পরিবারের ছোট মেয়ে হওয়া একটা অভিশাপের মত। বাড়ির সবাই যেন মাথায় চড়ে বসে থাকতে চায়। এ বলে এটা কর তো ও বলে ওটা কর। সারাদিন বাড়ির সবার এই কাজ ওই কাজ করতে করতে মিম ক্লান্ত হয়ে পরে। তার এত কাজ করতে ভালো লাগে না কিন্তু সে না করেও পারে না। কারণ সবাই যে তার বড়!
থালা-বাসন ধোয়া, কাপর কাচা, রান্নায় মাকে সাহায্য করা ঘর গোছানো সবকিছু মিমকে একাই করতে হয়। ঘরে কিন্তু সে একা থাকে না। তার বড় বোন আছে ছোট ভাইও আছে তারা সবাই পায়ের উপর পা তুলে আরামে দিন কাটায় আর মিমকে হুকুম করে। মিমের খুব রাগ হয় বড় বোনের ওপর কিন্তু কিছু বলতে পারে না বড় বলে। মিম রাতে যখন সব কাজ শেষ করে ঘুমোতে যায় তখন আয়নায় নিজেকে দেখে আজকাল এত বেশী কাজ করাতে চেহারা কেমন যেন শাবানা আন্টির মত হয়ে গেছে।
শুধু চেহারা না শাবানা আন্টির সিনেমার সব কিছুই মিলে যায় মিমের সাথে। সারাদিন কাজ করেও যদি একটু পান থেকে চুন খসে তাহলে খবর আছে বড় বোন, বাবা-মা, ভাই সবাই মিলে পারলে বকাবকির বস্তা নিয়ে আসে ওকে দেবার জন্য। মিমের মাঝে-মধ্যে সন্দেহ হয় ও কি সত্যিই এ ঘরের মেয়ে নাকি পালিত কন্যা? এ ঘরে শুধু একজন ভালো মানুষ আছে সে হচ্ছে মিমের দাদু, মিমের যখন মন খারাপ থাকে তখন উনি আনোয়ার হোসেনের মত দরদী কণ্ঠে মিমকে স্বান্তনা দেন।
মিম ড্রেসিং টেবিলে বসে খোঁপা খুলে তার লম্বা চুল গুলোতে তেল দিয়ে আঁচড়ায়। কপালে কালো একটা টিপ দিয়ে ভাবে তার জীবনেও একদিন কোনো এক বিক্রমশালী জসিম আসবে। তার সাথে ও সুখে ঘর বাধবে। ওদের অনেকগুলো গলুমলু বাচ্চা হবে। ওরা অনেক সুন্দর করে ঘর সাজাবে। ফুলের বাগান করবে। সেই বাগানে নিয়মিত পানি দিবে। বাগানে সব ধরনের ফুলের গাছ থাকবে। একটা বকুল ফুলের গাছ থাকবে বাগানের এক কোনায় সেই গাছে প্রথম যখন ফুল ফুঁটবে সেই ফুল দিয়ে মিম তার জসিমকে মালা বানিয়ে দিবে…..
“ওই লাইট অফ কর, আমার ঘুম আসছে।”
বড় বোনের ডাকে কল্পনায় ছেদ পড়ে মিমের। বুকের মধ্য থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাইট অফ করে সে ঘুমাতে যায়। বালিসে মাথা রেখে আবার কল্পনায় হারায়। সারাদিনের কাজের ধকলে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে বুঝতেই পারে না।
সারাদিন বাড়ির কাজ, মাঝে মধ্যে কলেজে গিয়ে ঘুরে আসা আর এক আধটু পড়াশোনা করে অনেক বোরিং লাগছিলো যখন তখন মিমের বাবা তাকে একটা খুশির সংবাদ দিলো। তা হচ্ছে, বড় বোনের বিয়ে। পাত্র পক্ষ মেয়েকে দেখেছে কিন্তু আজকেই আবার আনুষ্ঠানিক ভাবে দেখতে আসবে।
বড় বোনের বিয়ের কথা শুনে বোনের থেকে বেশী খুশি হল মিম। কারণ এই বদ মেয়েটা ওকে প্রচুর জ্বালাতন করে। সারাদিন কাজের হুকুমতো আছেই, তার ওপর ওর কোনো কিছু শান্তিতে রাখতে পারেনা বড়টার জন্য। মিম যদি একটা সুন্দর চুলের ব্যান্ড কেনে সেটা ওর লাগবে, বড় মেকাপ বক্সটা ওর লাগবে, জামার সেফটিপিন কিংবা বড় দাঁতের চিরুনি, ব্রেসলেট, কানের দুল, নুপুর, রং পেন্সিল জ্যামিতি বক্স সহ মিমের যা কিছু সুন্দর সবই বড় বোনটা দখল করে নেবে। তাই এবার মিম মহাখুশি বড় বোনটা বিদায় করে দিতে পারলে রাজত্ব ওর দখলে।
বর পক্ষ মিমের বোনকে দেখে পছন্দ করে, বিয়ের দিন তারিখও ঠিক হয়ে যায়। মিমের যেন আনন্দ আর ধরে না। আর মাত্র কটা দিন তার পরেই আপদ বিদায়। মিম ওর বড় বোনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে – “যারা বাপের বাড়িতে বসে বসে খায় জামাই বাড়িতে গেলে কপালে দুঃখ থাকে। আর এই লোকটাকেতো দেখে মনে হয় মাল-টাল খায় বাব্বাহ চোখদুটো কি লাল!” বড় বোনের নাকমুখ কুচকে যায় মিমের কথা শুনে আর তা দেখে মিম হাসিতে গড়াগড়ি খায়।
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে আসে। হলুদের দিনেই দূরের আত্মীয়রা বাড়িতে চলে আসে গোটা বাড়ি সাজানো হয়। বড় বোনের গালে মিম হলুদ মাখে আর মুচকি হাসে বলে আর মাত্র দুটো দিন তারপর তোমার বিদায়। মনের আনন্দে নেচে গেয়ে হলুদের দিন মাতিয়ে রাখে মিম। যেন বড় বোনের বিয়েতে সেই সবথেকে খুশি।
বিয়ের দিন বর পক্ষের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। মিম একটু পরপর উঠে বেলকনিতে গিয়ে উঁকি দিচ্ছে বরযাত্রীর গাড়ি আসে কিনা দেখার জন্য। কিন্তু বরযাত্রীর খবর নেই। মিম নখ কমড়ায় কতক্ষণ, পায়চারি করে কতক্ষণ কিন্তু বরযাত্রী আসেনা। মিম অস্থির হয়ে ওঠে। মাকে জিজ্ঞেস করে “বরযাত্রী এখনো আসে না কেন ? আর কতক্ষণ লাগবে?” মিমের মা হেসে বলেন- “কি ব্যাপার বর কি তোর? এতো তারা কিসের? চলে আসবে পথে আছে হয়তো।”
মিম মুখ বাকিয়ে মায়ের কাছ থেকে চলে যায়। বেলকিনতে বসে বরযাত্রীর অপেক্ষা করতে থাকে। মাঝে মাঝে বোনের সাজ-গোজের খোঁজ নিতে যায়। বরযাত্রীও চলে আসে কিছু সময় পরে।
মিম সাগ্রহে বরযাত্রীকে অভ্যর্থনা জানায়। বড়দের আনুষ্ঠানিকতা দেখে দূর থেকে দাঁড়িয়ে আর মনে মনে আনন্দে আত্মহারা হতে থাকে। ওর ভাবতেই ভালোলাগে আজকে পুরো বিছানা জুড়ে ও একা ঘুমাবে। ওর কোনো কিছুতে কেই ভাগ বসাতে আসবে না। মিম খুব আন্তরিকতার সাথে বরযাত্রীর খাওয়া দাওয়ার খোঁজ নেয়।
বড় বোনের বিদায়ের পালা। বাবা-মা, মিম আর ওর ভাই সবার সামনে পেছনে আত্মীয় স্বজনেরা। বড় বোনকে গাড়িতে তুলে দিবে একটু পরে।
গাড়ির কাছে আসতেই বড়টা মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো হাউমাউ করে। তারপর মিমকে জড়িয়ে ধরলো, ওর কান্নার গতি যেন বেড়ে গেলো শতগুনে। বড় বোন কাঁদতে কাঁদতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মিমকে বললো-“সাবধানে থাকিস, খাওয়া দাওয়া করিস ঠিকমতো।” মিমের বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে, বড়কে কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। চুপ করে থাকে, সারাদিনের খুশি খুশি মুডটা মূহুর্তেই কেমন যেন কষ্টে ভরে যায়।
বোনকে বিদায় দিয়ে মিম ঘরে ফিরে আসে। ভালো লাগছেনা ওর, ঘরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেছে। মনের মধ্যে কিসের যেন শূণ্যতা অনুভব করে ও। ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকায় সেখানে বড় বোনের দখল করা লিপস্টিক, একগোছা নীল রংয়ের চুড়ি, মিমের থেকে জোর করে নেয়া পারফিউমটা, কিচ্ছু নেয়নি বড়। মিমের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, দু ফোঁটা অশ্রু মিমের গাল বেয়ে আসে।
সে রাতে মিম ঘুমাতে পারে না। বিছানায় শুয়ে এপিঠ ওপিঠ করতে থাকে। ওর কানে বাজে বড় বোনের বকবকানি । যা ওর খুব অপছন্দের, কিন্তু আজকে সেই বকবকানিটা খুব মিস করছে ও। কোল বালিসটাকেও আজ একা মনে হচ্ছে বড়বোন থাকলে ওটা তার দখলেই থাকতো, মিম অনেক রিকোয়েস্ট করেও কখনো ওটা নিতে পারতোনা কিন্তু আজকে নেবার জন্য কেউ নেই, মিমেরও ভালো লাগছেনা ওটা নিতে। রাত শেষ হয়ে যায় চারপাশে আজান পরে মিমের চোখ বুজে আসে।
বেলা বারোটায় ঘুম ভাঙে মিমের। সারা বাড়ি কেমন যেন নিস্তব্ধ । চেনা বাড়িটা অপরিচিত লাগে ওর কাছে। বড় বোনের টেবিলের দিকে চোখ পড়ে মিমের, ওর কাছ থেকে অনেকযুদ্ধ করে যে গল্পের বইগুলো নিয়েছিল বড় বোন সেগুলো সাজানো টেবিলে। মিমের বুকের মধ্যে হুহু করে ওঠে। মিম মনে মনে ভাবে বৌভাতের পর বড় বোন এলে আর যেতে দেবে না। ও অপেক্ষা করতে থাকে ……
আজকে মিমের বোন আসবে। বাড়িতে অনেক কাজের চাপ। মিম খুব মন দিয়ে সব কাজ করে। আজকে ওর অনেক ভালো লাগছে বোন দুদিন ছিলো না, বাড়িটা কেমন ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। আজ আবার বাড়িতে অনেক খুশির আগমন। মিম মহানন্দে সাজগোজ করে অপেক্ষা করে কখন আসবে ওরা। আজকে অবশ্য মিমকে বেশী অপেক্ষা করতে হয় না। ঠিক সময়ে গাড়ি চলে আসে। বৌভাত থেকে সবাই ফিরে অনেক ক্লান্ত। মিম বোনের কাছে থাকে। বড় বোন মিমকে এক গ্লাস পানি আনতে বলে, মিম খুশি মনে জগসহ পানি এনে দেয়। বড় বোন স্যুপ খেতে চায় মিম বড় বোনের জন্য স্পেশাল স্যুপ করে দেয়। কারেন্ট চলে গেলে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে দেয়। সারাটাদিন বোনের ফুট-ফরমায়েশ করতে করতে চলে যায়।
সন্ধ্যার পরে সবাই যখন নানারকম গল্পগুজবে ব্যাস্ত মিম তখন সারাদিন পর একটু ফ্রী হয়ে বসেছে ঠিক তখনি বড় বোনের ডাক পড়ে। মিম দৌড়ে যায়, বড় বোনকে বলে- “কি হয়েছে ? ডাকলি কেন?”
বড় বোন আড়মোড়া ভেঙে বলে- “আমার পা দুটো খুব ব্যাথা করছে একটু টিপে দে।” মূহুর্তেই মিমের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, মনে মনে গজরাতে থাকে- “কি পেয়েছে আমাকে? আমি কি মেশিন? দুদিন ছিল না অনেক শান্তিতে ছিলাম। আবার এসেছে আমাকে জ্বালাতে।”
“কিরে কি বলছিস তুই?” একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে বড় বোন। মিম ধমক দিয়ে উত্তর দেয়-“পারবোনা তোর পা টিপতে, তোর পা তুই টেপ।”