়লো, চুড়ি গুলো হাতে নিয়ে হিমির সামনে আসলাম)
আমি: চুড়ি গুলো আমাকে দিবে?
হিমি: এই সস্তা চুড়ি গুলো দিয়ে আপনি কি করবেন? (হিমি বেশ অবাক হয়েই প্রশ্নটা করলো, আমি মৃদু হাসলাম)
আমি: প্রিয় মানুষটা যখন কাছে থাকবে না তখন নাহয় তার এই সস্তা চুড়ি গুলোই স্মৃতি হয়ে আমার কাছে থাকবে। (হিমি আমার উত্তর শুনে মাথা নিচু করে ফেললো, ওর গালে একটা হাত রাখলাম সাথে সাথে হিমি আমার চোখের দিকে তাকালো)
আমি: ভালো থেকো।
হিমির কপালে আলতো করে আমার ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিলাম, হিমি দুচোখ বন্ধ করে আছে দেখে মৃদু হেসে চলে আসলাম।

সিফাত: আরশান আর কতবার ওদিকে তাকাবি?
আরিয়ান: আরে হিমি তোকে ভালোবাসে না। হিমি তো জানতো আজ সকালে আমরা চলে যাবো, যদি তোকে ভালবাসতো তাহলে তুই চলে যাচ্ছিস জেনেও কি একবারের জন্য আসতো না? (ওদের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ হিমিদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছি, ভেবেছিলাম যাওয়ার সময় একনজর দেখতে পারবো কিন্তু হিমি তো একবারের জন্যও বের হচ্ছে না, এই মেয়েটা কি আমার ভালোবাসা এতটুকুও বুঝে না?)
শান্ত: আরশান চল দেরি হয়ে যাচ্ছে পরে কিন্তু ট্রেন মিস করবি।
তারিন: আরশান ভাইয়া হিমি আসবে না। (তারিনের দিকে তাকালাম, মন তো কিছুতেই হিমিকে একনজর না দেখে যেতে চাচ্ছে না)
তারিন: সরি ভাইয়া তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না।
আমি: তুমি সরি বলছ কেন? হিমি যদি আমার ভালোবাসা না বুঝে তাতে তো অন্য কারো দোষ নেই, এইটা আমারই ব্যর্থতা।
তারিন: আমি চেষ্টা করবো তুমি মন খারাপ করো না।
শান্ত: এবার চল।
তারিনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে চলে আসলাম।

ট্রেন চলছে তার নিজ গন্তব্যে, আমি আনমনা হয়ে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখছি। হঠাৎ সিফাত ডেকে উঠলো…
সিফাত: আরশান?
আমি: হুম।
সিফাত: এতো চুপচাপ থাকলে ভালো লাগে বল।
আরিয়ান: আমাদের জার্নি কখনো এতো নীরব হয়নি তোর গানের সাথে আমরা জার্নি ইনজয় করি আর আজ কিনা তুই এতো নীরব, এইটা ধর। (আরিয়ান আমার দিকে গীটার এগিয়ে দিল, মৃদু হেসে গীটারটা ওর দিকে আবার ঠেলে দিলাম)
আমি: গান গাওয়ার মতো মোড নেই।
সিফাত: ভুলে যা না সব।
আমি: এতো সহজে যদি সব ভুলা যেতো তাহলে ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণায় পৃথিবীর কোনো মানুষ কাঁদতো না।
আরিয়ান: একবার বাসায় ফিরে চল কয়েকদিন পর দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে তোর মন ভালো হয়ে যাবে।
আমি: মনটা যে গ্রামে রেখে এসেছি কি করে ভালো হবে?
সিফাত: আরশান ভালোবাসা যদি জোড় করে হতো তাহলে আমরা ঠিক হিমিকে তোর কাছে এনে দিতাম কিন্তু তাতো পসিবল নয়, বুঝার চেষ্টা কর প্লিজ!
আমি: (নিশ্চুপ)
আরিয়ান: ভুলে যা প্লিজ!
আমি: সম্ভব না।
সিফাত: তাহলে কি করবি?
আমি: অপেক্ষা।
আরিয়ান: তোর কি মনে হয় হিমি ফিরে আসবে?
আমি: হ্যাঁ, আমি ওর চোখে আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি। হিমি একদিন ঠিক আমার কাছে ফিরে আসবে।
সিফাত: তাহলে সেদিনের অপেক্ষায় বসে থাক।
আমি: হুম।

বাসায় এসে কলিংবেল চাপতেই আম্মু এসে দরজা খুলে দিলেন, আমাকে দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন।
আম্মু: আরশান।
আমি: কেমন আছ আম্মু?
আম্মু: বিয়ে বাড়িতে গিয়ে তো মা’কে ভুলেই গেছিস।
আমি: তোমাকে কখনো ভুলা যায়?
আম্মু: আরশান কি হয়েছে তোর মুখটা এমন শুকনো শুকনো লাগছে কেন?
আমি: তুমি তো সবসময় এই একই কথা বলো।
আম্মু: না আরশান আজ তোর মুখ অন্যরকম লাগছে।
রোদেলা: ভাইয়া চলে এসেছ?
আমি: হুম চাঁচি কোথায়?
রোদেলা: রুমেই আছে, আমার জন্য কি এনেছ?
আমি: তুই কি এখনো পিচ্ছি নাকি যে আসার সময় কিছু নিয়ে আসবো।
রোদেলা: চাঁচি দেখেছ কি বলে?
আম্মু: বলবেই তো আজ যে আমি অন্য আরশানকে দেখছি, যে আরশান সারাদিন পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখে ও তো সে আরশান নয়।
আমি: আম্মু তুমি অজতা ভাবছ, আপু কোথায়?
আম্মু: রুমে।
আমি: আপুর সাথে দেখা করে আসি।
আম্মু: হুম যা।

আমি: আমি যে এসেছি সে খেয়াল কি কারো আছে? (আপু বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে ফোন টিপছিল আমার কথা শুনে দরজায় তাকিয়েই এক দৌড়ে আমার কাছে ছুটে আসলো)
আপু: আমিতো ভেবেছিলাম হিমিকে ছেড়ে বুঝি আর আসবিই না।
আমি: তোদের ছাড়া থাকা সম্ভব?
আপু: এদিকে আয় তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে।
আমি: একটু রেস্ট নেই তারপর সব কথা।
আপু: তুই কিন্তু আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছিস।
আমি: কখন? আমাকে ফ্রেশ হওয়ার সুযোগ দিবি না?
আপু: না এখানে বস। (আপু আমাকে জোড় করে টেনে এনে বিছানায় বসিয়ে দিলো, জানি তো আপু হিমিকে নিয়ে কথা বলবে। কিন্তু কি বলবো আপুকে?)
আপু: এবার বল হিমি তোর প্রপোজ একসেপ্ট করেছে? প্রপোজের জন্য এতো আয়োজন দেখে হিমি নিশ্চয় চমকে উঠেছিল? এই তোরা বিয়ে কবে করছিস?
আমি: (নিশ্চুপ)
আপু: কিরে ভাই তোর মুখটা এমন মলিন লাগছে কেন?
আমি: অনেকটা রাস্তা জার্নি করেছি তো খুব টায়ার্ড লাগছে আপু। (আমার দিকে তাকিয়ে আপু কি যেন ভাবলো)
আপু: ঠিক আছে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসি।
আমি: হুম।

ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, হিমিকে বড্ড বেশি মিস করছি ইচ্ছে করছে ছুটে হিমির কাছে চলে যাই।
আপু: ভাই? (আপুর ডাক শুনে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলাম)
আমি: আপু আমি বারান্দায়।
আপু: খাবার এনেছি চল খাবি। (আপু এসে আমার হাত ধরলো, আপুর হাত ছাড়িয়ে দিলাম)
আমি: এই সন্ধ্যা বেলায় কিছু খেতে ইচ্ছে করছে নারে আপু। (আপু কিছু না বলে চুপচাপ এসে আমার পাশে দাঁড়ালো)
আপু: হিমি তোকে ফিরিয়ে দিয়েছে তাই না?
আমি: (নিশ্চুপ)
আপু: নাম্বার আছে হিমির? আমি কথা বলবো।
আমি: বাদ দে না আপু।
আপু: আমার ভাই কষ্ট পাবে আর আমি সেটা নীরবে সহ্য করবো?
আমি: জোড় করে কি ভালোবাসা হয়?
আপু: কিন্তু হিমি তোকে ভালোবাসে না কেন? তুই কি দেখতে খারাপ নাকি তোর টাকা পয়সার অভাব?
আমি: আপু হিমি খুব সহজ সরল মেয়ে ওর কাছে টাকা পয়সা বা সৌন্দর্যের কোনো মূল্য নেই।
আপু: তাহলে কিসের জন্য তোকে ফিরিয়ে দিলো?
আমি: মেয়েটা অল্পতেই বড্ড বেশি ভয় পায়, হয়তো পরিবারের ভয়ে।
আপু: তাহলে আমরা ওর পরিবারের সাথে কথা বলবো একেবারে বিয়ে ঠিক করে নিবো।
আমি: না আপু, হিমি আমাকে অনুরোধ করে বলেছে ওর পরিবার যেন এসব জানতে না পারে।
আপু: তাহলে আমরা করবোটা কি?
আমি: কিছু করার নেই, বাদ দাও আপু।
আপু: কাঁদিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি: কিচ্ছু ঠিক হবে না হিমি আমাকে পছন্দ করে না।
আপু: এতো ভেঙ্গে পড়ছিস কেন? এমন তো অনেক হয় সম্পর্ক গড়ার আগেই ভেঙ্গে যায়, তাই বলে কি মানুষ আর স্বপ্ন দেখে না? তুই নতুন করে স্বপ্ন দেখ, হিমির চেয়ে অনেক ভালো মেয়ে পাবি।
আমি: আমিতো ভালো মেয়ে চাইনি আমার হিমি নামের মায়াবতীটাকেই চাই।
আপু: কিন্তু…
আমি: আপু প্লিজ ভালো লাগছে না।
আপু: একা থাক একটু, সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি: হুম।
আপু চলে গেলো, আমি আনমনা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি হিমি কি কখনো ফিরে আসবে আমার কাছে আমার ভালোবাসার টানে…

ফোনের রিংটোনে আমার ঘুম ভাঙ্গলো, ঘুম ঘুম চোখে ফোন রিসিভ করলাম।
আমি: হ্যালো কে?
সিফাত: তোর দাদা।
আমি: ওহ তুই।
সিফাত: এই শালা মানুষ আর ছ্যাকা খায় না? তোর রিলেশন তো গড়ার আগেই ভেঙ্গে গেছে এইটাকে তো ছ্যাকাও বলা যায় না আর তুই কিনা এইটার জন্য কলেজ বন্ধু সব ছেড়ে দু সপ্তাহ ধরে ঘরবন্ধী হয়ে বসে আছিস।
আমি: এসব বলার জন্য সাতসকালে ফোন করেছিস?
সিফাত: আজ কলেজে আয়।
আমি: না ভালো লাগছে না।
সিফাত: আরশান আমরা ঐ গ্রাম থেকে ফিরে এসেছি দু সপ্তাহ হয়ে গেছে, মাঝখানে দুটো সপ্তাহ কেটে গেছে কিন্তু তুই এখনো হিমি নামটা ভুলতে পারছিস না, দু সপ্তাহ সময় কি কম?
আমি: সিফাত ভালো লাগছে না এসব শুনতে।
সিফাত: তা লাগবে কেন একটা মেয়ের জন্য তো আমাদের ভুলেই গেছিস। ওদিকে শান্ত দুদিন ধরে গ্রামের বাড়িতে আছে তুইও কলেজে আসছিস না, আমি আর আরিয়ান শুধু। একা একা ভালো লাগে বল।
আমি: ঠিক আছে আগামীকাল আসবো কলেজে।
সিফাত: সত্যি তো?
আমি: হ্যাঁ।
সিফাত: ঠিক আছে।
সিফাত ফোন রাখতেই উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।

তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে রুমে আসলাম, আপু আমার ফোন থেকে কার সাথে যেন কথা বলছে।
আমি: আপু কে ফোন করেছে?
আপু: শান্ত।
আমি: ওহ!
আপু: ধর কথা বল, আর নাশতা রেখে যাচ্ছি খেয়ে নিস। (আপু ফোন আমার হাতে দিয়ে মুচকি হেসে চলে গেলো, আপুর হাসির কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না)
আমি: হ্যাঁ শান্ত বল।
শান্ত: কলেজে আসবি না?
আমি: তুই তো গ্রামে।
শান্ত: গতকাল রাতে চলে এসেছি।
আমি: ওহ!
শান্ত: কলেজে আয় তোর জন্য একটা বড়সড় সারপ্রাইজ আছে।
আমি: কি সারপ্রাইজ?
শান্ত: আগে বলে দিলে সারপ্রাইজ থাকবে?
আমি: কিন্তু আমার ভালো লাগেনা এসব।
শান্ত: আরশান মধ্যে দুটো সপ্তাহ কেটে গেছে, নিজেকে আর কতদিন ঘরবন্ধি করে রাখবি?
আমি: ঠিক আছে আসছি।
শান্ত: তাড়াতাড়ি।

শান্ত ফোন রাখতেই রেডি হওয়ার জন্য আলমারি থেকে শার্ট নিতে আসলাম, হাত লেগে সাদা টিশার্ট’টা ফ্লোরে পড়ে গেলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি টিশার্টে লেগে থাকা হিমির ঠোঁটের লিপস্টিকের দাগের দিকে দুচোখে পানি ছলছল করছে। তাড়াতাড়ি টিশার্ট তুলে আলমারিতে রেখে আলমারিটা বন্ধ করে দিলাম। চোখ দুটো বুজে আলমারিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, এই টিশার্ট, হিমির চুড়ি আর কাজলের কৌটো আমাকে বড্ড বেশি যন্ত্রণা দেয়, এগুলো আমাকে রোজা কাঁদায়। মাঝখানে কেটে গেছে দুটো সপ্তাহ, কিন্তু আমি হিমিকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি। আর হয়তো কখনো ভুলতে পারবোও না। চোখের পানি মুছে রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

“আরশান” কলেজে আসতেই সিফাত, আরিয়ান আর অধরা অবাক হয়ে একসাথে আমার নাম ধরে চিৎকার করে উঠলো। সবাই গাছের নিচে বসে আছে, বাইক রেখে আমিও গিয়ে ওদের পাশে বসলাম।
সিফাত: কিরে তুই না বললি আসবি না আগামীকাল আসবি?
আমি: শান্ত ফোন করেছিল কিনা কি সারপ্রাইজ আছে বললো।
আরিয়ান: কিন্তু শান্ত তো ওদের গ্রামে ওর আম্মু, আব্বু আর তারিনকে আনতে গেছে।
আমি: কেন?
আরিয়ান: তারিন তো আমাদের কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে তাই ওরা সবাই এখানে বাসায় উঠেছে।
আমি: ওহ! শান্ত গতকাল রাতে চলে এসেছে।
অধরা: তোর মতো প্রেমিক আমি এই প্রথম দেখলাম, যে রিলেশন গড়ার আগেই ভেঙ্গে গেছে সে রিলেশনের জন্য কিনা তুই দু সপ্তাহ কলেজে আসিসনি। ওই তোর মায়াবতী কি দেখতে খুব সুন্দর যে চাইলেও ভুলা যায় না?
সিফাত: অধরা চুপ কর না দেখছিস ওর মন খারাপ।
অধরা: ওর মন খারাপ দেখতে ভালো লাগছে না বলেই তো বকবক করে যাচ্ছি। আচ্ছা আরশান এতোই যখন ভালোবাসিস তাহলে এভাবে চুপচাপ বসে আছিস কেন? (অধরার প্রশ্ন শুনে ওর দিকে তাকালাম)
আমি: মানে?
অধরা: পিছনে লেগে থাকলে তবেই না মেয়ে রাজি হবে, আর এমনিতেও মেয়েরা ছেলেদেরকে পিছনে ঘুরাতে একটু পছন্দ করে।
আমি: শুন হিমি এমন মেয়ে নয়।
অধরা: যাক বাবা আমি কি তোর হিমিকে খারাপ মেয়ে বলেছি? আমিতো শুধু বলেছি…
শান্ত: আরশান? (শান্তর ডাক শুনে সামনে তাকালাম, চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে হিমির দিকে। হিমি তারিনের সাথে কথা বলতে বলতে এদিকেই আসছিল আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো, দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি অপলক দৃষ্টিতে। আমার চোখে যেমন পানি ছলছল করছে তেমনি হিমির চোখেও পানি ছলছল করছে, মনে হচ্ছে কতো বছর ধরে দুজন দুজনকে দেখিনা)
আরিয়ান: হিমি এখানে?
সিফাত: কিরে শুভ দৃষ্টি এখানেই সেরে ফেলবি নাকি? (সিফাতের কথা শুনে হিমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো, আমি এখনো তাকিয়ে আছি ওর লজ্জামাখা মুখের দিকে)
অধরা: এই তোর মায়াবতী?
সিফাত: হ্যাঁ ও হিমি, কিন্তু হিমি তুমি আমাদের কলেজে?
অধরা: বাহ্ খুব সুন্দর, এজন্যই বুঝি আমাদের আরশান তোমার বিরহে কেঁদে কেঁদে…
শান্ত: অধরা চুপ করবি?
হিমি: তারিন চল।
হিমি তারিনের হাত ধরে চলে যাচ্ছে, আমি তাকিয়ে আছি ওর দিকে।

শান্ত: সারপ্রাইজটা কেমন হলো? (শান্তর ধাক্কায় যেন আমি স্তম্ভিত ফিরে পেলাম, ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম)
আমি: হিমি আমাদের কলেজে?
শান্ত: আজ থেকে এইটা হিমিরও কলেজ, মানে হিমি আর তারিন এখানেই অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। (আমি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না, হিমি এই শহরে এই কলেজে? তবে কি এইটা হিমিকে ফিরে পাওয়ার কোনো আশা?)
শান্ত: আব্বু যখন বললো তারিনকে এখানে ভর্তি করবে তখন আমি ভাবলাম হিমিও এখানে ভর্তি হলে কেমন হয়? তারিনকে দিয়ে হিমির ভাইয়াকে রাজি করালাম, হিমি তো অনেক ভালো রেজাল্ট করেছে তাই ওর ভাইয়া আর না করেনি।
আমি: থ্যাঙ্ক ইউ দোস্ত। (খুশিতে শান্তকে জড়িয়ে ধরলাম)
শান্ত: তোর জন্য আরো একটা খুশির খবর আছে, তবে তুই যদি সেটা কাজে লাগাতে পারিস ত…
আমি: কি বল।
শান্ত: হিমির ছোট ভাই বাহিরে আছে ছয়মাস পর দেশে আসবে আর ওর বড় ভাই সরকারী চাকরিজীবী বর্তমানে রাঙামাটিতে আছে এক বছরের মধ্যে ট্রান্সফার হওয়ার সম্ভাবনা নেই…
আমি: কিন্তু এতে আমার লাভ কি?
শান্ত: আমার কথা শেষ হতে দে। হিমিরা আপাতত আমাদের বাসায় উঠেছে, দু এক দিনের মধ্যে নতুন বাসা খুঁজে ওরা চলে যাবে। হিমির ভাইয়া যেহেতু ওদের কাছে থাকতে পারবে না তাই ভাইয়া চাইছে কোনো একটা পারিবারিক বাসা ভাড়া নিয়ে হিমিদের রাখতে।
অধরা: আমি বুঝে গেছি এতে আরশানের কি লাভ।
শান্ত: অধরা সবসময় এতো বকবক করিস কেন? চুপ কর না।
অধরা: ওকে করলাম চুপ।
শান্ত: আরশান তুই কিন্তু ছয় মাসের জন্য হিমিকে তোর কাছে পাচ্ছিস যদি সুযোগটা কাজে লাগাতে পারিস।
আমি: কিরকম?
অধরা: তোদের বাসায় হিমিদের ভাড়া দিবি সিম্পল।
শান্ত: এই বকবক করা মেয়েটা বুঝে গেছে আর তুই বুঝতে পারছিস না? তোদের তিনতলা বাসাতে তো তোদের সবার দুতলাতেই হয়ে যায় তৃতীয় ফ্লোর ফাঁকা থাকে, তুই চাইলে আমি হিমির ভাইয়াকে তোদের ঠিকানা দিয়ে দিতে পারি।
সিফাত: শান্ত আমার মনে হয় না বাসা ভাড়া দিতে আরশানের আব্বু রাজি হবে।
আরিয়ান: হ্যাঁ উনি যেরকম মানুষ রাজি হবে না।
শান্ত: দেখ আরশান আমার আর তারিনের পক্ষে যতোটা করা সম্ভব আমরা করেছি এখন বাকিটা তোর হাতে।
আমি: যতোটুকু করেছিস তাতেই আমি হিমিকে ফিরে পাওয়ার আশার আলো দেখতে পাচ্ছি, থ্যাংকস দোস্ত বাকিটা আমি করে নিবো।
অধরা: আমার কোনো হেল্প লাগলে বলিস।
সিফাত: তুই যা বেশি বেশি কথা বলিস কি থেকে কি বলবি পরে আবার দুজনের মধ্যে ঝগড়া লেগে যাবে হাহাহা।
ওরা সবাই মজা করছে আমি একটু দূরে এসে রোদেলাকে ফোন দিলাম, রোদেলা তো ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে এবার যা করার ওকে দিয়েই করাতে হবে।
রোদেলা: হ্যাঁ ভাইয়া বলো।
আমি: তুই কোথায়?
রোদেলা: কোথায় আবার তুমি জানোনা আজ আমার ফার্স্ট ক্লাস।
আমি: তোর ভাবিকে দেখবি?
রোদেলা: কি? সত্যি?
আমি: হুম।
রোদেলা: আমি ক্লাসে আছি প্লিজ তুমি আসো।
আমি: আসছি।

হিমি: তারিন তুই জানতিস আরশান যে এই কলেজে পড়ে? (ক্লাসে ঢুকতে যাবো তখনি হিমির কন্ঠ শুনে থমকে দাঁড়ালাম)
তারিন: হ্যাঁ, ওরা চার বন্ধু আর অধরা আপু সবাই তো ফাইনাল ইয়ারে পড়ে জানবো না কেন?
হিমি: তুই জেনেশুনে আমাকে কেন এই কলেজে আনলি?
তারিন: কারণ আমি চাই তুই আরশান ভাইয়াকে ভালোবেসে বিয়ে করে সুখে থাক।
হিমি: তারিন তুই বুঝতে পারছিস না…
আমি: আর কিছু বুঝতে হবে না এবার তুমি বুঝে নাও তোমাকে আমি আর দূরে যেতে দিচ্ছি না। (হিমির সামনের সিটে এসে বসে ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মারলাম হিমি মাথা নিচু করে ফেললো)
রোদেলা: ভাইয়া? (রোদেলা এসে আমার পাশে বসলো, হিমি কিভাবে যেন রোদেলার দিকে তাকাচ্ছে)
আমি: ও তারিন শান্তর বোন আর ও…
রোদেলা: আর ও আমার মিষ্টি ভাবিটা। (রোদেলা হিমির গাল টেনে দিলো হিমি তো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে)
রোদেলা: আজ থেকে আমরা শুধু ননদ ভাবি নই আমরা দুজন ফ্রেন্ড, আর তারিন তুমিও।
তারিন: ওকে।
আমি: এবার তোর ভাবিকে আমার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য হেল্প কর।
রোদেলা: কিরকম?
হিমি: ক্লাসের মধ্যে কি শুরু করেছেন সবাই দেখছে তো? (চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে হিমির দিকে তাকালাম)
আমি: আমি কি তোমায় কিস করেছি? (হিমি চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালো, তারিন আর রোদেলা ফিক করে হেসে উঠলো)
আমি: সবাই কি দেখছে? কিস তো করিনি চাইলে সেটাও করতে পারি, করবো?
হিমি: আপনি যান তো এখান থেকে।
আমি: যাচ্ছি যাচ্ছি তবে খুব শীঘ্রই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাবো।
হিমি আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে চলে আসলাম।

অধরা: আরশান একবার যেহেতু ফিরে পেয়েছিস আর হারাতে দিস না।
শান্ত: কি করবো হিমির ভাইয়াকে তোদের ঠিকানা দিবো?
আমি: বাসায় যাই রোদেলাকে দিয়ে সবাইকে রাজি করাবো।
শান্ত: ঠিক আছে।
সিফাত: এতো কিছু যে করছিস শেষ পর্যন্ত হিমি তোর হবে তো?
আমি: হিমির চোখে আমি আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি। হিমি যদি আমাকে ভালো না বাসতো তাহলে সেদিন রাতে ওকে জড়িয়ে ধরার জন্য রাগ করতো, ও সেদিন রাগ করেনি উল্টো আমার বুকে মুখ গুঁজেছিল। সেদিন রাতে তারিনের সামনে ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম তাতেও হিমি রাগ করেনি উল্টো আমার বুকের সাথে লেপ্টে ছিল। আসার সময় ওর কপালে চুমু দিয়েছিলাম হিমি রাগ করেনি আবেশে দুচোখ বুজে রেখেছিল।
অধরা: আমি বলছি হিমি তোকে ভালোবাসে, আমিতো একটা মেয়ে তাই আমি বুঝি একটা মেয়ে কখন একটা ছেলেকে জড়িয়ে ধরার অধিকার দেয়।
সিফাত: প্রেম নিয়ে গবেষণা করছিস নাকি আজকাল? নাকি নিজেই কারো প্রেমে পড়েছিস?
অধরা: তোকে আমি…
আমি: তোরা ঝগড়া কর আমি বাসায় যাচ্ছি।
শান্ত: ঠিক আছে।

বাইক স্টার্ট দিতেই রোদেলা দৌড়ে এসে বাইকে বসলো।
আমি: কিরে ক্লাস করবি না?
রোদেলা: না।
আমি: চাঁচিকে বলে দিবো।
রোদেলা: আমিও বলে দিবো ভাবির কথা।
আমি: ভয় দেখাচ্ছিস?
রোদেলা: হ্যাঁ, এবার বাসার দিকে যাও তো।
আমি: ওকে।
রোদেলা: ভাইয়া তুমি জানো আজ আব্বু আর চাচ্চু বাসায় আসছেন। (রোদেলার কথা শুনে চুপ হয়ে গেলাম, আব্বু বাসায় আসলে আমার নিজস্ব স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকেনা, সবকিছু আব্বুর ইচ্ছেতে করতে হয় আর তাই আব্বুকে আমার পছন্দ না। তাছাড়া আব্বু সারাক্ষণ শুধু টাকার পিছনে ছুটে, ছেলে মেয়ে যে বাবার কাছে একটু ভালোবাসা চায় একটু সময় চায় সেটা উনি অনেক আগেই ভুলে গেছেন)
রোদেলা: ভাইয়া সরি তোমার মন খারাপ করে দিলাম, তবে একদিকে ভালো হয়েছে হিমিদের বাসা ভাড়া দিতে হলে তো আব্বু আর চাচ্চুর অনুমতি লাগবে।
আমি: তুই জানিস কিভাবে বাসা ভাড়া দিতে হবে? আমিতো কিছু…
রোদেলা: তানিয়া আমাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছে।
আমি: হুম। কিন্তু তোর আব্বু অনুমতি দিয়ে দিলেও আমার আব্বু দিবে না কারণ উনি তো একটা…
রোদেলা: প্লিজ ভাইয়া রেগে যেওনা, আমি সব সামলে নিবো।
আমি: হুম।

রোদেলার সাথে হাসতে হাসতে বাসায় ঢুকলাম, ড্রয়িংরুমে আব্বু, চাচ্চু, চাঁচি বসে আছেন, আব্বুকে দেখে আমার হাসি মুখটা নিমিষেই চুপসে গেলো।
চাচ্চু: আরশান চলে এসেছিস? কেমন আছিস?
আমি: ভালো। (আম্মু কিচেনে রান্না করছেন দেখে ওদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম, আব্বু পিছু ডাকলেন)
আব্বু: আরশান?
আমি: হুম বলো।
আব্বু: আজকাল নাকি গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছ এসব তো…
আম্মু: আরশান এদিকে আয়। (আম্মুর ডাক শুনে আব্বুর কথার কোনো জবাব দিলাম না)
চাচ্চু: ভাইয়া ছেলেটা কলেজ থেকে ফিরেছে মাত্র এখন এসব নিয়ে বকাবকি করলে তো মন খারাপ করবে দুপুরের খাবারটাও খাবে না, তুমি জানো না আরশান কতোটা জেদি? (চাচ্চুর কথা গুলো শুনতে শুনতে আম্মুর কাছে চলে আসলাম)
আম্মু: কিরে এতো তাড়াতাড়ি যে চলে আসলি?
আমি: মন ভালো ছিল তাই। কিন্তু বাসায় এসে তো…
আম্মু: বাবা এসব নিয়ে মন খারাপ করিস না তুই তো জানিস তোর আব্বু একটু এরকম। উনার কোন বন্ধুর ছেলের বিয়ে তাই বাসায় এসেছে দুভাই, চারদিন থাকবে বিয়েতে যাবে আবার ব্যবসার কাজে বাহিরে চলে যাবে, চারটা দিনই তো।
আমি: উনার সাথে চারদিন কেন এক মুহূর্তও এক বাসায় থাকতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
রাগে কথা গুলো বলে রুমের দিকে চলে আসলাম। এই লোকটাকে আমার একদম সহ্য হয় না, সারাক্ষণ শুধু টাকা টাকা করে ভাল্লাগেনা এসব।

খাবার টেবিলে বসে আনমনা হয়ে ভাত নাড়াচাড়া করছি আর ভাবছি আব্বু বাসা ভাড়া দিতে আদৌ রাজি হবে তো? হিমিকে আমার কাছে আনতে পারবো তো?
আব্বু: আরশান কি হলো খাচ্ছ না কেন?
আম্মু: কিরে খাবার সামনে নিয়ে কি এতো ভাবছিস?
আপু: আম্মু খাচ্ছে তো ছাড়ো না।
রোদেলা: আব্বু, চাচ্চু তোমাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ ছিল। (রোদেলার কথা শুনে সবাই ওর দিকে তাকালো, খুব ভয় হচ্ছে কিযে হবে)
চাচ্চু: কি অনুরোধ বলো।
চাঁচি: রোদেলা যা চাইবার পরে চাস এখন খাবারের সময় না।
রোদেলা: এই খাবারের সময়টাতেই তো সবাই এক জায়গায় হই।
আব্বু: রোদেলা বলো কি চাও।
রোদেলা: আসলে আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড হিমি ওদের ছয়মাসের জন্য একটা ভাড়া বাসা প্রয়োজন অনেক খুঁজেছে পাচ্ছে না।
আব্বু: তো?
রোদেলা: বলছিলাম আমাদের বাসার তৃতীয় ফ্লোর তো ফাঁকা পরে আছে যদি…
চাচ্চু: ভাড়া দিতে বলছ?
রোদেলা: না আব্বু, তোমরা ভাড়া দিতে না চাইলে ওদের তো এমনিতেই থাকতে দিতে পারো। কিন্তু ওরা এমনিতে থাকবে না আসলে ওর ভাইয়া…
আব্বু: রোদেলা তোমার মাথা ঠিক আছে?
রোদেলা: (নিশ্চুপ)
আপু: আব্বু রোদেলা ওর ফ্রেন্ডকে সাহায্য করতে চাইছে এতে দোষের কি? (আব্বু চাচ্চু দুজনেই চুপ হয়ে আছেন, খুব ভয় হচ্ছে)
আব্বু: ঠিক আছে আসতে বলো ওদের। (আব্বুর কথা শুনে সবাই চমকে উঠলাম, আমিতো অবাক হয়ে আব্বুর দিকে তাকিয়ে আছি আব্বু এতো সহজে রাজি হয়ে যাবেন ভাবতেই পারিনি)
রোদেলা: সত্যি?
আব্বু: হুম।

হিমি এই শহরে, দুজন একই কলেজে, এখন আবার একই বাসায় সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। তারমানে আমি হিমিকে আমার করে পাবো, আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। আনমনা হয়ে এসব ভাবছিলাম হঠাৎ কলিংবেল এর শব্দে আমার ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো। আম্মু দরজা খুলতে গেলেন।
আম্মু: আরশান তোর নামে পার্সেল এসেছে। (আম্মুর কথা শুনে বেশ অবাক হলাম, আমার নামে পার্সেল?)
আব্বু: কি হলো যাও পার্সেলটা নিয়ে এসো।
আমার নামে কে পার্সেল পাঠাতে পারে আর কি আছে এতে ভাবতে ভাবতে গিয়ে সাইন করে পার্সেলটা নিয়ে আসলাম। সবার চোখ পার্সেলের দিকে, আব্বু চোখমুখ কুঁচকে পার্সেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমাকে কে পার্সেল পাঠাবে? আব্বুর সামনে কি প্যাকেট’টা খুলা ঠিক হবে? মাথায় হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে ভয়ে ভয়ে প্যাকেট’টা খুলতে শুরু করলাম…

এতো বড় প্যাকেটে ছোট একটা কাগজ আর একটা পায়েল দেখে বেশ অবাক হলাম, কাগজ খুলতেই চমকে উঠলাম। চিঠি তাও হিমিকে নিয়ে? কে পাঠালো এই চিঠি? তাড়াতাড়ি পড়তে শুরু করলাম।
“হিমিকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছিস তাই না? আচ্ছা একবারো হিমির অতীত জানার চেষ্টা করেছিস? গ্রামের মেয়ে বলে যে সহজসরল হবে এইটা ভাবা তোর জন্য বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। মনে রাখিস হিমি শুধু আমার, আর হ্যাঁ হিমি আমার ভয়ে তোর প্রপোজে কখনোই রাজি হবে না। যদি কখনো হয়েও যায় তাহলে হিমিকে ওপাড়ে পাঠিয়ে দিবো। হিমির পায়েল দিয়ে দিলাম এমন আরো অনেক স্মৃতি আছে ওর যা…
আব্বু: এতো মনোযোগ দিয়ে কি পড়ছ আরশান? কি আছে এতে? (আব্বুর প্রশ্ন শুনে চিঠিটা লুকিয়ে ফেললাম)
আব্বু: কিসের পার্সেল বলো।
আমি: কিছুনা।
আব্বু: কি লুকালে?
আমি: সবকিছু বলতে হবে? আমাদের পার্সোনাল কিছু থাকতে পারেনা?
চাচ্চু: আরশান তুই ভাইয়ার সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন?
আমি: আমরা বড় হয়েছি আমাদেরও কিছু পার্সোনালিটি আছে আমাদের নিজস্ব স্বাধীনতা দেওয়া…
আব্বু: তুমি যে এতো বড় হয়ে গেছ আমি বুঝতেই পারিনি।
আব্বুর দিকে রাগি দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে রুমে চলে আসলাম।

শান্তকে ফোন করে বললাম হিমির ভাইয়াকে পাঠিয়ে দিতে। চিঠিটা হাতে নিয়ে রুমের মধ্যে পায়চারী করছি আর ভাবছি চিঠিটা কে পাঠাতে পারে? কোনো ঠিকানা নেই আবার হিমির পায়েলও সাথে দিয়ে দিলো, আচ্ছা হিমির কোনো শত্রু নেই তো? এতো সহজ সরল মেয়ের শত্রু আবার কে হবে? ধ্যাত প্রশ্ন গুলা আমার মাথার ভিতরে খিলবিল শুরু করেছে, এই চিঠির পিছনে যে কি রহস্য আছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
আপু: ভাই? (আপু এসেছে দেখে চিঠি আর পায়েলটা টেবিলে রেখে বিছানায় এসে বসলাম)
আপু: কিরে এতো চিন্তিত লাগছে মুখটা? তখন দেখলাম পার্সেল…
আমি: আপু চিঠিটা পড়। (আপু চুপচাপ চেয়ার টেনে বসে চিঠি পড়তে শুরু করলো। পায়েলটা আদৌ হিমির কিনা সেটা জানার জন্য হিমিকে দেখানো প্রয়োজন, কিন্তু হিমি যদি কোনো কারণে আমাকে ভুল বুঝে?)
আপু: এই চিঠি কে পাঠিয়েছে আর এসব কি লেখা?
আমি: জানিনা কে পাঠিয়েছে কোনো ঠিকানা তো দেওয়া নেই। আর কিসব যে লেখা আমার মাথা ভনভন করছে।
আপু: ভাই শুন এই চিঠির পিছনে কি রহস্য আছে আমি জানিনা তবে এইটুকু বলতে পারি এসব নিয়ে হিমিকে কোনো প্রশ্ন করা তোর ভুল হবে। এখনি অতীত জানতে চাইলে হিমি ভাববে তুই ওকে বিশ্বাস করিস না। হিমি তো এখন থেকে এই বাসাতেই থাকবে, পরে নাহয় সুযোগ বুঝে পায়েলটা দেখাস।
আমি: ঠিক আছে, কিন্তু তুমি জানলে কিভাবে হি…
আপু: সকালে শান্ত আমাকে ফোনে সব বলেছে।
আমি: ওহ!
আপু: তোর বন্ধু গুলো খুব ভালো।
আপুর কথায় মৃদু হাসলাম, সত্যি ওরা খুব ভালো। শুধু হিমির বিষয়ে না সবকিছুতে সবসময় ওদের পাশে পাওয়া যায়।

রাত সাড়ে বারোটা, ছাদে বসে আছি আর আনমনা হয়ে ভাবছি কি হবে আমার ভালোবাসার? আমি কি আদৌ সাকসেসফুল হবো? হিমি কি আমাকে ভালোবাসবে? হিমির পরিবার মেনে নিবে তো? আর আব্বু… হঠাৎ পাশে রাখা ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো, অচেনা নাম্বার রিসিভ করলাম।
আমি: হ্যালো।
তারিন: আমি তারিন, এতো রাতে জেগে আছ যে হিমির চিন্তায় ঘুম আসছে না বুঝি? (তারিন হাসছে আমিও মুচকি হাসলাম, সত্যিই তো হিমিকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে ঘুম আসছে না)
তারিন: আমাদের হিমি মেডামেরও ঘুম আসছে না জানিনা কেন, হয়তো তুমি ঘুম কেড়ে নিয়েছ।
আমি: হিমি তোমার পাশে?
তারিন: হ্যাঁ, কেন কথা বলতে ইচ্ছে করছে?
আমি: হুম। (তারিন হুট করে ফোনটা হিমির হাতে ধরিয়ে দিলো, হিমি নিশ্চুপ হয়ে আছে। হিমির নিঃশ্বাসের শব্দেই আমি ওকে ছিনতে পারছি)
আমি: হিমি?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: কথা বলো প্লিজ! (হিমি নিশ্চুপ হয়ে আছে, এই মেয়েটা এতো লাজুক কেন?)
আমি: আমি কিন্তু এই রাতের বেলা শান্তদের বাসায় চলে আসবো।
হিমি: এই না।
আমি: এইতো এখন ভয় পেয়ে মুখে কথা ফুটেছে। আচ্ছা হিমি তুমি এতো লাজুক কেন আর অল্পতেই এতো ভয় পাও কেন?
হিমি: আমি রাখছি।
আমি: একদম না আমি কিন্তু চলে আসবো।
হিমি: আজ ভয় দেখাচ্ছেন দুদিন পর তো আমরা এই বাসা ছেড়ে চলে যাবো তখন কিভাবে ভয় দেখাবেন? (হিমির কথা শুনে হাসলাম, পাগলীটা তো জানেই না ওকে যে আমার কাছে আনার ব্যবস্থা করে ফেলেছি)
আমি: তোমার পিছু পিছু নতুন বাসায় চলে যাবো।
হিমি: আমিতো সেদিন আপনাকে বলেছি আমি আপনাকে পছন্দ করিনা তারপরও কেন…
আমি: আচ্ছা হিমি তোমার কি অন্য কারো সাথে রিলেশন আছে?
হিমি: না, কেন?
আমি: তাহলে প্রবলেম কোথায়?
হিমি: কোনো প্রবলেম নেই আমি আপনাকে পছন্দ করিনা ব্যস।
আমি: অপছন্দের মানুষকে বুঝি কেউ জড়িয়ে ধরার অধিকার দেয়?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: যদি পছন্দ না করো তাহলে সেদিন তোমার কপালে চুমু দেওয়াতে রাগ করনি কেন?
হিমি: জানিনা।
হিমি ফোন কেটে দিলো, ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছি সত্যি ও একটা পাগলী।

“বাসা ভাড়া কত দিতে হবে”
সকালবেলা ঘুম ঘুম চোখে নিচে নেমে আসছিলাম হঠাৎ কারো মুখে এই কথা শুনে সিঁড়িতেই থমকে দাঁড়ালাম। আম্মু, আব্বু, রোদেলা আর একজন লোক ড্রয়িংরুমে বসা, তাহলে কি ইনিই হিমির ভাইয়া?
রোদেলা: না না ভাইয়া কোনো টাকা লাগবে না, হিমি তো আমার বান্ধবী ওকে তো আমি এইটুকু হেল্প করতেই পারি।
ভাইয়া: হ্যাঁ তারিন বলছিল ওদের বান্ধবী তুমি, এজন্যই আমি এখানে এসেছি। আসলে আমিতো রাঙামাটি থাকি তাই আমার পরিবারকে কোনো একটা পারিবারিক…
আপু: ভাইয়া আপনি কোনো চিন্তা করবেন না নিশ্চিন্তে আমাদের বাসায় সবাইকে রেখে যেতে পারেন, রোদেলা যেমন আমার বোন হিমিও তো আমার বোন আমরা সবাই ওদের দেখাশোনা করবো। (আপু নাশতা এনে ভাইয়ার সামনে রাখতে রাখতে কথা গুলো বললো, বাব্বাহ্ সবাই যেভাবে ভাইয়াকে বুঝাচ্ছে ভাইয়ার তো না এসে উপায় নেই)
ভাইয়া: কিন্তু টাকার ব্যাপারটা?
আব্বু: তোমাদের পরিবারে সদস্য কতজন?
ভাইয়া: আমার মা, স্ত্রী, বোন হিমি, মেয়ে আনিলা আর ছোট ভাই দেশের বাহিরে আছে।
আব্বু: বাসা ভাড়া দেওয়ার ইচ্ছা আমার ছিল না কিন্তু রোদেলা যখন ওর বন্ধুকে কাছে আনতে চাইছে তাহলে তো দিতেই হবে, ভাড়া লাগবে না। তবুও যদি তোমার মন না মানে মাস শেষে নিজের ইচ্ছামতো দিয়ে দিও। (ভাইয়া নিশ্চুপ হয়ে কি যেন ভাবছেন, আল্লাহ্‌ জানেন ভাইয়া রাজি হবেন কিনা)
ভাইয়া: তাহলে আমরা আগামীকাল চলে আসতে পারি?
আব্বু: হ্যাঁ তোমাদের ইচ্ছা।
ভাইয়া: আজ তাহলে আসি।
আম্মু: তুমি তো কিছু খাওনি বাবা, কিছু একটা মুখে দিয়ে যাও।
বাব্বাহ্ সবাই যে যত্নআত্তি করছে ভবিষ্যৎ এ তো হিমি আর আমার বিয়েতে কোনো বাধাই থাকবে না। ভাইয়া একটুখানি শরবত খেয়ে আম্মুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো। আমি চুপচাপ এসে আম্মুর কাঁধে মাথা রেখে বসলাম।
আম্মু: খুশি?
আমি: হুম অনেক, লাভ ইউ আম্মু।
আব্বু: আরশান আজ এতো খুশি কেন?
আম্মু: সে তুমি বুঝবে না, এইটা আমাদের মা ছেলের ব্যাপার। (আম্মুর কথা শুনে আব্বু মৃদু হেসে উঠে চলে গেলেন)
রোদেলা: ভাইয়া আমি যে হেল্প করলাম আমাকে কি গিফট দিবে?
আমি: আম্মু ওর জন্য একটা ছেলে খুঁজে এনে দাও তো, এটাই বেষ্ট গিফট হবে।
রোদেলা: চাঁচি দেখেছ কি বলে?
আম্মু: এই ফাজিলের সাথে কথা বলিস কেন?
আম্মু হাসতে হাসতে উঠে চলে গেলেন, আমিও রোদেলার মাথায় আস্তে একটা থাপ্পড় দিয়ে নাশতার টেবিলে এসে বসলাম।

নাশতা সেড়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম, আজ ঘুম থেকে উঠতে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। হিমি হয়তো কলেজে চলে এসেছে তাই বাইক স্পিডে চালাচ্ছি।
শান্ত: আরশান? (বাইক থেকে নামতেই শান্ত ডাক দিলো, আজ ওদের ডাকে সাড়া দিবো না। আগে হিমিকে একনজর দেখে আসি)
আরিয়ান: এই আরশান কোথায় যাচ্ছিস?
আমি: হিমির সাথে দেখা করতে।
শান্ত: হিমি আজ আসেনি। (শান্তর কথা শুনে থমকে দাঁড়ালাম, হিমি এইটা কি করলো?)
অধরা: আহারে আমাদের আরশানের মুখটা একদম চুপসে গেছে। (চুপচাপ এসে ওদের পাশে বসলাম)
শান্ত: হিমি আজ আসবে না।
আমি: কতো তাড়াহুড়ো করে বাইক স্পিডে চালিয়ে আসলাম ওকে দেখবো বলে কিন্তু…
অধরা: হিহিহি…
আমি: তোর পেত্নী মার্কা হাসি বন্ধ কর নাহলে…
সিফাত: আরে রাগ করিস না হিমি তো এখন থেকে তোর বাসাতেই থাকবে রোজ দেখতে পারবি।
আমি: হুম।
সিফাত: আরশান তোর এক্সিডেন্ট এর কথা ভুলে গেছিস? (সিফাতের কথা শুনে ওর দিকে তাকালাম। বাইক স্পিডে চালানোটা আমার বদ অভ্যাস গুলোর মধ্যে একটি। দুবছর আগে এক্সিডেন্ট করে প্রায় এক মাস হসপিটালে ছিলাম, আম্মু তখন কাঁদতে কাঁদতে বাইক চালাতে নিষেধ করেছিলেন)
সিফাত: আন্টি কতো কান্না করেন তোর এই বদ অভ্যাস এর জন্য আর তুই কিনা হিমির জন্য আজ আবার বাইক স্পিডে চালিয়েছিস।
আমি: কিছু হবে না।
শান্ত: সেদিনও বলেছিলি কিছু হবে না তারপর মরতে বসেছিলি।
আরিয়ান: আন্টির কথা ভেবে যা করার করিস।
আমি: হুম।

সবার সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম হঠাৎ চিঠির কথা মনে পড়লো, ওদের তো বলা উচিত।
আমি: জানিস কাল আমার নামে একটা পার্সেল এসেছিল। (আমার কথা শুনে সবাই হাসি ঠাট্টা রেখে আমার দিকে তাকালো)
শান্ত: তো?
আমি: একটা চিঠি আর একটা পায়েল ছিল।
অধরা: পায়েল?
আমি: চিঠিতে হিমিকে নিয়ে কিসব লেখা ছিল আর পায়েলটা নাকি হিমির।
সিফাত: কি লেখা ছিল? (সবকিছু ওদের বললাম, আমার মতো ওরা সবাই চিন্তায় পড়ে গেলো)
আরিয়ান: সব তো শুনলাম আমার মনে হয় এইটা হিমির এক্স বয়ফ্রেন্ড এর কাজ।
শান্ত: এমনো তো হতে পারে হিমিকে কোনো ছেলে লাইক করে আর হিমি পাত্তা দেয়নি যার ফলে ছেলেটা তোকে হুমকি দিচ্ছে।
সিফাত: সবকিছুর উত্তর হিমি দিতে পারবে।
অধরা: পাগল হয়েছিস? এখনি হিমির অতীত ঘাটলে হিমি আরশানের প্রপোজে আর রাজি হবে না কারণ ও ভাববে আরশান ওকে বিশ্বাস করেনা।
শান্ত: ঠিক বলেছিস।
আমি: চিঠির বিষয়টা রহস্যের মতো লাগছে তবুও আমি হিমিকে কোনো প্রশ্ন করবো না, আমি হিমিকে হারাতে চাই না। একটা মানুষের জীবনে অতীত থাকতেই পারে, হিমি যেদিন নিজ থেকে আমাকে ওর অতীত বলবে সেদিন শুনবো এর আগে কোনো প্রশ্ন করবো না। আর হিমির অতীতে যা কিছুই থাকুক সব মেনে নিয়েই আমি ওকে ভালবাসবো।
অধরা: এইতো সত্যিকারের প্রেমিকের মতো কথা, হিমি তোকে কখনো ফিরাবে না দেখিস।
শান্ত: অলরেডি একবার ফিরিয়ে দিয়েছে তো।
সিফাত: তাতে কি হয়েছে আরশান আবার প্রপোজ করবে, কতবার হিমি ফিরিয়ে দিবে?
আরিয়ান: হিমির চিন্তা এবার বাদ দাও ক্লাসে যেতে হবে।
আমি: তোরা যা আমি যাবো না।
অধরা: পড়ালেখায় ফাঁকি দিতে নেই।
আমি: আমার ভালো লাগছে না। (সিফাতের পকেট থেকে জোড় করে সিগারেটের প্যাকেট বের করে আনলাম)
সিফাত: আরশান এখানে?
আমি: বললাম না ভালো লাগছে না। (সিগারেট খুব একটা খাই না কিন্তু যখন প্রচন্ড মাথা যন্ত্রণা করে তখন খাই। চিঠিটা খুব ভাবাচ্ছে আমায়, কেন বললো ও হিমি আমার প্রপোজে রাজি হলে হিমিকে মেরে ফেলবে? আমি নিজের অজান্তে হিমিকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছি নাতো? উফফ হিমির মায়াভরা মুখটা এক নজর দেখতে পারলে সব দুশ্চিন্তা মাথা থেকে চলে যেতো)
আরিয়ান: আরশান?
আমি: হুম।
চোখ বন্ধ করে এসব ভাবছিলাম আর সিগারেট টানছিলাম, আরিয়ানের ডাকে চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। হিমিকে এখনি আসতে হলো? এবার কি করবো? হিমি আমার হাতে থাকা সিগারেটের দিকে তাকিয়ে আছে আর রাগে ফুঁসছে, তাড়াতাড়ি সিগারেট ফেলে দিলাম। শান্তর দিকে রাগি চোখে তাকালাম ও কানে ধরে ইশারায় বলছে কিছু জানেনা।
আমি: হিমি আমিতো সিগারেট খাই না। (হিমি হনহন করে হেটে চলে যাচ্ছে)
তারিন: মেয়েটা ওর ভাইয়াকে কতকিছু বলে বুঝিয়ে কলেজে এসেছে তোমার সাথে দেখা করবে বলে আর তুমি… ধ্যাত তোমার দ্বারা আর যাই হউক প্রেম হবেনা।
আমি: সব দোষ শান্তর, তোকে আমি…
শান্ত: তারিন তো সকালে বলেছিল ওরা আজ আসবে না। কিন্তু পরে যে হিমি তোর সাথে দেখা করার জন্য আসবে সেটা তো আমি জানতাম না।
অধরা: এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন হিমির কাছে যা।
আমি: হুম।

দৌড়ে এসে হিমির সামনে দাঁড়ালাম, হিমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হিমি হয়তো এসব বদ অভ্যাস পছন্দ করে না তাইতো মায়াবী মুখটা এমন মলিন হয়ে গেছে। এখন কি করবো?
আমি: হিমি আ…
হিমি: আমি এসব পছন্দ করিনা।
আমি: ঠিক আছে ছেড়ে দিলাম, সিগারেট ড্রিংক ঝামেলা সবকিছু আজ থেকে ছেড়ে দিলাম। (হিমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, মৃদু হাসলাম)
আমি: তোমার জন্য আমি সব করতে পারি বুঝেছ?
হিমি: আশেপাশে কোথাও নদী আছে? আমাকে একটু নদীর পাড়ে নিয়ে যাবেন?
আমি: হ্যাঁ চলো, কিন্তু তোমাকে এমন আনমনা লাগছে কেন?
হিমি: নাতো।

হিমি আর আমি নদীর পাড়ে পাশাপাশি হাটছি, হিমি মাথা নিচু করে আনমনা হয়ে হাটছে আর আমি ওকে আড়চোখে দেখছি। হিমির চোখেমুখে আজ বিষণ্ণতার চাপ, বুঝতে পারছি না হিমির কি হয়েছে। আর হঠাৎ করে হিমি আমার সাথে এতো দূরে আসলো কেন?
আমি: হিমি একটা প্রশ্ন করবো?
হিমি: হুম।
আমি: তুমি কি আমাকে কিছু বলবে? (হিমি দাঁড়িয়ে পড়লো, আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে)
আমি: না মানে হঠাৎ করে আমার সাথে এখানে এসেছ তো তা…
হিমি: হ্যাঁ বলবো।
আমি: বলো।
হিমি: আপনি আমার সাথে আর যোগাযোগ না করলে খুশি হবো। (হিমির মুখে এই কথা শুনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লাম, হিমির দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছি)
হিমি: আমরা আগামীকাল নতুন বাসায় উঠছি তাই কিছুদিন ভাইয়া আমাকে কলেজে নিয়ে আসবে কারণ ওখানে তো আর তারিন থাকবে না। ভাইয়া কিছু সন্দেহ করুক বা বুঝে যাক তা আমি চাই না, আমি আমার স্বপ্নগুলো পূরণ করতে চাই। আমার স্বপ্ন গুলো ভেঙ্গে দিবেন না প্লিজ! (হিমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, তবে কি হিমি জানেনা ওরা যে আমাদের বাসায় উঠছে? তারিন হয়তো বলেনি সারপ্রাইজ দিবে ভেবে। শুধু কি স্বপ্ন পূরণের জন্য হিমি আমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে? নাকি চিঠির লোকটার ভয়ে?)
হিমি: কি দেখছেন এভাবে? (হিমির দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে এসব ভাবছিলাম, হিমির কথায় বাস্তবে ফিরে আসলাম)
আমি: শুধু কি স্বপ্ন পূরণের জন্য আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছ? নাকি কোনো একজনের ভয়ে? (আমার প্রশ্ন শুনে হিমি চমকে উঠে আমার দিকে তাকালো, হিমির দুচোখে ভয়)
হিমি: মামামাননে?
আমি: কি লুকাচ্ছ আমার থেকে? (দুহাতে হিমির গালে আলতো করে ধরে ওর মুখটা উপড়ে তুললাম, হিমি ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: তুমি কাকে ভয় পাচ্ছ আমি জানিনা তবে এইটুকু বিশ্বাস আমার উপর রাখতে পারো তোমার বিপদের সময় কখনো তোমার হাত ছেড়ে দিবো না। হিমি ভালোবাসা মানে যে শুধু সুখের সময় পাশে থাকবো এইটা নয়…
হিমি: আর কতবার বুঝাব আপনাকে? কিভাবে বুঝালে আপনি আমার সমস্যাটা বুঝবেন? কিভাবে বললে আপনি বিশ্বাস করবেন যে আমি আপনাকে ভালোবাসি না আপনাকে আমার সহ্য হয় না?
আমি: এসব তোমার মনের কথা নয় হিমি, তুমি ভয়ে এসব বলছ। কাকে ভয় পাচ্ছ তুমি কে তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে?
হিমি: আপনি আসলেই একটা খারাপ মানুষ।
হিমি ঝটকা দিয়ে আমার হাত সরিয়ে দিলো, ওর ভয়ার্ত দুচোখে পানি টলমল করছে। সত্যি কি হিমি আমাকে ভালোবাসে না? নাকি চিঠির লোকটার ভয়ে হিমি এমন করছে? হিমির ভয়ার্ত চোখ দুটু দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু কে সেই লোক…

নদীর পাড়ে আনমনা হয়ে বসে পানিতে ঢিল ছুড়ছি আর মাঝেমাঝে হিমিকে দেখছি, হিমি আমার থেকে কিছুটা দূরে নদীর পাড়ে বসে আছে। আমার উপর রাগ করে দূরে বসে আছে আর আমাকেও ওর কাছে যেতে নিষেধ করেছে। এদিকে বিকেল হয়ে আসছে বাসায় যেতে হবে, মেয়েটা এতো অভিমানী কেন?
আমি: হিমি?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: কথাও বলবে না নাকি? (রাগি চোখে আমার দিকে তাকালো, বাহ্ রাগলে তো মায়াবতীকে দারুণ লাগে)
আমি: তুমি জানো রাগ করলে তোমার মায়াবী মুখটা আরো বেশি সুন্দর লাগে।
হিমি: কাছে আসলে একদম গলা টিপে মেরে ফেলবো।
আমি: ঠিক আছে আমি তাহলে চলে যাচ্ছি।
হিমি: আমিতো কিছু ছিনি না আমাকে একা রেখে চলে যাবেন?
আমি: তো কি করবো? বিকেল হয়েছে সে খেয়াল আছে? দেরিতে ফিরলে আমার কোনো প্রবলেম হবে না তোমারই হবে।
হিমি: হুম যাবো তার আগে আপনি কথা দিন আর আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না।
আমি: ভেবে দেখবো।
হিমি: আমি কিন্তু নদীতে ঝাপ দিবো।
আমি: কি? সামান্য বিষয় নিয়ে তুমি…
হিমি: আপনার কাছে সামান্য হতে পারে কিন্তু আমার কাছে সামান্য নয়।
আমি: ঠিক আছে এবার চলো।
হিমি: আর জ্বালাবেন নাতো আমায়? (এবার কি বলবো? এই মেয়ে তো পাগলামি শুরু করেছে)
হিমি: কি হলো?
আমি: আমি নিজ থেকে তোমার কাছে আসবো না কিন্তু যদি তুমি আমার কাছে আসো বা দুজনের অজান্তে দেখা হয়ে যায় তাহলে কিন্তু আর পিছু ছাড়ছি না।
হিমি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চুপচাপ হাটতে শুরু করলো, আমিও হিমির পিছু পিছু হাটছি। হিমির দীঘল কালো চুল গুলো বাতাসে উড়ছে আমি তা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছি আর নিজের অজান্তেই হাসছি। আচ্ছা এই মেয়েটা এতো মায়াবী কেন? ওর সবকিছু আমাকে এমন মাতাল করে দেয় কেন এতো কাছে টানে কেন? এই মায়াবতীটার প্রেমে বারবার পড়তে ইচ্ছে হয় কেন? মায়াবতীকে অনেক বেশি ভালোবাসতে মন চায় কেন? আবোলতাবোল প্রশ্নগুলো ভেবে আনমনেই হেসে উঠলাম।

শান্ত: কিরে দুজন কোথায় গিয়েছিলি? (সবাই এক জায়গাতেই বসে আছে আমিও এসে বসলাম, তারিন হয়তো হিমির জন্য অপেক্ষা করছিল এসে হিমিকে আস্তে আস্তে কি যেন বলছে)
আমি: দুটো ভালোবাসার মানুষ একসাথে কোথায় যায়?
সিফাত: কোথায়?
আমি: কোথায় আবার হানিমোনে। (আমার কথা শুনে সবাই জোরে হেসে উঠলো, হিমি চোখ দুটো আগুনের মতো করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: আরে আমিতো দুষ্টুমি করে বলেছি।
হিমি: আপনি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছেন আর ডিস্টার্ব করবেন না আমাকে।
আরিয়ান: কিরে গাধার মতো এমন কথা দিয়েছিস কেন?
অধরা: তোর প্রেম আর সাকসেসফুল হবে না।
আমি: সাথে কিন্তু আরো একটা কথা বলেছি তুমি যদি আমার কাছে আসো বা দুজনের অজান্তে দেখা হয়ে যায় তাহলে কিন্তু আর পিছু ছাড়বো না। আর আমি জানি তুমি খুব শীঘ্রই আমার কাছে আসবে আমাদের শুভ দৃষ্টিও হবে।
তারিন: হিহিহি!
হিমি: পেত্নীর মতো না হেসে চল তো এখান থেকে। (হিমি তারিনের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে, আমি হিমির দিকে তাকিয়ে আছি আর হাসছি পাগলী একটা)
শান্ত: তুই এই কথা দিয়েছিস ওকে?
আমি: ও পাগলামি করছিল তাই বলেছি। আমার কি মনে হয় জানিস হিমি ভয় পেয়ে আমার প্রপোজে রাজি হচ্ছে না।
সিফাত: কিন্তু কিসের ভয়?
অধরা: হয়তো পরিবার।
আমি: না, চিঠির লোকটাকে হিমি ভয় পায়। মানুষটা কে আমাকে জানতে হবে আর সেটা হিমির থেকেই।
আরিয়ান: কিন্তু কিভাবে?
আমি: জানিনা, কিন্তু চেষ্টা তো করতেই হবে।
সিফাত: খুব ভালোবাসিস হিমিকে তাই না? (সিফাতের কথা শুনে মৃদু হাসলাম)
আমি: এই প্রথম কোনো মেয়েকে ভালোবেসেছি আর সারাজীবন তাকেই ভালোবাসতে চাই।
শান্ত: চিন্তা করিস না তুই সাকসেসফুল হবি কারণ তোর ভালোবাসা সত্যি।
আমি: আসছি আমি, আর হ্যাঁ আগামীকাল আমি আসছি না।
আরিয়ান: কেন?
আমি: কাল হিমি প্রথম আমার বাসায় যাবে বুঝেছিস?
অধরা: তুই সত্যি গেছিস।
হাসতে হাসতে চলে আসলাম, সত্যি আমি হিমির প্রেমে পাগল হয়ে গেছি।

রাতের আকাশে তারা’রা দল বেধে ছুটাছুটি করছে, কখনো এক ফালি মেঘ ভেসে এসে তারাদের ঢেকে দিচ্ছে, আমি বারান্দায় বসে তারা আর মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখছি। হঠাৎ হিমির কথা মনে পড়লো, হিমি যদি এখন আমার পাশে থাকতো তাহলে কেমন হতো? নিশ্চয় মেয়েটা তারা আর মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখে মিটিমিটি হাসতো। হিমি মুগ্ধনয়নে তারা দেখতো আর আমি দেখতাম মুগ্ধনয়নে আমার মায়াবতীকে। আবোলতাবোল ভাবনা গুলো ভেবে নিজের অজান্তেই হাসছি হঠাৎ পাশে রাখা গীটারের দিকে নজর পড়লো। গীটার হাতে নিয়ে টুংটাং সূর তুলতেই কাধে কারো হাতের স্পর্শ পেলাম, পিছনে তাকিয়ে দেখি আম্মু।
আম্মু: কিরে অনেক রাত তো হলো ঘুমাবি না?
আমি: তোমার বৌমার চিন্তায় ঘুম আসছে না।
আম্মু: কাল থেকে তো চোখের সামনেই পাবি সবসময়। (আম্মু হাসছেন দেখে আমিও হাসলাম)
আমি: আম্মু ওকে আমার করে এনে দাও না, বড্ড ভয় হয় ওকে হারানোর।
আম্মু: দুজনেই পড়াশোনা শেষ করো তারপর বিয়ের চিন্তা।
আমি: কিন্তু ওকে হারানোর ভয় যে আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে?
আম্মু: খুব ভালোবাসিস তো তাই এমন ভয় হচ্ছে।
আমি: হয়তো।
আম্মু: যা বলতে এসেছি, আগামীকাল আমরা সবাই বিয়েতে যাচ্ছি তুই যাবি তো? তুই তো হুটহাট না করে দিস তাই তোর আব্বু…
আমি: আম্মু কাল তো হিমিরা আসবে, হিমি আসবে আর আমি ধেইধেই করে বিয়ে খেতে চলে যাবো?
আম্মু: তাতে কি হয়েছে বাসায় তো কাজের লোক গুলো থাকবেই।
আমি: আমার বউ আসবে আর তোমার কাজের লোক গুলো ওকে রিসিভ করবে? আম্মু কাঁদবো কিন্তু।
আম্মু: আচ্ছা থাক যেতে হবে না। কিন্তু তোর আব্বুকে কি বলবো?
আমি: আব্বুর কোনো বন্ধুর বাসায় পার্টি বলো বা বিয়ে কোনো কিছুতে যেতে আমার ভালো লাগেনা আর আব্বু সেটা ভালো করেই জানেন, গিয়ে বলো আমার এসব ভালো লাগেনা।
আম্মু: ঠিক আছে, অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পড়।
আমি: আচ্ছা।
আম্মু চলে গেলেন, আমি চুপচাপ এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। এখন শুধু সকালের অপেক্ষা হিমি আমার কাছে চলে আসবে, রোজ ওর মায়াবী মুখটা দেখতে পারবো এইটা ভাবতেই খুশিতে মনটা নেচে উঠছে।

“আরশান উঠ অনেক বেলা হয়েছে” সকালে দরজায় কারো ঠোকার শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো।
আপু: আরশান?
আমি: হুম আপু।
আপু: উঠ অনেক বেলা হয়েছে। (উঠে দরজা খুলে দিয়ে আবার বিছানায় এসে বসলাম, ঘুম যেন চোখ থেকে যেতেই চাচ্ছে না)
আপু: ভাই এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমালি যে রাতে ঘুম হয়নি নাকি? শরীর ঠিক আছে তো? (আপুর কথা শুনে মাথা তুলে আপুর দিকে তাকালাম, আপুকে দেখে বেশ অবাক হলাম)
আমি: এতো সকালে বিয়েতে চলে যাচ্ছিস নাকি এতো সেজেছিস যে?
আপু: ঘড়ির দিকে থাকা তো। (আপুর কথা শুনে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম, ঘড়ির কাটায় সকাল এগারোটা পঁচিশ বাজে দেখে বেশ অবাক হলাম এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছি আজ?)
আপু: আম্মু ডাকছে নিচে চল।
আমি: হুম।

ঘুম ঘুম চোখে ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় বসলাম। সবাই রেডি, চলে যাবে হয়তো।
আম্মু: আরশান নে ধর বের হলে বাসায় তালা দিয়ে যাবি, এই নতুন দারোয়ানকে একদম বিশ্বাস নেই। (আম্মু আমার হাতে একটা চাবি ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতে পা বাড়ালেন, আবার থমকে দাঁড়ালেন)
আম্মু: আর এইটা তৃতীয় ফ্লোরের চাবি হিমিরা হয়তো বিকেলে আসবে দিয়ে দিস, আমাদের ফিরতে রাত হবে। (হিমি যে আজ আসবে আমিতো ঘুমের ঘোরে ভুলেই গিয়েছিলাম)
আম্মু: কিরে কি বলছি শুনছিস?
আমি: কি?
আম্মু: বিউটি একটু ওদের বস্তিতে গেছে এসে তোর জন্য রান্না করবে, তোর নাশতা টেবিলে রাখা আছে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিস।
আমি: ঠিক আছে।
আব্বু: আরশান যদি আমাদের সাথে যেতো তাহলে তোমাকে শুধু শুধু এতো টেনশন করতে হতো না। (আব্বু টাই বাঁধতে বাঁধতে নিচে নেমে আসছেন)
আমি: আব্বু ভালো করেই জানো এসব আমার পছন্দ না।
আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বেরিয়ে পড়লেন, আব্বুর পিছুপিছু বাকি সবাইও বেরিয়ে পড়লো। আব্বু যেমন উনার বন্ধু গুলোও তেমন যত্তোসব, চুপচাপ দরজা লাগিয়ে রুমে চলে আসলাম।

গোসল করে রুমে আসতেই কলিংবেল এর শব্দ শুনতে পেলাম, কাজের মেয়ে বিউটি এসেছে হয়তো। ভেজা চুল গুলো হাত দিয়ে নাড়তে নাড়তে এসে দরজা খুললাম।
আমি: কিরে তোর এখন আসার…
হিমি: ইহহ! (হিমির চিৎকার শুনে সামনে তাকালাম, হিমি দুহাতে মুখ ঢেকে রেখেছে। হিমিকে দেখে যেন বুকের মধ্যে কেমন হচ্ছে, মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি পিটাচ্ছে, কিন্তু হিমিকে সেটা বুঝতে দেওয়া যাবে না)
আমি: ওহ তুমি, কিন্তু মুখ ঢেকে রেখেছ কেন?
হিমি: তোয়ালে পড়ে কেউ বাইরে আসে? আর আপনি সত্যি সত্যি আমার পিছু নিয়ে আমাদের নতুন বাসায় চলে এসেছেন? (হিমির কথা শুনে নিজের দিকে একবার তাকালাম সত্যিই তো তোয়ালে পড়ে চলে এসেছি)
আমি: কি করবো এমন ভাবে বেল বাজাচ্ছিলে যে চেঞ্জ করার সুযোগই পাইনি।
হিমি: কিন্তু আপনি এই বাসায় কেন আপনিও ভাড়া নিয়ে… (এগিয়ে গিয়ে হিমির মুখ থেকে ওর হাত দুটো সরিয়ে দিলাম। হিমি আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুচকি হেসে ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম…)
আমি: বলেছিলাম না খুব শীঘ্রই দেখা হবে আর শুভ দৃষ্টিও হবে। (হিমি লজ্জা পেয়ে দু চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে ফেললো)
আমি: মেডাম আমি আপনার পিছু পিছু এসে বাসা ভাড়া নেইনি এইটা আমার বাসা আর আপনি তৃতীয় ফ্লোর ভাড়া নিয়েছেন।
হিমি: ভাইয়া যে কি করে, চাবি দিন। (হিমি হাত বাড়াতেই ওর হাত ধরে টান দিয়ে ভিতরে নিয়ে আসলাম ওকে, দরজা লাগিয়ে দিতেই হিমি ভয়ে কেঁপে উঠলো)

হিমি ভয় পেয়ে চোখমুখ কুঁচকে দেয়ালের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছে, আমি দুহাত দেয়ালে রেখে হিমিকে খুব কাছ থেকে দেখছি। এই মেয়েটাকে প্রতিটা মুহূর্তেই মায়াবী লাগে, লজ্জা পেলে, ভয় পেলে আর…
হিমি: চাবি নিতে এসেছি ভাইয়া খুঁজবেন আমাকে।
আমি: আমি কিন্তু তোমার কাছে যাইনি তুমিই এসেছ, মনে আছে তো কি বলেছিলাম?
হিমি: সব আপনার প্ল্যান আমি বুঝে গেছি।
আমি: নিজের বউকে কাছে আনার জন্য এটুকু প্ল্যান তো করতেই হতো। (হিমির কপালে আসা চুল গুলো আলতো করে ওর কানের পাশে গুঁজে দিলাম, হিমি ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে তাকালো)
আমি: ভালোবাসার মানুষকে কেউ ভয় পায় পাগলী?
হিমি: কেন করছেন এরকম?
আমি: ভালোবাসি তাই, তুমি আমাকে ভালো না বাসলে আমি কখনো এমন করতাম না। কিন্তু আমি তোমার দুচোখে আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি।
হিমি: চাবি দিন আমাকে যেতে হবে।
আমি: ওকে। (চুপচাপ মায়াবতীকে কোলে তুলে নিলাম)
হিমি: কি করছেন ছাড়ুন বলছি।
আমি: চাবি আমার রুমে আছে, তুমি প্রথম আমার রুমে পা রাখবে…
হিমি: তাই বলে…
আমি: নড়াচড়া করলে কিন্তু পড়ে যাবে। (হিমি ভয় পেয়ে দুহাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো)
হিমি: আমাকে ছাড়ুন প্লিজ ভাইয়া আমাকে খুঁজবে।
আমি: জানো মায়াবতী আজ তোমাকে রিসিভ করার জন্য অনেক আয়োজন করতে ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু তোমার ভাইয়ার ভয়ে কিছু করতে পারিনি, ভাইয়া সন্দেহ করলে তো তুমি কষ্ট পাবে তাই। (হিমিকে আমার রুমে এনে নামিয়ে দিলাম, ও রুমের চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। চাবি এনে হিমির সামনে ধরলাম, ও আমার দিকে মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে আছে)
আমি: এইযে মেডাম চাবি।
হিমি: বাসার বাকি সবাই কোথায়?
আমি: বিয়েতে গেছে।
হিমি: আপনি যাননি কেন?
আমি: আমি চলে গেলে তোমাকে চাবি কে দিত? (হিমি কিছু না বলে চুপচাপ চাবি নিয়ে চলে যেতে পা বাড়ালো)
আমি: মায়াবতী তুমি কিন্তু আজ আবারো প্রমাণ করে দিয়েছ তুমি যে আমায় ভালোবাস। (আমার কথা শুনে হিমি ভ্রু কুঁচকে পিছন ফিরে তাকালো)
আমি: ভালো না বাসলে যখন তোমাকে দেয়ালে চেপে ধরেছিলাম তখন তুমি চিৎকার করতে কিন্তু তুমি করনি, যখন কোলে তুলে নিয়েছিলাম তখন তুমি রেগে যেতে পারতে কিন্তু তুমি রাগনি তারমানে সামথিং সামথিং…
হিমি লজ্জা পেয়ে দৌড়ে চলে গেলো, ভালোবাসে কিন্তু প্রকাশ করতে চায় না উল্টো দূরে সরিয়ে রাখতে চায় ভীতুর ডিম একটা।

পরন্ত বিকেল, বাগানের দোলনায় বসে আনমনা হয়ে বই এর পৃষ্ঠা উল্টিয়ে যাচ্ছি একের পর এক আর হিমির কথা ভাবছি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো কিন্তু এতো সময়ের মধ্যে হিমিকে একবারো দেখতে পারলাম না, হিমি হয়তো জিনিসপত্র গুছাতে ব্যস্ত আছে। কিন্তু একবার তো দেখা দিতে পারতো ও কি জানে না এতো প্ল্যান করে ওদের এখানে এনেছি শুধু ওকে দেখবো বলে? এই মেয়েটা না… হঠাৎ হিমিদের ফ্লোরে চোখ আটকে গেলো, হিমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল গুলো মুছছে। আমি হা হয়ে তাকিয়ে আছি ওর লম্বা চুল গুলোর দিকে। হঠাৎ হিমির নজর আমার উপর পড়লো, আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
আমি: হিমি?
হিমি: কি?
আমি: আমার রুমে এসো। (হিমি মাথা নেড়ে না করলো)
আমি: তাহলে আমি তোমার রুমে আসছি।
হিমি: না না ভাইয়া আছে।
আমি: তাহলে এসো।
হিমি অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকালো আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে হাত দিয়ে ইশারা করে আমার রুমে আসতে বললাম।

দরজা খুলে ড্রয়িংরুমে বসে হিমির জন্য অপেক্ষা করছি, হঠাৎ হিমি হন্তদন্ত হয়ে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। রাগে গজগজ করে আমার দিকে এগিয়ে আসলো।
হিমি: আমাকে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করবেন বলে প্ল্যান করে এ বাসায় এনেছেন? এভাবে হুটহাট… (উঠে এসে হিমির মুখ চেপে ধরলাম)
আমি: তুমি জানোনা তোমাকে না দেখলে যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে? এতো সময়ের মধ্যে একবারো দেখা দেওনি কেন? তুমি জানো আমি কতক্ষণ ধরে ছটফট করছি তোমাকে এক নজর দেখবো বলে? (হিমি বেশ অবাক হয়ে ওর মুখ থেকে আমার হাত সরিয়ে দিলো)
হিমি: এতোটা ভালোবাসেন? কিন্তু এই অল্প কয়েকদিনে এতো বেশি ভালোবাসলেন কিভাবে? (হিমির কথা শুনে মৃদু হাসলাম)
আমি: জানো হিমি আমার কাছে এই প্রেম ভালোবাসা এক্সট্রা একটা পেইন মনে হতো যার কারণে কখনো কাউকে ভালোবাসিনি, এভাবে হুট করে প্রথম দেখায় কাউকে এতোটা ভালোবেসে ফেলবো সেটাও কখনো ভাবিনি। ভালোবাসা বোধহয় এমনই ভেবে চিন্তে করা যায় না হুট করে এক পলকের দেখায় হয়ে যায়। কাউকে কখনো ভালবাসবো না এইটা বারবার ভাবার পরও হঠাৎ করে মনের অজান্তে কাউকে ভালোবেসে ফেলাটাই হয়তো ভালোবাসার নিয়ম, যেমনটা তোমার ক্ষেত্রে হয়েছে। (হিমি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: তুমি বারবার ভেবেছ আমাকে ভালোবাসবে না কিন্তু দেখো তোমার অজান্তেই তোমার মনে আমি জায়গা করে নিয়েছি। হিমি ভালোবাসা লুকানো যায় না এইটা নিজের অজান্তেই প্রকাশ হয়ে যায়, তুমি যে আমায় ভালোবাস এইটা কিন্তু বারবার তুমি নিজের অজান্তে প্রকাশ করে ফেলেছ। হিমি ভালোবাস কিন্তু দূরে সরিয়ে রাখছ কেন? নিজেও কষ্ট পাচ্ছ আমাকেও কষ্টের আগুনে পুড়ে মারছ। (হিমি মাথা নিচু করে ফেললো ওর দুচোখ থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। হিমির তুথুনি ধরে ওর মুখটা উপড়ে তুলে আলতো হাতে ওর দুচোখের পানি মুছে দিলাম, হিমি বাচ্চা মেয়েদের মতো কেঁদেই যাচ্ছে)
আমি: কাঁদলে তোমার নিচের ঠোঁট কাঁপে আর এমন কাদের হয় জানো? ছোট বাচ্চাদের, তারমানে আমার মায়াবতী ছোট…
হিমি: আপনি খুব দুষ্টু।
হিমি চলে যেতে চাইলো তাড়াতাড়ি ওর হাত ধরে ফেললাম, হিমি পিছন ফিরে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। মুচকি হেসে হিমির হাত ধরে টান দিয়ে ওকে আমার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম। হিমি একটা হাত আমার বুকের বাম পাশে রেখে আমার বুকের সাথে মিশে রইলো। এখন তো খুশিতে আমার দুচোখ দিয়ে পানি ঝরছে, শেষ পর্যন্ত মায়াবতীটাকে আমার করেই নিলাম। হিমির দুগালে ধরে ওর চোখের দিকে তাকালাম। হিমি পলকবিহীন ভাবে আমার দুচোখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে মুচকি হেসে ওর কপালে আমার ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিলাম…

হিমি আমার সামনে লজ্জামাখা মুখে মাথা নিচু করে বসে আছে আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর ভেজা চুল গুলো দেখছি। হিমি রেশমি কালো লম্বা চুল গুলো কাধের এক পাশে এনে রেখেছে, চুল থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। ভেজা চুলে কোনো নারীকে এতোটা স্নিগ্ধ লাগে হিমিকে না দেখলে জানা হতো না।
হিমি: এইযে? (এক পলকে হিমির ভেজা চুল দেখছিলাম হঠাৎ হিমির ডাকে স্তম্ভিত ফিরে পেলাম, হিমির দিকে তাকালাম)
হিমি: অনেকক্ষণ ধরে তো বসিয়ে রেখেছেন এবার যাই ভাইয়া খুঁজছেন হয়তো।
আমি: তোমাকে যতো দেখি ততোই যেন দেখার ইচ্ছেটা আরো বেড়ে যায়, তৃষ্ণা মিটে না।
হিমি: ধ্যাত যাই আমি।
আমি: একবার তো ভালোবাসি শব্দটা বলে যাও।
হিমি: বলবো না, এতটুকুও ভালোবাসি না। (হিমি হাসতে হাসতে চলে যেতে পা বাড়ালো, ওর হাত ধরে ফেললাম)
আমি: বেশি ভালোবাসতে হবে না শুধু ততোটুকু বেসো যতোটুকু তোমার এই দীঘল কালো চুল গুলোকে বাস।
হিমি আমার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে দৌড়ে চলে গেলো।

আম্মু: আরশান আসবো? (সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে বই পড়ছিলাম হঠাৎ আম্মুর কন্ঠ শুনে উঠে বসলাম, আম্মু দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন)
আমি: হ্যাঁ আম্মু এসো, কখন ফিরেছ তোমরা?
আম্মু: এইতো কিছুক্ষণ হলো। আজ সন্ধ্যার সময় পড়তে বসলি যে?
আমি: এমনি।
আম্মু: হিমিরা এসেছে?
আমি: হ্যাঁ, তোমার বৌমার সাথে কথাও হয়েছে।
আম্মু: রাজি হয়েছে?
আমি: এখনো মুখে কিছু বলেনি তবে আচরণে বুঝিয়ে দিয়েছে ভালোবাসে।
আম্মু: আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি: আম্মু তুমি হিমির আম্মু আর ভাবির সাথে মিশে যাওনা হিমি যেন বারবার আমাদের ফ্ল্যাটে আসতে পারে।
আম্মু: পাগল ছেলে ঠিক আছে।
আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমি আবার সোফায় শুতে যাবো তখনি টেবিলে রাখা পায়েলের দিকে নজর পড়লো। উঠে এসে পায়েলটা হাতে নিলাম, এই পার্সেল কে পাঠিয়েছিল চিঠির মানুষটা কে তাতো আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে। কিন্তু কিভাবে খুঁজবো সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

রাত বারোটা, ছাদে বসে গীটার বাজাচ্ছি। এইটা আমার খুব পুরনো বদ অভ্যাস, আমার কাছে অভ্যাস কিন্তু আম্মুর কাছে বদ অভ্যাস আরকি। আসলে মায়েরা এমনই হয় সবকিছুতে ছেলে মেয়ের ক্ষতি হবে ভেবে… হঠাৎ একটা ছায়া দেখে চমকে উঠে গীটার রেখে পিছন ফিরে তাকালাম। এতো রাতে আমি ছাড়া তো ছাদে কেউ আসেনা, কে আসতে পারে? উঠে দাঁড়াতেই জোছনার আবছা আলোতে হিমিকে দেখতে পেলাম, আমি তাকিয়ে আছি বুঝতে পেরে হিমি চলে যেতে চাইলো। দৌড়ে এসে হিমির হাত ধরলাম, হিমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি: হিমি?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: এতো রাতে ছাদে কি করছিলে? আর এসেছিলে যখন আমার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন আমাকে ডাকোনি কেন?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: হিমি তাকাও আমার দিকে। (হিমির গালে ধরে ওর মুখটা উপড়ে তুলতেই চমকে উঠলাম, হিমি কাঁদছে? জোছনার আবছা আলোতে ওর দুচোখের পানি চিকচিক করছে, কিন্তু এতো রাতে ও কাঁদছে কেন?)
আমি: হিমি কি হয়েছে বলো আমাকে তুমি কাঁদতেছ কেন?
হিমি: হাত ছাড়ুন।
আমি: ছাড়বো না, প্লিজ লক্ষীটি বলো কাঁদছ কেন? আচ্ছা তুমি কি আবার ভয় পেয়ে কাঁদতেছ?
হিমি: কি বলবো? আপনার জিদের জন্য ভাইয়া আর আম্মু আমাকে কতো বকলো। তখন যদি জিদ করে আমাকে বসিয়ে না রাখতেন তাহলে ভাইয়া আমাকে বকার সুযোগই পেতো না। নতুন জায়গা, এতো সময় কোথায় ছিলাম জিজ্ঞেস করেই বকতে শুরু করেছিল। (আমিতো ভেবেছিলাম হিমি চিঠির লোকটার ভয়ে কাঁদছে, যাক বাঁচলাম হিমির এই ভয়টা কাটিয়ে তুলতে পারলেই হবে)
হিমি: হাত ছাড়ুন।
আমি: কেঁদো না প্লিজ! আচ্ছা ভাইয়া কি বকতে পারেনা?
হিমি: শুধু কি বকেছে ভাইয়া তো বলেছে আমিও বড় আ… (হিমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো, কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে)
আমি: কি বলো।
হিমি: কিছুনা।
আমি: কি লুকাচ্ছ?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: তুমি না একটা রহস্যে ঘেরা মানুষ, তোমাকে আমি একদম বুঝতে পারি না।
হিমি: বুঝার চেষ্টা না করলেই তো পারেন। (হিমি চলে যেতে চাইলো ওকে টেনে আমার কাছে এনে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরলাম)
আমি: সরি আর জিদ করবো না, এবারের মতো ক্ষমা করে দাও।
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: এতো রাতে ছাদে এসেছ ভাইয়া যদি দেখ…
হিমি: ভাইয়া ঘুমে।
আমি: যাও ঘুমিয়ে পড়ো গিয়ে।
হিমি: আপনি যান আমি এখানে বসবো কিছুক্ষণ।
আমি: তোমাকে একা ছাদে রেখে আমি চলে যাবো?
হিমি: তাহলে বসে থাকুন।
হিমি আমার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে ছাদের এক কোণায় গিয়ে বসলো, আমিও পিছু পিছু এসে ওর পাশে বসলাম।

হিমি আনমনা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, আমি হিমিকে দেখছি আর ভাবছি এই মেয়েটা কেমন যেন রহস্যময়ী, আমি একদম বুঝতে পারিনা ওকে।
হিমি: ছোটবেলায় শুনতাম মানুষ মারা গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়, আচ্ছা কথাটা কি সত্যি?
আমি: এসব মানুষ এমনি বলে।
হিমি: তবুও তো দূর আকাশের তারা দেখে মারা যাওয়া প্রিয় মানুষ গুলোকে অনুভব করা যায় মনে প্রশান্তি পাওয়া যায়। আচ্ছা হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষকে কি রাতের আকাশের তারায় অনুভব করা যায়? এতো বড় পৃথিবীতে কি এমন কিছু নেই যা দেখে হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষটাকে অনুভব করবো? (হিমি আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে আনমনে প্রশ্নটা করলো, আমি ওর এমন প্রশ্ন শুনে থমথম খেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। হিমি কেন এমন প্রশ্ন করলো? কে হারিয়ে গেছে ওর জীবন থেকে? কোন প্রিয় মানুষের জন্য হিমির দুচোখ দিয়ে পানি ঝরছে?)
হিমি: জানেন তো প্রিয় মানুষ জীবন থেকে হারিয়ে গেলে বড্ড কষ্ট হয় বুকের বা পাশে চাপা ব্যথা অনুভব হয়। (হিমি কথা গুলো বলতে বলতে আমার দিকে তাকালো, আমাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকিয়ে হালকা একটা ধাক্কা দিলো)
আমি: কে হারিয়ে গেছে তোমার জীবন থেকে? (হিমি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কোনো উত্তর না দিয়ে আবারো তারা দেখায় মন দিলো। হিমি কার কথা বলছে? তবে কি ও কাউকে ভালোবাসে?)
হিমি: ভাবছেন এই মেয়েটা সবসময় এমন রহস্যজনক কথা বলে কেন তাইতো?
আমি: সত্যি তুমি রহস্যময়ী।
হিমি: আমি অন্যদের মতো খুব সহজে ভিতরের কথা গুলো বলে ফেলতে পারিনা, কিছুটা বারণ আর কিছুটা ভয় আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।
আমি: কিসের ভয়? (হিমি কোনো উত্তর দিলো না, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো)
হিমি: আসি।
হিমি চলে যাচ্ছে আমি অপলক চোখে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। হিমির বলা কথা গুলো ভাবছি কিন্তু কোনো কিছু বুঝতে পারছি না, সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে।

রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। মাথায় হাজারটা প্রশ্ন এসে হানা দিচ্ছে, সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু প্রশ্ন গুলোর উত্তর যে শুধু হিমিই দিতে পারবে। হিমি তখন কারো কথা বলতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল, কার কথা বলতে চেয়েছিল হিমি? কোন প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণায় হিমি রাতের আধারে চোখের পানি ঝরায়? আচ্ছা চিঠির মানুষটা হিমির প্রিয় মানুষ নয়তো? আমি হিমিকে ভালোবেসে কোনো ভুল করিনি তো? দুহাতে মাথা চেপে ধরলাম, প্রশ্ন গুলো বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে কেমন যেন গোলকধাঁধার মধ্যে আটকে গেছি আমি।

সকালে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেলো, চারপাশে চোখ বুলিয়ে বিছানায় বসলাম। রাতে হিমির কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতেই পারিনি। কিন্তু এভাবে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেলো কেন? মাথায় টেনশন থাকলে বোধহয় এমনই হয়। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল আনলাম, সকাল দশটা সতেরো বাজে।
আপু: আরশান আরশান? (হঠাৎ আপুর ডাকে চমকে উঠলাম, আপু এমন ভয় পেয়ে ডাকছে কেন?)
আপু: ভাই দরজা খুল।
আমি: আসছি। (দরজা খুলে দিতেই আপু হকচকিয়ে রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো)
আমি: আপু কি হয়েছে তুমি এতো ভয় পেয়ে আছ কেন?
আপু: ভাই… (আপু আমার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলো)
আমি: কিসের কাগজ আপু?
আপু: চিঠি।
আমি: আবার?
আপু: সাথে এগুলো। (আপুর হাতে দুটো কানের দোল, নিশ্চয় হিমির হবে)
আপু: কিছুক্ষণ আগে কলিংবেল এর শব্দ শুনে আমি দরজা খুলতে যাই, পার্সেল দেখে আমি কুরিয়ার সার্ভিসের লোকটাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো তখনি আব্বু চলে আসেন। একটুর জন্য চিঠিটা আব্বুর হাতে পড়েনি, আরশান আব্বু কিন্তু তোকে সন্দেহ করছেন।
আমি: তো? আপু তুমি ভালো করে জানো এই লোকটাকে আমি ভালোও বাসি না ভয়ও পাই না।
আপু: ছিঃ ভাই এসব বলতে নেই উনি আমাদের বাবা। আব্বু যা করেন আমাদের ভালোর জন্য করেন।
আমি: তুমি কি আব্বুর হয়ে সাফাই গাইতে এসেছ?
আপু: না আমি এসেছি তোকে কড়া ভাষায় একটা কথা বলে দিতে।
আমি: কি?
আপু: তুই হিমিকে ভুলে যা। (আপুর মুখে এমন কথা শুনে বেশ অবাক হলাম, যে আপু সবসময় আমাকে সাপোর্ট করে সে আজ হঠাৎ এমন কথা বলছে?)
আমি: আপু তোমার মাথা ঠিক আছে? তুমিতো জানো আমি হিমিকে ভালোবাসি।
আপু: যে ভালোবাসা মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে যায় সে ভালোবাসার কোনো প্রয়োজন নেই।
আমি: মানে?
আপু: আজকের চিঠিটা পড়। আমি জানিনা লোকটা কে, তবে এইটুকু বুঝতে পারছি তুই হিমির সাথে থাকলে কখনো সুখী হবি না।
আমি: একটা অচেনা অজানা লোকের ভয়ে আমি হিমিকে ভুলে যাবো? এইটা কখনো হয় আপু?
আপু: তাহলে কখন ভুলবি যখন লোকটা তোকে মেরে ফেলবে তখন?
আমি: মরতে হলে মরবো কিন্তু হিমিকে ভুলে যাওয়া ইম্পসিবল।
আপু: ভাই?
আপুর হাত থেকে চিঠি আর কানের দোল দুটো এনে টেবিলে রাখলাম, আপুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে আসলাম।

আব্বু: আরশান? (নাশতার টেবিলে বসে ফোন টিপছিলাম হঠাৎ আব্বুর ডাকে পাশ ফিরে তাকালাম, আব্বু সোফায় বসা আর আমার ফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন। ফোনটা পকেটে রেখে খাবার খাওয়ায় মন দিলাম)
আব্বু: আজকাল তোমার নামে পার্সেল আসছে, তুমি কিছু বলছও না। শুধু এইটুকু বলি যা করো সাবধানে করো তোমার যেন কোনো ক্ষতি নাহয়।
আমি: (নিশ্চুপ)
আব্বু: আমি আর তোমার চাচ্চু কিছুক্ষণ পর চলে যাবো, ব্যবসার কাজে কিছুদিনের জন্য ব্যাংকক যাচ্ছি। এই কয়েকদিনের মধ্যে কোনো বিপদ ঘটিয়ে ফেলো না। আর হ্যাঁ কোনো ভুল কাজ করার আগে তোমার আম্মুর কথাটা মাথায় রেখো, তোমার আম্মুকে তো আর কম কাঁদাওনি।
আম্মু: থাক না এসব কথা ছেলেটা খেতে বসেছে।
আব্বু: তোমার ছেলের হাবভাব আমার ভালো লাগছে না সন্দেহ হচ্ছে, কিছু হলে তো কান্নাকাটি শুরু করে দিবে তাই আগেই সাবধান করছি।
আম্মু: আরশান এখন বড় হয়েছে নিজের ভালো নিজে বুঝে তুমি এতো চিন্তা করো না।
আব্বু: দুবছর আগে কি ও ছোট ছিল? (আব্বুর এই প্রশ্নে আম্মু চুপসে গেলেন, চুপচাপ চেয়ার টেনে আমার পাশে বসলেন। আমি নিশ্চুপ হয়ে ওদের কথা শুনছি আর খাবার খাচ্ছি)
আম্মু: আরশান তোর আব্বু কি কিছু সন্দেহ করেছেন হিমির ব্যাপারে? (আম্মুর প্রশ্ন শুনে পাশ ফিরে তাকালাম, আব্বু নেই চলে গেছেন)
আম্মু: তোর আব্বু চলে গেছেন নির্ভয়ে বল।
আমি: বোধহয়।
আম্মু: তোর কোনো পছন্দকে আমি কখনো অপছন্দ করিনি আর হিমিকে তো আমিও পছন্দ করেছি। দেখিস বাবা হিমির জন্য যেন তোর কোনো ক্ষতি না হয়ে যায়।
আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। খাবার আর গলা দিয়ে নামছে না, নিশ্চুপ হয়ে বসে আছি। আম্মুকে বা আপুকে কি করে বলি আমার মনেও যে এখন প্রশ্ন জাগছে, হিমিকে ভালোবেসে আমি কোনো ভুল করিনি তো?

বারান্দার রেলিং এ হাত রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আর হিমির কথা ভাবছি, হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখি তারিন ফোন করেছে, রিসিভ করলাম।
আমি: হ্যালো।
তারিন: আরশান ভাইয়া?
আমি: হুম তারিন বলো।
তারিন: ভাইয়া… (তারিন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, শান্তর কিছু হয়নি তো?)
আমি: কি হয়েছে তারিন শান্ত ঠিক আছে তো?
তারিন: না, ভাইয়া এক্সিডেন্ট করেছে।
আমি: কি? কিভাবে?
তারিন: সকালে ভাইয়া টিউশনিতে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল, তার আধা ঘন্টা পর হবে হঠাৎ হসপিটাল থেকে ফোন আসে। ভাইয়ার এখনো জ্ঞান ফিরেনি।
আমি: ঠিক আছে আমি আসছি।
ফোন রেখে তাড়াতাড়ি হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

আঙ্কেল, আন্টি, তারিন কাঁদছে আর পাশে আরিয়ান সিফাত বসা। আমাকে দেখে সিফাত এগিয়ে আসলো।
সিফাত: আরশান?
আমি: শান্ত কেমন আছে?
সিফাত: এখনো জ্ঞান ফিরেনি।
আরিয়ান: আরশান ওদিকে চল। (আরিয়ান আমার হাত ধরে টেনে আঙ্কেল আন্টির থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে আসলো)
আমি: কি?
আরিয়ান: শান্ত কোথায় টিউশনি পড়ায় জানিস?
আমি: নাতো।
আরিয়ান: আরে ও যে বাসায় যায় সেখানে যেতে বড় রাস্তায় যাওয়ার কোনো প্রয়োজন হয় না ছোট গলি দিয়ে যাওয়া যায়।
আমি: তো?
আরিয়ান: একবার ভেবে দেখ ছোট গলি রাস্তায় শান্ত এক্সিডেন্ট করবে কিভাবে?
সিফাত: তাইতো।
তারিন: ভাইয়ার জ্ঞান ফিরেছে। (তারিনের কথা শুনে সবাই শান্তর কেবিনের দিকে ছুটলাম)

শান্তর কপালে আর পায়ে ব্যান্ডেজ, পায়ের ব্যান্ডেজ দেখে তো মনে হচ্ছে পায়ে বেশি আঘাত পেয়েছে।
আন্টি: শান্ত এক্সিডেন্ট করলি কিভাবে তুই তো অসাবধানে চলার ছেলে না।
আঙ্কেল: এতোদিন তো সন্ধ্যার পর টিউশনিতে যেতিস আজ হঠাৎ সকাল বেলায় কেন? এতোদিন ধরে টিউশনি করাস কখনো তো এমন কিছু হয়নি।
শান্ত: তোমরা অজতা টেনশন করছ, আমি টিউশনি শেষে আসার পথে এমন হয়েছে। আচ্ছা এক্সিডেন্ট কি বলে হয়? হঠাৎই তো হয়ে যায়।
আমি: শান্ত তুই… (শান্ত ইশারায় আমাকে কথা বলতে নিষেধ করলো, শান্ত কি যেন লুকাতে চাইছে)
শান্ত: আব্বু তুমি আম্মুকে নিয়ে বাসায় যাও ওরা তো সবাই আছে এখানে।
আন্টি: আমি তোকে রেখে কোথাও যাবো না।
সিফাত: শান্ত আন্টিকে তোর কাছে থাকতে দে উনার মনের অবস্থা বুঝ একবার।
শান্ত: হুম।

সারা দুপুর শান্তর পাশে থেকে এখন বাসায় ফিরলাম। কলিংবেল চাপতেই আম্মু এসে দরজা খুলে দিলেন।
আম্মু: সেই সকালে বেরিয়েছিলি এই বিকেলবেলা তোর ফেরার সময় হলো? ফোন করেছিলাম রিসিভ করিসনি কেন?
আমি: ব্যস্ত ছিলাম। (ভিতরে ঢুকতেই ড্রয়িংরুমে হিমি আর দুজন মহিলাকে দেখতে পেলাম, হিমির আম্মু আর ভাবি হবে হয়তো। হিমি আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
রোদেলা: ভাইয়া?
আমি: হুম।
রোদেলা: ও হিমি আমার ফ্রেন্ড, আর উনারা হিমির আম্মু আর ভাবি।
আন্টি আর ভাবিকে সালাম করে হিমির দিকে এক নজর তাকিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। শান্তর এক্সিডেন্টের কথাটা মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। বারবার একটা প্রশ্নই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, এইটা কি সত্যিই এক্সিডেন্ট?

রোদেলা: ভাইয়া? (রুমে এসে শার্টের বোতাম খুলছিলাম রোদেলার ডাক শুনে পিছন ফিরে তাকালাম, হিমি আর রোদেলা দাঁড়িয়ে আছে)
রোদেলা: হিমি তোমার সাথে কথা বলতে চায় তাই নিয়ে আসলাম।
আমি: হিমি কি বলো। (হিমি রোদেলার দিকে তাকালো রোদেলা মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো)
আমি: এবার বলো।
হিমি: আপনি…
আমি: তুমি একটু বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
হিমি: ঠিক আছে।
হিমির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ফ্রেশ হতে চলে আসলাম। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিতেই হঠাৎ হিমির চিৎকার শুনে চমকে উঠলাম। দৌড়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রুমে আসলাম, হিমি অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে। হিমির হাতে পায়েলটা, পাশে কানের দোল দুটো ফ্লোরে পড়ে আছে। তাহলে কি হিমি এই পায়েল আর কানের দোল দেখে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে? কিন্তু কেন…

ফ্লোরে বসে হিমির মাথা আমার কোলে নিয়ে ওকে ডাকছি কিন্তু হিমি সাড়া দিচ্ছে না, অজ্ঞান হয়ে আছে। আমিতো বুঝতে পারছি না এগুলো দেখে হিমি এতোটা ভয় কেন ফেলো? একেবারে সেন্স হারিয়ে ফেললো।
আমি: হিমি কথা বলো প্লিজ!
রোদেলা: ভাইয়া কি হয়েছে? (রোদেলা সহ বাসার সবাই আমার রুমে আসলো, হিমির আম্মু ফ্লোরে বসে হিমিকে ডাকছেন)
আম্মু: আরশান কি হয়েছে হঠাৎ মেয়েটা জ্ঞান হারালো কেন?
আপু: হিমির চিৎকার বাগান থেকে শুনা গেছে আমিতো আনিলাকে নিয়ে ওখানেই ছিলাম।
আমি: জানিনা কি হয়েছে আমিতো ওয়াশরুমে ছিলাম, হঠাৎ ওর চিৎকার শুনে এসে দেখি জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে। আমার মনে হচ্ছে ও খুব ভয় পেয়েছে।
ভাবি: কিছু হবে না, কেউ একটু পানি দাও তো। (রোদেলা পানির গ্লাস এনে দিতেই ভাবি হিমির চোখেমুখে পানির ছিটা দিলেন, সাথে সাথে হিমির জ্ঞান ফিরে আসলো। হিমি মিটমিট করে প্রথমে আমার দিকে তাকালো আর লাফ দিয়ে উঠে বসে আবারো চিৎকার করলো)
আমি: হিমি কি হয়েছে?
ভাবি: হিমি কি হয়েছে বলো।
আন্টি: হিমি কি হয়েছে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি কিভাবে?
আমি: হিমি? (আমার ডাক শুনে হিমি ভয়ে চুপসে গিয়ে ভাবির গলা জড়িয়ে ধরলো তারপর আমার দিকে তাকালো)
হিমি: কে তুমি? (আমাকে উদ্দেশ্য করে হিমি প্রশ্নটা করলো, ওর এমন প্রশ্ন শুনে সবাই বেশ অবাক হলাম)
আন্টি: হিমি ও এই বাসার ছেলে, আমরা ওদের…
হিমি: ও অভিনয় করছে সব অভিনয় করছে। (হিমি ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই পায়েল আর কানের দোল দেখে যদি হিমি ভয় পেয়ে থাকে তাহলে এখন আবার দেখলে ও আবারো ভয় পাবে। আমি পায়েলটা হিমির সামনে ধরলাম সাথে সাথে হিমি দুচোখ বন্ধ করে ভাবিকে জড়িয়ে ধরলো। হিমি চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে)
ভাবি: মা হিমিকে রুমে নিয়ে যেতে হবে।
আম্মু: আরশান তুই ওকে দিয়ে আয় তো বাবা।
আমি: ঠিক আছে আম্মু।
হিমিকে কোলে তুলে নিলাম, দুহাত ছড়িয়ে হিমি চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে যাচ্ছে।

হিমির রুমে এনে ওকে বিছানায় শুয়ে দিলাম। হিমির মাথার পাশে বসে আছি অপর পাশে ভাবি বসা।
আপু: আমার মনে হয় এখানে ভীড় করা ঠিক হবে না, সবাই ড্রয়িংরুমে চলো। (আপু সবাইকে নিয়ে চলে গেলো। দুহাতে মাথা চেপে ধরে হিমির পাশে বসে আছি। কি যে হচ্ছে এসব কিছুই বুঝতে পারছি না)
আনিলা: আম্মু ফুপির কি হয়েছে?
ভাবি: কিছু হয়নি মামুনি একটু পর ফুপি ঠিক হয়ে যাবে।
আনিলা: এই আঙ্কেলটা কে? (আনিলার প্রশ্ন শুনে ওর দিকে তাকালাম, তিন-চার বছরের ছোট বাচ্চা মেয়ে দেখতে খুব মিষ্টি)
ভাবি: মামুনি তুমি খেলতে যাও।
আনিলা: আচ্ছা। (আনিলা দৌড়ে চলে গেলো। আমি হিমির দিকে তাকাতে গিয়ে ভাবির দিকে চোখ পড়লো, ভাবি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন)
ভাবি: কে তুমি?
আমি: মামামনেনে?
ভাবি: তুমি কি শুধু বাড়িওয়ালার ছেলে? নাকি আমি যা সন্দেহ করছি তা সত্যি?
আমি: কি?
ভাবি: হিমি তোমার রুমে কেন গিয়েছিল? ভয় ফেলো কেন হিমি?
আমি: ভাবি…
ভাবি: আমি দেখেছি হিমি অজ্ঞান হয়ে যাওয়াতে তুমি খুব ভয় পেয়েছিলে আর এই ভয়টা এখনো তোমার চোখেমুখে ফুটে আছে। হিমির মাথা তোমার কোলে নিয়ে ওকে পাগলের মতো ডাকছিলে, হিমির এই অবস্থা দেখে তুমি অস্থির হয়ে পড়েছিলে আর এই অস্থিরতাটা এখনো তোমার মাঝে আছে। কেন?
আমি: (নিশ্চুপ)
ভাবি: শুধু বাড়িওয়ালার ছেলে হলে তুমি হিমির কষ্টে কষ্ট পেতে না, তুমি হিমিকে ভালোবাস আর তোমার ভালোবাসা সত্যি। (ভাবির কথা শুনে চমকে উঠে উনার দিকে তাকালাম)
ভাবি: সত্যিকারের ভালোবাসা নাহলে তুমি এতোটা অস্থির হতে না। ভালোবাস?
আমি: হ্যাঁ।
ভাবি: ঠিক ধরেছি আমি। হিমি বাসে?
আমি: এখনো মুখে কিছু বলেনি। ভাবি প্লিজ এই কথাটা এখনি কাউকে জানাবেন না।
ভাবি: ঠিক আছে। কিন্তু হিমির ভাইয়া হয়তো মেনে নিবে না।
আমি: তখন নাহয় দেখা যাবে, আপনি আমাকে এইটা বলুন হিমির কি আগে কখনো এমন হয়েছিল?
ভাবি: মাঝেমাঝে হিমি ভয় পায়, অনেক সময় একা বসে থাকে কি যেন ভাবে চোখমুখে ভয়ের চাপ থাকে। কিন্তু এতোটা কখনো হয়নি।
আমি: কি যে হচ্ছে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আচ্ছা ভাবি ভাইয়া কোথায়?
ভাবি: ও তো দুপুরেই রাঙামাটি চলে গেছে।
আমি: ওহ!
হিমি: পানি পানি… (হিমি পানি চাইতেই ভাবি পানির গ্লাস এনে আমার হাতে দিলেন, আমি হিমিকে পানি খাওয়ালাম। হিমি চোখ খুলে তাকিয়ে আমাকে দেখে কেঁপে উঠলো)
আমি: হিমি ভয় পেয়ো না প্লিজ! আমি আরশান তোমার আরশান।
ভাবি: হিমি কেন ভয় পাচ্ছ ও তো তোমাকে ভালোবাসে। (হিমি আমার দিকে তাকালো তারপর উঠে বসার চেষ্টা করলো, হিমি আধশোয়া হতেই ওকে জড়িয়ে ধরে ওর মাথাটা আমার বুকে রাখলাম। হিমির এমন অবস্থা দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে, ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদি)
ভাবি: তোমরা কথা বলো আমি হিমির জন্য দুধ গরম করে নিয়ে আসি।
আমি: ভাবি ডক্টর ডাকবো?
হিমি: না আমি ঠিক আছি। (হিমির কথা শুনে ভাবি চলে গেলেন, হিমি মাথাটা আমার বুকে আরো গুঁজে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো)
আমি: হিমি?
হিমি: হুম।
আমি: তখন এতো ভয় পাচ্ছিলে কেন? আমাকেও ভয় পাচ্ছিলে, কই এখন তো আর আমাকে ভয় পাচ্ছ না।
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: আমাকে সবকিছু বলো প্লিজ!
হিমি: বলবো কিন্তু এখন নয়।
আমি: ঠিক আছে।
হিমি বাচ্চা মেয়েদের মতো আমার বুকের সাথে মিশে আছে। কিছুক্ষণ আগের হিমি আর এখনের হিমির মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। এখনের হিমিটা শান্তশিষ্ট হয়ে আমার বুকে শুয়ে আছে, যেন আমিই ওর সবকিছু। হিমির চুলে হাত বুলাচ্ছি আর ভাবছি কি করবো কিভাবে জানবো সবকিছু? হিমির এমন কষ্ট যে আমি সহ্য করতে পারছি না, আমারো বড্ড কষ্ট হচ্ছে।

হঠাৎ হিমি আমাকে ছেড়ে উঠে বসলো, আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি: কিছু বলবে?
হিমি: পায়েল আর কানের দোল আপনি কোথায় পেলেন? তাহলে কি সেদিন আপনিও…
আমি: কি?
হিমি: কোথায় পেয়েছেন বলুন।
আমি: আসলে হিমি…
হিমি: পায়েল আর কানের দোল দুটো আমার আর এগুলো ছিনতে আমি তিল পরিমাণও ভুল করিনি। যেহেতু এগুলো আমার তাই আমার থেকে কিছু লুকাবেন না প্লিজ!
আমি: হিমি আমার কাছে দুটো পার্সেল এসেছিল।
হিমি: পার্সেল?
আমি: হ্যাঁ, প্রথম পার্সেলে ছিল একটি চিঠি আর পায়েল আর দ্বিতীয় পার্সেলে ছিল একটি চিঠি আর কানের দোল।
হিমি: চিঠিতে কি লেখা ছিল? (হিমির এই প্রশ্নে আমি থমথম খেয়ে গেলাম, ভাবছি বলবো কিনা। হিমি অল্পতেই খুব ভয় পায়, এখন যদি জানতে পারে চিঠির লোকটা আমাকে হুমকি দিয়েছে হিমিকে মেরে ফেলবে বলেছে তাহলে তো হিমি আরো বেশি ভয় পেয়ে যাবে)
হিমি: বলবেন কিনা তাই ভাবছেন? জিনিসগুলো যেহেতু আমার তারমানে চিঠির সাথেও আমার নাম জড়িয়ে আছে, আমার থেকে না লুকিয়ে বলুন প্লিজ!
আমি: হুম।

হিমিকে চিঠিতে যা যা লেখা ছিল সব বললাম, হিমি সব শুনে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।
আমি: তুমি ভয় পেয়ো না আমাকে সবকিছু বলো আমি সব সামলে নিবো।
হিমি: কি বলবো?
আমি: এইযে তুমি সবসময় এতো ভয় পাও কেন? আর আজ পায়েল আর কানের দোল দেখে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে কেন? কে তোমাকে এভাবে ভয় দেখা…
হিমি: আপনাকে এসব বলতে যাবো কেন? আপনি কে?
আমি: মানে?
হিমি: আপনি তো আমার কেউ না তাহলে আপনাকে আমার ব্যক্তিগত কথা বলতে যাবো কেন? হ্যাঁ মানছি আপনি আমাকে ভালোবাসেন কিন্তু আমিতো বাসি না। আপনি আমাকে ভালোবাসেন বলে যে আমার সবকিছু আপনাকে বলতে হবে এর তো কোনো মানে নেই। এমন এক তরফা ভালোবাসা অনেকেই বাসে, তাই বলে কি সবাইকে সবকিছু বলতে হবে? (হিমির মুখে এসব কথা শুনে আমি যেন বোবা হয়ে গেলাম, কি বলছে হিমি এসব? আমার ভালোবাসা এক তরফা?)
ভাবি: হিমি এসব কি হচ্ছে? তুমি জানো ও তোমাকে কতোটা ভালোবাসে? তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে বলে ও কতোটা অস্থির হয়েছিল আমি দেখেছি।
হিমি: তো? আমি কি বলেছি আমার জন্য ভাবতে বা অস্থির হতে?
ভাবি: হিমি তোমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে।
আমি: ভাবি বাদ দিন। হিমি তো ঠিকই বলেছে আমার ভালোবাসা এক তরফা, হিমি তো একবারের জন্যও আমাকে ভালোবাসি শব্দটা বলেনি। আমিই ভুল ছিলাম, আমি অধিকার দেখিয়ে ওর কাছে সবকিছু জানতে চেয়েছিলাম। আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম যেখানে ভালোবাসাটা এক তরফা সেখানে অধিকার শব্দটা বেমানান।
ভাবি: দিলে তো ছেলেটাকে কাঁদিয়ে?
চুপচাপ হিমির রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। হিমি আমার সাথে এভাবে কথা বলবে আমি কখনো ভাবিনি। হিমির আচরণে মনে হয়েছিল ও আমাকে ভালোবাসে কিন্তু আমি সম্পূর্ণ ভুল ছিলাম, হিমির মনে আমার জন্য এতটুকুও ভালোবাসা নেই। আমি এতোদিন ভুলের জগতে বাস করছিলাম, সব ভুল সব মিথ্যে মনে হচ্ছে এখন।

রুমে এসে ঢুকতেই ফ্লোরে পড়ে থাকা পায়েল আর কানের দোল দেখতে পেলাম, এগুলো হাতে নিয়ে ভাবছি কি রহস্য আছে এগুলোর আড়ালে? হঠাৎ টেবিলে রাখা চিঠির দিকে নজর পড়লো, আজকের চিঠিটা তো পড়া হয়নি। চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।
“আবারো তোকে চিঠি লিখতে হবে ভাবিনি। সেদিনের হুমকিতে কাজ হয়নি না? সব মিথ্যে মনে হচ্ছে? শেষ পর্যন্ত হিমিকে তোর বাসায় নিয়ে গেলি, এর শাস্তি তো তোকে পেতেই হবে। হিমির জন্য আমি সব করতে পারি আর আজকে এর একটা নমুনা তোকে আমি দেখাবো, তৈরি থাকিস কষ্ট সহ্য করার জন্য। আজকের পর হিমির দিকে নজর দিলে পরের ঝড়টা তোর উপর দিয়ে যাবে”
রাগে চিঠিটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললাম। আজকের চিঠি পড়ে তো এইটা নিশ্চিত হলাম যে এসব করছে সে হিমিকে ভালোবাসে আর আমাদের উপর সবসময় নজরও রাখছে। কিন্তু ও এইটা কেন বললো আজ একটা নমুনা দেখাবে আমি যেন কষ্ট সহ্য করার জন্য তৈরি থাকি? কি করবে ও কার ক্ষতি করবে? হঠাৎ শান্তর এক্সিডেন্ট এর কথা মনে পড়লো, তবে কি শান্তর এক্সিডেন্ট… দৌড়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে ছুটলাম, যে মেয়ে আমাকে ভালোবাসে না তার জন্য আমার বন্ধু গুলো কষ্ট পাবে তাতো হতে পারে না।
চাঁচি: আরশান কোথায় যাচ্ছিস এভাবে?
আমি: আসছি চাঁচি।
চাঁচি: তোর আম্মু বকবে তাড়াহুড়ো করে যাস না।
আমি: কিছু হবে না।
চাঁচি: ঠিক আছে যা কিন্তু বাইক নিস না ভয় হয়।
আমি: আম্মুকে বলো না প্লিজ! আমি সাবধানে যাবো আর শান্তকে দেখেই ফিরে আসবো।
চাঁচি: এই সন্ধ্যাবেলায়…
চাঁচির বাকি কথা না শুনে বেরিয়ে আসলাম।

শান্ত শুয়ে আছে পাশে তারিন আর আরিয়ান বসা। শান্তর পাশে এসে চেয়ার টেনে বসলাম।
তারিন: ভাইয়া আরশান ভাইয়া এসেছে। (তারিনের কথা শুনে শান্ত চোখ মেলে তাকালো, আমাকে দেখে একটুখানি হাসলো)
শান্ত: এসেছিস?
আমি: সরি এতক্ষণ আসতে পারিনি আসলে হিমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।
তারিন: হিমি? কি হয়েছে হিমির?
আমি: এসব অনেক কথা পড়ে বলবো, শান্তর সাথে প্রয়োজন আছে তুমি একটু বাইরে যাও তো।
তারিন: ঠিক আছে।
শান্ত: কি হয়েছে রে?
আমি: এখন কেমন আছিস?
শান্ত: পা’টা বোধহয় ভেঙ্গেই গেছে।
আরিয়ান: ওকে জিজ্ঞেস কর এক্সিডেন্ট কিভাবে হয়েছে।
আমি: হ্যাঁ সেটা জানতেই এসেছি।
শান্ত: আমি তোদের সকালেই বলতাম কিন্তু আব্বু আম্মু থাকার কারণে বলতে পারিনি কারণ এসব শুনলে আব্বু তোদের সাথে থাকতে নিষেধ করবে, জানিসই তো তোদের ছাড়া থাকা সম্ভব না।
আমি: কি হয়েছিল বল।
শান্ত: গতকাল আমি টিউশনিতে যেতে পারিনি, আজ ভাবলাম সকালে পড়িয়ে আসি। বাসা থেকে বের হতেই মনে হয়েছিল কেউ আমাকে ফলো করছে, দুটো বাইক প্রায় আমার পিছু পিছু যাচ্ছিল। আমি ছোট গলিতে যাওয়া মাত্র একটা বাইক আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় আর একটা বাইক আমার পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়। আমার মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছে করে এইটা করেছে।
আরিয়ান: কিন্তু কে করবে আমাদের তো কোনো শত্রু নেই।
আমি: আছে, হিমির শত্রু এখন আমাদের শত্রু হয়ে গেছে। আমি হিমিকে ভুলে যাবো।
আরিয়ান: ভুলে যাবি মানে?
আমি: একটা মেয়ের ভালোবাসার জন্য আমি তোদের হারাতে পারবো না।
শান্ত: পাগল হয়ে গেছিস কি বলছিস এসব? আমরা তো জানি তুই হিমিকে কতোটা ভালোবাসিস।
আমি: কিন্তু হিমি তো বাসে না, যে মেয়ে আমাকে ভালোই বাসে না তার জন্য আমার বন্ধুরা বিপদে পড়বে কেন? আজ চিঠিতে লোকটা ইঙ্গিত দিয়েছিল আর সেটাই করেছে ও।
শান্ত: তোর জীবনে যেমন আমাদের প্রয়োজন তেমনি হিমিকেও প্রয়োজন কারণ তুই হিমিকে ভালোবাসিস। আর ভালোবাসায় বাধা থাকবেই অজতা…
আমি: বাধা? পরিবারের বাধা হলে মানা যেতো, ছিনি না জানিনা অচেনা অজানা এক লোক আমার ক্ষতি করে যাচ্ছে আর হিমি কিছু বলছে না আমাকে। হিমি আমাকে উল্টো কি বলেছে জানিস? আমার ভালোবাসা নাকি এক তরফা, আমার নাকি অধিকার নেই ওর সবকিছু জানার।
আরিয়ান: হয়তো রেগে গিয়ে বলেছে। সামান্য একটা ঝড়ে ভালোবাসা ভুলে যাবি?
আমি: শান্তর পা ভেঙ্গে গেছে ও হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে এইটাকে সামান্য ঝড় বলছিস?
শান্ত: হ্যাঁ সামান্যই। আর তো কারো ক্ষতি করেনি আমার ক্ষতি করেছে কারণ হিমিকে তোর কাছে এনে দিতে আমি হেল্প করেছি। আরশান বন্ধুর জন্য এইটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারবো না?
আরিয়ান: পাগলামি করিস না যা হবার তো হয়েই গেছে, তুই হিমিকে ভুলে গেলে তো শান্ত সুস্থ হয়ে যাবে না। আমরা জানি তুই হিমিকে অনেক বেশি ভালোবাসিস ওকে ভুলতে পারবি না উল্টো কান্নাকাটি করবি।
শান্ত: আর আমরা তোর কান্না সহ্য করতে পারবো না। বললি না হিমি অসুস্থ? বাসায় যা এখানে তারিন আর আরিয়ান আছে।
আরিয়ান: হিমি এখনো রাজি হয়নি তুই যদি এভাবে হুটহাট রেগে যাস তাহলে তো প্রেমটাই হবে না। আমরা তো তোদের বিয়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
শান্ত: হ্যাঁ আমরা তিনজন মিলে তোদের বাসর সাজাবো।
আমি: হসপিটালের বেডে শুয়েও ফাজলামি ছাড়িস নি।
শান্ত: হ্যাঁ এবার যা।
আমি: ঠিক আছে।
শান্ত আর আরিয়ানের থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম।

হিমির পাশে বসে আছি, হিমি ঘুমুচ্ছে। আমি মুগ্ধনয়নে ওর ঘুমন্ত মায়াবী মুখ দেখছি। হঠাৎ কাধে কারো হাতের স্পর্শে পিছন ফিরে তাকালাম।
আমি: ভাবি?
ভাবি: দেখা হয়েছে এবার যাও মা দেখে ফেললে প্রবলেম হবে। (মুচকি হাসলাম, ভাবি যদি আসার সুযোগ করে না দিতো তাহলে আজ আর হিমিকে দেখা হতো না। বাসায় ফিরেই ভাবির কাছে এসে পারমিশন নিয়েছিলাম)
আমি: ঠিক আছে চলে যাচ্ছি, হিমিকে দেখে রাখবেন কিন্তু।
ভাবি: বিয়ের আগেই এতো কিছু? আমার ননদ তো খুব ভাগ্যবতী।
মৃদু হেসে চলে আসার জন্য পা বাড়ালাম, হঠাৎ হিমির পড়ার টেবিলে চোখ আটকে গেলো। দুটো ডায়েরী রাখা, সাদা রঙের ডায়েরীটার ভিতরে কলম রাখা তারমানে আজ বা গতকাল এই ডায়েরীতে হিমি কিছু লিখেছিল।
আমি: ভাবি ডায়েরীটা নিয়ে যাচ্ছি হিমি যেন না জানে।
ভাবি: ডায়েরী দিয়ে কি করবে?
আমি: আমি যে প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজছি সেগুলো হয়তো এই ডায়েরীতে পেয়ে যাবো।
ভাবি: ঠিক আছে।
ডায়েরীটা হাতে নিলাম, হতে পারে এই ডায়েরী থেকে সব রহস্য জানতে পারবো…

ফ্রেশ হয়ে ডায়েরীটা হাতে নিয়ে বিছানায় এসে আধশোয়া হয়ে বসলাম। জানিনা এই ডায়েরীতে কি আছে তবে মন বলছে কিছু তো অন্তত পাবো। ডায়েরীর প্রথম পৃষ্ঠা উল্টালাম সাথে সাথে দরজায় টোকা পড়লো, ডায়েরী বন্ধ করে এসে দরজা খুললাম।
আমি: ওহ আপু তুই।
আপু: ভাই খাবি চল।
আমি: না ভালো লাগছে না।
আপু: আম্মুকে ডাকবো?
আমি: আম্মুকে কেন ডা…
আপু: ওটা কিসের ডায়েরী? (বিছানায় রাখা হিমির ডায়েরীর দিকে আপু ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো)
আমি: হিমির।
আপু: ও এজন্যই তুমি খাবে না, ডায়েরী পড়বে রাত জেগে? পড়াচ্ছি।
আমি: আপু ডায়েরী নিচ্ছিস কেন?
আপু: খাবার খেয়ে এসে চুপচাপ ঘুমাবি, সারাদিন অনেক ছুটাছুটি করেছিস। আর ডায়েরী সকালে নিস আমার থেকে।
আমি: আপু…
আপু: আগে তোর খাওয়া ঘুম ঠিকমতো হবে তারপর অন্যকিছু।
আপু ডায়েরীটা নিয়ে চলে গেলো ধ্যাত। এখন যা কিছুই বলি আপু সকালের আগে ডায়েরী দিবে না কারণ আপুর কাছে সবকিছুর আগে আমার সুস্থ থাকা। আমি একটু অসুস্থ হলে সবার আগে আপু অস্থির হয়ে পড়ে। অবশ্য সব ভাইয়ের জন্যই বোনরা এমন অস্থির হয়, এটাই হয়তো ভালোবাসা।

আম্মু: আরশান তোর আব্বু জিজ্ঞেস করছিল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে কি করবি, বাহিরে পড়তে যাবি নাকি…
আমি: এইটাও আব্বু ঠিক করে দিবেন? (খাবার খেতে বসে এসব শুনলে মাথাটাই গরম হয়ে যায়। সবকিছু আব্বুর ইচ্ছেমত করতে হবে আমাদের ইচ্ছের কোনো দাম নেই। পড়াশুনার ব্যাপারে তো অন্তত ছেলেমেয়েদের স্বাধীনতা দেওয়া প্রয়োজন, জোড় করে চাপিয়ে দিলে কি পড়াশোনা করা যায়?)
আম্মু: কি করবি বল তোর আব্বু চায়…
আমি: ব্যবসা সামলাই তাইতো? তোমাদের কথামতো তো আদিত্য নাচে ওকে দিয়ে ব্যবসা সামলাও না আমাকে কেন টানছ? শুনো আম্মু আমি স্পষ্ট ভাবে বলে দিচ্ছি আমার যা মন চাইবে আমি তা করবো আমার উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করো না।
আম্মু: আমিতো তোদের স্বাধীনতা দিতে চাই কিন্তু তোদের আব্বু…
আমি: আপুর উপর ঠিক এভাবে পড়াশুনা চাপিয়ে দিয়েছিলে, আপু হতে চেয়েছিল ডক্টর কিন্তু আব্বুর চাই অন্যকিছু। শেষ পর্যন্ত কি হলো আপু রাগে পড়াশুনাটাই ছেড়ে দিলো। কেন আম্মু আমরা নিজের ইচ্ছেমত পড়াশুনাটাও কি করতে পারবো না?
আম্মু: তোর আব্বু ফারিয়ার বিয়ের কথা ভাবছেন। (এবার রাগটা চরমে উঠে গেলো, আব্বু ছেলে ঠিক করা মানে কোনো এক ব্যবসায়ীর ছেলে ধরে আনবেন যার কাছে ভালোবাসার কোনো মূল্য থাকবে না থাকবে ব্যবসার মূল্য)
আম্মু: কিরে কিছু বলছিস না যে?
আমি: আপুর মতামত নিয়ে তবেই বিয়ে ঠিক করো, আপুর চোখে পানি দেখলে বিয়ে ভেঙ্গে যাবে মনে রেখো।
চাঁচি: আরশান তোর আব্বু আর চাচ্চু তো তোদের ভালোর জন্যই সবকিছু করে।
আমি: যে ভালো থাকায় আমাদের স্বাধীনতা থাকে না সে ভালো থাকা আমরা চাই না।
চাঁচি: তোর মুখেই এসব কথা শুনি শুধু, কই আমার আদিত্য তো এসব বলে না।
আমি: তোমার আদিত্য খুব ভালো ছেলে তাই বলে না আর আমিতো বখাটে।
আম্মু: আরশান খাবারটা খেয়ে যা।
রাগে চলে আসলাম। আমাদের মতামত না নিয়ে আব্বুর কোনো কিছু করাটাকে আমি একদম পছন্দ করিনা। আমার মতে ছেলেমেয়েকে পূর্ণ স্বাধিনতা দেওয়া উচিত। স্বাধীনতা পেয়ে যদি ভালো কাজে না লাগায় উচ্ছন্নে যায় তবেই শাসন করা প্রয়োজন। কিন্তু আব্বু তো সবসময় তার ইচ্ছেটাকে আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যা আমার একদমই পছন্দ না।

ভোরবেলা কারো গুণগুণ শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো, ঘুম ঘুম চোখে মোবাইল এনে দেখি ছয়টা বাজে, এতো সকালে কে গুণগুণ করছে? উঠে বসে কান পেতে শুনলাম হিমির কন্ঠ, ওর মিষ্টি কন্ঠ শুনে ঘুম উড়ে গেলো। আরেকটু স্পষ্ট ভাবে শুনার জন্য বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, হিমির মিষ্টি কন্ঠ সাথে শীতল বাতাস বইছে দারুণ একটা মুহূর্ত। আমি মুগ্ধ হয়ে হিমির গুণগুণ শব্দ শুনছিলাম, হিমির গুণগুণ করাটা এবার গানে রূপ নিলো…
আমারও পরানও যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো…
আমারও পরাণও যাহা চায়!

তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই কিছু নাই গো…
আমারও পরানও যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো…
আমারও পরানও যাহা চায়!

তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখেরও সন্ধানে যাও
তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখেরও সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়ও মাঝে
আরও কিছু নাহি চাই গো!

আমারও পরানও যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো…
আমারও পরানও যাহা চায়!

যাহ্ থেমে গেলো? আমি কতো মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম আর মায়াবতীটা গান বন্ধ করে দিলো?
আপু: ভাই? (হঠাৎ আপুর ডাকে দরজা খুলতে আসলাম)
আপু: এইনে তোর ডায়েরী আর সাথে এক মগ কফি ফ্রি।
আমি: থ্যাংকইউ।
আপু: ভাই তোর হিমি তো খুব সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত গায়।
আমি: তুই শুনেছিস?
আপু: হ্যাঁ আমিতো সকালবেলা বাগানে গিয়ে বসি, হঠাৎ শুনলাম হিমি গান গাইছে। তোকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হিমির গান শুনতে দেখলাম আর তাই কফি নিয়ে আসলাম।
আমি: তুই তো এই মিষ্টি মেয়েটাকে ভুলে যেতে বলেছিলি।
আপু: কি করবো বল তোর বিপদ হবে জেনেও কি চুপ থাকতে পারি?
আমি: ভালোবাসায় এমন ছোটখাটো বিপদ আসবেই আপু, এসবে ভয় পেলে ভালোবাসা জয় করবো কিভাবে?
আপু: তা ঠিক। আমি কিন্তু এখন আর হিমিকে ভুলতে বলবো না। (আপুর দিকে ভ্রু কুঁচকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম, আপু আমার হাতে থাকা ডায়েরীর দিকে তাকিয়ে হাসছে)
আমি: হাসছিস কেন?
আপু: আমি কিন্তু বেশি কিছু পড়িনি শুধু প্রথম পৃষ্ঠা পড়েছি।
আপু মুখ টিপে হেসে চলে গেলো, আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ডায়েরীর দিকে তাকিয়ে আছি। কি এমন লেখা আছে এই ডায়েরীতে যে আপু এভাবে হাসলো?

ডায়েরী নিয়ে বারান্দায় এসে চেয়ারে বসলাম, কফির মগে চুমুক দিতে দিতে ডায়েরীর পৃষ্ঠা উল্টালাম। প্রথম পৃষ্ঠায় আমার নাম দেখে বেশ অবাক হলাম, আগ্রহ নিয়ে পরের পৃষ্ঠা উল্টালাম।

“গল্পতে পড়েছি, সিনেমায় দেখেছি প্রথম দেখায় ভালোবাসা হতে। কিন্তু আমার জীবনেও যে এমন কিছু ঘটবে তা কখনো কল্পনাও করিনি। এভাবে হুট করে কোনো একজন আমার জীবনে আসবে আর আমার মনের ভিতরটা তোলপাড় করে দিবে কখনো ভাবিই নি। অতীতের সবকিছু ভুলে আমি সেই মানুষটিকে মনের অজান্তে হৃদয়ে জায়গা দিবো সেটাও ভাবিনি। মানুষের ভাবনার মধ্যে তো সবকিছু সবসময় থাকে না তাই হয়তো মনের অজান্তে তাকে প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছি। আর ভালবাসবো নাই বা কেন? এমন পুরুষ তো প্রতিটা নারীর স্বপ্নের পুরুষ হয়। সেই প্রথম দেখা, সে দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল পরনে ছিল হলুদ পাঞ্জাবী, চুল গুলো বাতাসে হেলেদুলে উড়ছিল, ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা চাপ দাড়ি যা ওর সৌন্দর্য কে বাড়িয়ে দিয়েছিল দ্বিগুণ। তার গভীর চোখ দুটো আটকে ছিল আমার দিকে। অবশ্য আমিতো সেদিন বুঝতেই পারিনি তাকে যে আমি প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছি, সেদিন কেন তারপর ঘটে যাওয়া কাহিনী গুলো থেকেও বুঝতে পারিনি সে আমার মনে কতটা জায়গা করে নিয়েছিল। বুঝতে পারছি আজ সে যখন তার শহরে ফিরে গেলো। এক পৃথিবী সমান শূন্যতা যেন আজ আমাকে গ্রাস করে নিয়েছে, বার বার মন তার কাছে ছুটে যেতে চাইছে। ভালোবাসা বোধহয় এমনি কাছে থাকলে প্রিয় মানুষটির মর্ম বুঝা যায় না আর যখন প্রিয় মানুষটি চোখের আড়াল হয়ে যায় তখন বুকের ভিতরটা কেমন যেন হাহাকার করে, মনের ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়, হৃদয়ের অনুভূতি গুলো সব এলোমেলো হয়ে যায় আর এটাই হয়তো সত্যিকারের ভালোবাসা”

“মায়াবতী, জানিনা সে এই কালো মেয়ের মধ্যে কি এমন দেখেছে যে প্রথম দিনই আমাকে মায়াবতী বলে সম্বোধন করেছে। আচ্ছা আমি কি আসলেই কারো মায়াবতী হওয়ার যোগ্য? জানিনা, আমি সত্যি জানিনা সে আমার মধ্যে কি দেখেছে আর কেন মায়াবতী বলে ডেকেছে। তবে হ্যাঁ তার মুখে মায়াবতী নামটা শুনতে একটু বেশিই ভালো লাগে আমার”

“এই কয়েকদিনের ছোট ছোট অনুভূতি গুলো আমি কখনো ভুলবো না। হলুদ পাঞ্জাবীতে তাকে প্রথম দেখা, তাকে ভয় পেয়ে কাজলের কৌটো ফেলে রেখে আমার দৌড়ে পালানো। মাঝরাতে তার চোখ দুটো আমাকে পাগলের মতো খুঁজেছিল আর অবশেষে আমাকে বাগানে দেখে তার মুখে এক ফালি হাসি ফুটেছিল। আর ভোররাতে? তাকে পুকুড়পাড়ে ড্রিংক করতে দেখেছিলাম। ইচ্ছে হয়েছিল কষিয়ে দুটো থাপ্পড় দিয়ে বলি ড্রিংক করা ভালো না কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছিল সে ড্রিংক করলে আমার কি আমি কেন কষ্ট পাচ্ছি? আশ্চর্য হয়েছিলাম তখন যখন দেখেছিলাম সে আমাকে দেখে ভয়ে ড্রিংক এর গ্লাস পুকুড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল, হাহাহা পাগল একটা”

“সেই স্নিগ্ধ সকালে তাকে আবারো দেখা। বেখেয়ালি মনে চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছিলাম বুঝতেই পারিনি সে আমাকে লুকিয়ে দেখছে। বুঝেছিলাম তখন যখন তার বন্ধুর ডাকে সে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। তারপর তার মিষ্টি কন্ঠে গান। শুনেছিলাম একটা মানুষ কখনো সবদিকে পারফেক্ট হয় না কিন্তু আমার মনে হয় সে সবদিকে পারফেক্ট, যেমন তার সৌন্দর্য তেমনি তার হাসি আর তেমনি তার মিষ্টি কন্ঠ”

“আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে বেলী ফুলের মালা গাঁথার চেষ্টা করছিলাম হঠাৎ আয়নায় তাকে দেখে চমকে উঠি, তার চোখ দুটো দেখে বুঝেছিলাম সে আমাকে পাগলের মতো খুঁজছিল। আমাকে পেয়ে সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল আর আমাকে অপলক ভাবে দেখছিল। তাকে দেখলেই মনের ভিতর কেমন যেন একটা করতো ভয় পেতাম বড্ড বেশি আর তাই তখন পালিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে আসতে দেয়নি, আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিল, কথা আছে। আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কি কথা? তার প্রশ্ন ছিল আমার নাম কি। মুহূর্তেই আমার ভয় কেটে মুখে হাসি ফুটেছিল কারণ সেতো আমার নাম জানতো। তারপর? তারপরের অনুভূতি তো আমি কখনোই ভুলতে পারবো না, জিদ ধরে আমার চুলে তার বেলী ফুলের মালা গেঁথে দেওয়া আর তারপর এক অদ্ভুত মুগ্ধতায় আমার দিকে তার চেয়ে থাকা। সে তখন চলে গিয়েও আবার ফিরে এসেছিল আমি ভয় পেয়েছিলাম, সে আমার কানেকানে বলেছিল ‘এই দীঘল কালো চুল গুলো এভাবে ছেড়ে রেখো না কারো নজর লেগে যাবে’ হাহাহা পাগল একটা”

“স্মৃতিময় রাত দুটোর কথা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। প্রথম রাত, হুট করে সে রাতের আধারে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বড্ড ভয় পেয়েছিলাম কারণ পুকুরপাড়ে কেউ আমাদের দুজনকে একসাথে দেখলে আমার গায়ে কলঙ্গের দাগ লেগে যেতো। সে তখন আমাকে তার ভালোবাসার কথা বলেছিল আমি পাত্তা দেইনি, বেশ অবাক হয়েছিলাম যখন সে বলেছিল আমি রাজি নাহলে নিজের ক্ষতি করবে। এমন পাগলও হয় সেটা আমি তখন বুঝিনি। তারপর হঠাৎ বড় ভাইয়ার ওদিকে আসা, ভয় পেয়ে তার টিশার্ট খামছে ধরে তার বুকে মুখ গুঁজেছিলাম আর সে আমাকে পরম যত্নে বুকের সাথে আগলে রেখেছিল। যখন বুঝতে পেরেছিলাম আমি তার বুকের সাথে লেপ্টে আছি তখন লজ্জায় তার দিকে তাকাতে পারিনি কিন্তু সে আমার লজ্জা দূর করার জন্য আমাকে তার কাছে টেনে নিয়েছিল। তারপর? ওড়না টেনে এনে আমার মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিয়েছিল, দুজন দুজনের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিলাম”

“সেই সন্ধ্যাটা আমি কখনো ভুলবো না, আমার জীবনে সে দিনটা স্মৃতিময় হয়ে থাকবে আরশান আমার জীবনে থাকুক বা না থাকুক। আরশান আমাকে প্রপোজ করার জন্য কতো কি আয়োজন করেছিল, ডায়মন্ড এর রিং দিয়ে প্রপোজ করেছিল। কিন্তু আমি তার প্রপোজ রাখতে পারিনি, বড্ড ভয় পেয়েছিলাম কারণ সে তো শহরের ছেলে যদি কখনো ছেড়ে চলে যায়? সারাজীবন গ্রামের এই সাধারণ মেয়েটাকে সে মনে রাখবে কিনা সেই প্রশ্নটা আমার মাথায় তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল। ফিরিয়ে দিয়েছিলাম তাকে, জানি সে খুব কষ্ট পেয়েছিল”

“দ্বিতীয় রাত, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনা হয়ে বৃষ্টি স্পর্শ করছিলাম আর কাঁদছিলাম, জানিনা সেদিন রাতে কেন আমার এতো কান্না পেয়েছিল। হঠাৎ তার আগমন, চলে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে পিছু ডাকে। আমি কাঁদছি বুঝতে পেরে সে অস্থির হয়ে পড়ে, একটা সময় রেগে গিয়ে আমার হাত চেপে ধরে। কাঁচের চুড়ি গুলো ভেঙ্গে হাতে বিধে গিয়েছিল, দৌড়ে চলে এসেছিলাম সেখান থেকে। আমার হাত কেটেছে বুঝতে পেরে সে পাগলের মতো ছুটে আমার রুমে এসেছিল, পরম যত্নে হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিল। সেদিন তার দুচোখে পানি ছিল, আমার কষ্টে তারও কষ্ট হচ্ছিল। সে চলে গিয়েও আবার ফিরে এসেছিল, আমাকে বুকের সাথে ঝাপটে ধরেছিল। আমি তার বুকের সাথে লেপ্টে ছিলাম, ইচ্ছে হচ্ছিল এ বুকে মাথা রেখে কাটিয়ে দেই সহস্র বছর। সে চলে গিয়েছিল আর স্মৃতি হিসেবে নিয়ে গিয়েছিল আমার চুড়ি গুলো”

“সকালে সে শহরে ফিরে যাওয়ার সময় তার দুচোখ বারবার আমাকে খুঁজছিল কিন্তু পায়নি কারণ আমিতো গাছের আড়াল থেকে তাকে দেখছিলাম। আজ বুঝতে পারছি তাকে আমি ভালোবাসি, শুধু ভালোই বাসি না বড্ড বেশিই ভালোবাসি। কিন্তু আমি এইটাও বুঝতে পারছি আমার এই ভালোবাসা কখনো প্রকাশ করতে পারবো না, অপূর্ণ থেকে যাবে। কারণ ভয় হয় আমার সে যদি ফিরে আসে? আমার আরশানের যদি কোনো ক্ষতি করে”

“সে যদি ফিরে আসে” লেখাটা দেখে চমকে উঠলাম, হিমি কাকে ভয় পাচ্ছে? এতো ভালোবাসে অথচ বারবার আমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। ডায়েরীর পৃষ্ঠা উল্টালাম আরো অনেক কিছু লেখা আছে কিন্তু এখন আর পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না, হিমির কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। ডায়েরী হাতে নিয়ে এক প্রকার দৌড়েই হিমির রুমের দিকে ছুটলাম।

হিমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল রুমে কেউ এসেছে বুঝতে পেরে পিছন ফিরে তাকালো আর আমাকে দেখে চমকে উঠলো।
হিমি: আপনি? আমার রুমে কেন এসেছেন আম্মু দেখলে প্রবলেম হবে। (ডায়েরীটা পিছনে লুকিয়ে হিমির কাছে এসে দাঁড়ালাম)
আমি: হিমি আমি তোমাকে ভালোবাসি এসব কিছুর ভয় পাই না আমি।
হিমি: কতবার বলবো আমি আপনাকে ভালোবাসি না, যান তো এখান থেকে।
আমি: সত্যি ভালোবাস না?
হিমি: বললাম তো না।
আমি: ভেবে বলছ তো? (এবার হিমি আমার দিকে তাকালো, আমি ডায়েরীটা হিমির সামনে ধরলাম। হিমি চোখ বড় বড় করে ডায়েরীর দিকে তাকিয়ে আছে)
হিমি: আপনি আমার ডায়েরী চুরি করেছেন কেন?
আমি: চুরি না করলে তো জানতে পারতাম না মায়াবতী যে এতো মিথ্যে বলতে পারে।
হিমি: আসসলেলে…
আমি: আসলে কি? এবার বলো ভালোবাস না।
হিমি: না মানে ইয়ে… (হিমি ভয় পেয়ে পিছাতে গিয়ে দেয়ালে আটকে গেলো, আমি ওর একদম কাছে এসে দাঁড়ালাম)
আমি: না মানে ইয়ে কি?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: কিসের এতো ভয় তোমার? এতো ভালোবাস অথচ বারবার দূরে সরিয়ে দিচ্ছ কেন?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: সব তো জেনে ফেলেছি, এবারো কি মিথ্যে বলবে আর আমাকে কাঁদাবে? (হিমি আমার দিকে তাকিয়ে আছে ওর দুচোখে পানি টলমল করছে)
আমি: কোনো এক জনের অনুপস্থিতে এক পৃথিবী সমান শূন্যতা অনুভব করাকেই ভালোবাসা বলে হিমি, আর তুমি সেটা অনুভব করেছ। কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ সাথে আমাকেও কষ্টের আগুনে পুড়ে মারছ, কিসের ভয় তোমার?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: এখনো চুপ হয়ে থাকবে? হিমি আমি কিন্তু এবার… (আচমকা হিমি আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো, ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও। আমি ওকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম)
আমি: আর তো মিথ্যে বলতে পারবে না।
হিমি: আর মিথ্যে বলবো না, এবার যান আম্মু দেখলে সমস্যা হবে। (হিমি আমাকে ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে কাঁদছে)
আমি: যাবো আগে বলো ভালোবাসি আর কান্না বন্ধ করো।
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: বলবা কিনা?
হিমি: ভালোবাসি। (হিমির মুখের কাছে আমার মুখ আনতেই ও ভয়ে বলে দিলো, আমি মৃদু হেসে ওর চোখের পানি মুছে দিলাম। হিমি আমার দুচোখের দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: ভালোবাসি মায়াবতী।
হিমি এক হাতে আমার শার্ট খামছে ধরে মাথা নিচু করে কাঁদছে, থুতুনি ধরে ওর মুখটা উপরে তুললাম। হিমির দুচোখে এখনো ভয়, জানিনা কিসের ভয় তবে ওর সব ভয় আমি দূর করে দিবো আমার ভালোবাসা দিয়ে। হিমির কপালে আসা চুলগুলো ওর কানের পাশে গুঁজে দিলাম, হিমি আমার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক ভাবে, আমি মুচকি হেসে ওর নাকের আঘার তিলকটায় আমার ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম…

আমি হিমিকে অপলক ভাবে দেখছি আর হিমি উশখুশ করছে, ওর এমন অবস্থা দেখে বড্ড হাসি পাচ্ছে। আমিই তো ওকে দেখছি তাহলে এতো লজ্জা পেয়ে উশখুশ করার কি আছে? হিমি আসলেই…
হিমি: যান প্লিজ!
আমি: (নিশ্চুপ)
হিমি: আম্মু একবার দেখে ফেললে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে।
আমি: আর একটু।
হিমি: এভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন বলুন তো।
আমি: আমার মায়াবতীকে। (মৃদু হেসে হিমির নাক টেনে দিলাম)
হিমি: আর বুঝি দেখেননি?
আমি: হুম দেখেছি। কিন্তু আজকের দেখায় অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করছে। (হিমি ভ্রু কুঁচকিয়ে আমার দিকে তাকালো, হয়তো আমার কথার মানে বুঝতে পারেনি)
আমি: আগে তো তুমি আমাকে ভালোবাসতে না শুধু আমি বাসতাম কাজেই ভালোবাসাটা এক তরফা ছিল। তখন তোমাকে দেখলে মনের মধ্যে কেমন যেন চাপা কষ্ট অনুভূত হতো আর আজ দেখো অন্যরকম এক মুগ্ধতা নিয়ে তোমায় দেখছি। কারণ আজ আমি জানি তুমি শুধু আমার। (হিমি আমার কথা গুলো শুনে মিটিমিটি হাসছে)
আমি: হিমি একটা প্রশ্ন করতে পারি? যদি অনুমতি দাও তো।
হিমি: অনুমতি চাওয়ার কি আছে? বলুন।
আমি: কারণ প্রশ্নটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে। (হিমি খানিকটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো)
আমি: তুমি কাকে ভয় পাও হিমি?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: হি…
“হিমি দেখে যা” (কিছু বলতে যাবো তখনি আন্টি হিমিকে ডাকলেন)
হিমি: যান প্লিজ!
আমি: এই শাশুড়ি মায়ের জন্য দেখছি শান্তিতে প্রেম করা যাবে না।
হিমি: আমাকে খুঁজতে খুঁজতে আম্মু যেকোনো সময় আমার রুমে চলে আসতে পারেন, আপনি যান প্লিজ!
আমি: যাচ্ছি, আবার কখন দেখা হবে?
হিমি: যখন সুযোগ পাবো।
হিমির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে আসলাম।

শান্ত বেডে শুয়ে আছে, পাশে সিফাত আর আরিয়ান। আমি এসে সিফাতের পাশে বসলাম, হিমির রুম থেকে বেরিয়ে সোজা হসপিটালে চলে এসেছি।
আরিয়ান: কিরে তোর তো কোনো খুঁজই নেই, কতবার ফোন দিলাম রিসিভ করলি না।
আমি: ফোন? (হঠাৎ মনে হলো ফোনটা বাসায় ফেলে রেখে এসেছি)
শান্ত: ওর কি আর আমাদের দেখার সময় আছে? ও তো এখন সকাল সন্ধ্যা হিমিকে দেখে শুধু।
আমি: ভাঙ্গা পায়ে দিবো একটা।
সিফাত: ভুল কি বললো?
আমি: একটা গুড নিউজ আছে।
শান্ত: কি?
সিফাত: কি?
আরিয়ান: বলনা আরশান।
আমি: হিমি রাজি হয়েছে আর আমাকে ভালোবাসিও বলেছে।
সিফাত: সত্যি?
শান্ত: আমি জানতাম তুই একদিন সাকসেস হবি।
আরিয়ান: ভালোবাসাটা যে সত্যি।
আমি: হুম।
আঙ্কেল: শান্ত ডক্টর বলেছেন বাসায় নিয়ে যেতে পারি কিন্তু…
শান্ত: ভয় নেই আমি সাবধানে থাকবো।
আমি: আজই রিলিজ নেওয়ার কি প্রয়োজন? আগে সুস্থ হ তারপর…
শান্ত: নারে আমার এখানে ভালো লাগছে না। তাছাড়া ডক্টর তো বললো একটু সাবধানে থাকলেই হবে।
আমি: তোর ইচ্ছে।
আঙ্কেল: বিকেলে রিলিজ করে দিবে।
শান্ত: ঠিক আছে।

আরিয়ান: আরশান তোর সাথে অধরার কথা হয়? (সবাই শান্তর পাশে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম হঠাৎ আরিয়ানের প্রশ্নে অধরার কথা মনে পড়লো, এসব ঝামেলায় তো অধরার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বকবক করা মেয়েটা হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল কোনো খুঁজ নেই তো)
আরিয়ান: কিরে কি ভাবছিস?
আমি: আমার সাথে তো কথা হয়নি, আচ্ছা অধরা শান্তকে দেখতে আসেনি?
শান্ত: না। অধরা হয়তো জানেই না আমি যে অসুস্থ আর হসপিটালে আছি।
আমি: ফোন দেতো।
সিফাত: দাঁড়া আমি দিচ্ছি। (অধরা তো সহজসরল একটা মেয়ে সবসময় বকবক করতে পছন্দ করে, আর রোজ তো আমাদের কারো না কারো সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু হঠাৎ মেয়েটা যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো কেন? আমরা চারজন কলেজে যাচ্ছি না অথচ অধরার কোনো ফোন মেসেজ নেই)
সিফাত: ফোন তো সুইচড অফ।
আরিয়ান: অধরা আমাদের সাথে যোগাযোগ করবে না এমন মেয়ে তো ও নয়।
শান্ত: এবার কিন্তু চিন্তা হচ্ছে। মেয়েটা হোস্টেলে থাকে, কোনো বিপদ হলো নাতো? (কেমন যেন ভয় হচ্ছে আমার, শান্তর সাথে যা হয়েছে অধরার সাথে তেমন কিছু হয়নি তো? অধরাও তো আমার ফ্রেন্ড, হয়তো ওর সাথেও খারাপ কিছু হয়েছে)
আমি: আসছি আমি।
সিফাত: কোথায় যাচ্ছিস?
আমি: অধরার হোস্টেলে যাবো।
শান্ত: কিন্তু তোকে তো ঢুকতে দিবে না।
আমি: কোনো ভাবে তো ওর একটা খুঁজ আনতে পারবো।
সিফাত: চল আমি যাচ্ছি তোর সাথে।
আমি: হুম।

অধরার হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, কিভাবে কি করবো বুঝতেই পারছি না। মেয়েদের হোস্টেলে তো আর আমাদের ঢুকতে দিবে না। কি যে হচ্ছে আমার সাথে এসব। এবার তো ভয় হচ্ছে হিমির ভালোবাসার জন্য না আমি এই চারটা বন্ধুকে হারিয়ে ফেলি।
সিফাত: আরশান এই দারোয়ান তো আমাদের চেনেন আগেও এসেছি আমরা, কিছু টাকা দিয়ে যদি অধরার কোনো খবর আনা যায়।
আমি: আমার মাথা কাজ করছে না তুই গিয়ে কথা বল প্লিজ! আর যতো টাকা লাগে দিবি।
সিফাত: তুই এখানে দাঁড়া আমি যাচ্ছি।
আমি: হুম। (মন থেকে দোয়া করছি কোনো খারাপ খবর যেন আমাকে না শুনতে হয়, যা কিছু ঘটছে এখন সত্যি অল্পতে খুব বেশি ভয় পাই আমি। হিমিকে ভালোবাসার জন্য আমার যা হবার হউক কিন্তু আমার বন্ধুদের ক্ষতি আমি কখনোই মানতে পারবো না)
সিফাত: আরশান? (হঠাৎ সিফাতের ডাকে ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো)
আমি: কিরে কিছু বলেছে?
সিফাত: হ্যাঁ অধরা কলেজে গেছে, চল।
আমি: হুম চল।

তাড়াহুড়ো করে কলেজে এসে সব জায়গায় অধরাকে খুঁজলাম, গাছের নিছে আমাদের সেই আড্ডার জায়গাটায় খুঁজলাম কিন্তু অধরা নেই। শেষমেশ ক্লাসে আসলাম, অধরা পিছনের সিটে আনমনা হয়ে বসে আছে।
সিফাত: অধরা? (সিফাতের ডাকে কেঁপে উঠে অধরা আমাদের দিকে তাকালো)
আমি: কিরে কোথায় ছিলি তোর কোনো খুঁজ নেই। (অধরা আনমনা হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: অধরা?
অধরা: হুম। (আমি ওর পাশে বসে ধাক্কা দিতেই ওর ধ্যান ভাঙ্গলো)
সিফাত: কথা বলছিস না কেন কি হয়েছে তোর?
অধরা: কিছু নাতো।
আমি: তোর ফোন সুইচড অফ কেন?
অধরা: ফোন ছিনতাই হয়ে গেছে।
সিফাত: এজন্য তোর মন খারাপ? মন খারাপ করিস না প্লিজ আমরা ফোন কিনে দিবো। (সিফাতের কথা শুনে অধরা একটা মলিন হাসি দিলো, কিছুই বুঝতে পারছি না অধরা ফোন ছিনতাই হয়ে যাওয়ার জন্য মন খারাপ করবে কেন? ও তো চাইলে ফোন কিনতে পারে)
অধরা: তেমন কিছু হয়নি, কলেজে এসে তোদের দেখতে পাইনি তাই মন খারাপ হয়েছিল।
আমি: শান্ত হসপিটালে জানিস তুই?
অধরা: (নিশ্চুপ)
আমি: কিরে জানিস?
অধরা: হু… না না আমি জানবো কিভাবে আমার তো ফোনই নেই।
সিফাত: তুই কি আমাদের থেকে কিছু লুকাচ্ছিস?
অধরা: নাতো কি লোকাবো?
আমি: আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুই খুব ভয় পেয়ে আছিস, আচ্ছা তোকে কেউ ভয় দেখিয়েছে?
অধরা: আজব তো আমাকে ভয় দেখাবে কে আর কেনই বা দেখাবে?
সিফাত: এতো বকবক করা মেয়েটা হঠাৎ এমন চুপচাপ হয়ে গেলো কেন? অধরা কিছু কি লুকাচ্ছিস?
অধরা: না, শান্ত কেমন আছে?
সিফাত: ভালো। ওকে দেখতে যাবি?
অধরা: না, কাল একবার যাবো।
সিফাত: ঠিক আছে তুই ক্লাস কর আমরা আসছি।
অধরা: হুম।
সিফাত: আরশান চল।
আমি: চল।
অধরার দিকে একবার তাকিয়ে চলে আসলাম। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে অধরা আমাদের থেকে কিছু একটা লোকাচ্ছে, কিন্তু কি সেটা? অধরা সবসময় হাসিখুশি থাকে বেশি কথা বলতে পছন্দ করে কিন্তু আজ ওর মুখে কোনো হাসি ছিলনা দুচোখে ভয়ের চাপ ছিল। আমার জন্য যদি ওদের কোনো ক্ষতি হয় তাহলে আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না।

হসপিটালে ফিরে আসলাম, শান্তকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর আমরা সবাই বাসায় যাবো।
ডক্টর: আর কিছুদিন এখানে থাকলে ভালো হতো। (কেবিনে ঢুকতে গিয়ে ডক্টর এর কথা শুনে থেমে গেলাম। ডক্টর শান্তকে বুঝাচ্ছে, পাশে আঙ্কেল আর আরিয়ান)
শান্ত: সমস্যা নেই…
ডক্টর: একটু এদিক সেদিক হলে কিন্তু পরে খুব বড় প্রবলেম হবে।
আঙ্কেল: আমিও তো বলছি হসপিটালে থাকতে কিন্তু শান্ত…
আমি: শান্ত এখানেই থাকবে আঙ্কেল ভয় নেই।
শান্ত: আরশান?
আমি: চুপ, সবকিছুতে বাড়াবাড়ি করিস না।
আঙ্কেল: এখানেই থাক সুস্থ হলে পর বাসায় নিয়ে যাবো। বাবারা তোমরা এখানে একটু থাকো আমি বাসা থেকে আসছি।
সিফাত: ঠিক আছে আঙ্কেল। (আঙ্কেল আর ডক্টর চলে যেতেই শান্ত আমার দিকে রাগি চোখে তাকালো)
আমি: তোর এই অবস্থা তো আমার জন্য হয়েছে তুই পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি লাগবে না। প্লিজ জিদ করিস না।
শান্ত: হুম।
আমি: আরিয়ান, সিফাত তোরা শান্তর খেয়াল রাখিস আর রাতে তো আঙ্কেল আসবেনই, আমি আসছি।
সিফাত: কোথায় যাচ্ছিস?
আমি: হিমির থেকে সব জানবো আমি, এমন ভয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
শান্ত: হিমি বলতে না চাইলে চাপ দিস না এতে মেয়েটা আরো ভয় পেয়ে যেতে পারে।
আমি: হুম।

বাসায় এসে কলিংবেল চেপে দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, সারাদিনের ছুটাছুটির পর বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।
রোদেলা: ভাইয়া কোথায় ছিলে? (রোদেলা দরজা খুলেই প্রশ্ন করলো, সবাই হয়তো টেনশন করছিল)
রোদেলা: চাঁচি কতো টেনশন করছিল বলে যাবে না তুমি?
আমি: হসপিটালে গিয়েছিলাম শান্তকে দেখতে। (ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই দেখি হিমি আর আনিলা বসে আছে, হিমি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো)
আমি: মহারাণী আমাদের ফ্ল্যাটে?
হিমি: আসতে মানা আছে?
আমি: তোমার শশুড়ের বাসায় তুমি আসবে আমি মানা করার কে? (আমার কথা শুনে হিমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো)
রোদেলা: এইযে আপনার শাশুড়ি রান্নাঘরে আছে দুষ্টুমি কম করুন।
আমি: শাশুড়ি রান্না ঘরে?
রোদেলা: হ্যাঁ আম্মু আর চাঁচির সাথে গল্প করছে।
আমি: বাহ্ বেয়ান হবার আগেই এতো মিল?
হিমি: আম্মু এসব কথা শুনলে কিন্তু সন্দেহ করবেন।
আমি: রাতে ছাদে এসো। (হিমিকে কথাটা আস্তে বলে মৃদু হেসে রুমে চলে আসার জন্য পা বাড়ালাম তখনি আম্মু পিছু ডাকলেন)
আম্মু: আরশান কোথায় ছিলি?
আমি: শান্তকে দেখতে হসপিটালে গিয়েছিলাম।
আম্মু: বলে যাবি না? কতবার ফোন করেছি।
আপু: আম্মু তোমার ছেলে তো ফোন বাসায় ফেলে রেখে গিয়েছিল।
আম্মু: যাবেই তো মায়ের যে চিন্তা হয় সেটা কি আর বুঝে? কবে যে একটা বৌমা ঘরে আনবো। (আম্মু হিমির দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে কথাটা বললেন, হিমি তো লজ্জায় লাল হয়ে গেছে)
আমি: তোমার বৌমা তো বিয়ের আগেই তোমার কাছে চলে এসেছে।
হিমি আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে, আমি মুচকি হেসে রুমের দিকে চলে আসলাম।

রাত আনুমানিক এগারোটা, ছাদে দাঁড়িয়ে আনমনা হয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি। জানিনা হিমি আসবে কিনা, কিন্তু ওর আসাটা আজ খুব প্রয়োজন। হিমির থেকে সবকিছু আমি জানতে চাই, এভাবে ভয়ে দিন কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সবকিছু জানতে পারলে একটা কিছু তো অন্তত করতে পারবো।
“আরশান” হঠাৎ হিমির ডাকে আমার ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো, পিছন ফিরে তাকালাম। একরাশ মুগ্ধতা যেন আমার দুচোখে ভড় করেছে, চোখ সরাতে পারছি না হিমির দিক থেকে। পূর্নিমা চাঁদের আলোতে হিমিকে ঠিক কেমন লাগছে কতোটা সৌন্দর্য ওকে ঘিরে নিয়েছে আমি বর্ণনা করতে পারবো না। আমি শুধু দুচোখে মুগ্ধতা নিয়ে হিমিকে কুটিয়ে কুটিয়ে দেখছি, সাদা পাড়ের নীল ওড়নাটা দিয়ে মাথায় ঘোমটা দেওয়া, চোখে গারো কাজল, হাত ভর্তি চুড়ি, হিমি একটু নড়াচড়া করলেই চুড়ি গুলো রিনিঝিনি শব্দে বেজে উঠছে।
হিমি: এইযে কি হলো? (হিমির আলতো ধাক্কায় আমার ঘোর কাটলো, মুচকি হেসে হিমির কাছে এগিয়ে গেলাম)
আমি: একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে আমার মায়াবতীকে দেখছিলাম।
হিমি: আমি কি সত্যি মায়াবতী নামটার যোগ্য? (হিমির এমন প্রশ্নে মাথায় রাগ চড়ে বসলো)
আমি: নাতো তুমি যোগ্য নও রাস্তার মেয়ে যোগ্য, যাই রাস্তার কোনো একটা মেয়েকে গিয়ে মায়াবতী বলে ডাকি আর ভালোবাসি বলি? সহ্য করতে পারবে তো?
হিমি: এতো রেগে যাচ্ছেন কেন?
আমি: তোমাকে… ধ্যাত।
হিমির থেকে দূরে সরে আসলাম।

ছাদের রেলিং এ হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছি আর রাগটাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছি। হঠাৎ হিমি এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার হাতের উপর ওর হাত রাখলো, রাগটা নিমিষেই শেষ হয়ে আমার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটলো। হিমির হাতটা আমার হাতের মুঠোয় এনে ওর দিকে তাকালাম।
আমি: আর কখনো এসব বলো না, আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই মায়াবতী বলে ডাকি। তাছাড়া তোমার সৌন্দর্য আমাকে তোমায় মায়াবতী বলে ডাকতে বাধ্য করে। বিশ্বাস করো তুমিই এই নামটার যোগ্য।
হিমি: কিন্তু আমি যে খুব সাধারণ অতি নগণ্য একটা মেয়ে, গায়ের রঙ কালো…
আমি: আমি এই সাধারণ মেয়েটাকেই ভালোবাসি আর ভালোবাসতে চাই সহস্র বছর, আমি তোমার এই নগণ্যতাকেই পছন্দ করি। আর গায়ের রঙের কথা বলছ? কিবা আসে যায় সামান্য গায়ের রঙে? ভালোবাসা কি গায়ের রঙ দেখে হয়? আর কালো মেয়েরা মায়াবতী হতে পারে না?
হিমি: হ্যাঁ পারে কিন্তু সেটা গল্পে, উপন্যাসে কিংবা কোনো সর্ট ফিল্মে।
আমি: আমি নাহয় এই কালো মেয়েটাকে আমার মনের ক্যানভাসের মায়াবতী করে নিলাম।
হিমি: কিন্তু আরশান আমাদের এই সম্পর্ক কেউ মেনে নিবে না।
আমি: কেন? ভয় হচ্ছে?
হিমি: জানেন না জগতের সব কালো ভালো শুধু কালো মেয়ে ছাড়া। সত্যি ভয় হচ্ছে…
আমি: ভয় পেয়ো না পাগলী আমি আমার ভালোবাসার এক ফালি রঙ দিয়ে তোমাকে রাঙিয়ে দিবো, আমার ভালোবাসার রঙের আড়ালে এই কালো রঙ ঢাকা পড়ে যাবে। (হিমি আমার দিকে অদ্ভুত এক মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে, আমি ওর কাজল কালো চোখ দুটোর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি)
আমি: তোমার এই গভীর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থেকে শুধু এই রাত না সহস্র বছর কাটিয়ে দিতে পারবো। (আমার কথা শুনে হিমি লজ্জা পেয়ে হাসলো)
আমি: তোমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার সারারাত কেটে যাবে, যে কারণে তোমাকে ডেকেছি শুনো…
হিমি: কি কারণ?
আমি: তুমি জানো শান্ত হসপিটালে?
হিমি: হ্যাঁ তারিন বলেছে শান্ত ভাইয়া নাকি এক্সিডেন্ট করেছে।
আমি: না হিমি শান্তকে ইচ্ছে করে এমন করা হয়েছে আর কে করেছে জানো? তুমি যাকে ভয় পাও। (হিমি আমার কথা শুনে ভয়ে কেঁপে উঠলো)
আমি: হিমি তোমার কাছে আমার অনুরোধ তুমি বলো প্লিজ কে সে, আমার বন্ধুদের আমি হারাতে চাই না। হি…
হিমি: সজিব।
আমি: সজিব?
হিমি: লোকে বলে প্রথম প্রেম নাকি ভুল মানুষের সাথে হয়, আমার প্রথম প্রেম শুধু ভুল মানুষের সঙ্গে নয় বরং একটা জঘন্য নোংরা খারাপ মানুষের সাথে হয়েছিল। আর তার নাম সজিব।
আমি: কেঁদো না প্লিজ! সজিব কি তোমাকে এখনো ডিস্টার্ব করে?
হিমি: নাতো।
আমি: তাহলে আমাকে কেন ভয় দেখাচ্ছে? শান্তর এই অবস্থা কেন করলো?
হিমি: জানিনা। (হিমি আচমকা আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো)
আমি: কাঁদছ কেন পাগলী কি হয়েছে?
হিমি: আরশান আমি আপনাকে হারাতে চাই না, সজিব খুব খারাপ মানুষ আমি ওকে চিনি। সজিব এখন শান্ত ভাইয়ার এই অবস্থা করেছে কাল যে আপনার এই অবস্থা করবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে?
আমি: আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না কারণ আমার কাছে তোমার ভালোবাসা আছে। (হিমির দুগালে ধরে ওর কপালে আলতো করে একটা চুমু দিলাম)
হিমি: আমার খুব ভয় করছে।
আমি: কিসের ভয়? আমার বউ হতে পারবে না?
হিমি: সবসময় এতো দুষ্টুমি করেন কেন?
আমি: তোমার চোখে কান্না দেখতে আমার ভালো লাগেনা, হাসো। (হিমি মুখ মলিন করে মাথা নিচু করে আছে। আমাকে ঝাপটে ধরার কারণে হিমির মাথার ঘোমটা পড়ে গিয়েছিল, ওড়না টেনে যত্ন করে হিমির মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিলাম)
আমি: এইযে মায়াবতী ঘোমটা দিয়ে তোমাকে আমার বউ করে নিলাম এবার তো অন্তত একটুখানি হাসো।
হিমি আমার পাগলামি দেখে ফিক করে হেসে দিলো। পূর্নিমার চাঁদের আলোতে কোনো মায়াবতী যদি এভাবে হাসে তাহলে কি মন মুগ্ধ নাহয়ে পারে? হিমি হাসছে আমি মুগ্ধ নয়নে ওর হাসি দেখছি আর ভাবছি এই মায়াবতীর মুখে সবসময় এই হাসিটা দেখার জন্য আমি সব করবো…

হিমির কোলে শুয়ে ওর হাতের চুড়ি গুলোতে রিনিঝিনি শব্দ করাচ্ছি, হিমি আকাশের চাঁদ দেখতে ব্যস্ত আর আমি ব্যস্ত আমার আকাশের চাঁদ দেখতে। সত্যি হিমি আমার জীবনে এসে সবকিছু আলোকিত করে দিয়েছে, ওকে পূর্ণিমার চাঁদ বললে ভুল হবে না কারণ এই মায়াবতীটা যে চাঁদের চেয়েও সুন্দর। হিমির কোলে শুয়ে আনমনা হয়ে ওর হাতের চুড়ি গুলো নাড়ছিলাম আর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম এক দৃষ্টিতে হঠাৎ হিমি আমার দিকে তাকালো, আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হিমি ভ্রু কু্ঁচকালো। আমি এক চিলতে হাসি দিয়ে হিমির হাতের মধ্যে চুমু দিলাম।
হিমি: কি হচ্ছে দুষ্টু কোথাকার?
আমি: এভাবে সবসময় তোমার পাশে থাকতে ইচ্ছে করে।
হিমি: তাহলে বিয়েটা করে নিন।
আমি: সত্যি বলছ? চলো কালই বিয়ে করে ফেলি।
হিমি: আপনি না বড্ড পাগল।
আমি: তুমিই তো পাগল বানিয়েছ। (হিমি হাসছে, এটাই সময় সজিবের ব্যাপারে সবকিছু জানার, হিমির মন ভালো আছে যেহেতু অবশ্যই বলবে। উঠে হিমির পাশে বসে হিমির একটা হাত আমার দুহাতের মুঠোয় আনলাম)
আমি: হিমি?
হিমি: হুম।
আমি: তুমি সজিবকে ভয় পাও কেন?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: সজিব কোথায় থাকে, তুমি কেন ওকে ভয় পাও, সবকিছু আমাকে না বললে আমি কিছু করবো কিভাবে?
হিমি: আপনাকে কিছু করতে হবে না, সজিব খুব খারাপ মানুষ ও আপনার ক্ষতি করতে দুবার ভাববে না।
আমি: কিন্তু তুমি ওকে ভয় পাও কেন?
হিমি: অতীত কি না জানলেই নয়? আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন তাহলে অতীত জানতে চাচ্ছেন কেন? নাকি অতীত জেনে আমাকে ভুলে যাবেন?
আমি: না না হিমি তুমি আমাকে ভুল বুঝছ, আমি তোমাকে ভুলবো কেন? আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তোমার ভালো দিক খারাপ দিক মেনে নিয়েই ভালোবাসি। একটা মানুষের জীবনে অতীত থাকবে এটাই স্বাভাবিক, তাই বলে মানুষটাকে ভালবাসবো না?
হিমি: অতীতটা যদি হয় খুব ভয়ংকর?
আমি: তাতে কি? আমি তোমার অতীত মেনে নিয়েই তোমাকে ভালবাসবো।
হিমি: বলা সহজ কিন্তু বাস্তবে সেটা করা খুব কঠিন।
আমি: একবার বলেই দেখো না।
হিমি: বলার পর হয়তো ছেড়ে চলে যাবেন আর তখন তো আমার কিছু করার থাকবে না।
আমি: প্রমিস করছি কখনো ছেড়ে যাবো না।
হিমি: যতোই প্রমিস করুন আমি জানি আপনি আমার অতীত জানার পর আর ভালোবাসবেন না, এইযে এতো মায়া এতো কেয়ার এসব কিছুই তখন আর থাকবে না। আমি আপনাকে ভালোবাসি, আমার জন্য আপনার কোনো ক্ষতি হউক আমি তা চাই না। আর ঠিক এই কারণেই ভালোবাসা সত্ত্বেও সেদিন আমি আপনার প্রপোজ একসেপ্ট করিনি, ভেবেছিলাম কিছুদিন কেটে গেলে ভুলে যেতে পারবো আর আপনিও আমাকে ভুলে যাবেন। কিন্তু তারিন আর শান্ত ভাইয়া সব উলটপালট করে দিলো, আমাকে একেবারে আপনার কাছে নিয়ে আসলো। ভালোবাসা প্রকাশ না করতে চাইলেও প্রিয় মানুষের সামনে প্রকাশ হয়ে যায়, আমি ফেঁসে গেছি তাই একসেপ্ট করতে হলো। আমার অতীত না জেনে যদি আমাকে ভালোবাসতে পারেন তাহলে বাসুন নাহলে ভুলে যান।
আমি: হিমি এখানে ভুলে যাওয়ার কথা আসছে কেন?
হিমি: সেই তো অতীত জানার পর ভুলে যাবেন, অতীত জানার আগেই নাহয় ভুলে যান। আমি চাই না আমার প্রতি আপনার যে ভালোবাসাটা আছে সেটা ঘৃণায় পরিণত হউক।
আমি: হিমি আমি শুধু তোমার অতীত জানতে চাচ্ছি সজিবকে…
হিমি: আসি। (হিমি উঠে চলে যাচ্ছে, বুঝতে পারছি না কি এমন লোকাচ্ছে হিমি?)
আমি: দাঁড়াও হিমি। (আমার ডাক শুনে হিমি দাঁড়িয়ে পড়লো কিন্তু পিছন ফিরে তাকালো না। আমি এসে হিমির সামনে দাঁড়ালাম)
আমি: আমি আর কখনো তোমার অতীত জানার আগ্রহ দেখাবো না যেমন ভালোবাসি সবসময় বাসবো, তুমি শুধু কখনো তোমাকে ভুলে যেতে বলো না।
হিমি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে হনহন করে চলে গেলো। আমি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, হিমি কিছু লোকাচ্ছে কিন্তু কি সেটা? অতীত জানতে চাওয়াতে হিমি ওকে ভুলে যেতে বলেছে তারমানে ও কখনোই অতীতটা বলবে না, আমাকেই সব খুঁজে বের করতে হবে। হিমির অতীত জানার চেষ্টা করবো হিমিকে ভুলে যাওয়া বা ভুল বুঝার জন্য নয় সজিবকে শাস্তি দেওয়ার জন্য।

এক সপ্তাহ পর…
জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে উদাসীন হয়ে বিকেলের মেঘলা আকাশ দেখছি। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে আজ, এই এক সপ্তাহ আমি সজিবকে খুঁজার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। আর ব্যর্থ হওয়াটা তো স্বাভাবিক, যাকে চিনি না জানিনা কখনো দেখিনি তাকে কিভাবে খুঁজে বের করবো? এদিকে হিমি কেমন যেন বদলে গেছে, সেদিন রাতে ওর অতীত জানতে চাওয়াটা ছিল আমার জীবনের চরম ভুল। সেদিনের পর থেকে হিমি বদলে গেছে, আগের মতো আর হিমি হাসে না, আমাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয় না, পুরো একদিন কথা না বলে দেখা না করে কাটিয়ে দিতে পারে, কলেজে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় কথা বলার প্রয়োজন মনে করে না। এসব আর নিতে পারছি না আমি, হিমির এই বদলে যাওয়া আমাকে তিলেতিলে শেষ করে দিচ্ছে। ওদিকে অধরা আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করে না সারাক্ষণ কেমন যেন ভয়ের মধ্যে থাকে, আমি সত্যি বুঝতে পারছি না কি করবো। হঠাৎ ফোনের রিংটোন আমার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালো, বিছানার উপর থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করলাম।
আমি: হ্যালো।
সিফাত: কিরে হসপিটালে আসবি না? আজ তো শান্তকে রিলিজ করে দিবে।
আমি: আসছি।
ফোন রেখে রেডি হয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।

আরিয়ান: কিরে তোর মন এখনো ভালো হয়নি? (শান্তর কেবিনে ঢুকতেই আরিয়ান প্রশ্ন করলো, ওর প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসলাম। মন, এই মনের খবর যার রাখার কথা সেতো বদলে গেছে)
শান্ত: নিজের কি অবস্থা করেছিস একবারো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছিস?
আমি: বাদ দে তো।
সিফাত: যে নিজেকে ভালোবাসে না সে নাকি আবার অন্যকে ভালোবাসে, তুই তো নিজেকেই ভালোবাসিস না তাহলে হিমিকে ভালোবাসবি কিভাবে?
আমি: জ্ঞান দিস নাতো ভালো লাগেনা এসব।
আঙ্কেল: শান্ত চল এখানকার সব কাজ শেষ।
শান্ত: হুম।

শান্তকে নিয়ে বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। শান্ত সুস্থ হলেও ভালোভাবে হাটতে পারে না তাই ওকে আমরা তিনজন ধরে ধরে বাসার ভিতর নিয়ে আসলাম, ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই হিমির দিকে আমার চোখ আটকে গেলো, হিমিও আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
তারিন: এখানে বসিয়ে দাও ভাইয়াকে। (শান্তকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে আমরাও বসলাম, হিমির নজর এখনো আমার দিকে)
তারিন: তোমরা বসো রাতে খাওয়াদাওয়া করে যাবে, আম্মু রান্না করছেন তোমাদের জন্য।
হিমি: তারিন আমি যাচ্ছি।
আন্টি: কেন মা চলে যাবি কেন? আমিতো সবার জন্য রান্না করছি।
হিমি: সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
তারিন: তাতে কি হয়েছে আরশান ভাইয়ার সাথে রাতে চলে যাস। (হিমি আমার দিকে তাকালো, কিছু না বলে চোখ নামিয়ে নিলাম)
শান্ত: তোদের কি হয়েছে বল তো দুজনের মন খারাপ কেন?
সিফাত: দুজনের মনে মেঘ জমেছে।
ওরা সবাই হাসি ঠাট্টা করছে, ভালো লাগছে না এসব চুপচাপ উঠে ছাদের দিকে চলে আসলাম।

গোধূলি সন্ধ্যা, ছাদে দাঁড়িয়ে আনমনা হয়ে সন্ধ্যার রক্তিম আকাশ দেখছি আর নিজের মনকে প্রশ্ন করছি সত্যি কি আমি কোনো অন্যায় করেছি? সামান্য অতীত জানতে চাওয়াটা কি এমন অন্যায় হলো আমার যে হিমি এমন বদলে গেলো?
হিমি: আরশান? (হঠাৎ হিমির ডাকে ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসলাম, পিছন ফিরে তাকালাম হিমি দাঁড়িয়ে আছে)
আমি: তুমি?
হিমি: কেন আসতে পারিনা?
আমি: তুমি তো আজকাল আমার সাথে কথা না বলে দিব্যি থাকতে পারো।
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: এখানে এসেছ আন্টি বকবে না রাত করে ফিরলে?
হিমি: না আম্মুকে বলে এসেছি ফিরতে দেরি হবে।
আমি: ওহ!
হিমি: আরশান?
আমি: কিছু বলবে?
হিমি মাথা নেড়ে না সূচক উত্তর দিয়ে চলে গেলো। এই হিমিকে আমি একদম ছিনতে পারছি না, বড্ড কষ্ট হচ্ছে আমার। কেন এমন করছে হিমি? ও কি বুঝেনা আমি ওর অবহেলায় তিলেতিলে শেষ হয়ে যাচ্ছি? বুকের ভিতরটা আজকাল কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগে, মাঝেমাঝে মনে হয় সব বুঝি শেষ হয়ে গেলো।

ঘড়ির কাটায় রাত নয়টা পনেরো, রাতের খাওয়াদাওয়া করে শান্তদের বাসা থেকে বের হলাম। হিমি আমার সাথে যাবে অথচ দুজনের মুখে কোনো কথা নেই।
সিফাত: সাবধানে যাস, আসছি।
আরিয়ান: এসব রাগ অভিমান সম্পর্কে ফাটল ধরায়, ভুলে যা এসব রাগ অভিমান।
আমি: হুম। (সিফাত আর আরিয়ান চলে গেলো, আমি চুপচাপ হিমির পাশে দাঁড়িয়ে আছি কি বলবো বা কি করবো বুঝতে পারছি না)
হিমি: আমরা রিকশাতে যাই?
হিমির আবদার শুনে ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে একটা রিকশা ডাক দিলাম।

রিকশাতে দুজন পাশাপাশি বসে আছি অথচ কারো মুখে কোনো কথা নেই। আজ প্রথম রাতের বেলা এভাবে দুজন একসাথে বাইরে আছি, রিকশায় পাশাপাশি বসে আছি, রাগ অভিমান নাহলে হয়তো মুহূর্তটা খুব সুন্দর হতো।
হিমি: আরশান?
আমি: হুম।
হিমি: এভাবে জড়সড়ভাবে বসে আছেন কেন?
আমি: এমনি।
হিমি: আমি শুনেছিলাম কেউ যদি তার প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে রিকশায় ছড়ে তাহলে তাকে আগলে…
আমি: থেমে গেলে কেন? (হিমির পিছনে আমার হাত দেখে ও থেমে গেলো, হিমি যদি পরে যায় বা ব্যথা পায় তাই পিছনে হাত দিয়ে রেখেছি। আমি ওকে আগলেই রাখছি এইটা বুঝতে পেরেই হয়তো থেমে গেছে আর লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে)
আমি: তোমার লজ্জামাখা মুখ দেখতে দারুণ লাগে।
হিমি: সরি আসলে…
আমি: ভয় নেই আমি থাকতে তোমার কোনো ক্ষতি হতে দিবো না।
হিমি বেশ অবাক হয়েই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মুচকি হাসলাম, হিমিও মুচকি হেসে আমার কাধে মাথা রাখলো।

রিকশা থেকে নেমে হিমি বাসায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো, আমি পিছু ডাকলাম।
আমি: হিমি?
হিমি: কিছু বলবেন?
আমি: হুম।
হিমি: বলুন।
আমি: সজিব আমাকে হুমকি দিচ্ছে, শান্তর ক্ষতি করিয়েছে, অধরাকেও সম্ভবত ভয় দেখিয়েছে তাই আমি তোমার কাছে সজিবের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম, তোমার অতীত জানার কোনো আগ্রহ আমার নেই। তবুও যদি অতীত জানতে চাওয়াতে আমার ভুল হয়ে থাকে তাহলে প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। বিশ্বাস করো হিমি আমি তোমার অবহেলা গুলো নিতে পারছি না, বড্ড কষ্ট হয়। (হিমি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু না বলে বাসায় চলে গেলো। আমি এসে কলিংবেল চাপলাম)
রোদেলা: কি ব্যাপার কি? খুব প্রেম করছ দুজনে।
আমি: মানে?
রোদেলা: রাতের রোমান্টিক ওয়েদারে দুজন একসাথে রিকশা দিয়ে আসলে, প্রেম খুব জমেছে তাই না?
আমি: চুপ কর তো।
রোদেলা: আমি ছাদ থেকে দেখেছি বলেই তো বললাম, রেগে যাচ্ছ কেন?
আপু: রোদেলা ফাজলামো বন্ধ কর। ভাই কি হয়েছে বলতো তোর?
আমি: কি হবে?
আপু: কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছিস, নিজের কি অবস্থা করেছিস দেখেছিস একবারো?
আমি: রুমে যাচ্ছি আমি।
আপু: দাঁড়া। (চলে যাচ্ছিলাম আপুর ডাক শুনে দাঁড়ালাম, জানি এখন হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে আমাকে)
আপু: হয়তো হিমির সাথে ঝগড়া হয়েছে তাই এসব ব্যাপারে কোনো কথা বলবো না, শুধু এইটুকু বলি সম্পর্কে রাগ অভিমানের প্রয়োজন আছে কিন্তু তাই বলে এতোটা বেশি নয়। বেশি কিছুই ভালো না, বেশি রাগ অভিমানে সম্পর্ক নষ্ট হয়।
আমি: হুম।
আপু: খাবি না?
আমি: খেয়ে এসেছি।
আপু: ঠিক আছে যা ঘুমিয়ে পড় তোকে দেখে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে।
আমি: হুম।
চুপচাপ রুমের দিকে চলে আসলাম।

রুমের ভিতর ঢুকতেই ফোন বেজে উঠলো, পকেট থেকে ফোন বের করলাম। অচেনা একটা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে, রিসিভ না করে বিছানার উপর ফোন রেখে দিলাম। কিছুক্ষণ পর আবার বেজে উঠলো, খানিকটা বিরক্তি নিয়েই রিসিভ করলাম।
আমি: হ্য…
“সজিব” (নামটা শুনে চমকে উঠলাম কোন সজিব? হিমির এক্স বয়ফ্রেন্ড নয়তো?)
সজিব: এতোদিনে নিশ্চয় হিমির থেকে নামটা জেনে নিয়েছিস?
আমি: জানিস তো অনেক খুঁজেও তোর কোনো ঠিকানা জানতে পারলাম না, বলতে পারিস আমি তোর ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম।
সজিব: কেন মরার পাখনা গজিয়েছে বুঝি?
আমি: মরার পাখনা কার গজিয়েছে সেটা তো তখনি জানতে পারবি যখন দুজন মুখোমুখি হবো।
সজিব: খুব সখ আমাকে দেখার?
আমি: কাপুরুষকে দেখার সখ হতেই পারে এইটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেন করছিস এসব? কেন কাপুরুষের মতো পিছন থেকে আমাকে আঘাত করছিস?
সজিব: শান্ত তো বেঁচে গেছে তাই আঘাতটা কম পেয়েছিস, মেরে ফেললে ভালো হতো।
আমি: এই একদ…
সজিব: আরে আস্তে রেগে যাচ্ছিস কেন? তোকে পার্সেলে করে চিঠি দিয়ে লাভ হয়নি তাই ফোন দিতে হলো, একটা কথা ভালো করে শুনে রাখ হিমি আমার ছিল আর আমারই থাকবে সারাজীবন, হিমি চাইলেও থাকবে আর না চাইলেও।
আমি: তোদের তো ব্রেকআপ হয়ে গেছে, কেন হিমিকে ডিস্টার্ব করছিস?
সজিব: ব্রেকআপ তো আমি করিনি হিমি করেছে। আর ডিস্টার্ব? হিমিকে কখনো আমি ডিস্টার্ব করিনি তবে ওর দিকে যে নজর দিয়েছে তাকে ডিস্টার্ব করেছি।
আমি: তুই খারাপ তাই হিমি ব্রেকআপ করেছে, কেন মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছিস?
সজিব: কই কষ্ট দিচ্ছি নাতো, আমিতো হিমিকে ভালোবাসি। সাফ শুনে রাখ হিমির কাছ থেকে দূরে সরে যা তোর মঙ্গল হবে।
আমি: তাই নাকি?
সজিব: যখন মারবো তখন এসব ঠাট্টা থাকবে না। হিমির পড়াশুনা শেষ হবার অপেক্ষা করছি আমি, হিমিকে ভুলে যা।
ফোন কেটে দিলো। বড্ড হাসি পাচ্ছে, আজকাল এমন পাগলও আছে? হুমকি দিচ্ছে আমাকে, ওর হুমকিতে ভয় পেয়ে নাকি আমি আমার মায়াবতীকে ভুলে যাবো, এইটা কখনো সম্ভব?

বুকের মধ্যে ভারী কিছু অনুভব করে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘুম ঘুম চোখে তাকালাম, হিমি আমার বুকে শুয়ে আছে দেখে এক চিৎকার দিলাম, হিমি আমার মুখ চেপে ধরলো।
হিমি: কি হচ্ছে চিৎকার করছেন কেন?
আমি: এইটা কি হচ্ছে? তুমি এই সকালবেলা আমার রুমে আর এইভাবে আমার বুকে… আম্মু দেখলে আমার বারোটা বাজাবে।
হিমি: হুহ আমি শাশুড়ি মায়ের অনুমতি নিয়েই আপনার রুমে এসেছি।
আমি: তুমি তো খুব চালাক মেয়ে। (হিমি মুচকি হেসে আলমারির দিকে গেলো)
হিমি: আজ আপনার সাথে দূরে কোথাও ঘুরতে যাবো। (হিমির কথা শুনে আমি হা হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি, এইটা কোন হিমি? এক সপ্তাহ ধরে অবহেলা করছে আর আজ বলছে ঘুরতে যাবে, এতো পরিবর্তন?)
হিমি: যান তো তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি আপনার ড্রেস বের করে রাখছি। (হিমি আলমারি থেকে শার্ট বের করতে গিয়ে ওর পায়ের কাছে আমার টিশার্ট পড়ে গেলো, টিশার্ট তুলতে গিয়ে লিপস্টিক এর দাগ দেখে হিমি চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালো, আমি ভ্রু কুঁচকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম..)
আমি: কি?
হিমি: কি সেটা তো আমি জিজ্ঞেস করবো। টিশার্টে লিপস্টিক এর দাগ কেন? কোন মেয়ের ঠোঁটের…
আমি: হবে হয়তো আমার আগের কোনো প্রেমিকার ঠোঁটের…
হিমি: আপনাকে তো আজ আমি মেরেই ফেলবো আমাকে ঠকানো হচ্ছে। (হিমির সেদিন রাতের পুকুড়পাড়ের কথা মনে নেই তাই দুষ্টুমি করে অন্য মেয়ের কথা বলেছিলাম, এখন তো এই মেয়ে আমার গলা টিপে ধরেছে)
আমি: হিমি ছাড়ো মরে যাবো তো।
হিমি: আপনার মরে যাওয়াই উচিত আমাকে ঠকাচ্ছেন এভাবে। (হিমি আমাকে ছেড়ে মুখটা মলিন করে বিছানার এক কোণে গিয়ে বসলো)
আমি: এমন দজ্জাল জিএফ মনে হয় আর কারো নেই। এই তুমি তো শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে হঠাৎ এমন দজ্জাল হলে কিভাবে?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: রাগ করেছ? (হিমির পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরলাম, এতোটা মন খারাপ করবে বুঝতেই পারিনি)
আমি: আমিতো দুষ্টুমি করেছি।
হিমি: সত্যি তো?
আমি: হ্যাঁ সত্যি।
হিমি: সরি, আমি আর কখনো আপনাকে অবহেলা করবো না। কাল আমি তারিনদের বাসায় আপনাকে লক্ষ করেছি কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছেন, নিজের যত্ন নেন না, রোগা হয়ে গেছেন, চুল গুলো উসকোখুসকো হয়ে গেছে। আমি আর আপনাকে কষ্ট দিবো না। আসলে সেদিন আমার কিযে হয়েছিল…
আমি: সেদিনের কথা আর মনে করো না, তুমি আগের হিমি হয়ে গেছ এতেই আমি খুশি।
হিমি: কিন্তু এই লিপস্টিক এর দাগ?
আমি: পুকুরপাড়ে যে আমার বুকে মুখ গুঁজেছিলে তখন লেগে গিয়েছিল, তোমার ঠোঁটের ছোঁয়া আমি কি ধুয়ে ফেলতে পারি? যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। (হিমি নিশ্চুপ হয়ে আমার দুচোখের দিকে তাকিয়ে আছে, আমি একটা হাত হিমির গালে রাখলাম)
আমি: সেদিন তো না জেনে লাগিয়ে দিয়েছিলে আজ নাহয় জেনেশুনে লিপস্টিক এর দাগ লাগিয়ে দাও।
হিমি: ধ্যাত আপনি খুব দুষ্টু।
হিমি লজ্জা পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল, আমি ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছি। এইতো হিমি কতো হাসিখুশি আছে কিন্তু অতীত মনে পড়লেই ও কেমন যেন চুপসে যায়, কিন্তু কেন? হিমির অতীত কি সেটা আমাকে জানতে হবে আর সেটা সজীবের থেকেই জানবো। সজিবের এই ফোনের সূত্র ধরেই ওকে আমি খুঁজে বের করবো। হিমির অতীত জানবো আর ওর সব ভয় দূর করে দিয়ে ওকে সবসময় এভাবে হাসিখুশি রাখবো, হিমির হাসিমাখা মুখ দেখতেই যে আমার পরম শান্তি…

রেডি হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গুণগুন করছিলাম আর চুল ঠিক করছিলাম হঠাৎ আয়নায় হিমিকে দেখতে পেলাম, দরজায় দাঁড়িয়ে আমার চুলের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। পিছন ফিরে হিমির দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম।
আমি: মেডাম আমার চুলে নজর লেগে যাবে।
হিমি: আমার এত্তো লম্বা চুল থাকতে আপনার চুলে নজর লাগাতে বয়েই গেছে আমার।
আমি: এই তুমি চোখে কাজল দাওনি কেন?
হিমি: মনে নেই। (কিছু না বলে হিমির কাজলের কৌটো আর চুড়ি গুলো এনে ওর সামনে ধরলাম, হিমি অবাক হয়ে একবার এগুলোর দিকে তাকাচ্ছে তো আবার আমার দিকে তাকাচ্ছে)
হিমি: এগুলো এখনো আপনার কাছে আছে?
আমি: তোমার জিনিস আর আমি যত্ন করে রাখবো না তা হয়? যাও চোখে কাজল দিয়ে নাও।
হিমি: থাক না।
আমি: তোমার কাজল কালো চোখ দুটো দেখতে আমার ভালো লাগে। (হিমি আর কিছু না বলে চুপচাপ আয়নার সামনে গিয়ে চোখে কাজল টেনে নিলো। আমি চুড়ি গুলো হাতে নিয়ে হিমির সামনে এসে দাঁড়ালাম)
আমি: এগুলো আমি পড়িয়ে দেই?
হিমি: আমার কাজল কালো চোখ আপনার ভালো লাগে, আমার হাতের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ আপনার ভালো লাগে, আমার লম্বা চুল গুলো পিটময় ছড়িয়ে থাকলে আপনার ভালো লাগে, এক কথায় আমাকে পরিপাটি সাজসজ্জায় দেখতে আপনার ভালো লাগে। আচ্ছা যখন ব্যস্ততায় চোখে কাজল দিতে ভুলে যাবো, হাতে চুড়ি পড়তে ভুলে যাবো, চুল গুলো এলোমেলো হয়ে থাকবে কাজের চাপে কিংবা শত ব্যস্ততায় পরিপাটি থাকতে পারবো না তখনো কি আমাকে আপনার ভালো লাগবে? এভাবেই কি ভালোবাসবেন আমাকে? (হিমির কথা শুনে হাসি পাচ্ছে, কি ভাবনা এই পাগলীর)
হিমি: কি হলো হাসছেন কেন?
আমি: তুমি আমাকে সত্যি ভালোবাস তো?
হিমি: মানে? বাসি তো।
আমি: তাহলে এইটা কেন বুঝনা প্রিয় মানুষটিকে সবসময় যেকোনো অবস্থাতেই ভালোবাসা যায়। প্রিয়জনের ভালো দিক খারাপ দিক দুটো মেনে নিয়েই ভালোবাসতে হয়, আর যে এইটা পারে না সে আমার মতে সত্যিকারের প্রেমিক/প্রেমিকা নয়। সত্যি ভালোবাসলে প্রিয় মানুষটিকে যেকোনো অবস্থায় মায়াবী লাগে সুন্দর লাগে। (হিমি মৃদু হেসে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো, আমি চুড়ি গুলো ওর হাতে পড়িয়ে দিলাম)
হিমি: আমি সত্যি খুব ভাগ্যবতী যে আপনার মতো একজন মানুষকে আমার করে পেয়েছি। নাহলে আপনার মতো একজন মানুষ যার বিশালত্বার কাছে আমি অতি তুচ্ছ এক মানবী… (হিমির মুখ চেপে ধরলাম)
আমি: কি বলছ এসব?
হিমি: যা সত্যি তাই।
আম্মু: না মা এইটা সত্যি নয়। (পাশ ফিরে দেখি আম্মু হাসি মুখে রুমে ঢুকছেন)
আম্মু: তুমি ভুল ভাবছ মা, তুমি আমার আরশানের যোগ্য তাই তুমি ওকে পেয়েছ। নিজেকে তুচ্ছ মনে করো না, যে নিজেকে সম্মান না করে তুচ্ছ বলে তাকে কি অন্যরা সম্মান দিবে? নিজেকে নিজে সম্মান করতে শিখো তবেই অন্যদের থেকে তুমি সম্মান পাবে।
হিমি: (নিশ্চুপ)
আম্মু: আমি দরজায় দাঁড়িয়ে তোমাদের সব কথা শুনেছি, আরশান তোমার হাতে চুড়ি পড়িয়ে দিয়েছে সেটাও দেখেছি। (আম্মুর কথা শুনে হিমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো, আম্মু ওর তুথুনি ধরে ওর মুখ উপড়ে তুললেন)
আম্মু: লজ্জা পাচ্ছ কেন? আমিতো চাই তোমরা দুজন সারাজীবন এভাবে দুজন দুজনকে ভালোবাস আর সুখে দুঃখে একে অপরের পাশে থাকো।
আমি: আম্মু তুমি সত্যি পৃথিবীর সেরা মা। (আম্মুকে এসে জড়িয়ে ধরলাম, আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন)
আম্মু: তোরা কি কোথাও যাচ্ছিস?
আমি: হ্যাঁ হিমি ঘুরতে যাবে।
আম্মু: বেশি দূর যাবি না, দু ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবি, আর বাইক নেওয়া চলবে না।
আমি: ঠিক আছে আম্মু। (আম্মু হিমির মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে চলে গেলেন, হিমি আম্মুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে)
আমি: কি?
হিমি: আন্টি কতো ভালো কতো সুন্দর করে সব বুঝিয়ে দেন আর আপনার কতো কেয়ার করেন।
আমি: আমি ঘুরতে যাবো শুনলেই আম্মু এসব বলে দেন, আসলে আম্মু ভয় পান আমি যদি আবার এক্সিডেন্ট করি।
হিমি: এক্সিডেন্ট?
আমি: হ্যাঁ একবার এক্সিডেন্ট করে আমি মরতে বসেছিলাম।
হিমি: তাহলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
আমি: দূর পাগলী কিছু হবে না, চলো।
হিমি: হুম।

হিমি আর আমি ফুটপাত ধরে পাশাপাশি হাটছি। হিমি এক হাত নেড়েচেড়ে বকবক করছে আর অন্যহাতের আঙ্গুল বারবার আমার হাতের আঙ্গুলে লেগে যাচ্ছে, আমি সেদিকেই লক্ষ করছি আর মৃদু হাসছি। প্রিয় মানুষের আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে এভাবে পাশাপাশি হাটার অনুভূতি এতোটা ভালো হতে পারে জানা ছিল না। হিমির দিকে তাকালাম, এক হাত নেড়েচেড়ে বকবক করেই যাচ্ছে। আজ হিমিকে একটু বেশিই খুশি লাগছে, হয়তো হিমি ঘুরতে পছন্দ করে।
হিমি: জানেন তো…
আমি: তুমি ঘুরতে খুব পছন্দ কর তাই না?
হিমি: হ্যাঁ কিন্তু আপনি বুঝলেন কিভাবে আমিতো বলিনি। (হিমি বেশ খানিকটা অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো)
আমি: অন্যদিনের তুলনায় তোমাকে আজ একটু বেশিই খুশি লাগছে।
হিমি: হ্যাঁ আমি ঘুরতে খুব পছন্দ করি। নদীর পাড়ে সাদা কাশবনে বা এমন ফুটপাত ধরে কিংবা রাতের নিস্তব্ধ নির্জন রাস্তায়।
আমি: আর কি কি ভালো লাগে তোমার?
হিমি: রাতের নিস্তব্ধ মেঘলা আকাশ, বৃষ্টিতে ভেজা, পাহাড়-ঝর্না, সমুদ্র আরো অনেক কিছু।
আমি: কি কি খেতে ভালো লাগে?
হিমি: ফুচকা খাবো। (হিমির কথা শুনে সামনে তাকালাম, ফুচকাওয়ালাকে দেখেই হিমি ফুচকার কথা বলেছে)
আমি: কিন্তু হিমি এই রাস্তার খাবার…
হিমি: ধ্যাত!
হিমি দৌড়ে ফুচকাওয়ালার কাছে ছুটে গেলো। আজ হিমিকে অন্যরকম লাগছে একদম বাচ্চা মেয়েদের মতো। হিমি হাতের ইশারায় আমাকে ডাকছে তাই আমিও ফুচকাওয়ালার দিকে এগিয়ে গেলাম।

হিমি: বেশি করে জ্বাল দিবেন কিন্তু। (হিমিকে অবাক হয়ে দেখছি, এর আগে ওকে কখনো এতোটা খুশি হতে দেখিনি)
হিমি: তখন জানতে চেয়েছিলেন না আমি কি কি খেতে পছন্দ করি? আইসক্রিম আর ফুচকা।
আমি: আর?
হিমি: এ দুটোই বেশি প্রিয়। মাঝরাতে বা বৃষ্টির সময় আইসক্রিম খাওয়ার মজাটাই আলাদা। আর এভাবে ফুটপাতে বসে বেশি করে জ্বাল দিয়ে ফুচকা খাওয়ার মজাই আলাদা। ওহ আমার আরো একটি পছন্দ আছে।
আমি: কি?
হিমি: চুড়ি, আমার চুড়ি পড়তে খুব ভালো লাগে। দুহাত ভরতি চুড়ি থাকবে আমার হাত নড়াচড়া করার তালে তালে চুড়ি গুলো রিনিঝিনি শব্দে ভেজে উঠবে উফফ দারুণ একটা অনুভূতি।
আমি: চোখে গারো করে কাজল দিতে ভালো লাগেনা? (হিমি ফুচকা খাচ্ছিল আমার প্রশ্ন শুনে আমার দিকে তাকালো)
আমি: তোমার কাজল কালো গভীর চোখ দুটো আমার খুব ভালো লাগে, ইচ্ছে হয় তোমার মায়া ভরা গভীর চোখ দুটোতে ডুব দিয়ে কাটিয়ে দেই হাজারটা শতাব্দী।
হিমি: ফুচকা খাবেন?
আমি: না।
হিমি: খেতে আপনাকে হবেই। (হিমি জোড় করে আমাকে ফুচকা খাইয়ে দিলো, এই মেয়ে এতো জ্বাল খায় কিভাবে আমার মুখ তো পুড়ে যাচ্ছে)
হিমি: আপনি জ্বাল খান না আগে বলবেন না? খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? (হিমি দৌড়ে গিয়ে ফুচকাওয়ালার কাছ থেকে পানি নিয়ে এসে আমাকে খাইয়ে দিলো)
হিমি: আপনার দ্বারা এসব খাওয়া হবে না, আপনি দাঁড়ান আমি খেয়ে নেই। (হিমিকে মুগ্ধ হয়ে দেখছি, এই মেয়েটা এতো পাগলামি করে কেন? আমার জ্বাল লেগেছে বলে একটু আগে ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল আর এখন আবার বাচ্চাদের মতো ফুচকা খাচ্ছে)
হিমি: আরশান? (আনমনা হয়ে হিমিকে দেখছিলাম হঠাৎ হিমির চিৎকারে চমকে উঠলাম, হিমির হাত থেকে ফুচকার প্লেট নিচে পড়ে গেছে আর হিমি ভয় পেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে)
আমি: হিমি কি হয়েছে?
হিমি: এখান থেকে চলুন আমি বাসায় যাবো।
আমি: কেন কি হয়েছে?
হিমি: বাসায় চলুন প্লিজ! (হিমিকে জড়িয়ে ধরে রেখেই চারপাশে চোখ বোলালাম কিন্তু এমন কিছুই দেখতে পেলাম না যা দেখে হিমি ভয় পেতে পারে)
হিমি: চলুন না।
আমি: কি হয়েছে বলো আমাকে।
হিমি: বললাম তো আমি বাসায় যাবো।
আমি: হ্যাঁ যাবো তো চেঁচামেচি করো না।
ফুচকাওয়ালার টাকা দিয়ে হিমিকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। চারপাশে চোখ বুলাচ্ছি কিন্তু বুঝতে পারছি না হিমি কি দেখে এতোটা ভয় পেলো।

বাসায় পৌঁছেই হিমি দৌড়ে ওদের ফ্ল্যাটে চলে গেলো। কিছুই বুঝতে পারছি না কি হয়েছে হঠাৎ হিমির, কি দেখে এতোটা ভয় পেলো।
আম্মু: আরশান? (কখন যে কলিংবেল চেপেছিলাম বুঝতেই পারিনি আম্মু দরজা খুলে ডাক দিলেন)
আম্মু: এতো হাসিখুশি ভাবে দুজন বের হলি আর এখন মুখটা এমন মলিন। ঝগড়া হয়েছে?
আমি: না আম্মু।
আম্মু: তাহলে?
আমি: কিছু হয়নি তুমি টেনশন করো না।
আম্মু: আমিতো ভেবেছিলাম দুজন একসাথে দুপুরের খাবার খেয়ে বাসায় ফিরবি।
আমি: ইচ্ছে তো ছিল কিন্তু হিমি হঠাৎ করে…
আমি: কি? (আম্মুকে বলা ঠিক হবে না, হিমি এভাবে হঠাৎ ভয় পায় শুনলে আম্মু টেনশন করবেন)
আমি: বাসায় ফিরতে চেয়েছিল আরকি, তুমি যাও তো খাবার দাও টেবিলে আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
আম্মু: ঠিক আছে।

রুমে এসে মাথাটা দুহাতে চেপে ধরে বিছানায় বসলাম। হিমির এতো ভয় পাওয়ার কারণটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। কি দেখেছিল হিমি? এতোটা ভয় কেন পেলো? হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো, পকেট থেকে ফোন বের করলাম। সজিব ফোন করেছে, তাহলে কি হিমির আজকের ভয় পাওয়া আর সজিবের মধ্যে কোনো কানেকশন আছে?
আমি: হ্যালো।
সজিব: বলেছিলাম হিমির থেকে দূরে থাকতে, আর তুই কি করলি? হিমিকে নিয়ে ফুটপাত ধরে আঙ্গুলে আঙ্গুল ঠেকিয়ে হাটা হচ্ছে। হিমি তোকে ফুচকা খাইয়ে দিচ্ছে আ…
আমি: তারমানে আমার ধারণা ঠিক, ওখানে তুই ছিলি আর তোকে দেখেই হিমি ভয় পেয়েছিল।
সজিব: ভয় তো পাবেই।
আমি: তুই যে কাপুরুষ আজ আবার প্রমাণ করে দিলি।
সজিব: এই?
আমি: কাপুরুষ বলেই আমার সামনে না এসে আড়াল থেকে হিমিকে ভয় দেখিয়েছিস। হিমিকে যতোই ভয় দেখাস আমি ওকে আগলে রাখবো।
সজিব: তাহলে এবার হিমির ক্ষতি করবো। (ফোনটা কেটে দিলো, আশ্চর্য একটা লোক। সবকিছু বরবাদ করে দিচ্ছে)
আম্মু: আরশান কোথায় তুই?
আমি: আসছি আম্মু।
আম্মুর ডাক শুনে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।

ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ আসলাম। আপু আর রোদেলা খাচ্ছে দেখে রোদেলার মাথায় টোকা দিলাম।
রোদেলা: চাঁচি দেখেছ এসেই আমাকে মারলো।
আমি: টোকা দেওয়া মাইর হয়ে গেলো?
আম্মু: আরশান খাবার খাওয়ার সময় দুষ্টুমি না।
আমি: ওকে।
রোদেলা: আজ নাকি দুজন ঘুরতে গিয়েছিলে?
আমি: তোকে বলবো কেন?
রোদেলা: হুহ আমার শুনতে বয়েই গেছে।
আপু: আম্মু আজ নাকি আদিত্য আসছে?
চাঁচি: হ্যাঁ আজ আমার ছেলেটা বাড়ি আসবে, কতদিন পর ছেলেটা আসবে। (চাঁচি এসে চেয়ার টেনে বসলেন। আদিত্য নাকি হোস্টেলে থেকে পড়াশুনো করে কিন্তু আমার তো সন্দেহ হ…)
চাঁচি: এখন আসলে আর হোস্টেলে যেতে দিবো না। আমার ছেলেটা ওখানের খাবার খেয়ে একদম শুকিয়ে যায়।
রোদেলা: তোমার ছেলেকে তো কেউ হোস্টেলে যেতে বলেনি, কলেজ তো কাছেই। আসলে কি জানো আম্মু ভাইয়া বাসায় থেকে তো নিজের ইচ্ছেমত চলতে পারেনা তাই হোস্টেলে থাকে। আর ভয় পেয়ো না তোমার ছেলে বলে কথা হোস্টেলের খাবার ও ভুলেও মুখে তুলবে না।
চাঁচি: চুপ শুধু পাঁকা পাঁকা কথা।
রোদেলা: উচিত বললে সবাই অপছন্দ করে।
আমি: চুপ কর না।
রোদেলা: আদিত্য ভাইয়া আসলে তো আমার কোনো স্বাধীনতা থাকে না, সারাক্ষণ চেঁচামেচি করে। (রোদেলা আস্তে আস্তে আমাকে কথাটা বললো আমি মুচকি হাসলাম, এই আদিত্যকে তো আমারও ভালো লাগেনা)
চাঁচি: আমার ছেলেটাকে এই বাসার কেউ সহ্য করতে পারে না।
আপু: ভুল বলছ চাঁচি আদিত্য তো আমাদের ভাই, হ্যাঁ ও একটু অন্যরম তাই…
চাঁচি: কি করেছে আমার ছেলে?
রোদেলা: প্রশ্নটা নিজেকেই করো না।
চাঁচির সাথে আদিত্যকে নিয়ে কথা বলা মানে উনার কান্নাকাটি শুরু করে দেওয়া তাই সবাই আর কিছু না বলে চুপচাপ খেয়ে নিলাম।

বাগানে বসে আছি আর হিমির রুমের দিকে তাকাচ্ছি, হিমি কি করছে একবার দেখা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু যাবো কিভাবে? হিমির আম্মু যদি সন্দেহ করেন?
“এইযে” আনমনা হয়ে হিমির রুমের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবছিলাম হঠাৎ কেউ ডেকে উঠলো, পাশ ফিরে দেখি ভাবি।
আমি: আপনি?
ভাবি: এতো উঁকিঝুঁকি যে মারছ মা দেখলে সন্দেহ করবেন।
আমি: হিমির সাথে দেখা করাটা খুব প্রয়োজন ছিল।
ভাবি: হিমির কি হয়েছে?
আমি: জানিনা, আজ আবারো ভয় পেয়েছে।
ভাবি: চিন্তা করো না দু এক ঘন্টার মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।
আমি: ভাবি আমাকে সত্যিটা বলুন প্লিজ! হিমি সবসময় এতো ভয়ে ভয়ে থাকে কেন?
ভাবি: আমি কি বলবো বলো, হিমিকে জিজ্ঞেস করো।
আমি: হিমিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম হিমি বলেনি উল্টো রেগে গিয়ে এক সপ্তাহ আমার সাথে ঠিকমতো কথা বলেনি।
ভাবি: হিমি যেহেতু বলতে চায় না আমি বলবো কিভাবে? আমি বললে তো হিমি রেগে যাবে।
আমি: হিমি জানতে পারবে না, আমি কখনো হিমিকে আপনার কথা বলবো না।
ভাবি: দুবছর আগে হিমির জীবনে একটা ঝড় এসেছিল আর এর প্রভাব এখনো কাটেনি, তখন যে হিমি ভয় পেয়েছিল আজো ভয় পায়। মাঝেমাঝেই হিমি ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। কখনো তো ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠে।
আমি: সেদিন তো এসব আমাকে বলেননি?
ভাবি: সেদিন মা পাশে ছিলেন, তুমি তো হিমিকে ভালোবাস তাই তোমার জানার অধিকার আছে। তাছাড়া আমি জানি তুমিই পারবে হিমির এই ভয় দূর করতে। ইদানীং হিমি একটু বেশিই ভয় পাচ্ছে এই কথাটা ওর ভাইরা জানলে টেনশন করবে। হিমি ঘুরতে খুব পছন্দ করে, ওর ভাইরা তো মাঝেমাঝেই ওকে নিয়ে এখানে সেখানে যায় হিমির মন ভালো রাখার জন্য হিমিকে হাসিখুশি রাখার জন্য। তুমি চাইলে ওকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে পারো, তাতে যদি হিমির মন ভালো হয়।
আমি: হিমি এখন কি করছে?
ভাবি: গায়ে বিছানা টেনে দিয়ে শুয়ে আছে, ভয় পেয়ো না ও এমন করেই। দু এক ঘন্টার মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে আর হিমিও আগের মতো হয়ে যাবে।
আমি: কিন্তু ভাবি কি ঝড় সেটা তো…
ভাবি: আমি চাইনা হিমির মতের বিরুদ্ধে তুমি এই কথাটা জানো, হিমি কখনো বললে শুনো।
আমি: ঠিক আছে।
ভাবি: আসছি।
ভাবি চলে গেলেন, আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। হিমি তো কিছু বলতেই চায় না সবকিছু আমি জানবো কিভাবে?

বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে, আমি ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছি, পাশেই আম্মু কাজ করছেন। সন্ধ্যার সময় বৃষ্টি হওয়াটা আমি একদম পছন্দ করিনা, এই সময়টায় দুনিয়ার সব মন খারাপ যেন এসে ভর করে তার উপর যদি আবার বৃষ্টি হয় তাহলে তো…
হিমি: আরশান? (আনমনা হয়ে বসে এসব ভাবছিলাম হঠাৎ হিমির কন্ঠ শুনে চমকে উঠলাম, হিমি হাসতে হাসতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। যাক পাগলীটার ভয় তাহলে কেটেছে)
হিমি: চলুন বৃষ্টিতে ভিজবো। (হিমি আমার হাত ধরে টানছে আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে আছি, আম্মু তো হিমির পাগলামি দেখে মিটিমিটি হাসছেন। আমার তাকানো দেখে হিমিও তাকালো আর আম্মুকে দেখে জিহ্বায় কামড় দিয়ে আমার হাত ছেড়ে দিলো, ভালোই লজ্জা পেয়েছে মায়াবতীটা)
আম্মু: আমার ছেলেটাকে খুব ভালোবাসিস তাই না? (আম্মু হিমির গালে হাত রেখে হাসছেন হিমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে রেখেছে)
আম্মু: কিন্তু মা আরশান তো… (আম্মুকে ইশারা দিয়ে বলতে নিষেধ করলাম, বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর হবে ঠান্ডা লাগবে আম্মু এটাই বলে দিচ্ছিলেন। একটু ঠান্ডা লাগলে সমস্যা কি হিমি তো হাসিখুশি থাকবে)
আম্মু: যা।

আমাকে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখে হিমি বৃষ্টিতে ভিজছে, ছাদের এপাশ থেকে ওপাশে ছুটাছুটি করছে। আমি মুগ্ধ নয়নে হিমির বাচ্চামি গুলো দেখছি আর মিটিমিটি হাসছি।
“ভাইয়া” হঠাৎ কারো ডাক শুনে চমকে উঠলাম, হিমি দুহাত মেলে বৃষ্টিতে ভিজছিল হিমিও ডাক শুনে পিছন ফিরে তাকালো। আদিত্য? ছাদে কেন? আমাকে খুঁজে এসেছে নাকি?
আমি: তুই?
আদিত্য: তোমাকে রুমে না পেয়ে ছাদে আসলাম ভাবলাম তুমি হয়তো চিলকোঠোর ঘরে। কিন্তু তুমি তো ভাবিকে নিয়ে ভিজতে ব্যস… (হিমি আমার কাছে আসতেই আদিত্য হিমিকে দেখে চমকে উঠলো, হিমিও আদিত্যকে দেখে চমকে উঠলো)
আদিত্য: ও?
আমি: হিমি, তোর হবু ভাবি।
আদিত্য: ওহ! ভাবি কেমন আছেন? (আদিত্য বৃষ্টিতে ভিজেই হিমির কাছে এগিয়ে আসলো, হিমি ভয় পেয়ে আমার বুকে মুখ গুঁজে দিলো)
আদিত্য: ভাবি এতো ভয় পাচ্ছেন কেন? (আদিত্য যতো এগুচ্ছে হিমি ততো বেশি ভয় পেয়ে আমার বুকের সাথে মিশে যাচ্ছে, হিমি এক হাত দিয়ে আমার শার্ট খামছে ধরেছে আর ভয় পেয়ে এতো জোড়ে ধরেছে যে ওর হাতের নোখ গুলো আমার বুকে গেঁথে যাচ্ছে)
আমি: আদিত্য হিমি তোকে দেখে এতো ভয় পাচ্ছে কেন?
আদিত্য: জানিনা তো আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।
হিমি: ওকে এখান থেকে চলে যেতে বলুন।
আমি: আদিত্য প্লিজ তুই নিচে যা।
আদিত্য: ঠিক আছে।
আদিত্য যেতেই আমার বুক থেকে হিমির হাতটা সরে গেলো, ওকে ডাকতে গিয়ে দেখি সেন্সলেস হয়ে পড়েছে। তাড়াতাড়ি হিমিকে কোলে তুলে নিলাম, ওকে নিয়ে রুমের দিকে এগুচ্ছি আর ভাবছি হিমি আদিত্যকে দেখে এতো ভয় পেলো কেন? এইতো মেয়েটা কতো হাসিখুশি ছিল বাচ্চা মেয়েদের মতো বৃষ্টিতে এপাশ থেকে ওপাশে ছুটাছুটি করছিল। হঠাৎ আদিত্যকে দেখে হিমি এতোটা ভয় কেন পেলো? আচ্ছা এমন নয়তো আদিত্যই সজিব? সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে…

হিমি সেন্সলেস হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে ডক্টর ওকে দেখছেন। সবাই হিমির রুমে ভীর জমিয়েছে, আমি হিমির মাথার পাশে বসে আছি। কিছুক্ষণ আগের হাসি খুশি মেয়েটার মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে। এভাবে সেন্সলেস হলে তো শরীর খুব দূর্বল হয়ে পড়ে হিমির নিশ্চয় খুব কষ্ট হয়। হিমিকে এই অবস্থায় দেখতে আমার একদম ভালো লাগছে না।
ডক্টর: এর আগে কখনো এমন হয়েছে?
আন্টি: হ্যাঁ কিছুদিন আগে হয়েছিল।
ডক্টর: শুধু দুদিনই? দেখুন মিথ্যে বলবেন না এতে আপনাদের মেয়েরই ক্ষতি হবে।
ভাবি: না ডক্টর হিমির এই সমস্যা দু বছর ধরে। দু বছর আগে একটা ঘটনায় হিমি খুব ভয় পেয়েছিল তারপর থেকেই মাঝেমাঝে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়, রাতে ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠে।
ডক্টর: চিকিৎসা করান নি?
ভাবি: আসলে এমন হলে এক দু ঘন্টা পরেই আবার হিমি স্বাভাবিক হয়ে যায় তাই চিকিৎসা করানো হয়নি। কিন্তু ইদানীং এই সমস্যাটা একটু বেশিই হচ্ছে।
ডক্টর: ভয়ের প্রভাব এখনো কাটেনি, ভয় কাটাতে হবে নাহলে উনার ব্রেনে চাপ সৃষ্টি হতে পারে এমনকি উনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যেতে পারেন। (ডক্টর এর কথা শুনে বুক ধড়পড় করে উঠলো, কি বলছে এসব ডক্টর?)
ডক্টর: আপনারা চাইলে আমার কাছেও চিকিৎসা করাতে পারেন। তবে চিকিৎসার চেয়ে বেশি যেটা জরুরী তা হলো মেয়েটাকে একা রাখা যাবে না, টেনশন করতে দেওয়া যাবে না, সবসময় হাসিখুশি রাখতে হবে। যখন সে একা থাকবে তখনি সেই ভয়ংকর ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠবে যার ফল সরূপ সে আর সেই ঘটনাটা ভুলতে পারবে না আর এমন হতেই থাকবে। এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় তার মানসিক ভারসাম্যতে প্রভাব পড়বে।
ভাবি: আপনিই চিকিৎসা করুন। আর হিমিকে আমরা সবসময় দেখে রাখবো।
ডক্টর: ঠিক আছে। ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছি কিছুক্ষণ এর মধ্যেই সেন্স ফিরে আসবে। কাল একবার আমার চেম্বারে এসো ওকে নিয়ে। (ডক্টর আমার উদ্দেশ্যে কথাটা বলে বেরিয়ে গেলেন। আমি নির্বাক হয়ে বসে আছি আর হিমির মলিন মুখটা দেখছি এক দৃষ্টিতে)
ভাবি: আগেই বলেছিলাম হিমিকে কোনো বড় ডক্টর এর কাছে নিয়ে যাও, আমার কথা কেউ শুনেনি। এবার বুঝ, মেয়েটার না কিছু হয়ে যায়।
আমি: ভাবি এভাবে বলছেন কেন? হিমির কিছু হবে না, আমি ওকে বড় ডক্টর এর কাছে নিয়ে যাবো।
আন্টি: আচ্ছা বাবা তুমি আর হিমি ছাদে কি করছিলে? (আন্টির প্রশ্ন শুনে ভয়ে আতকে উঠলাম কি বলবো এখন?)
ভাবি: আসলে মা হিমি তো বৃষ্টিতে ভিজছিল আরশান হয়তো হিমির চিৎকার শুনে ছাদে গিয়েছিল।
আমি: হ্যাঁ আন্টি আমি হিমির চিৎকার শুনে গিয়েছিলাম আর তারপরই তো ওকে কোলে করে নিয়ে আসলাম।
চাঁচি: কিন্তু আদিত্য তো বললো…
আম্মু: চুপ করো না।
আপু: ভাই তোর শার্টে রক্ত কেন? ভেজা কাপড় চেঞ্জ কর নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে।
রোদেলা: বুকের কাছে রক্ত আসলো কিভাবে? (হিমির নখ গেঁথে গিয়ে বুক থেকে রক্ত এসেছে, কতোটা ভয় পেলে কেউ এভাবে কাউকে আঁকড়ে ধরে ভাবতেই গাঁ শিউরে উঠছে, হিমি এতোটা ভয় পায় সেন্সলেস হওয়াটা তো স্বাভাবিক)
আম্মু: আরশান যা ভিজা কাপড় চেঞ্জ করে নে।
আমি: হুম যাচ্ছি।
হিমির দিকে এক নজর তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।

ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম হিমিকে একবার দেখতে যাবো, জ্ঞান ফিরেছে কিনা কে জানে।
চাঁচি: আমি কিন্তু সব বুঝি হ্যাঁ।
আম্মু: কি বুঝ? আরশান হিমিকে ভালোবাসে তাই তো? তাতে সমস্যাটা কি? (আম্মু আর চাঁচির কথা কাটাকাটি শুনে ড্রয়িংরুমে আসলাম)
চাঁচি: সমস্যা নেই আবার আছেও, এই মেয়ে কি আরশানের যোগ্য? দেখতে কালো তার উপর মধ্যবিত্ত, আরশানের আব্বু আর চাচ্চু মানবে? কালো হলেও নাহয় আরশানের জন্য মেনে নিলো কিন্তু এই মেয়ের তো সমস্যা আছে হুট করে অজ্ঞান হয়ে যায়, কে জানে কি রোগ…
আমি: চাঁচি? আমিতো হিমিকে ভালোবাসি তাই ওর গায়ের রঙ কালো নাকি ফর্সা, ওর ভাইরা বড় লোক নাকি মধ্যবিত্ত সেটা বুঝার দায়িত্বটা আমার উপর ছেড়ে দাও। আর হিমি কেন অজ্ঞান হয়ে যায় কি রোগ ওর সবকিছু নাহয় আমাকেই বুঝতে দাও, এখন হয়তো আমি ওর প্রেমিক কিন্তু একদিন তো স্বামী হবো।
চাঁচি: এখনি এতো দূর ভাবনা?
আমি: হিমিকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই ভালোবেসে ফেলেছি আর সেদিনই ওকে আমার বউ বানানোর স্বপ্ন দেখে ফেলেছি। হিমির পড়াশুনা শেষ হবার অপেক্ষা করছি, আব্বু যদি বাধা দেন তাহলে পড়াশুনা শেষ হবার অপেক্ষা না করে খুব শীঘ্রই বিয়েটা করে নিবো। মনে রেখো চাঁচি আমি কাউকে পরোয়া করিনা, ভালোবেসেছি যখন ভালোবাসার মানুষকে যোগ্য মর্যাদা দিয়ে বউ করে আনবো।
আম্মু: আরশান?
আমি: আম্মু আমি হিমির বিরুদ্ধে আর একটা কথাও শুনতে চাই না, এই বাসায় যেন কেউ হিমির বিরুদ্ধে কথা না বলে।
আদিত্য: আম্মু তুমি শুধু শুধু ওর বিষয়ে নাক গলাচ্ছ কেন? ও তো আব্বু চাচ্চু কাউকে সম্মান করে না, তোমাকে করবে নাকি? (চলে আসছিলাম আদিত্যর কথা শুনে থমকে দাঁড়ালাম)
আমি: কে কাকে কতোটা সম্মান করে সেটার হিসেব নাহয় পরে করবো, আগে তো এইটা জানি হিমি তোকে দেখে এতো ভয় পেয়েছে কেন?
আদিত্য: এই মেয়ের রোগ আছে বুঝেছ? আমাকে দেখে ভয় পায়নি।
আমি: সেটা নাহয় হিমির মুখ থেকে আমাকে জানতে দে।
আদিত্যর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে আসলাম। আমি যদি ভুল না করে থাকি তাহলে আদিত্যই নাম পাল্টে হিমির জীবনে ঢুকেছিল। নয়তো আদিত্য আর সজীবের মধ্যে কোনো কানেকশন আছে যা হিমি জানে।

হিমির রুমের দরজায় আসতেই দেখি ভাবি হিমিকে ওষুধ খাওয়াচ্ছেন। আমাকে দেখে হিমি ইশারা দিয়ে ভিতরে ডাকলো। আমি এসে হিমির পায়ের কাছে বসলাম।
ভাবি: তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে নাও তাহলে আমাকে আর কষ্ট করে ওষুধ খাওয়াতে হবে না।
হিমি: বিয়ে করে যতো দূরেই যাই না কেন তোমাকে আমি ঠিক জ্বালাবো।
ভাবি: দেখেছ তোমার বউ কি ব… এই তুমি কাঁদছ কেন? (ভাবির কথা শুনে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলাম, হিমির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে চোখের কোণে পানি এসে গেছে বুঝতেই পারিনি)
হিমি: কাঁদছেন কেন আমিতো সুস্থ হয়ে গেছি।(হিমির দিকে তাকিয়ে মুখে হাসির রেখা টানার বৃথা চেষ্টা করলাম)
হিমি: আরে বাবা আমি একদম সুস্থ আছি।
ভাবি: কোথায় সুস্থ জ্বর উঠে গেছে তো।
আমি: জ্বর?
ভাবি: হ্যাঁ।
আমি: ভাবি আমি হিমির সাথে একটু একা কথা বলতে চাই আপনি যদি একটু আন্টিকে…
ভাবি: ঠিক আছে আমি ওদিক সামলে নিবো।
আমি: হুম।
ভাবি: বলতে না চাইলে জোড় করো না হিতে বিপরীত হয়ে যাবে তখন। (ভাবি কথাটা আস্তে বলে চলে গেলেন, ভাবি হয়তো ভাবছেন আমি দুবছর আগের ঘটনা জানতে চাইবো। কিন্তু আমি হিমির এই অবস্থায় এসব কিছু জানতে চাইবো না, হিমি টেনশন করুক আমি চাই না। আমি শুধু হিমিকে জিজ্ঞেস করবো আদিত্যকে দেখে ভয় পেয়েছে কেন?)
হিমি: সরি।
আমি: কেন?
হিমি: আমার জন্য আপনাকে কতো ঝামেলায় পড়তে হয়।
আমি: এখন সব ঝামেলা দিয়ে দাও বিয়ের পর শুধু রোমান্স চলবে।
হিমি: আপনার মুখে না কিছু আটকায় না।
আমি: হিমি আদিত্যকে দেখে ভয় পেয়েছিলে কেন?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: বলো। (হিমি নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে রেখেছে, উঠে এসে হিমির মাথার কাছে বসলাম হিমিও উঠে আধশোয়া হয়ে বসলো)
আমি: তুমি বলতে না চাইলে আমি জোড় করবো না কিন্তু তুমি একটু বুঝার চেষ্টা কর আমারও তো এসব জানা প্রয়োজন। ডক্টর বলেছে তোমাকে…
হিমি: আমার তো কিছু হয়নি ডক্টর কেন আবার?
আমি: হ্যাঁ কিছু হয়নি, তবুও তুমি আমার জন্য কাল ডক্টর এর কাছে যাবে।
হিমি: ঠিক আছে।
আমি: এবার বলো তো আদিত্যকে দেখে ভয় পেয়েছ কেন?
হিমি: উনি কে আর এই বাসায় তো আগে দেখিনি?
আমি: এজন্য ভয় পেয়েছ অচেনা বলে?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: ও আদিত্য আমার চাচাতো ভাই, হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে তাই আগে দেখোনি। কিন্তু তাই বলে অচেনা মানুষ দেখে এতো ভয় পাবে? (হিমি কিছু না বলে মৃদু হেসে আমার কাধে মাথা রাখলো। বেশ বুঝতে পারছি হিমি কথা লুকাচ্ছে, কেন যে ও এমন করছে। এখন তো হিমিকে জোড় দিয়ে জিজ্ঞেসও করতে পারবো না কারণ ওকে টেনশন দেওয়া বারণ)
আমি: আচ্ছা হিমি এমন নয়তো আদিত্যই সজিব আর তুমি সেটা আমার থেকে লুকাচ্ছ? (হিমি মাথা নেড়ে না করলো)
আমি: তাহলে আদিত্য…
হিমি: আমাকে খুব ভালোবাসেন তাই না? আমি একটু কষ্ট পেলে আপনিও কষ্ট পান কান্না করেন আমার জন্য।
আমি: আমি একবার অসুস্থ হই তখন বুঝবে কেমন লাগে।
হিমি: আমি আপনার কিছু হতেই দিবো না।
আমি: হুম হয়েছে এবার ঘুমাও আমি যাচ্ছি, তোমার আম্মু দেখলে আমাকে ঝাড়ু পিটা দিবে।
হিমি হাসছে, আমি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে আসলাম।

রাতের খাওয়াদাওয়া করে আনমনা হয়ে হেটে রুমের দিকে যাচ্ছি, মাথাটা খুব ভারী লাগছে। হঠাৎ আদিত্যর কন্ঠ শুনে থমকে দাঁড়ালাম, ওর রুম থেকে কথা ভেসে আসছে। আস্তে আস্তে গিয়ে আদিত্যর রুমে উঁকি দিলাম, আদিত্য ফোনে কথা বলছে আর চেঁচামেচি করছে।
আদিত্য: দেখ আমি কখনো ভাবিনি এই মেয়ে ফিরে আসবে, এসেছে যেহেতু এই মেয়েকে তোর যা খুশি কর। এই মেয়েকে তুই বিয়ে করবি নাকি মেরে ফেলে দিবি সেটা একান্তই তোর ব্যাপার। এসবে আমাকে একদম জড়াবি না আর আমার ভাইয়ের গায়ে যেন একটা আছড়ও না লাগে। (ফোনের অপর পাশ থেকে কে কি বলছে কিছুই তো শুনতে পাচ্ছি না)
আদিত্য: দেখ আমি আবারো বলছি মেয়েটাকে যা খুশি কর কিন্তু আমার ভাইয়ের যেন কোনো ক্ষতি নাহয়। আর তুই যদি জেনেশুনে আরশান ভাইয়ার ক্ষতি করিস তাহলে তোর ব্যবস্থা আমি আব্বু আর চাচ্চুকে বলে করাবো।
আমি: কাকে হুমকি দিচ্ছিস আদিত্য? (আমার কন্ঠ শুনে আদিত্য কেঁপে উঠে ফোন কেটে দিলো)
আমি: কে আমার ক্ষতি করবে? কাকে হুমকি দিচ্ছিলি?
আদিত্য: কই নাতো।
আদিত্যর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে আসলাম। আমার সন্দেহ ভুল নাহলে আদিত্য সজিবের সাথে কথা বলছিল, আদিত্য আমার নাম নিয়েছে আর মেয়েটা হয়তো হিমি। এখন আদিত্যকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও বলবে না, হিমি কিছুটা সুস্থ হউক তারপর নাহয় আদিত্যকে প্রশ্ন করবো।

রাতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতেই পারিনি, সকালে প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মাথা খুব ভারী হয়ে আছে শরীর দূর্বল লাগছে, জানিনা কি হয়েছে। আস্তে আস্তে উঠে বিছানায় বসলাম। সকালের শীতল বাতাসে একটু হাটাহাটি করলে ভালো লাগবে হয়তো তাই ছাদের দিকে রওনা দিলাম।

ছাদের দরজায় আসতেই হিমির কন্ঠ শুনতে পেলাম এতো সকালে হিমি উঠে পড়েছে? ও তো অসুস্থ। কিন্তু হিমি কথা বলছে কার সাথে? একটু এগুতেই দেখি আদিত্য হিমিকে চিলকোঠোর ঘরের দেয়ালের সাথে চেপে ধরে ভয় দেখাচ্ছে আর হিমি ছুটার জন্য চেষ্টা করছে।
হিমি: ছাড়ুন।
আদিত্য: হুম ছেড়ে দিবো কিন্তু আমার কথাটা ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নাও, দু বছর আগের ঘটনা যেন ভাইয়া না জানতে পারে। যদি ভাইয়া কিছু জেনেছে তাহলে তোমাকে সজিবের হাতে তুলে দিবো। (সজিবের কথা শুনে হিমি ভয়ার্ত চোখে আদিত্যর দিকে তাকালো, আদিত্য মৃদু হাসলো)
আদিত্য: আমার ব্যাপারে যেন ভাইয়া কিছু না জানে, যদি কিছু বলেছ তাহলে দুবছর আগে যেটা হয়নি সেটা হয়ে যাবে। কি বলবে ভাইয়াকে?
হিমি: ছাড়ুন প্লিজ!
দাঁড়িয়ে ছিলাম যেন ওদের কথা শুনে কিছু বুঝতে পারি কিন্তু হিমি তো এখন ভয় পেয়ে কাঁদছে। দৌড়ে হিমির কাছে আসলাম।

আমাকে দেখে হিমি আদিত্যকে ধাক্কা মেরে ফেলে ছুটে আমার কাছে চলে আসলো, আমাকে জড়িয়ে ধরে হিমি কাঁদছে।
আদিত্য: আরে ভাইয়া।
আমি: হিমি কাঁদছে কেন? তুই এখানে হিমির কাছে কি করছিলি?
আদিত্য: আরে ভাবি তো ছাদে বসে ছিল আমি দেখে কাছে আসলাম এখন কেমন আছে জিজ্ঞেস করবো বলে কিন্তু ভাবি তো গতকালের মতো ভয় পেয়ে গেছে।
আমি: তাই?
আদিত্য: হ্যাঁ তাই আর কি কারণ হবে।
হিমি: না আরশান ও মিথ্যে বলছে, ও তো আমাকে…
আমি: কেঁদোনা, আদিত্য আমি তোর সব কথা শুনেছি। রাতে ফোনে কাকে যেন হুমকি দিলি এখন আবার হিমিকে দিচ্ছিস, এসব কি চাচ্চুকে বলবো?
আদিত্য: আশ্চর্য তো কি বলবে আমি করেছিটা কি?
হিমি: আপনি কিছু করেননি তাই না? আপনি তো দুবছর আগেই যা করার করেছিলেন, এখন আবার নতুন করে আমার জীবনে এসেছেন।
আদিত্য: এই মেয়ে একদম চুপ। (আদিত্যর ধমক শুনে হিমি ভয় পেয়ে আমার পিছনে এসে লুকালো)
আমি: নিজের পাপ ঢাকার জন্য হিমিকে হুমকি দিচ্ছিস এখন আবার ধমক দিচ্ছিস, তোর সাহস হয় কি করে ওকে ধমক দেওয়ার।
আদিত্য: তুমি না এই মেয়ের প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছ তাই আমার দোষ দেখতে পাচ্ছ। আসলে তো ও একটা খারাপ মেয়ে তাই আমার নামে মিথ্যে বলছে।
আমি: যতোটুকু বলেছিস ততোটুকুতেই থেমে থাক, এর বেশি কিছু বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলে রাখবো।
আদিত্য: এই বাজে মেয়েটার জন্য তুমি আমাকে মারবে?
আমি: আবার? তোকে আমি…
হিমি: আরশান ওকে ছাড়ুন, ও তো খারাপ ওর সাথে ঝগড়া করলে আপনারই সম্মান যাবে আপনার আম্মু কষ্ট পাবেন।
আদিত্য: এই মেয়েটার জন্য তুমি আমার সাথে এমন ব্যবহার করলে? এই মেয়েকে তুমি কতদিন আগলে রাখো দেখবো, এই মেয়ে কতদিন তোমার হয়ে থাকে আমি দেখবো।
আমি: তোকে… (আদিত্যকে মারতে যাচ্ছিলাম কিন্তু হিমি আটকে দিলো। আদিত্য রাগে গজগজ করতে করতে নিচে চলে গেলো)
হিমি: আপনি যে আমার জন্য নিজের ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করছেন এইটা কি ভালো? যখন মানুষ জানবে একটা মেয়ের জন্য দুভাই এর মধ্যে ঝগড়া হয়েছে তখন কি আমার সম্মান আর থাকবে?
আমি: সব তোমার জন্য হয়েছে, আমাকে কিছুই বলছ না তুমি। আমাকে সবকিছু বললে তবেই না আমি সজিবকে শাস্তি দিতে পারবো। না তুমি আমাকে বলবে কেন? আমি কে? হিমি আমার কি মনে হচ্ছে জানো তুমি আমাকে ভালোই বাস না।
হিমি: আরশান?
আমি: যদি ভালোবাসতে তাহলে আপন ভাবতে পারতে বিশ্বাস করতে। তুমি তো আমাকে আপন ভাবো না তাই সবকিছু লুকিয়ে রেখেছ।
হিমি: তা নয়…
আমি: তাহলে কি? কেন আমাকে বলছ না দুবছর আগে কি হয়েছিল? কেন ভীতু মেয়ের মতো এখনো সেই ঘটনা মনের মধ্যে পুষে রাখছ? তুমি তো চেষ্টা করলেই ভয় কাটিয়ে উঠতে পারো।
হিমি: কোন ভয় কাটিয়ে উঠবো? মন থেকে সজিবকে ভালোবেসেছিলাম আর ও আমার সাথে প্রতারণা করেছে সেইটা? নাকি আমি সজিবের সাথে ফিজিক্যাল রিলেশনে যাইনি বলে আমাকে কিডন্যাপ করে চারদিন একটা অন্ধকার রুমে আটকে রেখেছিল সেইটা? (হিমির কথা শুনে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম, হিমি ছাদে বসে পাগলের মতো কাঁদছে)
হিমি: আমি সেই চারদিনের কথা ভুলতে পারিনা, আমার চোখের সামনে সবসময় এগুলো ভাসে। আমি অন্ধকার ভয় পাই রাতে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাই, ঘুমের মধ্যে সেই অন্ধকার রুম দেখতে পাই। বলতে পারেন আমি কি করে অন্ধকার ঘরের কথা ভুলবো?
হিমি চিৎকার করে কাঁদছে, ওর পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। এখন বুঝতে পারছি হিমি কেন কথা লুকাতো, এসব ওকে মনে না করালেই ভালো হতো। নিজের ইচ্ছায় হিমিকে এতোটা কষ্ট দিলাম, এখন তো হিমির কান্না দেখে আমার চোখ থেকেও টুপটুপ করে পানি পড়ছে। মনে হচ্ছে আমার কলিজায় কেউ ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করেছে, খুব কষ্ট হচ্ছে, হিমির কষ্ট সহ্য করতে পারছি না…

হিমি আমার কাধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আমি ভাবছি হিমিকে কি কিছু জিজ্ঞেস করবো কিডন্যাপ এর ব্যাপারে? ভয় করছে হিমি যদি আবার রেগে যায়। হিমির দিকে তাকালাম এখনো কেঁদেই যাচ্ছে। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না, কেন যে ওকে এসব মনে করাতে গেলাম।
হিমি: আমি জানি আপনি কি ভাবছেন। (হঠাৎ হিমির কথায় আমার ঘোর কাটলো, এই মেয়ে কি জানে? ভুল কোনো ধারণা নিচ্ছে নাতো মনে?)
আমি: কি? কি জানো?
হিমি: ঐযে চারদিনের ব্যাপারে।
আমি: মানে? (হিমি উঠে দাঁড়ালো তারপর আমার দিকে তাকালো)
হিমি: ভালো সবাই বাসতে পারে কিন্তু নিঃস্বার্থভাবে ভালো সবাই বাসতে পারে নাহ।
হিমি রহস্যময়ী একটা হাসি দিয়ে চলে যেতে লাগলো। আমি নির্বাক হয়ে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি হিমি কি জানে? কি বুঝতে পেরেছে ও? ভুল কিছু নয়তো? ওর এই হাসির রহস্য কি? ওর এই কথার মানেই বা কি?

কোনো কিছুতে মন বসাতে পারছি না বারবার শুধু মনে হচ্ছে হিমির মনে আমাকে নিয়ে কোনো ভুল ধারণা বাসা বাঁধেনি তো?
আপু: ভাই আসবো? (আপুর ডাকে আমার ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো, আপু দরজায় দাঁড়িয়ে আছে)
আপু: কিরে আসবো?
আমি: হুম।
আপু: মন খারাপ?
আমি: না।
আপু: কিছু কি হয়েছে?
আমি: আপু হিমিকে হারানোর ভয় হচ্ছে। সজিব ফোনে হুমকি দিচ্ছে আর এদিকে তো…
আপু: কি?
আমি: আমার মনে হয় সজিব আদিত্যর ফ্রেন্ড।
আপু: কি বলিস?
আমি: হুম। আদিত্যকে কিছু বলতেও পারছি না হুটহাট রেগে যাচ্ছে।
আপু: আমি কি আদিত্যকে বুঝাবো?
আমি: না আমি নিজেই বুঝাবো কিন্তু এখন নয় আগে ওর রাগ কমুক।
আপু: ঠিক আছে। তোকে ডাকতে এসেছিলাম নিচে চল নাশতা করবি।
আমি: আপু একটা প্রশ্ন করবো?
আপু: হ্যাঁ বল।
আমি: তুই কি কাউকে ভালোবাসিস? মানে কারো সাথে কি রিলেশন…
আপু: হঠাৎ এই প্রশ্ন করছিস যে?
আমি: না এমনি।
আপু: তাড়াতাড়ি নিচে আয়।
আপু দ্রুত হেটে চলে গেলো। আপু কি আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো? তাহলে কি আপু কাউকে ভালোবাসে? কিন্তু আব্বু যে আপুর বিয়ে ঠিক করছে? না না কোনো কিছু গড়মিল হবার আগেই আপুর থেকে জানতে হবে আর আব্বুকে জানাতে হবে।

সবাই বসে নাশতা করছি হঠাৎ আমার ফোন বেজে উঠলো, এই সাতসকালে কে ফোন করলো ভাবতে ভাবতে পকেট থেকে ফোনটা বের করল। সজিবের নাম্বার দেখে মাথায় রাগ ছড়ে বসলো।
আমি: হ্যালো।
সজিব: ছিনতে পেরেছিস?
আমি: তোকে আবার ছিনতে পারবো না?
সজিব: এতোদিন আমি তোকে হুমকি দিচ্ছিলাম কিন্তু এখন তো তোর ভাই আমাকে হুমকি দিচ্ছে, কি করি বলতো। আসলে আ…
আমি: হিমিকে ভুলে যা সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
চাঁচি: উফফ খাবার টেবিলে বসেও সেই একই নাম হিমি, অসহ্য।
রোদেলা: তোমাকে শুনতে কে বলেছে আম্মু? কানে তুলো দিয়ে রাখতে পারো না?
চাঁচি: এই চুপ কর।
আমি: উফফ চুপ করবে তোমরা?
সজিব: আমি তোর সাথে দেখা করতে চাই।
আমি: কোথায়?
সজিব: রেস্টুরেন্টে।
আমি: কখন আসতে হবে?
সজিব: ঠিকানা সময় সব মেসেজে জানিয়ে দিবো।
আমি: ঠিক আছে।
সজিব ফোন রেখে দিলো। আমি খাবার রেখে ভাবছি সজিব হঠাৎ দেখা করতে চাইলো কেন? মেসেজটোন বেজে উঠলো, বারোটায় যেতে বলেছে। এখন বাজে আট’টা, তারমানে আমার হাতে চার ঘন্টা সময় আছে। আরিয়ান আর সিফাতকে কি বলবো? সজিবকে বিশ্বাস নেই যা খুশি করতে পারে। খাবার রেখে উঠে দাঁড়ালাম, রুমে গিয়ে একটু ভেবে দেখি কি করা যায়।

আদিত্য: ভাইয়া? (রুমের দিকে যাচ্ছিলাম সিঁড়িতে আসতেই আদিত্য পিছু ডাকলো)
আমি: কিছু বলবি?
আদিত্য: সকালের ব্যবহারের জন্য সরি। একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
আমি: হুম বল।
আদিত্য: তুমি কি সজিবের সাথে দেখা করতে যাচ্ছ? না মানে তোমার ফোনে কথা বলার ধরণ দেখে বুঝলাম।
আমি: হ্যাঁ।
আদিত্য: সজিব ভালো ছেলে নয় তুমি কেন শুধু শুধু রিস্ক নিচ্ছ?
আমি: ভালোবাসার জন্য এইটুকু রিস্ক তো নিতেই পারি। আচ্ছা সজিব কি তোর ফ্রেন্ড?
আদিত্য: হ্যাঁ। হিমিদের পাশের গ্রামের ছেলে সজিব, এখানে বাসা আছে বড় লোকের ছেলে। সজিব কিন্তু যা খুশি করতে পারে।
আমি: পরোয়া করিনা।
আদিত্য: কিন্তু আমি করি। ভাইয়া আমি খারাপ তাই বলে এতোটা খারাপ নই যে নিজের ভাইকে বিপদের দিকে ঠেলে দিবো। সজিব নিজের স্বার্থে সব করতে পারে, তোমার ক্ষতি করবে ও যেওনা তুমি।
আমি: আমি যাবো।
আদিত্য: আমি যেতে দিবো না।
আমি: পারলে আটকিয়ে দেখা।
আদিত্য: তোমার চোখ দুটো তো লাল হয়ে আছে। (আদিত্য আমার কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলো)
আদিত্য: তোমার শরীরে তো খুব জ্বর, বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধিয়েছ তাই না? চাঁচি চাঁচি…
আমি: আম্মুকে ডাকছিস কেন?
আদিত্য: তোমাকে আটকানোর রাস্তা পেয়ে গেছি।
আম্মু: কিরে ডাকছিলি? (আম্মু আঁচলে হাত মুছতে মুছতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসলেন, ইচ্ছে হচ্ছে আদিত্যকে দেই একটা)
আদিত্য: হ্যাঁ, দেখো ভাইয়ার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
আম্মু: কই দেখি।
আমি: আম্মু কিছু হয়নি ও মিথ্যে বলছে।
আম্মু: অনেক জ্বর তো।
আদিত্য: হ্যাঁ ও এই জ্বর নিয়ে বাইরে যেতে চাইছে।
আম্মু: একদম না, রুমে চল।
আম্মু আমাকে টেনে রুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, আদিত্য হাসছে। আশ্চর্য সকালে কি খারাপ ব্যবহার করল আর এখন আমাকে নিয়ে কতো ভাবছে।

বারোটা বাজতে মাত্র পনেরো মিনিট বাকি, আমি গায়ে বিছানা টেনে শুয়ে আছি। আদিত্য আম্মুকে কি বলেছে কে জানে আম্মু আমাকে এতক্ষণ ধরে শুয়ে রেখেছে আর কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। আম্মুর অস্থির হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, জ্বর মোটামুটি বেশিই উঠেছে, আসলে বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যাস নেই তো।
রোদেলা: ভাইয়া আসবো? (রোদেলার ডাকে দরজায় তাকালাম আর ওকে ইশারায় ভিতরে আসতে বললাম)
রোদেলা: আহারে রোমান্স করতে গিয়ে আমার ভাইটার কি হাল হলো।
আমি: মজা নিচ্ছিস? মজা না নিয়ে হিমির একটু খবর এনে দে, কে জানে পাগলীটা কি করছে।
রোদেলা: তোমার হিমি দরজা বন্ধ করে দিয়ে রুমে শুয়ে আছে, কারো ডাকে দরজা খুলছে না।
আমি: মানে? কিছু করে বসবে নাতো?
রোদেলা: ঝগড়া করেছ? কিছু করবে না ভয় পেয়ো না।
আদিত্য: রোদেলা যাতো ভাইয়ার সাথে আমার কথা আছে। (হুট করে আদিত্য এসে রুমে ঢুকলো, কি কথা বলবে ও? রোদেলা চলে যেতেই আদিত্য এসে আমার পাশে বসলো)
আমি: কেন করছিস এমন? সকালেই তো…
আদিত্য: সকালের কথা ভুলে যাও প্লিজ! আমি চাই না সজিব তোমার কোনো ক্ষতি করার সুযোগ পাক।
আমি: কিন্তু আমি না গেলে সজিব কি ভাববে? ভাববে আমি ভয় পেয়েছি। তখন ওর সাহস আরো বেড়ে যাবে।
আদিত্য: ঠিক আছে যেতে পারো কিন্তু একটা শর্তে।
আমি: কি?
আদিত্য: বাইক নেওয়া চলবে না। গাড়ি করে যাবে আর আমি ড্রাইভ করে নিয়ে যাবো।
আমি: তুই যাবি?
আদিত্য: হ্যাঁ তবে দূরে থাকবো।
আমি: ঠিক আছে।
আদিত্য: ভাইয়া একটা কথা বলবো?
আমি: হ্যাঁ বল।
আদিত্য: আমিতো ছোট নই তোমার থেকে মাত্র দুবছরের ছোট, আমি সব বুঝি। তুমি মেয়েটাকে ভুলে যাও, সজিব মেয়েটাকে যতোটা না ভালোবাসে তারচেয়ে বেশি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বিয়ে করতে চায়। মেয়েটাকে ভুল যাও নাহলে সজিব…
আমি: একবার বলেছিস আর বলিস না কথাটা। গাড়ি বের কর গিয়ে আমি আসছি।
আদিত্য: হুম।

সজিবের দেওয়া ঠিকানায় আসলাম, আদিত্য গাড়িতে বসে আছে আর আমি রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। চারপাশে চোখ বুলাচ্ছি, আচ্ছা সজিবকে আমি চিনবো কিভাবে? হঠাৎ একটি ছেলে হাত নেড়ে ইশারায় ডাক দিলো, ও একা বসে আছে তারমানে ও সজিব।
সজিব: আমি ভেবেছিলাম আসবি না। (আমি বসতে না বসতেই সজিব কথাটা বললো, আমি মুচকি হাসলাম)
আমি: তোর ডাকে না এসে পারি?
সজিব: আমাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল তাই না?
আমি: সেদিনই তো বললাম কাপুরুষকে দেখার ইচ্ছে…
সজিব: মুখ সামলে কথা বল এইটা রেস্টুরেন্ট এখানে কোন সিনক্রিয়েট করিস না।
আমি: ডেকেছিস কেন সেটা বল।
সজিব: হিমিকে ভুলে যা, আমি হিমিকে ভালোবাসি আর বিয়েও করবো।
আমি: তুই তো প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হিমিকে বিয়ে করতে চাস।
সজিব: তাতো বটেই, দুবছর আগের ওর হাতের থাপ্পড় আর ওর ভাইদের হাতের মাইর কি এতো সহজে আমি ভুলে যাবো?
আমি: এতকিছুর পরও তোর লজ্জা করেনা এসব করতে?
সজিব: লজ্জা করবে কেন? হিমি তো আমার বউ ওর সাথে আমার সব হয়ে গেছে এখন শুধু ওকে বউ সাজিয়ে আমার ঘরে আনার পালা। যেখানে হিমির সাথে আমার সব…
আমি: তোকে আমি…
আদিত্য: ভাইয়া ছাড়ো ওকে।
আমি: ও আমার হিমিকে জড়িয়ে খারাপ কথা বলেছে ওকে আমি…
আদিত্য: ছাড়ো বলছি। (সজিবের শার্টের কলার ধরেছিলাম আদিত্য এসে ছাড়িয়ে দিলো, ইচ্ছে হচ্ছে এই শালাকে এখানেই মেরে ফেলি)
সজিব: আমাকে মারলেই কি দুবছর আগের সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে? (সজিব বত্রিশটা দাঁত কেলিয়ে হাসছে ইচ্ছে হচ্ছে এক ঘুষি মেরে ওর সব কয়টা দাঁত ফেলে দেই)
আদিত্য: সজিব ভুলে যাস না ওই চারদিন আমিও তোর সাথে ছিলাম।
সজিব: তুই তো শালা মিরজাফর, এতদিন আমার সাথে থেকে এখন ভাইয়ের পক্ষ নিচ্ছিস।
আদিত্য: তুই কেরে? ভাই আগে না বন্ধু আগে? তাছাড়া তুই যদি ভালো হতি তাহলে মানতাম তুই তো একটা…
সজিব: এই…
আদিত্য: হিমিকে আমার ভাইয়ের বউ করে আনবো আর খুব শীঘ্রই পারলে আটকিয়ে দেখা।
আদিত্য আমাকে টেনে রেস্টুরেন্ট থেকে বের করে নিয়ে আসলো। আমি শুধু আদিত্যকে দেখছি আর অবাক হচ্ছি, যে ছেলেটা কারো কথা শুনে না সবসময় খারাপ পথে চলে সে আজ নিজের ভাইয়ের জন্য এতোটা ভাবছে?

আদিত্য কোনো কথা না বলে চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে, আমি পাশে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছি। হঠাৎ আমার ফোন বেজে উঠলো, অধরা ফোন দিয়েছে দেখে বেশ অবাক হয়েই রিসিভ করলাম।
আমি: হ্যালো।
অধরা: দেখা করতে পারবি?
আমি: কেন কোনো প্রয়োজন? আসলে আমি অসুস্থ জ…
অধরা: হ্যাঁ খুব প্রয়োজন। তোকে কিছু কথা বলার আছে আর কথা গুলো আজই বলতে হবে।
আমি: কোথায় আসবো?
অধরা: কলেজে।
আমি: ঠিক আছে আসছি। (ফোন রেখে আদিত্যর দিকে তাকালাম)
আদিত্য: কি?
আমি: কলেজে যেতে হবে একটু, তুই বাসায় চলে যা আমি ড্রাইভ করে যেতে পারবো।
আদিত্য: সমস্যা নেই আমি নিয়ে যাচ্ছি আর আমি নাহয় গাড়িতে বসে থাকবো।
আমি: হুম।

গাড়ি থেকে নামতেই অধরা, সিফাত আর আরিয়ানকে গাছের নিছে দেখতে পেলাম। অধরা কি বলবে ভাবতে ভাবতে ওদের কাছে আসলাম।
সিফাত: কিরে কেমন আছিস?
আমি: তোদেরকেও ডেকেছে?
আরিয়ান: হ্যাঁ অধরা নাকি তোকে কি বলবে। শান্তকে ডেকেছিল কিন্তু ও তো আর আসতে পারবে না।
সিফাত: কিরে অধরা আরশান তো আসলো এবার বল কি কথা।
অধরা: বলছি।
আমি: তুই বল আমি বসি, জ্বর তো মাথাটা কেমন যেন লাগছে।
সিফাত: জ্বর নিয়ে আসতে গেলি কেন?
আমি: অধরা যখন ডেকেছে নিশ্চয় ইম্পরট্যান্ট কিছু।
অধরা: হ্যাঁ সত্যি এইটা অনেক সিরিয়াস বিষয়। (অধরার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে গাছের নিছে এসে বসলাম। আমার পাশে সিফাত আর আরিয়ানও এসে বসলো)
আমি: কি হলো বল।
অধরা: আরশান আমি আসলে…
সিফাত: ওয়েট ওয়েট কি এমন কথা বলবি যে এতো লজ্জা পাচ্ছিস?
অধরা: আমাকে তো বলতে দিবি তোরা।
আরিয়ান: হ্যাঁ বল।
অধরা: আরশান আমি তোকে ভালোবেসে ফেলেছি, কথাটা তোকে না জানিয়ে থাকতে পারছিলাম না তাই বলে দিলাম। (অধরা একদমে কথা গুলো বলে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি বোকার মতো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, সিফাত আর আরিয়ান তো হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমি হাসবো নাকি অবাক হবো বুঝতে পারছি না, বোকার মতো শুধু অধরার দিকে তাকিয়েই আছি)
অধরা: সিফাত, আরিয়ান এইটা কিন্তু হাসির কোনো বিষয় নয়। আরশান আমি কিন্তু সিরিয়াস।
আমি: কি বলবো বুঝতে পারছি না।
সিফাত: মানলাম সিরিয়াস বিষয় এইটা, আচ্ছা অধরা এই কথাটা তুই আরশানকে আগে কেন বলিসনি?
আরিয়ান: হ্যাঁ আরশানের জীবনে হিমি আসার আগে বলতে পারতি।
অধরা: আসলে তখন আমি বুঝতে পারিনি।
সিফাত: এখন কয়েকদিনে বুঝে ফেলেছিস?
অধরা: হুম। হিমির প্রতি আরশানের ভালোবাসা কেয়ার এসব দেখে…
আরিয়ান: জেলাস ফিল করেছিস আর নিজের ভালোবাসাটা বুঝতে পেরেছিস তাইতো? অধরা তুই নিজেও জানিস আরশান হিমিকে কতো কষ্ট করে পেয়েছে আর ও হিমিকে কতোটা ভালোবাসে।
অধরা: আমিও তো আরশানকে খুব ভালোবাসি।
আমি: অধরা আমাদের সামনে বলেছিস ভালো কথা কিন্তু এই কথাটা যেন হিমির কান অব্ধি না পৌঁছোয়। আমি হিমিকে ভালোবাসি, আমি তোর কাছে হাত জোড় করছি প্লিজ আমাদের দুজনের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করিস না।
অধরা: কিন্তু আরশান আমিও তোকে ভালোবাসি।
আমি: আমি হিমিকে ভালোবাসি এইটা তো তোদের সবার জানা, তাহলে কেন জেনেশুনে ভুল পথে পা দিয়েছিস?
অধরা: কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক এসব কি মন বুঝে?
আমি: জেনেশুনে ভুল করেছিস আমার কিছু করার নেই। একটাই অনুরোধ এসব পাগলামি ভুলে আমাদের আগের অধরা হয়ে যাস। আসছি।
সিফাত: তোর না জ্বর একা যাবি কিভাবে?
আমি: আদিত্য গাড়িতে অপেক্ষা করছে।
আরিয়ান: ঠিক আছে যা।
অধরা কখনো এসব কথা বলবে আমিতো কল্পনাও করিনি। হিমির কথা জেনেশুনে অধরা এসব কথা বলতে পারলো কিভাবে?

সারা রাস্তা আদিত্যর সাথে কোনো কথা বলিনি, বাসায় পৌঁছেও কারো সাথে কথা বলিনি। চুপচাপ রুমে এসে শুয়ে পড়লাম, কিছু ভালো লাগছে না। বারবার শুধু আমি একটা কথাই ভাবছি হিমির কথা জানা সত্ত্বেও অধরা আমাকে নিয়ে এসব ভাবলো কিভাবে? কিভাবে বললো অধরা আমাকে ভালোবাসে?

গালের মধ্যে টুপটুপ করে পানি পড়ছে অনুভব করে ঘুম ভেঙ্গে গেলো, ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখি হিমি আমার মাথার পাশে বসে কাঁদছে। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম রাত আট’টা দশ মিনিট বাজে, বিকেলবেলা ঘুমিয়ে ছিলাম, এতক্ষণ ঘুমালাম আমি? কিন্তু হিমি কাঁদছে কেন? হিমির একটা হাত আমার মাথায় রাখা ওর হাত ধরে ওর দিকে তাকালাম, হিমি ভেজা ভেজা চোখে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আমি: কি হলো কাঁদছ কেন? (হিমি চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়েই আছে)
আমি: সারাদিন রুমের দরজা বন্ধ করে রেখেছিলে কেন? একবারো আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি? (হিমি আমার হাত থেকে ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো)
আমি: চলে যাচ্ছ কেন?
আম্মু: আরে মা চলে যাচ্ছ কেন? এই নাও ওষুধ আরশানকে খাইয়ে দাও। (হিমি আমি দুজনেই আম্মুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি)
হিমি: আন্টি আমার উপর আপনার রাগ হচ্ছে না?
আম্মু: রাগ হবে কেন?
হিমি: আমার জন্যই তো আরশানের এতো জ্বর, তখন আমাকে বললেই হতো আরশানের বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লাগে।
আম্মু: প্রিয় মানুষের খুশির জন্য এসব ছোট ছোট কষ্ট নিজেকে সহ্য করতে হয়। আরশান হিমি সন্ধ্যা থেকে ঠাই তোর মাথার পাশে বসে ছিল। (আম্মু হিমির গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে চলে গেলেন। হিমি ওষুধ নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলো)
আমি: ওষুধ পরে খাবো আগে বল সারাদিন আমার সাথে কথা বলনি কেন?
হিমি: লজ্জায়।
আমি: কিসের?
হিমি: ভয়ংকর সেই চারদিন নিয়ে আপনার মনে যা ভাবনা কাজ করছে তার জন্য। (হিমির এই কথা শুনে সজিবের বলা কথাটা মনে পড়লো, তখন সজিব বলছিল হিমির সাথে ওর সব হয়ে গেছে। তাহলে কি হিমি বারবার এই কথাটাই আমাকে বুঝাতে চাইছে? কিন্তু আমার মনে তো এসব কোনো ভাবনা আসেনি, আর আসবেই বা কেন আমিতো হিমিকে ভালোবাসি ওর শরীরকে নয়। তাছাড়া ঐ ঘটনাটা একটা দুর্ঘটনা ছিল এতে তো হিমির কোনো দোষ ছিলনা)
হিমি: আসছি আমি।
আমি: দাঁড়াও। (হিমি উঠে চলে যেতে চাইছিল আমার কথায় মাথা নিচু করে বসে রইলো)
আমি: সকালে তুমি বলেছিলে ভালো সবাই বাসতে পারে কিন্তু নিঃস্বার্থ ভাবে ভালো সবাই বাসতে পারে না। কেন বলেছিলে এই কথা?
হিমি: সেদিনের ঘটনায় আমার কোনো হাত ছিলনা আর আমি এখন যাই বলি আপনি বিশ্বাস করবেন না। এই ঘটনা জানার পর আর আট-দশটা মানুষ যা ভাববে আপনিও তাই ভেবেছেন এতে আপনার কোনো দোষ নেই। আসলে সবাই একটা পবিত্র মেয়েকে বিয়ে…
আমি: কি বলতে চাইছ তুমি অপবিত্র?
হিমি: যদি বলি তাই?
আমি: আমার ভালোবাসা দিয়ে সব অপবিত্রতা ধুয়ে দিবো। (হিমি আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে)
আমি: বিশ্বাস করো হিমি আমার মনে এসব কোনো ভাবনা আসেনি। তবুও যদি তুমি ভয় পেয়ে থাকো তাহলে চলো কালই আমরা বিয়ে করে ফেলি। (হিমি দুহাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো)
হিমি: সরি আরশান আমি আপনাকে পরীক্ষা করার জন্য মিথ্যে বলেছি, আমি হেরে গেছি।
আমি: কিসের পরীক্ষা? (হিমি কিছু না বলে কেঁদেই যাচ্ছে। বুঝতে পারছি না হিমি কিসের পরীক্ষার কথা বললো, তাহলে কি হিমি কোনো ভাবে আমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিয়েছে? হিমির দুগালে ধরে ওর মুখ উপড়ে তুললাম, হিমি লজ্জায় আমার চোখের দিকে তাকাতে পারছে না)
আমি: জানিনা কিসের পরীক্ষা নিয়েছ, শুধু এইটুকু জেনে রাখো ভালোবাসায় কোনো পরীক্ষা চলে না যা চলে তা হলো বিশ্বাস।
হিমি আমার চোখের দিকে তাকালো, লজ্জায় ওর মুখ লাল হয়ে গেছে। আমি মুচকি হেসে হিমির কপালে চুমু দিলাম, হিমি আরো বেশি লজ্জা পেয়ে আমার বুকে মুখ গুঁজে দিলো…

পার্ট: ১৬

সকালে রোদের আলো মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো, ঘুম ঘুম চোখে তাকালাম হিমি জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। রাতে লজ্জা পেয়ে দৌড়ে চলে গিয়েছিল এখন আবার এসেছে, আবার লজ্জা দিবো কিনা ভাবছি।
হিমি: ফ্রেশ হয়ে আসুন।
আমি: আবার আমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিতে এসেছ?
হিমি: সরি তো। এখন এসেছি আপনার জ্বর কমেছে কিনা দেখতে।
আমি: কমেছে?
হিমি: অনেকটা কমেছে। যান তো ফ্রেশ হয়ে আসুন, খাবার খেয়ে ওষুধ খাবেন।
আমি: ঠিক আছে।
হিমির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে ফ্রেশ হতে চলে আসলাম।

তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরুতে যাবো তখনি ঠাস করে কিসের যেন একটা শব্দ হলো, কিছু একটা ভেঙ্গে গেছে বুঝতে পারলাম। তাড়াতাড়ি রুমে আসলাম, রুমের অবস্থা দেখে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। খাবারের প্লেট, পানির গ্লাস ভাঙ্গা অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে আছে। হিমির দিকে তাকালাম রাগে কটমট করছে, তাহলে কি হিমি এগুলো ভেঙ্গেছে?
আমি: হিমি কি হয়েছে?
হিমি: সজিব তো আমার জীবনে অতীতে ছিল আমিতো ওকে রেখে আপনার সাথে রিলেশন করিনি, আপনি কেন আমাকে রেখে অধরার সাথে রিলেশন করেছেন?
আমি: কি বলছ এসব?
হিমি: এমন করার ইচ্ছে ছিল যখন আমাকে এতো স্বপ্ন দেখালেন কেন?
আমি: হিমি কেঁদো না কি হয়েছে বলো আমাকে।
হিমি: ভেবেছিলেন একসাথে দুটো রিলেশন করবেন আর আমি কখনো কিছু জানতে পারবো না? আমি সব জেনে গেছি অধরার মেসেজ পড়ে, আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন। আপনার সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই, কখনো আমার সামনে আসবেন না।
আমি: হিমি আমার কথা…
হিমির হাতে আমার ফোন ছিল, ফোন ফ্লোরে আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলে গেলো। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি, একটু সময়ের মধ্যে কি ঘটে গেলো কিছুই বুঝতে পারছি না। অধরা কি এমন মেসেজ করেছিল যে হিমি এতোটা রেগে গেলো?

আম্মু: আরশান কি হয়েছে এতো চেঁচামেচি… এগুলো ভাঙ্গলো কিভাবে? (আম্মু রুমে এসে এগুলো ফ্লোরে দেখে অবাক হয়ে গেলেন)
চাঁচি: হিমি মেয়েটাকে দেখলাম দৌড়ে চলে গেল ও ভেঙ্গেছে এসব তাই না? এই মেয়ের এতো সাহস? আজ তো ওর আম্মুকে সব বলবো। (সবাই আমার রুমে এসে ভীড় জমিয়েছে, কারো কথা আমার কান দিয়ে ঢুকছে না। আমি শুধু ভাবছি একটু আগে কি ঘটে গেলো। বিছানায় দফ করে বসে পড়লাম, হিমি আমাকে ভুল বুঝেছে অনেক বেশি ভুল বুঝেছে)
আম্মু: আরশান কি হয়েছে বল, হিমি কাঁদতে কাঁদতে তোর রুম থেকে বেরিয়ে গেল কেন? তুই অসুস্থ তাই মেয়েটা তোর জন্য নিজের হাতে রান্না করে খাবার নিয়ে এসেছিল আর…
আমি: কিছু হয়নি আম্মু রাগ করেছে আমি সামলে নিবো তুমি টেনশন করো না।
চাঁচি: হুহ রাগ করেছে ঢং।
আমি: চাঁচি প্লিজ আমার মাথা গরম করিও না।
চাঁচি: তোর মাথা তো ওই মেয়ে চিবিয়ে খেয়ে নিয়েছে। (চাঁচির দিকে রাগি চোখে তাকালাম, আম্মু তাড়াতাড়ি চাঁচিকে নিয়ে চলে গেলেন)
আপু: কি হইছে ভাই? হিমি তো রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, আমি ওখানেই ছিলাম কতো ডাকলাম সাড়া দিচ্ছে না।
আমি: যা ভয় পেয়েছিলাম তাই হয়েছে, এই অধরা আমাদের মধ্যে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আপু: অধরা?
আমি: হুম।
আদিত্য: কি হলো বাসায় এতো হৈচৈ কেন?
আমি: (নিশ্চুপ)
আপু: হিমি নাকি রাগ করেছে।
আদিত্য: কেন?
আপু: জানিনা। (আপু চলে গেল, আদিত্য এসে আমার পাশে বসলো)
আদিত্য: কি হয়েছে?
আমি: ভুল বুঝাবুঝি।
আদিত্য: আচ্ছা ভাইয়া মেয়েটা তোমাকে সত্যি ভালোবাসে তো?
আমি: মানে?
আদিত্য: না মানে ভালোবাসলে তো এভাবে তোমার পরীক্ষা নিতো না, বিশ্বাস করতো তোমাকে।
আমি: কখন পরীক্ষা নিলো?
আদিত্য: তুমি নিজেও সেটা জানো। কাল রাতে আমি ওদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম তোমার আর হিমির কথা শুনে তোমার দরজার পাশে দাঁড়াই, তুমি আবার ভেবো না লুকিয়ে তোমাদের রোমান্স দেখেছি।
আমি: না হেসে বল কি পরীক্ষা।
আদিত্য: কাল যখন ও বলছিল ও অপবিত্র তখনি আমি থমকে দাঁড়াই। অবাক হই যখন ও সেই চারদিনকে জড়িয়ে বললো ও অপবিত্র। কারণ সে চারদিন আমি আর আমাদের আরো দুটো ফ্রেন্ড ছিলাম সজিবের সাথে। সজিব চেয়েছিল হিমিকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলতে কিন্তু আমি আর রায়হান তা করতে দেইনি, এমনকি সজিব আমাদের জন্য হিমির গায়ে হাত দেওয়ার সাহস পায়নি। হিমি সব জেনেশুনে যখন রাতে তোমাকে বলছিল ও অপবিত্র তখন সত্যি খুব অবাক হয়েছিলাম কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পেরেছিলাম যে ও তোমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিচ্ছে। (তারমানে আমি ঠিক বুঝেছিলাম হিমি আমার পরীক্ষা নিয়েছিল কিন্তু নিজেকে অপবিত্র বলে পরীক্ষা নিবে আমি ভাবিনি)
আদিত্য: রেস্টুরেন্টে যখন সজিব বলেছিল হিমির সাথে ওর সব হয়ে গেছে তখন আমি চাইলে প্রতিবাদ করতে পারতাম কারণ আমার সব জানা কিন্তু আমি করিনি কারণ…
আমি: কারণ?
আদিত্য: ভুল বুঝো না, আমিও দেখতে চেয়েছিলাম তোমার ভালোবাসা কতটা সত্যি। সজিবের এসব কথার পরও তুমি হিমিকে ভালোবাস কিনা সেটা দেখতে চেয়েছিলাম।
আমি: বাহ্ ভালো তো, আমার ভালোবাসা কেউ বিশ্বাস করেনা।
আদিত্য: আমি করি, তোমার ভালোবাসায় জোড় আছে। নাহলে কেউ একটা মেয়েকে অপবিত্র জেনেও কাছে টেনে নেয়?
আমি: লাভ কি হলো সেই তো অধরা মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়ালো।
আদিত্য: এসব ছোটখাটো ভুল বুঝাবুঝি হয়েই থাকে, চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি: হুম।
আদিত্য মুচকি হেসে চলে গেলো। আমি চুপচাপ বসে আছি কি করবো বুঝতে পারছি না।

বারান্দার রেলিং ধরে উদাসীন হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি হঠাৎ কাধে কারো হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলাম, পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি হিমি। হিমির দুচোখে পানি টলমল করছে।
হিমি: অন্যায় করেছেন শাস্তি ভোগ করবেন, এতো ঢং কিসের?
আমি: কি?
হিমি: খাবার খাচ্ছেন না কেন? ওষুধ খাচ্ছেন না কেন?
আমি: খাবার, ওষুধ… (রুমের দিকে চোখ পড়লো রোদেলা দাঁড়িয়ে হাসছে, তারমানে রোদেলা হিমিকে এসব বলে নিয়ে এসেছে। এরকম ভাই বোন থাকলে আমাদের আলাদা করার সাধ্য কার আছে?)
হিমি: ওদিকে তাকিয়ে আবার হাসছেন কেন?
আমি: একটু আগেই তো বললে আমাদের সব সম্পর্ক শেষ আমি যেন তোমার সামনে না যাই।
হিমি: হুম।
আমি: সম্পর্ক যেহেতু শেষ তাহলে আমি ওষুধ না খেলে তোমার কি?
হিমি কিছু না বলে আমার হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে আসলো।

হিমির পিছু পিছু এসে ভদ্র ছেলের মতো বিছানায় বসলাম। হিমি টেবিল থেকে খাবার এনে আমার সামনে ধরলো।
হিমি: রোদেলা এতো করে বললো তখন খেলেন না কেন? (হিমির কথা শুনে হাসলাম, হিমি তো আর জানেনা আমার বোন যে ওকে বোকা বানিয়ে নিয়ে এসেছে)
হিমি: হাসুন বেশি করে, অধরা…
আমি: হিমি প্লিজ!
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: আমার ফোন তো ভেঙ্গে ফেলেছ নাহলে অধরার এখন খবর ছিল।
হিমি: সত্যিটা আমি জেনে গেছি তাই?
আমি: কিসের সত্যি? তখন থেকে আমি কিছু বলার চেষ্টা করছি তুমি শুনছই না। অধরা কি মেসেজ করেছিল সেটা…
হিমি: অন্যায় তো করেছেন আবার আমাকে ধমক দিচ্ছেন, থাকুন আপনি।
হিমি খাবারের প্লেট রেখে হনহন করে হেটে চলে গেলো। এই অধরার সাথে কথা বলতে হবে নাহলে পরবর্তীতে আরো বড় ঝামেলা হবে। শান্তদের বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।

শান্ত: সব তো শুনলাম এবার বল কি করতে পারি? অধরা এমন করবে আমিতো ভাবতেই পারিনি। (শান্তর সামনে চুপচাপ বসে আছি কি করবো বুঝতে পারছি না)
শান্ত: এতো টেনশন করিস না আমি অধরাকে বুঝাবো।
আমি: ওকে ফোন করে তোদের বাসায় আসতে বল।
শান্ত: ঠিক আছে।
তারিন: আরশান ভাইয়া তোমার থেকে এমন কিছু আশা করিনি। (তারিন এসে শান্তর পাশে বসতে বসতে কথাগুলো বললো, আমি নির্বাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি)
তারিন: তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে হিমির চোখে কখনো পানি আসতে দিবে না।
শান্ত: এতে আরশানের কোনো দোষ নেই, না জেনে কথা বলবি না।
তারিন: হিমি আমাকে সব বলেছে।
শান্ত: হিমি ভুল বুঝেছে আর তোকে ভুলটাই বলেছে। অধরা এখানে আসছে অপেক্ষা কর সব বুঝতে পারবি।
তারিন: হুম।

প্রায় এক ঘন্টা অপেক্ষা করার পর অধরা আসলো। আমাকে দেখে চমকে উঠলো, হয়তো শান্ত আমার কথা বলেনি।
শান্ত: এতো অবাক হচ্ছিস কেন?
অধরা: না মানে আরশান এখানে?
আমি: আমিই তোকে আনিয়েছি।
অধরা: কিন্তু কেন?
আমি: অধরা প্লিজ তুই সত্যিটা বল, তুই কি আমাকে সত্যি ভালোবাসিস নাকি সজিবের কথায় এসব করছিস?
অধরা: সজিব কে? আর ভালোবাসা নিয়ে কেউ মিথ্যে বলে নাকি?
আমি: সকালে কি মেসেজ করেছিলি? জানিস হিমি আমাকে ভুল বুঝেছে?
অধরা: আমিতো জাস্ট আই লাভ ইউ লিখে মেসেজ করেছিলাম। আর হিমি তোকে ভুল বুঝলে আমার কি? আমিতো আরো খুশি যে হিমি তোকে ভুল বুঝে ছেড়ে চলে যাবে আর তুই আমার… (অধরার গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিলাম, ও গালে হাত দিয়ে হাসছে)
আমি: তুই এমন করবি আমি কখনো ভাবতেই পারিনি।
শান্ত: তুই এতো পাল্টে যাবি ভাবিনি রে। তুই সত্যি অনেক নিচু মনের মানুষ হয়ে গেছিস।
অধরা: কখনো কখনো ভালোবাসার জন্য খারাপ হতে হয়।
আমি: তারিন এখন বুঝেছ তো কার দোষ?
তারিন: হুম বুঝেছি। অধরা আপু প্লিজ হিমি আর আরশান ভাইয়ার সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট করে দিওনা।
অধরা: ওদেরকে তো আলাদা আমি করবই।
আমি: পারবি না আমাদের ভালোবাসা এতো ঠুনকো না। (অধরা চলে যাচ্ছিল আমার কথা শুনে পিছন ফিরে তাকিয়ে মুচকি হাসলো)
অধরা: সেটা সময়ই বলে দিবে। (অধরা চলে গেলো, কোনো লাভ হলো না ওর সাথে দেখা করে, উল্টো মাথা গরম করে দিয়ে চলে গেলো)
তারিন: আরশান ভাইয়া তুমি টেনশন করো না আমি হিমিকে বুঝিয়ে বলবো।
আমি: ঠিক আছে আসছি।
শান্ত: সাবধানে যাস।

দুপুরের কড়া রোদে ফুটপাত ধরে হাটছি, জ্বর গায়ে বড্ড ক্লান্ত লাগছে। একদিকে সজিব কখন যেন কি করে বসে তার উপর আবার অধরা পাগলামি শুরু করেছে, আমি যে কি করবো ভেবেই পাচ্ছি না। হঠাৎ রাস্তার পাশের ছোট একটি দোকানে চোখ পড়লো, হরেক রকমের কাঁচের চুড়ি দেখে আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। হিমি তো চুড়ি খুব পছন্দ করে, চুড়ি নিয়ে গেলে নিশ্চয় ওর রাগ কমে যাবে। দোকানে এসে চুড়ি দেখছি আর ভাবছি কোন রঙের চুড়ি নিবো। হিমির কোন রঙ পছন্দ আমিতো জানিনা। এক কাজ করলে কেমন হয় সব রঙের চুড়ি নিয়ে যাই, হিমির যেগুলো পছন্দ হবে সেগুলো পড়বে। এক এক করে সব রঙের চুড়ি কিনলাম। দোকানদার প্যাকেট করছে আর হাসছে, হয়তো ভাবছে আমি পাগল হয়ে গেছি।

চুড়ির প্যাকেট হাতে নিয়ে হিমিদের ফ্ল্যাটে এসে কলিংবেল বাজালাম, ভাবি এসে দরজা খুলে দিলেন।
আমি: ভাবি হিমি…
ভাবি: হিমি তো বাসায় নেই।
আমি: কোথায় গেছে?
ভাবি: মা’কে নিয়ে ডক্টর এর কাছে গেছে।
আমি: ওহ!
ভাবি: গিফট নিয়ে আসা হয়েছে বুঝি মহারাণীর রাগ ভাঙ্গানোর জন্য? (ভাবির কথা শুনে মৃদু হাসলাম)
ভাবি: হিমি আসলে বলবো তোমার সাথে দেখা করার জন্য।
আমি: ঠিক আছে।
ভাবির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে আসলাম।

বাসায় এসে সবার তাড়াহুড়ো করে কাজ করা দেখে বেশ অবাক হলাম, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। বাসায় কি কোনো অনুষ্ঠান নাকি সবাই এতো কাজ করছে কেন?
রোদেলা: ভাইয়া তুমি এসেছ? বাসায় মেহমান আসবে কাজে লেগে পড়ো।
আমি: মেহমান?
আম্মু: হ্যাঁ ফারিয়াকে দেখতে আসবে। (আম্মুর কথা শুনে বেশ অবাক হলাম, হুট করে দেখতে আসবে আপুকে বিষয়টা কেমন যেন লাগছে)
আমি: কিন্তু আম্মু হঠাৎ করে…
আম্মু: তোর আব্বু কি কখনো কিছু বলে করে? কিছুক্ষণ আগে ফোন করে বললো সন্ধ্যার দিকে বাসায় আসবে আর সাথে মেহমানও আসবে।
আমি: আপু জানে?
আম্মু: হ্যাঁ। ফারিয়া তো রেডি হচ্ছে, বিকেল হয়ে গেছে তো মেহমান হঠাৎ চলে আসতে পারে।
আমি: আসছি আমি।

রুমে এসে চুড়ির প্যাকেট’টা রেখে আপুর রুমের দিকে আসলাম। আপুর রুমের দরজা লক করা দেখে বেশ অবাক হলাম, এই সময়ে দরজা লক?
আমি: আপু আপু?
আপু: কি হয়েছে?
আমি: দরজা খুলো।
আপু: আমি শাড়ি পড়ছি, পরে আসিস।
আমি: ঠিক আছে। (আপু কি মিথ্যে বললো? আপুর গলাটা কেমন যেন লাগছিল, মনে হলো গলায় কান্না দলা পেকে আসছিল। আপু কি কিছু লুকাচ্ছে আমার থেকে? এসব ভাবতে ভাবতে রুমে এসে ঢুকলাম, হিমি বসে আছে দেখে বেশ অবাক হলাম)
আমি: হিমি?
হিমি: আমাকে খুঁজে নাকি বাসায় গিয়েছিলেন?
আমি: হুম, ডক্টর এর কাছ থেকে কখন আসলে?
হিমি: এইতো কিছুক্ষণ হলো, রুমে না গিয়ে সোজা এখানে আসলাম।
আমি: তারমানে তারিনের সাথে তোমার কথা হয়নি?
হিমি: কি কথা?
আমি: অধরাকে নিয়ে।
হিমি: আমি এই নামটা শুনতে চাই না। আর একটা কথা শুনে রাখুন…
আমি: কি কথা?
হিমি: সজিবের ব্যাপারে আমি ছোট ভাইয়াকে সব বলেছি, ভাইয়া দেশে আসছেন আর…
আমি: আর?
হিমি: ভাইয়া আসলেই আমরা এ বাসা ছেড়ে চলে যাবো।
আমি: হিমি?
হিমি: এখানে থাকলে আমি আপনাকে ভুলতে পারবো না, অন্য কোথাও চলে যাওয়াটাই ভালো।
আমি: তারিনের সাথে কথা বলো তাহলে তোমার সব ভুল ভেঙ্গে যাবে। আর আজ প্লিজ এমন করো না, এমনিতেই আমি আপুকে নিয়ে টেনশনে আছি।
হিমি: কেন?
আমি: আপুকে আজ দেখতে আসবে।
হিমি: সত্যি? আমি আপুকে সাজাবো, আমার কনে সাজাতে ভালো লাগে। আসছি।
আমি: হিমি শুনো।
হিমি: কি?
আমি: এই প্যাকেট’টা খুলো।
হিমি: কি আছে এতে?
আমি: খুলে দেখো। (হিমি বিস্ময়ভরা চোখে প্যাকেট’টা নেড়েছেড়ে দেখছে)
আমি: কি হলো খুলো।
হিমি: হুম। (প্যাকেট খুলে এতো গুলো চুড়ি দেখে হিমি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো)
হিমি: এতগুলো?
আমি: তোমার পছন্দের রঙ কি আমিতো জানিনা তাই সব রঙের চুড়ি নিয়ে আসলাম। (হিমি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে চুড়ি গুলো বিছানার উপর রেখে দিলো)
আমি: কি হলো নিবে না এগুলো?
হিমি: ভালোবাসাটাই তো অন্য একজন কেড়ে নিয়েছে চুড়ি দিয়ে কি হবে? একটা মেয়ের কাছে তার ভালোবাসার চেয়ে দামী কিছু হয় না। মেয়েরা এসব চায় না ভালোবাসা চায় একটুখানি, আর সেটা পেলে কাউকে ভাগ দিতে পারেনা। মেয়েরা সব ভাগ করতে পারে কিন্তু নিজের ভালোবাসাকে না।
হিমি চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে গেলো। অনেক কষ্ট পেয়েছে হিমি, সত্যিই তো অন্য মেয়েকে সহ্য করবে কিভাবে?

মেহমানরা সবাই ড্রয়িংরুমে বসে আপুকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছে, পাশে আব্বু আর চাচ্চু বসা। আমি আর আদিত্য এক পাশে দাঁড়িয়ে আছি। আমি এক দৃষ্টিতে ছেলেকে দেখছি আর ভাবছি কেমন হবে ও? আমার বোনকে সুখে রাখবে তো? ভালোবাসবে তো আপুকে?
আব্বু: আরে আরশান উনাদের অনেক দূর যেতে হবে গিয়ে দেখো ফারিয়ার হলো কিনা।
আমি: যাচ্ছি আব্বু।

আপুর বিয়ে নিয়ে আব্বু যে কেন এতো তাড়াহুড়ো করছেন আমি বুঝতে পারছি না। নিশ্চয় আব্বুর কোনো একটা প্ল্যান আছে। আপুর রুমে ঢুকতে যাবো তখনি হিমি আর রোদেলা আপুকে নিয়ে রুম থেকে বের হলো। আমি অপলক দৃষ্টিতে আপুকে দেখছি, কি সুন্দর লাগছে আমার আপুটাকে।
আপু: কিরে আরশান কি হলো?
আমি: দেখছিলাম ছেলেটার সাথে তোকে মানাবে কিনা, ছেলেটা দেখতে মোটামুটি ভা… (আপু মুখটা মলিন করে ফেললো, হিমি আর রোদেলাও সেটা লক্ষ করেছে)
রোদেলা: আপু কি হয়েছে?
আপু: কিছু নাতো।
আমি: আপু তুই এই বিয়েতে খুশি তো? নাকি আব্বুর কথায়…
আপু: তোর সুখের জন্য আমি নিজের সুখকে বিসর্জন দিতে পারি।
আমি: মানে?
আপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলো, আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। আপু কি বলে গেলো? আমার সুখের জন্য আপু নিজের সুখ বিসর্জন দিচ্ছে মানে কি? আপু কি কাউকে ভালোবাসে? কিন্তু ভালোবাসলে আমার সুখের জন্য অন্য কাউকে বিয়ে করবে কেন? কি বুঝাতে চেয়েছে আপু? মাথায় হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে আমি ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম…

পার্ট: ১৭

মেহমানদের সামনে আপু বসে আছে, সবাই কতো হাসিখুশি। কিন্তু আমি আপুর দিকে নজর রাখছি, আপুর দুচোখে পানি টলমল করছে মুখটা মলিন হয়ে আছে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে আপু কষ্ট করে মলিন মুখে হাসি ফুঁটানোর বৃথা চেষ্টা করছে। আপু কোনো চালাকি করছে নাকি আব্বু বুঝে উঠতে পারছি না।
আদিত্য: আপুর দিকে এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে কি দেখছ? (কানের কাছে আদিত্যর কন্ঠ শুনে আমার ঘোর কাটলো, আদিত্যর দিকে তাকালাম)
আদিত্য: কি?
আমি: কেন জানিনা মনে হচ্ছে আপু এই বিয়েতে রাজি না। আপুর দিকে দেখ চোখে পানি চিকচিক করছে, মুখটা মলিন।
আদিত্য: তাহলে বিয়ে হবে না।
আমি: তোর কি মনে হয় আব্বু সেটা মেনে নিবে? আব্বু ছেলে পছন্দ করেছেন মানে নিশ্চয় ব্যবসায়ীক কাজের লাভ খুঁজেই করেছেন।
আদিত্য: তাই বলে আমরা আপুকে কষ্টের দিকে ঠেলে দিবো?
আমি: মেহমান যাক তারপর নাহয় এসব নিয়ে কথা হবে।
আদিত্য: হুম।

খাবার টেবিলে বসে আপুকে লক্ষ করছি, আপু আঙ্গুল দিয়ে প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করছে আর কি যেন আনমনা হয়ে ভাবছে। মেহমান যাওয়ার পর থেকেই দেখছি আপু বারবার আনমনা হয়ে কি যেন ভাবছে।
আম্মু: কিরে আরশান খাচ্ছিস না কেন? (আম্মুর ডাকে আপু আমি দুজনেই কেঁপে উঠলাম, আপু তাড়াতাড়ি খাবার খাওয়ায় মন দিলো)
আদিত্য: আপু ছেলেকে তোমার পছন্দ হয়েছে? (আদিত্যর প্রশ্ন শুনে আপু মাথা তুলে তাকিয়ে মৃদু হাসলো)
আদিত্য: আচ্ছা আপু তুমি এই বিয়েতে রাজি তো? না মানে কোনো…
আব্বু: আদিত্য একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? আর ফারিয়া বিয়েতে রাজি হবে না কেন? সুন্দর সুদর্শন, উচ্চ শিক্ষিত, ভালো বংশের ছেলে, টাকা পয়সা ব্যাংক ব্যালেন্স এর অভাব নেই ছেলের। এমন ছেলেই তো পাত্র হিসেবে ভালো।
আমি: আব্বু এসবের আগে যেটা প্রয়োজন সেটা হলো ভালোবাসা, আগে তো দুজনের মধ্যে বুঝাপড়া…
আব্বু: বিয়ের পর এমনিতেই ভালোবাসা হয়ে যাবে।
আমি: আব্বু…
আব্বু: ইদানীং প্রেম ভালোবাসা নিয়ে একটু বেশিই ভাবছ মনে হচ্ছে? ফারিয়াকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না নিজেকে নিয়ে ভাবো। কারো কথা তো তুমি শুনোনা, শুধু একটা কথাই বলি ভুল করেও পঁচা শামুকে পা কাটতে যেওনা। (আব্বু উঠে চলে গেলেন, আপু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। পঁচা শামুক বলতে আব্বু কি বুঝাতে চেয়েছেন?)
আম্মু: কেন যে শুধু শুধু তোর আব্বুকে রাগাতে যাস।
চাঁচি: এটাই তো তোমার ছেলে ভালো পারে।
রোদেলা: ভাইয়ারা তো ভুল কিছু বলেনি, যেখানে আপু রাজি না সেখানে বিয়ে হবে না ব্যস।
আপু: আমি কি একবারো বলেছি আমি রাজি না? তোরা কেন শুধু শুধু অশান্তি সৃষ্টি করছিস?
আমি: আপু কিছু লোকানোর চেষ্টা করিস না, আমি ঠিক সব খুঁজে বের করবো।
আপু আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে, চুপচাপ উঠে চলে আসলাম।

রুমে ঢুকে লাইট জ্বালাতেই বিছানায় ছড়িয়ে থাকা চুড়ি গুলোর দিকে চোখ পড়লো। হিমি এখনো রেগে আছে আর রাগ করাটা তো স্বাভাবিক, এভাবে হুট করে এমন মেসেজ দেখলে তো যে কারো রাগ হবে। রুমে একদম মন বসছে না গীটার হাতে নিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম।

চিলকোঠোর ঘরে ডীম লাইট জ্বালিয়ে ফ্লোরে বসে আনমনা হয়ে গীটার বাজাচ্ছি আর হিমির কথা ভাবছি। হঠাৎ দরজায় চোখ পড়লো, হিমি দাঁড়িয়ে গীটার বাজানো শুনছে। গীটার রেখে হিমির দিকে তাকালাম, হিমি এগিয়ে এসে আমার পাশে বসলো।
আমি: ঘুমাওনি? অনেক রাত হয়েছে তো।
হিমি: আপনার সাথে কথা না বলা পর্যন্ত ঘুম আসছিল না। আর আজ তো হুট করে আপনার রুমেও যেতে পারিনি কারণ আপনার আব্বু বাসায়।
আমি: তাতে কি হয়েছে?
হিমি: আপনার আব্বুকে দেখলেই আমার কেমন যেন ভয় লাগে। (হিমির কথা শুনে মৃদু হাসলাম)
হিমি: আরশান সরি। (হিমি আমার কাধে মাথা রেখে এক হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো, আমি বেশ অবাক হয়েই ওর দিকে তাকালাম)
হিমি: সকালে অধরার আই লাভ ইউ লেখা মেসেজ দেখে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল তাই রেগে গিয়ে…
আমি: তারিনের সাথে কথা হয়েছে?
হিমি: হ্যাঁ।
আমি: এজন্যই মহারাণীর রাগ কমে গেছে।
হিমি: সরি। আসলে একবার প্রতারণার স্বীকার হয়েছি তো তাই এখন অল্পতেই ভয় পেয়ে যাই।
আমি: বিশ্বাস রাখো আমার উপর আমি তোমাকে ঠকাবো না। (হিমি মিষ্টি হাসি দিয়ে আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো)
আমি: সারাদিন যে আমাকে কষ্ট দিয়েছ এবার তোমাকে কি শাস্তি দেওয়া যায়?
হিমি: যা শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নিবো।
আমি: তুমি গান গাইবে আর আমি গীটার বাজাবো।
হিমি: হ্যাঁ আর আম্মু আমার কন্ঠ শুনে এসে আমাকে আপনার সাথে দেখুক আর কাল সূর্য উঠার আগেই আমাকে নিয়ে গ্রামে চলে যাক তাই তো?
আমি: লাগবে না, তুমি দূরে গেলে আমি দম বন্ধ হয়ে মরেই যাবো।
হিমি: মরার কথা আসছে কেন?
আমি: তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো নাতো। (হিমি আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে। আমি হিমির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছি, নীল ডীম লাইটের আলোতে হিমির মায়াবী মুখ আরো বেশি মায়াবী লাগছে)
হিমি: হাসছেন কেন?
আমি: রাতের আধারে পেত্নী দেখে।
হিমি: কি?
আমি: ভালোবাসি। (হিমির কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ও লজ্জায় দুচোখ বন্ধ করে নিয়েছে। চোখ দুটো বন্ধ, ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি, ডীম লাইটের আলো সবকিছু মিলে হিমিকে এক অদ্ভুদ সৌন্দর্য ঘিরে নিয়েছে, আমি মুগ্ধ হয়ে হিমির সৌন্দর্য দেখছি)
আমি: এইযে লজ্জাবতী? (আমার ডাকে হিমি চোখ খুলে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো)
আমি: আচ্ছা তুমি কি বিয়ের পরও এভাবে লজ্জা পাবে? (হিমি ভ্রু কুঁচকিয়ে আমার দিকে তাকালো, আমি মুচকি হাসলাম)
আমি: না মানে বিয়ের পর এভাবে লজ্জা পেলে আমরা রোমান্স করবো কিভাবে?
হিমি: আপনি সত্যিই খুব দুষ্টু। (হিমি লজ্জা পেয়ে আমার বুকে মুখ গুঁজে দিলো, ওকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে চুমু দিলাম)
হিমি: আরশান আমাদের ভালোবাসা সাকসেস হবে তো? বিয়ে হবে তো আমাদের?
আমি: আমার উপর ভরসা রাখো, আল্লাহ্‌ ছাড়া আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।
হিমি: আর অধরা?
আমি: আবার অধরা?
হিমি: কথা দিন ওই বজ্জাত মেয়ের সাথে আর কথা বলবেন না।
আমি: ঠিক আছে বলবো না।
হিমি চুপচাপ আমার কাধে মাথা রেখে একহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে আর আমি গীটার বাজাচ্ছি।

সকালে হুট করে ঘুম ভেঙ্গে গেলো, ঘুম ঘুম চোখে চারপাশে তাকিয়ে নিজেকে চিলকোঠোর ঘরে আবিষ্কার করলাম। হিমি আমার বুকে মুখ গুঁজে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে, ওর চুল গুলো এলোমেলো হয়ে ওর মুখে আর আমার উপরে ছড়িয়ে আছে। রাতের কথা মনে পড়লো, তারমানে গীটার বাজাতে বাজাতে এখানেই খাটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হিমির দিকে তাকালাম ওর মুখে আসা চুল গুলো আলতো করে সরিয়ে দিলাম। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন এই ঘুমন্ত পরীটাকে জাগাতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু জাগাতে তো হবেই, হিমির আম্মু বা অন্য কেউ এভাবে আমাদের একসাথে দেখলে খুব বড় ঝামেলা হবে। হিমির গালে আলতো করে একটা হাত রেখে ওকে ডাকলাম…
আমি: হিমি হিমি?
হিমি: হু।
আমি: উঠে রুমে যাও।
হিমি: উঁহু। (হিমি আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, এখন তো মহাবিপদে পড়লাম)
আমি: হিমি তোমার আম্মু এসেছেন। (হিমি ধড়পড়িয়ে উঠে আমাকে ছেড়ে দূরে গিয়ে বসলো, ঘুম ঘুম চোখে চারপাশে চোখ বোলাচ্ছে)
আমি: সরি তোমাকে জাগানোর জন্য মিথ্যে বলেছি। তোমার আম্মু তো তোমাকে খুঁজে ছাদে আসতেই পারেন, রুমে যাও।
হিমি: আম্মু যদি বুঝতে পারেন আমি যে সারারাত এখানে আপনার সা…
আমি: বুঝবে না, যাও তুমি।
হিমি: হুম।
আমি: হিমি শুনো। (হিমি চলে যাচ্ছিল আমার ডাকে থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকালো)
আমি: তোমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় খুব সুন্দর লাগে, মনে হয় যেন কোনো এক মায়াবী পরী ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত হিমিকে এতোটা সুন্দর লাগে জানা ছিল না আমার।
হিমি: প্রিয়জনের বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে এতোটা ভালো লাগে আমারও জানা ছিলনা।
হিমি হাসতে হাসতে দৌড়ে চলে গেলো, আমি ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম।

রুমে এসে বিছানার দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলাম, চুড়ি গুলো বিছানায় নেই। কে এসেছিল আমার রুমে? চুড়ি গুলো কে নিলো?
রোদেলা: ভাইয়া চাচ্চু ডাকছেন নাশতা করবে না? (চুড়ি গুলো খুঁজছিলাম হঠাৎ রোদেলা আসলো)
আমি: তুই আমার রুমে এসেছিলি?
রোদেলা: আমিতো এখন মাত্র আসলাম, কেন কি হয়েছে?
আমি: কিছুনা যা আসছি আমি।
রোদেলা: তাড়াতাড়ি।
চুড়ি গুলো কোথায় গেল ভাবতে ভাবতে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।

আম্মু: আরশান সকালে কোথায় গিয়েছিলি? (খাবার মুখে দিতে যাবো তখনি আম্মু প্রশ্ন করলেন, সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এখন কি উত্তর দিবো?)
চাচ্চু: কোথায় ছিল মানে? রুমে ছিলনা?
আম্মু: না সকালে গিয়ে দেখলাম রুমে নেই।
আমি: রাতে গীটার বাজাচ্ছিলাম চিলকোঠোর ঘরে বসে আর ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
আব্বু: একা? (আব্বুর প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলাম হাত থেকে খাবার পরে গেলো, আব্বু একা কিনা জিজ্ঞেস করলেন কেন? তবে কি…)
আব্বু: না মানে…
আপু: বাদ দাও না খেতে বসেছে খেতে দাও ওকে। (আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ী একটা হাসি দিলেন, তারমানে আব্বু হিমিকে আমার সাথে দেখেছেন। আপুর বিয়ের আগে এখনি হিমির কথাটা আব্বুকে জানতে দেওয়া উচিত হয়নি)
রোদেলা: আরশান ভাইয়া তুমি তো কলেজে যাওনি তাই জানোনা, কলেজ থেকে টুরে যাচ্ছে, যাবে তুমি? তুমি গেলে আমি যেতে পারবো আরকি?
আদিত্য: কেন যাবে না ভাইয়া তো এমন একটা সুযোগেরই অপেক্ষা করছিল। (আদিত্য আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, আমি আব্বুকে লক্ষ করছি শুধু)
আব্বু: এখন কারো কোথাও যাওয়া হবে না। অসীম এর আব্বু বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলেছেন, এক সপ্তাহ পর বিয়ে।
আদিত্য: অসীম?
আব্বু: নিজেদের বোন বিয়ে দিবে অথচ যার কাছে দিবে তার নামটাই জানোনা?
আপু: অন্যরা জানার প্রয়োজন কি আব্বু? তুমি তো একাই একশ, তুমিই সবকিছু জানলে হবে।
আপু কথা গুলো বলে হাসলো, আব্বু কোনো উত্তর দিলেন না কথা গুলোর। সবকিছু কেমন যেন রহস্যের মতো লাগছে, আপু আর আব্বু কিছু একটা যে লুকাচ্ছে সেটা তো এখন স্পষ্ট।

কলেজে সবাই একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছি। সিফাত গীটার বাজাচ্ছে, আরিয়ান আর শান্ত গান গাইছে, আমি আনমনা হয়ে বসে আছি। হঠাৎ শান্ত ধাক্কা দিলো আমাকে।
শান্ত: কি হয়েছেরে?
আমি: কিছুনা।
সিফাত: অধরাকে খুব মিস করছি রে, ও এভাবে বদলে যাবে কখনো ভাবিনি।
আমি: (নিশ্চুপ)
আরিয়ান: অধরার সাথে তোর আর কথা হয়েছে?
আমি: না, হিমি তো আমার ফোনটাই ভেঙ্গে দিয়েছে।
সিফাত: বিয়ের আগেই ফোন ভেঙ্গে ফেলেছে? ভাই আমি নিশ্চিত বিয়ের পর তুই কোনো ভুল করলে হিমি তোকে আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেলবে। (ওরা সবাই হাসাহাসি করছে, আমি মুচকি হাসলাম এমন গুণ্ডি বউই তো হওয়া দরকার)
শান্ত: কেমন চলছে তোদের প্রেম?
আমি: আব্বু হিমির ব্যাপারে সব জেনে গেছেন।
শান্ত: কি বলছিস?
সিফাত: তোর আব্বু যেরকম আমার মনে হয় না মেনে নিবে তোদের।
আমি: হিমির পড়াশুনা নিয়ে ভাবলে হবে না তার আগেই বিয়ে করতে হবে।
আরিয়ান: কিন্তু কিভাবে?
আমি: আপুর বিয়ের পর পরই কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
শান্ত: তোর আব্বু মানবে?
আমি: মানাতে হবে।
সিফাত: চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে আর আমরা তো আছি তোর সাথে।
আমি: হুম।

“চলো না ঘুরে আসি অজানাতে!
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে”
হিমি: আরশান? (সবাই একসাথে গান গাইছিলাম হঠাৎ হিমির ডাকে থেমে গিয়ে সামনে তাকালাম, কোমড়ে হাত দিয়ে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে)
সিফাত: নে তোর গুণ্ডি বউ চলে এসেছে।
আমি: হিমি?
হিমি: কলেজে আসবেন আমাকে বলেননি কেন? একসাথে আসতে পারতাম।
আমি: তুমি যে আসবে সেটাও তো বলনি।
হিমি: এখন আমাকে দোষ দেওয়া হচ্ছে? আপনি…
আরিয়ান: এই হিমি তোকে এখনো আপনি করে কথা বলে?
আমি: হুম ও যেভাবে ডেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে আমি সেভাবেই খুশি।
শান্ত: বাব্বাহ্ কি প্রেম।
হিমি: কি যেন গান গাইছিলেন? চলো না ঘুরে আসি অজানাতে যেখানে নদী এসে থেমে গেছে। চলুন নদীর পাড়ে ঘুরতে যাবো।
আমি: এখন?
হিমি: হুম চলুন।
হিমি আমার হাত ধরে টেনে উঠিয়ে নিয়ে আসলো। আমার এক হাত জড়িয়ে ধরে হিমি হাটছে, আমি পাগলীটাকে মুগ্ধ হয়ে দেখছি। প্রেম ভালোবাসা কখনো পছন্দ করতাম না, কখনো ভাবিনি কোনো এক মায়াবতী আমার জীবনে আসবে আর এমন পাগলামি করবে।

নদীর পাড়ে বসে আছি আর হিমিকে দেখে মিটিমিটি হাসছি, হিমি কাশফুল ছুঁয়ে দিচ্ছে আর ছুটাছুটি করছে। এমন বাচ্চা মেয়ে নাকি দুদিন পর আমার বউ হবে হাহাহা!
হিমি: হাসছেন কেন? (হিমি অনেক গুলো কাশফুল হাতে করে নিয়ে এসে আমার পাশে বসলো)
হিমি: সুন্দর না এগুলো?
আমি: হুম তবে তোমার চেয়ে কম সুন্দর।
হিমি: মিথ্যে কথা, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর আর পবিত্র হচ্ছে ফুল। ফুলের সাথে মানুষের তুলনা করা বোকামি, আর আমিতো…
আমি: হিমি প্লিজ!
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: সেদিন কিন্তু আমার পরীক্ষা নিয়েছ আর আমিই জিতেছি। আদিত্য আমাকে সব বলেছে আমি সব জানি, আর মিথ্যে বলোনা প্লিজ!
হিমি: আদিত্য? হয়তো সেদিন সজিবের সাথে মিলে আমাকে কিডন্যাপ করেছিল কিন্তু এটাও সত্যি ও আর একজন ছেলের জন্য আমি আজো বেঁচে আছি আর আপনি আমাকে পেয়েছেন। সেদিন যদি ওরা সজিবকে বাধা না দিতো তাহলে আজ হয়তো…
আমি: ভুলে যাওনা ওসব, কেন শুধু শুধু ভয়ংকর দিন গুলো মনে করে নিজেকে কষ্ট দাও।
হিমি: ভুলে গিয়েছি তো, আপনাকে পেয়ে আপনার ভালোবাসায় আমি সব ভুলে গিয়েছি, নতুন করে স্বপ্ন দেখছি।
হিমি আমার কাধে মাথা রেখে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। হিমির লম্বা চুল গুলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে আমার চোখেমুখে এসে পড়ছে, আমি আবেশে দু চোখ বুজে হিমির চুলের ঘ্রাণ নিচ্ছি।

আব্বু: আরশান? (রুমে ঢুকা মাত্র আব্বু পিছু ডাকলেন। বাসায় আসা মাত্র আব্বু আমার রুমে বিষয়টা একটু সিরিয়াসই মনে হচ্ছে। শার্টের বোতাম খুলতে যাচ্ছিলাম, আবার শার্ট পরে পিছন ফিরে তাকালাম। আব্বু আমার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আব্বুর দিকে তাকালাম)
আব্বু: তোমার আম্মু বললো তোমার ফোন নাকি হারিয়ে গেছে, এক সপ্তাহ পর ফারিয়ার বিয়ে অনেক কাজ বাকি। ফোনের প্রয়োজন আছে তোমার, এইটা রাখো। (আমি চুপচাপ আব্বুর হাত থেকে প্যাকেট’টা এনে বিছানায় রেখে দিলাম)
আব্বু: আসছি।
আব্বু চলে গেলেন, আমিও ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।

ফ্রেশ হয়ে রুমে ঢুকতেই বিছানায় রাখা ফোনের দিকে নজর পড়লো, সিমটা বের করে এনে ফোন অন করলাম। আব্বু কি শুধুমাত্র আপুর বিয়ের উপলক্ষে আমাকে ফোন দিলেন নাকি অন্য কোনো কারণ আছে? এসব ভাবতে ভাবতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছিলাম হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। আশ্চর্য ফোন অন করার সাথে সাথে কে ফোন দিলো? ফোন হাতে নিয়ে সজিবের নাম্বার দেখে বেশ অবাক হয়েই রিসিভ করলাম।
আমি: হ্যালো।
সজিব: তোমার সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু দুদিন ধরে তোমার ফোন সুইচড অফ বলছে। (সজিবের মুখে তুমি? এতো নরম কন্ঠ? একটু বেশিই অবাক হলাম)
সজিব: কথা বলছ না যে? অবাক হচ্ছ? আসলে আমি সরি বলার জন্য ফোন দিয়েছি।
আমি: সরি?
সজিব: হ্যাঁ। অনেক ডিস্টার্ব করেছি তোমাকে আর হিমিকে এজন্য সরি। আর কখনো তোমাদের মাঝে আসবো না, ভালো থেকো।
আচমকা ফোন কেটে দিলো, আমি এখনো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সজিবের ফোন দেওয়া সরি বলা সব কি সত্যি ছিল নাকি কোনো অভিনয়? হঠাৎ করে এতো পরিবর্তন এতো শান্তশিষ্ট? পরিবেশ তো ঝরের পূর্বেই শান্ত থাকে, তাহলে কি সজিব কোনো প্ল্যান করছে? হয়তো সব সজিবের অভিনয়, হয়তো বড়সড় কোনো ঝর আসতে চলেছে হিমি আর আমার জীবনে…

আরশান আরশান? (কে যেন আমার চুলে খুব যত্ন করে হাত বুলাচ্ছে আর আমাকে ডাকছে। এতো সকালে উঠতে ইচ্ছে করছে না, নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ আঙ্গুলে গরম কিছু অনুভব করে চিৎকার দিয়ে উঠে বসলাম)
আমি: আমার আঙ্গুল পুড়ে গেছে।
হিমি: হিহিহি! (হাসি শুনে হিমির দিকে তাকালাম ওর হাতে চায়ের কাপ, তারমানে এতক্ষণ ও ডাকছিল আর আমি উঠিনি বলে আমার আঙ্গুল পুড়িয়ে দিয়েছে, ফাজি মেয়ে বুঝাচ্ছি)
আমি: আঙ্গুল পুড়ে গেছে, খুব যন্ত্রণা করছে। (একটু কান্নার ভাব করে হিমির দিকে আড়চোখে তাকালাম, হিমি ভয় পেয়ে গেছে)
হিমি: আমিতো দুষ্টুমি করেছিলাম এতোটা লেগে যাবে বুঝিনি, সরি। (হিমি আমার হাত ধরে আঙ্গুলটা ওর মুখে পুরে নিলো, আমি মিটিমিটি হাসছি আর ওকে এক দৃষ্টিতে দেখছি। হঠাৎ হিমি আমার দিকে তাকালো আর আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পেয়ে আমার হাত ছেড়ে দিলো)
হিমি: ফ্রেশ হয়ে নিচে আসুন, আসছি আমি।
আমি: দাঁড়াও। (হিমি উঠে চলে যাচ্ছিল ওর হাত ধরে টেনে ওকে আবার বসিয়ে দিলাম। হিমি লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে দেখে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম)
হিমি: কি করছেন কেউ দেখলে কি ভাববে?
আমি: চুপ করে বসে থাকো নাহলে আমি সবাইকে গিয়ে বলবো তুমি আমার আঙ্গুল পুড়িয়ে দিয়েছ।
হিমি: আসলে আমি বুঝতে পারিনি চা’টা যে এতো গরম আর এতোটা লেগে যাবে।
আমি: কই লাগেনি তো তেমন।
হিমি: তাহলে যে…
আমি: দুষ্টুমি করেছি।
হিমি: ফাজিল কোথাকার।
আমি: সাতসকালে আমার রুমে কি হ্যাঁ? মতলব কি?
হিমি: কিসের মতলব? রোদেলা চা নিয়ে আসছিল তাই ওকে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আসলাম। কেন অন্যায় করেছি?
আমি: ঘুম থেকে উঠে প্রথমে তোমার মুখ দেখা এইটা তো আমার জন্য…
হিমি: বাকিটা বলতে হবে না, উঠে নিচে আসুন সবাই কত ব্যস্ত কাজ নিয়ে আর আপনি বেলা দশটা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছেন।
আমি: কিসের কাজ?
হিমি: আগামীকাল আপুর বিয়ে ভুলে গেছেন? আজ তো গায়ে হলুদ। কতো কা…
আম্মু: ও কি আর এসব চিন্তা করে? ওর চিন্তাভাবনায় তো শুধু হিমি আর হিমি। (আম্মু আসছেন দেখে আমাকে সরিয়ে দিয়ে হিমি তাড়াতাড়ি সরে গেলো)
আম্মু: ভাবছি ফারিয়ার বিয়ের পর পরই তোদের বিয়েটা দিয়ে দিতে হবে। (আম্মুর মুখে বিয়ের কথা শুনে হিমি লজ্জা পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো)
আম্মু: আমার বৌমাটা না বড্ড লাজুক। (আম্মুর কথা শুনে মুচকি হাসলাম, আম্মু এসে আমার পাশে বসলেন)
আম্মু: হিমির পুরো পরিবারকে বিয়ে উপলক্ষে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছি, বলতো কেন? (আম্মুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম)
আম্মু: সারাক্ষণ ওরা আমাদের বাসায় থাকবে আর তোর ব্যস্ততার মাঝেও হিমি তোর চোখের সামনে থাকবে তাই। (আম্মু মুচকি হেসে আমার মাথার চুল গুলো এলোমেলো করে দিলেন)
আমি: তোমার মতো একজন মা পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার।
আম্মু: হয়েছে হয়েছে এবার যা ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি নিচে আয়।
আমি: যাও আসছি।
আম্মু চলে গেলেন, আমি চুপচাপ বসে আছি। মাঝখানে কেটে গেছে এক সপ্তাহ, কিভাবে কেটেছে বুঝতেই পারিনি। হিমির সাথে দুষ্টুমি, খুনসুটি, ঘুরে বেড়ানোতে কেটে গেছে। এর মধ্যে সজিব বা অধরা কেউ কোনো ঝামেলা করেনি, সত্যিই হয়তো ওরা ভালো হয়ে গেছে। আগামীকাল আপুর বিয়ে সব ভালোয় ভালোয় মিটে গেলেই হয়। একটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।

পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখছি, ফুল আর আলোয় আলোয় সাজিয়ে তুলা হয়েছে পুরো বাসা। এতো আলো, এতো সাজসজ্জা, এতো মেহমান, এতো আয়োজন তবুও এই বিয়েতে কেন যেন আমার মন সায় দিচ্ছে না। বাগানে দাঁড়িয়ে ছিলাম হঠাৎ কাধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পিছন ফিরে তাকালাম, আব্বু মৃদু হাসছেন।
আব্বু: তোমার বোনের বিয়ে, সবকিছু ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা কোনো কিছুতে ত্রুটি আছে নাকি সবকিছু তো তুমিই দেখবে। কিন্তু তুমি তো এসবে কোনো লক্ষই রাখছ না কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে আছ। (আব্বুর কথা শুনে মুচকি হাসলাম)
আমি: শহরের বড় ব্যবসায়ী মাহবুব হোসেনের মেয়ের বিয়ে তাও আবার তারই পছন্দ করা ছেলের সাথে, কোনো কিছুতে ত্রুটি কি থাকতে পারে?
আব্বু: তুমি কি এই বিয়েতে রাজি নও? নাকি অসীমকে তোমার পছন্দ হয়নি?
আমি: এখনো বুঝতে পারছি না। তাছাড়া তুমি তো একবারের জন্যও আমাদের কারো মতামত জানতে চাওনি।
আব্বু: জানতে চাইনি কারণ আমি তোমাদের জন্য সবসময় সবচেয়ে বেস্ট জিনিসটাই পছন্দ করি।
আমি: আচ্ছা তোমার এমন কেন মনে হয় যে তুমি যা পছন্দ কর সেটাই বেস্ট? এমনো তো হতে পারে তোমার পছন্দের জিনিসটা আমাদের পছন্দ নাও হতে পারে।
আব্বু: কখনো তো এমন হয়নি।
আমি: হবে কিভাবে তুমি তো কখনো আমাদের পছন্দ জানতে চাওনি, সবসময় তুমি নিজের পছন্দটা আমাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দিয়েছ।
আব্বু: আরশান তুমি ভুল করছ আমি তোমাদের উপর কখনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেইনি। আর এই বিয়েতে তো ফারিয়ার মত আছে।
আমি: সেটা এখনো আমার কাছে ক্লিয়ার না, আপু তো কিছু বলছেই না। একটা কথা জেনে রেখো যদি আমি জানতে পারি তুমি জোর করে আপুর এই বিয়েটা দিচ্ছ তাহলে এই বিয়ে হবে না। আর যদি বিয়ের পর জানতে পারি তাহলে আপুকে আমি ডিভোর্স করিয়ে নিয়ে আসবো।
আব্বু: আরশান?
আমি: চিৎকার না করে কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও।
আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, আমি চুপচাপ চলে আসলাম।

আপু: আমি আমার ভাইয়ের সুখের জন্য সব মেনে নিয়েছি তুমি কেন কাঁদছ? (আপুর রুমের দিকে যাচ্ছিলাম হঠাৎ আপুর মুখে এসব কথা শুনে দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালাম। ফোনের অপর পাশ থেকে কেউ কিছু বললো, আপু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে)
আপু: আমি যদি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি তাহলে তুমি কেন আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না? দেখো সবকিছু কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে এতে তো আমাদের কোনো দোষ নেই। মেনে নাও সব। (সবকিছু নীরব হয়ে গেলো শুধু আপুর ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। আমি আস্তে আস্তে রুমের ভিতরে ঢুকলাম, আপু আমাকে দেখে চমকে উঠলো)
আপু: তুই কখন আসলি?
আমি: কার সাথে ফোনে কথা বলছিলি?
আপু: কেউ নাতো।
আমি: ফোনটা দেখি।
আপু: আশ্চর্য তুই আমার ফোন নিচ্ছিস কেন?
আমি: দেখতে হবে আমাকে কার সাথে কথা বলছিলি।
আপু: ফোন দে বলছি। (আপু আমার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে এক আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেললো, আমি নির্বাক হয়ে ভাঙ্গা ফোনের দিকে তাকিয়ে আছি)
আপু: আরশান এমন করিস না।
আমি: ফোন ভেঙ্গে ফেলেছ তারমানে কোনো একটা রহস্য আছে।
আপু: তুই যা ভাবছিস তা না, বিশ্বাস কর আমি এই বিয়েতে খুশি। (আপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কথা গুলো বললো, আপুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম)

পরন্ত বিকেল, ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। এতো আয়োজন বিয়ে বাড়ির আমেজ কিছুই ভালো লাগছে না। বারবার একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আপুর থেকে কিভাবে সব জানবো? আমি কি করলে আপু সব সত্যি নিজ থেকে বলবে?
রোদেলা: এদিকে বস। (হঠাৎ রোদেলার কন্ঠ শুনে পিছন ফিরে তাকালাম, রোদেলা আর হিমি ছাদে এসে বসেছে। ওদের থেকে চোখ সরিয়ে উদাসীন হয়ে আকাশ দেখায় মন দিলাম। হঠাৎ কাধে কারো হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠে পাশে তাকালাম, হিমি আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
হিমি: মন খারাপ?
আমি: নাতো।
হিমি: হুম বুঝতে পারছি।
আমি: (নিশ্চুপ)
হিমি: চলুন।
আমি: কোথায়?
হিমি: আমার হাতে মেহেদী দিয়ে দিবেন।
আমি: কি?
হিমি: অবাক হচ্ছেন কেন? চলুন বলছি।

হিমি আমাকে টেনে এনে রোদেলার পাশে বসিয়ে দিলো, এই পাগলী যে কি করে আমি নাকি মেহেদী দিয়ে দিবো।
হিমি: মেহেদী দিয়ে দিন। (হিমি আমার পাশে বসে হাত বাড়িয়ে দিলো, আমি অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছি ওর দিকে)
রোদেলা: হিমি নিজের হাতটা নষ্ট করিস না, ভাইয়া পারবে না উল্টো তোর হাতে আঁকাবাঁকা কিছু এঁকে দিবে।
হিমি: তাতেও যদি ওর মন ভালো হয় আমি তাতেই খুশি। (হিমির কথা শুনে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম, আমার মন খারাপ বলে মন ভালো করার জন্য এমন পাগলামি করছে? এতোটা ভালোবাসে হিমি আমায়?)
হিমি: কি হলো মেহেদী দিয়ে দিবেন না?
আমি: দিচ্ছি। (হিমির হাতে সুন্দর করে আমার নাম লিখে দিলাম, ও হাতের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলো)
আমি: এবার যাই?
হিমি: না। (হিমি আমার কাধে মাথা রেখে বসলো, মুচকি হেসে এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরলাম)
রোদেলা: একটু কম রোমান্স করো দুজনে আমি কিন্তু এখানে। (রোদেলা হাসছে আর হিমির হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে)
“রোদেলা রোদেলা” (হঠাৎ কারো ডাকে সবাই ছাদের দরজার দিকে তাকালাম, রোদেলা আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো)
রোদেলা: ভাইয়া কে ডাকছে বলতো।
আমি: এইটা রাইসা না? এদিকেই তো আসছে।
রোদেলা: এসেই জিজ্ঞেস করবে আরশান কোথায়? ওকে কেন কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। (রোদেলা হাসছে আর হিমি আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। রাইসা আমার ফুফাতো বোন, আমার ধারণা ওর মাথার তার একটা ছেঁড়া। ও আসার আগে আমাকে লুকাতে হবে)
হিমি: এই রাইসাটা কে?
আমি: বলো আমি ছাদে আসিনি।
দৌড়ে চিলকোঠোর ঘরে এসে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললাম। রাইসা কিছুটা পাগলাটে হলেও আমি বুঝতে পারি ও যে আমাকে পছন্দ করে। তাছাড়া ফুফু একবার আমাদের বিয়ের কথা বলেছিলেন তারপর থেকে তো ও আমাকে চোখে হারায়। হিমি যদি কিছু বুঝতে পারে কি করবে কে জানে।

কিছুক্ষণ পর সব নীরব হয়েছে মনে হতেই বের হতে গেলাম তখনি হিমি এসে রুমে ঢুকলো, রাগি চোখে তাকিয়ে আছে।
আমি: কি?
হিমি: মেয়েটা কে?
আমি: রাইসা, ফুফাতো বোন।
হিমি: আপনাকে এভাবে পাগলের মতো খুঁজছে কেন?
আমি: আসলে ওর মাথায় একটু সমস্যা আছে।
হিমি: মিথ্যে কথা, ও আপনাকে পাগলের মতো খুঁজছে। আর মাথায় সমস্যা থাকলে এভাবে খুঁজত না। (হিমির হাতের দিকে লক্ষ করলাম দু হাত ভরতি মেহেদী, মুচকি হেসে হিমিকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলাম। মেহেদী হাতে আমাকেও সরাতে পারছে না নিজেও সরে যেতে পারছে না)
হিমি: সরুন।
আমি: এতো সন্দেহ করো কেন?
হিমি: হারানোর ভয়ে। (হিমি আমার চোখের দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে উত্তর দিলো, আমি মুচকি হেসে ওর কপালে আসা চুল গুলো কানের পাশে গুঁজে দিলাম)
আমি: ভয় নেই আমি কখনো তোমার থেকে দূরে যাবো না।
হিমি: কখনো ছেড়ে গেলে আমি মরে… (হিমির ঠোঁটে আঙ্গুল রাখলাম, ও নিশ্চুপ হয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: বললাম তো ছেড়ে যাবো না, আর কেউ তোমার থেকে আমাকে কেড়েও নিতে পারবে না।
হিমি আমার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক ভাবে। আমি মৃদু হেসে ওর আরো কাছে এগিয়ে গেলাম। হিমির দু ঠোঁটের কাছে আমার ঠোঁট নিয়ে চোখ বুজে ফেললাম, হঠাৎ হিমি দুহাতে আমার বুকে ধাক্কা দিয়ে আমাকে সরিয়ে দিলো। হিমি হাসতে হাসতে দৌড়ে পালিয়ে গেলো, আমি বুকের দিকে তাকিয়ে শার্টে মেহেদীর দাগ দেখে মুচকি হাসলাম, পাগলী একটা।
আন্টি: কোথায় ছিলি? (চিলকোঠোর ঘর থেকে বের হয়ে ছাদে আসতেই ভয়ে আতকে উঠলাম, আন্টি হিমিকে প্রশ্ন করছেন। হিমি আর রোদেলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে কি আন্টি কিছু বুঝতে পেরেছেন?)
আন্টি: কোথায় ছিলি বলছিস না কেন?
রোদেলা: আন্টি ও তো আমার সাথেই ছিল আমরা হাতে মেহেদী দিচ্ছিলাম।
আন্টি: তাহলে ও ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো কেন যে ঘর থেকে তোমার ভাই বেরিয়ে এসেছে? (আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, কি করবো বা বলবো বুঝতে পারছি না)
রোদেলা: আন্টি আ… (আন্টি হিমির গালে পরপর দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন)
আন্টি: তুই তোর ভাইদের কথা দিয়েছিলি অতীতের ভুল পুনরায় আর করবি না। তুই কি করে পারলি আবারো একই ভুল করতে?
হিমি: আম্মু আরশান সজীবের মতো নয়, আরশান খুব ভালো।
আন্টি: প্রথমে সবাই ভালো থাকে, চল। (আন্টি হিমির হাত ধরে টেনে ওকে নিয়ে চলে যাচ্ছেন, হিমি বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আর কাঁদছে। আমি বোবার মতো দাঁড়িয়ে আছি আর আমার দুচোখ দিয়ে পানি পড়ছে)
রোদেলা: ভাইয়া এবার কি হবে?
আমি: জানিনা।
রোদেলা: আন্টি তো খুব রেগে গেছেন। (রোদেলার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম)
রোদেলা: আরে কাঁদছ কেন?
আমি: (নিশ্চুপ)
রোদেলা: যার বোন আছে, ভাই আছে, এতোগুলো ভালো বন্ধু আছে তার চোখে কি কান্না মানায়? কেঁদো না, সবাই মিলে কিছু একটা ব্যবস্থা করে নিবো।
রোদেলার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চুপচাপ চলে আসলাম।

রাত আনুমানিক দশটা, রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্ট এর নিচে বসে আছি। তখন ছাদ থেকে আর বাসায় যাইনি সোজা বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। আন্টি হয়তো আমাদের বাসায় সব বলে দিয়েছেন, বাসার পরিস্থিতি কেমন হবে সেটা ভেবেই বাসায় যাচ্ছি না। আমার চোখের সামনেই আন্টি হিমিকে দুটো থাপ্পড় মেরেছিলেন, বাসায় নিয়ে হয়তো অনেক বকেছেন মেরেছেনও, ভালো লাগছে না কিছু আমার জন্য হিমির শরীরে আন্টি আঘাত করলেন। আন্টি জেনে গেছেন তারমানে তো হিমির ভাইয়েরাও এখন জেনে যাবে, ওরা মেনে নিবে তো? যদি না মেনে নেয় কি করবো আমি? আমিতো হিমিকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। তাহলে কি হিমিকে নিয়ে পালিয়ে যাবো? না না এইটা ঠিক হবে না সবাই খুব কষ্ট পাবে। উফফ কিছু ভাবতে পারছি না মাথাটা বিষণ ব্যথা করছে। দুহাতে মাথা চেপে ধরলাম সাথে সাথে কে যেন পিছন দিক থেকে আমার মাথায় আঘাত করলো। মাথা থেকে গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে, আমি বসা থেকে উপুড় হয়ে রাস্তায় পড়ে গেলাম। আস্তে আস্তে চোখ মেলে সামনে তাকালাম, ল্যাম্পপোস্ট এর আলোতে সজিবের মুখে হাসিটা খুব বিদঘুটে লাগছে। মাথা যন্ত্রণায় একহাতে মাথা চেপে ধরলাম সাথে সাথে কে যেন আমার পায়ে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করলো, ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলাম। সজিব আমার হাতে লাতি মেরে বেশ জুড়ে হেসে উঠলো।
সজিব: এক সপ্তাহ ধরে ডিস্টার্ব করছি না বলে খুব নিশ্চিন্তে বসে ছিলি তাই না? বোকা, খুব বোকা তুই।
আমি: কেন করছিস এসব?
সজিব: এইযে তোকে মারলাম আরো মারবো, তুই মরে যাবি আর আমি হিমিকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবো।
আমি: কাপুরুষের মতো পিছন দিক থেকে আঘাত করে আবার বড় বড় কথা বলছিস?
–সজিব ওর তেজ তো এখনো কমেনি। (অন্য একজন কথাটা বললো তারমানে সজিব একা না ওর সাথে আরো কেউ আছে)
সজিব: মাথায় আরেকটা আঘাত কর ডাইরেক্ট উপাড়ে চলে যাবে।
–মেরে ফেললে ফেঁসে যাবো, এভাবেই থাকুক।
সজিব: যদিও বেঁচে যাস বাসায় ফিরে হিমিকে আর পাবি না মনে রাখিস।
সজিব আমার পিটে ভারী কিছু একটা দিয়ে আঘাত করে চলে গেলো। রক্তে চারপাশ ভেসে যাচ্ছে, আমার চোখ ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসছে। উঠার চেষ্টা করতেই আবার রাস্তায় লুটিয়ে পড়লাম, আস্তে আস্তে আমার চোখ দুটো বুজে আসলো…

আস্তে আস্তে চোখ খুলার চেষ্টা করলাম কিন্তু মাথা যন্ত্রণায় পারলাম না, আবার চোখ বুজে ফেললাম।
আব্বু: আরশান আস্তে আস্তে চোখ খুলার চেষ্টা করো।
–উনাকে চাপ দিবেন না নিজে থেকেই চোখ খুলবে, ভয় নেই খারাপ কিছু হয়নি। (অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর আস্তে আস্তে চোখ খুলতে পারলাম, চারপাশে মিটমিট করে তাকালাম। আমি হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি, আমার দুপাশে চারজন ডক্টর আর পাশে আব্বু আর চাচ্চু বসা)
আব্বু: কষ্ট হচ্ছে?
ডক্টর: এখনি কথা বলতে হবে না তুমি রেস্ট নাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।
আব্বু: আদিত্য বাসায় ফোন করে জানিয়ে দে আরশানের জ্ঞান ফিরেছে।
আদিত্য: ঠিক আছে চাচ্চু।
চাচ্চু: আরশান কে করেছে তোর এই অবস্থা?
ডক্টর: আরে ওকে এখনি এতো প্রশ্ন করবেন না।
আমি: আমি ঠিক আছি ডক্টর। চাচ্চু আদিত্যকে ডাকো। (চাচ্চু আদিত্যকে ডেকে এনে আমার পাশে বসালেন)
আদিত্য: কি ভাইয়া?
আমি: হিমি কোথায়? বাসায় আছে তো ও?
আদিত্য: একদম চুপ, এই মেয়ের জন্যই তুমি আজ মরতে বসেছিলে।
চাচ্চু: আদিত্য তুই জানিস ওর এই অবস্থা কে করেছে?
আদিত্য: খুব ভালো করেই জানি। আপুর বিয়ের অনুষ্ঠান’টা মিটে যাক তারপর বুঝাবো শালাকে।
আমি: তোকে আমি কি জিজ্ঞেস করেছি?
আদিত্য: হুম হিমি বাসায় আছে।
আব্বু: বলেছিলাম পঁচা শামুকে পা কাটতে যেওনা, এবার বুঝেছ তো? (আব্বু রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন, পিছু পিছু চাচ্চুও চলে গেলেন)
আদিত্য: সজিব এসব করেছে তাই না?
আমি: হুম।
আদিত্য: সব এই হিমির জন্য হয়েছে।
আমি: ওকে কেন দোষ দিচ্ছিস? ও কি সজিবকে বলে দিয়েছে নাকি?
আদিত্য: হুম হিমিকে দোষ দেওয়াটাও বোকামি, এসব শুনার পর থেকে মেয়েটা পাগলের মতো কাঁদতেছে শুধু।
আমি: (নিশ্চুপ)
আদিত্য: আচ্ছা তুমি এতো রাত পর্যন্ত বাসার বাইরে কি করছিলে? আর সাথে মোবাইলটা আনলে কি হতো?
আমি: বুঝতে পারিনি সজিব হঠাৎ করে এমন কিছু করবে।
আদিত্য: তুমি বাসায় ফিরছ না দেখে সবাই খুব টেনশনে পড়ে যাই, বাসায় অনুষ্ঠান জেনেও তুমি এতো রাত পর্যন্ত বাইরে বিষয়টা খটকা লাগছিল। ফোন করি কিন্তু তোমার মোবাইল তো রুমে রাখা ছিল। আমি এক ফাঁকে হিমির কাছে যাই, হিমি বলে ওর আম্মু সব জেনে গেছে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম তুমি টেনশনে আর ভয়ে বাসায় ফিরছ না। সবাই মিলে খুঁজতে বের হই, আমিতো ভাবতেও পারিনি তোমাকে রাস্তায় এভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় পাবো।
আমি: বাসায় ফিরতে হবে আমাকে, কয়টা বাজে?
আদিত্য: চারটা এগারো।
আমি: সকাল হলেই বাসায় ফিরতে হবে।
আদিত্য: পাগল হয়েছ ডক্টর তোমাকে এই অবস্থায় রিলিজ দিবে?
আমি: রিলিজ নিতে হবে, হিমিকে আগলে রাখতে হবে আর আপুর বিয়ে আটকাতে হবে।
আদিত্য: কি?
আমি: হ্যাঁ বিয়েটা আটকাতে হবে, আমি হসপিটালে থাকলে বিয়েটা অনায়াসে হয়ে যাবে।
আদিত্য: কিন্তু বিয়ে আটকাবে কেন?
আমি: কারণ আপু বিয়েটা নিজের ইচ্ছেয় করছে না, আপু অন্য কাউকে ভালোবাসে। কিন্তু কাকে ভালোবাসে সেটা জানিনা।
আদিত্য: ঠিক আছে আমি ডক্টর এর সাথে কথা বলবো তুমি একটু রেস্ট নাও।
আমি: হুম।
আদিত্য চলে গেলো, আমি চোখ দুটো বুজে শুয়ে রইলাম।

ঘুম ভাঙ্গতেই আস্তে আস্তে চারপাশে তাকালাম, শান্ত, আরিয়ান, সিফাত আর আদিত্য একটু দূরে বসে আছে। আমি নড়াচড়া করছি দেখে সবাই উঠে আমার দিকে এগিয়ে আসলো।
শান্ত: কে করেছে তোর এই অবস্থা?
আমি: সজিব।
সিফাত: ওর ঠিকানা জানিস? একবার বল ওকে মেরে ওর বাসায়ই কবর দিয়ে আসবো।
আদিত্য: আমি জানি ওর ঠিকানা, কিন্তু এখন ঝামেলা করা যাবে না, আগে আপুর বিয়েটা মিটে যাক। (বিয়ের কথা বলতেই মনে পড়লো আমাকে তো বাসায় যেতে হবে)
আমি: আদিত্য ডক্টর এর সাথে কথা বলেছিস?
আদিত্য: হ্যাঁ ডক্টর রিলিজ দিতে চাইছে না।
আরিয়ান: আজই রিলিজ নিতে চাস? পাগল হয়েছিস নাকি?
আমি: সজিব বলেছে হিমিকে নিয়ে যাবে আ…
সিফাত: আমরা তোর হিমিকে দেখে রাখবো তুই নিশ্চিন্তে থাক।
আমি: নারে আপুর বিয়েটাও আটকাতে হবে।
আদিত্য: কিন্তু আজকেই তো আপুর বিয়ে।
আমি: হুম ডক্টর এর সাথে কথা বল।
আদিত্য: আব্বু আর চাচ্চু আমাকে মেরেই ফেলবে।
শান্ত: তোর হাতে, পায়ে, মাথায় ব্যান্ডেজ আর তুই এই অবস্থায় বাসায় চলে যেতে চাচ্ছিস? পাগলামি করিস না প্লিজ!
আমি: বললাম তো আমাকে যেতে হবে।
সিফাত: ঠিক আছে আমরা ডক্টর এর সাথে কথা বলছি।
সবাই চলে গেল, আমি চুপচাপ শুয়ে আছি আর হিমির কথা ভাবছি, পাগলীটা কি করছে কে জানে।

আব্বু: আরশান এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। (চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম হঠাৎ আব্বুর চেঁচামেচিতে কেঁপে উঠে চোখ খুলে তাকালাম)
আব্বু: তুমি নাকি বাসায় চলে যেতে চাচ্ছ? তোমার যা মন চায় তাই করবে তুমি?
আমি: আপুর বিয়ে কবে?
আব্বু: আমি বিয়েটা পিছিয়ে দিতাম কিন্তু এতো মেহমান চলে এসেছে দু বাড়িতেই যে এখন সম্ভব না। আমাকে এখানে থাকতে হবে তাই বিয়ের অনুষ্ঠান সন্ধ্যায় হবে। এক ফাঁকে গিয়ে সব মিটিয়ে আসবো। (আব্বুর কথা শুনে মুচকি হাসলাম, আমি হসপিটালে তবুও উনি আপুর বিয়েটা দিবেনই এতোটাই জরুরী বিয়েটা)
আদিত্য: ভাইয়া ডক্টর রিলিজ দিয়েছে।
আব্বু: আদিত্য?
আদিত্য: আমি কি করবো ভাইয়া জিদ করছিলো।
শান্ত: ভয় নেই আঙ্কেল আমরা ওকে দেখে রাখবো।
আব্বু রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন। সব ঝামেলা মিটিয়ে সবাই আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

বাসায় পৌঁছাতে প্রায় দশটা বেজে গেলো, এখনো অনেক সময় আছে আমার হাতে। বাসায় ঢুকতেই আম্মুর দিকে নজর পড়লো, আম্মু খুব কাঁদছেন।
আমি: আম্মু? (আমার ডাক শুনে আম্মু দৌড়ে আমার কাছে আসলেন)
আম্মু: কষ্ট হচ্ছে না তোর? আমি সবসময় ভয় পেতাম তোর বাইক চালানোটাকে আর আজ কিনা…
আমি: আম্মু তেমন কিছু হয়নি কেঁদো না। (আম্মুর চোখের পানি মুছে দিলাম, কেন যে বারবার আম্মুকে কাঁদাই)
ফুফু: এতো তাড়াতাড়ি রিলিজ নিয়ে চলে আসলি যে? (ফুফুর কথার উত্তর না দিয়ে বসতে বসতে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম, আপুকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না আপু কোথায়?)
আমি: আম্মু আপু কোথায়?
আম্মু: রুমে হয়তো।
চাঁচি: আরশানের জন্য বিয়েটা পিছিয়ে দিলেই হতো, শুধু শুধু ছেলেটা এই অবস্থায় বাসায় চলে এসেছে।
চাচ্চু: ও জিদ করে রিলিজ নিয়ে আসে কেন? ও ছাড়া কি ফারিয়ার বিয়ে আটকে থাকতো?
আপু: যে ভাইয়ের সুখের জন্য এতকিছু তার উপস্থিতি ছাড়া আমি কবুল বলবো সেটা তোমরা ভাবলে কিভাবে চাচ্চু? (আপু আমার দিকে আসতে আসতে কথা গুলো বললো, আপুর কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারিনা। চাচ্চুর দিকে তাকালাম আপুর কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ চলে গেলেন)
ফুফু: আচ্ছা তোর এই অবস্থা কিভাবে হয়েছে?
আদিত্য: ফুফু আ…
আমি: রাতে বাইরে ছিলাম তো ছিনতাইকারী এমন করেছে। (মিথ্যে বললাম নাহলে হিমিকে নিয়ে সমালোচনা হবে আর আমার হিমিকে কেউ খারাপ কথা বলুক আমি সেটা সহ্য করবো না)
আব্বু: বাহ্ আমার ছেলে বড় হয়ে গেছে।
ফুফু: এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকলে তো এমন খারাপ কিছু ঘটবেই। ভাইয়া আমি বলছিলাম কি আরশানকে বিয়ে করিয়ে দাও তখন দেখবে বাইরে থাকার অভ্যাসটা চলে যাবে। (ফুফুর কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে উনার দিকে তাকালাম, ফুফু এসব কি বলছে?)
আম্মু: আরশানের পড়ালেখা এখনো শেষ হয়নি কি বলছ এসব তুমি?
ফুফু: তাতে কি হয়েছে? রাইসা আর আরশান একসাথে পড়াশুনা করবে।
আপু: ফুফু কি বলতে চাইছ স্পষ্ট করে বলতো।
চাঁচি: কি আবার রাইসার সাথে আরশানের বিয়ে, এই কথা তো অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে।
ফুফু: ভাইয়া ফারিয়ার বিয়ের অনুষ্ঠানে ওদের দুজনের এংগেজমেন্ট সেরে ফেললে কেমন হয়?
আব্বু: ভেবে দেখছি। (আব্বুর কথা শুনে আপু রাগে কটমট করতে করতে আব্বুর দিকে এগিয়ে গেলো)
আপু: আব্বু বেঈমানি করোনা বেঈমানি আমি একদম পছন্দ করিনা। কথার নড়চড় হলে খুব খারাপ হবে মনে রেখো।
আপু রাগে রুমের দিকে চলে গেল। এখানে থাকলে আমিও ঝগড়া করবো ওদের সাথে তাই আমিও রুমের দিকে এগুলাম।

শান্ত: একটু রেস্ট নে আমরা বাইরে আছি।
আমি: হুম। (ওরা আমাকে রুমে দিয়ে চলে গেলো। খুব অস্বস্তি লাগছে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। হিমি একবারো আমার কাছে আসেনি তাহলে কি হিমি জানেনা আমি যে বাসায় ফিরেছি? নাকি ওর আম্মু আসতে দিচ্ছে না? আনমনা হয়ে এসব ভাবছিলাম হঠাৎ কে যেন আমার বুকে মাথা রাখলো, কে আবার হবে এই সাহস তো হিমিরই শুধু আছে। মুচকি হেসে এক হাতে জড়িয়ে ধরলাম, সাথে সাথে কেঁপে উঠে চোখ মেলে তাকালাম। রাইসা? এজন্যই চুল গুলো ছোট)
রাইসা: কি হলো ছেড়ে দিলে কেন?
আমি: উঠো বলছি।
রাইসা: ড্রয়িংরুমে এংগেজমেন্ট নিয়ে কথা হচ্ছিল কিছু না বলে চলে আসলে যে?
আমি: আগে আমার বুক থেকে সরো, তোমার সাহস হয় কি করে এসব করার? (এখন হিমি আসলে তো আমার বারোটা বাজিয়ে ফেলবে, এক হাতে ধাক্কা দিয়ে রাইসাকে সরিয়ে দিলাম)
রাইসা: আচ্ছা এমন করছ কেন? কিছুদিন পর আমাদের বিয়ে হবে, তুমি এখন অসুস্থ এই অবস্থায় কি আমি তোমাকে একটু আদরও করতে পারিনা।
আমি: না, এই অধিকার শুধু হিমির আছে। আর শুনো আমি তোমাকে বিয়ে করছি না, এই বিয়ে নিয়ে ভুল ধারণা তোমার আম্মু আর আমার আব্বুর।
রাইসা: হিমি কে? ওইযে উপরতলায় ভাড়াটে থাকে কালো মেয়েটা? (রাইসা হাসছে ইচ্ছে হচ্ছে একটা লাতি মারি, আমার হিমিকে নিয়ে হাসাহাসি)
রাইসা: এই কালো মেয়েকে তুমি ভালোবাস।
আমি: আর একবার হিমিকে নিয়ে বাজে কথা বললে তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এই রুম থেকে বের করে দিবো।
রাইসা: আমি আম্মুকে সব বলবো, তুমি ওই মেয়েটার জন্য আমাকে অপমান করেছ।
আমি: আমি আব্বুকেই পরোয়া করিনা ফুফু তো অনেক দূরের ব্যাপার। বেড়িয়ে যাও এই রুম থেকে।
রাইসা রাগে কটমট করতে করতে বেড়িয়ে গেলো। মাথাটাই নষ্ট করে দিলো।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল টিপছি হঠাৎ রোদেলা আসলো।
রোদেলা: হিমির সাথে দেখা করবে না?
আমি: ও আসেনি কেন?
রোদেলা: তুমি বাসায় এসেছ হিমি তো জানেই না অনেক কান্নাকাটি করতেছে। আর ও চাইলেও আসতে পারবে না কারণ ওর আম্মু আসতে দিবে না।
আমি: আমাকে ওর রুমে নিয়ে চল।
রোদেলা: ভাইয়াকে ডাকবো? তুমি তো হাটতেই পারো না।
আমি: না, তুই একটু ধর আমি যেতে পারবো। (বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখি অধরা, রিসিভ করবো কিনা ভেবে করেই ফেললাম)
আমি: হ্য…
অধরা: আরশান তোর নাকি এক্সিডেন্ট…
আমি: তোকে কে বললো?
অধরা: তুই বলিস নি তো কি হয়েছে আমি খবর পেয়েছি।
আমি: হুম ভালো।
অধরা: হসপিটালে আছিস? তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
আমি: বাসায় আছি, যদি বন্ধু হিসেবে দেখতে চাস আসতে পারিস।
অধরা: আরশান তুই কি আমার ভালোবাসা কখনো বুঝবি না?
আমি: আমার জীবনে হিমি আসার আগে তুই বললে ভেবে দেখতাম কিন্তু এখন সম্ভব না। অধরা পাগলামি ছাড় আমাদের আগের অধরা হয়ে যা।
অধরা: হুম।
আমি: রাখছি। (ফোন রেখে বিছানায় ছুড়ে মারলাম যত্তোসব ঝামেলা)
রোদেলা: এভাবে কতদিন ভাইয়া? আমার মনে হয় অধরা আপুকে সবাই মিলে বুঝালে বুঝবে।
আমি: বুঝিয়েছি ওর মাথায় সমস্যা আছে তাই বুঝতে চাইছে না।
রোদেলা: হুম চলো।
আমি: হুম।

হিমিদের ফ্ল্যাটে এসে কলিংবেল চাপতেই ভাবি এসে দরজা খুলে দিলেন।
ভাবি: তোমরা?
রোদেলা: ভাবি এতো ভয় পাচ্ছ কেন?
ভাবি: আসলে মা আছেন বাসায় তাছাড়া…
আমি: তাছাড়া কি?
ভাবি: মা তো হিমির ভাইয়াকে সব জানিয়ে দিয়েছেন উনি আসতেছেন। দু একদিনের মধ্যে হয়তো আমাদের নিয়ে গ্রামে অথবা অন্য বাসায় চলে যাবে। (ভাবির কথা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, এখন কি করবো আমি?)
রোদেলা: ভাবি তুমি কিছু কর প্লিজ!
ভাবি: এই ভুল তো একবার হয়নি, হিমির ভাইয়া খুব রেগে গেছে আমার কথা শুনবে না। হিমির থেকে ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল আর হিমি ওর ভাইকে কথাও দিয়েছিল এই ভুল আর দ্বিতীয় বার করবে না। কিন্তু হিমি ওর কথা রাখেনি, ওর ভাইয়ার রাগ করাটা তো স্বাভাবিক।
আমি: (নিশ্চুপ)
ভাবি: হিমিকে যখন সজিব কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিল চারদিন ওর দুই ভাই খাওয়া দাওয়া ছেড়ে পাগলের মতো হিমিকে খুঁজেছে, মা’কে তো হসপিটালে ভর্তি করতে হয়েছিল। হিমিকে যখন পাওয়া গেল তখন ওর সেন্স ছিলনা, হসপিটালে ভর্তি করা হলো। সেন্স ফিরত আবার হিমি চিৎকার দিয়ে সেন্স হারিয়ে ফেলত। অনেক দিন হিমিকে হসপিটালে রাখতে হয়েছিল। ঐ সময়ের কথা আমরা কখনো ভুলতে পারবো না, ওর দুই ভাই অনেক কষ্ট করেছে ওর জন্য, কাজেই ওদের এখন রাগ করাটা স্বাভাবিক।
রোদেলা: আচ্ছা আমাদের বাসা থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে ভাইয়া হিমিকে আরশান ভাইয়ার হাতে তুলে দিবে তো?
ভাবি: জানিনা, তবে চেষ্টা করে দেখতে পারো। আমি যতটুকু পারি সবাইকে বুঝাবো।
আমি: হিমি কোথায়?
ভাবি: ওর রুমে আছে।
ভাবিকে পাশ কাটিয়ে হিমির রুমের দিকে গেলাম।

আমি: হিমি? (বিছানায় শুয়ে পাগলীটা কাঁদছিল আমার ডাক শুনে চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকালো, আমাকে দেখে দৌড়ে এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো)
তারিন: এবার তুমি সামলাও এতক্ষণ আমি অনেক চেষ্টা করেছি কান্না থামানোর।
আমি: কি হয়েছে কাঁদছ কেন?
হিমি: সব আমার জন্য হয়েছে, এজন্যই আমি ভালোবাসা সত্ত্বেও আপনার সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাইনি। আমিতো জানি সজিব কেমন, আগেই বুঝেছিলাম ও আপনার ক্ষতি করবে।
আমি: তুমি শুধু শুধু কাঁদছ দেখো আমার তেমন কিছু হয়নি, আচ্ছা বেশি কিছু হলে কি আমি আজই বাসায় চলে আসতাম? (হিমি একটু সরে গিয়ে আমাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে শুরু করলো, ওর পাগলামি দেখে হাসি পাচ্ছে)
আমি: কি দেখছ? আমার তেমন কিছু হয়নি।
হিমি: হুম হয়নি, ডক্টর তো অঝতা হাতে পায়ে মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। (হিমির কোমড় জড়িয়ে ধরে ওকে আমার কাছে টেনে আনলাম, ওর কপালে কপাল ঠেকালাম)
হিমি: কি করছেন ওরা আছে রুমে।
আমি: অনেক বেশি ভালোবাস আমাকে তাই না?
রোদেলা: তারিন বাইরে চল বড়দের রোমান্স দেখতে নেই। (হিমি লজ্জা পেয়ে দূরে সরে গেল, তারিন আর রোদেলা হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল রুম থেকে)
হিমি: আম্মু আসতে পারেন যেকোনো সময়।
আমি: শাশুড়িকে আমি ভয় পাই নাকি? (কুড়িয়ে কুড়িয়ে হেটে এসে বিছানায় বসলাম, হিমি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে)
আমি: কি দেখছ?
হিমি: আপনার না কিছু হয়নি তাহলে কুড়িয়ে কুড়িয়ে হাটছেন কেন?
আমি: পায়ে একটু বেশি লেগেছে, সজিবের বুদ্ধি আছে নাহলে কি রাস্তায় একা পেয়ে এটাক্ট করে? যেদিন ও সরি বলেছিল সেদিনই বুঝেছিলাম ঝরের পূর্বাভাস। কিন্তু বুঝতে পারিনি এভাবে রাস্তায় একা পেয়ে পিছন দিক থেকে আঘাত করবে।
হিমি: কেন যে আমার জীবনের সাথে নিজেকে জড়াতে গেলেন। (হিমি আমার পাশে বসতেই ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে ওকে আমার কাছে নিয়ে আসলাম, হিমি আমার দুচোখের দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: রাইসা তো আমার কেউ না তবুও আমি অসুস্থ বলে আমাকে আদর করতে এসেছিল আর তুমি আমার বউ হয়ে আমাকে একটুও আদর করছ না, এটাই বুঝি ভালোবাসা? (হিমি দুহাতে চোখের পানি মুছে নিয়ে আমার গলা চেপে ধরলো)
আমি: কি করছ?
হিমি: অন্য মেয়ে আপনাকে টাচ্ করবে কেন?
আমি: তুমি যেহেতু করনা অন্য মেয়ে করলে দোষ কোথায়? (হিমি অভিমান করে মাথা নিচু করে ফেললো, ওর কান্না থামানোর জন্য দুষ্টুমি করেছিলাম কিন্তু ও তো এখন গাল ফুলিয়ে ফেলেছে)
হিমি: চোখ বন্ধ করুন।
আমি: কেন?
হিমি: করুন বলছি।
আমি: ওকে করলাম। (চোখ বন্ধ রাখলেও বেশ বুঝতে পারছি হিমি আমার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে, এক চোখ খুলে একটু তাকালাম সাথে সাথে হিমি সরে গেলো)
হিমি: আপনি চিটিং করেছেন।
আমি: আর করবো না।
আমি দুচোখ বন্ধ করতেই হিমি আমার একদম কাছে এসে আমার কপালে ওর মিষ্টি দুইটা ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। আচমকা হিমির এমন চুমু আমি যেন বরফের মতো জমে গেলাম। হিমির খিলখিল হাসির শব্দে আমার ঘোর কাটলো। চোখ মেলে তাকালাম, হিমি লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে। হিমির লাজুক মুখে মৃদু হাসি, আমি মুগ্ধ নয়নে হিমির লজ্জামাখা মুখ দেখছি…

–হিমি হিমি? (হিমি আমার হাতের ব্যান্ডেজে হাত বোলাচ্ছিল হঠাৎ ওর ভাইয়ার কন্ঠ শুনে কেঁপে উঠে দুজনে ছিটকে দূরে সরে গেলাম)
হিমি: এবার কি হবে আরশান?
আমি: ভয় পেয়ো না।
ভাইয়া: হিমি? (ভাইয়া হিমিকে ডাকতে ডাকতে রুমে এসে আমাকে দেখে রাগি চোখে তাকালেন, পরিস্থিতি যে খুব খারাপ হবে সেটা ভাইয়ার লাল বর্ণের চোখ দেখেই বুঝতে পারছি। হিমির দিকে তাকালাম ভয়ে কাঁদতেছে)
ভাইয়া: তুমি এই রুমে কেন?
হিমি: ভাইয়া আ…
ভাইয়া: আমি ওর সাথে কথা বলছি।
আমি: ভাইয়া হিমিকে দেখতে এসেছিলাম।
ভাইয়া: হিমি তুই আমাকে কি কথা দিয়েছিলি?
হিমি: ভাইয়া সরি, আমি…
ভাইয়া: তুই আমাকে কি কথা দিয়েছিলি? (ভাইয়ার ধমকে হিমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, আমি কি করবো বুঝতেই পারছি না)
ভাবি: কি হয়েছে ওকে ধমকাচ্ছ কেন? (ভাবি দৌড়ে এসে হিমিকে জড়িয়ে ধরলেন)
ভাইয়া: তুমি সব জানতে তাই না? আমাকে কিছু বলনি কেন?
ভাবি: বললে তুমি হিমিকে এখানে রাখতে?
ভাইয়া: ও আমাকে কথা দিয়ে…
ভাবি: হ্যাঁ কথা দিয়েছিল, তখন পরিস্থিতি ওকে বাধ্য করেছিল কথা দিতে। মানুষের মনের উপর কোনো জোর খাটে না, ভালোবাসা কখনো বলে আসেনা। হিমির অজান্তেই ওর মনে যদি আরশানের জন্য ভালোবাসা জন্ম নেয় তাহলে এতে ওর কি দোষ?
ভাইয়া: ভালোবাসা শিখাচ্ছ আমাকে?
ভাবি: না, শুধু এইটুকু বুঝানোর চেষ্টা করছি ভালোবাসা অন্যায় নয়, হিমি ভালোবেসে ভুল করেনি।
ভাইয়া: ভালোবাসা অন্যায় নয় কিন্তু ভুল মানুষকে ভালোবাসা অন্যায়।
ভাবি: হ্যাঁ হিমি সে ভুলটা একবার করেছিল সজিবকে ভালোবেসে। কিন্তু আরশান এমন ছেলে নয়, আমরা তো এই বাসায় অনেক দিন হলো আছি, আরশানকে দেখেছি ওর পরিবারকে দেখেছি সবাই খুব ভালো।
আন্টি: প্রথমে সবাই ভালো থাকে কিন্তু পরে…
আমি: আন্টি আমি এখন হিমিকে যেমন ভালোবাসি সারাজীবন তেমনি ভালবাসবো।
আন্টি: এসব সবাই বলে।
আমি: কতজনকে দেখেছেন আমি জানিনা তবে আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন।
ভাইয়া: তাহলে তোমার আব্বুর সাথে আমি কথা বলছি।
আমি: আব্বুকে এখনি কিছু বলতে পারবো না কারণ…
ভাইয়া: কারণ তুমি হিমিকে সত্যি ভালোবাস না, তুমি তোমার পরিবারে হিমির কথা জানাতে চাচ্ছ না।
আমি: সেটা নয় ভাইয়া, আপুর বিয়ে মিটে গেলেই আমি আব্বুকে হিমির কথা বলবো।
আন্টি: তার কোনো প্রয়োজন নেই, হিমিকে ভুলে যাও তুমি।
আমি: আন্টি…
ভাবি: সজিব ভুল করেছিল কিন্তু সজিবের ভুলের শাস্তি তোমরা আরশানকে কেন দিচ্ছ?
ভাইয়া: কারণ ওদের ভালোবাসাটাই সত্যি না।
আমি: ভাইয়া আমি কি করলে আপনি বিশ্বাস করবেন আমি যে হিমিকে সত্যি ভালোবাসি? (আমার প্রশ্ন শুনে ভাইয়া আর আন্টি আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন)
ভাইয়া: পরীক্ষা দিবে? (ভাইয়ার প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসলাম)
আমি: প্রয়োজন হলে তাই দিবো।
ভাইয়া: সুযোগ বুঝে আমি ঠিক তোমার পরীক্ষা নিয়ে নিবো। এবার তুমি আসতে পারো।
হিমির দিকে একনজর তাকিয়ে চুপচাপ চলে আসলাম।

শান্ত: একদিকে হিমির ভাইয়া আর আম্মু রাজি না অন্যদিকে তোর আব্বু, কি করে কি হবে বুঝতেই পারছি না। (জানালার পাশে বসে আনমনা হয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম, শান্তর কথা শুনে ওদের দিকে তাকালাম)
সিফাত: এজন্যই বলি প্রেম না করাই ভালো।
আমি: তোরা এতো ভয় পাচ্ছিস কেন? সত্যিকারের ভালোবাসা এতো সহজে জয় করা যায় না, বাধা আসবেই আর সে বাধা পেরিয়েই জয় করতে হবে।
আরিয়ান: তোর ভিতরে কি কোনো ভয় নেই?
আমি: আছে তো হিমিকে হারানোর ভয়।
শান্ত: একবার তো মরতে মরতে বেঁচে এসেছিস আবার না সজিব তোর প্রাণটাই নিয়ে নেয়। (শান্তর কথার কোনো জবাব না দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম)
আরিয়ান: আদিত্য তো সজিবের বাসা জানে সজিবকে পুলিশে দিলে কেমন হয়?
সিফাত: তোর কি মনে হয় আরশানকে এভাবে মেরে সজিব বাসায় আরামে ঘুমাচ্ছে? (ওরা কথা বলছে, ওদের কথায় কান না দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম)
আমি: আসছি আমি।
শান্ত: কোথায় যাচ্ছিস?
শান্তর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে আসলাম।

আপু বিছানায় বসে আছে আর আপুর চারপাশে অনেক মেয়েরা আপুকে ঘিরে রেখেছে। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আপুকে এক দৃষ্টিতে দেখছি, সবার মুখে হাসি শুধু আপুর মুখটাই মলিন।
–আরে আরশান? ভিতরে আসছ না কেন? (আপুর বান্ধবীর কথা শুনে আপু দরজার দিকে তাকালো)
আপু: ভাই? ভিতরে আয়। (ভিতরে ঢুকে বিছানায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম, লাল টুকটুকে বেনারসি আর অনেক গয়না পরে আছে বিছানায়)
আপু: কুড়িয়ে কুড়িয়ে হেটে তুই আসতে গেলি কেন আমাকে ডাকলেই পারতি। (আপুর কথার জবাব না দিয়ে বেনারসিটা হাতে নিলাম)
আপু: এভাবে কি দেখছিস? শাড়িই তো এইটা।
আমি: হুম শাড়ি, তবে এই শাড়িটা নিয়ে প্রত্যেক মেয়ের অনেক স্বপ্ন থাকে। প্রতিটা মেয়েই স্বপ্ন দেখে এই শাড়িটা পরে কার জন্য বউ সাজবে।
আপু: কি বলতে চাইছিস? (আপুর বান্ধবীদের দিকে তাকালাম সবাই চুপচাপ বেরিয়ে গেলো রুম থেকে)
আপু: আরশান সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে এসেছে…
আমি: তো?
আপু: রাতে আমার বিয়ে আর তুই এখন এসব আবোলতাবোল বকছিস।
আমি: রাতে বিয়ে, আরো কয়েক ঘন্টা পর। আপু বিয়েটা এখনো হয়ে যায়নি।
আপু: তো?
আমি: বিয়েটা ভেঙ্গে দিবি আর যাকে ভালোবাসিস তাকে বিয়ে করবি।
আপু: আমি কাউকে ভালোবাসি না।
আমি: যে ভাইকে এতো ভালোবাসিস তাকেই মিথ্যে বলছিস? তোর চোখ দুটো তো আমাকে সত্যিটা বলে দিয়েছে।
আপু: (নিশ্চুপ)
আমি: ছেলেটার নাম কি?
আপু: কোন ছেলে?
আমি: আপু বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু।
আপু: বাড়াবাড়ি তো করছিস তুই, কয়েক ঘন্টা পর আমার বিয়ে আর তুই এখন বিয়ে ভাঙ্গার চেষ্টা করছিস। একবার ভেবে দেখেছিস এখন বিয়েটা ভেঙ্গে গেলে যে লোকে মন্দ বলবে?
আমি: একবার এই বিয়েটা হয়ে গেলে যে সারাজীবন তুই যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে ছাই হবি তখন কি লোকে গিয়ে দেখবে? নাকি তোর চোখের পানি কেউ মুছে দিবে? সবসময় লোকের ভয় পেলে চলে না আপু, মাঝেমাঝে নিজের মনের কথা শুনতে হয়।
আপু: আমি বিয়েটা মন থেকেই করছি।
আমি: তাই?
আপু: হুম।
আমি: সত্যি কখনো চাপা থাকে না আপু, একদিন আমি ঠিক সত্যিটা জানতে পারবো। আর সেদিন তোর সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না।
আপু: আরশান?
আমি: চিৎকার করে লাভ নেই বুঝেশুনে বিয়েটা করিস।
আপু আমার দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপে চোখের পানি ফেলছে, চুপচাপ চলে আসলাম আপুর সামনে থেকে।

দুহাতে মাথা চেপে ধরে বিছানায় বসে ছিলাম হঠাৎ আম্মু এসে রুমে ঢুকলেন, আম্মুর হাতে খাবারের প্লেট।
আম্মু: আরশান খাবারটা খেয়ে নে।
আমি: (নিশ্চুপ)
আম্মু: কিরে খাবি না?
আমি: ইচ্ছে করছে না।
আম্মু: এইটা কেমন কথা? সকালে তো কিছুই খাসনি, এখনো খাবি না?
আমি: আম্মু একটা প্রশ্ন করবো? (আম্মু আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে খাবারের প্লেট টেবিলে রেখে আমার পাশে এসে বসলেন তারপর আমার মাথায় হাত রাখলেন)
আম্মু: বল।
আমি: তুমি তো জানো আমি হিমিকে ভালোবাসি, আব্বু যদি রাইসার সাথে আমার বিয়েটা দেন তাহলে তুমি কি করবে?
আম্মু: (নিশ্চুপ)
আমি: একটা কথা তো সত্যি আমি রাইসার সাথে কখনো সুখী হবো না কারণ হিমিকে কখনো ভুলতে পারবো না। পারবে তো সারাজীবন আমার চোখের পানি সহ্য করতে? (আম্মু আমার দিকে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছেন)
আমি: আব্বু সবসময় যা চেয়েছেন তাই হয়েছে, এবারো কি আব্বুর কথায় সব হবে? আব্বুর জন্য কি সারাটা জীবন ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণায় কাঁদবো?
আম্মু: না। তোর আব্বুর কথায় সব হলেও তোর বিয়েটা আমি অন্য কারো সাথে হতে দিবো না। তুই হিমিকে নিয়ে সুখে থাকলে আমি হিমিকেই তোর বউ করে আনবো, প্রয়োজন হলে তোর আব্বুর বিরুদ্ধে যাবো।
আমি: তাহলে আপুর বেলায় উল্টো কেন আম্মু? আমি তোমার ছেলে, আপু তোমার মেয়ে নয়?
আম্মু: মানে? (আম্মু আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন তারমানে আম্মু কিছু জানেন না)
আমি: আম্মু আপু কাউকে ভালোবাসে কিন্তু এই বিয়েটা আপুকে করতে হচ্ছে শুধুমাত্র আব্বুর জন্য।
আম্মু: কি বলছিস এসব?
আমি: আব্বু আপুকে বিয়েটা করতে বাধ্য করেছে। আপু সব নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে কাকে ভালোবাসে সেটাও বলছে না।
আম্মু: এতোদিন বলিসনি কেন আমাকে এসব?
আমি: আপু আব্বুর কথায় নিজের সুখটাকে এভাবে বিসর্জন দিবে আমি ভাবতে পারিনি।
আম্মু: তুই খেয়ে নে আমি আসছি।
আমি: আপুর বিয়ে না আটকানো পর্যন্ত আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না আম্মু।
আম্মু: আমার উপর ভরসা রাখ।
আম্মু চলে গেলেন। জানিনা আম্মু কি করবেন, বিয়েটা আদৌ আটকাতে পারবেন কিনা।

দুচোখ বন্ধ করে নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে ছিলাম হঠাৎ দরজা আটকানোর শব্দে বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে তাকালাম, হিমিকে দেখে বিরক্তি কেটে গিয়ে মুখে মুচকি হাসি ফুঁটলো। হিমি দরজা বন্ধ করে এসে আমার পাশে বসলো, ওর মুখে হাসি দেখে ভ্রু কুঁচকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম।
হিমি: বলবো না।
আমি: কি?
হিমি: গুড নিউজ।
আমি: বলো। (হিমি মৃদু হেসে আমার বুকে তুথুনি রেখে আমার দুচোখে চোখ রাখলো)
আমি: কি হলো বলো।
হিমি: ছোট ভাইয়া আসছে আজ।
আমি: তো?
হিমি: ভাইয়া বলেছে এসে প্রথমেই তোমার সাথে দেখা করবে কথা বলবে আর তোমাকে ভাইয়ার পছন্দ হলে বড় ভাইয়াকে রাজি করাবে। আমার আরশান তো দেখতে মাশাআল্লাহ্‌ খুব সুন্দর আ… (হিমির দিকে তাকিয়ে আমি হাসছি দেখে ও থেমে গেলো, বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর আমি এখনো হেসে যাচ্ছি ওর পাগলামি দেখে)
হিমি: কি হলো?
আমি: যে মায়াবতী আমাকে সবসময় আপনি করে কথা বলে সে আজ এতোটাই খুশি হয়েছে যে খুশিতে তুমি করে বলে ফেলেছে। (আমার কথা শুনে হিমি দুচোখ বন্ধ করে জিহ্বায় কামড় দিলো। মুচকি হেসে দুহাতে হিমির দুগালে আলতো করে ধরলাম, হিমি শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: তোমার মুখ থেকে তুমি ডাক শুনতে মাঝেমাঝে খুব ইচ্ছে হতো কিন্তু কখনো তোমাকে জোড় করিনি। কারণ আমি জানতাম একদিন তুমি নিজ থেকেই বলবে।
হিমি: হুম আজ আমি অনেক খুশি আর এই খুশিতেই বলে ফেলেছি।
আমি: এখন থেকে সবসময় বলবে কেমন?
হিমি: ঠিক আছে।
আমি: তোমার ছোট ভাইয়া রাগ করেনি আমাদের রিলেশনের কথা শুনে?
হিমি: করেছিল কিন্তু পরে আবার রাজি হয়ে গেছে। যদি একবার ভাইয়া তোমাকে পছন্দ করে ফেলে তাহলে আমাদের বিয়েটা আর কেউ আটকাতে পারবে না।
আমি: হুম খুব শীঘ্রই সবাইকে রাজি করিয়ে বিয়ে করে ফেলবো, আমি তোমাকে হারাতে চাই না।
হিমি: কিন্তু তোমার আব্বু? (হিমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলো ওর দুচোখে ভয়ের ছাপ)
আমি: ভয় পেয়ো না সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্‌। (হিমি চুপচাপ আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো, দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। আব্বুকে ভয় আমিও পাচ্ছি কারণ উনি যা চান তা জেদ করে হলেও করেন। কিন্তু এই ভয়টা হিমিকে বুঝতে দেওয়া যাবে না)
হিমি: আরশান? (হঠাৎ হিমির ডাকে আমার ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো, বুকে শুয়েই হিমি আমাকে ডাকছে)
আমি: কি?
হিমি: রাইসা তোমাকে ভালোবাসে তাই না? (হিমির গলাটা ধরে আসছে তারমানে কান্নারা ওর দুচোখে ভীড় জমিয়েছে। উঠে বসে হিমির একদম কাছে এসে ওর দুগালে আলতো করে ধরলাম। আমার চোখের দিকে তাকাতেই ওর দুচোখ থেকে টুপটুপ করে দু ফোঁটা পানি পড়ে গেলো, মৃদু হেসে ওর চোখের পানি মুছে দিলাম)
আমি: হিমি একটা মানুষকে অন্যজন ভালোবাসবে পছন্দ করবে এটাই স্বাভাবিক। একজন মানুষকে অন্য একজন মানুষের পছন্দ হতেই পারে তাই বলে কি তাকে সে মানুষটাও ভালোবাসে? আমাকে তো রাইসা অধরা দুজনেই ভালোবাসে আমি কি তাদের ভালোবাসি?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: সজিব তো তোমাকে ভালোবাসে তুমি কি সজিবকে ভালোবাস? খুঁজ নিয়ে দেখো তোমার অজান্তে অনেকেই তোমাকে পছন্দ করে কিন্তু তাই বলে কি তাকে নিয়ে ভাবতে হবে? আল্লাহর সব সৃষ্টিই সুন্দর আর তার মধ্যে অন্যতম মানুষ, একজনকে আরেকজন পছন্দ করতেই পারে।
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: লোকে বলে না তাকে বিয়ে করা উচিত যে তোমাকে ভালোবাসে? আমি এইটা মানিনা, আমার মতে তাকে বিয়ে করা উচিত যাকে আমি ভালোবাসি আর সে আমাকে ভালোবাসে। অধরা আর রাইসা তো আমাকে ভালোবাসে তাই বলে কি আমি তাদের বিয়ে করবো? নাতো, আমি তোমাকে বিয়ে করবো কারণ আমি তোমাকে এবং তুমি আমাকে দুজন দুজনকে ভালোবাসি। (হিমি ভেজা ভেজা চোখে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মুচকি হেসে ওর কপালে কপাল ঠেকালাম)
আমি: আমার ভালোবাসা তুমি, আমার ভালো লাগা তুমি, আমার ধ্যানধারণা চিন্তাভাবনা সবকিছুতে তুমি, আমার গল্পে তুমি, আমার এই জীবনের গল্পে এই মায়াবতী ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের জায়গা নেই, বুঝেছ মায়াবতী? (হিমি কাঁদতে কাঁদতে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো, হঠাৎ করে মাথা যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলাম)
হিমি: কি হয়েছে আরশান?
আমি: মাথা যন্ত্রণা করছে।
হিমি: চুপচাপ শুয়ে পড়ো।
আমি: হুম।
হিমির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। হিমি আমার চুলে হাত বুলাচ্ছে আর আমি দুচোখ বন্ধ করে নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছি।

হঠাৎ সবার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গলো, ঘুম ঘুম চোখে পাশে তাকালাম হিমি নেই। সবার চেঁচামেচি শুনে দরজার দিকে তাকাতেই দেখি আম্মু, আপু, অধরা, হিমি, ভাবি, আর হিমির ভাইয়া হয়তো উনি। কিন্তু হিমি এভাবে কাঁদছে কেন?
আপু: আরশান এসব কি? (আপুর প্রশ্ন শুনে বোকার মতো সবার দিকে তাকিয়ে আছি, কিছু বুঝতেই পারছি না)
ভাবি: রুদ্র এসেছিল তোমার সাথে হিমির বিয়ে নিয়ে কথা বলতে আর তুমি… ছিঃ!
ভাইয়া: হিমি এই তোর আরশান? এই তোর ভালোবাসা? (হিমি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে আর আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুচোখের পানি ঝরাচ্ছে। কিছু বুঝতে না পেরে আস্তে আস্তে উঠে বিছানায় বসলাম)
আপু: অধরা?
অধরা: আমার কোনো দোষ নেই আপু আরশান আমাকে ফোন করে আসতে বলেছিল। আসলে সবসময় তো আমরা বাইরেই… এখন তো আরশান অসুস্থ তাই…
আপু: একদম চুপ, বেরিয়ে যাও। (আপুর ধমক শুনে অধরা ফ্লোর থেকে ওর ওড়নাটা তুলে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলে গেলো)
ভাবি: আরশান তুমি কিছু বলছ না কেন?
আমি: কি বলবো ভাবি? আমিতো কিছু বুঝতেই পারছি না। (হিমির ভাইয়া আমার দিকে এগিয়ে আসছে দেখে ভয়ে আতকে উঠলাম)
ভাইয়া: এগুলো কি? তোমার সারা মুখে ওই নষ্ট মেয়েটার ঠোঁটের ছাপ, মেয়েটাকে খারাপ অবস্থায় তোমার বুকে দেখেছি এরপরও বলবে তুমি কিছু বুঝতে পারছ না? (ভাইয়ার কথা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, ঘুমানোর আগে হিমি ছিল আমার পাশে কিন্তু ঘুমানোর পর কি হয়েছে কিছুই তো…)
ভাইয়া: হিমির কান্না শুনে বাহির থেকে দেশে ছুটে এসেছি, হিমি যখন বললো তুমি খুব ভালো ছেলে তখন অতীতের সব ভুলে গেলাম। আমাদের বোন সুখে থাকলে ভালো থাকলে আমরা ভালো থাকবো তাই তোমার কাছে এসেছিলাম আর তুমি কিনা হিমিকে এভাবে ঠকাচ্ছ ওর চোখের আড়ালে?
আম্মু: তোমাদের সবার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে আমার ছেলে এরকম নয়, আরশান হিমিকে সত্যি ভালোবাসে।
হিমি: তোমার গল্পে মায়াবতী ছাড়া আর কোনো মেয়ের জায়গা নেই কিন্তু একটা নষ্টা মেয়ের জায়গা ঠিকই আছে তাই না আরশান?
আমি: হিমি তুমি অন্তত আমাকে ভুল বুঝ না।
হিমি: অনেক হয়েছে আরশান অনেক ঠকিয়েছ আমায় আর না প্লিজ! (হিমি কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলে গেলো)
ভাইয়া: যদি হিমি তোর কারণে খারাপ কিছু করে বসে তাহলে তোকে আমি খুন করে ফেলবো।
ভাইয়া আমার শার্টের কলার চেপে ধরে কথা গুলো বলে চলে গেলেন। এতক্ষণে লক্ষ করলাম আমার শার্টের বোতাম খুলা, তারমানে অধরা আমাকে ফাঁসানোর জন্য এসব করেছে। কিন্তু আমি সবাইকে এইটা বিশ্বাস করাবো কিভাবে? আম্মু, আপু, ভাবি সবাই একে একে চলে যাচ্ছে আমি সবার পথপাণে চেয়ে আছি, আমার দুচোখ দিয়ে বৃষ্টির মতো পানি পড়ছে। বারবার শুধু একটা কথা মনে হচ্ছে, অধরা আমার বন্ধু হয়ে আমার এতো বড় ক্ষতি করতে পারলো? অধরা কি এসব ইচ্ছে করে করেছে নাকি কারো ইশারায় করেছে? প্রশ্নটা বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে…

খাটে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আছি আর ভাবছি কি থেকে কি হয়ে গেলো। হিমির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিলাম বুঝতে পারিনি ঘুম ভেঙ্গে হিমির দুচোখে পানি দেখতে হবে আর এতসব কিছু ঘটে যাবে। প্রচন্ড মাথা যন্ত্রণায় ঘুমে এতোটাই কাতর ছিলাম যে হিমি কখন গিয়েছে আর অধরা কখন আমার রুমে এসেছিল বুঝতেই পারিনি। এখন আমি কি করবো আমাকে তো কেউ বিশ্বাস করছে না।
আম্মু: আরশান? (আম্মুর ডাকে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলাম, আম্মু এসে আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। আম্মুকে ঝাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম)
আম্মু: পাগল ছেলে কাঁদছিস কেন?
আমি: আম্মু বিশ্বাস করো আমি কিছু জানতাম না, অধরা আমাকে ফাঁসানোর জন্য এমন করেছে। আমিতো হিমির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তারপর কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারিনি।
আম্মু: আমি জানি আমার ছেলে এরকম নয়।
আমি: কিন্তু হিমি তো আমাকে ভুল বুঝেছে, হিমির পরিবারের কাছে আমি ছোট হয়ে গেলাম আমাদের ভালোবাসা ছোট হয়ে গেলো। এরকম লজ্জার থেকে মৃত্যুও ভালো আম্মু।
আম্মু: চুপ কিসব বলছিস? কেউ তোকে ফাঁসানোর জন্য এমন করেছে বলে যে তুই সত্যি খারাপ হয়ে গেছিস তাতো নয়। আর কেউ না জানুক আমিতো জানি আমার সন্তান কেমন। আমি হিমিকে বুঝাবো তুই টেনশন করিস না।
আমি: হিমি বুঝবে না আম্মু কারণ হিমি নিজের চোখে অধরাকে আমার বুকে দেখেছে।
আম্মু: যা চোখে দেখা যায় তা যে সবসময় সত্যি হয় এমন তো না, হিমি ঠিক বুঝবে কারণ ও তোকে ভালোবাসে। আমি হিমিকে বুঝাবো আর অধরাকে ধরে এনে সত্যিটাও প্রমাণ করবো, তুই কান্না বন্ধ কর। (হঠাৎ হিমিদের ফ্ল্যাট থেকে চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসলো, চোখের পানি মুছে আম্মুর দিকে তাকালাম)
আম্মু: কি হয়েছে বলতো ওদের ফ্ল্যাট থেকে এতো চেঁচামেচি শুনা যাচ্ছে কেন?
আমি: বুঝতে পারছি না আম্মু।
আম্মু: হিমি কিছু করে বসেনি তো?
আম্মুর কথা শুনে ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো, এক মুহূর্ত দেরি না করে হিমিদের ফ্ল্যাটের দিকে ছুটলাম।

হিমি দরজা বন্ধ করে ফেলেছে আর সবাই ওকে দরজা খুলার জন্য ডাকছে, ছোট ভাইয়া দরজায় ধাক্কাচ্ছেন।
তারিন: দরজা খুল হিমি দেখ আরশান ভাইয়া এসেছে।
ভাবি: আরশান তুমি ডেকে দেখো না হিমি দরজা খুলে কিনা।
আন্টি: প্রয়োজন নেই, হিমি তো মাঝেমধ্যেই এমন করে। কিছুক্ষণ পর হিমি নিজেই দরজা খুলবে সবাই যাও। (আন্টির কথায় কেন যেন শান্ত হতে পারলাম না, অন্যদিন হিমির দরজা বন্ধ করা আর আজকের করায় অনেক পার্থক্য। হিমি ওর ভালোবাসার মানুষকে অন্য একটি মেয়ের সাথে দেখেছে ওর কষ্ট পাওয়াটা স্বাভাবিক। হয়তো এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজেকে আঘাত করবে, হিমি কিছু করার আগেই ওকে ডাকতে হবে)
ছোট ভাইয়া: যদি আমার বোনের কিছু হয়েছে তাহলে তোকে…
আমি: ভাইয়া আমাকে পরেও মারতে পারবেন তার আগে হিমির দরজা খুলা প্রয়োজন।
তারিন: আরশান ভাইয়া একদম ঠিক বলেছে।
আমি: হিমি দরজা খুলো প্লিজ! এসব মিথ্যে আমি তোমাকে প্রমাণ দিবো, আমাকে একটু সময় দাও প্লিজ! তুমি কেন বুঝতে পারছ না আমাদের দুজনকে আলাদা করার জন্য অধরা এইটা করেছে? (হিমি কোনো সাড়া দিচ্ছে না দেখে ভয়ে বুক কাঁপতে শুরু করলো, পাগলীটা কিছু করে বসেনি তো? ছোট ভাইয়ার দিকে তাকালাম)
ছোট ভাইয়া: কি?
আমি: ভাইয়া ভয় হচ্ছে, দরজা ভেঙ্গে ফেলি।
আন্টি: বললাম তো হিমি মাঝেমাঝে এমন করে দরজা ভাঙ্গতে হবে না।
আমি: আমার হিমিকে আমি ভালো করে ছিনি, হিমি আমার পাশে অন্য মেয়েকে একদম সহ্য করতে পারেনা।
ছোট ভাইয়া: তাহলে অন্য মেয়েকে পাশে…
আমি: ভাইয়া সব মিথ্যে আমি প্রমাণ করে দিবো।
আদিত্য: ভাইয়া সরো আমি দরজা ভাঙ্গছি।
আমি: হুম।

দরজা ভেঙ্গে রুমে ঢুকে হিমির অবস্থা দেখে ধপাস করে ফ্লোরে বসে পড়লাম। হিমি সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে ফ্লোরে, হিমির হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে। হিমি আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য নিজেকে এভাবে আঘাত করলো? রক্তে ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে, হিমির যদি কিছু হয়ে যায় আমি কি নিয়ে বাঁচবো?
আম্মু: আরশান কি ভাবছিস? (আম্মুর ধাক্কায় আমার ঘোর কাটলো)
আমি: আম্মু হিমি…
আম্মু: ওকে হসপিটালে নিতে হবে, তুই ভেঙ্গে পড়িস না বাবা।
আদিত্য: আমি গাড়ি বের করছি তোমরা হিমিকে নিয়ে এসো।
ছোট ভাইয়া: ঠিক আছে।
হিমি ছোট ভাইয়ার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে, ওর হাত থেকে এখনো রক্ত পড়ছে। আমি হিমির মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, আমার জন্য আজ এই অবস্থা হলো ওর।

শান্ত: আরশান? (হিমির কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম হঠাৎ শান্তর কন্ঠ শুনে পিছন ফিরে তাকালাম, শান্ত, আরিয়ান, সিফাত, তারিন সবাই এসেছে)
শান্ত: তুই ঘুমিয়ে ছিলি তাই আমরা বাসায় চলে গিয়েছিলাম আর এর মধ্যে এতকিছু হয়ে গেলো?
আমি: আমার হিমি…
সিফাত: আরে পাগল কাঁদছিস কেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
আদিত্য: ভাইয়া ডক্টর তো হিমিকে দেখছে টেনশন করো না সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি: আমার জন্য সব হলো।
তারিন: এতে তোমার কি দোষ বলতো, সব তো অধরা আপু করেছে।
আরিয়ান: সত্যি বিশ্বাস হচ্ছে না অধরা এমন কিছু করেছে।
“আমার বোনের এতো বড় ক্ষতি যে করেছে তাকে আমি ছাড়বো না” (হঠাৎ কারো চিৎকার শুনে পিছনে তাকালাম, হিমির বড় ভাইয়া আসছে। এতক্ষণ ভাইয়া ছিলনা তারমানে ভাইয়া কিছু জানেননা, এখন ভাইয়াকে কি জবাব দিবো আমি? ভাইয়ার ভয়ঙ্কর রূপ দেখেই ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে)
বড় ভাইয়া: হিমিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে এখন আবার এখানে দাঁড়িয়ে আছ?
আমি: (নিশ্চুপ)
বড় ভাইয়া: কি যেন বলেছিলে ভালোবাসার পরীক্ষা দিবে, এই তোমার ভালোবাসার পরীক্ষা?
ছোট ভাইয়া: ভাইয়া কেন শুধু শুধু চেঁচামেচি করছ? এই ছেলেকে কিছু বলে লাভ নেই বাদ দাও তো।
বড় ভাইয়া: ও তো আমার বোনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।
ডক্টর: পেসেন্ট এর সেন্স ফিরেছে, চাইলে দেখা করতে পারেন। (ডক্টর এর কথা শুনে কেবিনে ঢুকার জন্য পা বাড়ালাম কিন্তু ছোট ভাইয়া আটকে দিলো। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি)
তারিন: আরশান ভাইয়া আমি হিমিকে দেখে এসে তোমাকে বলছি।
আমি: হুম।

কেবিনের বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আর তারিন আসার অপেক্ষা করছি, জানিনা হিমির এখন কি অবস্থা। হঠাৎ আদিত্য এসে আমার দিকে ওর ফোন এগিয়ে দিলো, ওর দিকে তাকালাম কথা বলতে ইশারা করলো।
আমি: হ্যালো।
আব্বু: তুমি কোথায়?
আমি: হসপিটালে।
আব্বু: আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পর তোমার বোনের বিয়ে আর তুমি এখন হসপিটালে?
আমি: হিমি অসুস্থ নিশ্চয় শুনেছ?
আব্বু: তাতে কি হয়েছে? বোনের বিয়ের থেকে অন্য একটা মেয়ের…
আমি: অন্য একটা মেয়ে নয় হিমি আমার ভালোবাসা। আর বিয়ের চেয়ে একটা জীবন অনেক দামী।
আব্বু: ছেলে পক্ষ এসে যদি তোমাকে খুঁজে তখন কি জবাব দিবো?
আমি: বলবে আরশান তার ভালোবাসার মানুষকে বাঁচাতে হসপিটালে গেছে।
আব্বু: ভালোবাসা না ছাই। এই মেয়ে যদি তোমাকে সত্যি ভালবাসতো তাহলে সামান্য বিষয় নিয়ে তোমাকে ভুল বুঝে সুইসাইড করতে যেতো না।
আমি: তোমার কাছে সামান্য বিষয় হতে পারে কিন্তু হিমির কাছে সামান্য নয়, হিমি আমাকে সত্যি ভালোবাসে বলেই আমার পাশে অন্য মেয়েকে সহ্য করতে পারেনি।
আব্বু: সব আবেগ আর লোভ।
আমি: সবাইকে নিজের মতো ভেবো না।
আব্বু: আমি তোমার সাথে তর্ক করতে ফোন করিনি, বাসায় কখন আসছ?
আমি: ঠিক বলতে পারছি না।
আব্বু: বিয়েতে থাকবে না?
আমি: যে বিয়েতে আপুর মত নেই সে বিয়েতে আমার না থাকাটাই ভালো।
আব্বু: তুমি এখনো এসব ভাবো?
আমি: হ্যাঁ কারণ এইটা আমার বোনের সারাজীবনের প্রশ্ন।
আব্বু: প্রয়োজন নেই তোমার আসার, মনে রেখো তোমার বিয়েটাও আমার ইচ্ছেতেই হবে রাইসার সাথে।
আমি: চেষ্টা করতেই পারো কিন্তু সফল হবে না। (ফোনটা কেটে দিলাম, এই লোকটা আমাদের সবার জীবন নষ্ট করে দিচ্ছে।)
তারিন: ভাইয়া হিমি তোমাকে ভিতরে ডাকছে। (তারিনের কথা শুনে হিমির কেবিনের দিকে পা বাড়ালাম)

হিমি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে, আমি নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হিমির ভাইয়েরা ডক্টর এর সাথে কথা বলছে। হিমির কাছে গিয়ে ওর হাত ধরার সাহসও আমার হচ্ছে না।
ছোট ভাইয়া: হিমি ওকে ডাকলি কেন?
হিমি: (নিশ্চুপ)
ছোট ভাইয়া: ওর জন্য তোর এই অবস্থা আর তুই…
হিমি: ভাইয়া আরশান কোনো অপরাধ করেনি। (হিমির কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম, হিমি আমাকে এখনো বিশ্বাস করে? হিমি ইশারায় আমাকে ওর কাছে ডাকলো, চোখের পানি মুছে হিমির পাশে এসে বসলাম)
বড় ভাইয়া: তুই এখনো ওকে বিশ্বাস করিস?
হিমি: হ্যাঁ।
ছোট ভাইয়া: তুই সত্যি পাগল হয়ে গেছিস।
হিমি: এখন সুস্থ আছি আগে পাগল ছিলাম আর তাইতো সুইসাইড করতে চেয়েছিলাম।
ছোট ভাইয়া: হিমি তুই…
হিমি: ভাইয়া আমার বিশ্বাস আরশান কোনো অপরাধ করেনি, ওকে সবকিছু প্রমাণ করার একটু সুযোগ দাও।
আমি: হিমি আমি অধরাকে তোমার কাছে নিয়ে আসবো তুমি নিজে ওর থেকে সত্যিটা জেনো।
বড় ভাইয়া: কোনো প্রয়োজন নেই, আরশান তুমি হিমিকে ভুলে যাও। আর আমরা খুব শীঘ্রই তোমাদের বাসা থেকে চলে যাবো।
আমি: একটা ভুল বুঝাবুঝির জন্য আমাদের দুজনকে এতো বড় শাস্তি দিবেন ভাইয়া?
বড় ভাইয়া: আজ তুমি এই অন্যায় করতে পেরেছ যখন বিয়ের পরও একই অন্যায় করতে দুবার ভাববে না তুমি।
আমি: ভাইয়া সব আমাকে ফাঁসানো…
ছোট ভাইয়া: অনেক বলেছ এবার আসতে পারো।
বড় ভাইয়া: তুমি হিমির আশেপাশে না আসলেই আমরা খুশি হবো। আর কথাটা না শুনলে আমরা তোমার বাবাকে জানাতে বাধ্য হবো।
ছোট ভাইয়া: উঠো চলো। (ছোট ভাইয়া আমার হাত ধরে টেনে আমাকে দাঁড় করাতেই হিমি আমার অন্য হাত ধরে ফেললো, সবাই হিমির দিকে তাকালাম)
হিমি: ওকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিলে আমি আবারো সুইসাইড করার চেষ্টা করবো। মনে রেখো এখন আর হাতের শিরা কাটবো না চাকু দিয়ে গলায় টান দিবো, বাঁচানোর সুযোগও পাবে না তোমরা। (হিমির কথা শুনে ছোট ভাইয়া আমার হাত ছেড়ে দিলেন। দুভাই দুজনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন)
আমি: এখনো আমায় এতোটা বিশ্বাস কর? (হিমি আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না)
হিমি: ডক্টর বলেছে আমি সুস্থ আছি বাসায় যেতে পারবো।
আমি: আজই?
হিমি: হুম। আজ তো আবার ফারিয়া আপুর বিয়ে। (হিমিকে এখনি রিলিজ করে দিলে ভালোই হবে, বাসায় গিয়ে আম্মুর সাথে কথা বলে অন্তত জানতে পারবো বিয়ে ভাঙ্গার কোনো ব্যবস্থা হলো কিনা)
হিমি: কি ভাবছ?
আমি: কিছুনা।
হিমির পাশে চুপচাপ বসে আছি, হিমি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে।

ছোট ভাইয়া: হিমি চল। (আনমনা হয়ে বসে ছিলাম হঠাৎ ছোট ভাইয়া এসে কেবিনে ঢুকলেন, ভাইয়ার দিকে হিমি আমি দুজনেই তাকালাম)
ছোট ভাইয়া: ডক্টর তোকে রিলিজ করে দিয়েছে, একটু রেস্টে থাকলেই সুস্থ হয়ে যাবি।
হিমি: হুম।
ছোট ভাইয়া: আরশান তুমি হিমিকে নিয়ে এসো আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি।
আমি: ঠিক আছে।

হিমিকে নিয়ে এসে গাড়িতে বসিয়ে দিলাম, পাশে তারিন আর ভাইয়ারা বসলেন।
বড় ভাইয়া: তুমি বাসায় যাবে না?
আমি: না।
আদিত্য: ভাইয়া বাসায় যাবে না কেন?
আমি: আমার উপর যে অপবাদ দেওয়া হয়েছে সেটা যে মিথ্যে প্রমাণ তো করতে হবে। অধরার হোস্টেলে যাবো আর ওকে হিমির সামনে এনে দাঁড় করাবো, অধরাই সব সত্যি বলবে।
আদিত্য: ঠিক আছে।
আমি: সাবধানে যাস।
আদিত্য: হুম। (আদিত্য গাড়ি স্টার্ট দিলো, গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে আর হিমি জানালা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
শান্ত: আরশান চল। (হিমির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম হঠাৎ শান্ত এসে কাধে হাত রাখলো। সবাই যাবো অধরার কাছে আর সব সত্যি আজ অধরার মুখ থেকে বের করবো)
সিফাত: কিরে কি ভাবছিস চল।
আমি: হুম।

অধরার হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, কেন যেন খুব ভয় করছে বারবার মনে হচ্ছে অধরাকে হোস্টেলে পাওয়া যাবে না। অধরা নিজ থেকে এসব করে থাকলে অবশ্যই হোস্টেলে থাকবে আর যদি কারো ভয়ে করে থাকে তাহলে ও হোস্টেলে থাকবে না আমি নিশ্চিত।
আরিয়ান: আরশান অধরা হোস্টেলে নেই।
আমি: যা ভেবেছিলাম তাই হলো।
সিফাত: ওরা বললো অধরা তিনদিন হলো গ্রামের বাড়িতে গেছে।
আমি: তিনদিন ধরে গ্রামের বাড়িতে হলে আজ দুপুরে ও আমার বাসায় গিয়ে এসব কান্ড কিভাবে করেছে?
সিফাত: সেটাই তো ভাবাচ্ছে।
শান্ত: অধরার গ্রাম এখান থেকে অনেক দূরে আর আমরা তো জানি এই শহরে ওর কোনো আত্মীয়স্বজনদের বাসা নেই, তাহলে অধরা আছে কোথায়?
আরিয়ান: আমার কিন্তু ভয় হচ্ছে, অধরা সহজসরল মেয়ে ওকে কেউ ফাঁসিয়ে বিপদে ফেলেনি তো?
আমি: যদি তাই হয় তাহলে সেটা সজীব অথবা আব্বুর কাজ।
সিফাত: হতে পারে।
শান্ত: তাহলে তো অধরার কোনো বিপদ হবার আগেই ওকে খুঁজে বের করা প্রয়োজন, এই শহরে আমরা ছাড়া ওর আর কে আছে বল।
আরিয়ান: আরশান তুই অধরার উপর রেগে থাকিস না প্লিজ! ও যদি সত্যি অন্যায় করে থাকে তাহলে পরে শাস্তি দিস।
আমি: আমি ওর উপর রেগে নেই, এখন আমারো টেনশন হচ্ছে। এক কাজ কর তোরা অধরার খুঁজ করার চেষ্টা কর আমি বাসায় যাচ্ছি যদি আব্বুর থেকে কোনো খুঁজ পাই অধরার।
শান্ত: ঠিক আছে।
সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এবার অধরার উপর থেকে রাগ কমে গিয়ে সত্যিই টেনশন হচ্ছে, জানিনা মেয়েটা কোথায় আছে কেমন আছে।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে একটু পর অন্ধকার নেমে আসবে, হিমির পাশে বসে আছি, হিমি ঘুমিয়ে আছে। না পারলাম অধরাকে এনে সব প্রমাণ করতে আর না পারলাম আপুর বিয়েটা আটকাতে। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে কিছুই হয় না আমাকে দিয়ে। এখন আমি হিমির ভাইদের সামনে কিভাবে দাঁড়াবো? হিমির ঘুম ভাঙ্গার পর কি জবাব দিবো? মাথাটা বড্ড যন্ত্রণা করছে, রুমে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম সাথে সাথে হিমি আমার হাত ধরে ফেললো, পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি হিমি আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। নীল ডিম লাইটের আলোতে হিমির চোখের কোণে জমে থাকা পানি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বুঝতেই পারছি না হিমিকে এখন কি বলবো, এসব বললে হিমি বিশ্বাস করবে কিনা।
হিমি: অধরা আসেনি?
আমি: আসলে অধরাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
হিমি: তাহলে কি আমিও ধরে নিবো সবকিছু সত্যি ছিল? (হিমির কথা শুনে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম, ও কি সেই হিমি যে হসপিটালে ওর ভাইদের সামনে আমাকে বিশ্বাস করেছিল?)
হিমি: আমি নিজের চোখে সবকিছু দেখেছি। ভাইয়াদের সামনে বলেছি আমি তোমাকে বিশ্বাস করি তুমি কোনো অপরাধ করনি। কিন্তু মন থেকে মেনে নিতে পারছি না, বারবার চোখের সামনে সেই দৃশ্য ভেসে উঠছে। আরশান…
আমি: ব্যস অনেক বলেছ, এই তোমার ভালোবাসা? নিজের ভালোবাসার মানুষের প্রতি বিশ্বাস নেই এ কেমন ভালোবাসা তোমার? আমিতো ভেবেছিলাম পৃথিবীর সবাই আমাকে অবিশ্বাস করলেও তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে, এখন দেখছি আমি ভুল ছিলাম।
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: এমন ঠুনকো বিশ্বাস নিয়ে আর যাই হউক ভালোবাসার সম্পর্ক গড়া যায় না। সবকিছু যে সাজানো ছিল তার প্রমাণ আমি দিবো, তবে হ্যাঁ এইটাও মনে রেখো প্রমাণ দেওয়ার পর তোমার সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না।
হিমি: আরশান?
আমি: যে আমাকে বিশ্বাস করে না তার সাথে আমি সারাজীবন কাটাবো কিভাবে? আমি বারবার বলার পরও যে আমার উপর ভরসা করতে পারছে না তার সাথে সারাটা জীবন কাটানো তো ইম্পসিবল।
হিমি: আরশান আমার কথা শুনো।
আমি: আর কিছু শুনতে চাই না হিমি, তুমি আমাকে এখনো ভালো বাসতে পারোনি। প্রমাণের অপেক্ষা করো, প্রমাণ দিয়ে আমি তোমার থেকে অনেক দূরে চলে যাবো।
হিমির হাত থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে এনে চলে আসলাম। চোখের পানি মুছে নিলাম, কার জন্য কাঁদবো যে আমাকে বিশ্বাসই করে না? বিশ্বাস ছাড়া আর যাই সম্ভব হউক ভালোবাসা সম্ভব না। সবকিছুর প্রমাণ দিয়ে আমি হিমির থেকে অনেক দূরে চলে যাবো, আর কখনো হিমির জীবনে ফিরে আসবো না।

গোধূলি সন্ধ্যা, ছাদে দাঁড়িয়ে আনমনা হয়ে আকাশপাণে তাকিয়ে আছি। চারদিকে একটু একটু করে অন্ধকার নেমে আসছে, মনে হচ্ছে এই রাতের আধারের মতো আমার জীবনেও একটু একটু করে অন্ধকার নেমে আসছে। হিমিকে ভালোবেসে সুন্দর একটা জীবন সাজাতে চেয়েছিলাম কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে গেলো। সবকিছু কেমন যেন এক মুহূর্তের মধ্যে মিথ্যে হয়ে গেলো। জীবনের এমন এক পর্যায়ে আমি আছি যে না পারছি সবকিছু মেনে নিতে আর না পারছি সবকিছু ঠিক করে নিতে।
আপু: আরশান? (হঠাৎ আপু এসে আমার কাধে হাত রাখলো, পিছন ফিরে আপুর দিকে তাকালাম না ইচ্ছে হচ্ছে না)
আপু: কিরে কি হলো? (আপু আমাকে ঘুরিয়ে দিলো, আপুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আর আপুকে এক দৃষ্টিতে দেখছি। আপু লাল বেনারসি পরে বিয়ের সাজে সেজেছে, আপুকে খুব সুন্দর লাগছে তবে আরো একটু বেশি সুন্দর লাগতো যদি আপুর ঠোঁটের কোণে হাসি থাকতো)
আপু: ছাদে দাঁড়িয়ে আছিস যে নিচে যাবি না? একটু পর তো বরযাত্রী…
আমি: তো আমি কি করবো? আব্বু আছে তো।
আপু: আমার বিয়ে অথচ তুই এমন করছিস?
আমি: বিয়েটা তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে হচ্ছে তাই এমন করছি।
আপু: কতবার বলবো আমি এই বিয়েতে রাজি।
আমি: হ্যাঁ রাজি কিন্তু সেটা আব্বুর ভয়ে, মন থেকে নয়।
আপু: মন থেকে চাইলেই কি সবকিছু পাওয়া যায়? সবকিছু যদি চাইলেই পাওয়া যেতো তাহলে তো পৃথিবীতে কষ্ট বলে কোনো শব্দ থাকতো না।
আমি: মানছি চাইলেই সবকিছু পাওয়া যায় না কিন্তু পাওয়ার জন্য তো চেষ্টা করতে হয়। চেষ্টা না করলে আল্লাহ্‌ তোকে দিবেন কিভাবে?
আপু: হয়তো অসীমের সাথেই আল্লাহ্‌ আমার ভাগ্য লিখে রেখেছেন তাই ওর সাথে বিয়ে হচ্ছে।
আমি: চেষ্টা করলে হয়তো তোর ভালোবাসার মানুষের সাথেই বিয়েটা হতো। চেষ্টা করার পর না পেলে এই কথাটা বললে মানাতো, তুই তো কোনো চেষ্টাই করিসনি।
আপু: একটু পর বিয়ে এখন আর এসব ভাবিস না। নিচে চল প্লিজ!
আমি: হুম।
আপু চলে গেলো, আপুর পিছু পিছু আমিও আসলাম।

রোদেলা: ভাইয়া? (ড্রয়িংরুমে যাচ্ছিলাম হঠাৎ রোদেলা আমার হাত ধরলো, পিছন ফিরে তাকালাম রোদেলা আর তারিন দাঁড়িয়ে আছে)
আমি: কিছু বলবি?
রোদেলা: তুমি হিমিকে কি বলেছ?
আমি: কি?
তারিন: অধরা আপুর বিষয়ে প্রমাণ দিয়ে নাকি তুমি হিমির থেকে অনেক দূরে চলে যাবে? হিমির সাথে কোনো সম্পর্ক…
আমি: হ্যাঁ বলেছি।
রোদেলা: কি বলছ এসব?
আমি: যে আমাকে এতটুকুও বিশ্বাস করে না তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারেনা। যেকোনো সম্পর্কের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে বিশ্বাস, যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে সম্পর্ক টিকবে কিভাবে?
তারিন: আসলে হিমির মাথা ঠিক নেই তাই ভুলভাল…
আমি: আমার মাথা ঠিক আছে? আমার বোনের বিয়ে হচ্ছে অন্য একটা ছেলের সাথে অথচ আমি কিছুই করতে পারছি না। আব্বু বলেছে আজ রাইসার সাথে আমার এংগেজমেন্ট হবে কি করবো বুঝতে পারছি না। এসবের মাঝখানে অধরা এসে আমার গায়ে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে গেলো, বলতে পারো আমার মাথা ঠিক আছে কিনা? এতকিছুর মাঝেও তো হিমিকে কখনো রেগে কথা বলিনি, হিমিকে যেমন ভালোবাসতাম তেমনই বাসি।
তারিন: আসলে তোমাকে আর অধরাকে ওভাবে দেখে…
আমি: হিমি যেদিন বলেছিল ও অপবিত্র সেদিন নির্দ্বিধায় ওকে কাছে টেনে নিয়েছিলাম, আমি কিন্তু সেদিন জানতাম না কিডন্যাপ এর পর চারদিন ওর সাথে কি হয়েছিল। তবুও ওকে কাছে টেনে নিয়েছিলাম কারণ আমার কাছে ভালোবাসা দামী শরীর নয়। আর হিমি কি করলো? অধরাকে আমার বুকে দেখে সব সত্যি ভেবে নিলো, একবারো ভাবেনি ওর আরশান তো এমন না। আমি বারবার বলেছি সব সাজানো তবুও ও আমাকে এতটুকু বিশ্বাস করতে পারেনি। আসলে কি জানতো হিমি আমাকে মন থেকে ভালোবাসে না।
রোদেলা: ভাইয়া তুমি ভুল করছ হিমি তোমাকে ভালোবাসে বলেই কিন্তু রাগ করেছে, রাগ তো তার উপরেই করা যায় যাকে ভালোবাসা যায়।
আমি: হয়তো ভালোবাসে কিন্তু ওর ভালোবাসার গভীরতা খুবই কম, ঠুনকো ভালোবাসা ওর।
তারিন: আরশান ভাইয়া হিমি নাহয় রাগে তোমাকে বিশ্বাস করেনি কিন্তু তাই বলে তুমি এমন সিদ্ধান্ত নিবে?
আমি: একটা ভালোবাসার সম্পর্ক কখন পূর্ণতা পায় জানো? যখন দুটো মানুষের ভালোবাসার পরিমাণ সমান হয়। একজন কম ভালোবাসলে আর একজন বেশি ভালোবাসলে সেই ভালোবাসা কখনো পূর্ণতা পায় না। ভালোবাসায় জয়ী হতে হলে দুজনকে সমান চেষ্টা করতে হয়, একজনের চেষ্টায় কখনো ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না।
তারিন: কি বলতে চাইছ হিমি তোমাকে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেনি? আচ্ছা হিমি যদি তোমাকে ভালো না বাসতো তাহলে কি সুইসাইড এর চেষ্টা করতো?
আমি: বললাম না হয়তো ভালোবাসে কিন্তু ওর ভালোবাসা ঠুনকো, এতোটাই ঠুনকো যে সামান্য আঘাতে কাঁচের মতো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে।
রোদেলা: কিছুই শেষ হয়নি তোমরা দুজনেই রেগে আছ, ভাইয়া তুমি অন্তত…
আমি: মাঝেমাঝে রাগ করতে হয় অভিমান করতে হয়, প্রিয় মানুষটিকে নিজের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য করতে হয়।
রোদেলা: গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে ভালোবাসার মানুষটাকেই হারিয়ে ফেলো না। রাগের মাথায় কোনো সিদ্ধান্ত নিও না পরে পস্তাতে হবে।
আমি: (নিশ্চুপ)
রোদেলা: চাচ্চু কিন্তু বলেছে আজ তোমার এংগেজমেন্ট রাইসার সাথে, ভেবে দেখো রেগে থাকবে নাকি কিছু করবে।
রোদেলা আর তারিন চলে গেলো, আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। সত্যিই তো আজ এংগেজমেন্ট হলে আমি তখন কি করবো? হিমির উপর এখন রাগ করাটা কি ঠিক হলো? একদম ঠিক হয়েছে, যে আমাকে বিশ্বাস করেনা তার সাথে সম্পর্ক কিসের আবার? আমি রাইসার হাতেই আজ আংটি পড়াবো। হিমি বুঝুক বেশি কিছুই যে ভালো না।

রুম অন্ধকার করে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছি নিশ্চুপ হয়ে। বাইরে থেকে খুব চেঁচামেচি শুনা যাচ্ছে, হয়তো বরযাত্রী এসেছে। কোনো কিছুতে মন বসাতে পারছি না, কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না, কেমন যেন দুটানায় পড়ে গেছি। হঠাৎ রুমের লাইট জ্বলে উঠলো, পিছনে তাকিয়ে দেখি রাইসা।
রাইসা: আরশান তুমি রুম অন্ধকার করে একা একা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
আমি: কারণ আমার জীবনেই অন্ধকার নেমে এসেছে।
রাইসা: তাতে কি হয়েছে? আমিতো আছি তোমার জীবন আলোয় আলোয় ভরিয়ে দিবো। (রাইসার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম, রাইসা এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো আর আচমকা আমার গলা জড়িয়ে ধরলো)
আমি: কি করছ রাইসা?
রাইসা: তোমার মন ভালো করার চেষ্টা।
আমি: প্রয়োজন নেই।
রাইসা: আছে। দেখতো আংটিটা কেমন হয়েছে। মামা আমার জন্য এনেছেন, আজ তুমি আমার আঙ্গুলে এই আংটি পড়িয়ে দিবে, আমার আঙ্গুলে খুব সুন্দর মানাবে তাই না? (রাইসা একহাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে আছে আর অন্যহাতে আংটি আমার সামনে ধরে রেখেছে, গলা থেকে ওর হাত সরানোর চেষ্টা করছি কিন্তু রাইসা আমার আরো কাছে চলে আসছে)
হিমি: বাহ্ বাহ্! (রাইসার হাত কোনোভাবে সরিয়ে দিয়ে পিছনে তাকালাম, হিমি আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত তালি দিচ্ছে। এমনিতে দুজনের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে তার উপর এই রাইসাটা…)
হিমি: নিজের এই চরিত্র ঢাকার জন্য আমার উপর রাগ করেছিলে? অন্যায় করেছ আর আমাকেই আবার কথা শুনিয়েছ। অন্যায়টা একবার নয় দুবার করেছ। রাইসা, অধরা আরো কেউ আছে বুঝি?
আমি: হিমি তুমি যা ভাবছ তা না।
হিমি: দু দুবার আমি নিজের চোখে তোমাকে দুটো মেয়ের সাথে দেখেছি এরপরও বলবে যা ভাবছি তা না?
আমি: হ্যাঁ বলবো কারণ…
রাইসা: হিমি আজ আমাদের এংগেজমেন্ট আর কিছুদিন পর বিয়ে, এখন তো আমরা রোমান্স করবো এটাই স্বাভাবিক, তুমি কেন আমাদের রোমান্সে বাধা দিচ্ছ আমিতো সেটাই বুঝতে পারছি না।
হিমি: এগুলো রোমান্স? নোংরা মেয়ে কোথাকার। আরশান ভালো থেকো তোমার এতো গুলো গার্লফ্রেন্ড এর মাঝখানে আমি আসতে চাই না, সকাল হলেই আমি তোমার থেকে দূরে চলে যাবো।
আমি: হিমি শুনো… (হিমি চলে যাচ্ছিল তাড়াতাড়ি ওর হাত ধরে ফেললাম, এখন রেগে থাকা বোকামি হবে)
আমি: আমাদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে তাই বলে ছেড়ে চলে যাবে?
রাইসা: যে যেতে চায় তাকে যেতে দাও আরশান। হিমি যদি তোমাকে সত্যি ভালবাসতো তাহলে তোমাকে ক্ষমা করে দিতো। আমাকে দেখো, আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি আর তাইতো অধরার সাথে তোমার কি হয়েছে না হয়েছে সেগুলো নিয়ে একদম মাথা ঘামাই না।
আমি: রাইসা একদম চুপ আর একটা কথাও বলবা না। হিমি প্লিজ এমন করো না, তুমি চোখে যা দেখেছ তা সম্পূর্ণ ভুল।
হিমি: কোনটা ভুল অধরা তোমার বুকে শুয়ে ছিল এইটা? নাকি রাইসা তোমার গলা জড়িয়ে ধরে… ছিঃ! (হিমি কাঁদছে এবার কি করবো? বারবার আমার সাথেই এমন হচ্ছে কেন? সময় কি কোনো কিছুর প্রতিশোধ নিচ্ছে আমার থেকে?)
হিমি: আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি আর তাই তোমাকে হারানোর ভয় আমাকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়, এই ভয় থেকেই আমি পাগলামি করতাম। আর তুমি কিনা দু দুটো মেয়ের সাথে…
আমি: তুমি যা ভাবছ তা নয়। আচ্ছা তুমি আমাকে হারিয়ে ফেলবে এই ভয় পাও তো? একটু দাঁড়াও তোমার ভয় দূর করে দিচ্ছি। (হিমিকে ছেড়ে রাইসার সামনে এসে দাঁড়ালাম)
আমি: আংটিটা দাও।
রাইসা: কেন?
আমি: আমার বাবা যেহেতু আংটিটা এনেছেন আমিতো নিতেই পারি প্রশ্ন করছ কেন?
রাইসা: কিন্তু এই আংটি মামা আমার জন্য এনেছেন।
আমি: উঁহু এই আংটি তার হাতেই মানাবে যে আমার বউ হবে। (রাইসার হাত থেকে আংটি নিয়ে এসে হিমির আঙ্গুলে পড়িয়ে দিলাম, হিমি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: ভয় দূর হয়েছে? এই আংটি পড়িয়ে তোমাকে আমার করে নিলাম।
হিমি: না ভয় দূর হয়নি, তোমার আব্বু চাইলেই এই আংটি খুলে নিতে পারেন। (এখনো মেয়েটা আমার উপর ভরসা করতে পারছে না? খুব রাগ হচ্ছে ইচ্ছে হচ্ছে…)
আমি: চলো।
হিমি: কোথায়?
আমি: আমি যেখানে নিয়ে যাবো সেখানে।
হিমির হাত ধরে টেনে নিয়ে আসলাম।

শান্তকে একটা মেসেজ করে বাইক স্টার্ট দিলাম।
আমি: উঠে বসো।
হিমি: কিন্তু আমরা কোথায় যাবো?
আমি: যেখানে গেলে তুমি আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারবে।
হিমি: মানে?
আমি: উঠে বসো, আব্বুর চোখে পড়লে ঝামেলা হয়ে যাবে। (হিমি চুপচাপ উঠে বসে আমার কাধে হাত রাখলো)
হিমি: এবার বলো আমরা কোথায় যাচ্ছি।
হিমির কথার জবাব না দিয়ে কাজি অফিসের দিকে এগিয়ে গেলাম।

রাত নয়টা, কাজি অফিসের সামনে এসে বাইক থামালাম। শান্ত, আরিয়ান আর সিফাত সবাইকে দেখে হিমি কিছুটা অবাক হলো, হিমি আরো একটু অবাক হলো যখন দেখলো এইটা কাজি অফিস।
হিমি: আরশান আমরা এখানে এসেছি কেন?
আমি: বিয়ে করবো তাই।
হিমি: মানে?
আমি: তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না আমার উপর তুমি ভরসা করতে পার না, তোমার বিশ্বাস অর্জন করতে গেলে বিয়েটা করতে হবে এছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার কাছে।
হিমি: পাগল হয়ে গেছ? কি বলছ তুমি বুঝতে পারছ?
শান্ত: ভুল কি বলেছে ও? সেই প্রথম থেকে আরশান তোমাকে পাগলের মতো ভালোবেসে এসেছে আর তুমি ওকে বারবার কষ্ট দিয়ে এসেছ। আজ আরশানের খুব খারাপ সময় যাচ্ছে আর তুমি এই সময়টাতেও ওর পাশে নেই? পাশে থাকবে কি তুমি তো উল্টো ওকে যন্ত্রণা দিচ্ছ, তিলেতিলে শেষ করে দিচ্ছ ওকে।
সিফাত: ভালোবাসা মানে ভুল বুঝাবুঝি রাগারাগি করে দূরে সরে যাওয়া নয় হিমি, ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষের পাশে সবসময় থাকতে হয় সেটা সুখে হউক কিংবা দুঃখে।
আরিয়ান: তুমি তো আরশানকে বিশ্বাসই কর না, তবুও যে আরশান তোমাকে এখনো ভালোবাসে সেটাই তোমার সৌভাগ্য। আমি হলে এমন মেয়েকে দুটো থাপ্পড় দিয়ে দূরে সরিয়ে দিতাম যে কিনা আমার কথা বিশ্বাস করেনা সে…
আমি: আরিয়ান প্লিজ চুপ কর। আমি এখানে বিয়ে করতে এসেছি আর সেটা খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে কারণ আব্বু যেকোনো সময়…
হিমি: আমি বিয়ে করবো না আরশান। (হিমির কথা শুনে সবাই বেশ অবাক হয়েই ওর দিকে তাকালাম)
শান্ত: কেন তুমি ওকে ভালোবাস না?
হিমি: হ্যাঁ বাসি। কিন্তু তাই বলে এভাবে বিয়ে করবো? আমার পরিবার ওর পরিবার সবাই তো কষ্ট পাবে।
আমি: এভাবে বিয়ে করতে তুমি আমাকে বাধ্য করেছ হিমি। তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস করে আমাকে সবকিছু প্রমাণ করার সুযোগ দিতে তাহলে আমাকে এতো রাতে কাজি অফিসে এসে বিয়ে করতে হতো না।
হিমি: আমি এভাবে বিয়ে করবো না, আমি বাসায় যাবো।
সিফাত: ধ্যাত এই মেয়ে তো তোকে ভালোই বাসে না। একবার তোর জন্য সুইসাইড করতে যাচ্ছে তো আবার বিয়ে করবে না বলে নাটক করছে। আসলে কি আরশান বেশি ভালোবাসলে এভাবেই মাথায় ছড়ে বসে।
আমি: প্লিজ চুপ করবি তোরা?
সিফাত: করলাম চুপ। কিন্তু তোদের পাঁচ মিনিট সময় দিলাম ভেবে সিদ্ধান্ত নে কি করবি তোরা। অনেক রাত হয়েছে একটু পর কাজি অফিস বন্ধ হয়ে যাবে। আর হিমি আমাদের ভুল বুঝনা, তোমাদের ভালোর জন্য আমরা এমন রাগ দেখাচ্ছি। প্রাণের ভয় আমাদেরও আছে, আরশানের বাবা আমাদের ছেড়ে দিবে না জানি তবুও এখানে এসেছি শুধুমাত্র তোমাদের ভালোবাসার কথা ভেবে। এবার তোমরা সিদ্ধান্ত নাও কি করবে। (ওরা সবাই একটু দূরে চলে গেলো। হিমির উপর খুব রাগ হচ্ছে বিশ্বাস করবে না আবার বিশ্বাস করাতে গেলেও বাঁধা। আমিতো বুঝতেই পারছি না এই মেয়ে আসলে চায়টা কি?)
আমি: তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিলাম ভেবে সিদ্ধান্ত নাও কি করবে। মনে রেখো তোমার এই সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে আমরা সারাজীবন একসাথে থাকবো কিনা। আমাদের এই সম্পর্ক এতো সহজে কেউ মেনে নিবে না, একবার বিয়ে হয়ে গেলে ঠিকই মেনে নিবে। তুমি রাজি হলে আজ বিয়ে হবে আর রাজি নাহলে আজ বাসায় ফিরে রাইসার সাথে আমার বিয়ে হবে, এখন তোমার ইচ্ছা।
হিমি আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, চুপচাপ দূরে চলে আসলাম। জানি হিমির খুব কষ্ট হচ্ছে, এমন বিয়ে কে চায়? কিন্তু আমিই বা কি করবো? একের পর এক যা হচ্ছে হিমিকে হারানোর ভয় হচ্ছে খুব, তাছাড়া আব্বুকে বিশ্বাস নেই তাই বিয়েটা এভাবেই করে ফেলা ভালো।

বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আর হিমিকে দেখছি, হিমি রাস্তায় পায়চারী করছে, হয়তো সিদ্ধান্ত নিতে হিমসিম খাচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম হিমি আমার দিকে এগিয়ে আসছে, হিমি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা ভেবে আমার বুক ধড়পড় করছে, হিমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে নাতো?
হিমি: আরশান চলো।
আমি: কোকোথথায়?
হিমি: বিয়ে করতে, তোতলাচ্ছ কেন?
আমি: সত্যি?
হিমি: হুম। (দুচোখ বন্ধ করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম)
হিমি: কিন্তু একটা শর্ত আছে, বাসায় কাউকে এখন কিছু জানাতে পারবে না।
আমি: ঠিক আছে।

আমি সিগনেচার করে হিমির দিকে খাতা এগিয়ে দিলাম, হিমি কলম হাতে নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে, ওর দুচোখ দিয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ে খাতা ভিজে যাচ্ছে। হিমির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, হিমির সিগনেচার করতে হাত কাঁপছে, আচ্ছা আমি কোনো ভুল করছি নাতো?
শান্ত: হিমি? (শান্তর ডাকে হিমি আমার দিকে এক নজর তাকালো তারপর দ্রুত সিগনেচার করে দিলো)
সিফাত: শান্তি, বিয়েটা তো হয়ে গেছে এবার তোর আব্বু যা খুশি করুক।
আরিয়ান: আরশান অনেক রাত হয়েছে হিমিকে নিয়ে বাসায় যা। আর বিয়ের কথাটা এখনি বাসায় জানানোর প্রয়োজন নেই।
আমি: হুম।
সবাই হাসি ঠাট্টা করছে, হিমির দিকে তাকালাম চোখের পানি মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলো।

হিমি বাইক এর কাছে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, ওর দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসলাম। হিমির কান্না দেখে নিজেকে খুব বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। আমারই বা কি করার ছিল?
হিমি: বাসায় চলো।
আমি: হিমি? (ডাক দিতেই হিমি আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করলো, কি করবো বুঝতেই পারছি না)
হিমি: খুব কষ্ট হচ্ছে আরশান, এভাবে বিয়ে করবো কখনো ভাবিনি। আম্মু আর ভাইয়ারা যখন জানবে খুব কষ্ট পাবে ওরা।
আমি: এভাবে বিয়ে কে চায়? আমার কিছু করার ছিল না হিমি। আমার উপর ভরসা রাখো আমি সবাইকে বুঝাবো, দেখবে সবাই খুশি মনে আমাদের বিয়েটা মেনে নিবে।
হিমি আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, দুহাতে আলতো করে ওর চোখের পানি মুছে দিলাম। হিমির ওড়না টেনে নিয়ে ওর মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিলাম, এখন একদম বউ বউ লাগছে আমার মায়াবতীকে। আমি হিমিকে মুগ্ধ হয়ে দেখছি দেখে হিমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো, দুহাতে আলতো করে হিমির দুগালে ধরে ওর মুখটা উপরে তুললাম, হিমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে মুচকি হেসে ওর কপালে আমার ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিলাম…

পার্ট: ২৩

হিমি আর আমি দুজন দুজনের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ আমার ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। এখনো হিমির দিকে তাকিয়ে আছি দেখে হিমি মিষ্টি হেসে ফোনের দিকে ইশারা করলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখি আব্বু, এবার কি বলবো?
আমি: হ্যালো।
আব্বু: কোথায় তুমি?
আমি: কেন?
আব্বু: তুমি জানো তোমার বোনের বিয়েটা আটকে আছে শুধুমাত্র তোমার বোকামির জন্য?
আমি: আমি কি করলাম?
আব্বু: হিমি কোথায়? তুমি বাসায় নেই আর হিমিকে পাওয়া যাচ্ছে না, হিমির ভাইয়েরা ভাবছে তুমি হিমিকে কিডন্যাপ করেছ।
আমি: কিডন্যাপ?
আব্বু: হ্যাঁ, আর হিমির ভাইয়েরা বাসায় পুলিশ নিয়ে এসেছে। রুদ্র বলেছে তুমি হিমিকে ফিরিয়ে না দেয়া পর্যন্ত ফারিয়ার বিয়ে ওরা হতে দিবে না।
আমি: সত্যি?
আব্বু: তুমি খুশি হয়েছ? আমার তো ভয় হচ্ছে অসীম ফারিয়াকে বিয়ে করবে কিনা এইটা ভেবে আর তুমি হাসছ?
আমি: হিমির ভাইদের বলে দাও হিমি আমার কাছে আছে। আর হ্যাঁ সাথে এইটাও বলে দিও আমাদের সম্পর্ক মেনে নিলে তবেই আমি হিমিকে ফিরিয়ে দিবো। (ফোন কেটে দিলাম, খুব শান্তি লাগছে এইটা ভেবে যে আপুর বিয়েটা ভেঙ্গে যাবে)
হিমি: কি হয়েছে এতো খুশি লাগছে কেন তোমাকে?
আমি: আমি তোমাকে কিডন্যাপ করেছি?
হিমি: মানে?
আমি: তোমার ভাই ভেবেছে আমি তোমাকে কিডন্যাপ করেছি আর তাই ওরা বাসায় পুলিশ এনেছে। আমি তোমাকে ফিরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত ওরা আপুর বিয়ে হতে দিবে না।
হিমি: কি বলছ এসব? আপুর বিয়েটা তো ভেঙ্গে যাবে।
আমি: হ্যাঁ আমিতো সেটাই চাই। আমরা অনেক দেরি করে বাসায় ফিরবো, তোমার ভাইয়ারা বিয়ে আটকে রাখবে ততোক্ষণ, আর অসীমের পরিবার ধৈর্য হারা হয়ে বিয়েটা ভেঙ্গে দিবে।
হিমি: বিয়েটা ভেঙ্গে দিবে?
আমি: হ্যাঁ। আপুর ভালোবাসার মানুষ কে সেটা জেনে তার সাথে আপুর বিয়ে দিবো।
হিমি: আপুকে খুব ভালোবাস তাই না?
আমি: হুম অনেক। এবার চলো এই জায়গা থেকে যাই।
হিমি: কিন্তু কোথায় যাবো?
আমি: রাত দশটা বাজে, বাসায় ফিরতে ফিরতে বিয়ে ভেঙ্গে যাবে।
হিমি: ঠিক আছে।

আমি বাইক চালাচ্ছি আর হিমি দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে পিছনে বসে আছে। বাসায় ফিরার পর কি হবে আমি জানিনা তবে এই মুহূর্তে নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে, ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহূর্তটাকে বেঁধে রাখি।
হিমি: আরশান? (হঠাৎ হিমির ডাকে আমার ঘোর কাটলো)
আমি: হুম বলো।
হিমি: কতক্ষণ ধরে ডাকছি শুনছই না।
আমি: বাইক এর পিছনের সিটে যদি বউ এভাবে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে তাহলে কি অন্য কিছু শুনতে মন চায়? আমার তো ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহূর্তটাকে বেঁধে রাখি।
হিমি: এসব সুখকর অনুভূতি চলে যাবে যখন বাসায় ফিরে দেখবে সবাই রেগে আছে।
আমি: থাকুক সবাই রেগে, আমিতো আমার মায়াবতীকে আমার বউ করে নিয়েছি আর কোনো ভয় নেই।
হিমি: তুমি তো আমার উপর রেগে ছিলে তাহলে বিয়েটা করলে কেন?
আমি: রাগ তো ক্ষণিকের জন্য, রাগের জন্য ভালোবাসা ভুলে যাবো? রাগ যতো গভীরই হউক না কেন ভালোবাসার গভীরতার কাছে রাগের গভীরতা কিছুই না। রাগ একদিন দুদিন থাকবে খুব বেশি হলে কয়েক বছর থাকবে কিন্তু একটা সময় রাগ কমে যাবে, তখন চাইলে কি আমি আর তোমাকে ফিরে পাবো? ক্ষণিকের রাগের জন্য ভালোবাসা হারানো বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। সম্পর্কে রাগ অভিমান খুনসুটি হবেই তাই বলে একেবারে ছেড়ে চলে যাবো?
হিমি কিছু না বলে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আমায়, ওর পাগলামি দেখে মুচকি হাসলাম।

ঝড়ের পর প্রকৃতি যেমন থমথমে হয়ে থাকে তেমনি এখন আমাদের বাসাটা থমথমে হয়ে আছে। বাসায় ঢুকতে ভয় হচ্ছে, হিমির হাত শক্ত করে ধরে আস্তে আস্তে বাসায় ঢুকলাম। পুলিশ সহ বাসার সবাই ড্রয়িংরুমে বসা দেখে ভয়ে বুক ধড়পড় করছে আমার।
রোদেলা: ওই তো ভাইয়া আর হিমি। (রোদেলার কথা শুনে সবাই আমাদের দিকে তাকালো, হিমির আম্মু ছুটে আসলো হিমির দিকে)
আন্টি: কোথায় ছিলি? এই ছেলে তোর কোনো ক্ষতি করেনি তো?
রোদেলা: ক্ষতি কেন করবে ভাইয়া কি ওকে কিডন্যাপ করেছিল নাকি? ভাইয়া তো ওকে ভালোবাসে।
চাচ্চু: চুপ কর তুই। আরশান কোথায় ছিলি তুই?
আম্মু: ধমকাচ্ছ কেন? আমি জিজ্ঞেস করছি।
আব্বু: কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই, যে ছেলের জন্য আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে সে ছেলের জায়গা আমার বাসায় নেই, ওকে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলো। (বিয়ে ভেঙ্গে গেছে শুনে আব্বুর দিকে তাকালাম আব্বু রেগে আগুন হয়ে আছেন, চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে আপুকে খুঁজলাম কিন্তু আপু তো এখানে নেই)
আম্মু: আমার ছেলে কোথাও যাবে না। ছেলে পক্ষ বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে সেটা কি আরশানের দোষ? বরং ভালো হয়েছে কারণ ফারিয়ার এই বিয়েতে মত ছিল না।
আব্বু: বিয়ে করতে এসে এমন পরিস্থিতিতে পড়লে কে বিয়ে করতে চাইবে? পুলিশ নিয়ে কি ঝামেলা…
আন্টি: এই ছেলে তোকে কিডন্যাপ করেছিল তাই না?
বড় ভাইয়া: আরশান কি তোর কোনো ক্ষতি করেছে?
আম্মু: তখন থেকে কিসব উল্টাপাল্টা বলেই যাচ্ছেন আমার ছেলে হিমিকে কিডন্যাপ করতে যাবে কেন? ওরা তো দুজন দুজনকে ভালোবাসে।
বড় ভাইয়া: হিমি তুই কি ভয় পাচ্ছিস?
আব্বু: তোমাদের জন্য আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছে আমার মান সম্মান সব শেষ হয়ে গেছে, এখন যদি তোমরা আরশানকে কিডন্যাপার প্রমাণ করতে না পারো তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না। আমি তোমাদের সবাইকে…
আমি: আব্বু প্লিজ থামো, আমি হিমিকে কিডন্যাপ করতে যাবো কেন?
চাঁচি: কিন্তু ওরা তো বলছে তুই কিডন্যাপ করেছিস।
আদিত্য: ভাইয়া হিমিকে কিডন্যাপ করেনি, আমি জানি ওরা দুজন কোথায় ছিল। (হঠাৎ আদিত্যর এমন কথা শুনে হিমি আমি দুজনেই ভয়ে আতকে উঠলাম, কি জানে আদিত্য? বিয়ের কথা নয়তো? যদি সবাইকে বলে দেয়?)
পুলিশ: কি জানো বলো।
হিমি: আমি বলছি। আরশান আমাকে কিডন্যাপ করেনি, আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। আমাদের দুজনের মধ্যে একটু মান অভিমান চলছিল তাই সবকিছু মিটিয়ে নেওয়ার জন্য দুজন ঘুরতে গিয়েছিলাম এছাড়া আর কিছুই না।
বড় ভাইয়া: হিমি?
হিমি: ধমক দিচ্ছ কেন ভাইয়া?
পুলিশ: সরি আমাদের কিছু করার নেই। (পুলিশ চলে গেলো, হিমির ভাইয়েরা রাগে গজগজ করতে করতে উপরে চলে গেল। হিমি আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে ওকে ইশারা করে রুমে চলে যেতে বললাম, হিমি চলে গেলো)
আব্বু: শান্তি পেয়েছিস তো? বিয়েটা ভেঙ্গে গেছে। ফারিয়ার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে, লোকে হাজারটা কথা শুনাচ্ছে, আমার সব সম্মান শেষ হয়ে গেছে।
আব্বু কাঁদছেন দেখে আব্বুর দিকে এগিয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু আম্মু মাথা নেড়ে না করলেন, চুপচাপ রুমের দিকে চলে আসলাম।

ফ্রেশ হয়ে রুমে ঢুকতেই দেখি আপু খাবার নিয়ে বসে আছে, আমাকে দেখে আপু মুচকি হাসলো।
আপু: খেয়ে নে।
আমি: (নিশ্চুপ)
আপু: মন খারাপ? আচ্ছা হিমি আর তুই কোথায় ছিলি?
আমি: একটু বাইরে গিয়েছিলাম।
আপু: আর এর মধ্যে বিয়েটা ভেঙ্গে গেলো।
আমি: খুশি হওনি?
আপু: বুঝতে পারছি না, বিয়েটা ভেঙ্গে গেছে ভেবে খুশি লাগছে কিন্তু আব্বুর মন খারাপ আর লোকের হাজারটা কথা শুনে খারাপ লাগছে।
আমি: সবসময় লোকের কথায় কান দিলে চলে না, মাঝেমাঝে নিজের সুখের জন্য লোকের কথাকে তুচ্ছ করে দেখতে হয়। আর আব্বুর মন খারাপ বলছ? আব্বু যখন তোমার মুখে হাসি দেখবে তখন মন খারাপের মেঘটা সরে যাবে দেখো, বাবারা এমনই হয়।
আপু: খুব বড় হয়ে গেছিস। (আপুর কথা শুনে হিমি আর আমার বিয়ের কথা ভাবলাম, সত্যি বড় হয়ে গেছি তাইতো কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি)
আপু: কিরে কোথায় হারিয়ে গেলি? খেয়ে নে আসছি আমি।
আমি: হুম।

বারান্দার রেলিং ধরে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছি আর ভাবছি যখন সবাই আমাদের বিয়ের কথা জানবে তখন কি হবে? মেনে নিবে তো সবাই? হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে পাশ ফিরে তাকালাম।
আমি: আদিত্য? ঘুমাসনি অনেক রাত হয়েছে তো।
আদিত্য: ঘুম আসছিল না তাই ছাদে বসে ছিলাম। তুমি কেন ঘুমাওনি?
আমি: এমনি।
আদিত্য: টেনশন হচ্ছে? শান্ত ভাইয়া আমাকে ফোন করে সব বলেছে। আর এইটাও বলেছে বাসায় কিছু হলে যেন ওদের জানাই আর সবসময় যেন তোমার পাশে থাকি। ভাইয়া ভাগ্য গুণে এমন বন্ধু গুলো পেয়েছ।
আমি: বিয়ের কথা বলেছে?
আদিত্য: হুম। টেনশন করো না আমরা সবাই আছি তোমাদের পাশে। ভাবি তোমার জন্য ছাদে অপেক্ষা করছে যাও। (আদিত্যর কথা শুনে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম, হিমি এতো রাতে ছাদে?)
আদিত্য: তাড়াতাড়ি যাও নাহলে মেয়েটা ভয় পাবে।
আমি: হুম।

দৌড়ে ছাদে আসলাম। হিমি দাঁড়িয়ে আছে, মৃদু বাতাসে হিমির খোলা চুল আর ওড়না উড়ছে। হিমির পাশে এসে দাঁড়ালাম।
হিমি: আরশান? (হিমি আমার দিকে না তাকিয়েই আমাকে ডাকলো)
আমি: কিছু বলবে? এতো রাত হয়েছে কিন্তু ঘুমাওনি যে?
হিমি: ভাইয়া বলেছে আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিবে পড়াশুনার জন্য। (হিমির কথা শুনে বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো, ওর দিকে তাকিয়ে আছি শান্ত চোখে)
হিমি: খুব ভয় হচ্ছে।
আমি: আমার মনে হয় বিয়ের কথাটা সবাইকে জানিয়ে দেওয়া উ…
হিমি: না। (হিমি চিৎকার করে উঠলো, বেশ অবাক হয়েই ওর দিকে তাকিয়ে আছি)
হিমি: বিয়ের কথা বলা যাবে না, ভাইয়ারা সহ্য করতে পারবে না।
আমি: তাহলে এখন কি করবো?
হিমি: আবারো একই কষ্ট পেলে আমার ভাইয়ারা মারা যাবে, সহ্য করতে পারবে না। (হিমি বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে বসে পড়লো, হিমির পাশে বসে ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম। হিমি কাঁদছে, হিমির কথাগুলোর মানে কি? তবে কি ও কিছু লুকাচ্ছে আমার থেকে?)
হিমি: আরশান আমি তোমাকে ছেড়ে দূরে যেতে পারবো না, থাকতে পারবো না তোমাকে ছেড়ে।
আমি: দূরে যেতে হবে না, কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় হয়ে যাবে দেখো।
হিমি: (নিশ্চুপ)

হিমি আমার কাধে মাথা রেখে নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে, এবার পাগলীটার কান্না থামানো প্রয়োজন নাহলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
আমি: হিমি আমাদের বিয়েটা কবে হয়েছে?
হিমি: কবে আবার আজ সন্ধ্যায়।
আমি: হুম। হিসেব মতে তো আজ আমাদের বাসররাত তাই না? (হিমি আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো)
আমি: বাসর রাত, রাতের নিস্তব্ধতায় দুজন ছাদে বসে আছি, চাঁদের আলো, হীম শীতল বাতাস, সব মিলিয়ে রোমান্টিক একটা ওয়েদার। কোথায় একটু রোমান্স হবে তা না তুমি কেঁদে কেঁদে আমার শার্ট ভিজিয়ে যাচ্ছ।
হিমি: এই অবস্থায় তোমার রোমান্স করতে ইচ্ছে হচ্ছে? তোমাকে তো… (হিমি রাগি চোখে আমার দিকে এগিয়ে এসেছিল ওর কোমড় জড়িয়ে ধরতেই শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, আলতো হাতে ওর দুচোখের পানি মুছে দিলাম)
আমি: বিয়ে নামক বন্ধনটার অনেক শক্তি, ভয় পেয়ো না আল্লাহ্‌ ছাড়া আমাদের আর কেউ আলাদা করতে পারবে না।
হিমি: খুব ভালোবাস তাই না?
আমি: ভালোবাসি বলেই তো বিয়ে করেছি। আর কেঁদো না, আমার মায়াবতীর চোখে কান্না মানায় না, মায়াবতীর ঠোঁটের কোণে সবসময় হাসি মানায়।
হিমি: তাই?
হিমির কথার জবাব না দিয়ে আলতো করে ওর দুগালে ধরলাম, হিমি আমার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। মুচকি হেসে হিমির দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসলাম। হিমির ঠোঁটের কাছে আমার ঠোঁট নিতেই ও দুচোখ বন্ধ করে ফেললো। আলতো করে হিমির ঠোঁটে আমার ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম, হিমি লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো, ধাক্কা দিয়ে আমাকে সরিয়ে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো, পাগলী একটা।

আম্মু: আরশান কি হলো উঠ বলছি।
আমি: আম্মু কি হয়েছে এতো সকালে ডাকছ কেন?
আম্মু: আগে উঠ তারপর বলছি।
আমি: উঁহু।
আম্মু: আরশান হিমিকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। (আমি কি স্বপ্ন দেখছি? লাফ দিয়ে উঠে বসলাম, আম্মু আমার পাশে বসা তারমানে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখিনি)
আম্মু: তুই জানিস হিমি কোথায়?
আমি: সাতসকালে এসব কি বলছ?
আম্মু: সত্যি হিমিকে সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ওর ভাইরা তো ভাবছে তুই…
আমি: আম্মু তোমাদের কোথাও ভুল হচ্ছে হিমি কোথায় যাবে? হিমির সাথে তো রাতেও আমার কথা হয়েছে আমরা দুজন একসাথে ছাদে ছিলাম।
আম্মু: বুঝতে পারছি না কিছু, হিমির আম্মু তো কাঁদতে কাঁদতে শেষ। (আম্মুর কথা শুনে বোবার মতো বসে রইলাম, কি বলছে আম্মু এসব? রাতে তো হিমি আমার কাছে ছিল, তখন লজ্জা পেয়ে দৌড়ে হিমি রুমের দিকে গিয়েছিল। এতো সকালে হিমি কোথায় যেতে পারে? আচ্ছা সজিব…)
বড় ভাইয়া: আরশান? (হঠাৎ ভাইয়ার ডাকে আমার ঘোর কাটলো, ভাইয়া এসে আমার পাশে বসলেন)
বড় ভাইয়া: হিমি কোথায় জানো? প্লিজ বলো। কথা দিচ্ছি আমি তোমাদের আলাদা করবো না।
আমি: (নিশ্চুপ)
বড় ভাইয়া: আরশান তুমি কাঁদছ? তারমানে কি…
আমি: হিমি কোথায় আমি জানিনা ভাইয়া। হিমির সাথে আমার রাতে লাস্ট কথা হয়েছিল। (ভাইয়া চুপচাপ চলে গেলেন। আম্মু এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন)
আম্মু: কাঁদছিস কেন? হিমিকে পাওয়া যাবে কান্না করিস না।
আমি: সজিব কিছু করেনি তো?
তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।

কি করবো বুঝতে না পেরে শান্তকে ফোন দিলাম।
শান্ত: আরশান বল।
আমি: হিমি তোদের বাসায়?
শান্ত: নাতো, আসলে তো তারিনের সাথে দেখতাম। কি হয়েছে?
আমি: হিমিকে পাওয়া যাচ্ছে না। শান্ত আমার ভয় হচ্ছে সজিব কিছু করেনি তো? হিমির কিছু হলে আমি…
শান্ত: কিছু হবে না, হয়তো কোথাও গিয়েছে।
আমি: কি করবো এখন?
শান্ত: টেনশন করিস না তুই আমরা তোদের বাসায় আসছি।
আমি: ঠিক আছে।

হিমি কোথায় যেতে পারে? কোথাও গেলে তো আমাকে অন্তত জানিয়ে যেতো। নাকি আমার ভয়টাই সত্যি হবে? সজিব কি আবারো হিমিকে…
আব্বু: ভালো হচ্ছে না কিন্তু। (আনমনা হয়ে এসব ভাবছিলাম হঠাৎ আব্বুর কন্ঠ শুনে চমকে উঠলাম, আব্বু ড্রয়িংরুমে বসে ফোনে কথা বলছেন আর কাকে যেন ধমকাচ্ছেন)
আব্বু: কতবার বলবো তোমার বোনের ব্যাপারে আমি কিছু জানিনা? আমার মেয়ে… (আব্বু থেমে গেলেন, ফোনের অপর পাশ থেকে কে কি বলছে শুনতে পাচ্ছি না তবে আব্বুর চোখেমুখে ভয়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছি)
আব্বু: রুদ্র ফারিয়াকে ফিরিয়ে দাও বলছি, আমি তোমার বোনের খুঁজ জানিনা। কেন কিডন্যাপ করেছ আমার মেয়েকে আমি কিন্তু…
অপর পাশ থেকে ফোন কেটে দিলো, আব্বু চুপচাপ বসে আছেন, আব্বুর চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছি। আব্বুর কথা শুনে তো মনে হলো হিমির ছোট ভাইয়া আপুকে কিডন্যাপ করেছে। কিন্তু কেন? আচ্ছা এমন নয়তো আব্বু সজিবের সাথে হাত মিলিয়ে হিমির কোনো ক্ষতি করেছেন আর ছোট ভাইয়া সেটা বুঝতে পেরে আপুকে কিডন্যাপ করেছে? বুকটা কেঁপে উঠলো সজিব যদি হিমির কোনো ক্ষতি করে ফেলে এইটা ভেবে। হিমি আর আপুকে ফিরে পেতে হলে আব্বুর মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন, চুপচাপ আব্বুর দিকে এগিয়ে গেলাম…

আমি আব্বুর সামনে এসে দাঁড়ালাম, আব্বু আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। আব্বুর কপালে ছোট ছোট ঘামের ফোটা জম্মেছে, আব্বুর চোখ বলে দিচ্ছে উনি যে কোনো অপরাধ করেছেন।
আব্বু: কি?
আমি: আপু কোথায়?
আব্বু: হিমির ছোট ভাই ফারিয়াকে কিডন্যাপ করেছে।
আমি: কেন?
আব্বু: কেন আবার নিশ্চয় টাকা চাইবে।
আমি: তাই? আচ্ছা হিমি কোথায়? (আমার এই প্রশ্ন শুনে আব্বু বেশ ভয় পেয়ে গেলেন)
আব্বু: সেটা আমি কি করে জানবো?
আমি: আমার তো মনে হয় তুমি হিমির খুঁজ জানো আর রুদ্র ভাইয়া সেটা বুঝতে পেরে তোমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আপুকে কিডন্যাপ করেছে।
আব্বু: আরশান? এসব কি বলছিস তু…
আমি: চিৎকার করো না, ওদের বোন তাই ওরা কি করবে সেটা ওদের ব্যাপার কিন্তু আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো না। আমার বোন বা আমার ভালোবাসা কারো যদি কোনো ক্ষতি হয়েছে তাহলে কিন্তু ভুলে যাবো তুমি আমার বাবা।
আব্বু: আরশান তুই ভুল বুঝছিস আমি হিমির খুঁজ জানিনা। হিমিকে ওর ভাইয়ারা খুঁজে নিবে তার আগে তুই ফারিয়াকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়, তুই বললে রুদ্র ফারিয়াকে ছেড়ে দিবে।
আমি: ফিরিয়ে তো আনবো দুজনকেই তবে যদি জানতে পারি এসবে তোমার হাত… (আমার ফোন বেজে উঠলো, অচেনা নাম্বার দেখে আব্বুর সামনে থেকে চলে আসলাম)

রুমে এসে ফোন রিসিভ করলাম।
আমি: হ্যালো।
ভাইয়া: আমি বলছি।
আমি: রুদ্র ভাইয়া? আপু কোথায়?
ভাইয়া: তোমার আপুর কোনো ক্ষতি করবো না আমি, তোমার আব্বুকে বুঝানোর জন্য এই কাজ করেছি। হিমির খুঁজ তোমার আব্বু জানে যাও জিজ্ঞেস করো হিমি কোথায়।
আমি: কিন্তু ভাইয়া…
ভাইয়া: বললাম তো তোমার আপুর কোনো ক্ষতি করবো না।
ভাইয়া ফোন কেটে দিলো, ইচ্ছে হচ্ছে আব্বুকে শাস্তি দেই কিন্তু বাবা হন তো তাই পারবো না। আব্বু খুব ভালো করেই জানেন হিমি কোথায় তাইতো ভাইয়া আপুকে কিডন্যাপ করেছে। কিন্তু এখন আমি কি করবো? আব্বু অপরাধ করে থাকলেও তো স্বীকার করবেন না।

আদিত্য: ভাইয়া? (মাথায় হাত রেখে চুপচাপ বসে ছিলাম হঠাৎ আদিত্যর ডাকে সামনে তাকালাম)
আমি: কিছু বলবি?
আদিত্য: হুম কিছু বলার ছিল কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বলা উচিত হবে না। হিমি বা আপুর কোনো খুঁজ পেয়েছ?
আমি: আপু তো রুদ্র ভাইয়ার কাছে আছে কিন্তু হিমি কোথায় আছে কিছুই জানিনা, বড্ড ভয় হচ্ছে।
শান্ত: হয়তো সজিবের কাছে আছে হিমি। (হঠাৎ শান্তর মুখে এমন কথা শুনে দরজায় তাকালাম, সবাই এসে আমার পাশে বসলো)
সিফাত: এতো ভেঙ্গে পড়ছিস কেন? হিমিকে আমরা ঠিক খুঁজে পাবো দেখিস।
আমি: হিমির ভাইয়েরা তো কম চেষ্টা করছে না কিন্তু এখনো তো কোনো খবর পায়নি।
শান্ত: আমার মনে হয় সজিব জানে হিমি কোথায়।
আমি: সাথে আব্বুও জানেন।
আরিয়ান: মানে?
আদিত্য: ভাইয়া এসব কি বলছ?
আমি: আব্বু নিজের স্বার্থে সব করতে পারেন।
আদিত্য: আমার মনে হয় একবার সজিবের বাসায় যাওয়া প্রয়োজন, হয়তো সজিবের কাছে হিমিকে পেয়ে যাবো।
আমি: এতো দূরে যাওয়ার কি প্রয়োজন? আব্বুকে বল সত্যিটা বলে দিতে তাহলেই তো আমি আমার হিমিকে পেয়ে যাবো।
শান্ত: আরে কাঁদছিস কেন?
আমি: কাঁদবো নাতো কি করবো? সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো, এতো সময় ধরে হিমি কোথায় আছে কেমন আছে আমি কিচ্ছু জানিনা। দুবছর আগের সেই চারদিন এর কথা হিমি আজো ভুলতে পারেনি, এখনো মেয়েটা ভয়ে আঁতকে উঠে ঐসব মনে পড়লে। আজ আবার নতুন করে…
আরিয়ান: কিচ্ছু হবে না ভয় পাস না, তোর আব্বুর কাছে যা।
আমি: কোনো লাভ হবে না।
শান্ত: তাহলে কি করবি?
সিফাত: সজিবের বাসায় যাবি?
আদিত্য: তাতেও লাভ হবে না কারণ সজিব তো আর অপরাধ করে বাসায় বসে থাকবে না।
আমি: আব্বু হিমিকে লুকিয়ে রেখেছে আমি নিশ্চিত, আব্বু নিজে থেকে না বললে আমাদের কিছু করার নেই। প্লিজ তোরা যা আমাকে একটু একা থাকতে দে।
সবাই চুপচাপ বেরিয়ে গেলো, আমি পাথরের মূর্তির মতো বসে আছি। বারবার একটা কথাই মনে আসছে হিমি কেমন আছে? কোথায় রেখেছে ওকে? আমার হিমি বোধহয় খুব ভয় পাচ্ছে।

ড্রয়িংরুমে পায়চারী করছি আর আব্বুর জন্য অপেক্ষা করছি। সেই দুপুর থেকে আব্বু বাসায় নেই, সন্ধ্যা নেমে আসছে কিন্তু আব্বু আসার খুঁজ নেই। আব্বু ছাড়া হিমির খুঁজ কেউ দিতে পারবে না আমি নিশ্চিত। সজিবের বাসায় তো শান্তরা গিয়েছিল কিন্তু সজিব বাসায় নেই। আমার ভাবনা ভুল নাহলে সজিব আব্বুর কথায় হিমিকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। সারাটা দিন কেটে গেলো অথচ হিমির কোনো খুঁজ পেলাম না, ওদিকে আপু কেমন আছে কে জানে।
আম্মু: কিরে এভাবে অস্থির হয়ে আছিস কেন? (হঠাৎ আম্মু এসে সামনে দাঁড়ালেন। আচ্ছা আপুর জন্য কি আম্মুর টেনশন হচ্ছে না?)
আমি: আম্মু আপুকে তো পাওয়া যাচ্ছে না তোমার টেনশন হচ্ছে না?
আম্মু: ফারিয়া যেখানে আছে যার কাছে আছে খুব নিরাপদেই আছে।
আমি: মানে?
আম্মু: আমি ভাবছি হিমির কথা, জানিনা মেয়েটা কোথায় আছে।
রাইসা: আমি জানি। (হঠাৎ রাইসার কথা শুনে আম্মু আমি দুজনেই চমকে উঠলাম)
আমি: আবার এসেছ আমাকে জ্বালাতে? রাইসা আমার মন ভালো নে…
রাইসা: আমি তোমাকে জ্বালাতে আসিনি আরশান, আমি জানি হিমি কোথায়?
আম্মু: কিভাবে জানো? কোথায় হিমি?
আমি: বলো কোথায়?
রাইসা: কোথায় আছে সেটা বলতে পারবো না তবে কার কাছে আছে সেটা বলতে পারবো।
আমি: কার কাছে?
রাইসা: সজিব নামের কারো কাছে আর সেটা মামার কথায়।
আমি: আব্বুর?
রাইসা: হ্যাঁ, মামা সকালে সজিব নামের কারো সাথে ফোনে কথা বলছিলেন হিমিকে কিডন্যাপ করার ব্যাপারে আর আমি সেটা শুনে ফেলেছি। আমি সাথে সাথে ফারিয়া আপুকে জানিয়েছিলাম কিন্তু তার কিছুক্ষণ পর থেকে আপুকেও তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তোমাদের বাসায় যে কি হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে আরশান আমি একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি যে তুমি হিমিকে সত্যি ভালোবাস। হিমিকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে তুমি সারাটাদিন ধরে যে ছটফট করছ তা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় তুমি হিমিকে আর হিমি তোমাকে দুজন দুজনকে সত্যি খুব ভালোবাস। আমি তোমাদের ভালোবাসাটা বুঝতে পেরেছি তাই আর তোমাদের মাঝে বাধা হয়ে থাকতে চাই না, যা হয়েছে তার জন্য সরি, পারলে আমাকে ক্ষমা করো আরশান।
আমি: তুমি যে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছ তাতেই আমি খুশি।
আম্মু: কিন্তু আরশান হিমি… (হঠাৎ আমার ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো, রুদ্র ভাইয়ার নাম্বার দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করলাম)
আমি: হ্যালো।
আপু: আরশান?
আমি: আপু কোথায় আছ তুমি? আর…
আপু: একটা ঠিকানা দিচ্ছি এই ঠিকানায় চলে আয়, শান্তদের নিয়ে আসিস।
আমি: আপু শুনো…
আপু তো ফোন কেটে দিলো। কিন্তু কিসের ঠিকানা বললো কার কাছে যেতে হবে আমাকে? ফোনের মেসেজটোন বেজে উঠলো, আপু একটা ঠিকানা মেসেজ করেছে। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে শান্তকে একটা মেসেজ করে বেরিয়ে পড়লাম।

আপুর দেওয়া ঠিকানায় আসতে আমাদের অনেক রাত হয়ে গেলো, কলিংবেল চাপতেই একজন মহিলা এসে দরজা খুলে দিলেন। বোকার মতো উনার দিকে তাকিয়ে আছি, উনি মুচকি হেসে ভিতরে যেতে বললেন। ড্রয়িংরুমে এসে হিমি আর আপুকে দেখে চমকে উঠলাম, হিমি আমার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। দৌড়ে গিয়ে হিমিকে বুকের সাথে ঝাপটে ধরে কেঁদে ফেললাম।
হিমি: আরশান কি করছ সবাই আছে এখানে।
আমি: তুমি তো ভালো আছ তাহলে আমাকে ফোন করনি কেন? জানো সারাটাদিন আমি কিভাবে কাটিয়েছি কত কষ্ট…
“এইযে হিমির বড় ভাই আছে এখানে” (কথাটা শুনে আচমকা হিমিকে ছেড়ে দিলাম, সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। কিন্তু এই লোক কে?)
আপু: আরশান শান্ত হ হিমি ভালো আছে। (আপুর কথা শুনে আপুর দিকে তাকালাম আপু বিয়ের সাজে সেজে আছে, হিমির দিকে তাকালাম হিমিও বউ সেজে আছে। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে আপুর দিকে তাকালাম)
আপু: শান্ত হ সব বলছি।
হিমি: আরশান আমার আপু রিমি আর দুলাভাই। (অবাক হয়ে তাকালাম উনাদের দিকে)
আমি: আগে তো কখনো বলনি।
হিমি: পরে বলবো।
শান্ত: আপু তোমরা বিয়ের সাজে?
দুলাভাই: কারণ এখন এখানে দুটো বিয়ে হবে।
হিমি: আমি আরশানের সাথে আলাদা কথা বলে আসছি।
হিমি আমার হাত ধরে টেনে অন্য একটা রুমে নিয়ে আসলো।

হিমি: কি হচ্ছে কিছু বুঝে উঠতে পারছ না তাই তো? (হিমির কথার উত্তর না দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম)
হিমি: আরশান আমি জানি সারাদিন তোমার কতটা কষ্ট হয়েছে, এখন তো আমি তোমার কাছে আছি এখনো কান্না করবে?
আমি: (নিশ্চুপ)
হিমি: জানতে চাইবে না আমি কোথায় ছিলাম? আপুর কথা তোমাকে আগে কেন বলিনি? আর এখনই বা বউয়ের সাজে সেজে আছি কেন? (হিমিকে ছেড়ে দিয়ে ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম)
হিমি: পাঁচ বছর আগে আপু পালিয়ে এসেছিল দুলাভাই এর সাথে। ভাইয়াদের বললে হয়তো উনারা মেনে নিতো কিন্তু আপু বা দুলাভাই কেউ বলেনি। আর তাই আম্মু বলেছে আপু সবার কাছে মৃত। ভাইয়া বা আম্মুর সামনে আপুর কথা বলা বারণ ছিল। আপুর কথা মনে পড়লে কষ্ট হতো খুব তাই তোমাকে কখনো বলিনি আপুর কথা। আর এজন্যই বিয়ের কথাটা বলতে বারণ করেছিলাম কারণ আপুর মতো আমিও এমন করেছি শুনলে সবাই খুব কষ্ট পাবে।
আমি: কিন্তু তুমি এখানে কেন?
হিমি: তোমার আব্বুর জন্য।
আমি: মানে?
হিমি: আমিতো উনার মেয়ের মতো তবুও উনি আমার সাথে এতো খারাপ কিছু করতে পেরেছেন ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে। রাতে তোমার কাছ থেকে দৌড়ে আসার সময় উনি আমাকে দেখে ফেলেন আর ভোরবেলা উনার সাথে দেখা করার জন্য বলেন। আমার তো আব্বু নেই, তোমার সাথে বিয়ে হয়ে গেছে মানে উনিই আমার আব্বু। আমি বিশ্বাস নিয়ে উনার সাথে ভোরবেলা দেখা করি বাগানে, তখনো সবাই ঘুমে। তোমার আব্বু প্রথমে বুঝান তোমার থেকে যেন দূরে চলে যাই তারপর খুব অপমান করেন। আমি বাধ্য হয়ে আমাদের বিয়ের কথাটা আব্বুকে বলে দেই কারণ আমি ভেবেছিলাম বিয়ে হয়ে গেছে শুনলে উনি আর রেগে থাকবেন না। কিন্তু উনি আমার ভাবনা গুলোকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আমি কিছু বুঝার আগেই সজিবের হাতে আমাকে তুলে দেন।
আমি: কি?
হিমি: হুম। সজিব আমাকে ওর চাচার বাসায় নিয়ে আসে তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। যখন আমার জ্ঞান ফিরে তখন আমি আপুর কাছে শুয়ে ছিলাম।
রিমি আপু: আমাদের পাশের বাসাটাই সজিবের চাচার। সজিবের চাঁচি হিমিকে ছিনতেন আমার আর হিমির ছবি দেখেছিলেন, চাঁচি এসে আমাকে জানান তারপর আমরা পুলিশ নিয়ে গিয়ে হিমিকে নিয়ে আসি, সজিব এখন থানায় আছে। হিমি সেন্সলেস ছিল তাই মাথায় কাজ করছিল না, রুদ্রকে ফোন করে এখানে আসতে বলি, রুদ্র ফারিয়াকে নিয়ে আসে তারপর তোমাকে ফোন করে আসতে বলে। (রিমি আপুর মুখ থেকে কথাগুলো শুনে দফ করে বিছানায় বসে পড়লাম, আব্বু এসব করতে পারলো?)
রিমি আপু: আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার আর হিমির, রুদ্র আর ফারিয়ার বিয়ে আজই দিবো।
আমি: ছোট ভাইয়া আর আপুর?
হিমি: হ্যাঁ আরশান, তুমি বলেছিলে না আপু কাউকে ভালোবাসে? ছোট ভাইয়া আর আপু দুজন দুজনকে ভালোবাসে।
আমি: আর আমি একবারের জন্যও বুঝতে পারিনি।
আপু: আমি বুঝতে দেইনি তাই তুই বুঝতে পারিসনি। (আপু এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পাশে বসলো)
আপু: হিমিরা যখন আমাদের বাসায় প্রথম আসে তখন আমি জানতাম না রুদ্র হিমির ভাই। আব্বু আমাকে জানান আর শর্ত দেন আমি যদি আব্বুর পছন্দে বিয়ে করি তাহলে আব্বু তোর আর হিমির সম্পর্ক মেনে নিবেন। তোর আর হিমির কথা ভেবে আমি রুদ্রকে সব বলি সাথে এইটাও বলি আমাকে যেন ভুলে যায় আর তারপরই আব্বুর পছন্দে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু শেষে আব্বু বেঈমানি করলেন। আজ যখন জানতে পারলাম আব্বু হিমিকে কিডন্যাপ করিয়েছেন তখন রুদ্রর সাথে আমি চলে আসি আর রুদ্র আব্বুকে ফোন করে বলে আমাকে কিডন্যাপ করেছে। আমরা ভেবেছিলাম আব্বু ভয় পেয়ে হিমিকে ফিরিয়ে দিবেন কিন্তু আব্বু কিছু করার আগেই দুলাভাই আর আপু হিমিকে পেয়ে যান।
দুলাভাই: বাকি কথা পরে হবে অনেক রাত হয়েছে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে হবে।
রিমি আপু: আরশান হিমিকে নিয়ে এসো, ফারিয়া চলো। (দুলাভাই এর ডাকে ওরা চলে যাচ্ছিল আমি আপুকে পিছু ডাকলাম)
আপু: কিছু বলবি?
আমি: বাসায় না জানিয়ে বিয়ে করবো? অন্তত আম্মুকে তো…
আপু: আম্মু সব জানেন আর আম্মুই অনুমতি দিয়েছেন আমরা যেন আজ রাতেই বিয়ে করি আর সকালে বাসায় ফিরে যাই। (আপু মুচকি হেসে চলে গেলো। কি করবো এবার? আবার বিয়ে করবো? কিন্তু এইটা কিভাবে সম্ভব?)
হিমি: আরশান সবাই যেহেতু মেনে নিয়েছে তাহলে নাহয় আবার আমাদের বিয়েটা হউক, তুমি প্লিজ কাউকে কিছু বলো না।
আমি: বিয়েটা কোনো খেলা নয় হিমি যে বারবার একই খেলা খেলবো, আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে তো তাহলে আমরা আবার কেন বিয়ে করতে যাবো?
হিমি: ভাইয়া শুনলে কষ্ট পাবে।
আমি: যা হবার হবে আমি দ্বিতীয় বার বিয়ে করতে পারবো না। আমার কাছে বিয়ে শব্দটার অনেক মূল্য, বারবার বিয়ে বিয়ে খেলা করে বিয়ে নামক সম্পর্কটাকে অপমান করতে পারবো না।
হিমিকে রেখেই ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।

আপু আর রুদ্র ভাইয়া পাশাপাশি বসে আছে, অনেকদিন পর আবার আপুর মুখে হাসি দেখতে পাচ্ছি। সবাই বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত, কাজিও বসে আছেন।
আরিয়ান: কিরে আরশান হিমি কোথায়?
আমি: আসছে।
দুলাভাই: এখনো আসছে বললে তো হবে না অনেক রাত হয়েছে বিয়ের কাজ…
আমি: সবাইকে আমার একটা কথা বলার আছে।
রিমি আপু: হ্যাঁ বলো কি কথা।
আমি: বিয়েটা আমি করতে পারবো না। (আমার কথা শুনে সবাই চমকে উঠলো, একজনের মুখের দিকে অন্যজন তাকাচ্ছে শুধু)
আপু: আরশান কি বলছিস এসব?
ছোট ভাইয়া: তুমি বোধহয় ভয় পাচ্ছ, দেখো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোমার আব্বু বাদে বাকি সবাই আমাদের দুটো সম্পর্কই মেনে নিয়েছে এমনকি ভাইয়া আর আম্মুও।
আমি: ভাইয়া আমি ভয় পাচ্ছি না, আসলে হিমি আর আমার বিয়েটা হয়ে গেছে।
ছোট ভাইয়া: মানে?
শান্ত: হ্যাঁ ভাইয়া আমরা সবাই সাক্ষী থেকে ওদের বিয়ে দিয়েছি। গতকাল রাতে কাজি অফিসে বিয়েটা হয়েছে।
আপু: আরশান আগে কেন বলিসনি?
আমি: হিমি নিষেধ করেছিল। আপু যেখানে আমাদের বিয়েটা হয়ে গেছে আবার কেন আমরা বিয়ে করবো?
রিমি আপু: কোনো প্রয়োজন নেই আবার বিয়ে করার আমরা সবাই মেনে নিয়েছি।
ছোট ভাইয়া: হিমি একবার আমাকে তো জানাতে পারতি। (ভাইয়ার কথা শুনে পিছনে তাকালাম, হিমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে)
হিমি: আসলে ভাইয়া আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
কাজী: এবার কিন্তু সত্যি দেরি হয়ে যাচ্ছে।
দুলাভাই: হ্যাঁ বিয়ের কাজ শুরু করুন ফারিয়া আর রুদ্রর। (হিমি এসে আমার পাশে দাঁড়ালো, এবার পাগলীর ভয় কেটেছে)
সিফাত: সবাই তো মেনে নিয়েছে বাসরের ব্যবস্থা করবো নাকি? (সিফাত ফিসফিসিয়ে কথাটা বললো, মুচকি হেসে হিমির দিকে তাকালাম, বউ সাজে মায়াবতীটাকে খুব সুন্দর লাগছে)

আপু আর রুদ্র ভাইয়ার বিয়ের ঝামেলা শেষে সবাই ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডা দিচ্ছি। হিমি আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে দেখে মৃদু হাসলাম।
রিমি আপু: আরশান রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো সারাদিন অনেক টেনশনে ছিলে।
আমি: ঠিক আছে আপু।

বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি আর রাতের আকাশ দেখছি। হঠাৎ হিমি এসে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
হিমি: ভালোবাসি।
আমি: হঠাৎ এতো ভালোবাসা?
হিমি: আজ তোমার থেকে দূরে থেকে বুঝেছি কতটা ভালোবাসি তোমায়। (হিমিকে আমার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরলাম)
আমি: আমিতো ভেবেছিলাম তোমাকে বুঝি হারিয়ে ফেলবো।
হিমি: আমিও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আর কখনো তোমার থেকে দূরে যাবো না।
হিমিকে ঘুরিয়ে দিয়ে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম, হিমির পেটে হাত রাখতেই হিমি কেঁপে উঠে আমার হাতের উপর ওর দুহাত রাখলো। হিমির চুলগুলো একপাশে নিয়ে ওর গলায় ঠোঁট ছুঁয়ালাম, হিমি কেঁপে উঠে ঘুরে গিয়ে আমার বুকে মুখ গুঁজে দিলো। মুচকি হেসে হিমির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললাম “ভালোবাসি”

কপালে কারো ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘুম ঘুম চোখে সামনে তাকালাম, হা করে হিমির দিকে তাকিয়ে আছি দেখে হিমি মিটিমিটি হাসছে। আবারো সেই আগের হিমি? পড়নে বেগুনী রঙের কাতান শাড়ি, শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা দেওয়া, চোখে গাড়ো করে কাজল টানা, কপালে ছোট টিপ, ঠোঁটে লিপস্টিক, কানে ঝুমকো আর চুলগুলো পিটময় ছড়িয়ে আছে।
হিমি: কি দেখছ?
আমি: আমার মায়াবতীকে। (হিমি হাসছে আর আমি মুগ্ধ নয়নে ওর টোলপড়া হাসি দেখছি)
হিমি: তুমি বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলে তাই ডেকে তুলিনি, সবাই রেডি হয়ে গেছে উঠে রেডি হয়ে নাও।
আমি: তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে একদম বউ বউ লাগছে।
হিমি: এখন সবাই জানে আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে, আজ প্রথমবার তোমার স্ত্রী হিসেবে তোমাদের বাড়িতে ঢুকবো বউ বউ না লাগলে হয়? (হিমি উঠে চলে যেতে চাইলো ওর হাত ধরে টেনে কাছে এনে হিমিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম, হিমি আমার বুকে তুথুনি রেখে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে লাজুক দৃষ্টিতে)
আমি: আজ আর ভয় করছে না?
হিমি: না।
আমি: লজ্জা করছে?
হিমি: ধ্যাত তুমি না।
আমি: আমি কি?
হিমি: আরশান একটা অনুরোধ করবো রাখবে?
আমি: হ্যাঁ বলো।
হিমি: আমি সজিবের সাথে একবার দেখা করতে চাই।
আমি: মানে? (হিমি ভয় পেয়ে দূরে ছিটকে গেলো, আমি উঠে বসে হিমির দিকে তাকালাম)
আমি: হিমি এতকিছুর পর সজিবকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে আমরা একটু শান্তি পেয়েছি আর তুমি…
হিমি: শুধু একবার আরশান।
আমি: কিন্তু কেন?
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: ঠিক আছে যাবো মুখ গোমড়া করে থেকো না প্লিজ!
হিমি উঠে চুপচাপ চলে গেলো, আমিও উঠে ফ্রেশ হতে চলে আসলাম, এই হিমি যে কি চায় আল্লাহ্‌ জানেন।

ড্রয়িংরুমে বসে সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে, আমি আসতেই সবাই উঠে দাঁড়ালো, কিন্তু শান্তরা কোথায়?
আপু: এবার বেরুনো প্রয়োজন ওদিকে আম্মুরা অপেক্ষা করছেন।
আমি: হিমি শান্ত, আরিয়ান, সিফাত ওরা কোথায়?
হিমি: জানিনা, নাশতা করার সময় আরিয়ান ভাইয়ার কাছে একটা ফোন আসলো তারপর ওরা নাশতা না করেই চলে গেলো। (আশ্চর্য আমাকে না জানিয়ে কোথায় গেলো ওরা তিনজন?)
রিমি আপু: আরশান তুমি নাশতা করে নাও তারপরই আমরা বেরুবো।
আমি: না আপু এখন আর ভালো লাগছে না চলুন।
রিমি আপু: ঠিক আছে। (হিমির দিকে তাকালাম ও কি সত্যি থানায় যেতে চায় সজিবের সাথে দেখা করার জন্য? কিন্তু দেখা কেন করতে চায়?)

যতটুক বুঝতে পারছি গাড়ি থানার দিকে যাচ্ছে, রুদ্র ভাইয়া ড্রাইভ করছেন তাই কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছি না। আচ্ছা এই হিমি চায়টা কি? গাড়ি থানার সামনে দাঁড় করানো হলো, আমি হিমির দিকে তাকালাম।
রুদ্র ভাইয়া: হিমি আমরা সবাই গাড়িতে আছি তুই আরশানকে নিয়ে থানার ভিতরে যা। আর হ্যাঁ মনে রাখিস তুই কিন্তু পাঁচ মিনিট সময় চেয়েছিস।
হিমি: ঠিক আছে।
হিমির পিছুপিছু থানার ভিতরে ঢুকলাম।

সজিব হিমিকে দেখে চমকে উঠলো, হিমি আস্তে আস্তে সজিবের দিকে এগিয়ে গেলো।
হিমি: কেমন আছ?
সজিব: থানায় কেউ ভালো থাকে?
হিমি: এমন অন্যায় করো কেন যে অন্যায় এর জন্য জেলে পঁচে মরতে হয়?
সজিব: (নিশ্চুপ)
হিমি: যখন তুমি প্রথম আমাকে কিডন্যাপ করেছিলে আর চারদিন আটকে রেখেছিলে তখন আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম প্রচণ্ড ভয় পেতাম, জানো তবুও আমি তোমাকে অভিশাপ দেইনি। কারণ ভালোবাসার মানুষকে কখনো অভিশাপ দেওয়া যায় না, মন থেকে সায় আসে না। আমি তোমাকে সত্যি ভালোবেসে ছিলাম সজিব কিন্তু তুমি… তুমি তো আমাকে ভালোবাসনি, তুমি আমার শরীরটাকে চেয়েছিলে। ভালোবাসা হয় মন থেকে শরীরের জন্য নয় সজীব। তুমি যা চেয়েছিলে তা সম্পূর্ণ পাপ ছিল আর আমি তোমার কথায় পাপে জড়াতে চাইনি বলে তুমি আমাকে কিডন্যাপ করেছিলে। ভালোবাসা কি প্রিয় মানুষের ক্ষতি করার শিক্ষা দেয় সজিব?
সজিব: তুমি কি করেছ? আমি যেমন তোমার ক্ষতি করেছিলাম তুমিও তো আমাকে জেলে দিয়েছ, তোমার আর আমার মধ্যে পার্থক্য কি রইলো?
হিমি: প্রথমবার তো আমি তোমাকে শাস্তি দেইনি অভিশাপও দেইনি বরং ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে দ্বিতীয় বার কিডন্যাপ করলে তোমার জিদের জন্য আর আরশানের আব্বুর কথায়। সজিব অন্যায় একবার ক্ষমা করা যায় কিন্তু বারবার নয়।
সজিব: (নিশ্চুপ)
হিমি: শাস্তি পেয়ে তোমার মুখটা দেখতে ঠিক কেমন হয়েছে সেটাই দেখতে এসেছিলাম। মনে রেখো ভালোবাসা মনের ব্যাপার শরীরের নয়। আর ভালোবাসার মানুষকে কখনো কষ্ট বা অভিশাপ দেওয়া যায় না। তুমি তোমার করা অন্যায় এর শাস্তি পাচ্ছ, আমি কখনো মন থেকে তোমার ক্ষতি চাইনি। (হিমির এই কথাটা শুনে সজিব বেশ অবাক হয়েই হিমির দিকে তাকালো)
সজিব: তুমি কি এখনো…
হিমি: না সজিব, আমি আর তোমাকে ভালোবাসি না। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা সেদিনই মরে গেছে যেদিন তুমি ভালোবাসার নামে আমার কাছে শরীর চেয়েছিলে। আমি একটা জিনিস খুব বিশ্বাস করি এখন “জীবনে সঠিক মানুষটি আসার জন্য ভুল মানুষটিকে কোনো না কোনো ভাবে চলে যেতে হয়” তুমি আমার জীবনে ভুল মানুষ ছিলে আর তুমি চলে যাওয়াতেই আরশান নামের সঠিক মানুষটি আমার জীবনে এসেছে। ধন্যবাদ তোমাকে আমার জীবনে সঠিক মানুষটিকে আসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। (সজিব হিমির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, সজিবের দুচোখে পানি টলমল করছে। হিমি আমার হাত ধরে চলে আসতে চাইলো তখনি সজিব হিমিকে পিছু ডাকলো)
হিমি: কিছু বলবে?
সজিব: পারলে ক্ষমা করে দিও।
হিমি মৃদু হেসে আমার হাত ধরে চলে আসলো।

হিমি: তোমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল তো আমি কেন সজিবের সাথে দেখা করতে চাই? বুঝতে পেরেছ এখন? (আনমনা হয়ে গাড়িতে বসে ছিলাম হঠাৎ হিমির এমন কথা শুনে ওর দিকে তাকালাম)
হিমি: শাস্তি পেয়ে ওর অবস্থা কেমন হয়েছে দেখতে গিয়েছিলাম আর ওকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়েছিলাম। সজিব আমার জীবন থেকে চলে গিয়েছে বলেই তো তুমি আমার জীবনে আসার সুযোগ পেয়েছ।
আমি: (নিশ্চুপ)
হিমি: আচ্ছা আরশান ভালোবাসার মানুষ গুলো বেঈমানি করে কেন? কেন ওরা নিজের স্বার্থের জন্য প্রিয় মানুষটির মনে আঘাত করে? (হিমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ওর প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে কিন্তু আমি কি উত্তর দিবো? আমার কাছে তো উত্তর নেই, আমি সত্যি জানিনা মানুষ কেন নিজের স্বার্থে ভালোবাসার মানুষের ক্ষতি করে বা তার মনে আঘাত করে)
আমি: হিমি সব ভালোবাসার মানুষ গুলো একরকম হয় না, কেউ খারাপ হয় আবার কেউ ভালো হয়। মানুষের জীবনে বারবার স্বার্থপর মানুষ আসলেও একটা সময় কেউ একজন আসে যে তাকে সত্যি ভালোবাসে তাকে নিজের থেকে বেশি ভালোবাসে।
হিমি: যেমন তুমি। (হিমি আমার দিকে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত এক মুগ্ধতায়, মুচকি হেসে ওকে আমার কাছে টেনে নিলাম)

আম্মু, চাঁচি, চাচ্চু, রোদেলা, আদিত্য, তারিন আর হিমির পরিবারের সবাই আমাদের বরণ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে দেখে বেশ অবাক হলাম। কিন্তু খারাপও লাগছে এখানে আব্বু নেই দেখে, তবে কি আব্বু এখনো আমাদের মেনে নেননি? অবশ্য এই খারাপ মানুষটার পক্ষে মেনে না নেওয়াটাই স্বাভাবিক। ভালো হতো এই মানুষটাকে শাস্তি দিতে পারলে।
আম্মু: আরশান কি হলো ভিতরে চল। (হঠাৎ আম্মুর ধাক্কায় হকচকিয়ে উঠলাম, সবাই বাসার ভিতর যাচ্ছে দেখে আমিও পিছুপিছু গেলাম)
আব্বু: তাহলে তোমার কথা গুলোই সত্যি করলে? (আব্বু সোফায় বসে ছিলেন আমরা ভিতরে ঢুকতেই আম্মুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন)
আম্মু: হ্যাঁ করলাম, ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি কোনো অন্যায় করিনি।
আব্বু: ভুল মানুষের সাথে বিয়ে দেওয়াটা অন্যায় নয়?
আম্মু: আমি ভুল মানুষের সাথে ওদের বিয়ে দেইনি, ওরা যাকে ভালোবাসে তার সাথে দিয়েছি আর ভালোবাসা কখনো অন্যায় হতে পারে না।
আব্বু: ভালোবাসা? আমার মান সম্মান নষ্ট করে এখন ভালো…
আম্মু: খবরদার আমার বৌমা বা মেয়ের জামাইর দিকে এক পা এগুলে খবর আছে।
আব্বু: আমি কিন্তু এবার তোমার উপর রেগে যেতে বাধ্য হবো।
আম্মু: সারাজীবন তো এটাই করে এসেছ আর আমি মুখ বুজে সহ্য করেছি। কিন্তু আর না… (কলিংবেল বেজে উঠলো, এই দুপুরবেলা আবার কে আসলো?)
আমি: আম্মু আমি দেখছি।
আম্মু: হুম।

দরজা খুলে পুলিশের দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে আছি, আশ্চর্য বাসায় পুলিশ কেন এসেছে?
আম্মু: আরশান ওদের ভিতরে আসতে দে।
আমি: আম্মু ওরা…
আম্মু: আমিই ডেকেছি।
আদিত্য: কিন্তু কেন চাঁচি?
আম্মু: অন্যায়কারীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।
আমি: মানে? (কি বলছে আম্মু এসব? তাহলে কি আম্মু আব্বুকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যই পুলিশ এনেছেন?)
আম্মু: আমার বৌমাকে কিডন্যাপ করানোর অপরাধে উনাকে নিয়ে যান।
আব্বু: কি বলছ এসব?
আম্মু: অন্যায় যখন করেছ শাস্তি তো পেতেই হবে।
আব্বু: শফিক তুই কিছু বলছিস না কেন? (আব্বুর কথা শুনে চাচ্চু কিছু না বলে মাথা নিচু করে রইলেন)
আব্বু: কিছুই বলবি না?
চাচ্চু: কি বলবো ভাইয়া? আমারো তো একটা মেয়ে আছে, রোদেলাকে যদি কেউ কিডন্যাপ করতো আমার কেমন লাগতো? আমি জানতাম তুমি ছেলে মেয়ের ভালোর জন্য টাকার পিছনে ছুটো কিন্তু তুমি যে এমন জঘন্য কাজ করবে আমি ভাবতে পারিনি। আজ যদি হিমির কিছু হয়ে যেতো পারতে ওকে ওর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে?
আব্বু: (নিশ্চুপ)
আম্মু: নিয়ে যান ওকে।
পুলিশ আব্বুকে নিয়ে যাচ্ছে আমি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, কি হয়ে গেলো এসব? আমিতো এমন কিছু চাইনি। হ্যাঁ আমি চেয়েছিলাম আব্বু শাস্তি পান কিন্তু এভাবে নয়।

পরন্ত বিকেল, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনা হয়ে আকাশ দেখছি। হঠাৎ কে যেন আমার কাধে হাত রাখলো, পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি আম্মু, তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলাম।
আম্মু: আরশান আমি জানি তোর খুব কষ্ট হচ্ছে, ফারিয়াও কান্নাকাটি করছে। আমি তোদের কথা দিচ্ছি খুব তাড়াতাড়ি আমি তোদের আব্বুর জামিনের ব্যবস্থা করবো।
আমি: (নিশ্চুপ)
আম্মু: এই কাজটা না করলে তোর আব্বু কখনো শোধরাতো না, এই কাজটা করা খুব প্রয়োজন ছিল তোর আব্বুর চোখে আঙ্গুল দিয়ে ওর অন্যায় গুলো দেখিয়ে দেওয়ার জন্য।
আমি: কিন্তু আম্মু…
আম্মু: অন্যায় বারবার ক্ষমা করলে হয় না আরশান মাঝেমাঝে অন্যায়কারীকে শাস্তিও দিতে হয়। আমি কথা দিচ্ছি তোদের আব্বুকে বেশি শাস্তি পেতে দিবো না। আমি চাই তোর আব্বু একটুখানি শাস্তি পেয়ে নিজেকে শোধরে নিয়ে ফিরে আসুক।
আমি: হুম।
আম্মু: তোরা মন খারাপ করে থাকিস না আমার ভালো লাগে না।
মৃদু হেসে আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম। এই মানুষটা আমাদের সাপোর্ট না করলে কবেই ভেসে যেতাম, এমন মা যে ভাগ্যগুণে পাওয়া যায়।

আদিত্য: তারিন তুমি কিছু বলবে কিনা? (হিমির রুমের দিকে যাচ্ছিলাম হঠাৎ আদিত্যর কন্ঠ শুনে থেমে গেলাম, কিছু দূরে আদিত্য আর তারিন দাঁড়িয়ে আছে)
আদিত্য: আমি কিন্তু খারাপ কিছু করতে বাধ্য হবো, অনেক সহ্য করেছি তারিন। আজ থেকে আমি তোমার পিছনে পড়ে আছি? তুমি বারবার আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ কাউকে কিছু বলতেও দিচ্ছ না। আমিতো আরশান ভাইয়াকে জানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি…
তারিন: প্লিজ আমাকে যেতে দাও।
আদিত্য: মন থেকে বলছ? তোমার চোখে তো আমি ভালোবাসা দেখেছি। আমি জানি তারিন তুমি শান্ত ভাইয়াকে ভয় পাচ্ছ।
আমি: কি হয়েছে রে আদিত্য? (আমাকে দেখে দুজন দুদিকে সরে গেলো, দুজন এভাবে কষ্ট পাচ্ছে আর আমরা কেউ কিছু বুঝতে পারিনি?)
আদিত্য: ভাইয়া গতকাল তোমাকে তারিনের কথাই বলতে গিয়েছিলাম কিন্তু তোমার মন খারাপ ছিল। ভাইয়া আমি তারিনকে ভালোবাসি কিন্তু ও শান্ত ভাইয়ার ভয়ে কিছু বলছেই না।
তারিন: আসছি আমি।
আমি: তারিন দাঁড়াও। (তারিন হনহন করে হেটে চলে গেলো, আদিত্য তারিনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে)
আমি: তারিন তোকে ভালোবাসে?
আদিত্য: ওর চোখে আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি কিন্তু ও শান্ত ভাইয়ার ভয়ে… (আমার ফোন বেজে উঠলো, শান্ত ফোন দিয়েছে)
আমি: হ্যালো।
শান্ত: একটু কলেজে আয়।
আমি: কেন?
শান্ত: তাড়াতাড়ি আয় প্রয়োজন আছে।
আমি: ঠিক আছে আসছি। (ফোন রেখে আদিত্যর দিকে তাকালাম)
আমি: তুই তারিনকে প্রপোজ করার ব্যবস্থা কর বাকিটা আমি দেখছি, এতো সুন্দর সারপ্রাইজ দিবি যেন তারিন অবাক হয়ে যায়।
আদিত্য: হুম।

শান্তর পাশে অধরা দাঁড়িয়ে আছে দেখে অবাক হয়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম, আমাকে দেখে অধরা মৃদু হাসলো।
আমি: কেমন আছিস? আর এতদিন কোথায় ছিলি? জানিস আমরা তোকে কতো খুঁজে…
অধরা: তুই ভালো আছিস তো?
আমি: হ্যাঁ ভালো।
অধরা: আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি আর কখনো এই শহরে ফিরবো না, দেখা হবে না আর তোদের সাথে।
আমি: কি বলছিস এসব?
অধরা: আসছি, ভালো থাকিস।
আমি: অধরা শুন। (অধরা চলে যাচ্ছে আমি নির্বাক হয়ে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি)
শান্ত: এই নে।
আমি: কি এইটা?
শান্ত: চিঠি, অধরা দিয়ে গেছে। (চিঠিটা হাতে নিয়ে অধরার দিকে তাকালাম, অনেক দূরে চলে গেছে)
শান্ত: চিঠিটা পড়।
আমি: হুম।

আস্তে আস্তে অধরার রেখে যাওয়া চিঠিটা খুললাম…
“আরশান তোরা বরাবরই আমার বন্ধু ছিলি, আমি কখনো তোকে নিয়ে অন্য কোনো স্বপ্ন দেখবো ভাবতেও পারিনি। তোর আব্বু আর সজিব আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। তোর আব্বু বলেছিল উনার কথা শুনলে আমাকে তোর বউ করে ঘরে নিবে। তোর আব্বুর কথায় সেদিন আমি তোর অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে ওসব নোংরামি করেছিলাম। বিশ্বাস কর আমার ভালোবাসায় কোনো নোংরামি ছিল না, আমি তোকে সত্যি ভালোবাসি। আর তাই তোর জীবন থেকে চলে যাচ্ছি, আমি না গেলে হিমি আর তুই এক হবি কিভাবে? দুজন ভালোবাসার মানুষকে এক হতে হলে তো তৃতীয় জনকে কষ্ট পেতেই হয়। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি, পারলে ক্ষমা করে দিস”
শান্ত: আরশান কাঁদিস না।
আমি: অধরা আমাদের ছেড়ে এভাবে চলে যেতে পারলো?
শান্ত: তৃতীয় ব্যক্তিকে তো সরতেই হয়।
আমি: হুম।
শান্ত: বাসায় চল অন্ধকার হয়ে আসছে আন্টি টেনশন করবেন।
আমি: চল।

বাসায় এসে রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম কিন্তু কে যেন আমার হাত ধরে টেনে অন্য রুমে নিয়ে আসলো, নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি হিমি। এই মেয়েটা রোজ এতো সাজগোজ করে কেন? ও কি বুঝেনা নিজেকে সামলে রাখতে পারিনা? আজ তো হিমিকে খুব সুন্দর লাগছে একদম আমার আগের মায়াবতী।
হিমি: এইযে? (হিমির ধাক্কায় আমার ঘোর কাটলো, ওকে পাত্তা না দিয়ে চলে আসার জন্য পা বাড়ালাম)
হিমি: কি হলো আমাকে এড়িয়ে চলছ কেন? (হিমি আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো)
হিমি: শাস্তি দিচ্ছ?
আমি: হ্যাঁ, রাতে তুমি আমাকে শাস্তি দিয়েছ আমি তোমাকে এখন শাস্তি দিচ্ছি।
হিমি: আরশান এতো গুলো বছর পর আপুর সাথে আমার দেখা হয়েছে তাই আমি আপুর কাছে ঘুমিয়েছিলাম আর তুমি কিনা এজন্য রাগ করছ?
আমি: আরে কান্না করছ কেন আমি রাগ করিনি। আসলে অধরার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম তাই তোমার কাছে যাওয়ার সুযোগ পাইনি।
হিমি: (নিশ্চুপ)
আমি: এখনো মুখ গোমড়া করে থাকবে? (হিমিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম)
আমি: আসলে আদিত্য আর তারিন…
হিমি: আমি সব জানি আর সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। শান্ত ভাইয়াকেও ফোন করে ডেকে নিয়েছি। তুমি ছাদে যাও আমি তারিনকে নিয়ে আসছি।
আমি: ঠিক আছে।
হিমির কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে ছাদের দিকে এগিয়ে গেলাম।

বাহ্ এখানে তো দেখছি সবাই আছে। আপু, রিমি আপু, দুলাভাই, শান্ত, সিফাত, আরিয়ান আর আদিত্য।
আদিত্য: ভাইয়া হয়েছে সব সাজানো? (ছাদের চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম)
আমি: হ্যাঁ খুব সুন্দর হয়েছে কিন্তু তুই এতো ঘামছিস কেন?
আদিত্য: ভয় হচ্ছে খুব।
আমি: আমিও হিমিকে প্রথম এভাবেই প্রপোজ করেছিলাম।
আদিত্য: ভাবি রাজি হয়েছিল?
আমি: না।
আদিত্য: ওহ।
আমি: ভয় নেই তারিন রাজি হবে।
শান্ত: আরশান আজ আবার পার্টির আয়োজন? হিমিকে আবার প্রপোজ করবি নাকি?
আমি: না তোকে প্রপোজ করবো।
শান্ত: মানে?
হিমি: আরশান? (হিমির ডাকে পিছনে তাকালাম, হিমি আর রোদেলা দুজন তারিনকে নিয়ে এসেছে। তারিন অবাক হয়ে সবকিছু দেখছে আর আদিত্যর দিকে তাকাচ্ছে)
আমি: শান্ত একটা জিনিস চাইবো দিবি?
শান্ত: কি?
আমি: তোর বোনকে আমার বোন করে সারাজীবনের জন্য আমাদের বাসায় নিয়ে আসতে চাই।
শান্ত: মানে বুঝলাম না।
আপু: আদিত্য আর তারিন দুজন দুজনকে ভালোবাসে কিন্তু তোর ভয়ে তারিন রাজি হচ্ছে না।
রোদেলা: শান্ত ভাইয়া কথা দিচ্ছি তোমার বোনকে আমার বোন করে রাখবো, ভাবি ভেবে কখনো দূরে সরিয়ে দিবো না। (শান্ত চুপচাপ আদিত্যর দিকে এগিয়ে গেলো)
শান্ত: কিন্তু যে আমার বোনকে চায় সে তো আমাকে কিছু বলেনি।
আদিত্য: ভাইয়া আমি তারিনকে কখনো কষ্ট দিবো না আআর আ…
আমি: শান্ত ওকে ছেড়ে দে, দেখছিস না ভয় পেয়ে ঘেমে যাচ্ছে?
শান্ত: তুই তো আমাকে একবার বলতে পারতি। আমি কি মেনে নিতাম না? তোর সুখেই তো আমরা সুখী। (শান্ত তারিনকে জড়িয়ে ধরলো, বাহ্ এই নাহলে ভাই বোনের ভালোবাসা)
রোদেলা: ভাইয়া এবার রিংটা ভাবির হাতে পড়িয়ে দাও। (আদিত্য তারিনের সামনে হাটু গেড়ে বসে তারিনের আঙ্গুলে রিং পড়িয়ে দিলো)
আমি: কিরে কাঁদছিস কেন? (শান্ত কাঁদছে দেখে ওকে জড়িয়ে ধরলাম)
শান্ত: তারিনকে সবসময় হাসতে দেখেছি কিন্তু আজকের মতো এতোটা হাসতে দেখিনি।
দুলাভাই: হয়েছে এবার ওদের একটু একা ছেড়ে দাও। ফারিয়া চলো রুদ্র অপেক্ষা করছে আর সিফাত… (দুলাভাই সিফাতকে কি যেন ইশারা করলো, সিফাত আর আরিয়ান এসে প্রথমে হিমির চোখ তারপর আমার চোখ বেঁধে দিলো)
আমি: কি করছিস তোরা?
সিফাত: যেখানে নিয়ে যাই চুপচাপ চল।

চোখের বাঁধন খুলে দিতেই অবাক হয়ে রুমের চারপাশে তাকালাম, হিমি আমার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে।
আমি: এভাবে তাকাচ্ছ কেন আমি কিছু জানিনা।
সিফাত: আরে ভাবি রেগে যাচ্ছ কেন? বাসর সাজিয়েছি এর বেশি কিছুনা। বন্ধু হিসেবে তো এইটুকু করতেই পারি।
আরিয়ান: ভাবি রেগে যাচ্ছে তারমানে ভাবি বাসর চায় না।
আমি: চুপ করবি তোরা? এমনি আমার বউটা লজ্জাবতী।
সিফাত: আজকে সব লজ্জা ভাঙ্গিয়ে দিস।
আমি: দাঁড়া। (সিফাত আর আরিয়ান দৌড়ে পালিয়ে গেলো। হিমি চারদিকে চোখ বুলিয়ে সাজানো দেখছে)
আমি: হিমি সত্যি আমি কিছু জানিনা এসব ফাজিলগুলো করেছে। তাছাড়া বাসর তো সাজানো লাগতোই, বিয়ে হয়েছে দুদিন হয়ে গেছে অথচ আমাদের… (হিমি লজ্জায় লাল হয়ে গেছে দেখে থেমে গেলাম। একটু একটু করে হিমির দিকে এগিয়ে গিয়ে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম)
আমি: আজো কি বাঁধা দিবে? (হিমির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে প্রশ্নটা করলাম, হিমি নীরব হয়ে আছে দেখে মুচকি হাসলাম কারণ নীরবতা সম্মতির লক্ষণ)
আমি: ভালোবাসি হিমি।
হিমি ঘুরে গিয়ে আমার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। হিমির কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলাম। বিছানায় শুয়ে দিতেই হিমি লজ্জায় দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো। হিমির হাত দুটো সরিয়ে দিলাম, দুচোখ বন্ধ রেখে হিমি হাসছে, লজ্জায় লাল হয়ে গেছে আমার মায়াবতীটা। হিমির হাতের আঙ্গুলের বাজেবাজে আমার আঙ্গুল গুলো আটকে দিলাম, হিমির নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে দেখে মুচকি হাসলাম আর ওর নাকের ডগার তিলকটায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম।