– আজকাল তোমার সাথে ইচ্ছে করেও ঝগড়া করা যায়না। তুমি অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছো।
– ওহ আচ্ছা।
– তুমি আমার কোন খোঁজই রাখোনা ইদানিং। কেমন জানি একা একা চলাফেরা করো। আমি যে একটা মেয়ে বাসায় আছি সেদিকে তোমার খেয়াল’ই নেই!
– বুঝলাম।
– তোমার কাছে একটা আবদার করবো, রাখবে?
– বলো দেখি। বড় মুখ করে আগেই কিছু বলার অভ্যাস আমার নেই!
– তুমি আগের মতো হয়ে যাওনা প্লীজ।
– সবাই সারাজীবন একই রকম থাকেনা। এটা বুঝো?
– কিন্তু আমি যে তোমাকে সারাজীবন একই রকম দেখতে চাই।
– সব তো আর চাইলেই হয়না।
.
বিরক্তিকর ব্যাপার। আমার বস বলেছিলো, তুমি যদি হাসিখুশী মেজাজের হও তাহলে তোমার সঙ্গী বলবে, ধ্যাৎ কোন পার্সোনালিটিই নেই। আবার যদি ঠান্ডা মেজাজের হও তাহলে তোমার সঙ্গী বলবে, ধুরু এরকম কোন মানুষ হয়? সারাদিন ঝিমায়। আর স্ত্রীদের ব্যাপারে আলাদা। মোটকথা হলো তুমি যেভাবেই থাকো সেভাবে ভালো লাগবেনা। এ ব্যাপারে আমার কিছু দ্বীমত ছিলো কিন্তু সত্যিই আমার স্ত্রীকে দেখে আমি এখন একমত পোষণ করি এবং সারাক্ষণই বসের কথা মনে হয়। আগে ছোট ছোট ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া হতো। এজন্য বলতো, প্লীজ আমার আর এসব ভাল লাগেনা। পরিবর্তন করো নিজেকে। ইত্যাদি ইত্যাদি। সবসময়ই আরবীকে হাসিখুশী রাখার জন্য মজা করতাম।
.
যার জন্য বেশী কথাও বলতে হতো। আর এজন্য বলতো, অতিরিক্ত কোন কিছুই ভাল লাগেনা। তারপর চিন্তা করলাম আমি এগুলো করিই যেন আরবীর ভাল লাগে আর এতে যদি আরবীর খারপই লাগে তাহলে আমার এসব ত্যাগ করা উচিৎ। নিজেকে শুধরিয়ে নিলাম আস্তে আস্তে। কথা কম বলি। নিজের সব কাজ নিজেই করার চেষ্টা করি সাধ্যমত। কোন বিষয় নিয়ে তর্কে যাইনা। ঝগড়া তো না’ই! এখন আবার এসব ভাল লাগেনা! আচ্ছা আমি করবোটা কি? সত্যি বলতে আমি কখনোই চাইনা যে আরবী চুল পরিমান কষ্ট পাক। আসলে এমনিতেই আরবী অনেক মানসিক যন্ত্রণার ভিতরে আছে। বিয়ের তিন বছর পার হয়ে গেলো এখনো ঘরে আলো জ্বলেনি। সুখের সূর্যটা উঠেনি।
.
হ্যাঁ বাবু। একটি বাবু। বিয়ের পর থেকে আরবীর একের পর এক অসুস্থতা লেগেই আছে। ডাক্তার এটা বলে, ওটা বলে! সব সমস্যা এক হয়ে সূর্যটা উঠছেনা। আরবীকে দেখে বুঝতে পারি একটা মেয়ের তাঁর সন্তানের প্রতি কি ভালবাসা আর স্বপ্নই না থাকে! সবসময়ই বলে, আচ্ছা এই ভাবী, ঐ ভাবীর বাবুটা এতো তারাতারি বড় হয়ে গেলো কেনো? বাবুরা যে কেন বড় হয়ে যায়! জানো বাবুরা বড় হয়ে গেলে আমার একদম ভাল লাগেনা। উত্তরে কিছু বলতে পারিনা আমি। আসলে সব কিছুই আল্লাহ্‌র হাতে। উনি যা চান তা’ই হয়। যা চাননা তা হয়না। কোনো ভাবেই হয়না। উনার ইচ্ছাতেই হয়তো আমাদের ঘরে সূর্যটা উঠছেনা।
.
কোন জায়গায় বেরোলে যদি কোন বাচ্চা দেখে তাহলে সেখান থেকে আর আসতে চায়না। বাচ্চাদের নিয়ে কখনো আমি ভারী কথা বলিনা। কারন এই একটা ব্যাপারে আমার মাফ নেই। আমাকে তো কিছু বলবেনা। কাঁদবে আর কাঁদবে। কাছে গেলে আরো বেশী কাঁদবে। কোন ভাবেই পরে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা। ঘুমানোর আগে বলে, আচ্ছা আমাদের দুজনের মাঝে একদিন আরেকজন শুবে না? ছোট ছোট হাত-পা থাকবে। আমাকে ধরবে, তোমাকে ধরবে সেই ছোট ছোট হাত দিয়ে। আমি মাথা নাড়িয়ে আরবীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ঘুম পারিয়ে দেই। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে ভাবি। আমাদের স্বপ্নটা কি পূরণ হবেনা? আসলে যাদের ধন সম্পদ সবই আছে কিন্তু কোন সন্তান নেই।
.
তাদের আসলে কিছুই নেই। তাঁরা শুন্য। আর যাদের কিছুই নেই কিন্তু সন্তান আছে তাদের সবই আছে। তবে সব সন্তানদের মধ্যে কিছু কুলাঙ্গার সন্তানও হয়। আরবী বলে, তুমি জানো আজকের বাবু আগামি দিনের কাজী নজরুল ইসলাম। আগামি দিনের সাকিব আল হাসান। আগামি দিনের ইনি, তিনি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই প্রত্যেকটা বাবুকে ছোট থেকেই ধার্মিক শিক্ষা দেওয়া উচিৎ। সব বাবুদের কপালে শিক্ষা দূরের কথা আদরই জুটেনা রাস্তাঘাটে বড় হতে হয়। যতবার আরবীকে নিয়ে পার্কে বা কোথাও ঘুরতে গিয়েছি। ততবারই কোন না কোন বাচ্চাকে সাথে নিয়েই খেতে হয়। বাচ্চা বলতে কিন্তু অতোটা ছোটও না চলাফেরা করতে পারেনা! শুবার ঘর থেকে শুরু করে রান্নাঘর পর্যন্ত।
.
সবখানেই বাবুদের ছবি টাঙ্গানো। কোন ছবির উপরে ধুলো ময়লা পরতে দেয়না। সারাদিন বাবুদের সাথেই সময় কাটে। আমার কাছে মনে হয় আসমানের চাঁদ এনে দিলে আরবীকে তত খুশী হবেনা যত খুশি না বাবুদের জিনিষপত্র আনলে খুশি হয়। ফিডার, পায়ের জুতো ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বাসায় কোন বাবু নেই! তবুও বাহির থেকে কিছু আনলে এগুলোই আনি। আসলে কোন সংসার পরিপূর্ণ হয়না বাবু ছাড়া, সন্তান ছাড়া। বিয়ের আগে কারো সন্তান হয়েছে। এজন্য কোন অনুষ্ঠান বা পার্টির কথা শুনলে আমার বিরক্ত লাগতো। বিয়ের পরে বুঝেছি। কারো সন্তান হবে। এর থেকে খুশীর খবর আর কি হতে পারে? একটা পরিবারে স্বর্গ নামে যখন আল্লাহ্‌র দয়াতে ঘরে নতুন সদস্য আসে।
.
ফেসবুকে একজন আপুকে আমি বলেছিলাম, আমার জাপানী বাবু ভাল লাগেনা। উনি বলেছিলেন, এহ.. আমার মেয়ে আমার জান। আসলে উনার দুই ছেলে সন্তান দেখতে বাঙ্গালীদের মতোই কিন্তু মেয়ে হয়েছে কিছুটা জাপানীজদের মতো। ব্যাপারটা কত মধুর না? মায়ের কাছে সন্তান জাপানীজদের মতো দেখতে হোক আর নিগ্রোদের মতো দেখতে হোক। মায়ের কাছে ঠিকই জান। বাবাদের ব্যাপারে ভিন্ন নয় কিন্তু! অফিষ শেষ। বাসার যাওয়ার জন্য রওনা দিলাম। দরজার সামনে এসে মনে পড়লো আরবীর জন্য কিছু আনা হয়নি! এজন্য মন খারাপ করবে। ভয়ে ভয়ে কলিং বেল চাপলাম। দরজা খুললো ছোট বোন। ভীতরে গেলাম। বাসাটা আজকে শান্ত শান্ত লাগছে।
.
ছোট বোনকে বললাম, কিরে পেত্নী কাহিনী কি রে? ছোটবোন বললো, একটা খুশীর খবর আছে। কিন্তু টাকা না দিলে বলবোনা। এবারের টাকা দিয়ে কিন্তু আমি আমার জন্য শপিং করবোনা। অন্য কারো জন্য শপিং করবো। আমি ভাবলাম পেত্নীর বিয়ে ঠিক হলো নাকি? নিজের বিয়ের কথা কেউ এভাবে বলে? যেহেতু খুশীর খবর বললো সেহেতু পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে দিলাম। পেত্নী বললো, এতে হবেনা। আমি আরেকটা নোট বের করে দিলাম। তারপর বললাম, এবার তো বলবি খুশীর খবরটা কি? পেত্নী শুধু বললো, আমি ফুফু হবো হুররে। বলেই সামনে থেকে চলে গেলো। মাথায় কিঞ্চিৎ পরিমাপে বজ্রাহত হলো। দৌড় দিয়ে রুমে গেলাম।
.
আরবীকে দেখে আরো অবাক হলাম। বিয়ের পরে মনে হয় আজকে আবার এই রুপে দেখলাম। আসলে সাজুগুজোর প্রতি আরবীর কোন ঝুঁক নেই বললেই চলে। আমি আরবীর হাত ধরে বললাম, পেত্নী যা বললো সত্যি? আরবী মুচকি হাসলো। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়েই বললো, কি মনে হয়? আমি বললাম, বলো তো প্লীজ! আরবী বললো কোলে নাও। আমি বললাম, আগে বলো সত্যি কি না? আরবী বললো, আল্লাহ্‌র দয়াতে সূর্যটা এবার উঠবে মনে হয়। হ্যাঁ সত্যি। কথাগুলো বলার সময় যে হাসিটা আরবীর চোখে মুখে সে হাসি কোন গর্ববতী মা ছাড়া কোন মেয়ে হাসতে পারেনা। সারাজীবন নতুন করে বেচে থাকার অনুপ্রেরণার হাসি। আমি বাবা হবো।
.
এরচেয়ে খুশীর খবর কি হতে পারে? কোলে নিলাম। আরবী বললো, এবার নামাও। আমি বললাম, না আজকে তোমাকে কোল থেকে নামাতে ইচ্ছে করছেনা। আরবী বললো, হুহ নামাও তো। যদি আমার বাবু ব্যাথা পায়? আমি রাগী চোখে আরবীর চোখে তাকালাম, তোমার বাবু মানে? আরবী বললো, আমি মানেই আমাদের। তুমি আর আমি একই তো নাকি? আমি হাসলাম। আরবী বললো, শুনো তুমি আজ থেকে কম কাজ করবে। এতো বিজি বিজি দেখাবেনা। আমার এতো টাকা পয়সা চাইনা। যা আছে তা যথেষ্ট। আমি চাই তুমি বাবুকে সময় দাও। বাবার স্নেহ ভালবাসা যেন পায় ঠিকমতো। আমি মাথা নাড়ালাম। আরবী বললো।
.
কি এতো মাথা নাড়াচ্ছো? শুনো যদি ছেলে বাবু হয় তাহলে নাম রাখবো সূর্য আর মেয়ে হলে আলো। আমি আবারো মাথা নাড়ালাম। আসলে আমার মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছিলোনা। এরকম সুখের মুহুর্ত জীবনে আসবে ভাবতে পারেনি। তারপর বললাম, তুমি যা বলো তা’ই হবে। আরবী একটু চোখ উঁচু করে বললো, এই তুমি আমার সব কথা মেনে নিচ্ছো কেন? তুমি কিছু বলো। চলো আমরা বাবুর নাম নিয়ে ঝগড়া করি? আমি বললাম, নাহ আমার দ্বারা সেটা সম্ভব না। তুমি যা বলো সেটাই হবে। আরবী মুখ ভেংচিয়ে বললো, হুহ কি পিরিত….!