মেয়েটাকে এক রাতের জন্য ভাড়া করে নিয়ে এসেছিল ফারাবি। বাড়িতে সপ্তাহ খানেক কেউ থাকবে না। ওর বাব-মা জরুরী কাজে বাড়ির বাইরে গেছেন। ছোট বোনটা মহিলা কলেজের হোস্টেলে থাকে। বাড়ি একদম ফাঁকা। কারণ, ফারাবি ওর স্ত্রীকে হারিয়ে বেদনায় কাতর হয়ে পড়েছিল। ক্রমশ ড্রাগ এ্যাডিক্টেড হয়ে পড়েছিল। ওর মায়াবতী ওকে ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে। প্রায় রাতেই নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে থাকতো। বাবা-মা সবসময় কাঁদতেন, বার-বার আহ্বান করতেন ভালো পথে ফিরে আসার জন্য। ছোট বোনটা প্রায়ই ফোন দিয়ে
কাঁদতো।
ফারাবিকে বলতো, “ভাইয়া ফিরে আয় তুই, আয় না আমার লক্ষ্মী ভাইয়া।”
কিন্তু ফেরার কোনো রাস্তাই হয়তো ছিল না, হয়তো ওর মাঝে বাঁচার কোনো ইচ্ছেই ছিল না।
এক রাতে হিরোইন কিনে বাড়ি ফিরছিল ফারাবি। রাস্তায় হঠাৎ কোনো একজনের গলার স্বর শুনতে পেল।
এক পাশ থেকে অচেনা একটা মেয়ে এসে বললো, “ভাইয়া, পছন্দ হয় আমায়?”
ফারাবি অবাক দৃষ্টিতে তাকায় মেয়েটার দিকে, “কী বলো এসব, দূরে থাকো আমার থেকে, আমি ওরকম ছেলে না।”
মেয়েটা আরো কাছে এসে বললো, “প্লিজ ভাইয়া দেখুন না তাকিয়ে আমার দিকে, কোনো কমতি নেই আমার
মাঝে।”
সে খেকিয়ে বললো, “তোমাকে বললাম না এখনি চলে যেতে।” মেয়েটা বোধহয় একটু ভয় পেয়েছিল।
ভয়ে ভয়ে বললো, “টাকার খুব দরকার, যা দিবেন তাতেই রাজি।”
ফারাবি ভাবতে লাগলো, কাছে যা টাকা আছে তা দিয়ে
আরো ছ’দিন চলতে হবে। টাকা কোনোভাবেই নষ্ট করা
যাবে না, নেশাখোরদের কেউ টাকা ধার দেয় না। বাড়িতে বাবা মা-ও নেই। মনেমনে কয়েক সেকেন্ড একটা হিসেব করছিল সে।
হঠাৎ তার ভাবনায় ছেদ করে মেয়েটা বলে উঠল, “আপনি যেখানে বলবেন সেখানেই যাবো।”
একটু ভেবে ফারাবি বললো, “আমার বাড়িতে যাবি?”
মেয়েটা মাথা ঝুকিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো।
“বেশি কিন্তু দিবো না, তুই রাজি তো?”
সবশেষে মেয়েটা ওর পিছনে অনুসরণ করে চলতে লাগলো।

সেদিন কীভাবে কী করবে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না ফারাবি। সে ভাবলো নেশাটা আগে সেরে নেওয়া যাক। বাড়িতে গিয়ে দরজা খুলে মোমমবাতি জ্বালালো, নেশার যন্ত্রে সবেমাত্র একটা টান দিয়েছে,
ঠিক তখনি মেয়েটা বললো, “ভাইয়া আমার সামনে এগুলো খাবেন না, আমার মাথা ঘোরে, বমি আসে।”
কথাটা শুনে একটু অবাক হয়েছিল সে। ভাবনা বেড়ে গেল, মেয়েটার জীবনে কি আমিই প্রথম নেশাখোর? নাকি ওর বিছানায় শোয়া প্রত্যেকেই ভালো ছিলো?
সন্দেহের বশে ফারাবি বললো, “কেন, হিরোইনের ধোঁয়ায় তোমার বুঝি কষ্ট হয়?”
মেয়েটা উত্তরে বললো, “হ্যাঁ, খুব খারাপ লাগে, বিড়ি, সিগারেটের ধোঁয়াও সহ্য হয় না আমার।”
নেশার পোকাকে পিষে মেরে হিরোইন ফেলে দিলো সে। এরপর মেয়েটার কাছে এগিয়ে গেল।
ওকে প্রশ্ন করলো, “তুমি কি এই কালো জগতের লাইনে নতুন?”
মেয়েটা মাথা নেড়ে জবাব দিলো, ” হ্যাঁ।”
“কেন এসেছো এই নোংরা জগতে? এই জগতটা তো ভালো নয়।”
সে মাথা তুলে ফারাবির মুখপানে কিছুক্ষণ চেয়েছিল।ওর চোখ-মুখে ছিলো বিস্ময়ের আবছাঁয়া। হয়তো সে অবাক হয়েছিল এই ভেবে যে, এমন প্রশ্ন তো কেউ কোনোদিন করেনি, এত গল্পের সময় তো কারো কাছে থাকে না। সবাই তো এই দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে এক মুহূর্ত দেরি করে না।
মেয়েটা বিছানা থেকে উঠে চলে যেতে চাইলে ফারাবি বললো, “পুরো দুহাজার দেবো রাতটা থাকবে আমার সাথে?” কেন ওকে রাতটা থাকার কথা বলেছিল জানেন?
ফারাবি জানতো মেয়েটা বাইরে গেলে কারো না কারও ক্ষপ্পরে পড়বেই। টাকার জন্য কারো না কারও কাছে নিজের দেহকে বিক্রি করে দেবে, তাই এইসব থেকে রক্ষা করার জন্যই ফারাবি মেয়েটাকে বাসায় এনেছিল।
“”””””””””””””
থমকে দাঁড়ায় মেয়েটা পুরো রাত থাকার কথা শুনে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবলো।
তারপর ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে বললো, “আগে টাকাটা দিন।”
ফারাবি পকেট থেকে টাকা বের করে দিলো। পরবর্তী কয়েকদিনের নেশার টাকা দিয়ে দিলো মেয়েটার হাতে।
মেয়েটা মুচকি হেসে বললো, “ভাইয়া একটু ফোন করতে
পারি আপনার ফোন থেকে?”
ফারাবি বললো, “আমার ফোন নেই।”
মেয়েটা একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, “ফোন নেই? আরে নিয়ে নেবো না, আমি ওরকম মেয়ে না।”
“জানি তুমি ওরকম না, কিন্তু সত্যিই আমার ফোন নাই, ওটাকে বেঁচে সাতদিন আগে হিরোইন খেয়েছি। কিন্তু কেন বলো তো? ফোন দিয়ে কী করবে তুমি? অন্য কাউকে বাতিল করবে নাকি?”
মেয়েটা কিছুই বললো না, চুপচাপ ফারাবির দিকে তাকিয়ে ছিল। রাত আনুমানিক বারোটা, মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। সে কী করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। নেশাটাও ততক্ষণে চড়ে বসেছে। নারীর দেহের নেশা নয়, ড্রাগের নেশা। সিগারেটের চিকচিকে কাগজটায় হিরোইন নিয়ে আগুন জ্বালালো। পরক্ষণেই মেয়েটা কেশে উঠলো, বুঝতে পারলো ধোঁয়ায় ওর কাশি উঠেছে।
কাশি থামার পর মেয়েটা বললো, “বললাম না আমার সামনে খাবেন না। যান বাইরে থেকে খেয়ে আসুন।”
আগুন নিভিয়ে বাহিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এক পা বাড়াতেই মেয়েটা আবার বলে উঠলো, “কেন খান এগুলো?”
“কষ্টে।”
“কীসের জন্য আপনার এত কষ্ট যে, জীবনটাকে এভাবে আঁধারে নিয়ে যাচ্ছেন?”
ওর প্রশ্ন শুনে ফারাবি অবাক হয়েছিল সেদিন। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো মেয়েটার দিকে। বয়স খুব একটা না, ১৬-১৭ বছর হবে হয়তো।
সে মেয়েটাকে বললো, “তোমার জীবনটা কোথায়? কোন আলোয় আছো তুমি?”
মেয়েটা ফারাবির দিকে তাকিয়ে থাকলো। একটু পর চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। সে আরও অবাক হয়ে গেল।
কিছুক্ষন পর চোখের জল মুছে মেয়েটা বললো, “কিছু করবেন না?”
“আমি কিছুই করবো না তোমার সাথে, তুমি ঘুমাও।”
“কেন করবেন না?”
“যাকে ভালোবাসতাম সেই মানুষটা চলে গেছে না ফেরার দেশে, একমাত্র সে ছিল আমার সুখ-দুঃখের সঙ্গী, ওর শরীর ছাড়া অন্য কারও শরীর কখনো স্পর্শ করিনি।”
“ভাবি অনেক ভাগ্যবতী আর মায়াবতী ছিল।”
“তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে তো কেন আমি নেশা করি, শুনবে?”
মেয়েটা মাথা ঝোকায়।
ফারাবি বললো, “শোনো তাহলে পিছনে ফেলে আসা ইতিহাস। যেখানে ছিল অনেক পবিত্র মায়াময় ভালোবাসা আর হাহাকার কষ্ট। কলেজ জীবন শেষ করে একটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। ক্লাস শুরুর প্রথম দিকে মাত্র দু’একদিন গিয়েছিলাম ভার্সিটিতে। তারপর নানা ব্যস্ততা আর অজুহাতে অনেক দিন যাওয়া হয়নি, সব মিলিয়ে কারও সাথে তেমন পরিচয় ছিল না। তবে দু’একজন বন্ধু ছিল। একটা সময় পরিক্ষা চলে আসলো, পরিক্ষা দিতে গিয়ে দেখলাম তেমন কাউকেই চিনি না, দু’একজন বন্ধু থাকায় ওদের সাথেই বসে পরিক্ষা দিয়েছি। দুই-তিনটা পরীক্ষা দেওয়ার পর একদিন আমার সাথে একই বেঞ্চে একটা মেয়ে বসে ছিল। প্রথম দিন তেমন একটা কথাবার্তা না হলেও পরেরদিন থেকে বেশ ভালোই কথা হতো, কথা বলার মাধ্যম ছিল পরিক্ষার রুম আর ফেসবুক, সাথে খুনসুটিও চলতো বেশ। পরিক্ষার শেষের দিকে দুজন একটা ভালো সম্পর্কে জড়িয়ে যাই, তবে তখন পর্যন্ত সেটা প্রেম কিংবা ভালোবাসা ছিল না। ওর নাম ছিল রাত্রি, নামের মতোই সুন্দর আর মায়াবতী ছিল সে। তখন পর্যন্ত একটু একটু ভালো লাগতো। পরিক্ষা শেষ হলে দুজন দুজনের গন্তব্যে পাড়ি জমাই, রাত্রি ওর বাসায় চলে যায়, আমি চলে আসি আমার বাসায়। তারপর বেশ কিছুদিন আর ভার্সিটিতে যাওয়া হয়নি এবং ওর সাথেও দেখা হয়নি। কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর ভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করলাম, রাত্রির মায়া আমাকে টানতো। আমার কাছে রাত্রি ছিল সেরা। ছোট্ট ছোট্ট খুনসুটি, হাসি, আর অল্প অল্প কথাবার্তায় কেটে যায় অনেকদিন। একটা সময় আমরা সত্যিকারের ভালোবাসায় জড়িয়ে যাই। পাগলি মেয়েটা অনেক ভালোবাসতো আমাকে, আমিও কিন্তু কম বাসতাম না, মায়াবতীর মায়াই তো আমাকে পাগল করে রাখতো। আমাদের ভালোবাসা ছিল গগন সমান পবিত্র। অনুমতি ছাড়া কখনো রাত্রির হাতটা পর্যন্ত ধরিনি। সম্পর্কের অনেক দিন পর আমি রাত্রির সম্পর্কে আমার বাড়িতে জানাতে বাধ্য হই। আমার আর রাত্রির পরিবারের সম্মতি নিয়েই আমাদের বিয়ে হয়েছিল। অবশেষে দুজন দুজনকে কাছে পেয়ে, পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অনেক সুখে ছিলাম৷ রাতে ওর চুল বেঁধে দিতাম, কোলো করে ছাঁদে নিয়ে যেতাম, আমি তো কমবেশি গল্প-কবিতা লিখতে পারতাম তাই সে যখন আমার কাঁধে মাথা রাখতো তখন আমি কবিতা শোনাতাম। পাগলিটা খুশি হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু এঁকে দিতো। রাত্রি যখন রান্না করতো তখন মাঝে মাঝে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতাম, ফাজলামো করে ওর রান্নায় ব্যাঘাত ঘটাতাম। সে করতো কি, চামচ হাতে নিয়ে আমাকে দৌঁড়ানি দিতো। ঠিক এভাবেই ভালোবাসাটা আলোর গতিতে বেড়ে যাচ্ছিল। বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর নিয়তি উল্টো দিকে মোড় নিলো, রাত্রি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছিল। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছিলাম, কিন্তু কেউ কিছুই বলতে পারেনি। জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে মায়াবতী হঠাৎ একদিন সবাইকে ছেড়ে চলে যায় না ফেরার রাজ্যে। রাতের আঁধারেই হারিয়ে যায় আমার রাত্রি। ঠিক তারপর থেকেই আমি ছন্নছাড়া জীবন-যাপন করতে শুরু করেছি। এখন ছোট একটা চাকরি করি, এটাই আমার একমাত্র সম্বল। এই চাকরির টাকা থেকেই আমি ড্রাগস কিনি, নয়তো কবেই ছেড়ে দিতাম চাকরি।”

মেয়েটা গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে যখন চলে যাচ্ছিল তখন ফারাবি ডেকে বললো, “তোমার ঠিকানাটা দিবে?”
“না।”
“ঠিক আছে আজ আবার এই ঠিকানায় চলে এসো।”
মেয়েটা হেসে বললো, “আচ্ছা।”
“আজ কত টাকা নেবে?”
সে টাকার কথা না বলেই চলে গেল। সেদিন রাতে মেয়েটা আবার ফারাবির বাড়িতে এসেছিল। আর ফিরে যায়নি, ফারাবির ছোট বোন হয়েই থেকে যায় বাড়িতে। এই ছোট বোনটাই একসময় ফারাবিকে নেশার জগত থেকে ফিরিয়ে আনে। হয়তো প্রত্যেকটা রাতে রাত্রির কথা ভেবে ডুকরে ডুকরে কাঁদে ফারাবি। তার কান্নার স্বর চার দেয়ালের মাঝেই আঁটকে থাকে। রাত্রির অভাবে ফারাবি নেশা নামক বিষাক্ত জগতে পা বাড়িয়েছিল, তখন ওর রাত্রি হয়তো দূর গগন থেকে দেখে অঝোরে কাঁদতো। ফারাবি এখন আট-দশটা ভালো ছেলের মতোই বেঁচে আছে, আর ওর মায়াবতীটাও হয়তো এখন মুচকি মুচকি হাসছে।