একটা বছর….!
১সংখ্যাটি শুনতে ক্ষুদ্র মনে হলেও ১২ টা মাস আশায় বুক বেধে কাটিয়ে দিয়েছে মুনিরা । এই ১বছরে না পেয়েছে আফরানের ভালোবাসা না পেয়েছে তার বন্ধুত্ব । তবুও যেনো বুকে শত আশা মুনিরার। কিসের উপর ভিত্তি করে? বৈধ সম্পর্কের উপর নাকি ভালোবাসার উপর? হুম, আফরান চাইলেও অস্বীকার করতে পারেনা মুনিরা তার বিয়ে করা স্ত্রী। বৈধ সম্পর্কে আবদ্ধ আছে তারা। আর ভালোবাসা? সম্পর্কের টানেও ভালোবাসা যায় নিজে এই পরিস্থিতিতে না পড়লে কখনো হয়তো বুঝতোই না সে। নাহলে এতো কিছু ঘটে যাবার পর বিশেষ করে আফরান তাকে ভালোবাসে না জেনেও এই বাড়িতে পড়ে থাকার কোনো মানে হয়!
সায়নী তো বলেছিলো আফরান তাকেও ঠিক ভালোবাসবে একদিন। মুনিরার ভালোবাসা তো মিথ্যে নয়, তার সম্পর্কের বাঁধনও মিথ্যে নয়। তাহলে কেনো এতো দুরুত্ব তাদের মাঝে! শুধুমাত্র সায়নীর জন্য? আফরানের কাছে সে সায়নীর জায়গা কখনো চায়নি বা চায়বেনা। আফরান কি পারেনা তার জন্য একটি জায়গার বন্দবস্ত করতে তার মনের গহীনে?
নিজের মনে এসব কথা ভেবে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো মুনিরা। অনিশ্চিত জীবন নিয়ে হয়তো সারাজীবন এভাবে ভেবেই আশায় কাটাতে হবে দিন তার। তবুও সে আফরান কে ছেড়ে যেতে রাজী নয়। কেনোই বা যাবে! যেভাবেই হোক বিয়েটা তাদের হয়েছে। আফরানের দ্বিতীয় স্ত্রী হলেও স্ত্রী সে!
এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা বেজে উঠলো মুনিরার। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো মায়ের ফোন এসেছে। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুবিন্দু মুছে নিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো সে-
হ্যালো আম্মা আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়া আলাইকুমুসসালাম।
-ভালো আছো?
-মেয়ের অশান্তি দেখে নিজে কেমনে ভালো থাকি বল?
-আমার কিসের অশান্তি!
-স্বামীর ভালোবাসা ছাড়া কোনো স্ত্রী শান্তিতে থাকতে পারেনা মুনিরা।
-উনি আমায় ভালোবাসেন মা।
-আচ্ছা তাই! তাহলে এখনো তোর গলা এমন ভেজা ভেজা কেনো?
.
মায়েদের কাছ থেকে বুঝি কিছু লুকানো যায়না সহজে! যেদিন থেকে তার মা শুনেছেন, সে এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেদিন থেকেই তিনি এই সিদ্ধান্তের সাথে সহমত নয়। পৃথিবীর কোনো মেয়ে যেটা মানতে পারবেনা সেটা নিজের মা-ই বা কি করে মানতে পারবে!
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে
মুনিরা বললো-
তুমি আমাকে নিয়ে এতোটা চিন্তায় থাকো কেনো আমি বুঝিনা!
-চিন্তায় কি সাধে থাকি রে মা!
যাক যেটা বলতে ফোন দিছি তোকে, তোর বাবা তোর জন্য এবার আফরানের চেয়েও সুন্দর ছেলের প্রস্তাব আনছে।
-উনার সৌন্দর্য্য বা অর্থের জন্য আমি এখানে পড়ে থাকিনি আর কতোবার বলতে হবে তোমাদের!
-আরে শুন! আমাদের পাশের গ্রামের চেয়ারম্যান এর ছোট ছেলেরে তুই চিনিস না? বেচারার বউ তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তোদের বিয়ে হলে একজন অপরজনকে ঠিক বুঝবি। এবার আর অমত করিস না মা। ওই মায়া জাল থেকে বের হয়ে আয়।
-চুলোয় রান্না বসিয়েছিলাম। গেলাম আমি। পরে কথা হবে।
.
ফোনের লাইন কেটে বিছানার উপরে বসে পড়লো মুনিরা।
এতোক্ষণ চোখের কোণে পানি আসলেও তা এখন গাল বেয়ে বেয়ে পড়ছে তার। নিজের মা যদি তাকে না বুঝে কাকে বোঝাতে যাবে এই দুঃখ সে!
অবশ্য তারই বা দোষ কোথায়?
নিজের মেয়েকে কে অনিশ্চিত জীবনের মুখে ঠেলে দিতে চায়!
.
.
.
ওপাশ থেকে মুনিরা ফোন কেটে দিয়েছে দেখে হতাশ হয়ে ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে সোফার উপরে বসে পড়লেন সেনোয়ারা বেগম।
সায়নীকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাবার পরেই তারা তাদের বিয়ে সম্পর্কে জানতে পেরেছিলো মুনিরার কাছে। সায়নীকে আগেই পছন্দ ছিলোনা সেনোয়ারা বেগমের। তার কার্যকলাপ তার খুব একটা ভালো লাগতো না। কিন্তু তার ধারণের বাইরেও যে তারা এতো বড় একটা কান্ড আগে থেকে ঘটিয়ে রেখেছে জানতে পেরে হতবাক হয়ে যান তিনি। সায়নী আফরানের স্ত্রী কথাটি মানতে তিনি যত না অবাক হয়েছেন তার চেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছে নিজের মেয়ে মুনিরার জন্য। প্রথমে বিয়ের দিনই হবু বর ইন্তেকাল করলো আর পরে যাকে বিয়ে করলো তার নাকি আগেই বিয়ে হয়েছে একবার এবং সে স্ত্রী একই ঘরে থাকে তারই সাথে। এতোবড় ধোঁকা! কই! আফরান কে তারা জোর করেনি মুনিরাকে বিয়ে করতে। তাহলে সে কেনো এই বিয়েটা করেছে? বিয়ে মানে তো আর ছেলেখেলা নয়!
যেদিন থেকেই আফরান আর সায়নীর ব্যাপারে সবটা জানতে পেরেছেন তিনি সেদিন থেকেই মুনিরাকে বুঝিয়ে চলেছেন এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে। পৃথিবীতে কি ছেলের অভাব পড়েছে! কেনো এই ছেলের জন্য নিজের জীবনটা খারাপ করবে সে! তার কোনো কথা মুনিরা শুনেনি। বরং সায়নীর কথা মাথায় রেখেছে। সায়নী তাকে বলেছে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। এই মিথ্যে আশায় মুনিরা একটা বছর পার করে দিলো কিন্তু ফলাফল শূন্য! তার মেয়েটা কি কখনো সুখের দেখা পাবেনা?
.
রুমের ভেতর প্রবেশ করে স্ত্রীর মুখ দেখতে পেয়ে মুনিরার বাবা নুরুল আলমের আর বুঝতে বাকি রইলো না কি হয়েছে।
-নিশ্চয় মুনিরা এই প্রস্তাবেও রাজি হয়নাই?
.
তার দিকে না তাকিয়ে সেনোয়ারা বেগম জবাব দিলেন-
মেয়েটা নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মারছে।
-আফজালের সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে হবে। সে যদি বোঝায় তাহলে হয়তো মুনিরা বুঝতে পারে। তোমার কি মনেহয়?
-তুমি যা ভালো মনেহয় করো। আমি শুধু আমার মেয়েটারে সংসারী দেখতে চাই, সুখী দেখতে চাই।
-মানুষ এক জীবনে সব পায়না সেনোয়ারা। তোমার মেয়ের খুশি আফরানের বাড়িতেই তার ভালোবাসা না পেলেও।
.
স্বামীর কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে নিজের মনে ভাবতে থাকলেন সেনোয়ারা বেগম-
তাহলে এমন কিছু কি করতে হবে? যাতে আফরান তার প্রাপ্য সুখ দিতে বাধ্য হয় মুনিরাকে?
.
.
.
আফজাল খানের শরীরটা প্রায় খারাপ থাকে ইদানিং। কোমর ব্যথা, পিঠে ব্যথা, হাঁটতে অসুবিধা, শরীরটা মেষ মেষ করা এসব যেনো প্রতিদিনের সঙ্গী তার। তবুও যে বড় ধরনের কোনো অসুবিধে হচ্ছেনা এটাও কম কি! অবশ্য সারাক্ষণ সেবার উপরেই থাকছেন তিনি।
-বাবা আসবো?
.
মুনিরার ডাকে সাই দিয়ে আফজাল খান বললেন-
হ্যাঁ আসো।
.
এক কাপ গরম চা টেবিলের উপর রেখে তার পাশে বসে মুনিরা বললো-
আজকের চা টা আমি বানানোর সৌর্ভাগ্য অর্জন করলাম।
.
তার কথায় মুচকি হেসে আফজাল খান বললেন-
হাসপাতাল থেকে কোনো খবর এসেছে?
-না এখনো আসেনি।
-আফরানকে একটা ফোন দিয়ে দেখতে পারো। সে হয়তো ওখানেই থাকবে।
-জ্বী আমি রুমে গিয়ে দিচ্ছি। ফোনটা ওখানেই।
-আচ্ছা।
.
.
নিজের রুমে এসে ফোন হাতে নিলো মুনিরা। হাসির মায়ের শরীরটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেলো। হাসির একার পক্ষে ডাক্তার নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা সম্ভব নয় বলেই আফজাল খানের কথামতো আফরান তার দায়িত্ব নেয়।
আফরানের ফোন নাম্বার ডায়েল করে মুনিরা কল দিলো।
একবার রিং হতেই আফরান রিসিভ করে বললো-
হ্যাঁ বলো মুনিরা?
-ভালো আছেন?
-উহু! দৌড়াদৌড়ির উপর আছি।
-খালার শরীরটা কেমন?
-ভর্তি করাতে হয়েছে হাসপাতালে।
-বলেন কি! সিরিয়াস কিছু?
-তেমন কিছুনা। স্যালাইন দেয়া হয়েছে তাকে। শরীরটা দূর্বল।
– আমি আসবো আপনাদের জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে?
-না থাক। রেস্টুরেন্ট এ গিয়ে খেয়ে নিবো।
-আমি থাকতে রেস্টুরেন্ট কেনো! বাইরের খাবার তো…
-হুম জানি। বাইরের খাবার সে একদমই খেতে পছন্দ করেনা। ঠিক আছে আমি আসবো।
খাবার রেডি করে রেখো। হাসপাতালে আমি নিয়ে আসবো খাবার চিন্তা করোনা। তোমার বাবার কাছে থাকা উচিত।
-আমি খালাকে দেখবো না?
-নিশ্চয় দেখবে। কাল এসো তুমি।
-ঠিক আছে।
.
ফোন রাখার পরে মুনিরা আবারো ছুটে গেলো আফজাল খানের রুমের দিকে।
.
.
-বাবা? খালাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। আর উনি দুপুরের খাবার নিতে আসবেন বাসায়।
-আচ্ছা। তুমি তৈরী করে নাও।
.
আফজাল খানের রুমের দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল ১১টা বাজতে আর ১০মিনিট বাকি। দ্রুতবেগে মুনিরা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।
.
.
.
যোহরের আযান দিয়ে দিলো। কিন্তু মুনিরা এখনো রান্নাঘরের কাজেই ব্যস্ত।
ঝটাপট হটপটে খাবার ঢুকিয়ে নিলো মুনিরা। একবার ভাবলো গোসলটা সেরে নিবে। আবার ভাবলো আরেকটু অপেক্ষা করলেই হয়, আফরান যদি চলে আসে! ভাবতে ভাবতেই কলিং বেল এর শব্দ বেজে উঠলো। মুনিরা ছুটে এসে দরজা খুলে দেখা পেলো আফরানের।
ইশ! বেচারা ঘেমে গিয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে।
তার অবস্থা দেখে মুনিরা বললো-
এ কি! এই অবস্থা কেনো আপনার?
.
ভেতরে প্রবেশ করতে করতে আফরান জবাব দিলো-
বলেছিলাম দৌড়াদৌড়ির উপরে আছি।
-হুম।
-খাবার তৈরী আছে?
-হ্যাঁ সব তৈরী।
-আমি গোসল সেরে নামাজ আদায় করে আসছি।
.
আফরান নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই মুনিরা রান্নাদিকের দিকে ছুটলো আফরানের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে।
.
.
নামাজ সেরে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসেই ডাইনিং রুমে টেবিল সাজানো দেখতে পেয়ে চেয়ারে বসা মুনিরাকে জিজ্ঞাসা করলো আফরান-
আমার জন্য এসব?
-হু।
-আমি চেয়েছিলাম ওখানে খাবো।
-এসেছেন যখন এখানে খেয়ে নিলেই হয়।
.
কিছুক্ষণ চুপ থেকে চেয়ার টেনে বসে পড়লো আফরান। একটা প্লেট নিয়ে এক চামচ ভুনাখিচুড়ি ও মুরগির একটা পিচ নিয়ে খেতে লাগলো সে। তা দেখে মুনিরা বললো-
এতো কম খাবার?
-আবার খাবো ওখানে।
বাবাকে দিয়েছো?
-হ্যাঁ দিয়ে এসেছি।
-তুমি খেয়েছো?
-না আমি গোসলই সারতে পারিনি।
-ওহ।
.
মুনিরা আশা করেছিলো আফরান নিজের সাথে তাকে খেতে বলবে। কিন্তু এমন কিছুই আফরান বললো না। খাওয়া শেষ করে সে মুনিরার উদ্দেশ্যে বললো-
খাবার গুলি ডাইনিং টেবিলে এনে রাখো। আমি বাবার সাথে দেখা করে এসেই বেরিয়ে যাবো।
-হু।
-আর শুনো?
-হুম?
-তুমিও খেয়ে নিও।
.
.
.
-হ্যালো ওল্ড ম্যান!
.
আফরানের ডাকে শোয়া থেকে উঠে বসলেন আফজাল খান। তিনি হেসে বললেন-
হাই ইয়াং ম্যান! কি অবস্থা তোর? একা এসেছিস?
-হ্যাঁ।
-হুম হাসির মায়ের পাশে থাকাটা দরকার। বিশ্বস্ত মহিলা সে। নিজের সংসারের মতো এই সংসারটাও আগলে রেখেছিলো। নিজের বোনের জায়গা দিয়েছি তাকে।
-তাহলে তাকে ফুফু ডাকা উচিত খালা না ডেকে।
.
বলেই হো হো শব্দে হেসে উঠলো আফরান। আফজাল খান মৃদু হেসে বললেন-
খাবার নিতে এসেছিস না? যা এখন, দেরী হয়ে যাচ্ছে।
-হু যাচ্ছি।
.
.
.
বাসার কাজ, গোসল ও নামাজ সেরে নিতে মুনিরার দুপুর ৩টা বেজে গেলো।
খেতে ইচ্ছে না করলেও আফরানের বলা কথাটি তার মনে পড়লো।
“তুমিও খেয়ে নিও।”
এমন ছোট ছোট কথাগুলোও যেনো আফরানের মুখ থেকে শুনতে ভালো লাগে মুনিরার।
এটাই কি তবে ভালোবাসা?
ভীষণভাবে মিস করছে সে আফরানকে। আফরান অফিস থাকাকালীন তাকে মিস করলে তার রুমে গিয়ে হেঁটে আসে মুনিরা। আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। আফরানের রুমে থাকার অধিকার না পেলেও হেঁটে আসার অধিকার সে ঠিকই পেয়েছে!
.
আফরানের রুমে প্রবেশ করতেই বিছানার উপরে তার শার্ট টা দেখতে পেলো মুনিরা। এই শার্ট পরেই সে সকালে হাসপাতালে গিয়েছিলো। এখন তা বদলে আরেকটি পরেছে।
বিছানার উপর থেকে শার্ট টা নিয়ে তাতে নাক ডুবালো মুনিরা। আফরানের শরীরের ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টায় মগ্ন সে। এই কাজ টা যে এই প্রথম করছে এমন নয় কিন্তু! প্রায় করে সে এমন তবে লুকিয়ে।
কিছুক্ষণ এভাবে কাটানোর পর সে ভাবলো শার্ট টা গোসলের আগে দেখলে ধুয়ে দিতে পারতো।
আবার ভাবলো, গোসল করেছে তাতে কি! স্বামীর কাজ সবসময় করা যায়। এখন ধোয়া যেতেই পারে, পরে না হয় খেয়ে নিবে।
আর না ভেবে মুনিরা এগিয়ে গেলো ওয়াশরুমের দিকে।
.
.
.
বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যে এসে গেলো।
একবার কি ফোন দিকে দেখবে ওদিকের কি অবস্থা? ভাবতে ভাবতেই কলিং বেলের শব্দ কানে এলো মুনিরার।
দরজার পাশে এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিয়ে দেখা পেলো প্রিয় মানুষের।
মুখে হাসি ফুটিয়ে মুনিরা বললো-
এসেছো তুমি!

মুনিরার প্রিয় কয়েকজন মানুষের মাঝে সায়নীও একজন। আর দরজার ওপাশে রয়েছে সায়নী।
মুনিরার উদ্দেশ্যে মিষ্টি হাসি দিয়ে সায়নী বললো-
হু আসলাম।
.
সায়নী ভেতরে প্রবেশ করলেও মুনিরা তাকিয়ে থাকলো দরজার বাইরে।
পেছনে ফিরে মুনিরাকে দেখে হেসে উঠলো সায়নী। মুনিরা অবাক চোখে তাকিয়ে বললো-
হাসছো কেনো আপু?
-এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেই হয় আফরান কোথায়।
-না মানে দেখছি নাতো, একসাথেই তো আসার কথা।
-একসাথেই এসেছি বাবা! গাড়ি পাকিং করছে।
-ওহ তাই বলো!
-হু।
-খালা ভালো আছেন?
-হ্যাঁ ভালো আছেন। তবুও আজ রাত ওখানেই রাখছি। হাসি আছে সাথে।
-হুম ভালোই করেছো।
-আমার জন্য একটু চা করে দিবি? গোসলটা সেরে আসছি আমি।
-আচ্ছা।
.
সায়নী রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই আগমন ঘটলো আফরানের। তাকে দেখে মুনিরা বলে উঠলো –
চা খাবেন তো আপনি?
-কেনো নয়!
.
.
.
চুলে তোয়ালে প্যাচিয়ে সালোয়ার কামিজ পরে ওয়াশরুম থেকে গোসল সেরে বেরিয়ে আসলো সায়নী। তার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে আফরান বললো-
সে এমন একটা মেয়ে, যে পাহাড় কাটলেও মনেহয় তার মুখে ক্লান্তির ছাপ পড়বেনা। অবশ্য অপ্সরী সর্বদা অপ্সরীই থাকে।
.
ভ্রু জোড়া কুচকে সায়নী জিজ্ঞাসা করলো-
কার কথা বলছো?
.
সোফা ছেড়ে উঠে সায়নীর পাশে এসে মাথায় প্যাচানো তোয়ালে খুলতে খুলতে আফরান বললো-
তোমার।
.
মৃদু হাসলো সায়নী।
এদিকে আফরান তার ভেজা চুলের মাঝে মুখ ডুবোতে দেরী করলো না।
সায়নীর ভেজা চুলের স্পর্শ আফরানের কাছে বৃষ্টির ফোটার মতো মনেহয়। এই বৃষ্টিতে যেনো সারাদিন ভিজলেও শান্তি!
-শুরু হয়ে গেলো! মুখে ক্লান্তির ছাপ দেখা না গেলেও বড্ড ক্লান্ত আমি। ছাড়ো এখন, চা খেয়ে আসি।
-উহু!
-কিসের উহু ফুহু! ছাড়ো তো আফরান!
.
কে শুনে কার কথা! সারাদিন দৌড় ঝাপের পর সায়নীকে কাছে পেয়ে যেনো সব ক্লান্তি ভুলে গিয়েছে আফরান। তাই তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রয়েছে সে। এতোটা সুখ কেনো এই মেয়েটার মাঝে!
.
-আপু হলো তোমাদের?
.
মুনিরার ডাক কানে আসতেই আফরান ছেড়ে দিলো সায়নীকে। সায়নী হাসতে হাসতেই বললো-
চলো এখন।
-রাতে পুষিয়ে দেবে কিন্তু?
-সে দেখা যাবে।
.
.
.
ডাইনিং টেবিলে চা এবং নাস্তা সাজিয়ে রেখেছে মুনিরা। সায়নী ও আফরান একইসাথে এসে বসলো চেয়ার টেনে। গরম গরম নুডলস দেখে সায়নী বলে উঠলো-
এটার দরকার ছিলো খুব বেশি!
.
সায়নী এক বাটি নুডলস নিয়ে খাওয়া শুরু করলে আফরানের উদ্দেশ্যে মুনিরা বললো-
আপনি খাবেন না?
-আমার দু’বার ভাত খেতে হয়েছে। একবার এখানে আরেকবার হাসপাতাল সায়নীর সাথে। আচ্ছা তোমরা থাকো। চা টা রুমে নিয়ে গেলাম আমি। কিছু কাজ আছে।
.
আফরান চলে যেতেই সায়নী বললো-
তোর আজ অনেক কষ্ট হয়েছে তাইনা? একা সব সামলাতে হয়েছে।
-নিজের সংসারের কাজ করতে কিসের কষ্ট!
.
নিজের সংসার! কথাটি শুনে বুকে হালকা ব্যাথা অনুভব করলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে সায়নী বললো-
হুম সেটাও ঠিক। বাবা ভালো আছেন?
-হ্যাঁ আছেন।
.
.
খাওয়া শেষ করে সায়নী পা বাড়ালো আফজাল খানের রুমের দিকে।
আফজাল খানকে বিছানার উপরে বসে বই পড়তে দেখে সে বললো-
আমি এখন আসলে কি তোমার বই পড়ার ডিস্টার্ব হবে?
.
বই টা একপাশে রেখে তিনি জবাব দিলেন-
হবে বললেও তুই না এসে থাকবি?
.
ভেতরে প্রবেশ করে দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে সায়নী বললো-
ঠিক বলেছো। তা তোমার কোনো অসুবিধে হয়নি তো? নিশ্চয় আমার হাতের চা অনেক মিস করেছো? বানিয়ে আনবো এখন?
-তোকে মিস করেছি কিন্তু চা মিস করিনি। মুনিরার হাতে বানানো চা একেবারেই তোর মতো। একসাথে থাকতে থাকতে তোর মতো অনেক কিছুই পারে সে।
.
আফজাল খানের কথা শুনে সায়নীর মুখের হাসি যেনো বিলীন হয়ে গেলো।
কথা না বাড়িয়ে সে বললো-
আমি এখন আসি। ক্লান্ত লাগছে।
-হুম আয়।
.
.
রুম থেকে বেরিয়ে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেললো সায়নী।
এমন টাতো হবার কথা ছিলোনা! উন্নত চিকিৎসার জন্য আফরানের সাথে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলো সায়নী। আল্লাহর অশেষ রহমতে সে সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছে। মুনিরাকে দেয়া কথা সে রেখেছে। কিন্তু আফরান মুনিরার সাথে এখনো সহজ হতে পারেনি। শুরুর দিকে মুনিরার দিকে আফরানকে ঠেলে দিতে চাইলেও ধীরেধীরে থেমে যায় সায়নী। কারণটা কি তা সে নিজেও জানেনা। তবে একটা কথা ঠিকই জানে। নিজের সব কিছু অন্য একটা মেয়েকে শেয়ার করা গেলেও স্বামী যায়না! আবার এটাও অমান্য করা যাবেনা মুনিরাও আফরানের স্ত্রী।
হয়তো বা কোনো একদিন আফরান ও তার মাঝে সবটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সেদিন ঠিকই সবটা মানতে হবে তার। এটাও ভুলে গেলে চলবেনা, মুনিরার বাবার জন্যই আফরান আজ তার হয়েছে। কেননা ছোট বেলায় পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচায় আফরান কে মুনিরার বাবা। আবার মুনিরার জন্য আজ সায়নী জীবিত রয়েছে। নাহলে সেদিনই হয়তো গাড়ির চাপায় প্রাণ হারাতো সে! তাছাড়া সমস্ত কিছুর উপরে বড় সত্য যেটা তা হলো, মুনিরাও আফরানের স্ত্রী!
মাথা থেকে সমস্ত খারাপ চিন্তা বের করে সায়নী বিড়বিড় করে বললো-
আমাকে শক্ত থাকতে হবে। মুনিরার অধিকার থেকে আমি ওকে বঞ্চিত করতে পারিনা!
.
.
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে টিভি দেখছে মুনিরা। তার পাশে এসে বসলো সায়নী।
মুনিরা বাংলা মুভি দেখতে অনেক পছন্দ করে। সায়নীর তা খুব একটা ভালো না লাগলেও মাঝেমাঝে মুনিরাকে সঙ্গ দিতে তার পাশে বসে।
বাংলা সিনেমা দেখলে অন্য কোথাও মনোযোগ দেয়না মুনিরা।
সায়নী যে তার পাশে এসে বসেছে খেয়ালই করেনি সে।
সায়নী হেসে বলে উঠলো-
আমিও এসেছি তোর সাথে ফিল্ম দেখার জন্য।
-ওহ আপু তুমি!
-ফিল্মের নাম কি রে?
-এক টাকার বউ।
-এক টাকার বউ বলতে? কাবিননামা এক টাকা?
.
সায়নীর প্রশ্ন শুনে মুনিরা তাকে সিনেমার কাহিনী শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সে নাকি আগেও এই সিনেমা দেখেছে। এদিকে মনোযোগ সহকারে কাহিনী শুনে চলেছে সায়নী, মাঝেমধ্যে উচ্চ শব্দে হেসে উঠছে। মুনিরার বলার ধরণ খুব ভালো। ইমোশনাল সিনের কথা এমন ভাবে বলবে যে কেউ কাঁদতে বাধ্য হবে। আবার হাসির সিনের কথা এমনভাবে বলবে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে বাধ্য হবে মানুষ।
সায়নী খুব এনজয় করে এসব ব্যাপার গুলো।
.
.
ড্রয়িং রুম থেকে সায়নী ও মুনিরার কথা-হাসির শব্দ ভেসে আসছে আফজাল খানের কানে।
মৃদু হাসলেন তিনি। কেউ দেখলে তাদের সতীন বলেনা। বলে তারা একই মায়ের পেটের বোন! নাহলে দুইটা মেয়েই যেভাবে সংসারটা আগলে রেখেছে অন্য কোনো মেয়েদের পক্ষে এসব সম্ভব নয় এই যুগে।
সায়নী যখন আফরানের সাথে বিদেশ গমন করে, মুনিরা দিন রাত এক করে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছে সায়নীর সুস্থতা কামনা করে। তার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো সায়নীর মৃত্যুও কামনা করতে পারতো।
আল্লাহর অশেষ রহমতে সায়নী সুস্থ হয়ে আসে। মুনিরাকে দেয়া নিজের কথা রাখে সে। যেতে দেয়নি তাকে এই বাড়ি ছেড়ে।
সায়নীর সাথে ঘটা করে আবারো বিয়ে দেয়া হয় আফরানের। লোক সমাজ নানা কথা বললেও ধার ধারেননি আফজাল খান না ধার ধেরেছে সায়নী ও মুনিরা। তখন থেকেই এই দুই সতীন দুই বোনের মতো আছে। কিন্তু পরিবর্তন হয়নি আফরানের মাঝে। অন্য কোনো ছেলে হলে হয়তো প্রথম বউ এর অনুমতি পাওয়ার পরেই দ্বিতীয় বউ কে সহজে আপন করে নিতো। তবে আফরান এই ১বছরেও মুনিরার সাথে সম্পর্ক টা আগাতে সক্ষম হয়নি৷
হয়তো বা কোনোদিন পারবে! এই আশায় আছেন তিনি সাথে মুনিরাও।
.
.
.
সারাদিন হাসপাতালে কাটানোর ফলে সায়নীর শরীরটাও ভালো লাগছে না। তাই আজ সে মুনিরার পাশে বেশিক্ষণ না বসে এগিয়ে গেলো নিজের রুমের দিকে।
অফিসের কাগজপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি তে ব্যস্ত আফরান।
সায়নী তার পাশে বসে বললো-
কি করে সারাদিন এসব করতে ভালো লাগে তোমার? আজ সারাদিন হসপিটালে দিন চলে গিয়েছে। এখন অন্তত রেস্ট নাও।
.
সায়নীর কোলে মাথা রেখে আফরান বললো-
তুমি বললে ঘুমিয়েও যাবো।
-না এখন ঘুমোতে হবেনা। ভাত খেয়েই ঘুমোবে তুমি।
-আজ না একটুও খাবার খেতে ইচ্ছে করছেনা।
-মুনিরা এতো কষ্ট করে রান্না করেছে খাবেনা কেনো!
-তোমার হাতের রান্না বললে অল্প হলেও খেতাম।
-ঠিক আছে সরো, রান্না করে আসি।
-আরে আমি তো মজা নিলাম! মুনিরার রান্নাও খারাপ না।
-হু, তাহলে খেয়েই ঘুমোবে।
.
.
.
সেনোয়ারা বেগমকে সারা রুমে পায়চারী করতে দেখে নুরুল আলম বললেন-
আমি সায়নীর সাথে কথা বলবো। সে যেনো মুনিরাকে রাজী করায় আরেকটা বিয়ের ব্যাপারে।
-ওই মেয়েই তো যত নষ্টের মূল।
-এভাবে বলছো কেনো তুমি!
-কিভাবে বলবো? যে আশ্রয় দিছে তারই ক্ষতি করে দিছে এই মেয়ে। এভাবে গোপনে কোন ভালো মেয়ে বিয়ে করে বলো?
-আফজালের কিন্তু সায়নীকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। আমার সম্মান রাখতে গিয়ে সে আফরানের সাথে জোরাজোরি করেছে মুনিরাকে বিয়ে করতে। তবে এর আগেই যদি জানতে পারতো সায়নী ও আফরান একে অপরকে ভালোবাসে তাহলে সে নিশ্চয় মেনে নিতো। দোষ টা আফরানের। সে তার বাবাকে চিনতে ভুল করেছে। আসলে আফরানের দোষও বলা যায় না। পরিস্থিতিটাই হয়তো খারাপ ছিলো।
-হু দোষ কারো না। দোষ আমার মেয়ের কপালের। তুমি ভাবছো? সায়নী যদি পোয়াতি হয় তবে মুনিরার কি হবে?
-তোমার মেয়েই যদি এসব না ভাবে আমার কি করার আছে বলো?
-তোমার আপাতত কিছু করতে হবেনা। আমাকে ভাবতে দাও কি করা যায়।
.
কথাটি বলেই আবারো পায়চারী করা শুরু করলেন সেনোয়ারা বেগম। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন নুরুল আলম।
.
.
.
রাত ১১টা…
খাওয়া দাওয়া শেষ করে যে যার রুমে ঘুমোতে চলে গেলেও চোখে ঘুম নেই মুনিরার। ঘুমটাও যেনো তার সঙ্গী হতে নারাজ।
শোয়া থেকে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আকাশের চাঁদের আলো উপভোগ করলো সে।
হঠাৎ পানি খেতে ইচ্ছে হলে রুমে এসে দেখতে পেলো পানির জগটা খালি। জগ নিয়ে সে এগিয়ে গেলো ডাইনিং রুমের দিকে।
ডাইনিং রুমে আসতেই কানে বাজলো মুনিরার আফরানের গাওয়া গান-
এই আকাশ কে সাক্ষী রেখে
এই বাতাসকে সাক্ষী রেখে
তোমাকে বেসেছি ভালো
তুমি মোর নয়নের আলো।
.
এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো আফরান যেনো তার জন্যই গানটি গেয়েছে। কিন্তু না, এই এক বছরেও এই সৌভার্গ্য লাভ করেনি মুনিরা।
ডাইনিং রুমটা আফরানের রুমের পাশের হওয়ায় ভেতরের শব্দ বাইরেও চলে এসেছে। আর এমনটা যে মুনিরা প্রথম শুনেছে তা নয়। কোনোদিন শুনে আফরান ও সায়নীর হাসি ঠাট্টার শব্দ, কোনোদিন একইসাথে গান করার, কোনোদিন আজকের মতো আফরানের গান।
তার জীবনে কি এমন দিন কখনো আসবেনা?
ভাবতেই বুক চিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো মুনিরার।
ভালোবেসে আফরান তাকে একটা গান না শোনালে যেনো মরেও শান্তি পাবেনা সে। যদিও এটা কখনো সম্ভব কিনা তার জানা নেই। কেননা আফরান শুধু সায়নীকেই ভালোবাসে। সবটা জেনেও সে পড়ে আছে এই বাড়িতে। আশা করছে একদিন তাকেও আফরান ভালোবাসবে, এভাবে গান শোনাবে। এসব কি খুব অন্যায় চাওয়া নাকি বেহায়াপনা? যদি তাই হয়ে থাকে, হোক না সে একটু বেহায়া নিজের বৈধ সম্পর্কের জন্য!

সকালে ঘুম ভাঙতেই ঘড়ির দিকে তাকালো আফরান।
এ কি! সকাল ৯টা পার হয়ে গিয়েছে কিন্তু সায়নী তাকে ডাকেনি!
চোখ জোড়া কচলাতে কচলাতে উঠে পড়লো আফরান। তখনি আগমন ঘটলো সায়নীর।
-কিরে? আমায় ডাকলে না কেনো? অফিসের দেরী হয়ে গেলো অনেকটা।
-আজ অফিসে যাওয়া হচ্ছেনা তোমার।
-মানে?
-উহু আফরান! ভুলে গেলে আজ খালাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়াতে হবে। তারপর রাতে তোমার বন্ধুর বিয়ে আছে,ওখানে যেতে হবে।
-খালাকে আমি বাসায় পৌছে দিয়ে অফিসে ঘুরে আসতে পারতাম। কালও যাওয়া হয়নি। আর বিয়েতো রাতে!
-এখন থেকে এতো দৌড়াদৌড়ি করলে রাতে দেখতে আনফ্রেশ লাগবে তোমাকে।
-আমি আফরান খান জনাবা!
আনফ্রেশ আমার ডিকশনারি তে নেই।
.
আফরানের কথা শুনে হাসতে থাকলো সায়নী।
আফরান মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-
সকাল সকাল আমাকে মেরে ফেলার ধান্দা করছো নাকি?
-হু করছি তো। উঠো এইবার। নাস্তা করে হাসপাতাল যাও।
.
আফরান বিছানা ছেড়ে উঠতেই সায়নী বলে উঠলো-
তুমি কাল নিজের শার্ট নিজে ধুয়েছো! বাহবা! আমি একদিন না থাকাতে কতো উন্নতিই না হয়েছে তোমার।
-বুঝলাম না?
-আরে বারান্দায় পেয়েছি তোমার শার্ট টা ঝুলানো অবস্থায়। আলনায় রেখেছি। ভালোই ধৌত করতে পারো দেখছি। যাই হোক ফ্রেশ হয়ে আসো টেবিলে।
.
সায়নী বেরিয়ে যেতেই আফরান এগিয়ে গেলো আলনার দিকে। কালকে হাসপাতাল থেকে আসার পর সে শার্ট টি বিছানার উপরে রেখে গিয়েছে স্পষ্ট মনে আছে। তাহলে কে ধুয়েছে? মুনিরা?
শার্ট টা হাতে নিয়ে মুচকি হেসে আফরান আপনমনে বললো-
এই মেয়ে অন্য কারো বউ হলে নির্ঘাত তার মায়া জাল থেকে স্বামী বেরিয়ে আসতে পারতো না। মুনিরা মানেই একটা মায়াবতী।
.
.
.
ডাইনিং টেবিলে নাস্তা করতে এসেই মুনিরা ও সায়নীর দেখা পেলো আফরান।
চেয়ার টেনে বসতেই সায়নী বললো-
একটা কথা ছিলো।
-হু বলো?
-তোমার সাথে আজ মুনিরাকে নিয়ে যাবে হাসপাতালে? খালাকে দেখতে চায়ছে ও।
.
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে মুনিরার উদ্দেশ্যে আফরান বললো-
তৈরী হয়ে আসো।
.
এতো সহজে আফরান রাজি হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি তারা৷ মুনিরা উৎসুক কণ্ঠে বলে উঠলো-
এখুনি আসছি।
.
মুনিরা ছুটে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সায়নী তার উদ্দ্যেশ্যে বললো-
ওই পাগলি মেয়ে? নাস্তা তো করে যা?
-পরে করবো আপু।
.
মুনিরা চলে গেলে সায়নী মুচকি হেসে বললো-
মেয়েটার ছেলেমানুষী এখনো গেলো না।
-হু, বয়স কম তো। দেখছোনা এমন ভাবে ছুটছে যেনো হাসপাতাল না বেড়াতে নিয়ে যাবো তাকে।
.
কথাটি বলেই খাওয়াই মনোযোগ দিলো আফরান।
সায়নী নিজের মনে বললো-
তোমার সাথে বেরুতে পারবে বলেই এতোটা উৎফুল্ল সে। তোমাকে যে সেও বড্ড ভালোবাসে। একদিন হয়তো তা তুমিও বুঝবে।
.
.
গাড়িতে বসে আছে মুনিরা ও আফরান। আফরান ব্যস্ত ড্রাইভিং করতে। তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে রয়েছে মুনিরা। আফরান কে যেনো ঠিক বাংলা সিনেমার হিরোর মতোই লাগছে তার কাছে!
আফরান তার দিকে তাকাতেই চোখ সরিয়ে বাইরে তাকালো মুনিরা। ঠিক তখনি চোখে পড়লো ছোটখাটো একটা ফুসকার দোকান।
উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুনিরা বলে উঠলো-
ফুসকা!
.
সাথে সাথে গাড়ি থামিয়ে দিলো আফরান। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো-
খাবে তুমি?
-হু।
-এখানে বসো। আমি নিয়ে আসছি। গাড়িতে বসেই খেতে হবে কিন্তু।
.
গাড়ি থেকে বেরিয়ে আফরান এগুলো দোকানের দিকে।
মুনিরা নিজের গায়ে চিমটি দিয়ে বিড়বিড় করে বললো-
না আমি স্বপ্ন দেখছি না!
.
.
.
সকাল ১১টা…
আফজাল খানের আরেকবার চা খাবার সময় হয়েছে। সায়নী তার জন্য চা নিয়ে এগিয়ে গেলো তার রুমে।
চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রেখে সায়নী বললো-
বাবা তোমার চা খেয়ে নাও।
-একটু বসবি মা?
.
আফজাল খানের কথায় বসে পড়লো সায়নী।
তার দিকে তাকিয়ে আফজাল খান বললেন-
আফরান আর মুনিরা একইসাথে বাইরে বলে কি তোর মন খারাপ হয়েছে?
-কি যে বলোনা বাবা! এসব পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে এমন ধারণা আমার আগেই ছিলো। সবটা জেনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি।
-কিন্তু আফরান তার প্রাপ্য অধিকার এখনো মুনিরাকে দিতে পারেনি। হ্যাঁ মুনিরাকে সে অনার্স কমপ্লিট করানোর জন্য কলেজে ভর্তি করিয়েছে, কোনো কিছু অভাব হতে দিচ্ছেনা। কিন্তু ভালোবাসা?
স্বামীর ভালোবাসা ছাড়া সংসার অপূর্ণ। এটা মানিস তুই?
-হু।
-কখনো যদি মুনিরাকে আফরান ভালোবাসতে শুরু করে মানতে পারবি তুই?
.
সায়নীর মনে হচ্ছে তার গলাটা ধরে আসছে। কথা আসছেনা মুখ দিয়ে কোনো।
তার অবস্থা বুঝতে পেরে আফজাল খান বললেন-
যদি নাই পারিস মুনিরাকে এই সম্পর্ক থেকে বেরুতে বাধ্য কর। মেয়েটার বয়স কম। বড় আবেগি মেয়ে। তার প্রথম ভালোবাসা আফরান বলেই এতোকিছু সহ্য করেও এক বছর সে এখানে পড়ে আছে। আমি চাইনা মুনিরা তার সারাটা জীবন এভাবে নষ্ট করুক।
.
.
নিজের রুমে বসে আছে সায়নী। আফজাল খানের কথা তার কানে বাজছে। কানে বাজছে মুনিরাকে দেয়া তার নিজের কথাও।
আসলেই মুনিরা তার প্রাপ্য অধিকার পাচ্ছেনা। তার উচিত মুনিরার প্রাপ্য অধিকার পেতে সাহায্য করা। কিন্তু এর মানে হলো আফরানকে ভাগ করে নেয়া।
আফরান যদি চাইতো তাহলে নিশ্চয় কিছুই করার ছিলোনা সায়নীর। কিন্তু আফরান তো নিজেই এই সম্পর্ক টা আগাতে চায়না। সে নিজেই বা কি করতে পারে! আর যদি আফরান সম্পর্ক টা আগাতো তাহলে কি করতো সে?
নানারকম প্রশ্নে অস্থির হয়ে আছে সায়নীর মন।
গোপনে বিয়ে করার, মুনিরাকে শুরু থেকে কিছু না বলার শাস্তি যে তাকে এভাবে পেতে হবে ভাবেনি সে।
না চাইতেও কাঁদতে তার অনেক বেশিই ইচ্ছে করছে।
একপর্যায়ে ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো সায়নী।
উপরের দিকে তাকিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে বলে উঠলো-
হে আল্লাহ! মুনিরাকে দেয়া কথা আমি ফেলতে চাইনা। আবার আফরান আর কাউকে ভালোবাসবে এটাও আমি মানতে পারবো না। তুমিই আমাকে রাস্তা দেখাও। এমন কিছু একটা করো যাতে সবটা সহজ হয়ে যায়, সবটা আমি মানতে পারি। মুনিরাকে আমাদের মাঝে রাখার একটা ব্যবস্থা করে দাও। আফরান আর আমি দুজনেই যেনো ওর প্রাপ্য অধিকার থেকে ওকে বঞ্চিত না করি। আমার মনে এই নিয়ে যেনো কোনো সংশয় না থাকে এই ব্যবস্থা তুমি করে দাও আল্লাহ! তাও যদি না পারো আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও আল্লাহ, নিয়ে যাও। তবুও আমি কথার খেলাপ করেছি, সতীন সতীনই হয় এমন কোনো কথা শুনতে পারবো না।
.
.
.
সন্ধ্যা ৭টা….
মুনিরার রুমে উপস্থিত হলো সায়নী।
সায়নীকে দেখতে পেয়ে মুনিরা বললো-
আপু কিছু লাগবে তোমার?
-হু লাগবে।
-কি?
-আজ আফরানের বন্ধুর বিয়ে। তুইও আমাদের সাথে যাবি।
-মানে?
-মানে যা শুনছিস তা। আকাশী রঙের কাতান শাড়িটা বের কর।
একই রকম করে সাজবো আজ।
.
মুখটা ফ্যাকাসে করে মুনিরা বলল-
উনি কিছু বললে?
-উনি কি বলবে! তুইও তার স্ত্রী।
-কাল আমার ক্লাস আছে আপু, ক্লান্ত হয়ে যাবো।
-তোর না টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেলো প্রথম বর্ষের? সামনে এমনিতেও বন্ধ কলেজ। একদিন না গেলে কিছু হবেনা। দেখি আয় তৈরী হয় দুজনে একসাথে।
.
.
ঢালা শাড়ি পরণে, কানে বড় ঝুমকো, ২হাতে ২ডজন চুড়ি, মাথায় খোপা করা, সে খোপায় বেলী ফুল। বাহ! সায়নীকে দেখতে বেশ লাগছে।
আফরান পরণে মাত্র শার্ট ঢুকিয়েছিল। সায়নী তার পাশে এসে বোতাম লাগিয়ে দিতে দিতে বললো-
আজ আমাদের সাথে অন্য একজনও যাবে।
-কে?
-মুনিরা।
-কিন্তু বাবা?
-দাড়োয়ান কাকাকে বলে দিয়েছি বাবার সাথে থাকতে।
-সায়নী?
-হু?
-খুব দরকার এটার?
-ও তোমার স্ত্রী আফরান। ওকে আমি কথা দিয়েছিলাম ওর অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে দিবোনা। কথা কি রাখতে পারছি আমি?
-আমি কথা দেয়নি।
-কিন্তু তুমিই ওকে সম্পর্কে আবদ্ধ করেছো। বিয়ে তো আর ছেলে খেলা নয়। ভুল যা করেছি আমরা করেছি। আমাদের ভুলের জন্য ও কেনো শাস্তি পাবে?
-সায়নী…
-মুনিরা যাচ্ছে আমাদের সাথে। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতেই হবে তোমাকে। কাউকে দুঃখে রেখে সুখী হওয়া যায়না আফরান। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি আমি। বেঁচে ফিরেছি বলে কথা খেলাপ করবো এমন মেয়ে আমি অন্তত নয়। তুমি বললেও বলতে পারো এটা ন্যাকামি!
.
.
বিয়ে বাড়িতে আলোর ঝলকানির মাঝে মুনিরার হাসিটা চোখে পড়লো আফরানের। সায়নীর মতোই একইভাবে সেজেছে সে। ভালোই লাগছে তাকে। এই প্রথম তাকে নিয়ে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আসা হয়েছে। কতই না খুশি লাগছে মেয়েটাকে। অল্পতেই খুশি হয়ে যায় এই মেয়েটি।
-হ্যালো মি.আফরান খান!
.
পেছনে ফিরে পুরানো বান্ধবীর দেখা পেয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আফরান বললো-
তুমি!
-হু আমি! তোমার সাথে যোগাযোগ না থাকলেও দুলা মশাই এর সাথে ঠিকই ছিলো। তা বিয়ে সাদি করেছো?
-হ্যাঁ, তুমি?
-হুম। হাসবেন্ড দেশের বাইরে।
-ওহ!
-তা তোমার ওয়াইফ কোথায়?
দেখা করতে চাই। যে আফরানের জন্য মেয়েরা পাগল ছিলো তার বউ এর মুখ খানি দেখতে চাই।
.
মুচকি হেসে আফরান বললো-
নিশ্চয়, এসো আমার সাথে।
.
সায়নী ও মুনিরা একই পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো।
আফরান তার বান্ধবী কে নিয়ে এগিয়ে এসে সায়নীকে দেখিয়ে দিয়ে বললো-
মিট মাই ওয়াইফ সায়নী।
-হাই সায়নী! আমি আফরানের ক্লাসমেট ছিলাম।
-ও আচ্ছা! ভালো আছেন?
-হ্যাঁ। তুমি মাশাআল্লাহ অনেক বেশিই সুন্দর সায়নী। অবশ্য আফরানের বউ এমনি হওয়ার কথা!
.
মৃদু হেসে সায়নী জবাব দিলো-
ধন্যবাদ।
.
-বাই দ্যা ওয়ে তোমার পাশে এই মেয়েটি কে? একইভাবে সেজেছো তোমরা?
.
আফরানের দিকে তাকিয়ে সায়নী বললো-
তুমিই বলো আফরান। মুনিরা তোমার কি হয়?

কেনো যেনো মুনিরার মনে হলো আফরান আজ সত্যি বলবেই।
আফরান শান্ত গলায় তার বান্ধবীর উদ্দেশ্যে বললো-
সি ইজ মাই ওয়াইফ অলসো।
.
মেয়েটির কথাটা বুঝতে একটু সময় লাগলো। আফরানের ফোনের রিংটোন বাজলে সে ওখান থেকে প্রস্থান করে।
মেয়েটি উৎসুক দৃষ্টিতে সায়নীর দিকে তাকিয়ে বললো-
ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আফরান দুটো বিয়ে কেনো করেছে জানতে পারি?
.
সায়নীর মুখে সবটা শোনার পরে হাসতে হাসতেই মেয়েটি বললো-
এই যুগে দুইটা বউ! মানা যায় এসব! মনে হচ্ছে সিরিয়াল দেখছি।
-জীবনে অনেক কিছুই ঘটে কতোটুকু মানতে পারি আমরা?
আফরান পরোকিয়া করেছে নাকি অন্য কোনো মেয়ের সাথে ঘুরছে ফিরছে! সে যা করেছে তা ভুলেই। মানুষ মাত্রই তো ভুল। তবে ভুল হলেও বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে সে।
-যাই বলো সায়নী দুই বউ শুনতে কেমন কেমন লাগে।
-আমরা আছি আমাদের সমস্যা না হলে মানুষের এতো সমস্যা কিসের!
-তোমাদের দেখে হয়তো আমাদের স্বামীরা বহু বিবাহে উৎসাহ পাবে।
-উৎসাহ! আমি আগেও বলছি এখনো বলছি, আফরান ভুলবশত বিয়েটা করেছে। আমাদের ইসলাম একাধিক বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছে সেজন্য নয় আবার দুইটা বউ নিয়ে ফূর্তির জন্যও নয়। আর তখন কি যেনো বলেছিলেন? সিরিয়াল? মানুষের জীবনের সাথে সিরিয়ালের কি কোনো মিল নেই?
.
মেয়েটি চুপ হয়ে গেলে মৃদু হেসে সায়নী বললো-
উস্কানিমূলক কিছুই এখানে হয়নি। দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। এমন অনেক পরিবার আছে যাদের বাধ্য হয়ে পরিস্থিতির চাপে পড়ে দুইটা বিয়ে করতে হয়। তারা সুখে থাকলেও কিন্তু সমাজের কিছু মানুষের জ্বলে। তাদের যেনো মাথা উঁচু করে সমাজের মানুষরা থাকতেই দিবেনা। এতে এফেক্ট হয় পরবর্তী প্রজন্মের। আমি বলছিনা দুই বিয়েকে প্রাধান্য দেন কিন্তু অবশ্যই বলবো যারা সুখে আছেন তাদের না খোচালেই বেটার।
.
.
.
রাত ১১টা হয়ে গেলো…
নিজের বিছানায় শুয়ে আছে মুনিরা। প্রথমে সায়নীকে ভুল বুঝলেও পরে সায়নী ও আফরানের ব্যাপারে সবটা জেনে ভুল বুঝাবুঝির অবশান ঘটেছিলো মুনিরার। সায়নী সিঙ্গাপুর যাবার আগে তাকে কথা দিয়েছিলো, এসে সবটা ঠিক হয়ে যাবে। সায়নী তার কথা রাখছে। বিশেষ করে আজকে সে যা করলো অন্য কোনো মেয়ে হলে কি করতো? অবশ্যই না। সায়নীর ভালো মানুষীর জন্যই মুনিরা তার প্রতি ধীরেধীরে দূর্বল হয়ে পড়েছে। নিজের বোনের জায়গা দিয়েছে তাকে। প্রিয় মানুষদের মাঝে একজন করেছে।
আল্লাহ কোনো হিংসা রাখেননি মুনিরার মনে সায়নীর জন্য। শুধু রেখেছেন অফুরন্ত ভালোবাসা।
সবই সে পেয়েছে এই বাড়িতে শুধু আফরানের ভালোবাসা ছাড়া। সত্যি বলতে সায়নীর প্রতি আফরানের ভালোবাসা দেখে আরো বেশি আফরানকে ভালোবেসেছে মুনিরা। এই ছেলে তার ভালোবাসায় এতোটা মগ্ন, যে কিনা অন্য একটি বউ থাকা স্বত্তেও নিজের ভালোবাসার অমর্যাদা হতে দেয়না সে ছেলের মনে মুনিরা একটুখানি জায়গা করতে পারলেও মনেহয় নিজেকে ধন্য মনে করবে।
আর আফরান আজ তার বান্ধবীকে বলেছে মুনিরাও তার স্ত্রী! এতোটুকুই বা কম কিসের!
.
.

আফরানের বুকে মাথা লুকিয়ে শুয়ে আছে সায়নী। হঠাৎ সে বললো-
আচ্ছা আফরান? দুইটা বউ রাখলে সমান অধিকার দিতে হয় এটা তো তোমার অজানা নয় তাইনা?
-মুনিরার কথা বলছো? কিসের অভাবে রেখেছি?
-ভালোবাসার।
.
আফরানকে চুপচাপ দেখে সায়নী বললো-
আমাদের ধর্মেও কিন্তু এর ব্যাখ্যা আছে।
-ধর্ম কতোটুকুই বা মান্য করতে পারি আমরা? তুমি আমি বিয়ে করেছিলাম পালিয়ে।
-একবার ভুল করেছি বলে বারবার করতে হবে? মুনিরাও তোমার স্ত্রী। ধীরেধীরে তাকেও তার অধিকার দিতে চেষ্টা করো।
.
কথাটি বলেই ওপাশ ফিরে সায়নী চোখের পানি ফেলছে বুঝতে কষ্ট হলোনা আফরানের।
পরিস্থিতির চাপে পড়ে মানুষকে কতো কিছুই না করতে হয়! তাই বলে কি ভালোবাসা যায়?
.
.
.
সকাল সকাল বাড়ির আশেপাশে হাটাহাটি করা নুরুল আলমের অভ্যাস। আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। তবে আজ দেখা পেলেন তিনি গ্রামের চেয়ারম্যানের।
-আরে নুরুল! কি অবস্থা তোমার?
-জ্বী চেয়ারম্যান সাহেব ভালো। আপনার?
-আছি ভালো। শুনলাম পাশের গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলের সাথে তোমার বিবাহিতা মেয়ের বিয়ে দিতে চাচ্ছো?
তা সে কি সতীনের ঘরে সংসার করতে পারছেনা?
-বিষয়টা এমন না।
-কেমন? অলক্ষী মেয়ের কোথাও ঠাই হয়না। তাই তো আরেক বিয়ে করতে হচ্ছে এখন। দেখো বাপু যাই করো আমার গ্রামে এসব চলবেনা। বিয়ে দিবে তো বাইরে গিয়ে দাও বিয়ে। এখানে যেনো মুনিরার ছায়াও আমি না দেখি। গ্রামে পা দিলে গ্রামেও অশুভ ভর করবে। বাইরে তার ১০টা হলেও বিয়ে দাও, আমার কোনো সমস্যা নেই।
.
.
বাসায় এসেই নুরুল আলম ব্যাগ গোছাতে শুরু করলেন। সেনোয়ারা বেগম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন-
কোথায় যাচ্ছো?
-আফজালের কাছে। যদি মেয়েটাকে শান্তিতে নাই রাখতে পারে দায়িত্ব কেনো নিতে গিয়েছে সে! অন্য কোথাও আমি মেয়ের বিয়ে দিবোনা। ওই বাড়িতেই থাকতে হবে তার। মাথা উঁচু করে থাকবে আর সমস্ত অধিকার দিতে হবে তাকে।
-মাথা ঠান্ডা করো। আমিও যাবো তোমার সাথে।
-তো চলো!
-ঠান্ডা হও আগে। এখন নয়। ধীরেসুস্থে বের হবো।
-তবে আজই যাবো।
-ঠিক আছে।
.
.
.
ক্লাসে মাত্র প্রবেশ করে সিটে গিয়ে বসলো মুনিরা।
তার পাশে থাকা মেয়েটি মুখ টিপে হেসে বললো-
আজ তোর জামাই তোকে দিয়ে গিয়েছে বুঝি? জানালা দিয়ে দেখলাম।
-হু।
-হঠাৎ করে?
-উনার অফিসের সময়ের সাথে আমার ক্লাস টাইম মিলেনা। উনাকে আগেই বেরুতে হয়। আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়েছে। আমি বেরুচ্ছিলাম, উনিও অফিসের উদ্দেশ্যে বেরুচ্ছিলেন। তাই…
-ইশ! এভাবে আর কতোদিন! আমার মনেহয় কি তোর সতীনই তোর জামাইকে তোর সাথে ঘেষতে দেয়না। পেটে পেটে সব শয়তানি তার।
.
দাঁতে দাঁত চেপে মুনিরা জবাব দিলো-
তোমাদের এসব নিয়ে না ভাবলেও চলবে। আর কে বলেছে সে আমার সতীন? বোন মানি তাকে আমি।
-সে মানেতো?
-না মানলে এই এক বছরই আমি টিকতে পারতাম না।
-তবে তোর জামাই ধরা দিচ্ছেনা কেনো তোর ভালোবাসায়?
-ভালোবাসা এতো ঠুংকো না যে চাইলেই পাওয়া যাবে৷ আর এতো সহজে আমি উনার ভালোবাসা পেলে এটার কদর করতে জানতাম? সায়নী আপুর প্রতি উনার ভালোবাসা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি যদি আমাকেও সহজে ভালোবাসতো হয়তো আমি এতোটা আকৃষ্ট তার প্রতি হতামই না।
-কিসের জোরে থাকবি তুই ভালোবাসা ছাড়া? আর কিসের জোরেই বা এতো বড়বড় কথা বলছিস?
-বৈধ সম্পর্কের জোরে।
.
.
.
আফরান অফিসে, মুনিরা কলেজে।
রান্নার জন্য রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যাবার সময় ফোন বেজে উঠলো সায়নীর। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো মিশিকার ফোন।
-হ্যালো মিশি!
-কি অবস্থা মাই জানু?
-আমি ভালো আছি। তোর আর পাবেলের কি অবস্থা?
-আছে ভালোই।
-তুই দেখি নিয়ম করে আমাকে সপ্তাহে একবার হলেও ফোন দিস। এতোটা ভালোবাসিস তুই আমাকে!
-ধুর ছাই! তোর জন্য পাবেলকে বিয়ে করে আমেরিকা আসতে পেরেছি বলেই তো তোকে ভুলতে পারিনা।
.
হেসে উঠলো সায়নী৷ মিশিকা হেসে জিজ্ঞাসা করলো-
আফরান কোথায়?
-অফিসে।
-আর মুনিরা?
-কলেজে।
-কি করে পারিস বাপু সতীন সহ্য করতে আমি জানিনা।
-আমি তোর সতীন হলে কি তুই আমাকেও সহ্য করতিনা?
-পাগল নাকি! মোটেও করতাম না।
-মুনিরাকে সহ্য না করার কথা আসেনা মিশি। মৃত্যু পথযাত্রি থাকাকালীন তাকে কথা দিয়েছিলাম আমি। সে কিন্তু ডিভোর্স এর জন্য তৈরীও ছিলো তখন। এখন বেঁচে ফিরে তার স্বপ্ন ভঙ্গ করবো এমন মেয়ে আমি নয়।
-কিন্তু আফরান?
-পুরুষ মানুষ সে। নিশ্চয় ঠিক হয়ে যাবে।
-তুই ঠিক থাকতে পারবি?
-আল্লাহ কে বলেছি কোনো মাধ্যমের ব্যবস্থা করতে যাতে করে সবটা সহজ হয়ে যায় নাহলে…
-কি?
-বাদ দে। এসব পুরানো কথা।
-হুম। আফজাল আঙ্কেল কোথায়? উনাকে দে কথা বলি।
.
.
.
দুই দিন অফিসে না যাওয়ার ফলে আজ সারাদিন অফিসে কাটাতে হয়েছে আফরানের। এখন রাত ৮টা হয়ে গেলো বাসায় আসতে। ক্লান্ত শরীরে কলিং বেল চাপতেই দেখা পেলো মুনিরার।
-বাসায় আব্বা আম্মা এসেছেন।
-কবে?
-একটু আগেই।
-ওহ!
.
নিজের রুমের দিকে আফরানকে এগুতে দেখে মুনিরাও তার নিজের রুমে এগিয়ে গেলো।
সেনোয়ারা বেগম তাকে দেখে বললেন-
জামাই এসেছে?
-হুম।
-ভালোই হলো। সবার সাথেই খোলামেলাভাবে কথা বলা যাবে।
-কি বলতে চাইছো তুমি?
-তোর প্রাপ্য অধিকার জামাই তোকে দিবে কিনা?
-আমি তো ভালোই আছি আম্মা!
-না তুই ভালো নেই।
.
রুমের মাঝে সায়নীর আগমন ঘটলে দাঁড়িয়ে পড়লেন সেনোয়ারা বেগম। গম্ভীর গলায় তিনি বললেন-
এই মেয়েটাই তো যতো নষ্টের মূল। বড়ই সতীন রাখার ইচ্ছে তাইনা? তা সতীন রাখছো নাকি কাজের মেয়ে?
-আন্টি আপনি যা ভাবছেন তা নয়।
-তা নয়! ওমা! তাহলে কেমন? আমাদের ধর্মেও আছে বউদের সমান অধিকার দেয়ার কথা। তাহলে মুনিরা কেনো সেই অধিকার পাচ্ছেনা? তোমাদের ভুলের শাস্তি ও কেনো পাবে?
.
সায়নী চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। কি জবাব দিবে সে তার জানা নেই!
এরই মাঝে উপস্থিত হলো আফরান। তাদের সালাম জানিয়ে সে বললো-
এতে সায়নীর কোনো দোষ নেই। দোষ আমার মনের। যে মনে শুধু সায়নীর স্থান।
.
আফরানের উদ্দেশ্যে সায়নী বললো-
আফরান প্লিজ থামো।
-না আমাকে বলতে দাও সায়নী। তাদের মেয়েকে জোর করে কি রাখা হয়েছে?
.
এপর্যায়ে কথা বলে উঠলেন নুরুল আলম-
জোর তোমাকেও করা হয়নি৷ তবুও তুমি বিয়েটা করেছো। এতে দোষ আছে না সায়নীর না মুনিরার। তাই এদের দুজনেরই দায়িত্ব তোমার নিতে হবে।
-কিন্তু…
.
আফরান কে কিছু বলতে না দিয়ে তার পাশে এসে তার দুহাত আঁকড়ে ধরে নুরুল আলম বললেন-
তোমার মনে মুনিরার জন্য কি জায়গা তৈরী করা যায়না বাবা? জানো, আজও আমাকে শুনতে হয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে কতো কথা শুনালেন। আমার মেয়েটা অলক্ষী, আরেকটা বিয়ে হলে যেনো গ্রামে আর পা না দেয়। তুমিও জানো সমাজে ডিভোর্সি মেয়ের সম্মান কতোটুক।
.
আফরানকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার হাত ছেড়ে দিলেন নুরুল আলম।
মুনিরার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন-
তোর সুখের জন্য আর কতো মানুষের কাছে ছোট হতে হবে বলতে পারিস তুই? তুই আসলেই একটা অলক্ষী। আজই আমাদের সাথে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি তুই। গ্রামে যেতে না পারি তোকে নিয়ে, সাগরে ডুবে মরতে তো পারবো! তোর মতো অভাগী মেয়ের কপালে বোধহয় মরাই লেখা আছে।
-মুনিরার মতো মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার । ও অলক্ষী নয়৷ কোথাও যাবেনা ও। এখানেই থাকবে।
.
কথাটি বলে আফরান হনহন করে বেরিয়ে গেলো রুম ছেড়ে।
সেনোয়ারা বেগম সায়নীর পাশে এসে বললেন-
কথার খেলাপ করবেনা তুমি আশা করি।
.
.
.
শোয়ার আগে দরজা বন্ধ করার সময় আফরানের দেখা পেয়ে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো মুনিরা।
-এ কি আপনি!
-আজ আমি এখানে ঘুমাবো।
-আম্মাদের দেখানোর জন্য?
.
আফরান ভেতরে প্রবেশ করে বললো-
এখন সেটাই বলতে পারো। তবে আমি চাই তোমাকে তোমার প্রাপ্য অধিকার দিতে। কিন্তু সেটা তো আর একদিনেই সম্ভব নয়। আমি আজ থেকে চেষ্টা করতে চাই। মানে আমাদের সম্পর্ক টাকে একটা সুযোগ দিতে চাই।
-হু।
.
বিছানায় উপরে শুয়ে ওপাশে ফিরে আফরান বললো-
শুয়ে পড়ো।
-কোথায়? না মানে এই রুমে তো কোনো সোফা নেই।
-পাশেই শোও।
.
এই কোন আফরানকে দেখছে মুনিরা! যে কিনা তার সাথে বন্ধুত্বের হাতও বাড়িয়ে দেয়নি সেই কিনা আজ এই সম্পর্ক টা কে এগিয়ে নিতে রাজি হয়েছে!
তার এতোদিনের অপেক্ষা কি শেষ হতে চলেছে?
সমরেশ মজুমদারের একটি কথা মনে পড়লো মুনিরার-
“সব কিছু মনের মত মেলে না, মানিয়ে নিতে হয়। মেনে নিলে ঠিক এক সময় সুখ ফিরে আসে।”
.
(চলবে)
.
বি:দ্র: যেখানে কুপিয়ে মানুষ হত্যা করলেও দাঁড়িয়ে তামাশা দেখি আমরা, সেখানে একটা গল্পকে নিয়ে কতোটা সিরিয়াস! ভাবা যায় এসব! যাই হোক আমার গল্পে কোনো বহু বিবাহ কে উসকানি দেয়া হয়নি। মানুষ মাত্রই ভুল। আফরানের ও একটা ভুল হয়েছে। পরিস্থিতি তো অনেক কিছুই করতে বাধ্য করে মানুষকে। উস্কানি তখনি হতো যখন আফরান স্বেচ্ছায় বিয়েটা করতো, পরিস্থিতির চাপে পড়ে নয়।
.
সায়নী ও আফরানের ভুলের দায় অবশ্যই মুনিরার নয়। সমাজে যেমন সতীনের ঘর করলে কথা শুনতে হয় তেমনি ডির্ভোসি মেয়েকেও কথা শুনতে হয় এটাই নিয়ম। দুই দিকেই কথা শুনতে হলে মুনিরা কেনো তার এই ঘর ছেড়ে চলে যাবে? আফরান ভালোবাসে না বলে? বাঙালী মেয়েরা ধৈর্য্যশীল। যারা সত্যিকারে ভালোবাসে হৃদয় উজার করেই ভালোবাসে। আর অপেক্ষা করে সুখের আশায়। মুনিরার বিশ্বাস আছে নিজের সম্পর্কের উপর।
.
আর সায়নী? প্রথম বউ হিসেবে ওর মনে যে মাঝেমাঝে ক্ষোভ আসে এটাও অনেকের ন্যাকামি মনে হয়। আবার অনেকের সায়নীর জন্য অতি মাত্রায় খারাপ লাগে। সায়নীর ও ভুল ছিলো। তবে সে তার ভুলের মাশুল হিসেবে মুনিরাকে মেনে নিতে চেষ্টা করছে। কেননা সে নিজেও একটা মেয়ে। তাই মুনিরার কষ্টটা সে উপলব্ধি করতে পারছে সহজেই।
.
গল্পের মাত্র তিন পর্ব গেলো এরই মাঝে শুরু হয়ে গেলো মুনিরা ও সায়নী কে নিয়ে দ্বন্দ। আপনাদের কারণেই সিজন ১ আমার অর্ধেকে শেষ করতে হয়েছিলো। এখন মাত্র গল্পটা ধরলাম, আমাকে আমার মতো আগাতে দিন না! তাছাড়া আমি বলেছি শুধুমাত্র রিকোয়েস্ট রাখতেই সিজন ২শুরু করেছি আমি। যারা ভালোবেসে আমার গল্পকে আমার মতো করেই মেনে নিতে পারবে শুধুই তারাই পড়বেন।
আপনারা নিজেরাই ভেবে দেখুন তো? কেউ মুনিরার পক্ষে কেউবা সায়নী?
আমি কেনো কারো পক্ষপাতিত্ব করবো! যেহেতু আমি গল্পটা লিখছি সায়নী, মুনিরা দুজনেই আমার কাছে সমান। আর বাংলাদেশে দুই বিয়ে কি হয়না? নাকি এমন কোনো ঘটনা বাংলাদেশে ঘটে না? চারপাশে অনেক কিছুই ঘটে যা আমরা সহজে মানতে পারিনা। এই গল্পটাও না হয় এমন কিছু ধরুন। ।
কেউ মরে যাওয়া বা অন্য কোনো নায়ক আনাই কিন্তু সমাধান নয়।
ইসলামের যুক্তি, সামাজিক যুক্তি এতো এতো যুক্তি দেখে কথা গুলো বলতে বাধ্য হলাম।
আবার অনেকে সিরিয়ালে এতো মগ্ন যে সব কিছুতেই সিরিয়াল খুঁজে পায়। সিরিয়াল মনে হলেও আমার কিছু আসে যায়না। ভুলে গেলে চলবেনা, শরৎচন্দ্রের দেবদাস আর রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি নিয়েও কিন্তু সিরিয়াল তৈরী হয়েছে এবং তা চলেছে।

আফরান শুয়ে পড়লেও মুনিরা পায়চারী করছে রুমের মাঝে।
আফরান তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো-
না শুয়ে এত রাতে হাটাহাটি করছো কেনো?
-কেনো যেনো ঘুম আসছেনা।
গল্প করা যাবে আপনার সাথে একটু?
.
মুনিরার কথা শুনে বসে পড়লো আফরান।
মৃদু হেসে বললো-
বলো, কি গল্প করতে চাও?
.
তার পাশে এসে বসতে বসতে মুনিরা বললো-
বাংলা সিনেমার গল্প করি চলুন।
.
সায়নীর থেকে শুনেছে আফরান, মুনিরা বাংলা সিনেমার কাহিনী বলা শুরু করলে থামেই না। অনেকটা সিরিয়াস হয়ে বলে কাহিনী গুলো। আর যতক্ষণ না মনমতো ভাবে কাহিনি বলা শেষ করতে পারবে ততক্ষণ থামবেনা সে। জোর করে হলেও শুনিয়েই ছাড়বে।
তাই আফরান চোখ জোড়া বড় করে আফরান বললো-
কোনো দরকার নেই। অন্য কিছু বলো।
-তাহলে আপনিই বলেন টপিক?
-উম্ম…
তোমার কলেজের গল্প বলো।
-কলেজের আর কি গল্প! সোজা যাই সোজা আসি, ক্লাসে পড়ানো হয়। এছাড়া আর কি গল্প হতে পারে!
ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। একটা আছে।
-কি?
-আমি যখন প্রথম প্রথম কলেজে যেতাম ছেলে একটা আমাকে ফলো করতো। কিছুদিন পর সে আমাকে একটা লেটার পাঠায় তার এক বন্ধুর দিয়ে।
.
ভ্রু জোড়া কুচকে আফরান বললো-
তারপর?
-লেটারে লেখা ছিলো সে আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। আমি তার ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিচ্ছি কিনা জানতে চায় সে। আমি কি করেছি জানেন?
-কি?
-আমিও একটা লেটার পাঠিয়ে দিয়েছি তাকে।
.
মুনিরার কথা শুনে গলা গম্ভীর করে আফরান বললো-
তুমি আমার বউ হয়ে অন্য একটা ছেলেকে চিঠি দিয়েছো কেনো?
.
ইশ! আমার বউ! কথাটা গিয়ে বুকে লেগেছে মুনিরার।
মুনিরাকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আফরান বললো-
না মানে তুমি বিবাহিতা। এসব করা কি ভালো কাজ?
-আরে পুরো কথা তো শুনেন। আমি চিঠিতে লিখে দিয়েছি, আমাকে ভালোবাসেন শুনে খুশি হতে পারলাম না। আরো আগে শুনলে হয়তো বা খুশি হতে পারতাম। কেননা আমি বিবাহিতা। স্মার্ট, হ্যান্ডসাম একটা হাসবেন্ড আছে আমার। দোয়া করবেন আমাদের জন্য।
.
মুনিরার কথা শুনে হেসে উঠলো আফরান।
সাথে হাসলো নিজের বোকামির জন্যও। পুরো কথা না শুনে ওভাবে মুনিরাকে কথা শোনানো উচিত হয়নি তার।
মুনিরার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় আফরান বললো-
কেউ বিরক্ত করলে বা কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবে।
.
মুনিরা হাসতে হাসতেই বললো-
করবেনা কেউ। ওই ঘটনার পর থেকেই ক্লাসের সকলে জানতে পেরেছে আমি বিবাহিতা।
-হুম হয়েছে অনেক গল্প। এবার ঘুমাও। কথাটি বলেই শুয়ে পড়েছে আফরান।
.
.
মুনিরা ও আফরান পাশাপাশি আজ একই বিছানায় প্রথমবারের মতো। যদিও দুজনে দুদিকে ফিরে শুয়ে আছে তবুও দুজনের চোখে ঘুম নেই। আফরানের মাঝে অস্থিরতা কাজ করছে আর মুনিরার মনে আনন্দ।
নাহ, কিছুতেই ঘুম আসছেনা মুনিরার। উঠে পড়লো সে। এগুলো বারান্দার দিকে।
চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো-
এই চাঁদ? এতোদিন আমার দুঃখের সাথী ছিলি তুই। আজ থেকে সুখের সাথীও হবি।
.
-এতো রাতে এখানে কি করছো?
.
আফরানের প্রশ্নে চমকে গেলো না মুনিরা। তার কেনো যেনো মনে হয়েছে আফরান জেগে আছে। আর তার খুব করে আফরানের সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করছিলো।
.
মুনিরার পাশে এসে আফরান আবারো প্রশ্ন করলো-
প্রায় রাতে কি চাঁদ দেখো?
-হু। আপনি কি করে জানলেন?
-নাহলে সাথী হতোনা তোমার এই চাঁদ।
.
মুনিরার কথাটি আফরান শুনেছে বুঝতে পারলো সে। মুচকি হেসে বললো-
অনেক ইচ্ছে ছিলো আপনার সাথে এভাবে চাঁদ দেখা উপভোগ করবো একদিন।
-হু।
.
বাইরে ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। খোলা বারান্দা হওয়ায় বাতাস ঘিরে ধরেছে তাদের।
মুনিরার খোলা চুলগুলো উড়ছে সাথে শাড়ির আঁচলও।
তার দিকে চোখ পড়লো আফরানের।
এই মুহুর্তটাকে চরমভাবে উপভোগ করছে মুনিরা। তার হাসি মুখটা দেখেই তা বুঝা যাচ্ছে। মেয়েটাকে এমন হাসিখুশিতেই ভালো লাগে। কে বলে সে অলক্ষী? যার মাঝে এতো মায়া সে কিভাবে অলক্ষী হয়?
আফরানের দিকে তাকাতেই মুনিরা দেখতে পেলো সে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
কেনো যেনো মুনিরার অবাধ্য মনটা আফরানের কাছে যেতে চাইছে৷
একটুখানি গেলে কি খুব বেশি ক্ষতি হবে তার?
আর কিছু ভাবতে পারছেনা মুনিরা। মন যেনো মানতেই চাইছেনা!
ধীরেধীরে এগিয়ে গেলো সে আফরানের কাছে। এতোটা কাছে, যতটা কাছে গেলে তার নিঃশ্বাসের শব্দ উপলব্ধি করতে পারবে মুনিরা।
মুনিরা কি করতে চাইছে বুঝে উঠার আগেই সে আফরান কে জড়িয়ে ধরলো আচমকা।
কি করা উচিত আফরানের? বুঝে উঠতে পারছেনা সে। সকলকে কথা দিয়েছে এই সম্পর্কটা আগাতে চেষ্টা করবে সে। তাহলে কি করে এখন মুনিরাকে আটকাতে পারে সে?
.
কতক্ষণ এভাবে ছিলো জানেনা মুনিরা। তবে তার আফরানকে ছাড়তে মোটেও ইচ্ছে করছেনা। মনে হচ্ছে এভাবে যেনো সারা জনম কাটিয়ে দেয়া যাবে!
.
আফরানের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে তার ঠোঁটের উপর ঠোঁটের ছোঁয়া বসিয়ে দিয়ে মুনিরা বললো-
সম্পর্ক আগাতে আপনি আজ থেকে চেষ্টা করলেও আমি অনেক আগেই মেনে নিয়েছি তাই এটা না করে পারলাম না আজ।
কথাটি বলে দৌড়ে রুমের দিকে চলে গেলো মুনিরা।
মুনিরার ছেলেমানুষী দেখে ফিক করে হেসে দিলো আফরান।
সায়নী ঠিকই বলে, মেয়েটার স্বভাব একেবারেই বাচ্চার মতো।
ভেতরে এসে আফরান দেখতে পেলো মুনিরা গুটিসুটিভাবে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ডিম লাইটের আলোয় তার মিটমিট করা চোখ জোড়া স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। এমন কান্ড করে এখন লজ্জায় চোখও খুলতে পারছেনা সে।
আফরানও চুপচাপভাবে শুয়ে পড়লো ওপাশ ফিরে।
ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বললো-
সায়নী, ঠিক আছো তো তুমি?
.
.
.
বারান্দার দরজা খোলা, জানালা খোলা, মাথার উপর ভনভনিয়ে ফ্যান চলছে। এতো বাতাসের মাঝেও ঝামছে অনবর‍ত সায়নী।
এর আগেও মুনিরার সাথে আফরান থাকলেও তার কষ্ট হয়নি। কেননা তখন সে জানতো তার আফরান তারই থাকবে। কিন্তু আজ?
সব কিছু ভেবেই তো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সে। তবে এতো কষ্ট কেনো লাগছে তার?
.
কিছুক্ষণ সারারুমে পায়চারী করার পর নিজের মনে সায়নী বললো-
আমার যেমন আজ কষ্ট হচ্ছে এমনটা মুনিরারও বুঝি হতো?
.
.
.
সকাল সকাল দুই বন্ধু আড্ডার ঝুড়ি নিয়ে বসলো।
কথা বলতে বলতে আফজাল খানের উদ্দেশ্যে নুরুল আলম বললেন-
আচ্ছা যদি আফরান আগে তোকে জানাতো সে সায়নীকে বিয়ে করতে চায়। তুই কি মেনে নিতি?
-সায়নীর সাথে পাবেলের বিয়ে ঠিক ছিলো। শুরুতে না মানলেও পরে হয়তো মানতাম। বাচ্চারা তা বুঝলো না। করে ফেললো একটা ভুল।
-মুনিরাকে বিয়ে করাটাও ভুল নয় কি?
-হ্যাঁ অবশ্যই ভুল। সে যদি তখনো সত্যিটা বলতো এমন একটা সিদ্ধান্ত আমি নিতামই না। আবার একটা কি জানিস নুরুল?
-কি?
-মুনিরাই আমাকে সায়নী আর আফরানের ব্যাপারে সবটা জানায়। মুনিরা যদি ওদের মেনে না নিতো আমি তাদের ডির্ভোস করিয়েই ছাড়তাম। কারো সামনে আসতে দিতাম না কথাগুলো। যেমন গোপনে বিয়ে করেছে তেমনই গোপনে বিবাহ বিচ্ছেদও করাতাম। তাদের ভুলের শাস্তি মুনিরাকে পেতে দিতাম না। কিন্তু মুনিরাই যখন মেনে নিয়েছে আমার আর কি বলার আছে!
বড্ড ভালো মেয়েটা। সুখ তার জন্য অপেক্ষা করছে। দেখিস ভালো থাকবে সে।
.
.
.
রান্নাঘরে রুটি বেলতে ব্যস্ত সায়নী। তখনি আগমন ঘটে আফরানের। আফরান আসার পর তার দিকে নজর পড়তেই চোখ নামিয়ে ফেললো সায়নী।
আফরান তার পাশে এসে বললো-
রেগে আছো?
-উহু!
-তবে নজর লুকোচ্ছো কেনো?
.
কান্না পাচ্ছে সায়নীর। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু আফরানের সামনে তা প্রকাশ করতে চায়না।
আফরানের উদ্দেশ্যে কিছু বলার আগেই মুনিরা প্রবেশ করলো।
সায়নীর উদ্দেশ্যে সে বললো-
রুটি বেলা শুরু করে দিয়েছো! আচ্ছা আমি ছেকে দিচ্ছি দাও।
.
আফরানের দিকে তাকিয়ে মুনিরা বললো-
আপনিও কাজ করবেন আমাদের সাথে?
-শখ নেই। তোমরাই করো।
.
.
মুনিরাকে দেখতে আজ উৎফুল্ল লাগছে। মুনিরার জন্য খুশি হলেও বুকে চাপা কষ্ট যেনো থেকেই যায়।
মুখে বললেও এসব করতে অনেক বেশিই কষ্ট হচ্ছে সায়নীর। এমন কষ্ট আগে হবে জানলে আল্লাহর কাছে আগেই বলতো, সে যেনো সুস্থ না হয়ে মারাই যেতো!
.
.
.
সকাল ১০টা….
মুনিরার বাবা মা তাদের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এমন সময় মুনিরা এসে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-
আজকের দিনটা থাকো?
-মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে থাকা ভালোনা। তোর আব্বার কথা এইটা।
-আব্বার বন্ধুর বাড়িও এটা।
.
মেয়ের কথা শুনে হেসে উঠলেন সেনোয়ারা বেগম। মেয়েকে কাছে টেনে তার কপালে চুমু এঁকে বললেন-
যা করি ভালোর জন্য করি তোর। খারাপ ভাবিস না মাকে।
-উহু।
-আচ্ছা সত্যি করে একটা কথা বলতো? এই বাড়িতে আসলেই পড়ে আছিস কেনো? জামাই কে ভালোবাসিস বলে নাকি আমাদের সম্মানের ভয়ে?
-সম্মানের ভয় আগে থাকলেও ধীরেধীরে আমি উনাকে ভালোবেসে ফেলি। শুধু উনাকে নয়, সায়নী আপুকেও। এই বাড়ির প্রত্যেককে, প্রতিটা কোণাকে। যখন আমি সর্বহারা হতে যাচ্ছিলাম আল্লাহ আমাকে এই পথে পাঠিয়েছেন। সেটা হোক ভুলে, এসেছি তো। ভালোবাসাও পেয়েছি।
-যার দরকার তার তো পাসনি?
-মন বলছে খুব তাড়াতাড়ি পাবো, আর বেশি দেরী নেই।
-তাই যেনো হয় তবে তোর ওই সতীন…
-আম্মা!
-যা বাদ দিলাম।
.
.
মুনিরার মা-বাবা চলে যাবার পরেই নিজের রুমে এসেই শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয় সায়নী।
সারারাত ঘুম হয়নি তার। ভাবছে এখন হয়তো হবে। না ঘুম আসছেনা সায়নীর।
উঠে পড়লো সে। হাটতে থাকলো সারারুমে।
তখনি আগমন ঘটলো আফরানের।
-ঘুমাওনি সারারাত?
-হয়েছে ঘুম। অফিসে যাচ্ছোনা?
-হুম যাবো। মুনিরার আম্মারা যাবার অপেক্ষায় ছিলাম।
-ওহ।
-সায়নী?
-হু?
-ঠিক আছো তুমি?
-আশ্চর্য! ঠিক কেনো থাকবোনা। আমি ঠিক আছি। একদম ঠিক আছি। বরং…
.
আফরানের চোখের সামনেই কথা বলতে বলতে আচমকা অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে ঢ’লে পড়লো সায়নী।
আফরান দ্রুত বেগে সায়নীর কাছে এসে তার মাথাটা কোলের উপর নিয়ে বললো-
সায়নী কি হয়েছে তোমার?
.
.
ডাক্তার সায়নীকে দেখছে ভেতরে।
এদিকে ড্রয়িংরুমে পায়চারী করছে আফরান। মুনিরাও তার পাশে রয়েছে।
আফরান ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললো-
সিঙ্গাপুর নিয়ে চিকিৎসা করেছিলাম সায়নীর। এমনটা তো হওয়ার কথা না। তাহলে চিকিৎসায় কোনো ভুল ছিলো!
-এসব কেনো ভাবছেন আপনি! আপুর কিছু হবেনা। হয়তো শরীরটা হঠাৎ খারাপ করেছে তার। মেজর কিছু না।
-তাই যেনো হয়।
.
রুমের ভেতর থেকে এগিয়ে আসছে ডাক্তার সাথী।
তাকে দেখতে পেয়ে আফরান বললো-
কি হয়েছে সায়নীর? ওর তো অপারেশন হয়েছেই আপনি জানেন, সুস্থও ছিলো সে৷ তাহলে হঠাৎ..
-মি.খান রিলাক্স! আপনি বাবা হতে চলেছেন। সায়নী ইজ প্রেগন্যান্ট। আপনি তবুও সিউর হবার জন্য টেস্ট করাতে পারেন। তবে ঘরোয়া সকল টেস্ট শেষ করেই ব্যাপারটা সিউর হয়েই বললাম আমি।
.
.
.
সায়নীকে কোলে তুলে ঘুরছে আফরান।
সায়নী খবররটি শোনার পর তার সব কষ্ট যেনো নিমিষেই ভুলে গেলো! তার আর আফরানের অংশ আসতে চলেছে পৃথিবীতে। এর চেয়ে খুশির খবর কিইবা হতে পারে! এই খুশির কাছে দুনিয়ার সকল কষ্টই যেনো তুচ্ছ।
.
.
-আমার আফরানের অংশ আসতে চলেছে! আমার বংশধর আসতে চলেছে!
.
মুনিরার মুখে খবরটি শোনার পর খুশিতে চোখে পানি চলে এলো আফজাল খানের চোখে।
মুনিরার উদ্দেশ্যে তিনি বললেন-
আমাকে নিয়ে চলো ওদের কাছে।
.
-নিতে হবেনা। আমরাই এসেছি।
.
আফরানের কথা শুনে আফজাল খান বললেন-
এদিকে আয় ব্যাটা৷ আমার ঘরে নাকি জুনিয়র আফরান আসতে চলেছে?
.
বাবার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আফরান বললো-
সে জুনিয়র আফজাল খানও হতে পারে।
.
বাবা ছেলের আনন্দ দেখে দুই বউ এর চোখের কোণাও যেনো ভিজে গেলো।
সায়নীকে জড়িয়ে ধরে মুনিরা বললো-
সে কিন্তু জুনিয়র সায়নীও হতে পারে। কি বলো আপু?
.
মৃদু হেসে সায়নী বললো-
আল্লাহ যা দেন আরকি।
.
আফজাল খান সায়নীকে উদ্দেশ্যে করে বললেন-
এদিকে আয় মা, দোয়া করি তোকে প্রাণ ভরে।
.
.
.
সারা মহল্লায় হাসির মাধ্যমে মিষ্টি বিতরণ শুরু করে ফেললেন আফজাল খান।
বাসায় এতো মিষ্টির প্যাকেট দেখে আফরান বললো-
বাবা! বাচ্চা হওয়ার পরেও বিতরণ করতে হবে তো। আজই সব করে ফেলবে নাকি?
-আমার কি টাকা কম আছে নাকি হ্যাঁ? এখনো করবো, তখনো করবো। আরে সবাই দোয়া করার জন্য মাসে মাসে করবো। আমার নাতী আসতে চলেছে বলে কথা।
.
আফজাল খানের কথা শুনে সকলে হেসে চলেছেন।
মুনিরার ফোন বেজে উঠলে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো মায়ের ফোন।
সে একটু দূরে গিয়ে ফোন রিসিভ করে বললো-
হ্যালো আম্মা? পৌছে গিয়েছো তোমরা?
-হ্যা।
-জানো আম্মা একটা খুশির খবর আছে।
-কি?
-সায়নী আপু প্রেগন্যান্ট।
-কখন হলো? না মানে সকালেও ওখানে ছিলাম কিছুতো শুনলাম না।
.
মুনিরার মুখে সবটা শোনার পর সেনোয়ারা বেগম বললেন-
এখন দেখবি তোর এই বোনের পরিবর্তন।
-মানে?
-মানে আফরানের মন এতোদিন সায়নীর দিকেই ছিলো এখন আবার সে পোয়াতি। তুই ওই বাড়ির পার্মানেন্ট কাজের মেয়ে হওয়ার প্রস্তুতি নে।
-একটা শিশু দুনিয়াতে আসতে চলেছে তার জন্য শুভ কামনা না করে এসব ভাবছো তুমি!
-কারণ তুই আমার মেয়ে।
আমি চাই তুই সুখে থাক। সম্মান নিয়ে আসছিস না, যখন দূরদূর করে তাড়িয়ে দেবে তখন তুই বুঝবি।
-তোমাকে এসব বলাই আমার ভুল হয়েছে আম্মা।
.
কথাটি বলার পরেই ফোন কেটে মুনিরা নিজের মনে বললো-
উনি কাল বলেছেন, আমাদের সম্পর্কে সুযোগ দিবেন। আর সায়নী আপু মা যেমনটা বলছেন মোটেও তেমন নয়। কেনো যাবো আমি! তারা আমার ভালোবাসার মানুষ। তাদের ছেড়ে আমি কোথাও যাবোনা।
.
.
বিছানার উপরে মোবাইলটা ছুড়ে মারলেন সেনোয়ারা বেগম।
বিড়বিড় করে তিনি বললেন-
কি আছে আমার মেয়ের কপালে! এতোদিন কাজের মেয়ে ছিলো এখন সে বাচ্চার আয়াও হবে!

১১দিন কেটে গেলো…..
মুনিরাকে দেয়া কথা রাখার চেষ্টা চালু থাকলেও সায়নীর সাথে বেশি সময় কাটাতে হয় আফরানের। কেননা গর্ভবতী কালীন মেয়েদের মেজাজ কারণে অকারণে খারাপ হয়। সায়নীরও এর ব্যতিক্রম হচ্ছেনা। হুট করেই মেজাজ বিগড়ে যায় আবার হুট করে ভালোও হয়ে যায়।
বাসার সকলে সায়নীর দিকে বিশেষ মনোযোগ রাখছে।
তবে ইদানীং সায়নী নিজের রুমেই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটায়। মুনিরার সাথে আগের মতো বসে গল্পও করেনা।
হয়তো মুনিরার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে তাই।
.
অফিস থেকে এলো আফরান। হাসির মা দরজা খুলে দিতেই সে সোজা চলে গেলো মুনিরার রুমে।
-এ কি আপনি!
-হু। পড়ছো?
-হ্যাঁ।
-তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি।
-কি?
.
মুনিরার দিকে একটি প্যাকেট বাড়িয়ে দিলো আফরান।
মুনিরা খুলে তাতে একটি লাল রঙের জামদানি শাড়ি দেখতে পেলো।
উৎফুল্ল দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুনিরা বললো-
অনেক বেশি সুন্দর!
-সত্যি?
.
আফরানের কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে মুনিরা বললো-
হু সত্যি।
.
.
.
আফরান এসেছে প্রায় ১৫মিনিটের বেশি হচ্ছে। এখনো সায়নীর রুমে আসছেনা কেনো! এমন টা তো হয়না। প্রতিবার সায়নীর কাছেই আগে আসে সে।
রুমের মাঝে পায়চারী করতে করতে আফরানের অপেক্ষা করছে সায়নী।
এরইমাঝে আগমন ঘটলো আফরানের।
সায়নীকে দেখতে পেয়ে সে বললো-
আমার রানীটা কে অস্থির অস্থির মনে হচ্ছে যে?
-এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
-মুনিরা ও বাবার সাথে দেখা করে এসেছি।
-ওহ!
.
আফরান তার হাতে থাকা প্যাকেট থেকে গোলাপি রঙের একটি জামদানি শাড়ি বের করে এগিয়ে দিলো সায়নীর দিকে।
সায়নী বললো-
আমার জন্য এটা?
-তোমার দিকে বাড়ালাম মানে তোমারই।
-সুন্দর। মুনিরাকে দিয়েছো?
-হুম।
-এমনি?
-না৷ লাল রঙের।
-কেনো?
.
বিছানার উপর বসতে বসতে আফরান বললো-
কেনো মানে? যে যেমন রঙ পছন্দ করে তাকে তেমনি দিলাম।
-আজকাল দেখছি অনেক কিছুরই খেয়াল রাখো তুমি।
-মানে?
-আগে তুমি আমার কাছেই আসতে আজ হলো এর বিপরীত। কেনো?
.
সায়নী কি ইঙ্গিত করছে বুঝতে পারলো আফরান।
মৃদু হেসে সে বললো-
তোমার সাথে তো আমি থাকবই। তাই তো ওদের সাথে দেখা করে এলাম।
-মুনিরার সাথে থাকো গিয়ে। আমি কিছু বলবো না।
.
আফরান সায়নীর পাশে এসে তার দুগালে হাত দিয়ে বললো-
কি হয়েছে সায়নী তোমার বলো তো? মনে কি চলছে তোমার? আমাকে বলো?
.
এ কি করছে সে! সে এটা করতে পারেনা। সে সুস্থ হয়েছে তার সন্তান আসতে চলেছে বলে মুনিরাকে দেয়া কথা সে ফেলতে পারেনা৷ ভুলতে পারেনা মুনিরার জন্যই সমাজে স্বীকৃতি পেয়েছে সে।
নিজেকে সামলে নিয়ে আফরানের বুকে মাথা রেখে সায়নী বললো-
কিছুনা। মিস করছিলাম তোমাকে।
.
আফরানও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সায়নীকে।
ডাক্তার বলেছে এই সময়ে মুড সুইং হয় যখন তখন। এসব মানিয়ে চলতে হবে।
.
.
হঠাৎ কলিং বেলের শব্দ হতেই আফরানের উদ্দেশ্যে সায়নী বললো-
তুমি বসো, আমি দেখছি কে এসেছে।
.
দরজা খুলেই সায়নী পাশের বাসার নতুন বউ এর দেখা পেলো। সাথে তার শ্বাশুড়ি সীমা আক্তারও এসেছেন।
তারা সায়নীর সাথে এসে সোফায় বসলেন।
-এই হলো আমার পুত্রবধু। তোমার সাথে দেখা করাতে আনলাম।
.
নতুন বউ এর দিকে তাকিয়ে সায়নী বললো-
ভালো আছো?
-জ্বী আছি।
.
মহিলাটি তার ছেলের বউ কে উদ্দেশ্য করে বললেন-
এইটা হলো প্রথম বউ। কতো ধৈর্য্য এই মেয়ের! ঘরে আরেকটা বউ আনছে তাও সে চুপচাপ আছে। আর ওই মুনিরা মানে ছোট বউ টা এতোটা বেহায়া সব কিছু জেনেও পড়ে আছে এখানে।
.
-আপনি এসব বলতে এসেছেন এখানে?
.
আফরানকে দেখতে পেয়ে সীমা আক্তার চমকে গেলেন। থতমত খেয়ে তিনি বললেন-
আসলে…
.
সোফার উপরে বসে নতুন বউ এর উদ্দেশ্যে আফরান বললো-
মানুষের শোনা কথায় কান দিতে নেই। আমি ইচ্ছে করে দুটো বিয়ে করিনি।
-আমি কি শুনতে পারি আপনার কাহিনী?
-হু।
সায়নীকে ভালোবাসি আমি। বিদেশ থেকে ফিরে এসে হঠাৎ তার বিয়ের কথা শুনে মানতে পারিনি। বাবা নিজে বিয়েটা করাবেন বলে জানিয়েছেন। ওই সময় কি করবো মাথায় কাজ করছিলো না। তাই সায়নীকে বাধ্য করি আমাকে বিয়ে করতে। ওর হবু বর দেশে আসার পরেই বাবাকে সব জানাবো ঠিক করি।
.
নতুন বউটি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-
তারপর?
-বাবার সাথে মুনিরার গ্রামের বাড়িতে তার ব বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে এটেন্ড করতে যাই আমি। ওখানে তার হবু বর আনাস আসার পথেই মারা যায়। যে কারণে মেয়েটিকে মানে মুনিরাকে অলক্ষী হিসেবে গ্রামের সকলে অপমান করতে থাকে। বের হয়ে যেতে বলে গ্রাম থেকে।
বাবার বন্ধুর মেয়ে মুনিরা। আর মুনিরার বাবা আমাকে ছোটবেলায় পানি ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিলেন। এভাবে তাকে করা অপমান সহ্য করতে না পেরে বাবা আমার থেকে জিজ্ঞাসা না করেই বলে ফেললো, মুনিরাকে বিয়ে করবো আমি।
বাবাকে যদিও আমি বলেছি এই বিয়েটা আমি করতে পারবোনা তবে আমার গোপন বিয়ের কথা এতো এতো মানুষের সামনে বাবাকে জানাতে পারিনি আমি।
এদিকে একটা মেয়ের অসহায়ত্ব দেখে আমারো খারাপ লাগছিলো। কি হয়েছিলো জানিনা আমার, তবে হ্যাঁ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। বিয়ে করে নিই মুনিরাকেও।
কিন্তু আমার মন তো সায়নীতেই আটকে ছিলো। তাই সিদ্ধান্ত নেই ডির্ভোস দিবো মুনিরাকে।
মুনিরাকে শুরুতে সবটা লুকোই আমরা। সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। কিছুদিন পর আমরা বলার আগেই মুনিরা আমাদের ব্যাপারে জেনে যায়। তবে সবটা না৷ সে ভেবেছিল আমাদের মাঝে অবৈধ সম্পর্ক আছে।
-জেনে কি করলো?
-জানার পর সে সায়নীকে অপমান করলো৷ মিথ্যে অপবাদ সহ্য করতে না পেরে সায়নী তাকে সব সত্যিটা জানায়।
সব জানার পরেও নিজের কথা ভেবে মুনিরা থাকতে চায় এই বাড়িতে। সায়নী এটা মানতে পারবেনা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। রাস্তায় ছুটতে থাকে পাগলের মতো। হঠাৎ একটা গাড়ি সায়নীর দিকে এগিয়ে আসলে মুনিরা তাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই এক্সিডেন্ট করে বসে।
-কোনো ক্ষতি হয়েছে কি তার?
-আল্লাহর রহমতে হয়নি। সুস্থ হয়ে যায় মুনিরা। তবে এই ঘটনার পরেই সায়নীর মনে জন্মে তার জন্য ভালোবাসা। কিন্তু মুনিরা তখন আমাদের মাঝ থেকে সরে যেতে যায়। দুইটা ভালোবাসার মানুষের মাঝে দাড়াল হয়ে থাকতে চায়নি সে।
-তবে এখনো যায়নি কেনো?
-সায়নীর জন্য। সায়নীর প্রায় অসুস্থ থাকতো। তাই তার টেস্ট করিয়েছিলাম৷ টেস্টের রিপোর্ট আসলো তার ব্রেইন টিউমার হয়েছে। সায়নী ভেবেছিলাও সে সুস্থ হতে পারবেনা। তাই সে চেয়েছে মুনিরা আমার পাশেই থাকুক। তার অবর্তমানে মুনিরাই আমার খেয়াল রাখতে পারবে।
-তারপর?
-তারপর আর কি। দুই বোনের মাঝে কথা হয়েছে সায়নী সুস্থ হয়ে ফিরে আসলেও মুনিরাকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেনা।
-হুম।
-সায়নীর মন বলছিলো সে সুস্থ হবেনা। তাই সে বাবাকেও আমাদের বিয়ের ব্যাপারে জানাতে চায়নি আর।
কিন্তু মুনিরা ঠিকই বাবাকে মেনেজ করে নেয়। সায়নী বাবার মেয়ের জায়গা দখল করে ছিলো। আর মুনিরা সবটা মেনে নিয়েছে তাই বাবাও মেনে নেয় আমাদের।
-আপনি মানতে পেরেছেন কি মুনিরাকে?
-এই এক বছরেও পারিনি। তবে এখন চেষ্টা করছি।
.
আফরানের কথা শুনে সীমা আক্তার বললেন-
কি দরকার এত মানা মানির? ওই মেয়েকে ছেড়ে দিলেই হয়। এক ঘরে দুইটা বউ! ছি ছি…
.
কথাটি শুনে তার ছেলের বউ বললো-
ছি টা শুধু মুনিরা আপুর জন্যই কেনো! যা করেছে আফরান ভাইয়া ও সায়নী আপু৷ তাই বলে মুনিরা আপু কেনো শাস্তি পাবে? তিনি তো চলে যেতেই চেয়েছিলেন।
-তখন সায়নী অসুস্থ ছিলো এখন সে সুস্থ। বাচ্চাও হচ্ছে তার। একটা মেয়ের পক্ষে কি করে মেনে নেয়া সম্ভব এসব? তুই হলে কি করতি?
-আপনাকে মুনিরা আপুর মতো আশা দিয়ে পরে ঠকানো হলে আপনি কি করতেন মা? সতীনের ঘরে সন্তান হতে যাচ্ছে শুনেও মেনে নিতেন এসব?
-আরে মুনিরার মা বাবা আছে। সায়নীর আপন বলতে এই আফরানই আছে।
-কিন্তু সায়নী আপুকে মুনিরা আপুর মতো অলক্ষী অপবাদ শুনতে হয়না। মুনিরা আপুর জন্য তার মা বাবাকেও কথা শুনতে হয়। আমি মুনিরা আপুর জায়গায় থাকলে কখনো নিজের স্বামীকে ছেড়ে যেতাম না।
-আমিও সায়নীর জায়গায় থাকলে জামাই ছেড়ে যেতাম না।
.
শ্বাশুড়ী বউ মার কথা শুনে মৃদু হেসে সায়নী বললো-
আমরাও সেটা পারছিনা। পরিস্থিতি, ভুল, সম্মানহানি, বেহায়াপনা যাই হোক না কেনো, নিজের স্বামিকে ছেড়ে যেতে পারছিনা আমরা।
আপনারা হয়তো খুব সহজেই বলে দিচ্ছেন যেকোনো একজন থাকলেই ভালো হতো। কিন্তু সে যেকোনো একজন কে হবে? আপনার মতে আমি আর আপনার পুত্র বধুর মতে মুনিরা। কিন্তু ঘটনা আমাদের সাথে ঘটেছে। তাই আমরাই যেতে পারছিনা।
.
সায়নীর কথা শুনে সীমা আক্তার বললেন-
আফরান যাকে ভালোবাসে সে থাকলেই হয়।
-বিষয়টা এখন শুধু ভালোবাসাতে সীমাবদ্ধ নয়।
নিজেকে একজনের জায়গায় দাঁড় না করিয়ে দুজনের জায়গাতেই দাঁড় করান। আপনি হলে কি করতেন তখনি বুঝতে পারবেন। যত যাই হোক, নিজের স্বামী কে ছেড়ে দেয়া সম্ভব নয়। কেননা এখানে আফরানের দোষ নেই। সে কেবলমাত্র পরিস্থিতির স্বীকার।
.
কথাগুলো বলার পর লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লো সায়নী। মনে যাই চলুক বাইরে তা প্রকাশ করা যাবেনা।
.
.
আড়াল থেকে কথা গুলো শোনার পর মুনিরার মনে আসলো-
আমি আসলেই দুইটা ভালোবাসার মানুষের মাঝে দাড়াল হয়ে আছি কি!
.
.
.
সকাল ৫.৩০….
নামাজ সেরে পড়ার টেবিলে বসে এক মনে পড়ে চলেছে মুনিরা। মাঝেমাঝে তার মনে চলে আসছে সীমা আক্তারের বলা কথাগুলো। সেসব কথা ভুলে যাওয়ার জন্য জোরে জোরে শব্দ করে পড়ছে সে।
হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠলো।
স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো তার মায়ের ফোন।
এতো সকালে মা ফোন করেছে কেনো!
কোনো এক অজানা ভয় কাজ করছে মুনিরার মাঝে।
দেরী না করেই ফোন রিসিভ করলো সে।
তখনি ওপাশ থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার মা বলে উঠলো-
মুনিরা রে….. সব শেষ হয়ে গেলো মুনিরা, সব শেষ হয়ে গেলো।
.
মায়ের এমন আহাজারি শুনে বুকের ভেতরটায় ধুক করে উঠলো মুনিরার।
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। মায়ের উদ্দেশ্যে সে বললো-
কি হয়েছে আম্মা? এমন করছো কেনো তুমি?
-তোর বাবা ঘুম থেকে উঠছেনা মুনিরা। নামাজ পড়তে উঠছেনা। বাড়ির সবাই তাকে ডাকাডাকি করছে তাও উঠছেনা। সবাই বলছে তার শরীরটা আছে প্রাণ নাকি নাই।
এসব কি বলছে সবাই! তুই আয় মা। এখুনি আয়। নিশ্চয় তোর ডাকে সাড়া দিবে তোর বাবা। তুই না ডাকলে সে না উঠে পারবেই না। আয় মা তুই।
.
.
আফরানদের দরজায় ধুমধুম শব্দ শুনতে পেরে ঘুম ভেঙ্গে গেলো তাদের।
চোখ জোড়া কচলিয়ে সায়নী বললো-
এই সকালে কে?
-মুনিরা নয়তো?
.
দরজার ওপাশ থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মুনিরা বলছে-
আপু দরজা খুলো।
.
মুনিরার গলার এমন শব্দ শুনে নিজের বাবার জন্য আফরানের মনে ভয় কাজ করা শুরু করলো। ঠিক আছে তো তার বাবা!
.
আফরানের উদ্দেশ্যে সায়নী বললো-
দরজা টা খুলো আফরান তাড়াতাড়ি।
.
দরজা খোলার পরেই আফরান কে দেখতে পেয়ে তার বুকের মাঝে ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকলো মুনিরা।
বিছানা ছেড়ে উঠে এসে সায়নী জিজ্ঞাসা করলো-
মুনিরা কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেনো?
.
আফরানের কাছ থেকে নিজের সরিয়ে নিয়ে সায়নীর পাশে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে মুনিরা বললো-
আপু.. আমার আব্বা নাকি চোখ খুলছেনা। সবাই বলছে তিনি নাকি…
.
আর কথা বলতে পারছেনা মুনিরা।
কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সে।
মুনিরার কথাটি শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো আফরান ও সায়নী দুজনেই। এইতো একমাস আগেই নুরুল আলম কে সুস্থ দেখেছেন তারা। এখন এসব কি শুনছে!
নিজেকে সামলে নিয়ে মুনিরার উদ্দেশ্যে সায়নী বললো-
সামলা নিজেকে। তুই এমন করলে তোর মায়ের কি হবে!
.
সায়নীর কোনো কথা যেনো মুনিরার কানে যাচ্ছেনা। এক নাগাড়ে কেঁদে চলেছেই সে।
আফরানের দিকে তাকিয়ে সায়নী বললো-
মুনিরার গ্রামে যাবার ব্যবস্থা করো। ড্রাইভার কে ফোন দিয়ে গাড়ি বের করতে বলো?
-বাবাকে বলবো?
-নিশ্চয়। বাবার বন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ তাকে জানাতে হবে।
.
মুনিরার পিঠে হাত বুলিয়ে সায়নী বললো-
মুনিরা শক্ত হো। গ্রামে যেতে হবে তোকে।
.
.
সকলে তৈরী হলেও আফজাল খানের কথায় সায়নী হয়নি।
সায়নী প্রেগন্যান্ট। এই অবস্থায় তার ওখানে যাওয়া ঠিক হবেনা।
ইচ্ছে থাকলেও বাবার কথা রাখলো সায়নী।
গাড়িতে উঠার আগে তার পাশে এসে আফরান বললো-
সকাল ৭টাই হাসি আসবে তোমার কাছে। নিজের খেয়াল রেখো।
-বাবার শরীর তো ভালোনা। খেয়াল রেখো উনার। মুনিরার আর নিজের ও রেখো।
-হু।
.
.
.
সকাল ১০টা পার হলো মুনিরা যখন তার গ্রামের বাড়ি এসে পৌছায়।
তার বাবার শেষ গোসল কাজ সম্পন্ন হয়েছে মাত্র।
বাড়ির ড্রয়িং রুমে পাটি বিছিয়ে দেহটা সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
মুনিরা ধীরেধীরে এগিয়ে গেলো বাবার মৃত দেহটার দিকে।
মুখের উপর থেকে কাপড় সরাতেই যেনো সে স্তব্ধ হয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পলকহীন চোখে বাবাকে দেখার পর ফুফিয়ে কেঁদে উঠে বললো সে-
আম্মা বলেছে, আমি বললে নাকি তুমি ঘুম থেকে উঠে যাবে। তাই আমি ছুটে এসেছি। উঠোনা আব্বা ঘুম থেকে। দেখোনা তোমার মেয়ে এসেছে।
.
বাবার কোনো সাড়া না পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলো মুনিরা।
আফরানের মনে পড়ে গেলো তার মা হারানোর দিনটির কথা।
আফরান তার পাশে এসে বসে বললো-
শান্ত হও মুনিরা, শান্ত হও।
.
আফজাল খান ও এক পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলে চলেছেন।
আর বিড়বিড় করে তিনি বলছেন-
মেয়ের সুখটা দেখে যেতে পারলি না রে নুরুল!
.
.
.
-তোর সাথে একটা রাজপুত্রের বিয়ে দিবো আমি। রাজরানী হয়ে থাকবি তুই।
-আমার তো রাজকুমারী থাকতেই ভাল লাগছে।
-রাজকুমারী একসময় রাজরানী হয়রে মা।
.
নিজের বাবার কথা মনে হতেই চোখের কোণায় পানি চলে এলো সায়নীর।
এক দিনেই মা বাবাকে হারিয়েছে সে এক্সিডেন্টের মাধ্যমে।
তার উপর দিয়ে কি বয়ে গিয়েছে সে ছাড়া কারো বোঝার উপায় নেই।
মা মানেই মমতাময়ী। আর বাবা মানেই মাথার উপরের ছায়া।
দুজনের একজনেরও সায়নীর নেই। তাই সে মুনিরার কষ্ট টা উপলব্ধি করতে পারছে সহজেই।
.
.
.
বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেলো।
দাফন কাজ সম্পন্ন করেই মাত্রই ঘরে এসেছে আফরান।
সে দেখতে পেলো মুনিরাকে ঘিরে ধরেছে গ্রামের প্রায় মহিলা।
আফরান একটু কাছে যেতেই শুনতে পেলো একটি মহিলার কথা।
-আরে আমিতো বলেছিলামই এই মেয়ে রাক্ষুসী। প্রথমে ভালো পোলা আনাস রে খাইছে আর এখন নিজের বাপরে। এতো চিন্তা করলে মানুষ বাঁচতে পারে! সংসারেও অসুখী এই মাইয়া। তাই নাকি আরেকটা বিয়ে দেবার কথা চলছিলো। বাপটা এসব নিয়া চিন্তা করতে করতেই মারা গেলোরে… নাহলে সুস্থ মানুষ। রাতে ঘুম দিলো। সকালে আর উঠলোনা। মেয়ের চিন্তায় ঘুমের মাঝেই ওপারে চলে গেলো।
.
মুনিরার পাশে এসে আফরান বললো-
এই মহিলা কে?
.
শান্ত গলায় মুনিরা জবাব দিলো-
আমার ফুফু।
-ফুফু হয়ে নিজের ভাগনীর নামে এসব কি বলছেন আপনি?
-ওহ হো! আসছে আমার ভালো পোলা! দুই বিয়া করেও গলার জোর কমেনাই তাইনা তোমার? মুনিরারে তো আরেকটা বিয়া দিতে চাইছো শুনলাম। তা এখুনি রেখে যাবে নাকি তাকে?
.
সেনোয়ারা বেগম এতাক্ষণ চুপচাপ তার কথা শুনলেন।
এপর্যায়ে মুখ খুললেন তিনি-
জামাই তুমি মুনিরাকে নিয়ে চলে যাও। তুমি তো মুনিরার আব্বাকে কথা দিয়েছিলে মুনিরার খেয়াল রাখবে। কথা রাখবেনা বলো?
.
তার পাশে এসে মুনিরা বললো-
আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা মা।
-আমার কসম লাগে তোকে যেতে হবে। নাহলে এরা তোকে শান্তিতে থাকতে দিবেনা মা। যা চলে যা তুই, চলে যা।
.
.
.
রক্তাক্ত তিনটা শরীর। চেহারা বোঝারও উপায় নেই কোনটা কে।
তবে হ্যাঁ একটা তার বাবা, একটা মা আরেকটা তার খালা ডাক্তার শনাক্ত করছেন।
চোখের সামনে তিনজন আপন মানুষের লাশ দেখে চিৎকার করে উঠলো সায়নী।
.
সায়নীর চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেলো হাসির।
সায়নী ঘুমের মাঝে আবোলতাবোল বলে যাচ্ছে।
হাসি তাকে ডেকে বললো-
সায়নী আপু, ঠিক আছো তুমি?
.
ঘুম ভেঙ্গে গেলো সায়নীর।
স্বপ্নে তার মা বাবা হারানোর দিনটা আবারো দেখতে পারলো সে।
হাঁপাতে হাঁপাতে বললো সায়নী-
মা, বাবা এভাবে চলে গেলে তোমরা আমাকে ফেলে!
.
হাসি বুঝতে পারলো আজ অনেক বছর পরে মুনিরার বাবার মৃত্যুর সংবাদ শুনে নিজের মা বাবার কথা মনে পড়ছে সায়নীর।
হাসি সায়নীর জন্য পানি আনতে এগিয়ে যাচ্ছে ডাইনিং রুমের দিকে।
তখনি কলিং বেলের শব্দ শুনতে পেলো সে।
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো রাত ১১.২০!
এতো রাতে কে হতে পারে তা দেখার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে গেলো সে।
.
সায়নীও এগিয়ে গেলো ড্রয়িং রুমের দিকে।
.
.
মুনিরাকে মেঝের উপর চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সায়নী তার পাশে এসে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো তাকে।
মুনিরা ফুফিয়ে কেঁদে বলে উঠলো-
কাল পাশের বাসার মহিলাটা বলেছিলো না আমার মা বাবা উভয়ই আছে! তাকে ডেকে বলো আপু আমার বাবা আর নেই! তাকে ডেকে বলো….

মুনিরার কথাটি শুনে সায়নীর বুকে তীরের মতো আঘাত করলো। আসলেই তো, কালই সীমা আক্তার বলেছিলেন মুনিরার মা বাবা আছে। আর আজই এমন একটা অঘটন ঘটে গেলো। মহিলাটির কথা মুনিরাকে বড্ড আঘাত করেছে।
.
আফজাল খান বললেন-
তোমরা দেখো মেয়েটাকে। আমি নিজের রুমে গেলাম। মনটা ভালো নেই।
..
আফজাল খান এগিয়ে যেতেই আফরানের দিকে তাকিয়ে সায়নী বললো-
তোমরা আজই চলে এলে কেনো? না মানে সেনোয়ারা আন্টির পাশে মুনিরার থাকাটা দরকার ছিলো।
.
আফরান কিছু বলার আগেই সায়নীর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মুনিরা বললো-
সেটাও আমার কপালে সইলো না আপু। এই সময়ে আমি আমার মায়ের পাশেও থাকতে পারলাম না। সকলে কথা শোনাচ্ছিলো আমাকে। আমার জন্যই নাকি আব্বা চিন্তা করতে করতে অপারে চলে গিয়েছেন।
এসব শুনে আম্মা আমাকে রাখলেন না তার সাথে। মায়ের দুঃখের সময়েও আমি তার পাশে নেই। এর থেকে অভাগী কেউ আছে দুনিয়াতে!
.
আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো মুনিরা।
মুনিরাকে এমন অবস্থায় কেনো যেনো আর দেখতে ভালো লাগছেনা আফরানের।
নিজের রুমের দিকে হনহনিয়ে এগিয়ে গেলো সে।
.
এদিকে মুনিরাকে নিয়ে সায়নী তার রুমে আসলো।
বিছানার উপরে বসিয়ে তার দুহাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো-
এভাবে কান্নাকাটি না করে আঙ্কেলের জন্য দোয়া কর। ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। কবরে শান্তি পায় মতো দোয়া কর।
.
শান্ত গলায় মুনিরা জবাব দিলো-
হু আপু কবরে শান্তি পাবে। আমার জন্য তো দুনিয়াতে শান্তির মুখ দেখলোনা!
.
.
.
আজ আমার জন্যই মুনিরার এই অবস্থা৷ সেদিন যদি ওকে বিয়েটা না করতাম তাহলে ওর এতো এতো কথা শুনতে হতোনা।
মুনিরার কি আসলেই এসবই প্রাপ্য!
.
নিজের মনে এসব বলে পায়চারী করে চলেছে আফরান।
সায়নী এসে তাকে এমন অস্থির দেখে বললো-
ঠিক আছো তুমি?
-না নেই। আমিই যত নষ্টের মূল। আমার জন্য মুনিরার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেলো। বেচারি কে সবাই এতো কথা শুনায় সে বলতেও পারেনা তার স্বামীর ভালোবাসা পেয়েছে সে। তুমিই বলো সায়নী? ওর এই পরিণতির জন্য আমিই দায়ী তাইনা? এমন একটা মুহুর্তে মায়ের পাশেও থাকতে পারলোনা মেয়েটা।
.
আজ অনেকদিন পর আফরানের চোখে পানি দেখলো সায়নী।
এটা কি অনুশোচনার জন্য নাকি শুধুমাত্র মুনিরার কষ্টের জন্য?
.
আফরানের পাশে এসে তার কাধে হাত রেখে সায়নী বললো-
এখন এসবের সময় নয় আফরান। মুনিরার পাশে থাকার সময় এখন। আমরা নিজেরাই যদি ভেঙ্গে পড়ি মেয়েটা শক্ত হতে পারবে কি?
.
সায়নীকে জড়িয়ে ধরে আফরান বললো-
হুম।
-আমি আজ মুনিরার সাথে থাকবো।
-তোমার নিজের শরীর ঠিক নেই সায়নী।
-এই সময় ওকে আমি একা ছাড়তে পারিনা আফরান। তোমার উপরও কম দখল যায়নি।
-হু।
-হাসিকে বলেছি খাবার তৈরী করতে। সবাই কিছু খেয়ে নিও।
-তুমি খেয়েছো?
-হু।
-সত্যি?
-হু।
-দেখো সায়নী এই সময় তোমার নিজের থেকে নিজেরই খেয়াল রাখতে হবে।
-রাখছি।
.
সায়নীর পেটে হাত দিয়ে আফরান বললো-
যত যাই হয়ে যাক, যে আসতে চলেছে তার যেনো অযত্ন না হয় আর তার মায়েরও।
.
.
.
কারো চাপা কান্নার শব্দে
ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো সায়নীর। মাত্রই চোখটা লেগে এসেছিলো তার।
উঠে বসে পড়লো সায়নী। বারান্দা থেকে ভেসে আসছে এই শব্দটি।
ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো সায়নী সেদিকে।
শাড়ির আঁচল মুখের উপর চেপে রেখে কেঁদে চলেছে মুনিরা।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সায়নী বললো-
চাপা কান্না নয়, প্রাণ খুলে কাঁদ, কাঁদতেই যদি হয়। হালকা লাগবে।
.
এতক্ষণ মুনিরার বকবকানির জন্য সায়নী ঘুমোতে পারেনি।
যেই তার চোখটা লেগে এসেছে মুনিরার নিজেকে একাএকা লাগছিলো। কিন্তু সায়নীর ঘুম ভাঙ্গার ইচ্ছে তার মোটেও নেই। তাই বারান্দায় এসে কান্না লুকোনোর বৃথা চেষ্টা করছিলো সে।
সায়নীর কাছে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলো মুনিরা।
এবার আর সায়নী তাকে আটকালো না।
কাঁদলেই যদি মেয়েটার মন হালকা হয় তাহলে কাঁদুক না সে!
.
.
.
সকাল ১০টা হয়ে গেলো।
সকলে জেগে থাকলেও কাল রাত থেকে মুখে কেউ কিছু নেয়নি।
ড্রয়িং রুমে আফরান বসে আছে তার বাবার সাথে।
সায়নী একটা ট্রে হাতে নিয়ে টেবিলে রেখে বললো-
এবার অন্তত খাও কিছু তোমরা।
.
দুজনেই জবাব দিলো-
ইচ্ছে নেই।
-ওহ তাই! না খেলে সব ঠিক হয়ে যাবে কি?
.
এবার দুজনেই চুপ হয়ে আছে। তাদের এমন নীরব দেখে সায়নী বললো-
ঠিক আছে। খেতে হবেনা কাউকে কিছু। আমিও খাবোনা।
.
ভ্রু জোড়া কুচকে আফরান বললো-
তার মানে তুমিও খাওনি এখনো!
তুমি এসব করবেনা বললাম, খেয়ে নাও।
-আমি এসবই করবো।
.
মৃদু হেসে আফজাল খান ট্রে এর উপর থেকে এক বাটি নুডলস নিয়ে বললেন-
এই মেয়ে বড্ড জেদি আফরান। খেয়ে নে। নাহলে নিজেও খাবেনা।
.
সায়নীর দিকে তাকিয়ে আফরান বললো-
এদিকে আসো। খেয়ে নাও।
-তুমি খাবে বলো আগে।
-হু খাবো।
.
সায়নী পাশে বসতেই আফরান তার দিকে বাটি এগিয়ে দিয়ে বললো-
নাও খাও।
-হু।
-মুনিরা খেয়েছে কিছু?
-না। রুমে রেখে এসেছি খাবার তবুও। কি করবো বলো? মুখে তুলছেই না কিছু। বলছে সে একা থাকতে চায় এখন। কাল আবার পরীক্ষাও আছে৷ এমন করলে পরীক্ষা দেয়ার শক্তি থাকবে মেয়েটার মাঝে!
-হুম।
.
.
দুপুর ২টা….
নিজেদের খাবার শেষে মুনিরার জন্য ভাত নিয়ে তার রুমে আসলো আফরান।
মেঝের উপরে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে মুনিরা।
মাথার চুলগুলো এলোমেলো। শাড়ির আঁচল টাও ঠিক নেই।
মুনিরাকে এমন অবস্থায় দেখে আফরানের সেই আগের কথা মনে পড়ে গেলো।
যেদিন অসাবধানতা বশত মুনিরার আঁচলটা সরে গিয়েছিলো আর আফরান তাকে বলেছিলো, শাড়ির আঁচল ঠিক করো। বেহায়ার মতো আমাকে শরীর দেখানোর প্রয়োজন নেই।
.
ইশ! কি কড়া কথাটায় না শুনিয়েছিলো সে মুনিরাকে।
.
মুনিরার পাশে বসে মেঝের এক পাশে প্লেট টা রাখলো আফরান।
নিজে তার আঁচল টা ঠিক করে দিলো।
আশেপাশে তাকিয়ে চিরুনী খুঁজতে লাগলো সে।
ড্রেসিং টেবিলের উপরে চোখ পড়তেই উঠে দাঁড়ালো আফরান।
চিরুনীটা হাতে নিয়ে আবারো মুনিরার পাশে বসে পড়লো সে।
-এই যে? বিছানার সাথে লেগে না থেকে মাথাটা আমার দিকে করো দেখি?
.
মুনিরা চুপচাপ তাই করলো।
আফরান সুন্দরভাবে তার চুলগুলো আছড়িয়ে দিলো।
তারপর তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো-
কিছু কথা বলি শোন৷ জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এই তিনটি আল্লাহ নির্ধারণ করে জানোই তো। তোমার বাবার হায়াত শেষ হয়ে গিয়েছে তাই আল্লাহ তাকে তুলে নিয়েছেন। এতে তোমার কোনো দোষ নেই। তাই নিজেকে দোষারোপ না করে দোয়া করো উনার জন্য। বুঝেছো?
-হু।
-আর কাল তোমার পরীক্ষা আছে। তোমার খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম করলে কি চলবে বলো?
না খেলে পড়ার জন্য শক্তি পাবে? আর না পড়লে পরীক্ষায় কি দিবে? পড়তে হবেনা?
-হু।
-এই তো ভালো মেয়ে। এবার খেয়ে নাও ভাত।
.
শান্ত গলায় মুনিরা বললো-
মন খারাপ থাকলে বাবা ভাত খাইয়ে দিতো। আজ আপনি কি আমাকে খাইয়ে দিবেন প্লিজ।
.
কোনো কিছু না ভেবেই মুনিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আফরান বললো-
হুম। হাত ধুয়ে আসছি আমি।
.
.
.
রাত হলে সায়নীর যেনো অস্থিরতা বেড়ে যায়।
চারমাসও হয়নি সে প্রেগন্যান্ট। এখন থেকেই এমন হলে সামনে আরো কি হবে ভাবতেই আরো খারাপ লেগে উঠে সায়নীর।
মুনিরাকে পড়িয়ে আফরান সায়নীর রুমে আসলো।
সায়নীর চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ দেখে আফরান বললো-
খারাপ লাগছে?
-হু। ঘুমের দরকার ভীষণ।
-তোমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে সায়নী। এমন হলে তো সমস্যা।
দেখি, চুপচাও ঘুমাও।
-কিন্তু মুনিরা?
-আমি খেয়াল রাখবো। তোমার মাঝে আরেকজন আছে এটাও ভুলে গেলে চলবেনা তোমার।
-হু।
.
সায়নী শুয়ে পড়লে আফরান তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
নিমিষেই ঘুমিয়ে পড়লো সায়নী।
.
আফরান বসে পড়লো তার ল্যাপটপ নিয়ে। অফিসের অনেক কাজ জমা পড়ে যাচ্ছে।
.
.
মায়ের নাম্বার ডায়েল করে ফোন দিলো মুনিরা।
একবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ করে বললো-
হ্যালো?
-আম্মা ঠিক আছো তুমি?
-আর ঠিক রে মা! মনে হচ্ছে তোর আব্বা আমাকেও ডাকছে।
-এসব কি বলছো আম্মা তুমি! এসব বলতে নেই।
-মনে শান্তি নাইরে মা শান্তি নাই।
তোর বাবার সাথে আমাকে কেনো নিয়ে গেলোনা আল্লাহ!
-আম্মা! এসব বললে আমি আর কথা বলবোনা তোমার সাথে।
-কথা! এই সময় আমার পাশে থাকার কথা তোর। কিন্তু দেখ কেমন পোড়া কপাল। বাপ মাটিতে ঢোকার সাথে সাথেই তোকেও চলে যেতে হলো। আর কতো দুঃখ সইতে হবে বলতে পারিস আমাদের?
.
এপর্যায়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো মুনিরা। তার কান্নার শব্দ পেয়ে সেনোয়ারাও কাঁদতে থাকলেন।
.
.
হাতের কাজ শেষে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত দুটো বাজে।
সায়নী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
কিন্তু মুনিরার কি অবস্থা?
একবার দেখে আসা যাক।
ভেবেই আফরান এগুলো মুনিরার রুমের দিকে।
বিছানার উপরে বসে বই হাতে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে মুনিরা।
চোখ বেয়ে পড়ছে অঝর ধারায় পানি।
আফরান তার পাশে এসে বললো-
আর পড়তে হবেনা ঘুমাও।
.
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মুনিরা বললো-
আমার কিছু মনে থাকছেনা।
-লেখার সময় মনে পড়ে যাবে।
-আমি পারবোনা কিছু।
-পারবে তুমি।
-আব্বার মুখটা ভেসে আসছে চোখে বারবার। আর আম্মার কথা খুব মনে পড়ছে। আম্মার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে খুব বেশি। কিন্তু পোড়া কপাল, যেতেই পারবোনা আমি।
.
মুনিরার পাশে বসে আফরান বললো-
তোমার আম্মাকে নিয়ে তো আসতে পারবো। কি বলো?
.
ছলছল নয়নে আফরানের দিকে তাকিয়ে মুনিরা বললো-
সত্যি?
-হুম সত্যি। এবার ঘুমাও।
.
অনেকটা সংকোচ করে আফরানের কাছে মুনিরা আবদার করে বসলো-
আমি কি আপনার কোলে মাথা রেখে শুতে পারি? আমি ঘুমোলে না হয় চলে যাবেন আপনি।
-হুম আসো।
.
এই প্রথম আফরানের কোলে মাথা রেখে শুয়েছে মুনিরা।
আফরান তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।
এতো শান্তি আফরানের মাঝে জানা ছিলোনা মুনিরার। পরম শান্তিতে ধীরেধীরে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো সে।
.
.
সকাল ৬টা…
নিজের ঘুম ভাঙতেই আফরান দেখা পেলো মুনিরার।
মেয়েটা ঘুমিয়ে রয়েছে। তাই সে নিজের কোল থেকে খুব সাবধানে মুনিরার মাথাটা বালিশের উপরে রেখে উঠে পড়লো। এগুলো সায়নীর রুমের দিকে।
সায়নীও গভীর ঘুমে লিপ্ত।
সায়নীর মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রেখেছে অজানা নয় আফরানের।
আফরান তার মোবাইল টি নিয়ে এলার্ম বন্ধ করে দিয়ে এগুলো রান্নাঘরের দিকে।
.
.
৭টার দিকে ঘুম ভাঙলো সায়নীর।
পাশ ফিরে আফরান কে দেখতে না পেয়ে উঠে বসলো সে।
তার ডাকেই আফরানের ঘুম ভাঙ্গে। আজ কি এলার্মের শব্দেই ভেঙ্গে গেলো!
সে কেনো শুনলোনা। আর আফরানই বা কোথায়?
হঠাৎ মনে এলো সায়নীর, সে হয়তো মুনিরার কাছে গিয়েছে।
সায়নী উঠে তার চুলে খোপা করে নিলো।
ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে এগুলো রান্নাঘরের দিকে সকালের নাস্তা তৈরী করার জন্য।
.
রান্নাঘরে এসে আফরানকে দেখতে পেয়ে চমকে গেলো সায়নী।
চোখ জোড়া বড়বড় করে সে বললো-
কি করছো তুমি!
-ওহ তুমি উঠে গিয়েছো। এইতো শেষ আমার।
-কি শেষ?
-খিচুড়ি করেছি তোমাদের জন্য।
-আমাকে বললেই হতো।
-তোমাকে ঘুম থেকে তুলতে ইচ্ছে করেনি। গুটিসুটি হয়ে আরাম করে ঘুমোচ্ছিলে তো।
এখন এদিকে এসো। দেখো খিচুড়ি কেমন হয়েছে।
.
.
আফরান খিচুড়ি রেধেছে শুনে মুনিরার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটলো।
এই প্রথম সে আফরানের হাতে তৈরী খাবার মুখে দিলো।
মুনিরার উদ্দেশ্যে আফরান বললো-
কেমন হয়েছে?
-অনেক বেশি ভালো। আপনি দেখছি ভালো রান্নাও করতে পারেন।
-হু পারি তো।
-জানতাম না।
-ধীরেধীরে সবই জানবে।
.
খাওয়া শেষ হলে আফরান বললো-
যাও মুনিরা তৈরী হয়ে আসো। আজ পরীক্ষার সেন্টারে আমি নিয়ে যাবো তোমাকে।
-ঠিক আছে।
.
মুনিরা এগুতেই আফরানের দিকে তাকিয়ে সায়নী বললো-
নুরুল আঙ্কেল ভালো মানুষ ছিলেন। তার কথা মনে পড়লে আমারো খারাপ লাগে।
.
.
.
১৭দিন পর…..
সকাল সকাল ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো সায়নীর।
পায়চারী করছে সে রুমের মাঝে। তখনি ফোন এলো মিশিকার।
ফোন রিসিভ করতে ওপাশ থেকে বললো-
হ্যালো সায়নী? ভিডিও কলে কথা বলবো। তোকে মিস করছি।
-আচ্ছা অনলাইনে আয়।
.
ল্যাপটপ টা নিয়ে সায়নী ড্রয়িংরুমে চলে আসলো।
তাদের কথার শব্দে আফরানের ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে তাই।
.
সোফার উপর বসে অনলাইনে যেতেই মিশিকার ভিডিও কল আসলো।
-হাই সায়নী? কি অবস্থা তোর?
-ভালো রে। তোর কি অবস্থা?
-এইতো ভালোই। শুনেছি তোদের বাসা ডুপ্লেক্স করার প্লান করছিস?
-হ্যাঁ রে৷ কার থেকে শুনলি?
-আফরান ভাই পাবেলকে বলেছে। তা ডুপ্লেক্স করলে তুই কোথায় থাকবি? উপরে উঠবিনা?
-নারে। আমার এটাই পছন্দ। মূলত বাবার কথাতেই মুনিরার জন্য করা হচ্ছে এটা।
-কেনো রে? মুনিরারও বাচ্চা কাচ্চা হতে চলেছে নাকি? আলাদা হয়ে যাচ্ছিস।
-আলাদা কোথায়! উপর নিচেই তো। আর আফরানের সাথে ওর এমন কিছু এখনো হয়নি।
-তোকে হলেও কি বলবে! তাছাড়া হতে আর কতদিন! বাদ দে, তুই সুস্থ আছিস তো?
-হুম আছি।
-মুনিরা ঠিক আছে?
-আছে।
-মেয়েটার মনটা খারাপ হয়ে থাকতে দিস না। অনেক কান্নাকাটি করে শুনলাম।
-হুম। তবে আফরান ওর খেয়াল রাখে অনেক।
-ডিপ্রেশনের সময় সবসময় কারো পাশে থাকাটা জরুরী। নাহলে মনের উপর এফেক্ট পড়ে। আসলে মেয়েটার কথাও কি বলবো। বেচারী মুনিরা। অল্প বয়সে কত কিছু সহ্য করতে হচ্ছে।
-হুম।
-তোর ছেলে হলে কিন্তু আমার মেয়ের সাথে বিয়ে দেবো তার।
-ঠিক আছে দিস।
.
সায়নীর দিকে তাকিয়ে মুখটা ফ্যাকাসে করে মিশিকা বললো-
তোর জন্য মাঝেমাঝে বড্ড কষ্ট হয়রে আমার। কিভাবে পারছিস এসব সহ্য করতে! ভেবে দেখেছিস? মুনিরা না থাকলে হ্যাপি কাপল হতি তোরা। শুধু শুধুই কাবাবের মাঝে হাড্ডি হয়েছে সে। যদিও ওর ও কোনো দোষ নেই। তবুও তুই যেহেতু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, তোর কথা মনে হলেই খারাপ লাগে।
-ওসব ছাড় এখন। পাবেলের কি অবস্থা বল?
.
.
আড়াল থেকে এতক্ষণ যাবৎ সায়নী ও মিশিকার কথা শুনেছে মুনিরা।
মিশিকার কথার কোনো প্রতিবাদ সায়নী করলোনা কেনো!
তবে কি সায়নীও ভাবে, মুনিরা তাদের মাঝে দেয়াল হয়ে আছে?
আর আফরানের মনে কি আসলেই তার জন্য জায়গা তৈরী হয়নি? তবে এতোদিন যে আফরান তাকে আগলে রেখেছে, খেয়াল রেখেছে এসব কি? শুধুই মানবতা? কিন্তু এসবের জন্য যে সে আরো বেশি দূর্বল হয়ে পড়েছে আফরানের প্রতি।
আফরান কি সেটা বুঝেনা?
এভাবে সারাজীবন আফরানের পাশে থাকতে চায় সে। তবে তার চাওয়া পাওয়ার কি আদৌ মূল্য আছে!
.
.
সায়নী নিজের রুমে এসেই দেখলো আফরান ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়েছে।
সায়নীর দিকে এগিয়ে এসে সে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
আচমকা আফরানকে একটা প্রশ্ন করে বসলো সায়নী-
আচ্ছা আফরান? কখনো যদি আমার আর মুনিরার মাঝে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে বলি, কাকে বেছে নিবে তুমি?
.
সায়নীকে ছেড়ে তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো আফরান। হাসতে হাসতেই বললো-
সকাল সকাল এমন আজব প্রশ্ন?
-এমনিতেই।
-ফ্রেশ হয়ে নাও।
.
আফরান ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।
সায়নী বিড়বিড় করে বললো-
আগে হলে কোনো কিছু না ভেবেই বলতে তোমাকে বেছে নিবো। এখন তুমি উত্তর টাও দিতে পারলেনা। মুনিরা শেষ অবধি তোমার মনে জায়গা পেয়েই গেলো। আমিও তো এটাই চেয়েছিলাম৷ তবুও আমার খারাপ লাগছে কেনো বলতে পারবে? মাঝেমাঝে মনেহয় মুনিরা না থাকলে তুমি, আমি আর আমাদের বাচ্চাটা কতো না সুখে থাকতাম!
.
.
.
সায়নীর রুমটা খানিকটা দূরে মুনিরার রুমের থেকে। তবে আজ আরো বেশি দূর লাগছে মুনিরার কাছে।
সে যেটা করতে যাচ্ছে এটা ঠিক কিনা জানেনা। তবে সে কারো সুখের সংসার নষ্ট করতে পারেনা৷ আসলেই তো! আফরান তো তাকে মনে জায়গা দিতে পারেনি। তবে এখানে কেনো পড়ে থাকবে সে!
থাক না দুটো ভালোবাসার মানুষ একসাথে। সে নাহয় দূর থেকেই তাদের ভালোবেসে যাবে।
.
রুমের মাঝে এসে সায়নীকে দেখতে পেলো মুনিরা।
সে তার পাশে এসে বললো-
আপু? আমি উনাকে ডির্ভোস দিবো। এবার আর আমাকে আটকাবে না প্লিজ। তোমাদের মাঝে আমি আর দেয়াল হয়ে থাকতে চাইনা। কোনো ক্ষোভ নেই তোমাদের জন্য আমার। আমার কপাল টাই হয়তো খারাপ তাই যেটা সম্ভব না সেটা আশা করে বসে ছিলাম।
.
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেলো মুনিরা।
ছলছল নয়নে সায়নী তাকিয়ে রইলো তার পথের দিকে।
মুনিরা কিভাবে বুঝতে পারলো তার মনে কি চলছে! তার কোনো আচরণে কি….
এ কি করে ফেললো সায়নী! সব কিছু এভাবে ভুলে গেলো সে!
এটা ঠিক করেনি সায়নী।
কিন্তু তারই বা কি করার আছে! তার মনে যে তুফান চলছে সে ছাড়া কেউ বুঝবেনা। এখন কি করা উচিত তার? চলে যেতে দিবে মুনিরাকে? নাকি আটকাবে তাকে? আর আফরান? সেইবা কি করবে? মুনিরার জন্য তার মনেতো জায়গা হয়েই গেলো। উফফ…! আর ভাবতে পারছেনা সায়নী। মাথাটা ভীষণ ধরেছে সায়নীর।
আলনা থেকে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায় সে। মাথাটা ভেজালে হয়তো ভালো লাগবে তার।
.
.
.
রান্নাঘরের দিকে মুনিরাকে এগুতে দেখে ডাক দিলো আফরান।
-কোথায় যাচ্ছো?
-নাস্তা তৈরী করতে।
-ওহ! তাহলে সায়নীকে বলে এসো রেস্ট করতে৷ তুমি বানিয়ে দিচ্ছো।
-ঠিক আছে।
.
আজ কথা বলার সময় আফরানের দিকে তাকালোনা মুনিরা। কষ্ট হচ্ছে তার ভীষণ।
কিভাবে ছেড়ে যাবে সে আফরানকে!
.
.
রুমের কোথাও সায়নীকে না পেয়ে ওয়াশরুমের দরজায় কড়া নাড়লো মুনিরা। কয়েকবার কড়া নাড়ার পরেও ভেতর থেকে কোনো শব্দ পাচ্ছেনা মুনিরা।
আতঙ্কিত স্বরে সে বললো-
আপু? ঠিক আছো তুমি?
.
না, কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা। তাড়াহুড়ো করে মুনিরা এগুলো আফরানকে ডাকার জন্য।
.
.
আজ সায়নী এমন একটা প্রশ্ন করলো কেনো?
কি চলছে সায়নীর মনে?
সে চেয়েছে তার মনে যেনো মুনিরার জন্য জায়গা হয়।
আচ্ছা, আসলেই কি তা হয়েছে?
তবে হিউম্যান সাইকোলজির ভাষায় একটা কথা আছে,
একটা মানুষ সবসময় তোমার আশেপাশে থাকলে মানুষটার প্রতি তোমার আবেগ, অনুভূতি ও মায়া জন্মাবে।
আফরানের ক্ষেত্রেও কি মুনিরার জন্য এমন ফিলিংস তৈরী হয়েছে?
নাহলে আজ সায়নীর প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারেনি কেনো!
তবে কি তার মনে জায়গা তৈরী করে ফেললো, মুনিরা নামের এই মায়াবতী?

হ্যাঁ, জায়গা দিয়ে ফেলেছে তার এই মন মুনিরাকে। এতোটা ধৈর্য্যশীল, মায়াবী, শান্ত কোনো মেয়ের প্রতি ভালোবাসা এমনিতেই জন্মে যাবে। সে জায়গায় মুনিরা তার স্ত্রী। তবে এই একটা বছর এক সাথে না কাটালে আফরান কখনো উপলব্ধি করতে পারতোনা মুনিরার প্রতি এই ফিলিংস!
.
এসব ভাবতে ভাবতেই মুনিরার গলার শব্দ কানে আসলো আফরানের-
শুনছেন? তাড়াতাড়ি আসুন প্লিজ। আপু ওয়াশরুমের দরজা খুলছেনা।
.
মুনিরার কথা শুনে এক মুহুর্তও দেরী না করে নিজের রুমের দিকে ছুটে গেলো আফরান।
.
.
.
৪দিন পর….
সায়নী বসে আছে নিজের রুমে। মাত্রই হাসপাতাল থেকে বাসায় এসেছে সে।
ওয়াশরুমে অসাবধানতা বশত পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ফলে অজ্ঞান হয়ে যায় সায়নী। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় তার।
দরজা ভেঙ্গে হাসপাতাল নিতে নিতে অনেকটা দেরী হয়ে যায়।
যার ফলে তার গর্ভের বাচ্চাটিকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। শুধু এটাই নয়, ডাক্তার জানিয়েছেন সায়নী আর কখনো মা হতে পারবেনা।
এর চেয়ে হৃদয় বিদারক ঘটনা আর কিইবা হতে পারে!
পুরো খান ম্যানশনে যেনো শোকের ছায়া নেমে এলো।
একটার পর একটা দূর্ঘটনা লেগেই আছে তাদের জীবনে।
এই বাড়ি আলো করে আফরানের অংশ আসবে বলে কতই না আনন্দে ছিলো তারা। কিন্তু নিয়তির এই কি পরিহাস!
সুখ যেনো এই বাড়িতে ধরা দিতেই চায়না।
.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে আফরান।
কি থেকে কি হয়ে গেলো! তবে সায়নী যে ঠিক আছে এটাও কম কিসের!
চোখের পানি মুছে রুমের দিকে এগিয়ে এসে আফরান বললো-
সায়নী?
.
আফরানের ডাকে ঘোর কাটলো সায়নীর।
সোফার উপরে পাথরের মতো বসে ছিলো সে। আফরানের ডাকে নড়েচড়ে বসলো।
আফরান তার পাশে বসতেই সায়নী বললো-
বাবা ভীষণ কষ্ট পেয়েছে তাইনা?
-হু।
-তুমিও পাচ্ছো তাইনা?
.
চুপ হয়ে আছে আফরান। সায়নী তার দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে বললো-
আমি তোমাদের জুনিয়র আফরানের খেয়াল রাখতে পারিনি আফরান! আমি মা হবার যোগ্য নয়।
.
সায়নীকে বুকে টেনে নিলো আফরান। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো-
তোমার দোষ নেই এতে। সব ঠিক হয়ে যাবে। শান্ত হও। তুমি যে ঠিক আছো আমার কাছে এটাই অনেক।
.
.
.
সায়নীর শরীরটা দূর্বল। তাকে কিছু খাওয়ানো উচিত। তা ভেবে আফরান রান্নাঘরে আসতেই দেখা পেলো মুনিরার।
এক পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদে চলেছে সে একনাগাড়ে।
-কাঁদছো কেনো?
-আমি আপুকে এভাবে দেখতে পারছিনা। আর কতো কষ্ট আপুকে সহ্য করতে হবে বলতে পারেন! অল্প সময়ে মা বাবা হারিয়েছে। স্বামীর ভাগ অন্য একটা মেয়েকে দিতে হয়েছে। এখন মা হবার সুযোগটাও হারালো! কতো কিছু সইবে আপু আর!
-নিয়তিই হয়তো এটাই। সায়নী সুস্থ আছে এটাই বেশি নয় কি!
-হু। তবে আপুকে খুশি দেখতে চাই আমি। তাই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
-কি?
-ডির্ভোস দিবো আপনাকে। ছিলাম তো একবছর। ভালোবাসার মানুষ হতে পারিনি কারো। কষ্টই দিয়ে এসেছি শুধু।
-এসব কি বলছো তুমি?
-ঠিকই বলছি। আমার জন্য আপনাদের আর কষ্ট পেতে হবেনা। আমি চলে যাবো। গ্রামে যেতে না পারি। এই শহরের কোনো এক কোণায় নিজের জন্য ঠিকই জায়গা করে নিবো।
.
কথাটি বলেই মুনিরা নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।
আফরান নিজেকে উদ্দেশ্য করে বললো-
মুনিরা চলে যাবে শুনে আমার কষ্ট লাগছে। হুম কষ্ট লাগছে। তবে সে এমন একটা সিদ্ধান্ত কেনো নিয়েছে! সায়নী কি চায়না মুনিরা থাকুক?
এই কোন পরিস্থিতি তে পড়লাম আমি! যখন চেয়েছি মুনিরা চলে যাক তখন সে যায়নি আর যখন সবটা আমার কাছে স্বাভাবিক হয়ে এলো তখন আবার এমন একটা মোড় চলে এলো।
আসলেই ভুলটা আমারই। শুরু থেকে আমার। এতদিন এই দুটো মেয়েকে আমি কষ্ট দিয়েছি তাই আমারো পেতে হচ্ছে এখন।
পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমার জীবনটা দোটানাময় হয়ে গেলো। এখন কি করা উচিত আমার!
.
.
জগে পানি না থাকায় রান্নাঘরের দিকে এসেছে সায়নী।
আফরানের বলা কথাগুলো শুনে চুপচাপ সে নিজের রুমে চলে এলো।
বসে পড়লো বিছানার উপরে।
এসব কি বলছে আফরান!
নিজের কানে না শুনলে হয়তো বিশ্বাসই করা যেতোনা।
তবে কেনো বলেছে এসব? মুনিরা কি চলে যাবে বলেছে তাদের জীবন থেকে!
আচ্ছা মুনিরা যদি চলে যায়, আদৌ কি সায়নী খুশি থাকতে পারবে?
চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো সায়নী।
ভেসে আসছে মুনিরার সাথে কাটানো দিনগুলি।
আফজাল খান নাতী আসবে বলে কতই না খুশি ছিলেন। আর আফরান! বাবা হবার জন্য উতলা হয়ে পড়েছিলো। জুনিয়র আফরানের জন্য সকলে অপেক্ষায় ছিলো।
আর মুনিরা? নিজের কথা ভাবার আগে সবসময় ভেবেছে সায়নীর কথা।
চোখ জোড়া খুলে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো সায়নী। তার গর্ভে সন্তান আসার পরে মুনিরাকে দেয়া কথা সে প্রায় ভুলতেই বসেছিলো।
মুনিরা তাকে এসে জানিয়েছিলো সে চলে যাবে। সেদিন সায়নী বলতে পারেনি, যেওনা তুমি। এই বাড়িতে তোমারও সমান অধিকার রয়েছে।
তার এই মনোভাবের জন্যই হয়তো শাস্তি স্বরূপ বাচ্চাটি দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলো।
প্রথমে আফজাল খানকে না জানিয়ে তার ছেলেকে বিয়ে করা, পাবেল ও তার ইমোশন নিয়ে খেলা করা, প্রয়োজনে মুনিরাকে ব্যবহার করা আর কতো অপরাধের শাস্তি না পেয়ে পার পাবে সে!
মুনিরাই পারে এই অন্ধকার বাড়িটাতে আবার আলোতে ভরিয়ে দিতে।
আফরানকে ভালোবাসে সায়নী। তার সুখের জন্য এতোটুকু সে করতেই পারে।
নাহ, যেতে দেয়া যাবেনা মুনিরাকে। আটকাতে হবে তাকে।
.
সায়নী ছুটে গেলো মুনিরার রুমের দিকে।
সায়নীকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে মুনিরা বললো-
কি হয়েছে আপু?
এই শরীরে এভাবে ছুটছো কেনো?
-আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম অতি সুখে। আমাকে ক্ষমা করে দে মুনিরা। এই বাড়ি ছেড়ে তুই যাস না।
.
সায়নী কি বলতে চায়ছে বুঝতে অসুবিধে হলোনা মুনিরার।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সে বললো-
তোমার জায়গায় তুমি ঠিক আছো আপু। কিন্তু এবার আর আমাকে আটকাবে না। আমি একটা অলক্ষী বলেই বারবার এসব হচ্ছে।
-তুই যতবারই চলে যেতে চেয়েছিস ততবারই খারাপ কিছুনা কিছু হয়েছে। তুই এই ঘরের লক্ষী মুনিরা। একমাত্র তুই পারিস, বংশধর এনে বাবা আর আফরানের মুখে হাসি ফোটাতে।
-তা আর সম্ভব নয় আপু। যেখানে তোমাদের ভালোবাসাই পাইনি সেখানে আর…
-আমি তোকে ভালোবাসিরে পাগলি। কিছু সময়ের জন্য মনটা স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু দেখ তোর সায়নী আপুই আমি। যে তোকে বোনের জায়গা দিয়েছে। আফরানের মনে জায়গা তৈরী করতে সাহায্য করেছে। আমার একটা ভুলের জন্য এভাবে শাস্তি দিবি সবাই কে?
-তুমি বুঝতে পারছোনা আপু। উনিই তো আমাকে ভালোবাসেনা। শুধুই তোমাকে বাসে।
-তোকেও বাসে। তাইতো আমি যেদিন ওকে প্রশ্ন করেছিলাম আমাদের মাঝে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে বলা হলে সে কি করবে, উত্তর দিতে পারেনি সে। দুইটা পশু পাশাপাশি থাকলে একজন আরেকজনের উপর মায়া জন্মায়। সেখানে তুইও ওর বিবাহিতা আদর্শ স্ত্রী। তোর প্রতি ভালোবাসা জন্মাবেই না কেনো!
.
সায়নীর কথা শুনে যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো মুনিরা। সায়নী যা বলছে সত্যি বলছে তো!
.
সায়নী আবারো বললো-
জানিস মুনিরা? আল্লাহ কে বলেছিলাম তোকে আমাদের মাঝে রাখার কোনো মাধ্যম বের করে দিতে। যাতে আমার মনে তোকে নিয়ে কোনো সংশয় না থাকে। আল্লাহ সেই মাধ্যমের পথ আজ দেখিয়ে দিয়েছেন। এই যে তুই হবি আফরানের বাচ্চার মা।
তোর মাধ্যমে আমিও আফরানের অংশ কে ছুঁতে পারবো, কোলে নিতে পারবো, আগলে রাখতে পারবো।
বিশ্বাস কর তোর ডিসিশন কে আমি সম্মান জানাতাম, যদি আফরান তোকে মেনে না নিতো৷ এখন আফরানও তোকে চায়।
আমিও আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। তুই চলে গিয়ে আমাদের হাসিটাও নিয়ে যাস না মুনিরা। আজ প্রয়োজনে আসিনি, তুই প্রিয়জন বলেই এসেছি।
.
.
.
সায়নী রুমে আসতেই তাকে দেখে আফরান বললো-
কোথায় গিয়েছো? কখন থেকে খাবার নিয়ে বসে আছি আমি।
-ভালোবাসো মুনিরাকে?
.
সায়নীর প্রশ্ন শুনে চুপ হয়ে গেলো আফরান।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো সে।
সায়নী তার পাশে এসে হাত ধরে বললো-
তুমি এতো ভালো কেনো? প্রথমে আমি তোমাকে বলেছি ওকে ডিভোর্স দাও, রাজী হয়েছো। পরে বলেছি দিওনা, রাজী হয়েছো। এর পর বলেছি সম্পর্ক আগাও রাজী হয়েছো। এক মুখে এতো কথা বলার পরেও কখনো তুমি আমাকে মুখ ফুটে কিছু বলোনি। এই যেমন বুঝতে পেরেছিলে আমার মনে কিছু চলছে। অথচ তুমি আমাকে বলতে পারতে, আমার কথা শুনেই মুনিরার দিকে এগিয়েছো তুমি তাহলে কেনো আমি আবার ঝামেলা পাকাতে চাইছি।
.
সায়নীর হাতের পিঠে চুমু খেয়ে আফরান বললো-
তোমার জায়গায় যেকোনো মেয়ে থাকলে এটাই করতো। এতো সহজ ছিলোনা তোমার পক্ষে এসব৷ তবুও তুমি পরিস্থিতি সামলাতে, ভুল শোধরাতে, মুনিরার প্রতি ভালোবাসার জন্য স্বামীর ভাগ দিতেও প্রস্তুত ছিলে। কয়টা মেয়ে পারে এসব! তোমার অবস্থাটা বুঝতে পেরেছি আমি। তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা সায়নী। আমি না বুঝলে কে বুঝবে তোমাকে?
-বুঝোই যদি এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? আটকাও মুনিরাকে। এবার আর কোনো সংশয় নেই আমার মনে। তোমার মনেও থাকুক আমি চাইনা। আমি কখনোই মনে করবোনা, আমার বাচ্চা হবেনা বলে তুমি তাকে রেখেছো। কেননা আগেই আমি জেনেছি তোমার মনে মুনিরার জন্যও জায়গা তৈরী হয়েছে। এটাই তো হওয়ার ছিলো তাইনা? মুনিরা মেয়েটাই যে এমন। আফরান আমি এটাও জানি তুমি আমার জায়গা ওকে কখনো দিতে পারবেনা। কেননা ও আমার জায়গা দখল করেনি। নিজেই একটা জায়গা তৈরী করে নিয়েছে।
আজ কোনো চাপ নেই আফরান। নিজের মনের কথা শুনো। মন যা চাই করো। আমি তোমার সাথে আছি। তোমার উপর বিশ্বাস আছে আমার।
যাও আফরান আটকাও মুনিরাকে। এই বাড়ির লক্ষীকে যেতে দিওনা।
.
.
.
সায়নী কি বলেছে! আফরান তাকে ভালোবাসে? কই? কখনো তো বললো না।
ভাবতে ভাবতেই আফরানের গানের গলা কানে আসলো মুনিরার-
তোকে বলবো ভাবি কিছু অল্প কথায়
তুই স্বপ্নে ছিলি, ছিলি গল্প কথায়
আজ তোর নামে রাত নামে
দিন কেটে যায়…
আমার মন তোর পাড়ায়
এসেছে তোরি আস্কারায়,,
আমার মন তোর পাড়ায়
এসেছে তোরি আস্কারায়…
.
স্তব্ধ হয়ে আফরানের গান শুনছিলো মুনিরা। আফরান থামতেই তার দুচোখ বেয়ে পানি ঝরতে লাগলো।
আফরান তার দিকে এগিয়ে এসে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো-
আজ আমি তোমাকে বলছি, কোথাও যাবেনা তুমি।
মায়াবতী যে এই মনে জায়গা করে নিলে।
.
এবার কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিলো মুনিরা।
মুখে হাসি সাথে কান্নাও।
তার এই অবস্থা দেখে আফরান বললো-
সায়নী ঠিকই বলে, তুমি বাচ্চাই রয়ে গেলে একদম।
.
.
.
সায়নীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আফজাল খান। নরম স্বরে তিনি বললেন-
তোরা দুজনেই অনেক কিছু হারিয়েছিস। তাই হয়তো তোদের দুজনের ভাগ্য এক সুতোয় গাঁথা। যা মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলাটায় উত্তম। মুনিরা মন থেকে সবটা মেনে নিলেও তোর মনে যে সংশয় ছিলো এটা আমার অজানা ছিলোনা সায়নী। আর এটা নিয়ে আমি ভয়ে ছিলাম। আমি বেঁচে থাকতে মুনিরার মতো মেয়ের দুঃখ সহ্য করতে পারতাম না। আজ তুই আমার সকল চিন্তা, ভয় দূর করে দিলি মা। জুনিয়র আফরান কে দেখতেও সহজ করে দিলি।
আল্লাহ তোকে ভালো রাখবে সবসময়।
.
আফজালের মুখে হাসি দেখে সায়নীর মুখেও হাসি ফুটলো।
তার করা সব অন্যায়ের যেনো প্রায়শ্চিত্ত করতে পারলো সে।
.
.
.
দেড় বছর পর…..
মুনিরা প্রেগন্যান্ট আজ ৯মাস ১০দিন হলো প্রায়।
তার যত্নের কোনো অভাব হয়না। এই বাড়ির সকলের ভালোবাসা সে পেয়েছে।
আর আফরান? সে দুজনের প্রতিই তার দায়িত্ব পালন করে চলেছে।
সায়নী একটি সরকারি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেছে।
মুনিরার দেখাশোনার জন্য হাসির মা তো আছেনই।
সব কিছুই ভালোই চলছে, জুনিয়র আফরান বলে কথা!
.
হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো মুনিরার।
মুনিরার আম্মার ফোন।
-হ্যালো আম্মা?
-আমি কালই আসবো মুনিরা।
-হুম আম্মা এসো।
-তোর সতীন তো তোর দেখাশোনা করার ভয়ে কলেজে পড়ানো শুরু করছে।
-কি যে বলোনা আম্মা! আপু চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়েছিলো। কতো ডিমান্ড জানো আপুর? সুযোগ পেয়েছে কাজে লাগাবেই না কেনো!
-যাই বলিস না কেনো। শুরু থেকে যদি তুই এসব মেনে না নিতিস তাহলে আফরান আজ শুধুই তোরই থাকতো। বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে তার সাথে সুখে থাকতে পারতিনা বল? একটা ভুলের জন্য এই সতীন টাকে সহ্য করতে হচ্ছে তোর। যাই হোক আমি কাল আসছি। এখন রাখলাম।
.
কি বললো তার মা? শুরু থেকে এসব না মানলে আফরান তারই থাকতো? আজ এই বাচ্চাটা নিয়ে তারাই সুখে থাকতো। ভাগ দিতে হতোনা সায়নীকে।
.
এসব ভেবে মুনিরা দাঁড়িয়ে পড়লো। কি ভাবছে টা কি মায়ের কথা শুনে এসব সে! যার মনে কিনা কোনোদিন খারাপ কিছু আসেনি সায়নীকে নিয়ে আজ তার মনে এসব আসলোই বা কিভাবে!
এই বাচ্চাটি কি তার মনে সংশয় সৃষ্টি করে ফেলবে? বাধ্য করবে সায়নীকে দূরে ঠেলে দিতে?
.
.
বিকেলে কলেজ থেকে বাড়ি এসেই সায়নী উপরে উঠতে লাগলো।
মুনিরার এই অবস্থায় নিচে নামা বারণ।
তাকে দেখে না আসলে যেনো সায়নী শান্তিতে বসতেই পারবেনা।
কয়েক সিড়ি পা দিতেই হাসির মাকে ছুটে আসতে দেখলো সায়নী।
আতঙ্কিত হয়ে বললো-
কি হয়েছে খালা?
-মুনিরার ব্যাথা উঠছে।
.
কি করবে এখন সায়নী! এই সময় আফরানও বাসায় নেই। অফিসের কাজে চট্রগ্রামের বাইরে আছে সে।
.
আর না ভেবে হাসির মায়ের উদ্দেশ্যে বললো-
ড্রাইভার কে গাড়ি বের করতে বলো খালা। মুনিরাকে নিয়ে আসছি আমি।
আর বাবাকে বলে দিও, আফরানকে যেনো ফোন দিয়ে জানায়।
.
.
.
অপারেশন থিয়েটারে মুনিরা।
কোরিডোরে পায়চারী করছে সায়নী।
ডাক্তার জানিয়েছে মুনিরার বাচ্চার পজিশন ঠিক নেই।
তাই সিজার করাতে হবে।
চিন্তায় সায়নীর মাথা যেনো ফেটে যাচ্ছে। ঘামছে সে অনবরত। আর মনেমনে আল্লাহ কে ডাকছে।
.
কিছুক্ষণ পর অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এলেন নার্স।
সায়নীর উদ্দেশ্যে বললেন-
রোগী বড্ড বায়না করছে আপনার সাথে কথা বলার জন্য। যদিও ডাক্তারের ও আপনাকে কিছু বলার আছে। প্লিজ ভেতরে আসুন।
.
কি বলবে ডাক্তার! সব ঠিক আছে তো!
ছুটে ভেতরে এলো সায়নী।
মুনিরা তাকে ডেকেই বলে উঠলো হাত ধরে-
আপু ডাক্তার রা বলাবলি করছেন হয় আমাকে বাঁচাতে পারবে তারা নাহয় আমার বাচ্চাকে। আমার বাচ্চাকে বাঁচাতে বলেছি আমি। কেননা তাদের মতে আমার আর বাচ্চা নেয়া সম্ভব না। তাই আমি চাই বাচ্চাটি আসুক দুনিয়াতে। ওর দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে গেলাম।
-এসব কি বলছিস তুই!
-হুম আপু। এই বাচ্চা নিয়ে তোমার জন্য এক মুহুর্তের জন্য হলেও সংশয় সৃষ্টি হয়েছিলো আমার মনে। দেখো তার পরেই আল্লাহ আমাকে কোন জায়গায় পৌছে দিয়েছে। যে তোমার জন্যই সব পাওয়া সেই তোমাকে নিয়ে আমি…
.
কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে মুনিরার। হাঁপিয়ে যাচ্ছে সে। তবুও বললো-
আমার বাচ্চাটাকে দেখো। ওকে উপহার দিয়ে যাচ্ছি তোমাকে।
.-এই যে শুনছেন?
-হু শুনছি মুনিরা।
-একমাস ধরে চেষ্টা করে আমি একটা কবিতা লিখেছি।
-আমার জন্য?
-হু, আপনার জন্য। শোনাবো?
-নিশ্চয়।
– জীবনে চলার পথে
কাউকে না কাউকে ভালবাসতে হবে,
তা ভেবে ভালবাসিনি।
তোমাকে পেতেই হবে,
তা ভেবে ভালবাসিনি।
ভালবেসে অমর হবো
তাও ভাবিনি,
ভালবেসে ভুলে যাব,
তাও ভাবিনি।
ভালবেসেছি ভাল লাগে বলে,
ভালবেসেছি ভালবাসি বলে,
কেন ভালবাসি তা জানার জন্য,
কতটুকু ভালবাসা যায়
তা বোঝার জন্য,
আত্মার পূণ্যতা লাভের আশায় শুধু ভালবেসেছি তোমায়।
.
.
মুনিরার শোনানো কবিতাটি কানে বাজছে আফরানের। চোখে ভেসে আসছে তার সাথে কাটানো দিনগুলি।
সায়নীকে ভালোবাসার পরে তার মনে আর কেউ জায়গা করে নিবে এমনটা কখনো ভাবেনি আফরান। কিন্তু মুনিরা নামের মায়াবতী এটা করেছে। এটাই হয়তো বৈধ সম্পর্কের টান!
এমন একটা সময়ে আফরান তার পাশে নেই। ঠিক আছে তো মেয়েটা! আর সায়নী? একাএকা সামলাতে পারবে তো সবটা?
.
সবে মাত্র চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠেছে আফরান।
চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে তার মনটা। কখন যে হাসপাতালে পৌছতে পারবে সে!
.
.
.
মুনিরার হাতে চুমু খেয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটে এলো সায়নী।
ডাক্তার তার উদ্দেশ্যে বললেন-
রোগী জেদ করছিলো তাই আপনাকে এখানে আনা হলো। তবে আমরা রোগীর কথা শুনে অপারেশনের কাজ শুরু করবো না। অবশ্যই তার ফ্যামিলি মেম্বারের কথা শুনে করবো। তার জন্য একটা সাইনও দরকার। এবার বলুন আপনি রোগীর কি হন?
.
কোনো সংকোচ ছাড়াই সায়নী জবাব দিলো-
বড় বোন।
-ওকে ফাইন, ইতিমধ্যে জেনেছেন যেকোনো একজন কে বাঁচাতে পারবো আমরা।
.
ডাক্তারের কথা শুনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সায়নী বললো-
এমনটা বলবেন না প্লিজ! যত টাকা লাগে আমি দিবো। দুজনকেই বাঁচান।
-দেখুন টাকা দিয়েতো সব হয়না। নিজেকে সামলে নিন। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো দুজনেরই যেনো কোনো ক্ষতি না হয়। তবুও যদি একজন কে বাঁচাতে হয় কাকে বাঁচাবো? আপনারা তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে জানান।
-আপনারা?
-মানে উনার হাসবেন্ড বা পরিবারের…
-আমি যা বলি তা। দুজনকেই বাঁচাতে হবে।
-ম্যাম দেরী হয়ে যাচ্ছে। প্লিজ আমাদের তাড়াতাড়ি বলুন যেকোন একজন টা কে হবে? রোগী কিন্তু পরবর্তীতে আর মা হতে পারবেনা। সো ভেবেই বলুন।
.
একবার মুনিরার দিকে তাকিয়ে আর কিছু না ভেবেই সায়নী বললো-
যদি একজনকেই বাঁচাতে হয় তবে রোগীকেই বাঁচাবেন।
.
সায়নীর কথা স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে মুনিরা।
এমন অবস্থার মাঝেও মুনিরার মনে হচ্ছে সায়নীর জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে কি করতো!
.
.
.
২৫বছর পর…..
আফজাল খানের রুমে বসে আছে আফরান।
বাবা মারা যাবার পর এই রুমটাতেই সে থাকে। বাবার সকল স্মৃতি ঘীরে রয়েছে এই রুমটাতে। আফরানের এখনো মনেহয়, তার বাবা তাকে দেখে বলে উঠছে-
হ্যালো ইয়াং ম্যান!
.
বাবার কথা মনে হতেই দুচোখ ছলছল করে উঠলো আফরানের।
মা মারা যাবার পর তার বাবা আর বিয়ে করেন নি। নিজেই খেয়াল রেখেছে আফরানের।
মায়ের অভাব কখনো বুঝতে দেয়নি তাকে। তার জায়গায় অন্য কোনো বাবা হলে নিশ্চয় সৎ মা নিয়ে আসতো। আনবেই না বা কেনো! টাকা পয়সার কমতি ছিলোনা তার।
সত্যিই! আফজাল খান একজন আদর্শ বাবা। যার কোনো তুলনা হয়না।
.
.
.
এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলো সায়নীর।
নামাজ আদায় করে ঘুমিয়েছিলো সে।
সাধারণত নামাজের পর ঘুমোলে ৭টার আগে আর ঘুম থেকে উঠেনা সায়নী। তবে আজ ৪০মিনিট পরেই উঠে গেলো।
কেননা আজ তার প্রিয় বান্ধবী মিশিকা পুরো পরিবার নিয়ে বাংলাদেশ আসছে আমেরিকা থেকে। তাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে যাবে আরাফ।
তবে এই সকাল বেলা আরাফ কে ঘুম থেকে আদৌ উঠবে কি!
.
বিছানায় হাতড়িয়ে চোখের চশমাটা হাতে নিলো সায়নী।
শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে চোখে চশমা লাগিয়ে এগিয়ে গেলো আফজাল খানের রুমের দিকে।
.
বিছানায় বসে বসে উপন্যাস লালসালু উপন্যাসটি পড়ছে আফরান।
সায়নী তার দিকে এগিয়ে যেতেই সে বললো-
বসো সায়নী।
-তুমি পড়ছো।
-তাতে কি! আসো তো, বসো।
.
আফরানের পাশে সায়নী বসে বললো-
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এর
লালসালু উপন্যাসের সাথে আমাদের জীবনের কাহিনী মিল আছে তাইনা?
-তার মানে আমি মজিদের মতো?
-তুমিও মোটেও মজিদের মতো নয়। আমি শুধু দুই বউ নিয়ে বললাম।
.
মৃদু হেসে আফরান বললো-
হু মিল আছে। রহীমার জায়গায় তুমি আর জমিলার জায়গায় মুনিরা।
-রহীমা চরিত্রটা আমাকে খুব টানে। জমিলা ছোট ছিলো বলে তার অনেক ভুল হয়ে যেতো যেসব মজিদ পছন্দ করতো না। রহীমা চাইলে মজিদকে জমিলার বিরুদ্ধ নিতে পারতো। কিন্তু সে বারবারই জমিলার অন্যায় লুকিয়ে যেতে চেষ্টা করতো।
বই এ একটা লাইন আছেনা?
জমিলাকে পেয়ে রহীমার মনে শ্বাশুড়ীর ভাব জাগে। স্নেহ-কোমল চোখে সারাক্ষণ তাকে চেয়ে চেয়ে দেখে আর যত দেখে তত ভালো লাগে তাকে।
-বাহ! সবই মুখস্ত তোমার?
-হু। জমিলার সাথে মুনিরার বাচ্চা মানুষীর দিকটা বড্ড মিল।
-হুম। আর আমি রহীমার মাঝে তোমার মিল খুঁজে পাই।
-কি যে বলোনা। রহীমার মতো নিঃস্বার্থ নয় আমি।
-স্বার্থপরও নও। তুমি যা করেছো কয়টা মেয়েই বা তা করতে পারে সায়নী?
মাঝেমাঝে মনেহয় তোমার সাথে অন্যায় করেছি। আবার মাঝেমধ্যে মনেহয় মুনিরার সাথে।
-কারো সাথেই করোনি। সমানভাবে তুমি দায়িত্ব পালন করেছো।
-পরিস্থিতি আসলেই মানুষকে অনেক কিছুই করতে বাধ্য করে। আমি কি কখনো ভেবেছিলাম! আমার জীবনে দুজন ভালবাসার মেয়ে থাকবে!
-আমিও কখনো ভাবিনি রহীমার মতো আমার জীবনেও জমিলা আসবে। আর সে এতোটা সুখ নিয়ে আসবে। সেও আমাদের ভালবাসার মানুষ হয়ে উঠবে।
.
মুচকি হাসলো আফরান সায়নীর কথা শুনে।
সায়নীও হেসে বললো-
তোমার গুণধর পুত্রের কাছে যাচ্ছি এখন। ঘুম থেকে উঠাতে হবে তাকে।
-আহা বেচারা! যাও তুলো। অবশ্য তোমার একটা ডাকই তার ঘুম ভাঙার জন্য যথেষ্ট।
.
.
.
-আরাফ??
.
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আরাফ।
তবুও সায়নীর ডাক তার কানে এলো।
চোখ জোড়া না খুলে ভাঙ্গা গলায় বললো সে-
সকাল ১০টা হয়ে গেলো বড় আম্মু?
-১১টা হয়েছে।
.
সায়নীর কথা শুনে এক লাফে বসে পড়লো আরাফ।
চোখ জোড়া কচলাতে কচলাতে বললো-
কি বলো! আজ না তাসুদের এয়ারপোর্ট থেকে আনার কথা?
-হ্যাঁ তবে সেটা সকাল ১০টাই না। ৮টাই।
-তুমি তো আমাকে বলোনি ৮টাই।
-বললে যেনো তুই উঠে যেতি?
-তুমি বললে অবশ্যই উঠতাম।
.
মুচকি হাসলো সায়নী। ছেলের উদ্দেশ্যে বললো-
ফ্রেশ হয়ে নে। আমি নাস্তার ব্যবস্থা করছি।
.
কথাটি বলেই সায়নী এগুলো রান্নাঘরের দিকে।
আরাফ ফোন হাতে নিয়ে উপমার মোবাইল নাম্বারে মেসেজ দিলো-
Shuvo Sokal Jan Pakhi ta….
.
ঘুম থেকে উঠে তাকে মেসেজ না পাঠালে আরাফের দিনটা যেনো ভালো কাটেনা।
উপমা হলো আরাফের গফ। গত ১বছর ধরে সম্পর্কে আবদ্ধ আছে তারা।
আরাফ সবেমাত্র বুয়েট পাস করে বের করেছে।
বাবার সাথে বিজনেস এ হাত দেবার আগেই উপমার কথা বাসায় জানাতে চায় সে।
পরীক্ষা শেষ হবার অপেক্ষায় ছিলো আরাফ।
এখন সময় এসেছে উপমার কথা বাসায় জানানোর।
তার মা বাবারা নিশ্চয় উপমাকে দেখে পছন্দ না করে পারবেই না।
.
আপনমনে এসব বলে উঠে দাঁড়ালো আরাফ।
ফ্রেশ হয়ে নেয়া যাক চটজলদি।
.
.
.
আড়মোড়া ভেঙ্গে শোয়া থেকে উঠে বসলো মুনিরা। একটা হাই তুলে ঘড়ির দিকে তাকালো সে। দেখলো সকাল ৬টা পার হয়ে গেলো।
তাড়াহুড়ো করে উঠে সে এগিয়ে গেলো আরাফের রুমের দিকে।
.
বিছানায় আরাফকে দেখতে না পেয়ে ওয়াশরুমের পাশে এসে মুনিরা বললো-
আরাফ তুই আবার ওয়াশরুমে ঘুমিয়ে পড়লি নাকি? আজ কিন্তু এয়ারপোর্টে যেতে হবে।
.
ভেতর থেকে চেঁচিয়ে আরাফ বলে উঠলো-
বড় আম্মুর একটা ডাকেই আমি উঠে পড়েছি। নাহলে ছোট আম্মু এসে যে আরেক দফা ডাকাডাকি চলাতো ভালোই জানা আছে আমার।
.
আরাফের কথা শুনে হাসলো মুনিরা।
নিচের দিকে এগিয়ে গেলো সে।
.
.
আফরান মনোযোগ সহকারে বই পড়ে চলেছে।
মুনিরা এসে তার উদ্দেশ্যে বললো-
শুভ সকাল।
.
হাতে থাকা বইটা এক পাশে রেখে আফরান বললো-
শুভ সকাল মুনিরা। বসো।
.
আফরানের পাশে বসতে বসতে মুনিরা বললো-
আজ অফিস যাবেন না?
-হু যাবো। আরাফের হাতে দায়িত্ব তুলে না দেয়া অবধি নিশ্চিত হতে পারছিনা।
-আরাফ পারবে তো এসব সামলাতে?
-কেনো পারবেনা! আমার ছেলে সে।
-আমাদেরও ছেলে সে।
.
কথাটি বলেই মৃদু হাসলো মুনিরা।
আফরান তার দিকে তাকিয়ে বললো-
আজ তো দেশে পাবেল রা আসছে। তার মেয়ে দুইটা মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দরী তাইনা?
-হ্যাঁ। যেমন মেহেনুবা সুন্দরী তেমন তাসুও কম না। আমার তো মেহেনুবা কে আরাফের বউ হিসেবে আনার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু সায়নী আপু মেহেনুবার জন্য ডাক্তার ছেলে ঠিক করে ফেলেছে মিশিকা আপুর কথায়।
-তারাই বলেছিলো তাদের বড় মেয়েকে ডাক্তারের সাথেই বিয়ে দিতে চায়। আর আমাদের ছেলে কি কম নাকি। মেয়ের লাইন পড়ে যাবে ওর জন্য।
-এটা মন্দ বলেন নি। দেখতে একেবারেই আপনার মতো হয়েছে। আর সায়নী আপুর মতো ট্যালেন্ট।
-এবং তোমার মতো সরল।
.
মুচকি হেসে মুনিরা বললো-
সায়নী আপুর কাছে যাচ্ছি রান্না ঘরে।
.
.
.
ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই রিং টোনের শব্দ পেলো আরাফ।
ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো উপমার ফোন।
ঘুম থেকে উঠে আরাফকে ফোন দেয়া গত এক বছরের অভ্যাস উপমার।
-হ্যালো?
-গুড মনিং।
-ইউ টু। উঠেছো উপমা?
-হু উঠেছি।
-আজ এতো তাড়াতাড়ি?
-আরাফ! আজ ৮টাই ক্লাস আছে আমার। ভুলে গেলে?
-ওহো!
-আজ ক্লাস শেষে দেখা করবো।
-আজ তো পারবোনা।
-কেনো?
-তোমাকে তাসুদের কথা বলেছিলাম না? তাদের রিসিভ করতে যাবো আজ।
-ওহ। তবে শোন?
-হু বলো।
-একদম ঘেষাঘেষি করবে না মেয়েগুলোর সাথে।
.
আরাফ হেসে বললো-
কি যে বলোনা উপমা তুমি!
-আমেরিকা থেকে আসছে। নিশ্চয় দামাদামি প্রসাধনী মেখে আকর্ষণীয় হয়ে থাকবে।
-আমার উপমা প্রসাধনী ছাড়াই বেস্ট।
-সেটাই মনে করিয়ে দিচ্ছি। বেশি কথা বলার দরকার নেই মেয়েগুলোর সাথে।
-হু বলবোনা।
.
.
.
নাস্তা করা শেষে তৈরী হয়ে এলো আফরান ও আরাফ।
তাদের দেখে সায়নী ছেলের উদ্দেশ্যে বললো-
এক সাথে বেরুচ্ছিস?
-হুম। বাবাকে ড্রপ করে দিয়েই আমি চলে যাবো।
-ঠিক আছে।
.
আফরান ও আরাফ বেরিয়ে যাবার পর সায়নীর উদ্দেশ্যে মুনিরা বললো-
শেষ বার যখন মেহেনুবা দের দেখেছিলাম আমার মনে একটা আশা জমেছিলো। মেহেনুবাকে ছেলের বউ করবো।
-কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়রে মুনিরা।
-তাহলে তাসুকে করা যায়না?
.
কিছুক্ষণ নীরব থেকে সায়নী বললো-
মিশি কিন্তু এই ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেনি।
-সে তো মেয়ের মা। সে কেনো বলবে? আমরা প্রস্তাব তো দিতে পারি?
.
মৃদু হেসে সায়নী বললো-
মন্দ বলিস নি। তবে আগে আরাফের সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে হবে।
-আরে আমরা যা বলি মেনে নিবে সে।
-এই ব্যাপারে মানবে বলে মনেহয় তোর? না মানে লাইফ টা ওর। বিয়ের ব্যাপারে ওর সাথে কথা বলেই আগানো উচিত।
আমাদের ছেলের উপর আমরা এমন কিছু চাপিয়ে দিতে পারিনা যাতে সে ভুল পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়। আমাদের নিজেদের লাইফই তো একটা শিক্ষা। তাইনা মুনিরা?
-হুম আপু।
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের মনে সায়নী বললো-
আরাফের জীবনে খারাপ কিছু হোক আমি চাইনা। তাই তার জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে দেয়া হবে।
.
.
.
চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে খোলা চুলে এয়ারপোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেহেনুবা ও তাসু।
তাদের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো পাবেল ও মিশিকা।
হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে পাবেল বললো-
হায়রে! কোথায় আমাদের জন্য আরাফের দাঁড়িয়ে থাকার কথা সে জায়গায় তার জন্য আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।
.
বিরক্তিভরা কণ্ঠে মেহেনুবা বললো-
একটা গাড়ি ঠিক করে নিলেই পারতে আব্বু!
.
গাড়ি ঠিক করলে কি বাংলাদেশে এসেই আরাফ ভাইয়ার দেখা পেতাম?
.
কথাটি বলেই জিভে কামড় বসিয়ে দিলো তাসু।
তাসু তো আরাফ বলতেই পাগল। মেহেনুবা কে সবসময় বলতেই থাকে সে, আরাফ হলো তার ক্রাশ।
.
তাসুকে সে কিছু বলতে যাবে তখনি কারো গলার আওয়াজ শুনতে পেলো মেহেনুবা।
.
-সরি সরি, ১৫মিনিট লেইট হয়ে গেলো।
.
পেছনে ফিরে আরাফকে দেখতে পেলো তারা।

ব্লু জিন্স, ব্লু টি-শার্ট, চোখে সানগ্লাস দেয়া আরাফকে দেখে তাসু বিড়বিড় বলে উঠলো-
হায়… এই ছেলে আর কতো ক্রাশ খাওয়াবে আমাকে!
.
তাসুর পাশেই মেহেনুবা থাকাতে তার কথাটি বুঝতে কষ্ট হলোনা মেহেনুবার।
দাঁতে দাঁত চেপে সে বললো-
ভুলে যাস না তাসু, তুই কিন্তু মেয়ে। ছেলের মতো আচরণ করবিনা একদম।
.
তৃতীয়বারের মতো মেহেনুবা ও তাসু দেশে এসেছে। তাও মেহেনুবার বিয়ে উপলক্ষে।
তাসুর সাথে মাঝেমাঝে ইমু বা মেসেজ্ঞারে আরাফের কথা হলেও মেহেনুবার সাথে খুব কমই হয়।
আমেরিকা থাকলেও মেহেনুবার মাঝে বাঙালী মেয়ের সব স্বভাব রয়েছে। দেখতে সুন্দরী, মায়াবী, চুল ঘন কালো লম্বা তার। পোশাক-আশাক, আচার-আচরণ সবই বাঙালী মেয়েদের মতোই।
এদিকে তাসু সুন্দরী হলেও চঞ্চল একটা মেয়ে। সুন্দর কালো চুল গুলো কালার করে রেখেছে। পোশাক ও তার বিদেশীদের মতো। তবে অন্তরের দিক থেকে খাঁটি বাঙালি।
.
.
আরাফের সাথে কথা বলার পরে তাদের নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই তাসু বলে উঠলো-
আম্মু, আব্বু, আপু তোমরা পেছনে বসো।
আমি কিন্তু সামনের সিটে বসবো।
.
আরাফ মুচকি হেসে বললো-
হু আসো।
.
তাসুকে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে মেহেনুবা। কি এমন দেখেছে এই ছেলের মাঝে যে তার ওভার স্মার্ট বোন তার জন্য পাগল!
.
.
.
-বড় খালা, ছোট খালা তোমরা কোথায়?
.
রুমানা…
পাশের বাসার সীমা আক্তারের নাতনী।
আফরান তাকে নিজের ছোট বোনের মতোই দেখে.
আর সায়নী ও মুনিরা দেখে নিজের মেয়ের মতো। তাদের কোনো মেয়ে নেই কিনা।
.
রুমানার ডাকে সায়নী ও মুনিরা ড্রয়িং রুমে এগিয়ে আসলো।
.
সায়নী তার উদ্দেশ্যে বললো-
সকাল সকাল চেঁচাচ্ছিস কেনো?
-তোমাদের গুণধর ছেলেকে ডাক দাও। খুশির খবর আছে।
-সে তো বাসায় নেই।
-কোথায়?
-এয়ারপোর্টে।
-ওহ!
.
মুনিরা হেসে বললো-
খুশির খবর আমরা কি শুনতে পারিনা?
-কেনো নয়! রাকিবের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে আমার।
.
রাকিব হলো এই এলাকারই ছেলে। ছোট থেকে রুমানাকে সে পছন্দ করে। রুমানা তাকে পছন্দ না করলেও নিজের জন্য রাকিবের পাগলামি দেখে সেও তার প্রেমে পড়ে যায়।
কিন্তু সৌদী আরবের ভিসা হয়ে যায় রাকিবের। আর সে বিদেশ যাবার আগেই রুমানার সাথে আকদ করে যেতে চায়।
রাকিব তার বাসায় সবটা জানালে তার পরিবার রুমানাদের বাসায় প্রস্তাব পাঠায়।
রুমানার পরিবারও এই প্রস্তাবে সম্মতি জানায়।
.
রুমানার মুখে রাকিবকে তার পরিবার মেনে নিয়েছে শুনে বেশ খুশিই হলো সায়নী ও মুনিরা।
কিন্তু রুমানা মুখটা ফ্যাকাসে করে বললো-
চেয়েছিলাম আরাফ বলদ টাকে আগে খবর টা দিবো।
.
মুহুর্তেই ফ্যাকাসে মুখটার বদলে হাসিমুখে সে আবার বললো-
তার আগে আমিই আমার ভালোবাসার কথা বাসায় আগে জানাতে পেরেছি, ইয়েস!
.
রুমানার কথা শুনে সায়নী ও মুনিরা একইসাথে বলে উঠলো-
কি! আরাফের ভালোবাসা?
.
-এই রে কি বলে ফেললাম এইটা!
.
নিজের মনে কথাটি বলে রুমানা আমতাআমতা করে তাদের উদ্দেশ্যে বললো-
এইরকম কিছু আমি বলিনি।
.
মুনিরা ভ্রু জোড়া কুচকে বললো-
আমি না হয় ভুল শুনেছি। তবে সায়নী আপুও কি ভুল শুনলো!
.
মুনিরার কথায় তাল মিলিয়ে সায়নী বললো-
হু আমি নাহয় বুড়ি হয়ে গেলাম। চোখে কম দেখি, কানেও না হয় কম শুনলাম। কিন্তু মুনিরার তো এমন হওয়ার কথা না। সে ভুল শুনবেনা।
.
রুমানা সায়নীর পাশে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো-
কে বলেছে সুন্দরী খালাটা বুড়ি হয়ে গিয়েছে।
.
রুমানার কান টেনে সায়নী বললো-
ওরে কথা ঘুরাস না। আরাফ কার সাথে ইটিস পিটিস করছে বল?
-আহ আমার লাগছে তো, আগে ছাড়ো।
.
সায়নী তাকে ছেড়ে দিতেই সে দৌড়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো-
তোমরা দুজনি কানে কম শুনো।
.
.
রুমানা বেরুতেই মুনিরা সায়নীর উদ্দেশ্যে বললো-
আমার কিন্তু মনে হচ্ছেনা আপু, কানে কম শুনেছি আমি।
-আমারো মনে হচ্ছেনা।
-তার মানে আমাদের আরাফ প্রেম করছে আর আমরাই জানিনা!
.
মুচকি হেসে সায়নী বললো-
প্রেম কি বাসায় জানিয়ে করে বোকা?
-ওহ তাই তো! আমি আরো তাসুকে বউ বানাবো ভেবেছি।
-তাই তো বলেছি আরাফের সাথে আগে কথা বলতে।
-আমাকে কিছু বলবে বলে মনেহয় না। তুমিই জিজ্ঞাসা করিও।
-দুজনি করবো।
.
চিন্তিত স্বরে মুনিরা বললো-
মেয়ে যদি ভালো না হয়?
-এতো ভাবিস না। ভালো হবে সব।
.
.
.
সকাল পার হয়ে দুপুর এসে গেলো।
মিশিকারা আরাফকে নিয়ে নিজেদের বাসায় পৌছালো বেশ কিছুক্ষণ হলো।
যদিও সায়নী অনেকবার বলেছে তাদের বাসায় যেতে কিন্তু পাবেলের একটাই কথা, দেশে এসে প্রথমে নিজের বাসায় পা রাখায় শান্তি।
সায়নীর কাছে তাদের বাসার চাবি থাকায় সে ঘরটা আগেই গুছিয়ে রেখেছে।
পাশের হোটেলে খাবারের অর্ডার করে রেখেছে।
আরাফ খাবার গুলো এনে মিশিকার হাতে দিয়ে বললো-
এবার আমি আসি আন্টি।
-মার খাবি? খেয়ে যাবি আমাদের সাথে।
-কিন্তু…
-কোনো কিন্তু না। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। একটু অপেক্ষা কর।
.
আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। তার মানে সকলে ব্যস্ত ফ্রেশ হতে।
এতোক্ষণ যাবৎ উপমা অনেকবার ফোন দিলেও সকলের সামনে রিসিভ করতে পারেনি আরাফ।
কেননা উপমার সাথে কথা বলার সময় আদুরী ভাষায় ন্যাকা প্রেমিকের মতো কথা না বললে দোষ খুঁজে এই মেয়ে। আঙ্কেল, আন্টির সামনে কিভাবে এসব বলা যায়! তার চেয়ে সব গালি এখুনি খাওয়া যাক।
এসব ভেবে ড্রয়িং রুমের বারান্দায় এসে উপমার মোবাইল নাম্বারে ফোন দিলো আরাফ।
একবার রিং হতেই রিসিভ করে কটমট স্বরে উপমা বললো-
ঘেষাঘেষি এতোই চলছে যে আমার ফোন রিসিভ করার সময় টুকু পাচ্ছো না।
-কি যে বলোনা! হেহে…
-কিসের হেহে! এসব মুখে উচ্চারণ করা নকল হাসি আমাকে শোনাবে না।
-আহ বাবুটা! রাগ করছো কেনো বলোতো? আঙ্কেল বা আন্টির সামনে আমি কিভাবে ফোন রিসিভ করবো তুমিই বলো? তাছাড়া আমি ড্রাইভ করছিলাম। ড্রাইভ করার সময় কি কথা বলা ভালো ফোনে?
.
শেষের কথাটি শুনে শান্ত গলায় উপমা বললো-
না ভালোনা। এখন কোথায়?
-মাত্রই বাসায় আসলাম আন্টিদের।
-অনেক ক্লান্ত লাগছে তাইনা?
-কিছুটা। তুমি কোথায়?
-বাসায় রওনা দিবো। ক্লাস শেষ।
-ওহ।
-ওকে রিলাক্স হয়ে বসে আরাম করো তুমি। বাসায় গিয়ে ফোন দিবো।
-ঠিক আছে।
.
উপমার সাথে কথা বলার পরেই আরাফ কল দিলো সায়নীর নাম্বারে-
হ্যালো বড় আম্মু বাসায় এসেছি।
-খাবার গুলো নিয়েছিস?
-হ্যাঁ নিয়েছি।
-কই সবাই?
-ফ্রেশ হচ্ছে। শুনো আমি এখান থেকে খেয়েই রওনা দিবো। আমার জন্য অপেক্ষা করোনা।
-আচ্ছা।
-ছোট আম্মু কি পাশে আছে?
-নামাজের সময় এখন, হয়তো উপরে।
-ওহ। আচ্ছা আমি ফোন দিচ্ছি। নাহলে তিনিও চিন্তায় থাকবেন আমার জন্য।
-ঠিক আছে।
.
সায়নীর সাথে কথা বলার পরেই আরাফ ডায়েল করলো মুনিরার নাম্বারে।
আড়াল থেকে এই দৃশ্যটি দেখে মনটা ভরে গেলো মেহেনুবার। প্রথমে বড় আম্মুর সাথে কথা তারপর ছোট আম্মু।
দুইটা মাকেই এই ছেলে কতোটা সম্মান করে। অথচ অনেক ছেলেরা একটা মা নিয়েই কতোটা বিরক্তি। ঠিকমতো আচরণ করেনা, খবর নেইনা, যথার্থ সম্মানও দেয়না। আসলেই এদিক থেকে আরাফ খাঁটি।
.
মুচকি হেসে মেহেনুবা চলে গেলে উপস্থিত হলো তাসু।
আরাফ ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে ভেতরে আসতেই
তার দিকে তাকিয়ে তাসু বললো-
কার সাথে কথা বলছিলে?
-আম্মুদের সাথে।
.
শর্ট জিন্স ও টি-শার্ট পরিহিতা তাসুকে একেবারে আমেরিকান মেয়ের মতোই লাগছে। তবে তাসুকে এভাবে দেখে কেমন যেনো অস্বস্থি লাগছে আরাফের। সে তাসুর উদ্দেশ্যে বললো-
তোমাকে দেখতে ভালো লাগছে কিন্তু বাংলাদেশে এসব আসলে… না মানে লম্বা জিন্স পরলে ভালো হতো আর কি।
-ওহ হো! আব্বুও আমাকে বারণ করেছিলো এসব না পরতে। আমি এখুনি চেইঞ্জ করে আসছি।
.
.
তাসুকে লং জিন্স পরতে দেখে মেহেনুবা বললো-
কিরে? এতো উন্নতি হঠাৎ?
-আরাফ ভাইয়ার জন্য।
.
মেহেনুবা কিছু বলতে যাবে তখনি মোবাইল হাতে হাজির হলো মিশিকা।
-আতিকের ফোন। নে কথা বল।
.
আতিক…
এর সাথেই বিয়ে ঠিক হয়েছে মেহেনুবার।
আতিক পেশায় ডাক্তার, দেখতে হ্যান্ডসাম, ভালো ফ্যামিলির ছেলে। তাই তাকে অপছন্দ হবার কারণই নেই।
এদিকে মেহেনুবা মাশআল্লাহ সবদিক দিয়েই সেরা। তাই আতিকও তার সম্পর্কে জেনে ও ছবি দেখে পছন্দ করে তাকে।
পরিবারের সম্মতিতেই দুজনের মাঝে কথা বলতে দেয়া হয়।
তবে মাঝেমাঝেই হয় কথা। কেননা মেহেনুবার বিয়ের আগেই ক্লোজ হবার ইচ্ছে নেই এতো।
-হ্যালো? তোমার বাংলাদেশের কোনো নাম্বার নেই বলে এতক্ষণ খবর নিতে পারিনি। আন্টির ফোন না আসলে আরো অস্থির হয়ে যেতাম। যাই হোক ওয়েলকাম টু বাংলাদেশ।
-ধন্যবাদ।
-এবার আমাদের দেখা করার ব্যবস্থা করো। আচ্ছা আমিই বলবো আন্টিকে।
-জ্বী।
.
মেহেনুবা জ্বী, হ্যাঁ, আচ্ছা ছাড়া আতিকের সাথে আর কোনো কথা বলেছে কিনা মনে করতে পারবেনা আতিক। তবে এই কথাগুলোও যেনো তার মুখে হাজার বছর শুনতে পারবে সে।
.
.
.
সন্ধ্যে হতেই ঘরে প্রবেশ করলো আরাফ।
সায়নী ও মুনিরাকে বসে থাকতে দেখে সে বললো-
হাই আম্মুগণ।
.
সায়নী ও মুনিরা একইসাথে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলো-
তুই প্রেম করিস আমাদের জানালি না কেনো?
.
এই কি শুনছে আরাফ! মায়েরা এসব জানলো কিভাবে! এখন কি করবে সে!

-কি হলো বল?
.
মুনিরা ধমকের সুরে কথাটি বলতেই আরাফ মিনমিনে স্বরে বললো-
ইয়ে মানে, প্রেম কি বলে বলে করে নাকি?
-তার মানে তুই করছিস প্রেম?
-আগে বলো কে বলেছে এসব?
-তোর প্রেমের কথা কে জানে?
-রুমানা ছাড়া কেউ তো না।
.
কথাটি বলেই মাথায় হাত দিয়ে দিলো আরাফ।
মায়েদের সামনে যেনো মিথ্যে মুখ দিয়ে আসেই না তার।
.
সায়নী ও মুনিরা হেসে উঠলো তার অবস্থা দেখে।
তারা ইশারায় ডাকলো আরাফকে।
সোফার উপরে দুই মায়ের মাঝে গুটিসুটি মেরে মাথা নিচু করে বসে আছে আরাফ।
সায়নী শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলো-
মেয়ের নাম কি?
-উপমা।
.
মুনিরা জিজ্ঞাসা করলো-
কি করে?
-প্রিমিয়ার ভার্সিটি তে বিবিএ ২য় বর্ষের ছাত্রী।
-বাবা কি করে?
-রাজনীতি।
-ছবি আছে?
-বাবার ছবি তো নেই।
-আরে উপমার?
-হু।
-দেখা।
.
আরাফের মোবাইলে উপমার ছবি দেখে মন ভরে গেলো সায়নী ও মুনিরার।
আরাফের পছন্দ আছে বলতে হবে।
সায়নী হেসে জিজ্ঞাসা করলো-
কতোদিন হলো মেয়েটিকে ফাঁসিয়েছিস?
-১বছর।
.
মুনিরা ভ্রু জোড়া কুচকে বললো-
দেখেছো আপু? আমাদের ছেলে এক বছর আগেই পর হয়ে গিয়েছে।
-বিয়ে তো করতেই হবে তাইনা? বিয়ে করলে কি আর পর হয়ে যায়!
-হয়না। তবে আরাফ আমাদের একমাত্র ছেলে। আমাদের পছন্দ হলেই সে বিয়ে করতে পারবে মেয়েটিকে। কি বলো আপু তুমি?
-হ্যাঁ তা অবশ্যই।
-এবার বলো তোমার পছন্দ হয়েছে উপমাকে? নাকি মেয়েকে সরাসরি দেখে নিবো একবার?
.
সায়নীর উত্তর জানার জন্য আকুপাকু করছে আরাফের মনটা। সে অসহায় দৃষ্টিতে সায়নীর দিকে তাকাতেই হেসে দিলো সায়নী।
.
আরাফ নিচের দিকে তাকিয়ে বললো-
হাসছো কেনো বড় আম্মু?
-তোর অবস্থা দেখে। যাক তোর যখন উপমাকে পছন্দ, ১বছরের সম্পর্কও আছে। আমি আর কি বলবো। আমার দেখার কিছু নেই। তোর লাইফ তোর ডিসিশন। এবার মুনিরা তুই তোর মত জানা?
.
-উম্ম….
.
মুনিরার ডিসিশন কি হবে! এটা নিয়ে আবার দুই মায়ের মাঝে দ্বন্দ্ব বেজে যাবে নাতো?
এসব চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে আরাফের মন।
আরাফের ভয় কাটিয়ে মুনিরা বললো-
ছেলে আর বড় মা যখন রাজি আমি আর কি বলবো! আমিও রাজি। এবার আরাফ তুই বল কখন আমরা প্রস্তাব নিয়ে যাবো উপমার বাসায়।
.
আরাফ খুশিতে দুহাতে দুমাকে জড়িয়ে নিয়ে বললো-
ওহ আম্মুগণ! তোমরা আসলেই গ্রেট।
.
সায়নী বললো-
ছাড় ছাড়। বউ তাড়াতাড়ি ঘরে আনতে চাই। আমার আর মুনিরার যে একটা মেয়ের অনেক শখ জানিসই তো তুই।
-হু জানি। কিন্তু আব্বু?
-তোর আব্বুও প্রেমিক মানুষ আফরান। না করবেনা। আর আমরা থাকতে এসবের চিন্তা করতে হবেনা তোকে।
-আগে যাই রুমানার বাচ্চা রুমানাকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে আসি। ওর জন্যই আজ এটা সম্ভব হলো। নাহলে আমি কিভাবে কথাগুলো তুলবো ভেবেই পাচ্ছিলাম না।
.
.
.
-ওই রুমানার বাচ্চা?
.
রুমানার বাসায় এসে আরাফ হুংকার ছেড়ে ডাকছে তাকে।
সোফার উপরেই বসে ছিলো রুমানা।
আরাফের গলার স্বর শুনে লুকিয়ে পড়লো রুমানা।
রুমানার মা এসে হেসে বললো-
রুমানা কিভাবে রুমানার বাচ্চা হবে রে আরাফ?
.
আন্টি রুমানাকে ডাকো। ওর সাথে হিসেব নিকাশ আছে আমার।
.
-এই রে! আজ আমাকে আলু ভর্তা, পাইন্না ডাল সব বানাবে এই আরাফ ভাইয়া। তার প্রেমের কথা ফাঁস করে দিলাম কিনা!
.
ভাবতে ভাবতেই কাধে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করলো রুমানা।
পেছনে তাকিয়ে দেখলো আরাফ।
দাঁড়িয়ে পড়লো রুমানা।
আমতাআমতা করে বললো-
আমি ইচ্ছে করে বলিনি। আসলে মুখ ফুসকে বলে ফেলেছি।
-কি! আমি আরো ভেবেছি আমার মায়েদের তুই রাজি করিয়ে এসেছিস৷ আমি বলতে পারছিলাম না তাই।
তোকে তাই ধন্যবাদ দিতে এসেছিলাম।
-রাজি হয়েছে আন্টিরা?
-হ্যাঁ।
.
রুমানা মিটমিট করে হেসে বললো-
হ্যাঁ হ্যাঁ! আমিই তো রাজি করিয়েছি। কতো পাম্প মেরেছি তাদের। কতো ইমোশনাল হয়ে বুঝিয়েছি।
.
রুমানার কথা শুনে হেসে উঠলো আরাফ।
রুমানা তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু জোড়া কুচকে বললো-
হু…
ভুলেই বলেছি ভাইয়া। আমি গিয়েছিলাম আমার আর রাকিবের বিয়ে ঠিক হয়েছে এটা জানানোর জন্য। কথার মাঝেই এটাও ভুলেই…
-কি! সত্যি তোদের বিয়ে ঠিক হয়েছে?
-হুম সত্যি।
.
রুমানার হাত ধরে ঘুরতে থাকলো আরাফ।
রুমানা বললো-
ভাইয়া মাথা ঘুরছে আমার ছাড়।
-ওহ হো! আজকে আমাদের খুশির দিন।
-তাই বলে ঘুরতে হবে?
.
রুমানাকে ছেড়ে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আরাফ বললো-
তুই তোর রাকিব কে পাচ্ছিস আর আমি আমার উপমা কে।
.
-উপমা কে নিয়েই থাকবা নাকি বাপের মতো আরেকটা বিয়ে করে আনবা?
.
সীমা আক্তারের কথা শুনে রুমানা বললো-
তুমি সবসময় কেনো এসব বলো তো দাদী?
-হুম আমি কিছু বললেই খারাপ। কিন্তু হক কথা বলি আমি।
.
বলেই সীমা আক্তার তার রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন।
.
আরাফ রুমানার উদ্দেশ্যে বললো-
বাদ দে রুমানা। আমি এখন আসি।
-ভাইয়া তুই রাগ করেছিস?
-নারে। সারাদিন বাইরে ছিলাম তো, ক্লান্ত লাগছে।
.
.
.
বাসায় আসতেই আফরানকে দেখতে পেলো আরাফ।
আফরান তার উদ্দেশ্যে বললো-
আমার রুমে আয় একটু। কথা আছে তোর সাথে।
.
আরাফ মায়েদের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞাসা করতে চায়লো, তারা কি সব বলে দিয়েছে আফরানকে?
কিন্তু জিজ্ঞাসা করতেই পারলো না।
.
.
বাবার পাশে বসে আছে আরাফ।
আফরান তার হাত ধরে বললো-
আমার ব্যবসা টা আমার বাবার হাতে গড়া জানিসই তো।
-হ্যাঁ।
-আমার একমাত্র বংশধর তুই। এখন যে হাল তোর ধরার সময়। তবে…
-কি আব্বু?
-তুই বুয়েট পাস করা ছাত্র। তোর যদি নিজের কিছু করার ইচ্ছে থাকে তাহলে বলতে পারিস।
.
মৃদু হেসে আরাফ বললো-
ট্যালেন্ট ছিলো কাজে লাগিয়েছি। এখন সে ট্যালেন্ট দিয়ে তোমার ব্যবসাও বড় করবো ইনশাআল্লাহ।
.
ছেলের কথা শুনে তাকে জড়িয়ে ধরলো আফরান।
সত্যিই আরাফ তার গর্ব।
.
.
.
বাবার সাথে কথা বলেই নিজের রুমে এসে আরাফ ফোন দিলো উপমাকে।
-হ্যালো সোনাটা?
-না শয়তান টা।
-উহু উপমা! তুমি সবসময় এতো খিটখিটে মেজাজে থাকো কেনো বলো তো?
-এখন ফোন দিয়েছো কেনো? এখন আমার পড়ার সময় জানো না?
-জানি তো। কিন্তু একটা গুড নিউজ আছে যে।
-কি?
-আম্মুরা তোমাকে পছন্দ করেছে।
-তো?
-তো মানে? তুমি খুশি হওনি?
-আমাকে পছন্দ করবেনা এমন টা আমি ভাবিনি কখনো। আমার ভয় তোমাকে নিয়ে।
.
অবাক হয়ে আরাফ বললো-
আমাকে নিয়ে কেনো?
-আরে প্রেমের ক্ষেত্রে মেয়ের মা বাবারা একটু আলগা পার্টে থাকে জানোনা?
-না।
-জেনে রাখো।
-তুমি তোমার বাসায় আমাদের কথা জানাও।
-পাগল নাকি! এখন আমাকে তারা বিয়ে দিবেনা।
-জানিয়ে রাখলে তো অসুবিধে নেই? আমার আম্মুরা যেতেও রাজি তোমাদের বাসায়।
-না না পাঠিও না তাদের। এখন যখন বিয়ে দিবেই না তাদের পাঠিয়ে লাভ কি বলো।
-বিয়ে তো একদিন হবে।
-সে একদিন দেরী আছে। আগে আমি পড়াশোনা কমপ্লিট করি।
-আমাকে বুড়ো বানানোর পর বিয়ে করলে লোকে বলবে উপমা বুড়ো বিয়ে করেছে।
-আমার বর তাদের কি!
-তুমি বিষয়টা সিরিয়াসলি নাও উপমা। পড়াশোনা আমার কাছেও করতে পারবে তুমি। আমার মায়েরা তোমাকে মেয়ের মতোই রাখবে। কোনো কিছুর কমতি হবেনা তোমার।
-আমার গুলো আমি আদায় করতে জানি।
-কি বললে?
-কিছুনা। এখন রাখো আরাফ।
-তুমি ভেবে দেখো উপমা৷ অন্তত এনগেজমেন্ট হলেও করে রাখা তো যায়?
-হু, জানাবো আমি। এসব ডিসিশন তো আর হুট করে নেয়া যায়না।
-হুম।
.
আরাফ ভেবেছিলো উপমাকে জানালে তার মায়েরা তাদের সম্পর্ক মেনে নিয়েছে সে খুশি হবে। কিন্তু এমন একটা আচরণ করলো যেনো মেনে না নিলেও তার কিছু যায় আসতো না।
মেয়েটাকে মাঝেমাঝে এতোটা ভাবলেশহীন মনে হয় কেনো!
.
.
.
সকাল ১১টাই ঘুম ভাঙলো আরাফের।
ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দরজা খুলেই তাসুকে দেখে যেনো ধাক্কা খেলো।
-এতো সকালে তুমি?
.
তাসু মৃদু হেসে জবাব দিলো-
১১টা বাজে এতো সকাল! যাই হোক, শুধু আমি না। আমরা সবাই এসেছি।
-ওহ!
.
আরাফ ত্রি-কোয়াটার প্যান্ট পরে রয়েছে দেখে হাসতে লাগলো তাসু।
ভ্রু জোড়া কুচকে আরাফ বললো-
এতো হাসির কি আছে শুনি?
-বাংলাদেশে এসব প্যান্ট চলে?
.
তাসুর দিকে তাকিয়ে আরাফ দেখলো সে লং জিন্সের সাথে ফুল হাতা শার্ট পরেছে।
মাথা নেড়ে আরাফ বললো-
লম্বা পরেছো তো সব। চলে চলে এসব।
-আরে আমার কথা বলছিনা আমি। বলছি তোমার কথা।
.
নিচের দিকে তাকিয়ে দরজা লাগাতে লাগাতে আরাফ বললো-
নিজের রুমের ভেতরে সব চলে।
.
আরাফের কান্ড দেখে হাসতে হাসতেই তাসু বললো-
ইশ! এত্তো কিউট কেনো এই ছেলে টা!
.
.
ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমেই মিশিকাদের সাথে দেখা হলো আরাফের।
মেহেনুবার দিকে চোখ পড়তেই দেখলো সাদা রঙের একটা গাউন পরেছে সে।
দুধে আলতা গায়ের রঙের সাথে তার জামার রঙ যেনো মিশে যেতে চাইছে।
কানে ঝুমকো, হাতে চুড়ি, খোলা চুল, চোখে কাজল, ঠোঁটে গোলাপি রঙের লিপস্টিক। সব মিলিয়ে বেশ ভালোই লাগছে তাকে৷ কিন্তু এতো সাজগোজের কারণ কি!
মিশিকা আরাফের উদ্দেশ্যে বললো-
আজ আতিকের সাথে লাঞ্চ করবি তোরা।
-ভালোই তো। আসুক সে।
-আসবেনা৷ তোরা যাবি রেস্টুরেন্টে।
আজ প্রথমবারের মতো মেহেনুবা ও আতিকের দেখা হবে। তুই নিয়ে যাবি মেহেনুবাকে।
.
এতোক্ষণে আরাফ বুঝতে পারলো মেহেনুবার এতো সাজগোজের কারণ।
সে মৃদু হেসে বললো-
ঠিক আছে নিয়ে যাবো।
.
-আমি যাবোনা?
.
তাসুর কথা শুনে মিশিকা বললো-
মোটেও না।
-হবু দুলাভাই কে তো দেখবো?
-পরে দেখিস। তুই যে বকবক করিস না!
.
তাসুর উদ্দেশ্যে মুনিরা বললো-
তুমি আমাদের সাথে গল্প করো। আমেরিকার গল্প করো।
.
মুখটা ফ্যাকাসে করে তাসু বললো-
কি আর করার!
.
.
.
রেস্টুরেন্টে সামনাসামনি বসে আছে মেহেনুবা ও আতিক।
আরাফ একটু দূরে অন্য দিকে বসে আছে।
মেহেনুবার খুবই অস্বস্থি লাগছে।
আতিক তার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যে নিজেকে জোকার ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছেনা তার।
নীরবতা ভেঙে আতিক বললো-
আমি কিন্তু বিয়েটা তাড়াতাড়ি করে ফেলতে চাই। তোমার কোনো অমত নেইতো?
.
মাথা নেড়ে মেহেনুবা বললো-
না।
.
.
দূর থেকে তাদের দেখছে আরাফ।
মেহেনুবাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে ভীষণ নার্ভাস।
এখন যদি উপমা তার সামনে থাকতো কথার ঝুড়ি খুলে দিতো। আর এই মেহেনুবা?
সারা রাস্তায় তার সাথে একটা কথাও বললো না। এখন দেখছে নিজের হবু বরের সাথেও এমন!
মাথাটা নিচু করে আছে। আতিক কে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে আর মেহেনুবাকে মাথা নাড়তে।
ভাবতে ভাবতেই অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসলো আরাফের।
-হ্যালো?
-আমি তাসু। এটা আমার নিউ নাম্বার।
-ওহ তাসু! হ্যাঁ বলো?
-আপু কই?
-হবু দুলাভাই এর পাশে।
-কি করছে?
-মাথা নাড়ছে।
-মানে?
-মানে কথা বলছে আর কি।
-আতিক ভাইয়া দেখতে কেমন?
-সেই।
-আর আপুকে দেখে তার রিয়াকশন কেমন ছিলো?
-জাস্ট ও মাই গড।
-ইশ! আমি এসব মিস করছি।
-তুমি চাইলে দেখতে পারো।
-কিভাবে?
-ছবি তুলে দিচ্ছি তোমাকে।
-ঠিক আছে।
.
আরাফ দূর থেকেই তাদের ছবি তুলে পাঠিয়ে দিলো তাসুকে।
.
.
লাঞ্চের পরেই রেস্টুরেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো মেহেনুবা ও আরাফ।
গাড়ি ছাড়ার কিছুক্ষণ পরে আয়নায় চোখ পড়তেই আরাফ দেখতে পেলো, মেহেনুবা তার হাতের চুড়ি, কানের দুল সবই খুলে ফেলছে।
আরাফ তাকে উদ্দেশ্যে করে বললো-
খুলে ফেলছো যে?
-আম্মুর জোরাজুরি তে পরেছিলাম। আতিক কে দেখানো শেষ তাই খুলে ফেলছি।
.
হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে দিলো আরাফ।
মেহেনুবা কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লো সে।
একটি পথ শিশু হোচট খেয়ে রাস্তায় পড়ে গিয়েছে।
তাকে উঠাতেই গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লো আরাফ।
আরাফ তাকে তুলে জামা কাপড়ে লেগে থাকা ময়লা ঝেড়ে দিচ্ছে।
মুগ্ধ চোখে এই দৃশ্যটি দেখে চলেছে মেহেনুবা।
আরাফের এমন ব্যবহার গুলি খুব ভালো লাগে তার।
আরাফ কে সে ভালোবাসেনা, কিন্তু আরাফের চোখে প্রথম যেদিন তার চোখ পড়ে মনে হয়েছিলো অন্য একটা জগত সেই চোখে দেখেছে মেহেনুবা।
তাসুর মতে আরাফ এমন একটা ছেলে, যে কেউ তার প্রেমে পড়তে বাধ্য।
তাই মেহেনুবা দুরত্ব বজায় রেখে এসেছে প্রতিবারই আরাফের কাছ থেকে। প্রেমে পড়ার ইচ্ছে তার নেই।
ভাগ্য বিশ্বাসী মেহেনুবা। প্রেম ভালোবাসায় নয়।
.
.
গাড়িতে উঠে কিছুদূর যাওয়ার পরেই ফোন বেজে উঠলো আরাফের।
ফোনে হ্যাডফোন লাগিয়ে সে রিসিভ করলো কল। উপমার ফোন এসেছে, না ধরলে পরে হাজার টা প্রশ্ন করবে। তার চেয়ে বরং ড্রাইভ করছে জানায় দেয়া শ্রেয়।
কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে উপমা বললো-
আম্মু আমাদের ব্যাপারে সবটা জেনে গিয়েছে আরাফ! রেগেমেগে আব্বুকে ফোন দিতে গেলো এখন।
-কি করে জানলো?
-সে পরে বলবো। এখন কি করবো!
.
আরাফ তাকে অভয় দিয়ে বললো-
-এই পাগলি মেয়ে কিছু হবেনা। সবটা সত্যি জানাবে।
দেখবে মেনে নিবে তারা।
-সত্যি?
-হু সত্যি।
-আচ্ছা রাখছি এখন। আম্মু কি করছে দেখে আসি।
-নিজের খেয়াল রেখো।
.
হ্যাডফোন কান থেকে সরাতেই মেহেনুবা জিজ্ঞাসা করলো-
স্পেশাল কারো সাথে কথা বলছিলে?
-হুম।
.
আরাফের মুখে হুম শুনে তাসুর কথা মনে পড়ে গেলো মেহেনুবার। আরাফের জীবনে স্পেশাল কেউ আছে শুনলে তাসুর রিয়াক্ট কেমন হবে!

দুপুরে খাবারের পর রান্নাঘরে থালাবাসন ধোয়া ও গুছিয়ে রাখার কাজ করছে সায়নী, মুনিরা।
মুনিরা হঠাৎ সায়নীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো-
মেহেনুবা মেয়েটা বেশি সুন্দরী। শুধু সুন্দর না, আদব কায়দায় দিকেও সেরা। দেখেছো আপু আমেরিকা থাকে তাও আমাদের দেখার সাথে সাথেই পায়ে ধরে সালাম করলো।
-হুম।
-তাসুর মাঝে যদিও বিদেশিদের মতো ভাব আছে তবে অন্তর পরিষ্কার। মেহেনুবাকে সালাম করতে দেখে সেও এসে করেছে। দুইটা মেয়েই সেরা। তাইনা?
-হ্যাঁ।
-না জানি উপমা টা কেমন হয়।
.
মুনিরার কপালে চিন্তার ভাজ দেখতে পেলো সায়নী।
মৃদু হেসে সে বললো-
আরাফের পছন্দ সে। নিশ্চয় ভালো হবে। তোর মন মেহেনুবা বা তাসুর দিকে পড়ে আছে। তাই তো হাবিজাবি ভাবছিস তুই।
-সব ভালো হবে তো আপু? আমাদের একমাত্র ছেলে আরাফ….
-সব ভালো হবে। ভরসা রাখ।
.
.
.
ঘরে প্রবেশ করেই তাসুকে খুঁজতে খুঁজতে আরাফের পাশের রুমে পেয়ে গেলো মেহেনুবা।
মেহেনুবা কে দেখেই তাসু বলে উঠলো-
আতিক ভাইয়াকে কেমন লেগেছে?
-সবার ভালো লেগেছে যখন আমার আর কি বলার আছে।
-মানে কি! আব্বু বাংলাদেশী ছেলে চায় তার মেয়েদের জন্য। তুই রাজীও হয়েছিস তার ডিসিশন এ। কিন্তু যে ছেলে বলবে তাকেই বিয়ে করতে হবে বলে কথা নেই আপু। আমি তো আমার পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করবো। আমেরিকায় সেটেল আছে এমন কাউকে। তুইও আতিক কে ভালো না লাগলে বলে দে।
.
তাসুর কথা শুনে চোখ জোড়া বড়বড় করে মেহেনুবা বললো-
মানেটা কি! তাহলে আরাফ?
-হোয়াট আরাফ?
-তুই না আরাফকে পছন্দ করিস?
-হুম করি। তো? ওয়েট ওয়েট আপু। তুই কি আরাফকে আমি লাভ করি ভেবেছিস? সিরিয়াসলি?
-করিস না? না মানে আরাফের জীবনে স্পেশাল কেউ থাকলে তুই কষ্ট পাবিনা?
-নো! হি ইজ মাই ক্রাশ আপু। আরে সালমান, সিয়াম, জাস্টিন ওদের উপরেও আমি ক্রাশ খাই। তাই বলে কি সবাইকে ভালোবাসি?
-তবে যে তুই বলতি, আরাফ এমন একটা ছেলে যে কেউ তার প্রেমে পড়বে?
-হু পড়বে। তাই বলে প্রেম করতে হবে কথা আছে নাকি! আসলে আমার প্রেম ট্রেমে ইন্টারেস্ট নেই। ফ্লাট করতেই ভালো লাগে।
বাই দ্যা ওয়ে এসব কেনো আস্ক করছিস তুই?
-না এমনিতেই।
.
.
আরাফ কে তাসু ভালোবাসেনা শুনে মনের ভেতর শান্তি অনুভব করছে মেহেনুবা।
কিন্তু কেনো!
নিজের মাথায় বাড়ি দিয়ে মেহেনুবা এগিয়ে গেলো ওয়াশরুমের দিকে ফ্রেশ হবার জন্য।
.
.
.
ঝামে ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে আরাফ।
উপমার চিন্তায় অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে তার।
ফ্যানের নিচে বিছানার উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে সে।
ফুল স্পীডে ফ্যান চললেও ঘেমে চলেছে আরাফ।
উপমার নাম্বার বন্ধ পাচ্ছে সে।
তবে কি খারাপ কিছু হলো!
ভাবতে ভাবতেই ফোন বেজে উঠলো আরাফের।
এক লাফে বসে পড়ে বিছানার পাশ থেকে মোবাইল টা হাতড়িয়ে নিলো সে।
উপমার কল দেখে এক সেকেন্ডও দেরী না করে রিসিভ করে বললো-
হ্যালো উপ? ঠিক আছে সব?
-আম্মু আব্বু তোমাকে এখুনি বাসায় আসতে বলেছে।
-কেনো?
-কথা বলার জন্য। আসবে তুমি?
-কেনো নয়! নিশ্চয় আসবো।
উনারা কি মেনে নিয়েছে আমাদের সম্পর্ক?
-এই ব্যাপারে কিছু বলেনি।
-বাসায় জানলো কিভাবে?
-তোমার আমার একটা ছবি বের করে দেখছিলাম। কখন যে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল ছিলোনা। মা আমার রুমে এসে দেখে ফেলেছে।
-ভালোবাসো বেশি, তাইনা?
-এক বছরেও বুঝোনি?
-হু। তুমি অপেক্ষা করো। আমি এখুনি আসছি।
-সব ঠিক হবে তো?
-হবে।
.
.
আরাফ তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে লাগলো ঘর ছেড়ে।
আচমকা সায়নী ডাক দিয়ে বললো-
কোথায় যাচ্ছিস? মাত্রই তো বাসায় এলি।
.
সায়নীর ডাকে থেমে গেলো আরাফ। তার পাশে এসে বললো-
উপমার বাসায় সবটা জেনে গিয়েছে আমাদের ব্যাপারে। আমার বাসায় যেভাবে সম্পর্ক টা মেনে নিয়েছো তোমরা, তারাও মেনে নিবে তো?
.
ছেলেকে শান্তনা দিয়ে সায়নী বললো-
কেনো মানবে না! নিশ্চয় মানবে। কিন্তু তুই ওখানে যাচ্ছিস কেনো?
-ডেকেছে আমাকে।
-আমি যাই তোর সাথে?
-আগে আমি গিয়ে কথা বলি।
-কিন্তু…
-ছোট আম্মুকে জানিও। আমি আসি এখন।
.
কথাটি বলেই আরাফ এগিয়ে গেলো সদর দরজার দিকে।
সায়নীও এগিয়ে গেলো মুনিরার রুমের দিকে। তাকে সবটা জানানো প্রয়োজন।
.
.
.
চেম্বারে বসে আছে আতিক।
রেস্টুরেন্ট থেকে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো কিন্তু মনটা মেহেনুবাতেই আটকে আছে তার।
মেহেনুবা শুধু সুন্দরী নয়, অতি ভদ্রও।
আজ আতিকের নিজের উপর গর্ব হচ্ছে সে ডাক্তার বলে। যদি ডাক্তার না হতো, তবে কি মেহেনুবা কে পেতো!
উহু, এখনো পায়নি। তবে পাবে খুব তাড়াতাড়ি।
আপনমনে এসব ভেবে হেসে চলেছে আতিক।
.
.
.
আফরান মাত্রই পাবেলের সাথে আড্ডা শেষ করে শুতে এসেছে।
এরইমাঝে মুনিরাও তার পিছুপিছু এসেছে।
আফরান তাকে দেখে বললো-
মনে হচ্ছে কিছু বলবে আমাকে?
-আপনি রাগ করবেন না বলেন?
-আগে শুনি?
-ইয়ে মানে সায়নী আপুই আমাকে বলতে পাঠিয়েছে।
.
মৃদু হেসে আফরান, বললো-
ঘটনা কি?
-আমাদের আরাফ, উপমা নামের একটি মেয়েকে ভালোবাসে।
.
অবাক চোখে তাকিয়ে আফরান বললো-
সত্যি?
-হুম।
-কে বলেছে? আর মেয়ে কি করে?
.
মুনিরার মুখে সবটা শুনে আফরান বললো-
ভালোই হলো আমাদের জানিয়েছে। আমার মতো ভালোবাসার কথা চেপে রাখেনি।
-হু। তো আফরান সাহেব, এবার শ্বশুড় হবার প্রস্তুতি নাও। দুঃখিত শ্বশুড় হবার প্রস্তুতি নেন।
.
আফরান হেসে বললো-
তুমি করে বললেই পারো।
-নাহ। ছোট থেকে ইচ্ছে, নিজের স্বামীকে আপনি করেই বলবো। আমাদের গ্রামের মেয়েরা এমনি বলে।
-আচ্ছা! তোমারাও শ্বাশুড়ী হবার প্রস্তুতি নাও। তবে বিয়ের আগে আরাফকে ব্যবসার কাজে হাত লাগাতে হবে। যাকে তাকে বেকার বলতে না পারে।
-হ্যাঁ। ও আসার পরেই কথা বলিয়েন ওর সাথে। আজ তো উপমার বাসায় কথা বলে আসবে। আমাদের কষ্ট কমে গেলো তাইনা?
-হু।
-আচ্ছা আমি যাই। সায়নী আপুদের সাথে আড্ডা দিবো।
.
.
ছেলের জন্য ভীষিণ খুশি আফরান। সে যে ভুলটা করেছিলো তার ছেলে অন্তত এই ভুল করলোনা ভেবে ভালোই লাগছে তার।
.
.
.
উপমার বাবা ফখরুল মোবারক ও মা রুপা আক্তার এর সামনে বসে আছে আরাফ।
উপমাকে দেখা যাচ্ছেনা।
সে হয়তো আড়াল থেকেই তাকে দেখছে।
ফখরুল মোবারক হালকা কেশে বলে উঠলেন-
নাম কি?
-আরাফ খান।
-বাহ! খান বংশের ছেলে।
-জ্বী।
-কি করো?
-সবে মাত্র বুয়েট পাস করলাম। কিছুদিন পর বাবার বিজনেস এ জয়েন করবো।
-ফ্যামিলি বিজনেস?
-জ্বী।
-মা কি করে?
-গৃহিনী। তবে বড় আম্মু প্রায় ১৬বছর শিক্ষকতা করেছেন সরকারী কলেজে।
-তোমার বড় আম্মুর কথা শুনে লাভ নেই। তা বাসায় জানে উপমার কথা?
-বড় আম্মু আর ছোট আম্মু জানে।
.
রুপা আক্তার ভ্রু জোড়া কুচকে বললেন-
কি বড় আম্মু, ছোট আম্মু লাগাইছো! নিজের মায়ের কথা বলো?
-আমি তাদের কথায় বলছি।
-মানে কি! তোমার চাচীরাই তোমার অভিবাবক? মা নাই তোমার?
-মা আছেন। দুইজন মা আছেন আমার। তাই তো বলছি বড় আম্মু, ছোট আম্মু।
-মানে সতীন?
.
সতীন কথাটা শুনতে কেনো যেনো ভালো লাগেনা আরাফের। তাও সে মাথা নেড়ে সাই দিলো।
.
রুপা আক্তার আরো জিজ্ঞাসা করলেন-
এক সাথে থাকে?
-জ্বী।
.
রাগে গিজগিজ করে রুপা আক্তার স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন-
দেখেছো আমি বলেছিলাম না? আমার মেয়ে সহজ সরল। এই ছেলেই আমার মেয়েকে পটাইছে। আরে আমার মেয়ের জন্য কতো ছেলে পাগল। আর সে কিনা এমন একটা ঘরে যেতে চায় যে ঘরে দুইটা শ্বাশুড়ী আছে! এরা তো জ্বালায় খাবে আমার মেয়ে কে।
-আমার আম্মুরা এমন নয় আন্টি। তারা খুব ভালো মনের মানুষ।
-তবে খুবই নোংরা মনের মানুষ।
.
ফখরুল মোবারকের মুখে কথাটি শুনে যেনো থমকে গেলো আরাফ।
ফখরুল মোবারক আরো বললেন-
যে ছেলের বাবা দুইটা বিয়ে করে দুই বউ কেই এক ছাদের নিচে রাখতে পারে সে ছেলে কেমন হবে আমার জানা আছে। হাজার হোক, বাবার রক্তই তো শরীরে বইছে তোমার। তুমিও যে পরে আরেকটা বিয়ে করবেনা এর গ্যারান্টি কি?
.
নিজের রাগ সংযত করে আরাফ বললো-
আঙ্কেল আমার আব্বু পরিস্থিতির স্বীকার ছিলেন। কিন্তু পরে আমার আব্বু দুই বউকেই সমান অধিকার দেন৷ কাউকে ছাড়েন নি বা কাউকে কষ্ট পেতে দেননি৷ এইরকম কতোজন পারে? অন্য কেউ হলে একজনের সাথে অন্যায় করতো।
-কিন্তু তোমার মায়েরা আসলেই সুখে আছে তো? নাকি তোমার বাবার ভোগবিলাসীর বস্তু তারা শুধু? আর তোমার মায়েরা বোধহয় বাজে ফ্যামিলির মেয়ে। নাহলে কিভাবে মানলো এসব!
.
এপর্যায়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো আরাফ-
যেটা জানেন না সেটা নিয়ে কথা বলবেন না প্লিজ।
.
ফখরুল মোবারক দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন-
তোমার সাহস তো কম না? আমার বাসায় দাঁড়িয়ে আমার সাথে এভাবে কথা বলছো তুমি।
অবশ্য বলবে নাই বা কেনো! যেমন ফ্যামিলির ছেলে তেমনি বেয়াদব হবার কথা।
.
আরাফও দাঁড়িয়ে বললো-
আঙ্কেল আপনি আমাকে নিয়ে যা খুশি বলুন। ফ্যামিলি নিয়ে কথা বলবেন না প্লিজ।
-একশো বার বলবো, হাজার বার বলবো। যেটা সত্যি সেটাই বলবো। কি করবে তুমি?
আরে যাকে জিজ্ঞাসা করবে সেই বলবে তোমার ফ্যামিলি কতোটা নোংরা।
-আঙ্কেল অতিরিক্ত বলছেন আপনি৷ আমার ধৈর্য্যের সীমা পার হলে কিন্তু…
.
কথাটি বলেই থেমে গেলো আরাফ।
উপমা এসে অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো-
কি করবে তুমি ধৈর্য্যের সীমা পার হলে? হাত তুলবে?
.
আরাফ উপমার কাছে এসে বললো-
উপমা আমি এমনটা বুঝাইনি।
.
ছলছল চোখে তাকিয়ে উপমা বললো-
তাহলে কেমন টা বুঝিয়েছো?
-তুমি সবটা শুনোনি উপমা।
-আমি সবটাই শুনেছি। যাই খুশি বলুক না আব্বু, শুনে নিলে কি এমন ক্ষতি হতো?আব্বু তো ভুল কিছু বলছেন না৷ তাহলে হজম করতে অসুবিধে কিসের?
.
উপমার কথা শুনে যেনো আরাফ বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গেলো।
চোখের কোণায় পানি চলে এলো আরাফের।
হাতের আঙুল দিয়ে মুছে উপমার উদ্দেশ্যে বললো-
ভুল বলেনি আঙ্কলে? আমার আব্বু, আম্মুদের নিয়ে এসব বাজে কথা আমাকে সহ্য করতে হবে?
-তুমি যদি আমাকে ভালোবাসতে তাহলে তাই করতে।
-আমার পরিবার আমার কাছে আগে নয় কি উপমা?
-ওহ তাই! পরিবার আগে তোমার কাছে? তাহলে এখানে কি করছো? যাওনা ওই দুই সতীনের আঁচলে মুখ লুকিয়ে রাখো। একটা বাবার পছন্দে আর দুইটা দুই মায়ের পছন্দে বিয়ে করে নাও।
.
পেছন থেকে রুপা আক্তার বললেন-
বাবা দুইটা করছে, ছেলে তিনটা করলে সমস্যা কি!
.
আরাফ শান্ত গলায় উপমার দিকে তাকিয়ে বললো-
তোমার মা বাবার নামে কেউ উল্টো পালটা কথা বললে সহ্য করতে তুমি?
-না।
-তাহলে আমি কি করে করবো?
-কারণ এসব মোটেও উলটো পালটা কথা ছিলোনা। তাই তোমার করা উচিত ছিলো। তুমি আমার জন্য তোমার থার্ড ক্লাস বাবা মায়েদের নামে দুইটা খারাপ কথা শুনতে পারছো না। যদিও এসব সত্য কথা। তাহলে ফিউচারে কি করবে বোঝায় যাচ্ছে।
.
উপমার কথাটি শুনে নিজের রাগ আর সংযত করতে পারলোনা আরাফ।
কষে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো তার বাম গালে।
আরাফের এমন কান্ডে
উপমা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।
আর তার বাবা এসে আরাফের কলার ধরে বললো-
তোর এতোবড় সাহস তুই আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছিস? তুই জানিস আমি কে?
.
রুপা আক্তার এগিয়ে এসে ছাড়িয়ে নিলেন আরাফকে স্বামীর কাছ থেকে।
আরাফের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বললেন-
আর কোনো ঝামেলা হবার আগেই এখুনি বেরিয়ে যাও এখান থেকে। নাহলে আমি আর উনাকে আটকাবো না।
.
.
.
মিশিকাদের আগমণে পুরো বাড়ি গমগম করলেও আরাফের অনুপস্থিতিতে সায়নী ও মুনিরার মনটা অস্থির হয়ে আছে।
সন্ধ্যে হয়ে গেলো। এখনো আরাফ এলোনা। কারো ফোনও রিসিভ করছেনা সে।
সব ঠিক আছে তো!

ড্রয়িং রুম ভর্তি মানুষকে উপেক্ষা করে, তাদের নজরের আড়ালে আরাফ সোজা এগিয়ে গেলো উপরের দিকে।
তবে সায়নী ও মুনিরার নজর এড়ালো না। তার এমন আচরণ দেখে সায়নী ও মুনিরার কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো।
মুনিরাকে ইশারায় সায়নী তার সাথে উপরে যেতে বললো।
দুজনেই একসাথে পা বাড়ালো আরাফের রুমের দিকে।
.
.
মেঝেতে বসে আছে আরাফ।
সারা শরীরে ঘাম, চুলগুলো এলোমেলো, চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।
আরাফকে এমন অবস্থায় দেখে মায়েদের মনটা ধুক করে উঠলো।
দুজনিই তার পাশে এসে বসলো।
সায়নী শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলো-
কিছু হয়েছে?
.
চুপচাপ মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে আরাফ। তা দেখে মুনিরা বললো-
মেয়ের বাসায় কি মেনে নেয়নি?
.
আরাফের কাছে কোনো সাড়া না পেয়ে সায়নী বললো-
তাতে কি হয়েছে! উপমা ঠিক থাকলেই হলো। আমরা এক কাপড়েও ঘরের বউ করে আনতে রাজি। শুধু তোরা ভালো থাকলেই হলো।
.
ছেলে হয়েও তার খুব করে কান্না আসছে।
তার মায়েরা কতো ভালো! আর উপমা কিনা তাদের নামেই যা তা বলেছে!
নিজেকে সামলিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে আরাফ বললো-
উপমা কে আমি ভুলে যাবো। সে তোমাদের পুত্র বধু হবার যোগ্য নয়।
.
কথাটি শুনতেই সায়নী ও মুনিরা একসাথেই বলে উঠলো-
মানে টা কি? হয়েছে কি খুলে বল?
.
ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো আরাফ।
আফজাল খানের মৃত্যুর সময় প্রথম আরাফকে কাঁদতে দেখেছিলো তারা। আর আজকে আবার দেখছে। তাহলে নিশ্চয় এমন কিছু হয়েছে যা সহ্য ক্ষমতার বাইরে ছিলো।
সায়নী ও মুনিরার দুজনেই আরাফকে বাধ্য করলো সত্য বলার জন্য। সবটা শোনার পরে দুজনেই যেনো থমকে গেলো।
এক জন চেয়ে রইলো আরেকজনের মুখের দিকে।
তাদের অতীতের জন্য তাদের ছেলের ভালোবাসা টা হেরে গেলো!
.
.
আড়াল থেকে সবটা শুনে মেহেনুবার চোখেও অশ্রু চলে এলো।
এদিক দিয়েই যাচ্ছিলো সে।
দরজা খোলা থাকাই আরাফের অশ্রুসিক্ত মুখটা তার চোখে পড়লো।
তাকে এমন অবস্থায় দেখে না চাইতেও কি হয়েছে তা জানার জন্যই আড়াল থেকে সবটা শুনেছে সে।
আরাফের কষ্টে যেনো সেও কষ্ট অনুভব করছে।
উপমা আরাফকে বুঝলো না। বুঝলোনা এই পরিবার কে। হয়তো একদিন বুঝবে। সেদিন কি তার এই ব্যবহারের জন্য আরাফ তাকে মন থেকে মেনে নিতে পারবে!
.
.
.
নিজের রুমে বসে আছে উপমা।
আরাফ তার গায়ে হাত তুলেছে! এটা যেনো বিশ্বাসই করতে পারছেনা সে।
রুপা আক্তার এসে উপমার উদ্দেশ্যে বললেন-
যে ছেলে বিয়ের আগেই তোর গায়ে হাত তুলতে পেরেছে সে ছেলে বিয়ের পরে কি করবে ভেবে দেখেছিস?
.
নিশ্চুপ হয়ে আছে উপমা। তার পাশে বসে রুপা আক্তার বললেন-
পুরো দুনিয়া ওই ফ্যামিলির নামে এসব কথা বলে। তবে আমাদের মুখে কেনো সে এসব শুনে সহ্য করতে পারলো না! আসলে সে তোকে ভালোই বাসেনা। বাসলে চুপচাপ সব সহ্য করে বসে থাকতো। না সে তা করলো না। তর্ক করলো তোর বাবার সাথে। তুই বুঝাতে এসেছিস আর তোর গায়ে হাত তুললো। দেখেছিস? তোর আব্বুই কিন্তু এর প্রতিবাদ করেছে। ওই ছেলের ঘরে এমন কিছু হলে দুই মা মিলে তাল দিতো আরো। ভালোই ভালোই ওই ছেলের আসল রূপ চলে আসলো সামনে।
.
রুপা আক্তার খেয়াল করলেন উপমার হাতের মুঠোয় আরাফ ও তার ছবিটা।
উপমার হাত থেকে রুপা আক্তার ছবিটা নিয়ে ছীড়ে ফেলতে ফেলতে বললেন-
তোর জন্য ছেলের অভাব নেই। ভুলে যা এই ছেলেকে।
.
মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো উপমা।
কাঁদতে কাঁদতেই বললো-
আরাফ এমন হবে আমি ভাবিনি আম্মু। ভেবেছি আমার জন্য সে সব করতে পারবে।
-ভুলে যা মা ওকে। ওদের বাসায় দুই বিয়ে প্রাধান্য দেয় দেখছিস ই তো। তোর পরে আরো কয়েকটা বিয়ে করলেও কেউ কিছু বলবেনা। কষ্ট পাবি শুধু তুই।
.
.
.
সায়নীর মুখে সবটা শোনার পর আফরান বুকের ভেতরে অন্য রকম কষ্ট অনুভব করছে।
তার ভুলের জন্য তার ছেলের সাথে এসব হলো।
কি করে সমাজ কে বোঝাবে আফরান! পরিস্থিতি যে বড় অসহায়। তার জীবনে যা ঘটেছে আরাফের জীবনে তা ঘটার নয়। কেননা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বারবার হয়না।
আরাফ কে সেই চাপে তারা পড়তেই দিবেনা যার ফলে সে সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগবে।
শুধুমাত্র তার ভুলের জন্য নিজের ছেলের জীবনে এভাবে প্রভাব পড়বে ভাবেনি আফরান।
সবার জীবনের কাহিনী তো এক হয়না। এটা কেনো সমাজ বুঝেনা! কেনো মা বাবার জন্য তাদের সন্তানদের কথা শুনতে হবে!
সারারুমে পায়চারী করছে আফরান।
দেয়ালে টাঙানো বাবার ছবিটির দিকে তাকিয়ে বললো-
বাবা? তুমি তো সব জানো। কি পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে আমার জীবনে দুইজন নারী এসেছে।
আজ এটার জন্যই আমার ছেলে তার ভালোবাসা হারাতে বসেছে।
আজ আমার প্রচুর আফসোস হচ্ছে। কেনো জীবনে এতো ভুল করলাম! যার খেসারত আমার ছেলেকে দিতে হচ্ছে!
.
.
.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে মেহেনুবা।
তাসু এসে বললো-
আরাফ ছেলেটার দরজা বন্ধ সেই কখন থেকে। ঘরে মেহমান আছে সেই খেয়াল নেই তার।
.
তাসু খেয়াল করলো মেহেনুবার চোখে পানি। সে বললো-
আপু তুই কাঁদছিস কেনো?
.
আসলেই তো! সে কাঁদছে কেনো! তার নিজেরই অজানা।
.
ভ্রু জোড়া কুচকে তাসু বললো-
তোকে আতিক ভাইয়া কিছু বলেছে?
-উহু।
-তাহলে তাকে তোর পছন্দ হয়নি?
-এসব কিছু না তাসু। ভালো লাগছেনা। একটু একা থাকতে দে আমাকে।
-সেটা তো দিতে পারিনা মাই ডিয়ার আপ্পি। আচ্ছা তুই কান্না কর। আমি তোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকি।
-কেনো?
-বারেহ! আমার আপুকে এভাবে আমি একা রেখে যেতে পারিনা।
.
আচমকা তাসুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলো মেহেনুবা।
তাসু তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো-
বুঝেছি। সামনে বিয়ে বলে মন খারাপ হচ্ছে তোর?
-উহু! কেনো কাঁদছি নিজেও জানিনা। তবে কাঁদতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
.
বোনের মুখে কথাটি শুনে ফিক করে হেসে দিলো তাসু।
হাসতে হাসতেই বললো-
ওলে বাবালে…
আচ্ছা কাঁদ কাঁদ।
.
.
.
সায়নী রান্নাঘরের এক কোণায় পিড়ি পেতে বসে আছে।
এই খানে দরকার ছাড়া কেউ আসেনা। বাড়িতে মেহমান থাকার সময়ে এই জায়গা টাই মনেহয় একা থাকার জন্য সেরা।
কিন্তু মুনিরা কি তাকে একা থাকতে দিবে! দুজনের মনেই তো একই ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
মুনিরাও তার পাশে এসে বসলো।
শান্ত গলায় বললো-
আমার মনে যা চলছে তোমার মনেও তা চলছে তাইনা আপু?
-হুম। আরাফ হবার পরেই যদি আমি চলে যেতাম তোদের মাঝ থেকে, তাহলে এমন দিন দেখতে হতোনা।
-ওহ তাই! তোমার কি মনেহয়? তুমি যেতে চাইলেই উনি যেতে দিতো তোমাকে? পাগলের মতো ভালোবাসেন উনি তোমাকে। মাঝখানে তো আমিই এসেছি। আমারি উচিত ছিলো চলে যাওয়া। আরাফকে তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে চলে যাওয়া।
-ও বুঝি তোকেও যেতে দিতো!
.
দুজনেই চুপ হয়ে গেলো।
শান্ত গলায় সায়নী বললো-
আমাদের জীবনে যা ঘটেছে সবটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্যই। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা এক সুতোয় বেধে গিয়েছি। তবে সমাজ এটা মানবে না আমাদের অজানা ছিলোনা। এতোদিন তো দেখে এসেছিই। কিন্তু আরাফের জীবনে যে এর খারাপ প্রভাব পড়বে আমার জানা ছিলোনা। ভাবিই নি কখনো এমন।
-আমিও ভাবিনি আপু। আর কেমন মেয়ে এই উপমা টা!
আরাফ কে সে ভালোই বাসেনা। বাসলে তাকে বুঝতো সে।
-আমার মনেহয় মেয়েটার মনে একটা ভুল ধারণা জন্ম নিয়েছে। যেটা আমরা ভাঙাতে পারি। সে আরাফ কে ভালোবাসে। তাই আমার বিশ্বাস মাথা ঠান্ডা হলেই নিজের ভুল বুঝতে পারবে সে।
-কিন্তু…
-না মুনিরা। এবার আর কোনো ভুল হবেনা। প্রতিটা পদক্ষেপ নিতে হবে ভেবে ভেবে। আমরা যাবো উপমার কাছে। তাকে বোঝাবো। আমাদের ভুলের শাস্তি আরাফকে দিতে বারণ করবো। সে সুখে থাকবে তার গ্যারান্টি দিবো।
-মানবে উপমা?
-সেটা তার ব্যাপার। কিন্তু আরাফের জন্য এটা আমাদের করতেই হবে।
.
কথাটি বলেই সায়নী দাঁড়িয়ে পড়লো।
মুনিরা জিজ্ঞাসা করলো-
এখুনি যাবে?
-ঠিকানা নিতে যাচ্ছি রুমানার কাছ থেকে। আরাফ নিশ্চয় এখন উপমার ঠিকানা আমাদের দিবেনা।
-হুম।
.
.
.
সায়নীর মুখে সবটা শুনে রাগে গিজগিজ করে রুমানা বলে উঠলো-
এই উপমা মেয়েটাকে আমার প্রথম থেকেই ভালো লাগতো না। কতো বুঝিয়েছিলাম আরাফ ভাইকে। এতো মাথায় তুলিস না এই মেয়েকে। হলো তো এখন!
-বাদ দে। আমাকে ঠিকানা টা দে উপমার।
-ওখানে যাওয়া টা ঠিক হবে? না মানে এতো কিছুর পরে কি দরকার! বাদ দাও। আমাদের আরাফ ভাই এর জন্যও ভালো মেয়ের অভাব হবেনা। দেখিয়ে দাও তাদের।
-কিন্তু আরাফ যে উপমা কেই ভালোবাসে।
.
কথাটি শুনে শান্ত ভঙ্গিতে রুমানা বললো-
দিলে তো ইমোশনাল করে আমাকে! নিজেও ভালোবেসেছি তাই ভালোবাসা কি জিনিস বুঝি আমি। ঠিক আছে আমি দিচ্ছি ঠিকানা।
.
.
-সায়নী কোথায়?
.
মিশিকার মুখে প্রশ্নটি শুনে মুনিরা বললো-
পাশের বাসায় গিয়েছে। চলে আসবে।
-তোমাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। সব ঠিক আছে?
-হ্যাঁ আপু আছে।
-তোমাদের দেখলে অবাক হয়ে যাই আমি। কি সুন্দর মিলেমিশে থাকছো দুজনে এতো বছর।
-এটাই তো আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
-মানে?
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মুনিরা বললো-
কিছুনা। বসো। তোমাদের কথা বলো।
.
.
.
সকাল সকাল সায়নী ও মুনিরাকে বেরিয়ে যেতে দেখে মিশিকা ডাক দিলো।
মিশিকার ডাকে দাড়িয়ে পড়লো তারা।
মিশিকা বললো-
আমাদের জোর করে রেখে কোথাও যাওয়া হচ্ছে এতো সকালে?
.
সায়নী জবাব দিলো-
এখুনি চলে আসবো। দোকানে তোদের জন্য নাস্তা কাল রাতেই অর্ডার করে রেখেছি।
-ওই! নাস্তা সে আমি বানিয়ে খেতে পারি। তোরা কই যাচ্ছিস?
-এসে বলি?
-কোনো সমস্যা?
.
মৃদু হেসে সায়নী বললো-
নাহ।
আসিরে।
.
.
সায়নী ও মুনিরার উপমার কাছে যাচ্ছে। যেভাবেই হোক, উপমার ভুল ধারনা ভাঙাতে হবে তাদের। আরাফ যে বড্ড ভালোবাসে মেয়েটিকে।

-আমি তোমার সাথে আছি, তুমি এদিক ওদিক কি দেখছো?
.
উপমার কথা শুনে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ের দিকে তাকিয়ে আরাফ বললো-
মেয়ে দেখছি।
.
আরাফ যে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে উপমা সেই মেয়েটির দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো-
ওই যে সবুজ শার্ট পরিহিত ছেলে টাকে দেখছো, সে আমার বফ।
.
মেয়েটি খানিকটা বিরক্তিভাব নিয়ে বললো-
তা আমি কি করবো?
-কখনো যদি তোমাকে প্রপোজ করে বসে তাই জানিয়ে দিলাম।
-বিশ্বাস নেই নিজের বফ এর উপর?
-অবশ্যই আছে।
-তাহলে এসব কোন ধরনের আচরণ!
.
পরিস্থিতি ঘোলাটে হবার আগেই আরাফ তাদের মাঝে এসে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বললো-
আসলে আমরা চ্যালেঞ্জ ধরেছিলাম।
.
আবার উপমার দিকে তাকিয়ে আরাফ বললো-
হয়েছে তুমি জিতেছো। চলো এখন।
.
.
কিছুদূর দুজনে এগিয়ে আসার পর উপমার উদ্দেশ্যে আরাফ বললো-
আসলেই তুমি আমাকে বিশ্বাস করোনা?
-তুমিই তো বলেছো মেয়ে দেখছো তুমি।
-এসব তো মজা করে করেছি।
-আমি কিন্তু মজা করিনি। আমি তোমার পাশে কাউকে সহ্য করতে পারিনা এবং পারবোনা।
-করতেও হবেনা।
-কি করে বিশ্বাস করবো! তোমার বাবা তো দুটো বিয়ে করেছে। আমি বুঝিনা তোমার মায়েরা কিভাবে একে অপরকে সহ্য করে!
.
উপমার হাতটা ধরে আরাফ বললো-
আব্বু পরিস্তিতির স্বীকার ছিলো। তাছাড়াএসব দুই যুগ আগে হয়েছে। আমার সাথে এমন কিছু হবেনা। তুমি আমি ঠিক থাকলে সব কিছুই ঠিক। বর্ণমালার ভ দিয়ে, শুধু তোমার ভালোবাসা আর ভরসা দরকার আমার।
.
মৃদু হেসে উপমা তার হাত ধরে বললো-
হুম।
.
.
আগের কথা ভেবে ভেবে আরাফের চোখের কোণায় পানি জমে গেলো।
উপমা তার ফ্যামিলি নিয়ে আগেও এসব বললেও পাত্তা দেয়নি আরাফ।
কিন্তু কাল সে যা যা বললো তাতে খুব বেশিই কষ্ট পেয়েছে আরাফ।
ভালোবাসায় কি সব? যেখানে ভরসা নেই, সম্মান নেই।
বিয়ে মানে তো দুটো মানুষের মিলন না শুধু। দুটো পরিবারেরও মিলন। আর উপমাসহ তার পরিবার আরাফের পরিবার নিয়ে কাল যা যা বলেছে সেসব চাইলেও ভুলতে পারছেনা আরাফ।
.
বিছানা ছেড়ে উঠে সারারুমে পায়চারী করতে থাকলো আরাফ।
এতো কিছুর পরেও সে উপমাকে ভুলতে পারছেনা কেনো!
যে হাত দিয়ে উপমাকে চড় মেরেছে সেই হাতটা দিয়ে দেয়ালের মাঝে ঘুষি দিতে লাগলো আরাফ।
এক পর্যায়ে মেঝেতে বসে পড়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে বললো-
এসব না হলেও পারতো।
.
.
.
রুপা আক্তারের সামনে বসে আছে সায়নী ও মুনিরা।
রুপা আক্তার তাদের খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছেন।
মুনিরার এখানে আসার ইচ্ছে না থাকলেও সায়নীর কথায় আসতে হয়েছে।
যে কারণে এসেছে আদৌ তা সফল হবে কিনা জানেনা।
.
রুপা আক্তারের উদ্দেশ্যে সায়নী বললো-
আমরা কি একটু উপমার সাথে কথা বলতে পারি?
-আমার মেয়ে এতো সকালে ক্লাস না থাকলে ঘুম থেকে উঠেই না।
-আরাফের আম্মুরা এসেছে জানলে নিশ্চয় আসবে সে।
-সেটা জানলে মোটেও আসবেনা।
-বেশি সময় নিবোনা। ৫টা মিনিট কথা বলেই চলে যাবো।
-আপনি বরং ৫সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে চলে যান।
.
মুনিরা গম্ভীর গলায় বললো-
উপমা না আসা পর্যন্ত আমরা যাচ্ছিনা। আপু তো বললোই বেশি সময় নিবো না।
-আহ মুনিরা তুই থাম, আমি কথা বলছি তো।
.
সায়নী ও মুনিরার কথা শুনে রুপা আক্তার বললেন-
-বাহ! একজনের প্রতি আরেকজনের এতো দরদ! সবই লোক দেখানো।
.
সায়নী বললো-
যা ভাবেন। তবে আপনারা ভুল ভাবছেন। আমাদের সাথে যা হয়েছে আরাফের সাথেও হবে কথা নেই। আরাফের জীবনে উপমা ছাড়া কেউ আসবেনা। আমরা গ্যারান্টি দিচ্ছি।
.
সায়নীর কথা শুনে হেসে উঠলেন রুপা আক্তার। হাসতে হাসতেই বললেন-
নিজেদের জীবনের কোনো গ্যারান্টি নেই অন্যের টা নিয়ে কথা বলতে আসছে।
-অন্য মানে কি! আরাফ আমাদের ছেলে।
-ওহ তাই! দুজনের পেটেই নিশ্চয় থাকেনি সে। আরাফের আসল মা কে?
.
মুনিরা জবাব দিলো-
আমরা দুজনেই।
-আপনাদের যে লজ্জা নেই এই বিষয়ে আমি আগেই অবগত হয়েছিলাম। কিন্তু আমার ভাবনার বাইরে নির্লজ্জ আপনারা। নাহলে কাল এতো কিছুর পরেও কিভাবে এখানে আসতে পারেন!
.
সায়নী দাঁড়িয়ে বলে উঠলো-
আপনার সাথে এতো কথা বলে লাভ নেই। আমি উপমার সাথেই কথা বলে যাবো।
.
কথাটি বলেই সায়নী চেঁচিয়ে ডাকতে থাকলো উপমার নাম ধরে।
সায়নীর ডাক উপমার কানে আসতেই এগিয়ে এলো সে ড্রয়িং রুমের দিকে। জেগেই ছিলো সে। তবে আরাফের মায়েরা এসেছে তা জানতো না।
সায়নী ও মুনিরাকে দেখে চিনতে দেরী হলোনা উপমার।
আরাফের কাছে অনেক ছবি সে দেখেছে তাদের।
তবে আজ তাদের সামনাসামনি দেখতে পেয়ে মনের ভেতরে পুষে থাকা রাগ সব বেরিয়ে আসছে।
কাল এদের জন্যই আরাফ তার বাবা মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করেছে। শুধু এটা করেই সে ক্ষান্ত হয়নি। তার গায়ে হাত তুলেছে আরাফ। শুধুমাত্র এই মহিলাগুলোর জন্যই।
উপমা দাঁতে দাঁত চেপে রাগে গিজগিজ করে বললো-
অভদ্রের মতো এভাবে চেঁচামেচি করছেন কেনো?
.
মুনিরা এগিয়ে এসে বললো-
তুমি কতোটা ভদ্র সেটা প্রথম দেখাতেই বুঝে গেলাম।
-আমার বাসায় এসে আমাকেই ভদ্রতা শেখাচ্ছেন?
.
মুনিরার উদ্দেশ্যে সায়নী বললো-
মুনিরা আমাকে কথা বলতে দে।
.
উপমার দিকে তাকিয়ে ছলছল নয়নে সায়নী বললো-
আমাদের ছেলেটা তোমাকে বড্ড ভালোবাসে। আমাদের নিয়ে যে ভাবনা টা তোমাদের হয়েছে তা পরিবর্তন করতে পারবোনা। কিন্তু আরাফের জীবনে এমন কিছুই হবেনা বিশ্বাস করো। আমরা সবাই তোমার কথা জানি। মেনেও নিয়েছি। তুমি ভালো থাকবা।
.
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে উপমা বললো-
আপনাদের মানা না মানাতে আমার কিছু এসে যায়না। আমার এসে যেতো আরাফ কে নিয়ে। কিন্তু কাল সে প্রমাণ করে দিলো, সেও তার পরিবারের লোকের মতোই হবে। নাহলে কেনো সে কাল আমার মা বাবার কথা হজম করতে পারেনি! উল্টো আমার বাড়িতে থেকে আমার মা বাবার সামনেই আমার গায়ে হাত তুলেছে সে।
-ভুল করেছে উপমা। সামান্য ভুলের জন্য সম্পর্ক নষ্ট করার কোনো মানে হয়?
-আপনাদের মতো অসহায় পরিবারের মেয়ে নয় যে আমি এই ফালতু সম্পর্ক টা ধরে রাখতে হবে আমাকে। আসলে অসহায় বললে ভুল হবে। নষ্ট ফ্যামিলি একটা।
.
সায়নীর উদ্দেশ্যে মুনিরা বললো-
আপু চলো এখান থেকে। যে বুঝেনা তাকে হাজার বুঝিয়েও পারবেনা। একদিন আমাদের অবস্থায় সে পড়বে। সেদিন বুঝবে ভালোবাসা কি আর পরিস্থিতি কি।
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সায়নী বললো-
হুম তবে সেদিন হয়তো অনেকটা দেরী হয়ে যাবে।
.
.
.
সারারাত টা অস্থিরতায় কেটেছে মেহেনুবার।
তার এতোটা খারাপ কেনো লাগছে নিজেরই বোধগম্য নয়।
আরাফের কাহিনী শুনেই তার খারাপ লাগছে, না জানি আরাফের উপর দিয়ে কি বয়ে যাচ্ছে।
এটা ভেবে দাঁড়িয়ে পড়লো মেহেনুবা।
তাসু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
মেহেনুবার ইচ্ছে করছে আরাফের কাছে যেতে।
যদিও সকাল সকাল যাওয়া টা ঠিক হবেনা। তবে হোকনা কিছু বেঠিক!
.
.
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই দরজা খুলে দিলো আরাফ।
মেহেনুবাকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে গেলো সে।
মেহেনুবা মৃদু হেসে বললো-
আসতে পারি?
-হুম পারো।
.
ভেতরে এসে চেয়ার টেনে বসলো মেহেনুবা।
আরাফ বিছানার উপরে বসতে বসতে বললো-
হঠাৎ কি মনে করে?
-চোখ লাল করে কি লাভ?
.
মেহেনুবার প্রশ্নে চোখ জোড়া কচলাতে কচলাতে আরাফ বললো-
রাতে ঘুম হইনি তো।
-উপমাকে একটা ফোন করলেই পারতে।
.
মেহেনুবার কথা শুনে চমকালো আরাফ।
আরাফ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেহেনুবা বললো-
কাল তোমাদের কথা আড়াল থেকে সব শুনেছি আমি। সরি, এটা আমার উচিত হয়নি।
.
মেহেনুবার কথা শুনে আরাফ বললো-
এতোকিছু ঘটে যাচ্ছে আমার জীবনে, এটা আর এমন কি!
-কষ্ট যখন পাচ্ছোই রাগ, অভিমান করে লাভ কি? আমার মনেহয় তোমার বাসা থেকে ওখানে কেউ গেলেই ভালো হয়। হয়তো বাসার কারো সাথে কথা বললে সবটা ঠিক হয়ে যেতে পারে।
-কাল ওদের সবার চোখে আমি যে হিংস্রতা দেখেছি তা তোমরা দেখোনি। এখান থেকে ওখানে কেউ গেলে অপমান ছাড়া কিছু হবেনা।
.
বলতে বলতেই ফোন বেজে উঠলো আরাফের।
উপমার ফোন দেখে মেহেনুবার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো-
উপমার ফোন!
.
মুখে হাসি ফুটিয়ে মেহেনুবা বললো-
নিশ্চয় ভুল বুঝতে পেরে ফোন দিয়েছে। রিসিভ করো।
.
আরাফ রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কর্কশ কণ্ঠে বললো-
নাটকের শেষ নেই। নাটক করতে আবার আমার বাসায় মা দের পাঠিয়েছো। লজ্জা করেনা তোমার?
.
উপমার কথার কিছুই আরাফ বুঝতে পারলোনা।
সে জিজ্ঞেস করলো-
কি বলছো তুমি কিছুই বুঝলাম না।
-বুঝোনা নাকি ভান করো! এতোটা নির্লজ্জ তোমরা জানা ছিলোনা আমার। তোমার মায়েদের যে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিইনি এটাই বেশি বলো।
.
দাঁতে দাঁত চেপে আরাফ বললো-
আমার আম্মুরা ওখানে যাবে জানলে কখনো যেতে দিতাম না। আর তোমার জন্য একটু আগেও আমার খারাপ লাগা কাজ করছিলো। এখন থেকে সেটাও আর হবেনা। ভাগ্যিস কথা গুলো তুমি ফোনের ওপাশ থেকে বলেছো। সামনে থাকলে আজ আরেকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতাম।
.
কথাটি বলেই আরাফ লাইন কেটে উপমার নাম্বার ব্লক লিস্টে করে দিলো।
মেহেনুবা চিন্তিত স্বরে বললো-
কি হয়েছে?
-আম্মুরা ওখানে গিয়েছিলো তাদের বোঝাতে। তারা নাকি অপমান করেছে আম্মুদের। এটা আবার আমাকে ফোন করেও বলছে! কাকে ভালোবেসেছি আমি! এই উপমাকে! তুমি আরো বলছো এখান থেকে ওখানে কেউ গেলে বোঝালে তারা বুঝবে! আরে যারা বুঝেনা তাদের শত বুঝিয়েও বোঝানো যাবেনা।
-তুমি মাথা ঠান্ডা কতো আরাফ। সব ঠিক হয়ে যাবে।
.
মেহেনুবা দেখতে পেলো আরাফের হাতটা লাল হয়ে আছে।
নিশ্চয় নিজের হাতে নিজেই আঘাত করেছে এই ছেলে।
আরাফের উদ্দেশ্যে মেহেনুবা বললো-
নিজের শরীরের ক্ষরি করছো দেখলে আন্টিরা কষ্ট পাবে। এমন টা আর করোনা।
.
হাতের দিকে তাকিয়ে আরাফ বললো-
হু।
.
.
.
প্রায় ৩০মিনিট পরে
সায়নী ও মুনিরা বাসায় ফেরার পর, আফরান তাদের কাছে সবটা শুনে হতাশ হয়ে পড়লো। তারা যতো যাই বলুক না কেনো, তাদের জন্য তার ছেলের আজ এই অবস্থা।
আফরান এগিয়ে গেলো নিজের ছেলের রুমে।
নক না করেই ভেতরে এসে বললো-
আরাফ?
.
শান্ত গলায় আরাফ বললো-
ওহ তুমি আব্বু!
-কাকে আশা করেছিলি?
-আম্মুদের।
.
আফরান তার পাশে বসে বললো-
আমি সবটা জানি।
.
অবাক হলোনা আরাফ। তার মায়েরা যে বাবাকে সবটা জানাবে জানা ছিলো তার।
আরাফ মাথা নিচু করে বসে বাবার উদ্দেশ্যে বললো-
আমার জন্য তোমাদের এতো কথা শুনতে হয়েছে।
-আমাদের জন্য তোর সম্পর্ক টা ভাঙলো।
-না আব্বু! তোমাদের জন্য নয়।
-আমি সবটা শুনেছি। তবে আমি এক্সপেক্ট করেছিলাম যে উপমা তোর সাথে
থাকবে, তোকে সাপোর্ট দিবে। ভালোবাসা তো এমনটাই হওয়া উচিত তাইনা?
-আমি ওকে ভুলে যেতে চাই আব্বু। ভুলে যেতে চাই।
.
আরাফ কে এভাবে দেখতে পারছেনা আফরান। সে বেরিয়ে গেলো রুম ছেড়ে।
একটু পরেই মেহেনুবা আরাফের দরজার সামনে এসে বললো-
আসবো?
-হুম।
.
আরাফের পাশে এসে মেহেনুবা বললো-
কাউকে মন চায়, এর মানে এই নয় যে তার সাথেই থাকতে হবে। কখনো কখনো মনের সাথে যুদ্ধ করে হলেও দূরে সরে যাওয়াই শ্রেয়। কেননা জীবনটাকে কোনো একজন ভুল মানুষ বা ভুল একটা জায়গায় থামিয়ে রাখা একেবারেই অনুচিত।
আজ উপমা যেটা করেছে সেটা মোটেও ঠিক হয়নি। তোমার সাথে রাগ করা যায় তাই বলে আন্টিদের সাথে এই আচরণ মানা যায়না।
-হুম।
-যা করবে ভেবেই করো আরাফ। এমন কিছুই করবে, যেটা নিয়ে ভবিষ্যতে পস্তাতে না হয়।
.
মেহেনুবা জানেনা সে আরাফকে এসব কথা কেনো বলছে!
তবে একটা মানুষ হিসেবে অন্য একটা মানুষকে সঠিক পরামর্শ দিতে নিশ্চয় কোনো কারণ নিশ্চয় দরকার নেই।
.
.
মেহেনুবা বেরিয়ে যাবার বেশ কিছুক্ষণ পরেই আরাফ এগিয়ে যেতে থাকলো রান্নাঘরের দিকে।
.
সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি এই খেয়াল কারো নেই! এতো হতাশা কিসের সবার!
রান্নাঘরের সামনে যেতেই দেখতে পেলো সায়নী ও মুনিরার সাথে গল্পে মজে আছে মেহেনুবা। শুধু গল্প নয়, তাদের কাজেও সাহায্য করছে সে।
যে সময়ে তার মায়েদের মুখটা ফ্যাকাসে থাকার কথা, সেই সময়ে এই মেয়েটি তাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।
সত্যিই মেহেনুবা আলাদা।
.
.
.
পাবেল বসে আছে ড্রয়িং রুমে। তার পাশে এসে মিশিকা বললো-
তোমার মা বাবাকে দেশে ফিরতে বলো এবার। মেহেনুবার বিয়ের আয়োজন শুরু করে দিবো। আতিক কে তার পছন্দ হয়েছে। এখন শুধু পারিবারিকভাবে বসে সব ঠিক করতে হবে।
.
মৃদু হেসে পাবেল বললো-
আমাদের জামাই আরাফ হলেও মন্দ হতোনা। তাইনা?
-তুমি ই তো ডাক্তার জামাই খুঁজেছো বড় মেয়ের জন্য।
-হুম। তবে এখন মনে হচ্ছে আরাফ হলেও চলতো।
-হতেই পারে।
-কি করে! মেহেনুবার তো একপ্রকার বিয়ে ঠিকই হয়ে গেলো।
-তাসু আছেনা!
-তাসু! সে এখানে বিয়ে করবে?
-আরাফ কে করতেই পারে। আমেরিকান ছেলেদের মতোই স্মার্ট, হ্যান্ডসাম সে।
-মন্দ বলোনি। তবে তাসু রাজি হলেই সায়নী কে বলবে তুমি।
-অবশ্যই। এটা আধুনিক যুগ স্যার।
-প্রেম সব যুগেই ছিলো ম্যাডাম।
.
পাবেলের কথা শুনে হেসে মিশিকা বললো-
বাচ্চাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা কিছুই করবো না। সে হোক তাসু বা আরাফ।

মায়েদের হাসি মুখটা দেখেই যেনো আরাফের পেট, মন সব ভরে গেলো।
সে সোজা এগিয়ে গেলো নিজের রুমের দিকে।
এদিকে আরাফের পছন্দের ভুনাখিচুড়ি রান্না হয়েছে।
অন্যান্য কাজে সায়নীরা সাহায্য করলেও রান্না সম্পূর্ণ মেহেনুবায় করেছে।
মুনিরা একটা চামচ নিয়ে এক চামচ খিচুড়ি খেলো।
সায়নীর দিকে তাকিয়ে সে বললো-
আমাদের মেহেনুবা আমেরিকায় থেকেও এতো ভালো বাঙালী রান্না পারে!
.
মুচকি হেসে সায়নী বললো-
মিশিকার মেয়ে বলে কথা। মিশিকা ডাক্তার হলে কি হবে! সেও সব দিকে পাক্কা।
-হুম মায়ের মতো হয়েছে সে।
.
মেহেনুবার দিকে তাকিয়ে মুনিরা বললো-
এবার এক প্লেট খিচুড়ি নিয়ে আরাফের কাছে যাবে।
-আমি?
-হু তুমি। তার কাছে যাও। আমাদের যেভাবে হাসিয়েছো সেভাবে হাসাবে।
.
মেহেনুবা বুঝতে পারলো মুনিরা কেনো এসব বলছে। তারা গেলেই যে আরাফ হীনমন্যতায় ভুগে। ভাবে তার জন্যই মায়েদের কথা শুনতে হয়েছে। আজ আবার তারা উপমার বাসায় গিয়েছিলো। হয়তো এসব নিয়ে জিজ্ঞাসা করবে বলেই যেতে চাইছেন না তারা।
তাদের উদ্দেশ্যে মেহেনুবা বললো-
ঠিক আছে৷ আমি নিয়ে যাচ্ছি।
.
.
.
মেহেনুবা রুমে আসতেই আরাফ বললো-
আম্মুদের কি বলছিলে যে তারা হাসিতে মেতে উঠেছে?
-তুমি দেখেছো! যাক ওসব মেয়েদের কথা। তোমাকে বলা যাবেনা।
-আচ্ছা!
-হু। দেখি খেয়ে নাও।
.
প্লেটে ভুনাখিচুড়ি দেখেই মেহেনুবার হাত থেকে আরাফ তা নিয়ে খাওয়া শুরু করলো।
কয়েকচামচ খাবার পর আরাফ বললো-
এটা বড় বা ছোট আম্মুর হাতের রান্নার মতো লাগছেনা।
.
মুখটা ফ্যাকাসে করে মেহেনুবা জিজ্ঞাসা করলো-
কেনো? ভালো হয়নি?
-অনেক ভালো হয়েছে। আমি জাস্ট বললাম স্বাদ টা ভিন্ন। মজার মাঝেও ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ আছেনা?
.
মুখে হাসি ফুটিয়ে মেহেনুবা বললো-
তার মানে ভালো হয়েছে!
আমি করেছি।
আন্টিরাও সাহায্য করেছে তবে। উনাদের জন্যই ভালো হয়েছে।
.
আরাফ মৃদু হেসে বললো-
আসলেই ভালো হয়েছে।
.
.
.
আরাফ তার ফোন নাম্বার ব্লক করেছে!
এই ভালোবাসা আরাফের! বড়ই তো মুখে ভালোবাসি ভালোবাসি করতো এই ছেলে, আজ কি হলো!
আপনমনে এসব ভেবে নিজের রুমে হেটে চলেছে উপমা।
দরজার আড়াল থেকে মেয়েকে একবার দেখে নিয়ে, নিজের রুমে এসে স্বামীর উদ্দেশ্যে রুপা আক্তার বললেন-
উপমার মাথা থেকে ওই ফালতু পরিবারের ছেলের নামটা বোধহয় নেমেছে।
.
ফখরুল মোবারক ঠোঁট জোড়া প্রসস্থ করে বললেন-
আসলেই।
-সকালের কান্ড তো তুমি দেখলেনা। কি অপমান টাই না করলো ওই ছেলের মায়েদের উপমা।
-দেখেছি আমি আড়াল থেকে। উপমা সবটা সামলে নিয়েছে বলেই সামনে যাইনি।
-এই সুযোগে মেয়েটার জন্য একটা ভালো ছেলে দেখো।
-হু।
.
.
.
ড্রয়িং রুমে বসে সকলে মেহেনুবার হাতে তৈরী খিচুড়ি খেয়েছে।
আফরান, সায়নী ও মুনিরা তার প্রশংসায় মেতে উঠেছে।
মিশিকা তাদের বললো-
শ্বশুর বাড়ির সকলেই মেয়েটাকে এভাবে ভালোবাসলেই হয়।
.
মিশিকার কথা শুনে সায়নী বললো-
আতিকের মায়ের সাথে একই সাথে আমি শিক্ষকতা করেছি এতো বছর। তাকে আমি চিনি।।মেহেনুবা কে ভালো রাখবে অনেক।
.
সায়নীর দিকে তাকিয়ে পাবেল জিজ্ঞাসা করলো-
আর আতিক?
-আতিক যে পেশায় ডাক্তার সেটা তো সবাই জানি। তার সাথে আমার কয়েকবার দেখাও হয়েছে। ভদ্র, সুন্দর ছেলেটা। সেও মেহেনুবাকে ভালো রাখবে, আমার বিশ্বাস।
-তাহলে কালই তাদের আসতে বলা হোক। আর দেরী কেনো! আতিকসহ তার পরিবারের সকলের সাথে দেখা করে বিয়ের ডেইট ফাইনাল করি?
.
তাসু তাদের দিকে এগিয়ে এসে বললো-
আগে পাত্র তো দেখো।
-মেহেনুবা যেহেতু ভালো লেগেছে বলেছে সেহেতু কথা আগানো ছাড়া আর কিছুই বলার নেই। সায়নী? তারা কাল আসতে চায় কিনা ওটা জানলে ভালো হয়।
.
পাবেলের কথা শুনে সায়নী ডায়েল করলো আতিকের মায়ের নাম্বারে।
-হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ভালো আছেন?
-জ্বী, আপনি?
-ভালো আছি।
-আসলে আমরা চাচ্ছিলাম কাল আপনারা যদি বাসায় আসতেন তাহলে বিয়ের কথা নিয়ে এগুতাম।
-আমার কোনো অসুবিধে নেই। মেহেনুবাকে আতিকের অনেক পছন্দ হয়েছে।
-আলহামদুলিল্লাহ।
-কোথায় আসবো বলেন?
-আমার বাসায়।
-ঠিক আছে। সন্ধ্যে বেলায় আসবো কাল।
.
.
ফোন রাখার পর সায়নীর উদ্দেশ্যে মিশিকা বললো-
এখানে কেনো ঝামেলা করছিস! আমাদের বাসায় করতে পারতাম।
-আরে কিসের ঝামেলা! তোরা দেশে এসেছিস বেড়াবি শুধু।
-হুম বাবার বাড়ির সকলের সাথেও একবার দেখা হয়েছে এখনো। যদিও মা বাবা বেঁচে নেই। তবে ভাই তো আছে। কাল ভাইয়া ভাবীকেও ডাকতে হবে। তাই বলছিলাম…
-কিছু বলতে হবেনা। সব এখানে কর।
.
.
সকলের কথা শুনে তাসু এগিয়ে গেলো উপরের দিকে।
.
উপরে উঠতেই দেখা পেলো আরাফের।
সাদা রঙের একটা টি-শার্ট পরেছে সে।
তাসু দেখেই বললো-
হায়….! এখানে থাকলে ক্রাশ খেতে খেতে মরেই যাবো।
.
ভ্রু জোড়া কুচকে আরাফ বললো-
সরি?
-কিছুনা।
.
বলেই তাসু এগিয়ে গেলো মেহেনুবার কাছে।
.
.
.
তাসুর কাছে সবটা শুনে মেহেনুবা বললো-
বড়রা যেটা ভালো বুঝেছে করছেন।
-তোর কিছু বলার নেই?
-না তাসু। কি বলার থাকবে বল! আতিক ডাক্তার, ভালো ছেলে, দেখতেও সুন্দর। কি বলার থাকবে!
-পারফেক্ট হলেই যে সবার পছন্দ হতে হবে তো কথা নেই তাইনা?
-এসব কেনো বলছিস তুই?
-কারণ আমার মনে হচ্ছে তুই খুশি না।
.
মেহেনুবা কে চুপচাপ দেখে তাসু বললো-
এখানে থাকলে ক্রাশ খেতে খেতে মরেই যাবো বোধহয় আমি।
-কেনো?
-আরাফ কে দেখে দেখে। সামনে পড়লেই ক্রাশ খাই।
-তুই না বলেছিলি ওর জন্য তোর কোনো ফিলিংস নেই?
-নেই তো। ওহ আপু! এটা ক্রাশ ক্রাশ, নট লাভ! কয়বার বলবো!
.
মেহেনুবা বিড়বিড় করে বললো-
বুঝিনা বাপু এতো কিছু।
.
.
.
সায়নী ও মুনিরা আরাফের রুমে আসতেই আরাফ তাদের উদ্দেশ্যে হাসিভরা মুখ নিয়ে বললো-
খিচুড়ি টা সেই হয়েছে। মেহেনুবা দেখছি ভালোই রান্না পারে।
.
আরাফকে হাসিমুখে দেখে সায়নী ও মুনিরার ও যেনো শান্তি লাগছে মনে। তারা আর উপমার বিষয়ে কথা তুললো না। ছেলের সাথে গল্প করতে লাগলো অন্য বিষয় নিয়ে।
.
.
.
খান বাড়ির সদস্যদের যেখানে হতাশায় থাকার কথা, মেহেনুবাদের আগমনে পুরো বাড়ি গমগম করছে।
আরাফও হাসিখুশি রয়েছে। কাল আতিকের পরিবার আসবে বলে নানাকাজে সায়নীদের সাহায্য করছে সে।
মানুষের ভীড়ে ও কাজের ফাঁকে সে নিজের কষ্টটা আড়াল করতে চাইছে।
এদিকে সায়নী ও মুনিরা বিশাল আয়োজন করছে।
এই আয়োজনের মাঝে নিজেদেরও মনটা হালকা হবে।
সব কিছু দেখে মেহেনুবার মনে হচ্ছে কাল তার বিয়ের তারিখ ঠিক হবেনা। বরং কাল তার বিয়েই।
সকলেই মহাখুশি।
তবে তার কেনো এমন অস্থির লাগছে!
আতিক তো সবদিক থেকেই পারফেক্ট। তারপরেও তার মনে কিসের এতো অস্থিরতা কাজ করছে!
ভাগ্য বিশ্বাস করে কি ভুল করতে যাচ্ছে সে!
.
.
.
আরেকটা রাত কেটে গেলো….
সকাল সকাল ঘুম ভেঙে ড্রয়িং রুমে বসলো আফরান।
টেবিলের উপর থেকে পত্রিকাটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে সে।
হঠাৎ চোখ পড়লো একটা শিরোনামে।
শিরোনামের নিচে আতিকের ছবিটি দেখে চিনতে কষ্ট হলোনা আফরানের। আফরান তাকে আগেও দেখেছে।
তবে এখন এটা কি দেখছে সে! এটা তো হবার ছিলোনা!
সায়নীর উদ্দেশ্যে আফরান চেঁচিয়ে বলে উঠলো-
সায়নী এদিকে এসো।

কিডনি পাচারকারীর সাথে যুক্ত আতিক। কাল রাতেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সে স্বীকারও করেছে তার অন্যায়!
এমন একটা খবর শুনে সায়নী যেনো বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গেলো।
আতিকের মা একজন আদর্শ শিক্ষিকা। আর তার সন্তান হয়ে আতিক কিনা রোগীদের নিয়ে ব্যবসা করে চলেছিলো!
নিজের রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে আতিকের মায়ের নাম্বারে ডায়েল করলো সায়নী।
বেশ কয়েকবার রিং হবার পরে, একপর্যায়ে রিসিভ করে ওপাশ থেকে কান্নাজড়িত কন্ঠে আতিকের মা বললেন-
আমি জানি আপনি কেনো ফোন দিয়েছেন।
-পত্রিকা তে আতিক কে নিয়ে যা দেখছি তা কি ঠিক? নাকি কোনো ভুল বুঝাবুঝি বা আতিক কে কেউ ফাসাচ্ছে?
-এমনটা হলে আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হতোনা। আজীবন সৎ পথে চলেছি কিন্তু ছেলেটা যে এমন জঘন্য পথে চলে যাবে ভাবতে পারিনি।
-আতিক নির্দোশও হতে পারে।
-কাল বাসায় পুলিশ আসার পরে সে নিজেও তাদের বলছিলো, সে কোনো অন্যায় করেনি। কিন্তু আমি যখন ওর হাতটা আমার মাথায় রেখে কসম করে সত্য কথা বলতে বলি তখন সে আর মিথ্যে বলতে পারেনি।
.
সায়নী তার কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো।
আতিকের মা আবার বললেন-
বড় আশা করে ছেলেটাকে ডাক্তার বানিয়েছিলাম, মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকবে বলে। আর সে কিনা…..
কেনো সে আমার গর্ভেই জন্ম নিয়েছে!
.
আতিকের মা কে শান্তনা দেয়ার ভাষা নেই সায়নীর। তবুও তাকে শান্ত হতে বলে ফোনের লাইন কেটে বিছানার উপরে বসে পড়লো সে।
আফরান এতক্ষণ সায়নীর পাশেই ছিলো। সায়নীর দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞাসা করলো-
সবটা সত্যি?
-হ্যাঁ।
বিশ্বাস করতে যদিও কষ্ট হচ্ছে কিন্তু সবটা সত্যি।
.
আফরানও সায়নীর পাশে বসে শান্ত ভঙ্গিতে বললো-
মিশিকারা ডাক্তার ছেলে পেয়েছে বলে কতোই না খুশি ছিলো।
.
ছলছল নয়নে আফরানের দিকে তাকিয়ে সায়নী বললো-
এখন কি জবাব দিবো আমি! অনেক আগে আমি পাবেল কে আশা দিয়ে ঠকিয়েছিলাম আর আজ তার মেয়েকে! পাবেল আমাকে ক্ষমা করতে পারবে?
-তখন তুমি পরিস্থিতির শিকার ছিলে আর আজ যা হয়েছে তাতে তোমার কোনো ভুল নেই। আতিকের মা-ই যেখানে নিজের ছেলেকে চিনতে পারেনি, তুমি কি করে চিনবে!
-যদি ভুল বুঝে আমাকে! ভয় করছে আফরান।
.
সায়নীর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় মুষ্টিবদ্ধ করে আফরান বললো-
নির্ভয়ে তাদের সবটা জানাও। কিচ্ছু হবেনা।
.
.
.
বাড়ির সকল কে ড্রয়িংরুমে ডেকে আতিকের ব্যাপারে সবটা জানালো সায়নী।
সে তার মাথাটা নিচু করে সকলের উদ্দেশ্যে বললো-
আমি আসলে জানতাম না আতিক এমন হবে। আমার জন্য আগেও..
.
কথাটি বলেই থেমে গেলো সায়নী।
মিশিকা তার দিকে এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বললো-
তোর জন্য কি? পাবেলের মন ভেঙেছে?
.
সায়নীর সাথে সকলেই নিশ্চুপ থাকলেও পাবেল বললো-
মিশিকা এসব কেনো তুলছো!
.
মিশিকা ফিক করে হেসে বললো-
আরে সায়নীর মুখটা দেখো কেমন হয়েছে!
.
সায়নীর হাত ধরে মিশিকা বললো-
তোর জন্যই কিন্তু আমি পাবেল কে পেয়েছি আর পাবেল আমাকে। আমরা অনেক ভালো সময় কাটিয়েছি দুজনে। হুম, পাবেল প্রথমদিকে একটু দূরে দূরে থাকলেও এক সময় সবটা ঠিক হয়ে যায়। একে অপরকে ভালোবেসেছি আমরা। তবে কি জানিস? পাবেল কখনো তোকে দোষারোপ করেনি, তোর জন্য আফসোসও করেনি। তোর অবস্থাটা বুঝেছে আগে আর পরে তোর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলো। কেনো বল তো?
.
মৃদু হেসে সায়নী বললো-
তোকে যে সে পেয়েছে।
-হ্যাঁ।
-কিন্তু মিশিকা? মেহেনুবা তো আতিক কে পছন্দ করেছিলো।
-তাই বলে ওই খারাপ ছেলের সাথেই ওর থাকতে হবে! বিয়ের আগে সবটা ক্লিয়ার হয়েছি এটাই যথেষ্ট নয় কি!
-আমি সেটা বোঝাচ্ছি না। মেহেনুবা যদি আতিক কে ভালোবেসে থাকে, তবে সে তার সত্যিটা জেনে কষ্ট পাচ্ছে।
.
মেহেনুবা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তাসু ও আরাফের মাঝখানে।
তার সামনে এসে মিশিকা বললো-
তোর জন্য ছেলের অভাব হবেনা মেহেনুবা। ওই ছেলেকে ভুলে যা তুই। ভালোবাসিস বলে এতবড় অন্যায় কে প্রশ্রয় দেয়ার মানে হয়না।
.
শান্ত গলায় মেহেনুবা বললো-
আমি আতিক কে পছন্দ করতাম, ভালোবাসতাম না আম্মু। বিয়ের পরেও ভালোবাসা যায় এটা তো তোমাদের দেখেই শেখা। আর আমি ভাগ্য বিশ্বাস করি। তাই বিয়ের আগেই এসব প্রেম বা ভালোবাসার মায়ায় জড়াতে চাইনি। আজ তার ফল পেলাম। আতিক কে ভালোবাসলে হয়তো কষ্ট পেতাম আমি। এখন পাচ্ছিনা।
.
সায়নীর দিকে তাকিয়ে মেহেনুবা বললো-
আন্টি আপনি একেবারেই মন ছোট করবেন না। আপনি তো আমার ভালোর জন্যই ডাক্তার ছেলে ঠিক করেছিলেন। তবে সময় থাকতেই যে সব সত্যি প্রকাশ পেয়েছে এটাই অনেক।
.
সায়নী মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো-
হুম। তবে তুমি ভালো ছেলে পাবে। ভালো ডিসার্ব করো বলেই আতিকের সত্যিটা প্রকাশ হয়ে গেলো।
.
তাসু দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে বললো-
আমার কিন্তু ওই আতিক ব্যাটারে পছন্দ ছিলোনা। ভালোই হলো যা হয়েছে। তার ছবি দেখে কোনো ক্রাশ ক্রাশ ভাব আসেনি।
.
তাসুর কথা শুনে আরাফ হেসে বললো-
সে এতোবড় একটা ক্রাইম করেছে আর তুমি আছো ক্রাশ ভাব নিয়ে?
-হু! ক্রাশ ভাবটা থাকলে অন্তত মায়া হলেও লাগতো।
-মায়া লাগার জন্য ক্রাশ!
.
উচ্চশব্দে হেসে উঠলো আরাফ। তার সাথে যোগ দিলো উপস্থিত সকলেই।
.
.
.
-আচ্ছা আরাফ? তোমার কেমন মেয়ে পছন্দ?
.
উপমার কথা শুনে আরাফ জবাব দিলো-
তোমার সাথে যেহেতু প্রেম করছি তোমাকেই পছন্দ।
-তার মানে আমার মতো মেয়ে পছন্দ?
-হু।
-আমার কোন জিনিসটা তোমার খুব ভালো লাগে?
-এই যে তুমি আমার পাশে কাউকে সহ্য করতে পারোনা। ধমক দাও। এটাই ভালো লাগে।
-কিন্তু অন্য কোনো ছেলে হলে এটাকে প্যারা মনে করতো।
-আমি মনে করছি এটা ভালোবাসা। স্রেফ ভালোবাসা।
-আর যে ধমক গুলো দিই এটাও ভালোবাসা?
-হু। আদর মিশ্রিত ভালোবাসা।
.
আরাফের হাতটা শক্ত করে ধরে উপমা বললো-
ভালোবাসি তোমাকে অনেক বেশি।
.
.
আগের কথা ভেবে বুক চিরে দীর্ঘ একটা শ্বাস বেরিয়ে আসলো আরাফের।
মুখে ভালোবাসি বললেই যে ভালোবাসা হয়না এটা আজ সে হারে হারে উপলব্ধি করতে পারছে।
তবুও যেনো মন মানেনা! ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে সেই উপমার কাছেই। কেননা তার ভালোবাসা তো আর মুখের ভালোবাসা, মিথ্যে অভিনয় বা কোনো মোহ ছিলোনা। মন থেকেই ভালোবেসেছিলো সে উপমাকে। আর সে কিনা….
দাঁড়িয়ে পড়লো আরাফ।
হাটতে লাগলো সারারুমে। কি করলে উপমার কথা তার আর মনে পড়বেনা!
.
-আসবো আরাফ?
.
মুনিরার ডাকে তার দিকে তাকিয়ে আরাফ বললো-
হুম ছোট আম্মু আসো।
.
আরাফের পাশে এসে মুনিরা বললো-
মেহেনুবা যতো যাই বলুক। তার মন টা যে ছোট হয়ে আছে এটা আমি বুঝতে পারছি।
-ওহ।
-ওরা দেশে এসেছে আজ কতোদিন! অথচ তুই ওদের নিয়ে কোথাও ঘুরতে বের হলিনা। এটা কি ঠিক হচ্ছে?
-আমি কেনো?
-বারেহ! তোর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কিন্তু এটা। তোর বড় আম্মুর মেহমান তারা। তাদের দেখভাল করলে বড় আম্মু কতোটা খুশি হবে ভেবে দেখেছিস? তাছাড়া মেহেনুবার মনটাও হালকা হবে।
.
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আরাফ বললো-
ওদের তৈরী হতে বলো। একটু পরেই বেরিয়ে যাবো। দুপুরের খাবারও বাইরে খাবো।
-ঠিক আছে।
.
.
.
রান্নাঘরে সায়নীর কাছে এসে মুনিরা বললো-
বাচ্চারা আজকে বাইরে দুপুরের খাবার খেয়ে আসবে।
-কোন বাচ্চারা?
-আরাফ, মেহেনুবা, তাসু।
.
অবাক চোখে তাকিয়ে সায়নী জিজ্ঞাসা করলো-
আরাফ যাচ্ছে?
-মায়েদের কথা ফেলতে পারবে নাকি!
-তুই বলেছিস যেতে?
-হুম। আরাফের মনটাও ফ্রেশ হবে।
.
সায়নী ভ্রু জোড়া কুচকে বললো-
আমার মনে হচ্ছে অন্য মতলব আছে তোর?
-তোমার থেকে কি লুকোবো! আসলে এই সুযোগে মেহেনুবা বা তাসুর সাথে আরাফ ক্লোজ হলেই হয়। উপমার ভুতটা মাথা থেকে নামলেই বাঁচি।
.
সায়নী মৃদু হেসে বললো-
তুই না পারিসও! প্রেম করিস নি কিন্তু টেকনিক সব জানিস।
-সবই বাংলা সিনেমার অবদান আপু।
.
কথাটি বলেই হেসে উঠলো মুনিরা। তার সাথে যোগ দিলো সায়নীও।
.
.
.
-তোমার হাতটা এভাবে ঘামছে কেনো উপমা?
.
আরাফের কথা শুনে উপমা বললো-
তুমি এভাবে ধরে আছো তাই।
-ব্যথা লাগছে না?
-উহু না! ভালো লাগা কাজ করছে। আরো শক্ত করে ধরো।
.
আরাফ তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। উপমা মৃদু হেসে বললো-
সুপার গ্লু দিয়ে যদি লাগিয়ে দিতে পারতাম এই দুই হাত!
-তুমি চাইলে পুরো শরীর টাই লাগিয়ে নিতে পারো।
-আসো, লেগে লেগে বসি।
-এই যে এটা রেস্টুরেন্ট! এতোটা লাগা লাগি করলে কিন্তু মানুষের চোখে পড়বে।
-পড়লে পড়ুক! আমার কি।
-এতো সাহস?
-সাহসের কি দেখেছো! আমি চাইলে সবার সামনে তোমাকে…
-থেমে গেলো কেনো! কি?
.
আরাফের মাথায় আলতো করে হাত ছুইয়ে উপমা বললো-
মারতেও পারি।
-ওহ! আমি তো ভেবেছি…
-কি?
-না কিছুনা।
.
মুখ টিপে হেসে চলেছে উপমা। তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আরাফ।
.
.
-কি খাবেন আপনি?
.
রোমানের প্রশ্নে ঘোর কাটলো উপমার। এতক্ষণ আরাফের সাথে কাটানো মুহুর্তের কথা ভেবে চলছিলো সে।
হালকা কেশে উপমা জবাব দিলো-
জাস্ট কোল্ড কফি।
.
রোমান হলো উপমার বাবার পছন্দের ছেলে। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার সে।
তার সাথেই বিয়ে দিতে চায় বাসার সকলেই। আজ প্রথমবারের মতো উপমা তার সাথে দেখা করতে এসেছে।
.
.
বেশকিছুক্ষণ পর উপমা খেয়াল করলো একই রেস্টুরেন্ট এ দুটো মেয়ে নিয়ে প্রবেশ করছে আরাফ।
তাকে ব্লক করে মেয়েদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসা হচ্ছে!
ভাবতেই শরীরটা জ্বালা করে উঠলো উপমার।
মেহেনুবাদের নিয়ে আরাফ বসলো উপমার ঠিক পাশেই।
বসার পরেই উপমাকে দেখে যেনো থমকে গেলো আরাফ।
তাকে প্রথম দেখাতেই আরাফ চিনে ফেলেছে৷
আজ উপমা শাড়ি পরেছে! এই প্রথমবার শাড়িতে উপমাকে দেখছে আরাফ।
অন্য মেয়েদের মতো শাড়িতে তাকেও দারুণ মানিয়েছে৷ আরাফের ইচ্ছে করছে উপমাকে কাছে ডেকে এনে সামনে বসিয়ে রেখে বলতে-
আমার সামনে বসো তো। শাড়ি পরিহিতা উপমা কে দেখে মনটা জুড়াই।
.
এদিকে আরাফকে দেখার পর রোমানের সাথে গল্প জুড়ে দিলো উপমা।
মুখে হাসি ফুটিয়ে তার সাথে কথা বলে যাচ্ছে সে।
এমন একটা দৃশ্য যেনো আরাফ সহ্য করতে পারছেনা।
রাগে তার মুখটা লাল হয়ে আছে। শরীরে যেনো কাঁপুনি দিয়ে উঠেছে।
মেহেনুবা তার দিকে তাকিয়ে বললো-
সব ঠিক আছে?
.
শান্ত স্বরে আরাফ বললো-
হু। কি খাবে তোমরা অর্ডার করো।
.
তাসু ডাক দিলো ওয়েটার কে।
.
.
বেশ খানিকক্ষণ সময় অতিবাহিত হবার পরে উপমার ফোনটা বেজে উঠলো। মায়ের ফোন এসেছে তার। এগিয়ে গেলো সে বাইরের দিকে।
আরাফও এগিয়ে গেলো তার পিছুপিছু।
.
.
উপমা মায়ের সাথে কথা বলা শেষ করে পেছনে তাকিয়ে আরাফ কে দেখতে পেলো।
তবে সে চমকালো না।
আরাফের দিকে তাকিয়ে বললো-
তুমি এখানে?
-তুমি এখানে কেনো? আর ছেলেটি কে?
-ওর সাথেই আমার বিয়ে সামনে।
.
কথাটি শুনেই যেনো আরাফের বুকে ব্যথা অনুভব হলো।
তার ভালোবাসা অন্য কারো হয়ে যাবে যেনো মানতেই পারছেনা সে।
আরেকটা বার কি চেষ্টা করে দেখবে সে, উপমার ভুল ভাঙাতে?
.
আর না ভেবে উপমার উদ্দেশ্যে আরাফ বললো-
আমাকে ভালোবাসো তুমি?
.
কোনো সংকোচ ছাড়াই উপমা জবাব দিলো-
বাসি।
-তাহলে কেনো এমন করছো তুমি! কি করলে বিশ্বাস করবে, তুমি সুখে থাকবে আমার সাথে?
-এখন আর কিছু করার নেই আরাফ। তুমি আসতে পারো।
-আমি তোমাকে দেখে ঠিক থাকতে পারছিনা উপমা।
-দূরেই থাকো তবে।
-কিছুই কি করার নেই?
-সব তো বেঠিক হয়ে গেলো।
-আমার আম্মুদের কাছে তোমার একটা সরিতেই কিন্তু সব ঠিক হতে পারে। বলবে? আমিও বলবো তোমার ফ্যামিলি কে। একটা বছর এক সাথে সময় কাটিয়েছি আমরা। এতোদিনে একটুও কি আমায় বুঝলেনা তুমি? বিশ্বাস করো ভালো থাকবো আমরা।
.
আরাফের কথার জবাব না দিয়ে উপমা তাকিয়ে রইলো নিচের দিকে।
.
.
.
সায়নী ও মুনিরার সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে মিশিকা।
আড্ডার এক পর্যায়ে মিশিকার উদ্দেশ্যে মুনিরা বললো-
আচ্ছা আপু? আপনি তো অনেক আগে থেকেই বলতেন, সায়নী আপুর ছেলের সাথে আপনার মেয়ের বিয়ে দিবেন। এখন যখন বাচ্চারা বড় হয়ে গেলো এই বিষয়ে আর কিছু বলেন না কেনো? আরাফ কে পছন্দ না আপনার?
.
মুনিরার হঠাৎ এমন প্রশ্নে চমকে গেলো সায়নী।
তবে মিশিকা কিছু না ভেবেই মৃদু হেসে বললো-
আরাফ কে আমার অনেক বেশি পছন্দ। তবে বড় মেয়ের জন্য ডাক্তার আশা করেছিলাম। নিজে ডাক্তার তো।
-ডাক্তার হতে হবে বলে তো কথা নেই তাইনা? আরাফের মতো ছেলে কিন্তু লাখে একটা পাওয়া যাবে।
-অন্তত দুই মায়ের প্রতি সম্মান দেখেই তা বুঝেছি আমি। সত্যি বলতে মেহেনুবার বিয়ে ঠিক হবার পর তাসুর সাথে আরাফ কে নিয়ে ভেবেছি আমরা।
-এখন তো দেখলেনই, ডাক্তার হলেই ভালো মানুষ হয়না। আর মেহেনুবা যেহেতু বড় ওর জন্যই আগে দেখা উচিত নয় কি এখন?
.
সায়নীর দিকে তাকিয়ে মিশিকা জিজ্ঞাসা করলো-
মেহেনুবা কে তোদের পছন্দ?
-হুম। তবে আমি মুনিরাকে এসব বলতে বলিনি। তোদের মেয়ের জন্য তোরাই ভালো বুঝিস।
-তাহলে মুনিরা তোর চেয়ে ভালো। সে যে আমাকে এসব কথা বলেছে আমি খুশিই হয়েছি। কেননা আরাফের চেয়ে ভালো ছেলে মেহেনুবার জন্য হতেই পারেনা।
.
অবাক চোখে তাকিয়ে সায়নী বললো-
সত্যি?
-হুম সত্যি। তবে হ্যাঁ বাচ্চা দুজনের মতামতই কিন্তু নিতে হবে।
.
সায়নী ও মুনিরা একইসাথে জবাব দিলো-
অবশ্যই।
.
মিশিকার কাছে আশ্বাস পেয়ে মুনিরার মনে আশা জন্মালো।
মেহেনুবার মতো একটা মেয়েই যে আরাফের যোগ্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন ভালোই ভালোই সবটা হয়ে গেলেই হয়।
.
এদিকে খুশির সাথে চিন্তায় পড়ে গেলো সায়নী।
মেহেনুবা ও আরাফ একে অপরকে পছন্দ করবে তো?
.
.
.
আরাফ কোনো জবাব না পেয়ে হতাশ হয়ে চলে যাচ্ছে। তবে দাঁড়িয়ে পড়লো সে উপমার ডাকে।
উপমা বললো-
আমি সরি বলতে রাজি আছি।

উপমা খেয়াল করলো, তাদের দিকে এগিয়ে আসছে রোমান।
সে আরাফের উদ্দেশ্যে বললো-
আগে বলো মেয়েগুলো কে?
-ওই যে মেহেনুবা আর তাসু।
-ওহ! রোমান এদিকে আসছে। পরে কথা হবে। আমি চাইনা ও আমাদের সম্পর্কে জানুক।
-ঠিক আছে।
-ব্লক টা খুলে দিও। এবার যাও।
-ভালোবাসি বলো?
-হু বাসি। যাও তো!
.
মুচকি হেসে আরাফ চলে গেলো।
উপমার কাছে এসে রোমান বললো-
আমার একটা কাজ ছিলো। আমাদের বেরুতে হবে। বিল পেমেন্ট করেই এসেছি আমি।
-না করলেও অসুবিধে হতোনা। আমিও করতে পারতাম।
-সরি?
-কিছুনা চলুন। আমাকে ড্রপ করে দিবেন? নাকি এটার সময়ও নেই?
-কি যে বলোনা উপমা! চলো।
.
.
আরাফের মুখে হাসি দেখে মেহেনুবারও যেনো ভালো লাগছে।
আরাফের দিকে তাকিয়ে সে বললো-
তোমাকে এভাবেই ভালো লাগে।
.
আরাফের ইচ্ছে করছে তাকে উপমার কথা বলতে কিন্তু তাসুর সামনে এসব কথা তুলতে তার ইচ্ছে করছেনা। তাই সে মেহেনুবার উদ্দেশ্যে বললো-
মুড ভালো রাখার কারণ পেয়ে গিয়েছি।
.
.
.
মিশিকার মুখে সবটা শুনে পাবেল খুশিই হলো।
আরাফ কে তার ভীষণ ভালো লাগে।
মিশিকার উদ্দেশ্যে পাবেল বললো-
মেহেনুবার জন্য আরাফের মতোই একজন জীবনসঙ্গী দরকার।
যে ছেলে তার মায়েদের এতোটা ভালোবাসতে পারে নিঃসন্দেহে সে তার স্ত্রী কেও ভালোবাসবে।
ভালোই থাকবে আমাদের মেহেনুবা।
.
পাবেলার কথা শুনে মিশিকা বললো-
দুজনে রাজি হলেই হয় এইবার।
-আরে হবে। এতো ভেবোনা তো।
মেহেনুবার সাথে আজই কথা বলবে। দেখেছোই তো? আতিক ডাক্তার হয়েও কেমন! আর আরাফ তো আমাদের ঘরের ছেলেই।
-হ্যাঁ।
.
.
.
আফরান অফিসে। তাকে সবটা ফোনে জানিয়েছে মুনিরা।
আরাফের আপত্তি না থাকলে তারও আপত্তি নেই, এটাই মুনিরাকে জানায় সে।
মুনিরা ফোন রাখতেই তার উদ্দেশ্য সায়নী বললো-
কি মনে হয় তোর? আরাফ রাজি হবে?
-হবে।
-কিভাবে বুঝলি?
-কেননা মেহেনুবা মেয়েটাই এমন।
-আর যদি উপমা তার ভুল বুঝে ফিরে আসে?
-তাহলে আরাফ তাকে মেনে নিবেনা। তার মায়েদের অপমান করেছে সে।
-ভালোবাসায় এসব বিচার করা যায়না মুনিরা।
-তুমি কি বলতে চাইছো আপু? ওই মেয়েটা ফিরে আসলে আরাফ যেনো মেনে নেয় তাকে?
-হুম। যদি সে ভুল বুঝে ফিরে আসে তবেই।
-কিন্তু আমি তো মানবো না! হতে দিবোনা এই বিয়ে। এতোকিছুর পরেও কিভাবে আরাফ ওই মেয়েকে মেনে নিবে!
-আমি কিভাবে আফরান কে মেনে নিয়েছি তোকে বিয়ে করার পরেও?
.
সায়নীর কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো মুনিরা।
সায়নী তার দিকে তাকিয়ে বললো-
ভালোবাসতাম বলে।
-কিন্তু উনি পরিস্থিতির শিকার ছিলেন। তা তুমি বুঝেছিলে।
-আমার মনেহয় আরাফ কে আরেকটু সময় দেয়া উচিত।
পরিস্থিতির শিকার হোক বা দোষ হোক। ভালোবাসার মানুষটাকে এতো সহজে ভোলা যায়না।
-একবার বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার সাথে উনার ঠিক হলোনা?
-হয়েছে তবে আমাকেও কিন্তু ছাড়তে পারেনি ও। প্রথম ভালোবাসা আমি ওর।
দেখ মুনিরা তোকে এসব বলার আমার একটাই কারণ। আরাফের জীবনে আমরা কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারিনা। তুই তাকে মেহেনুবার কথা বলতেই পারিস। কিন্তু জোর করতে পারিস না। উপমার রাগটা কমে নাকি সে অপেক্ষা টুকুও কি আরাফের করার উচিত নয় কি?
-এসব রাগ না আপু। বেয়াদবি।
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সায়নী বললো-
তোর যেটা মনেহয় কর। কিন্তু এই ব্যাপারে আমি পুরোপুরি সাপোর্ট দিবো আরাফের সিদ্ধান্ত কে।
.
.
.
সারাদিন বাইরে ঘুরাঘুরির পরে সন্ধ্যের আগে বাসায় প্রবেশ করলো আরাফ রা।
আরাফ নিজের রুমে এসে ফ্রেশ না হয়েই বিছানায় শরীর টা এলিয়ে দিলো।
মগ্ন হয়ে পড়লো সে উপমার ভাবনায়।
উপমার সাথে পরিচয় টা হয়েছিলো এক বন্ধুর মাধ্যমে। বন্ধুর ফুফাতো বোন উপমা।
প্রথম দেখাতে আরাফের তাকে ভালো লাগে। বন্ধুর মাধ্যমে ফ্রেন্ডশিপ এর প্রপোজাল পাঠালে উপমা এক্সেপ্ট করে।
ফোন নাম্বার আদান প্রদানও হয়।
প্রায় দুই মাস কথা বলতে বলতে দুজনেই উপলব্ধি করতে পারলো, তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছে।
ব্যাস, শুরু হয়ে যায় তাদের প্রেমের সম্পর্ক।
তবে এই এক বছরে এক বারই খুব কাছ থেকে উপমাকে অনুভব করেছে আরাফ।
কয়েকমাস আগে সেই বন্ধুর বাসায় তার জন্মদিনের দাওয়াত পায় আরাফ। উপমাও উপস্থিত ছিলো।
তবে কিছুক্ষণ পর উপমাকে দেখতে পারছেনা আরাফ। খুঁজতে খুঁজতে ডাইনিং রুমের পেছনের বারান্দায় তাকে দেখতে পেলো সে।
উদাসীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে উপমা। বাতাসে চুলগুলো উড়ছে তার।
এভাবে কোনো মেয়েকে এই প্রথম দেখছে আরাফ।
ধীরপায়ে এগিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো উপমাকে।
উপমা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলো-
কে?
-আমার উপমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরার সাহস আর কার আছে?
.
আরাফের কন্ঠ শুনে মৃদু হেসে উপমা বললো-
ওহ তুমি! কি করবো বলো? কখনো তো ধরোনি তাই স্পর্শ টাও চিনছিনা।
-বিয়ের পর মিশে যাবো একেবারে।
-তবে বিয়ের আগেই আমার একটা ইচ্ছে পূরণ করা যায়?
-কি?
-নিজের কপালে তোমার ঠোঁটের ছোঁয়া নেয়ার প্রবল ইচ্ছে আমার।
.
উপমাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে তার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে দিলো আরাফ। তারপর কানের পাশে মুখটা নিয়ে বললো-
শখ পূরণ করে দিলাম। আমার গুলো নাহয় বিয়ের পরেই পূরণ করো।
.
.
-এই কি! ফ্রেশ না হয়ে শুয়ে আছিস কেনো?
.
মুনিরার ডাকে চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলো আরাফ।
উঠে বসলো সে।
সায়নীর সাথে মুনিরা এগিয়ে আসলো আরাফের দিকে।
তার পাশে বসে মুনিরা বললো-
বাহ! ছেলেটাকে আজ হাসিখুশি লাগছে অনেক।
-হুম। তা আম্মুগণ হঠাৎ এখানে?
-বলছি বলছি। আগে হাসিমুখ হবার কারণ কি বল?
-আগে তোমরা কি বলতে এসেছো বলো।
-আমার মনেহয় আমি জানি তোর হাসিমুখের কারণ।
-কি?
-মেহেনুবা।
-মানে?
-ওর সাথে বের হয়ে মুড ফ্রেশ হয়ে গেলো তোর।
-সাথে তো তাসুও ছিলো।
-তবে মেহেনুবা আলাদা।
-হু।
-তাই আমি ভাবছিলাম এই মিষ্টি মেয়েটাকেই ছেলের বউ করবো।
-কোন ছেলে?
-আমাদের ছেলে কয়টা রে?
.
আরাফ অবাক চোখে তাকিয়ে বললো-
এসব কি বলছো তুমি! আমি উপমাকে ভালোবাসি।
-কিন্তু সে তো তোকে ভালোবাসে না। আর আমাদের এতো অপমান করার পরেও এসব কি বলছিস তুই?
-উপমা তোমাদের সরি বলবে বলেছে।
-কবে?
-আজই দেখা হয়েছে উপমার সাথে। তোমাদের বলতাম আমি।
.
এতক্ষণে সায়নী বুঝতে পারলো আরাফের মুখে হাসির ঝলকের কারণ কি।
তবে মুনিরা গম্ভীর গলায় বললো-
সরি তেই সব মিটমাট হয়ে যাবে তুই ভাবলি কি করে! ওই মেয়েকে আমি কখনো ক্ষমা করবো না। আমাদের নিয়ে এতো কথা বললো, অপমান করে তাড়িয়ে দিলো, তোর ভালোবাসার অপমান করলো। তারপরেও তুই এসব বলছিস। আমাদের ভালোবাসিস না তুই?
-বাসি ছোট আম্মু। কিন্তু আমি উপমাকেও ভালোবাসি।
-তুই ওর মেয়ের জালে অন্ধ হয়ে গেছিস। আমি…
.
আর কিছু না বলে মুনিরা চলে গেলো রুম ছেড়ে।
আরাফ সায়নীর কাছে এসে বললো-
উপমা আমার প্রথম ভালোবাসা বড় আম্মু। আমি জানি ও ভুল করেছে। কিন্তু ক্ষমা তো মহৎ গুণ তাইনা?
-হু।
-ও যদি তোমাদের সরি বলে তবেই আমি সম্পর্ক টা আগাবো। আমি জানি ও বলবে। কেননা ও আজ আমাকে ভালোবাসে বলেছে।
-তাহলে আরেকটা সুযোগ দে। তবে উপমাকে নয়, নিজের ভালোবাসা কে। যাতে পরবর্তীতে আর কোনো আফসোস না থাকে। তুই যে সিদ্ধান্ত নিবি নে, আমি তোর সাথে আছি।
-হুম। এবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
-আশা রাখছি।
-কিন্তু ছোট আম্মু?
-রাগ কমলে ঠিক হয়ে যাবে। উপমা যা করেছে রাগ করাই স্বাভাবিক।
.
.
.
-আরাফকে তোর কেমন লাগে?
.
মায়ের মুখে এমন একটা কথা শুনে চমকে গেলো মেহেনুবা।
সে জবাব দেয়ার আগেই তাসু বলে উঠলো-
আমার তো অনেক বেশিই ভালো লাগে।
.
ভ্রু জোড়া কুচকে মিশিকা বললো-
যাকে প্রশ্ন করেছি উত্তর টা সেই দিক না?
.
মেহেনুবা শান্ত স্বরে বললো-
ভালো লাগে।
-আমরা চাচ্ছি আরাফের সাথে তোর বিয়ে হোক। করবি?
.
কথাটি শুনেই যেনো মেহেনুবা বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গেলো।
আর তাসু হাসি ভর মুখ নিয়ে বললো-
এই হ্যান্ডসাম আরাফ, আই মিন মাই ক্রাশ হবে আমার দুলাভাই!
হায়….
এর শালী হতে পেরেই যে ধন্য হয়ে যাবো আমি!
.
মায়ের দিকে তাকিয়ে মেহেনুবা জিজ্ঞাসা করলো-
এসব কি তুমি বলছো? না মানে আন্টি বা আরাফ জানে?
-আরেহ! সায়নীরা রাজি। তারা রাজি মানে আরাফও রাজি। এখন তোর টা বল।
-তারা রাজি মানে আরাফও রাজি না। আমার আরাফের মত টা দরকার।
-তুই তোর টা তো বল?
-আরাফ যদি চায়, আমার আপত্তি নেই।
.
মেহেনুবার জবাব শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে তাসু বললো-
তার মানে আরাফ কে তুই পছন্দ করতি তাইতো কিছু না ভেবেই হ্যাঁ করে দিলি।
-এসব কিছু না। তুই তো জানিসই এসবে আমি বিশ্বাস করিনা।
.
মিশিকা হেসে বললো-
ওরে থাম তোরা! আরাফ এমনই একটা ছেলে। তাকে পছন্দ না করে উপায় আছে! আমি সায়নীকে জিজ্ঞাসা করে আসি, আরাফ কি জানালো।
.
.
মেহেনুবা জানেনা আরাফ কি বলবে।
উপমার দেয়া আঘাত যে আরাফ ভুলতে পারেনি জানে সে।
এতো সহজে অন্য একটা সম্পর্কে আবদ্ধ হতে রাজি হবে তো আরাফ?
আর সে নিজেই বা এতোকিছু জানার পরেও কেনো রাজি হয়ে গেলো!
তাহলে তাসুর কথাই কি সত্যি!
আরাফ কে সে আগে থেকেই পছন্দ করতো?
.
.
.
ব্লক লিস্ট থেকে উপমার ফোন নাম্বার টা সরিয়ে তাকে ফোন দিলো আরাফ।
-হ্যালো?
-উপমা শুনছো? ব্লকটা আমি খুলে দিয়েছি।
.
মুচকি হেসে উপমা বললো-
সেটা তোমার ফোন দেখেই বুঝেছি।
-কাল আসবে আমাদের বাসায়? আম্মুদের বলবে তুমি, তোমার ভুল বুঝতে পেরেছো।
-সরি বলতে আসবো আমি।
-আমি জানতাম, আমার উপমা বেস্ট।
-হু। তার আগে তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
-বলো?
-এভাবে নয়। কালই বলবো। তোমার বাসায় আমাকে নেবার জন্য এখানে আসবেনা তুমি?
-তুমি বললে আসবো। আঙ্কেল আন্টিকে সরিও বলে আসবো।
-ঠিক আছে। তাহলে কাল দেখা হচ্ছে। এখন রাখছি।
.
.
.
মুনিরার রুমে এসে সায়নী বললো-
আরাফ যা চায়ছে তা কিন্তু অযৌক্তিক নয়। আমি তোকে বলেছিলামও, উপমা ফিরে আসলে…
-আমাকে কিছু বুঝিয়ে লাভ নেই আপু। আমি উপমা কে কখনো ক্ষমা করবোনা।
-আরাফের কথাটাও ভাববি না তুই?
-ও ভাবছে আমাদের কথা!
.
-তোরা এখানে? আমি সারা বাড়ি খুঁজছি।
.
মিশিকার প্রশ্ন শুনেই সায়নী বুঝতে পারলো, তাদের কথপোকথন সে শুনেনি।
সায়নী তার দিকে তাকিয়ে বললো-
ভেতরে আয় মিশি।
.
ভেতরে এসে তাদের উদ্দেশ্যে মিশিকা বললো-
মেহেনুবা রাজি হয়েছে। তবে বলেছে আরাফ চায়লেই এই বিয়ে হবে।
.
মুনিরা হাসিমুখে বলে উঠলো-
ওমা তাই!
আমাদের আরাফও রাজি। কেনো চায়বেনা আরাফ! আমার কথা ঠিক শুনবে।
-বলেছো ওকে?
.
মুনিরাকে কিছু বলতে না দিয়ে সায়নী বললো-
আসলে আরাফের এখুনি বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলোনা। আগে বাবার সাথে কাজে হাত লাগানোর ইচ্ছে আছে। তাই ভাবছিলাম যে, ছেলেটা আগে কাজে জয়েন করে নিক তারপর নাহয় বলবো।
-উহু সায়নী! জয়েনের সাথে পছন্দ অপছন্দের সম্পর্ক কি! আচ্ছা আমি নিজেই যাচ্ছি আরাফের কাছে। এতোটুক অন্তত ফ্রি আমি ওর সাথে।
.
তার পথ আটকে মুনিরা বললো-
আরাফ ঘুমোচ্ছে এখন। উঠলেই আমি জিজ্ঞাসা করবো। তবে ধরে রাখুন আপু, মেহেনুবা আর আরাফের বিয়েটা হবেই।
.
.
.
অবশেষে কাল ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটতে যাচ্ছে।
উপমাকে নিজের করে পাবে আরাফ, ভাবতেই মনে ভালো লাগা কাজ করছে তার।
তার ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে।
কিন্তু তার ছোট আম্মু মেনে নিবে তো উপমাকে?
আর বড় আম্মু তো তার সিদ্ধান্ত কেই মেনে নিবে বলেছে।
এসব ভাবতেই বুকটা ধুক করে উঠছে আরাফের।
তার জন্য দুই মায়ের মাঝে আবার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে না তো!
.সকাল ১১টা….
উপমার মা বাবার সামনে বসে আছে আরাফ।
উপমার ভরসায় সে আজ এখানে এসেছে।
উপমার মা বাবা আরাফের ঠিক সামনেই বসে আছে। তাদের পাশেই রয়েছে উপমা।
যদিও তাদের আরাফের মুখ দেখারও ইচ্ছে ছিলোনা তবে উপমার আবদার রাখার জন্যই এসেছে তারা।
আরাফ শান্ত ভঙ্গিতে তাদের উদ্দেশ্যে বললো-
সেদিনের ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত।
.
ফখরুল মোবারক কিছু না বলে চলে গেলেন। আর রুপা আক্তার আরাফের দিকে তাকিয়ে বললেন-
একমাত্র মেয়ে উপমা আমার। ও যা চায় আমরা তাই করবো। কিন্তু মন থেকে তোমাকে বা তোমার পরিবার কে আমরা মানতে পারবো না। সেই তুমি পায়ে ধরে ক্ষমা চায়লেও।
.
উপমার দিকে তাকিয়ে রুপা আক্তার বললেন-
তুই কি করতে চাইছিস আমি জানিনা। কিন্তু মনে রাখিস, এই ছেলে কখনো তার মায়েদের চেয়ে বেশি তোকে দাম দিবেনা।
সেদিন থাপ্পড় একটা মেরেছিলো। মায়েদের প্রশ্রয়ে বারবার মারবে। এক শ্বাশুড়ীর জ্বালায় থাকতে পারতাম না। দুইটা নিয়ে কিভাবে ভালো থাকবি আমি জানিনা।
.
কথাটি বলে রুপা আক্তারও ভেতরের দিকে চলে গেলেন।
উপমার দিকে তাকিয়ে আরাফ বললো-
আমার আম্মুরা অনেক বেশি ভালো উপমা। ভালো রাখবে তোমাকে।
-চলো তোমার বাসায়।
-কি যেনো বলতে চেয়েছিলে?
-সবার সামনেই বলবো।
.
.
.
মিশিকারা সবাই পাবেলের এক বন্ধুর বাসায় যাচ্ছে আজ।
দুপুরের দাওয়াত পেয়েছে তারা।
মিশিকা যদিও আরাফ কে সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু মুনিরার কাছে শুনেছে আরাফ আজ ব্যস্ত।
মুনিরা কিছুতেই চায়নি, উপমার কথা তাদের সামনে আসুক।
তার আশা পূরণ হয়েছে। কাল রাতেই পাবেলের বন্ধু ফোনে দাওয়াত টা দিলো।
ভাগ্যিস আজ দাওয়াতে যাচ্ছে তারা। নাহলে উপমার ব্যাপারে সবটা জেনে ফেলতো।
আপনমনে এসব ভেবে স্বস্থির একটা নিঃশ্বাস ফেললো মুনিরা।
মিশিকা তার আর সায়নীর উদ্দেশ্যে বললো-
আরাফের সাথে কথা বলে নিস আমরা আসার আগেই। এসে যেনো খুশির খবর শুনি।
.
মুনিরা মৃদু হেসে বললো-
অবশ্যই।
-আসি আমরা।
.
.
মিশিকারা বেরিয়ে যেতেই সোফায় বসে পড়লো মুনিরা।
তার পাশে এসে বসলো সায়নী।
তার দিকে তাকিয়ে সায়নী বললো-
উপমা যদি অনুতপ্ত হয় তবে আরাফ যা চায় তাই হবে।
-বাচ্চারা ভুল করবে। সে ভুল আমরা সাপোর্ট করবো?
-আরাফ আর বাচ্চা নেই মুনিরা। নিজের টা নিজে বুঝতে শিখেছে। তুই ওকে কোনো প্রেসার দিবিনা।
-উপমা তো সরি বলবেই। তাই তো সে এখানে আসছে। কিন্তু আমি তাকে ক্ষমা করবোনা। আরাফ কে বোঝাবো আমি, মেয়েটা এই বাড়ির যোগ্য নয়।
-যতক্ষণ না আরাফের মন এটা বুঝবে ততক্ষণ তাকে কেউ বুঝাতে পারবেনা।
-এই প্রথম আমার কোনো সিদ্ধান্তে তুমি আমার সাথে নেই।
-তুই ও কি আছিস?
.
নীরব হয়ে গেলো মুনিরা। সাথে সায়নীও।
তারা জানেনা, সামনে কি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।
দুজনের জায়গা থেকে দুজনেই ঠিক। কেউ কারো জায়গায় এসে দাঁড়াতে নারাজ। তবে দুজনের একটাই চাওয়া, আরাফ যেনো ভালো থাকে।
.
.
.
আরাফের সাথে বাসায় প্রবেশ করা মাত্রই সায়নী ও মুনিরার দেখা পেলো উপমা।
তারা ড্রয়িং রুমেই বসে আছে।
উপমা কে দেখে সায়নী তার পাশে এসে বললো-
ভালো আছো মা?
.
মৃদু হেসে উপমা বললো-
জ্বী, আপনি?
-আছি।
.
আরাফ তাকালো মুনিরার দিকে। সে চুপচাপ বসে আছে।
উপমা মুনিরার উদ্দেশ্যে বললো-
আপনি আমার উপর রেগে আছেন? আমি আজ সরি বলতে এসেছি। সব রাগারাগির অবসান হবে আজ।
.
কোনো জবাব দিলোনা মুনিরা।
সায়নী বললো-
তোমার কোনো সরি বলতে হবেনা। তুমি বসো আমাদের সাথে।
-নাহ! আমি তো বসতে আসিনি। আরাফ চায় আমি যেনো আপনাদের সরি বলি। তা বলতেই এসেছি।
.
উপমার উদ্দেশ্যে ফিসফিসিয়ে আরাফ বললো-
এভাবে কেনো কথা বলছো তুমি?
.
দাঁড়িয়ে পড়লো মুনিরা। তার দিকে এগিয়ে এসে বললো-
আরাফ চায় বলে এসেছো। তার মানে তোমার মনে হচ্ছেনা তুমি যা করেছো ঠিক করোনি?
-হুম আরাফ চায় বলেই এসেছি। কারণ আমি আরাফকে ভালোবাসি।
.
আরাফের দিকে তাকিয়ে উপমা বললো-
কাল যাকে আমার সাথে রেস্টুরেন্ট এ যাকে দেখেছো? সে ছেলেটার নাম রোমান। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার সে। তুমি জানো এমন কতো ছেলে আমাকে বিয়ে করতে চায়?
-হু। তুমি মেয়েটাই যে সেরা।
-কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাই আমি আজ তোমার কথাতেই এখানে এসেছি।
-আমি জানি উপমা।
-আমি উনাদের সরি বলবো, তবে আমার একটা কথা তোমার রাখতে হবে।
.
মুনিরা কিছু বলতে চায়লে তাকে আটকালো সায়নী।
সায়নী বললো-
ওকে বলতে দে মুনিরা। কি বলতে চায় আমরাও শুনি।
.
উপমার দিকে তাকিয়ে আরাফ বললো-
আমি বুঝতে পারছিনা কি বলতে চাইছো তুমি! এভাবে ঘোলাটে না করে প্লিজ ক্লিয়ার করবা?
-অবশ্যই করবো। আমি চাই বিয়ের পর আমরা আলাদা হয়ে যাবো। আমি তোমাকে বিয়ে করবো কিন্তু এখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয় আরাফ।
কেনো জানো? তোমার মায়েদের দেখলেই আমার মনে পড়বে, উনাদের জন্যই তুমি আমার গায়ে হাত তুলেছো। উনাদের সমস্যার জন্যই বাবা তোমাকে মানতে নারাজ।
তাই…
.
উপমার কথা শুনে যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো সায়নী ও মুনিরা।
আরাফ মৃদু হেসে বললো-
তুমি এসব কি বলছো উপমা! আমি তাদের একমাত্র সন্তান। তাদের ফেলে আমি…
তুমি এসব মজা করছো, তাইনা?
-অবশ্যই না। আমিও আমার মা বাবার একমাত্র সন্তান। আমি যদি তাদের ফেলে তোমার কাছে আসতে পারি তুমি কেনো পারবেনা?
-উপমা তুমি মেয়ে। আর এটাই তো সমাজের নিয়ম, তাইনা?
.
তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে উপমা বললো-
-ওহ তাই! একটা বিয়ে করাই সমাজের নিয়ম। সেই জায়গায় তোমার দুই মা যে এক ঘরে থাকে! তুমি তাদের ছেলে হয়ে আমাকে নিয়ম অনিয়ম বোঝাচ্ছো?
.
এপর্যায়ে মুখ খুললো মুনিরা।
কর্কশ কন্ঠে সে বলে উঠলো-
দরকার নেই তো তোমার এতো কথা বলার। তোমার চেয়ে ভালো মেয়ে আমাদের ছেলের জন্য আনবো।
-কোনো ভালো পরিবারের মেয়ে এই ঘরের বউ হয়ে আসবেনা। কোন ভালো মেয়ে বিয়ে করবে আরাফ কে! হ্যাঁ যদি পটিয়ে পারে আরাফ তাহলেই করবে।
তাই আমি যে অফার টা দিচ্ছি মেনে নিন সবাই। আরাফ কে বুঝান। এতে করে সরিও ফ্রি পাবেন।
.
উপমার এসব কথা শুনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আরাফ। নাক, কান রাগে লাল হয়ে আছে তার।
সায়নী বললো-
মা, আরাফ তোমাকে অনেক ভালোবাসে। আমাদেরও অনেক ভালোবাসে সে। কি করে আমাদের ফেলে থাকবে সে?
-সে আমি জানিনা। তবে দুই শ্বাশুড়ীর সংসারে আমি থাকতে পারবোনা। আরাফ আমাকে ভালোবাসলে এই শর্ত টা মানতেই হবে।
.
আরাফের দিকে তাকিয়ে উপমা বললো-
কি ব্যাপার আরাফ? উপমা চলে গেলে তোমার লাইফে কে আসবে? কে মানবে তোমাদের ফ্যামিলির এসব?
.
সায়নী বললো-
এ ছাড়া অন্য কোনো শর্ত কি দেয়া যায়না মা?
.
কিছুক্ষণ ভেবে উপমা বললো-
হু পেয়েছি! আমার হবু শ্বশুড় তার যেকোনো একজন স্ত্রী কে ডিভোর্স দিলেই কিন্তু হয়ে যায়। তাহলে আমাকে আর দুই শ্বাশুড়ী নিয়ে থাকতে হলোনা। আমার মা বাবাও নিশ্চিত থাকবে। কেউ নোংরা ফ্যামিলির বউ ও বলবেনা। সবাই বলবে, উপমা এসেই বাড়িটাকে নোংরামুক্ত করলো।
কিন্তু কাকে ছাড়বে হবু শ্বশুড়!
হ্যাঁ।, এখানেও কিন্তু ভালো সমাধান আছে। আরাফের আসল মা যিনি, তিনি থাকলেই হয়। বাকিজনের কি দরকার এই সংসারে! সো বলুন আন্টি? আরাফের আসল মা কে?
.
উপমার প্রশ্ন শুনে থমকে গেলো সায়নী।
মুনিরা রাগে গিজগিজ করতে করতে বললো-
তুমি যদি এই বাড়ির বউ হও, আমি নিজেই চলে যাবো এই বাড়ি ছেড়ে।
-সত্যি! যেতেই পারেন। তবে আরাফের আসল মা হলে যাবার দরকার নেই।
.
-অনেক হয়েছে!
.
আরাফের গলার স্বর শুনে উপমা বললো-
না হয়নি অনেক। তুমি আমাকে ভালোবাসলে এটা তোমার করতেই হবে। থাপ্পড় টা আমি ভুলিনি আরাফ। মায়েদের জন্য আমাকে মেরেছো এবার
আমার জন্য কি করতে পারো তুমি দেখিয়ে দাও। নাহলে কোন ভরসায় আমি থাকবো তোমার কাছে?
.
দাঁতে দাঁত চেপে আরাফ বললো-
থাকার কোনো দরকার নেই। তুমি আসতে পারো। আমার জীবনে এমন কোনো মেয়ে দরকার নেই, যে আমার ফ্যামিলি কে অসম্মান করে।
-এসব তুমি কি বলছো আরাফ! আমি আমার ভালোবাসার পরীক্ষা চাইছি। এটা অন্যায়?
-ন্যায় অন্যায় বিচার করার বোধশক্তি আছে তোমার!
আমি খারাপ কিছু করার আগেই তুমি এখান থেকে বেরিয়ে যাও উপমা। আমার মায়েদের সামনে কোনো মেয়ের অপমান আমি করতে পারিনা। নাহলে….
.
অবাক চোখে তাকিয়ে উপমা জিজ্ঞাসা করলো-
নাহলে কি? সেদিনের মতো থাপ্পড় দিতে একটা?
-একটা না। কয়েক টা দিতাম।
-এই তুমি আমাকে ভালোবাসো?
-এই আমি তোমাকে ভালোবেসেছি! ভাবতেই নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে আমার।
প্লিজ যাও তুমি এখান থেকে। নাহলে দাড়োয়ান ডাকতে বাধ্য হবো আমি।
.
উপমার চোখে পানি। তার ভালোবাসা হেরে গিয়েছে।
আরাফ হারিয়ে দিয়েছে।
কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে পড়লো সে খান বাড়ি থেকে।
.
এদিকে সায়নীর চোখ জোড়া ছলছল করছে।
উপমার কথা অনুযায়ী
আরাফের যে মা নয় তার কি থাকা দরকার এখানে!
আসলেই তো!
আরাফের দিকে তাকিয়ে সায়নী বললো-
উপমা কে ফিরিয়ে আন আরাফ। আমি তোর আব্বুকে ডিভোর্স দিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবো।
.
সায়নীর কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো আরাফ।
কাঁদতে কাঁদতে বললো-
আমার জন্যই তোমাকে এসব শুনতে হয়েছে বড় আম্মু, আমার জন্য। কিন্তু তুমি ওর কথায় কেনো মনে কষ্ট পাচ্ছো? তুমি আমার জন্য কি তা আমি জানি। শুধু কি গর্ভধারণ করলেই মা হওয়া যায়?
-আমার জন্য যে উপমা চলে গেলো। এটা করলে হয়তো তোর ভালোবাসা ফিরে আসবে।
-চাইনা আমার এমন ভালোবাসা। যে আমার আম্মুকে সম্মান দিতে জানেনা। আসলে উপমা আমার ভালোবাসা না৷ সে আমার ভুল। ভুল মানুষকে মন দিয়েছিলাম আমি, ভুল মানুষকে।
.
সায়নী ও আরাফ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
তাদের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে মুনিরাও।
আরাফ জন্মের সময় সায়নী ডাক্তার কে বলেছিলো, দুজন থেকে যদি একজনকেই বাঁচানো যায় তবে যেনো রোগীকে বাঁচানো হয়।
অথচ মুনিরা তাকে বলেছিলো, বাচ্চাটিকে নিয়ে সুখে থাকতে। মুনিরা নিজে বাঁচতে চায়নি। সায়নীর কাছে নিজের বাচ্চা তুলে দিয়ে নিজে পরপারে চলে যেতেও রাজি ছিলো।
মুনিরা তা সায়নীকেও জানায়। তবুও সায়নী স্বার্থপর হয়নি।
দুই বোনের এই ত্যাগের জন্যই হয়তো সেদিন মীরাক্কেল হয়ে যায়।
বেঁচে যায় মুনিরা ও তার সন্তান দুজনেই।
তবে মুনিরা সুস্থ হয়েই তার সন্তান কে তুলে দেয় সায়নীর হাতে।
দুজনের সবটা জেনে আফরান খুব অবাকই হয়। এই দুইটা নারীই যে মহৎ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেদিনের পর থেকে দুজনের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান আরো যেনো বেড়ে যায় আফরানের।
আরাফ কে কখনো বুঝতে দেয়নি কেউ, কে তার আসল মা।
সমান ভালোবাসা পেয়েছে সে দুজনের কাছেই। তাই সে সায়নীকে বড় আম্মু ও মুনিরাকে ছোট আম্মু ডাকে। ভালোও বাসে দুজন কে প্রচুর।
আর তাদের নামে এসব কথা সে সহ্য করবে! এমনটা কখনো হবেনা।
আরাফ যে বুঝতে পেরেছে উপমা মেয়েটা তার ও তার পরিবারের জন্য ঠিক নয় এটাই অনেক।
সায়নীর মনেও উপমাকে নিয়ে আর সংকোচ থাকবেনা।
.
আপনমনে এসব ভেবে চোখের পানি মুছে মুখে হাসি ফুটালো মুনিরা।
.
.
.
-আচ্ছা আপু বাবুর নাম কি দেয়া যায়?
-তুই দে মুনিরা।
-কেনো! তুমি দাও। স দিয়ে দাও, তোমার সাথে মিলিয়ে।
-নাহ। ম দিয়ে দে, তোর সাথে মিলিয়ে।
-আরে তুমি দাও।
-আরে তুই দে!
-দাও না।
-দে না!
.
সায়নী ও মুনিরার কথপোকথন শুনে আফরান বলে উঠলো-
বাচ্চা শুধু তোমাদের! আমার নয় কি! নাম আমিই দিবো। ওর নাম হবে আরাফ খান।
.
নামটি শুনে সায়নী ও মুনিরা দুজনে একসাথেই বলে উঠলো-
চমৎকার!
.
আরাফ কে কোলে নিয়ে, সায়নীর কাছে এসে তার কোলে তুলে দিয়ে মুনিরা বললো-
তুমি জানোনা আপু তুমি আমার জন্য কি! বাইরের মানুষ যাই বলুক না কেনো, আমরা ঠিক থাকবো। আর এই যে আরাফ, ওকে মানুষের মতো মানুষ করার দায়িত্ব তোমার৷ সবাই যেনো দেখে বলে, এই যে আরাফ একদম সায়নীর মতো হয়েছে।
.
মুনিরার কথা শুনে সায়নী মুচকি হেসে বললো-
আরাফ একদম তার বাবা ও মায়েদের মতো হয়েছে।
.
আগের স্মৃতি মনে করে ডুকরে কেঁদে উঠলো সায়নী।
সে কখনো আরাফ কে সৎ ছেলে মনে করেনি। আরাফও তাকে সৎ মা ভাবেনি। তাহলে বাইরের মানুষের কি অসুবিধে!
বারবার কেনো আরাফের আসল মা কে, এটাই তারা জানতে চায়।
কেনো!
.
বেশকিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। তবুও সায়নীর মনের অস্থিরতা কাটেনি।
মুনিরা তার রুমে এসে বললো-
ওই বেয়াদব মেয়ের কথায় কষ্ট পাবার কি আছে বলো তো আপু?
-আমি কষ্ট পাচ্ছিনা।
-তুমি পাচ্ছো। দেখেছো ওই মেয়ের আসল রূপ? এখনো বলবে ওই মেয়ের পক্ষে তুমি?
-আমি আরাফের পক্ষে। ওই মেয়ের না।
-আচ্ছা! আরাফ যদি এখনো ওই মেয়েকে আনতে চায় তবে?
-তাহলেও আমি আরাফের পক্ষে। তার জন্য যদি আমাকে চলে যেতে হয় রাজি আছি।
.
সায়নীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মুনিরা বললো-
তুমি এতো ভালো কেনো আপু!
.
.
.
ভেবেছিলো আজ উপমা তার আম্মুদের সরি বলবে।
অথচ কি হয়ে গেলো!
আজ মেহেনুবার বলা কথাটি বড্ড মনে পড়ছে আরাফের।
ভুল মানুষকে ভালোবাসা আসলেই অনুচিত।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে উপমার নাম্বার ব্লক দিলো আরাফ।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বললো সে-
আজ তুমি সত্যিই আমার মন থেকে উঠে গেলে উপমা। নিমিষেই মনের গহীনে থাকা ভালোবাসা হারিয়ে গেলো আমার। তুমি সেই উপমা নও, যাকে আমি চেয়েছিলাম। সেই উপমা নও তুমি, যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম।
.
.
.
সন্ধ্যে ৬টাই মিশিকারা ফিরে আসলো খান বাড়িতে।
যে যার যার রুমে চলে গেলে সায়নীর উদ্দেশ্যে মিশিকা জিজ্ঞাসা করলো-
আরাফ কে জিজ্ঞেস করেছিস?
সে এই বিয়েতে রাজি কিনা?
-না মানে…
.
-আমি রাজি মেহেনুবা কে বিয়ে করতে।
.
.
পেছন থেকে আরাফের মুখে কথাটি শুনে সায়নী চমকে গেলেও মুখে হাসি ফুটে মিশিকা ও মুনিরার।
মিশিকা ও মুনিরা খুশি বিনিময় করলেও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেললো সায়নী।
আরাফের মনে যে তুফান চলছে এটা তার অজানা নয়।
উপমা একদিন পস্তাবে। নিজের ভুল সে বুঝবে। সেদিন হয়তো অনেকটা দেরী হয়ে যাবে। কিন্তু আরাফও সেদিন পারবে তো, নিজেকে উপমার কাছ থেকে দূরে রাখতে!
.আরাফের সামনে বসে আছে রুমানা।
ভ্রু জোড়া কুচকে সে জিজ্ঞাসা করলো-
সত্যি তুই মেহেনুবা আপুকে বিয়ে করবি?
.
আরাফ জবাব দিলো-
হু।
-জেদের বসে করছিস না তো ভাইয়া?
-তুই জানিস না, উপমা আমাকে কি কি বলেছে। আমি নাকি কোনো ভালো ফ্যামিলির মেয়ে বিয়ে করতে পারবো না। মেহেনুবা কে বিয়ে করে দেখিয়ে দিবো আমি। সবার চিন্তা ধারা ওর মতো নোংরা নয়।
-তাহলে তুই জেদের বসেই বিয়েটা করতে রাজি হয়েছিস।
-এটা কে যদি জেদ বলে তাহলে জেদই।
-পরে যদি ওই উপমা ভুল বুঝে ফিরে আসে?
-আসবেনা।
-যদি আসে?
.
চুপ হয়ে গেলো আরাফ।
তার নিশ্চুপ মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে রুমানা বললো-
জেদের বসে মেহেনুবা আপুর লাইফ টা খারাপ করিস না।
.
.
.
-সত্যি বলছিস! তুই রোমান কে বিয়ে করবি?
.
রুপা আক্তারের প্রশ্নে উপমা জবাব দিলো-
হ্যাঁ বললাম তো! যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের আয়োজন করো।
-তুই আমাদের একমাত্র মেয়ে, ধুমধামে ভাবেই বিয়ে দিবো তোর।
-সেটা কি দ্রুত করা যায়না?
-আমি রোমানের পরিবারের সাথে কথা বলবো।
-তারা যদি না পারে অন্য পাত্র দেখো। সাত দিনের ভেতর বিয়ে করবো আমি।
.
রুপা আক্তার বুঝতে পারলেন, উপমার মনের অবস্থা ভালোনা।
এই সুযোগ টা কাজে লাগিয়ে তার বিয়েটা দিয়ে দিলেই যেনো বাঁচে তারা।
কিন্তু রোমানের পরিবার রাজি হবে তো এতো তাড়াতাড়ি বিয়ের অনুষ্ঠান করতে?
.
.
.
রুমানার কথা ভাবাচ্ছে আরাফ কে।
সে কি আসলেই মেহেনুবা কে ভালো রাখতে পারবে?
মেহেনুবা ভালো কাউকে ডিসার্ব করে। তবে সেও কি তার মায়েদের ভালো রাখতে পারবে?
নাকি মিশিকা অর্থ্যাৎ তার মায়ের কথায় বিয়েটা করতে রাজি হয়েছে?
এমনটা হলে মেহেনুবার সাথে খুব দ্রুত কথা বলা উচিত।
তারও যদি উপমার মতো চিন্তাধারা থাকে!
নাহ, রিস্ক নিতে চায়না আরাফ।
মেহেনুবার সাথে কথা বলার জন্য খুঁজতে লাগলো তাকে।
.
.
.
-আমার ছেলেটা বড্ড মা পাগল, এতে তোমার আপত্তি নেইতো?
.
মুনিরার কথা শুনে মুচকি হেসে মেহেনুবা বললো-
অবশ্যই না।
-যে ছেলে মায়েদের এতো ভালোবাসে। সে নিশ্চয় তার স্ত্রী কেও ভালোবাসবে। জানো নিশ্চয়?
-জ্বী।
.
মেহেনুবার উদ্দেশ্যে সায়নী বললো-
তুমি কি এই বিয়েতে রাজি আছো? নাকি মিশিকার কথা তেই….
-এমন কিছু নয় আন্টি। আরাফ যদি চায় আমিও রাজি আছি।
-আমাদের কোনো কিছু নিয়ে তোমার কোনো অভিযোগ নেই তো?
-কি যে বলেন না আন্টি! আমি দুইটা মায়ের আদর পাবো যেমনটা আরাফ পেয়েছে। আর আপনাদের যে মেয়ের অনেক শখ আমি শুনেছি। আপনাদের কাছে আমি ভালোই থাকবো।
-আর আরাফ? না মানে কেমন লাগে তাকে?
.
সায়নীর উদ্দেশ্যে মুনিরা বললো-
ভালো না লাগলে নিশ্চয় রাজি হতো না। দেখো কি প্রশ্ন করেছো, লজ্জায় মেয়েটার মুখ লাল হয়ে আছে।
-আরে আমরা আধুনিক হবু শ্বাশুড়ী। এসব প্রশ্ন করতেই পারি। তাছাড়া আমরা বউ আনছিনা। মেয়ে আনছি, মেয়ে।
-হয়েছে, এবার চুল গুলো আঁচড়ে দাও আমার।
-আচ্ছা আয়। তারপর আমার গুলোও দিবি।
.
মেহেনুবা তাদের উদ্দেশ্যে বললো-
আমি দিই?
.
মুনিরা বললো-
-দুজনকেই?
-হুম। প্রথমে বড় আন্টি তারপর ছোট আন্টি।
-ভালো বুদ্ধি। আমরাও দেখি। হবু মেয়ে কেমন চুল আঁচড়ে দিতে পারে।
.
কথাটি বলেই হেসে উঠলো মুনিরা। তার সাথে যোগ দিলো সায়নী ও মেহেনুবা। আর দূর থেকে তাদের হাসিমাখা মুখ দেখে হেসে চলেছে আরাফ।
এতক্ষণ আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে সবটা শুনেছে সে।
এমন দৃশ্য দেখে তার মনটা জুড়ে গেলো।
তার ভালোবাসা পূর্ণতা পায়নি, মায়েদের পছন্দই না হোক পূর্ণতা পাক!
.
.
.
-দুলাভাই?
.
তাসুর ডাকে দাঁড়িয়ে পড়লো আরাফ।
তাসুর দিকে তাকিয়ে বললো-
দুলাভাই?
-হু।
-হয়নি এখনো।
-হয়ে যাবা। আর কয়দিন! যাক, খুশি তো এই বিয়েতে?
-হঠাৎ এই প্রশ্ন?
-জানতে চাইলাম আর কি।
-তুমি খুশি না?
-আমার ক্রাশ আমার দুলাভাই হতে যাচ্ছে। খুশি তো হবোই।
-আমি ক্রাশ তোমার?
-হু।
-কখন?
-অনেক আগে থেকে।
-তার মানে মেহেনুবার ও?
-নাহ! আপু তো তোমাকে দুই চোখে সহ্য করতে পারতো না।
-কি!
-হুম, এমনটাই দেখাতো সে। তবে এখন আমার মনে হচ্ছে আগে থেকেই সে তোমাকে পছন্দ করতো।
-কেনো মনে হচ্ছে?
-নাহলে এতো সহজে বিয়েতে রাজি হতো নাকি! তুমিই বলো?
-সেতো আতিকের সাথেও হয়েছিলো।
-হয়নি। আম্মুরা অনেক বুঝানোর পরে হয়েছে। সায়নী আন্টি আতিক কে পছন্দ করেছে এমনটা বলার পরে হয়েছে। আমার মনেহয়, সায়নী আন্টি তোমার কথা বলেনি তো তাই অভিমান করে আপু রাজি হয়ে গিয়েছিলো।
-তুমি ওর সৎ বোন?
-মানে কি?
-তাহলে কিছুই সিউর করে জানো না কেনো?
-আপু কেমন চাপা স্বভাবের জানোই তো।
-হু।
-আচ্ছা, তুমি কি আপুকে আগে থেকে পছন্দ করতে?
-নাহ।
-তাহলে রাজি কেনো হয়েছো?
-প্রেম, ভালোবাসা, আগে থেকে পছন্দ এসব ছাড়া বুঝি বিয়ে হয়না?
-এই যুগে কই হয়!
-ওহ! তার মানে তুমি কাউকে ভালোবাসো। বলো বলো?
-এই না! এমন কিছু না।
-তাহলে এতো কনফিডেন্স সহকারে এসব বলছো যে?
-আমি বাসিনা তবে বাসবো। ভাগ্যিস তোমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। নাহলে তোমার পাশে থাকতে থাকতে তোমার প্রেমেই পড়ে যেতাম।
.
আরাফ শান্ত স্বরে বললো-
আমার যেকোনো একজন হলেই হবে। তবে যেনো তার মধ্যে আমার ফ্যামিলির জন্য রেসপেক্ট টুকু থাকে।
.
.
.
মা রা তো পরশুই চলে আসবে তাইনা?
.
মিশিকার প্রশ্নে জবাব দিলো পাবেল-
হুম।
-তাড়াতাড়ি বিয়ের আয়োজন টা সেরে ফেলবো। তুমি খুশি তো?
-কেনো হবোনা! আমি তো আরাফ কে মেয়ের জামাই হিসেবে দেখতে চেয়েছি।
-হু। তবে মেহেনুবা যে এতো সহজে রাজী হবে আমি ভাবিনি।
-ডাক্তার হতে হবে কথা নেই। হ্যান্ডসামই যথেষ্ট।
আরাফ ছেলেটা এমনি। মেহেনুবার জায়গায় অন্য কেউ হলেও রাজি হতো।
এই যে যেমন তুমি। নিজে ডাক্তার হয়ে আমার প্রেমে পাগল ছিলে। কেনো? আমি হ্যান্ডসাম ছিলাম বলে।
-হু তখন এসেছিলাম বলো ভাগ্যিস। নাহলে তো তুমি সায়নীর শোকে ছ্যাকা খেয়ে বেকা হয়ে যেতে।
-মন্দ বলোনি।
.
মুখটা প্যাচার মতো করে আছে মিশিকা।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে পাবেল হেসে বললো-
মেয়ের বিয়ে দিতে যাচ্ছো, পাগমালি কমলো না তোমার।
.
.
.
নিজের রুমের বারান্দায় বসে আছে আরাফ।
মেহেনুবা কে নিয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ আর নেই। এই মেয়ে নিশ্চিত তার পরিবার কে ভালো রাখবে।
তবে সে নিজে ভালো থাকতে পারবে তো উপমাকে ছাড়া!
.
চোখ জোড়া বন্ধ করে উপমার কথা মনে করতে চায়লো আরাফ।
চোখ বন্ধ করতেই ভেসে আসছে সেই দৃশ্য ও কানে শুনছে উপমার সেই কথা-
কোন ভালো ফ্যামিলির মেয়ে তোমাকে বিয়ে করবে!
.
চোখ জোড়া খুলে ফেললো আরাফ।
আগে চোখ বন্ধ করলেই উপমার সাথে কাটানো সেই মুহুর্ত ভেসে আসতো। উপমা দূরে থাকলেও উপলব্ধি করতে পারতো তাকে। আর আজ….!
একবার নয়, কয়েকবার সুযোগ দিয়েছে সে তার ভালোবাসা কে।
কিন্তু ফলাফল শূন্য।
মানুষ নাহয় একবার ভুল করে।
বারবার যেটা করা হয় সেটা ভুল নয়।
আর উপমা যা করেছে এর কোনো ক্ষমা হয়না।
তার বাসায় এসে সে জানতে চেয়েছে কে তার আসল মা!
আরাফ কি কখনো ভেবেছিলো?
তার ভালোবাসার মানুষটাই তাকে এভাবে আঘাত করবে?
বারবার আঘাত করবে!
ভালোবাসা মানেই কি শুধু দুটো মানুষের মনের বা শারীরিক মিলন?
বিশ্বাস, ভরসা বলতে কিছু নেই?
নাকি উপমার কাছে নেই?
উফফ… অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব করছে আরাফ।
মাথাটা তার প্রচন্ড ব্যাথা করছে।
কি ভেবেছিলো আর কি হয়েছে!
এখন কি করার উচিত আরাফের?
ব্যর্থ প্রেমিকের মতো নিজেকে গুটিয়ে নেয়া?
নাকি এক কোণায় বসে বসে সিগারেটের ধোঁয়া উড়ানো?
.
-আমার মনেহয় এখন এক কাপ চা প্রয়োজন তোমার?
.
মেহেনুবার কথায় তার দিকে পেছনে ফিরে তাকালো আরাফ।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।
আরাফ তার হাত থেকে কাপ টা নিয়ে চুমুক দিলো চায়ে।
বেশ ভালোই লাগছে তার।
কোনো কথা না বলে চা টা শেষ করলো সে।
বারান্দায় থাকা চেয়ারের কাপ টা রেখে মেহেনুবার উদ্দেশ্যে বললো-
কি করে বুঝলে আমার এখন চা দরকার?
-তোমার উপর দিয়ে যা যাচ্ছে তাতে করে না বোঝার কারণ নেই।
-আজ উপমা এসেছিলো বাসায়। জানো?
-না তো।
-আবারো অপমান করেছে সে।
-তাই বুঝি রাজি হলে বিয়েতে?
.
নিশ্চুপ হয়ে গেলো আরাফ।
কিন্তু মেহেনুবা মৃদু হেসে বললো-
জানো আরাফ? আমি ভাগ্য বিশ্বাসী। তাই আতিকের সাথেও বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। ভাগ্যে থাকলে সেই আমার জীবনসঙ্গী হবে এমনটাই ভেবেছি। কিন্তু দেখো, বিয়েটা হতে হতেও ভেঙ্গে গেলো। এখন আমার সাথে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আবার হতে পারে জেনেও তোমার সাথে বিয়েতে রাজি হয়েছি আমি।
-কেমন?
-এই যে উপমা ফিরে আসলে তুমি তার হয়ে যাবে।
-এমন টা আর হবেনা। সে শুধু আমাকে আঘাত করতেই ফিরবে।
-আর যদি ভালোবাসতে ফিরে?
.
চুপ হয়ে গেলো আরাফ।
এতো কিছুর পরেও উপমা ফিরলে কি করবে কেনো সে বলতে পারেনা! তার তো উচিত বলা, উপমা ফিরলেও আর কিছুই সম্ভব নয়। তবুও কেনো পারছেনা সে!
.
মেহেনুবা বললো-
ভাগ্য বিশ্বাস করি বলেই আমি রাজি হয়েছি। তবে তোমার মনের অবস্থাটা আমি পুরোপুরি না বুঝলেও বুঝছি। আমাকে যে তুমি উপমার জায়গা দিতে পারবেনা সেটা আমি জানি। কিন্তু ভাগ্য যদি আমাদের এক সূত্রে গেঁথে রাখে তাহলে কিছু করার নেই। ভালো না বাসো, তবুও রয়ে যাবো। কারণ…
.
মেহেনুবা থেমে গেলে আরাফ তাকে জিজ্ঞেস করলো-
কারণ?
.
-কারণ আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। তাই চেষ্টা করবো তোমাকে সুখে রাখতে। কষ্ট না দিতে। তোমাকে এভাবে দেখতে যে মোটেও ভালো লাগছেনা আমার।
তোমার খুশির জন্য সবটা করতে পারবো আমি।
ভাগ্য বিশ্বাসীর সাথে আজ আমি ভালোবাসায়ও বিশ্বাসী আরাফ!
.
কথাটি আপনমনে বললেও আরাফ কে বললো না মেহেনুবা।
আরাফের উদ্দেশ্যে সে শুধুই বললো-
কিছুনা। তবে বিয়ের আগ পর্যন্ত যদি তুমি ডিসিশন বদলাতে চাও বদলাতে পারো। আমি তোমার সাথে আছি।
-হুম।
.
মেহেনুবা চলে যেতে চায়লে আরাফ তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লো-
তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?
.
আরাফের প্রশ্ন শুনে থমকে গেলো মেহেনুবা।
হঠাৎ এমন প্রশ্ন আরাফের!
সে কি কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে!
যদি তাই হয়, সে হয়তো ভাববে নিজের ভালোবাসার জন্য আমি তাকে চাইছি। কিন্তু আসলেই তো এমন না। আমি যে আরাফ কে সুখে দেখতে চাই।
.
-কি হলো বলো মেহেনুবা?
ভালোবাসো আমাকে? নাহলে আমার সম্পর্কে সবটা জানার পরেও রাজি হয়েছো কেনো? শুধুই ভাগ্যের উপর বিশ্বাস করে?নাকি অন্য কিছু?

-সব কথা বলতে হয়না। কিছু কথা লুকায়িত থাকাই শ্রেয়।
.
কথাটি বলেই মেহেনুবা চলে গেলো।
আরাফ দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গায়।
.
তোমাকে যে ভালোবাসে তুমি যদি তার কাছেই থাকো, তবে সুখী বেশি হবে।
এমন একটা প্রচলিত কথা শুনেছে আরাফ।
আজ তাসুর কথা শুনে মেহেনুবাকে উপলব্ধি করতে চেয়েছে আরাফ। পেরেছেও সে।
মেহেনুবার চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখেছে আরাফ।
মুখে স্বীকার না করলেও চোখে স্বীকারোক্তি প্রকাশ পেয়েছে তার।
আগে যদি মেহেনুবার ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারতো তাহলে কি এমন কষ্ট পেতে হতো!
.
-আরাফ?
.
আফরানের ডাকে ঘোর কাটলো আরাফের।
বাবার ডাকে সে বারান্দা থেকে বেরিয়ে রুমে আসলো।
তার উদ্দেশ্যে আফরান সরাসরিই প্রশ্ন করলো-
সবটা ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস তো?
-কিসের?
-মেহেনুবা কে বিয়ে।
-হু।
-বিয়ের পরে যদি উপমা ফিরে আসে? তাহলে?
-আসবেনা।
-আসলেও কি করবি এখন থেকে ভেবে নে।
-হুম।
-আমি নিজে দুটো বিয়ে করে তোকে এসব জ্ঞান কেনো দিচ্ছি ভাবছিস?
-না বাবা!
-ভাবতেই পারিস। তবে আমার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা ছিলো। ভুলও বলতে পারিস। কিন্তু আমার সাথে যেটা হয়েছে সেটা তোর সাথে হতে হবে বলে কথা নেই। তাই যা সিদ্ধান্ত নিবি ভেবেই নিবি।
আমার মতো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগিস না।
আমরা তোর সাথে আছি।
-জ্বী আব্বু।
.
কথাটি বলেই চলে গেলো আফরান।
বিছানার উপরে বসে আরাফ নিজেরমনে বললো-
উপমা আমার ভুল, আমার ভুল উপমা, ভুল আমার উপমা।
আজ থেকে এটাই সত্যি!
.
.
.
মুনিরার মনে আছে আরাফ কে নিয়ে ভয়।
আরাফ যে উপমাকে সত্যিকার অর্থে ভালো বেসেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু উপমা আরাফের জন্য সঠিক নয়। যদিও আরাফ তা আজ বুঝতে পেরেছে। তবুও ভয় থেকেই গেলো মনের মাঝে মুনিরার।
ভালোবাসা যে বড্ড বেহায়া। সে নিজেও বেহায়াপনা করেছে। কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষটি উপমার মতো ছিলোনা। তাইতো আরো বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলো সে আফরান কে।
উপমা ফিরে আসলেও কোনোদিনও আরাফ কে ভালো থাকতে দিবেনা। তাই যা করা উচিত খুব দ্রুত করতে হবে।
হ্যাঁ, আরাফ আর মেহেনুবার বিয়েটা খুব দ্রুত সারতে হবে।
একবার সমাজের সকলের সামনে বিয়েটা হয়ে গেলে উপমা নামের আপদটা বিদায় হবে তাদের জীবন থেকে।
এসব ভেবে লম্বা একটা শ্বাস ফেললো মুনিরা।
এগিয়ে গেলো সে ড্রয়িংরুমের দিকে।
.
.
.
ড্রয়িংরুমে বসে আছে সকলে।
আরাফ ও মেহেনুবার বিয়ে নিয়ে আলোচনা চলছে।
মুনিরা সকলের উদ্দেশ্যে বললো-
যতো দ্রুত সম্ভব মেহেনুবা কে বউ করে আনতে চাইছি আমরা।
.
পাবেল হেসে বলে উঠলো-
আমার বাবারা পরশুই চলে আসবে সো আমার কোনো সমস্যা নেই। বরং আমিও নিশ্চিত হবো বিয়েটা হয়ে গেলে।
.
পাবেলের কথা শুনে যেনো মনে শান্তি পেলো মুনিরা।
সায়নীর দিকে তাকিয়ে বললো-
সাত দিন পরেই বিয়ের তারিখ দিই?
.
সায়নী বললো-
খুব তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছেনা?
-সবই যখন ঠিক আছে দেরী কেনো করবো!
-না মানে আত্নীয়-স্বজনদের দাওয়াত দেয়া, কেনা-কাটা এসব করতে হবেনা? এতো তাড়াহুড়ো করলে কি হয়! আমাদের একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা!
.
-জ্বী সাতদিন পর নয়, বিয়েটা ১মাস পরে দিলে ভালো হয়।
.
পেছন থেকে মেহেনুবার কথা শুনে সকলে তার দিকে দৃষ্টি দিলো।
মেহেনুবা শান্ত স্বরে বললো-
নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি এতো তাড়াহুড়ো করতে চাইনা।
সবটা আস্তেধীরে করতে চাই। যাতে পরবর্তীতে এই নিয়ে কোনো আক্ষেপ না থাকে।
.
মেহেনুবার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তাসু।
সে মেহেনুবাকে সমর্থন করে বললো-
হ্যাঁ! আমাদের মার্কেটিং করতেই তো ১০দিনের মতো লেগে যাবে।
সাত দিনে বিয়ে! জাস্ট ইমপসিবল।
.
মুনিরা বললো-
আরে সব হয়ে যাবে। আমরা আছি না!
.
মুনিরার উদ্দেশ্যে পাবেল বললো-
আমি জানি মেহেনুবাকে সবার অনেক পছন্দ কিন্তু
মেহেনুবা ঠিক বলছে। তাড়াহুড়ো করা ঠিক হবেনা। তাছাড়া আমার বড় মেয়ে মেহেনুবা। এমনভাবে বিয়ে দিবো যেনো এই বিয়ের কথা সকলের মনে থাকে।
.
সায়নী বললো-
হ্যাঁ। তাহলে পরের মাসেই বিয়েটা হচ্ছে।
.
সায়নী মনেমনে খুশি হলেও মুনিরা হতে পারলোনা।
সায়নী এখনো ভাবছে উপমা ভুল বুঝে ফিরে আসবে।
আর মুনিরার চিন্তা, সে ফিরে আসলে সবটা ভেস্তে যাবে। এমন টা যেনো না হয়।
.
.
.
সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে মেহেনুবা ও তাসু।। তাদের ডেকে মিশিকা বললো-
জামা কাপড় গুছিয়ে নে তোরা। কাল সকালেই বাসায় যাবো।
.
মেহেনুবা ‘আচ্ছা’ বলে তাসুর সাথে উঠতে লাগলো।
এদিকে মিশিকার কথা শুনে সায়নী বললো-
চলে যাবি মানে! কেনো যাবি?
-বারেহ! দেশে যে একটা বাড়ি আছে সেটা ভুলে গেলে চলবে! আর তাছাড়া ভাইয়ার বাসায়ও থাকতে হবে কিছুদিন। নাহলে রাগ করবেন।
-এখান থেকে যা। আবার চলে আসিস।
-নারে। আবার আসবো। যতোদিন দেশে আছি আসা যাওয়া তো থাকবেই। তুই আর জোর করিস না।
.
.
-তাসু তুই রুমে যা। আমি একটু আসছি।
.
মেহেনুবার কথা শুনে তাসু দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে বললো-
ওহহো! হবু হাসবেন্ড এর রুমে গিয়ে ইটিস পিটিস করবি!
-ছিঃ!
.
মেহেনুবার দিকে তাকিয়ে তাসু বললো-
তুই এতো সিরিয়াস হয়ে যাস কেনো বল তো আপু! আমি তো জাস্ট ফান করছিলাম।
-যা তো তুই। রুমে যা। আমি আসছি।
.
.
আরাফের রুমের সামনে এসে মেহেনুবা বললো-
আসতে পারি?
-হুম।
-আমাদের বিয়ের ডেইট ঠিক হয়েছে।
.
কথাটি শুনেই যেনো বুকের ভেতরে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো আরাফ।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে মেহেনুবা বললো-
দেরী আছে। আরো এক মাস বাকি। সময় টা আমি চেয়ে নিয়েছি। কেনো জানো?
-কেনো?
-তোমাকে সময় দিলাম ভাবার জন্য। যাতে পরবর্তীতে তোমার আফসোস না হয়।
.
-আরাফ?
.
সায়নীকে দেখে মেহেনুবা বললো-
আসুন আন্টি।
-ওহ তুমি আছো। আচ্ছা আমি পরে আসবো।
-না আন্টি, কথা শেষ আমার।
.
মেহেনুবা চলে যেতেই আরাফের পাশে এসে বসলো সায়নী।
আরাফের উদ্দ্যেশ্যে সে বললো-
আগামী মাসে তোর বিয়ে শুনেছিস?
-হু।
-এক সপ্তাহ পরেই হয়ে যেতো কিন্তু…
-মেহেনুবা সময় চেয়েছে। কেনো জানো?
-হয়তো কেনাকাটা, প্রস্তুতি এসবের জন্য।
-না। ও সবটা জানে উপমার ব্যাপারে।
.
অবাক চোখে তাকিয়ে সায়নী বললো-
সত্যি?
-হ্যাঁ। তাই আমাকে সময় দিয়েছে।
-হুম। বুদ্ধিমতি মেয়েটা। কিন্তু সবটা জেনেও বিয়েতে রাজি হলো! অবাক করার মতো বিষয়টা।
-হু।
.
আরাফের হাত ধরে সায়নী বললো-
তবে তোকে মেহেনুবা ভালোবাসে।
-হয়তো।
-আর তুই উপমা কে।
-হুম।
-এখনো বাসিস?
-না।
-মনের কথা?
.
মুখটা ফ্যাকাসে করে আরাফ জবাব দিলো-
বুঝতে পারছিনা। কিন্তু ওকে আমি ভালোবাসতে চাইনা।
.
মৃদু হাসলো সায়নী।
আরাফের উদ্দেশ্যে বললো-
আমি তোকে বলেছিলাম নিজের ভালোবাসা কে সুযোগ দিতে।
-হুম।
-দিয়েছিলি তুই। কিন্তু ফলাফল শূন্য। তোর ভালোবাসা হয়তো ভুল ছিলো। সুযোগ পেয়েও তাই ফিরে আসেনি।
তবে এরপরেও আমি ভয়ে ছিলাম। কেনো জানিস? উপমা যদি নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসে! কিন্তু আজ মেহেনুবা আমার ভয়টা কাটিয়ে দিলো। উপমার জন্য সে আরো একটা মাস বাড়িয়ে দিলো।
-মানে?
-মানে এবার সব কিছু ভাগ্যের উপরে ছেড়ে দে। উপমা যদি ভুল বুঝে নিজে ফিরে আসে এই এক মাসের ভেতর তাহলে তাকে মেনে নিবি। মেহেনুবার হয়তো কষ্ট হবে তবে সাময়িক।
আর যদি উপমা ফিরে না আসে তবে তুই তাকে মানাতে যাবিনা। এবার ভালোবাসা প্রমাণ করার সুযোগ ওর, তোর না।
-এতো কিছুর পরেও উপমা ফিরে আসলে মেনে নিতে বলছো তুমি?
-হুম। কারণ ও তোর ভালোবাসা। তবে হ্যাঁ, যদি নিজ থেকে তোর বিয়ের আগে ফিরে আসে তবেই।
.
সায়নীকে জড়িয়ে ধরে আরাফ বললো-
ধন্যবাদ আমার মনটা হালকা করার জন্য।
আমি আসলেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম।
উপমা যদি আমার হয় তবে ফিরে আসবে। কেননা ভুলটা তার, আমার নয়। আর না আসলে আমি তাকে ভুলে যাবো, ভুলে যাবো।
.
.
.
রোমানের বাবার সাথে কথা বলে উপমার রুমে আসলেন রুপা আক্তার।
উপমার উদ্দেশ্যে তিনি বললেন-
রোমান ফ্যামিলি ট্যুরে দেশের বাইরে যাবে।
এক মাসের ভেতর বিয়েটা করতে পারবেনা। কারণ এতো তাড়াহুড়ো করে রোমানের বাবা ছেলের বিয়ে দিতে চান না৷ আমি তো সবটা খুলে বলতে পারছিনা তাই তারা আমাদের অবস্থা বুঝছেন না।
-তাহলে অন্য পাত্র দেখো।
-পাগলামি করিস না উপমা। পাত্র হলেই তো হয়ে গেলো না!
-কেনো পাত্রের কি অভাব পড়ছে!
-এতো অল্প সময়ে কোন পরিবার আয়োজন করতে রাজি হবে বল!
-আমি জানিনা কিছু।
-বিয়ে করতে পারবেনা তবে এনগেজমেন্ট সারতে পারা যায় বলেছেন রোমানের বাবা। কিন্তু তাও সপ্তাহ খানেক পর। বিশাল আয়োজন ছাড়া এনগেজমেন্ট ও করতে নারাজ তারা।
-ঠিক আছে। বিশাল আয়োজন শুরু করে দাও।
এনগেজমেন্ট হলে এনগেজমেন্ট! আমি আরাফ কে দেখাতে চাই, ওকে ছাড়া আমি ভালো থাকবো।
-হ্যাঁ। আমার মেয়ের এনগেজমেন্ট দেখেই সে পাগল হয়ে যাবে। তোর দাম কতোটা সে বুঝবে।
.
.
.
পরেরদিন সকাল ১০টা….
ব্যাগ কাল রাতেই গোছানো হয়ে গিয়েছে। মিশিকা ডাক দিয়েছে বেশকিছুক্ষণ হলো।
নিজের বাসায় যাবার জন্য তৈরী হয়ে নিলো মেহেনুবা।
তবে কেনো যেনো রুম থেকে বেরুতেই ইচ্ছে করছেনা তার।
এই বুঝি গেলে আর আসতে পারবেনা!
আরাফ কে দেখতে পারবেনা, পাবেনা তার সঙ্গ!
ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে মেহেনুবার।
হ্যাঁ মেহেনুবা উপলব্ধি করতে পেরেছে, আরাফ কে ভালোবাসে সে।
আরাফ কে সে ভালোবাসে সেটা উপলব্ধি করার পর থেকেই বেহায়া মনটা তার আশেপাশে থাকতে চায় সারাক্ষণ।
কি অন্যায় কি ভুল সে জানেনা। শুধু জানে সে আরাফ কে ভালোবাসে।
তবে এই ভালোবাসা মানেই যে আরাফ কে কাছে পেতে হবে তা নয়। আরাফ সুখে থাকলেই সে খুশি হবে।
নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখতে রাজি সে আরাফের জন্য।
.
-ব্যাগ গুছিয়েছো?
.
দরজার পাশে আরাফ কে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো মেহেনুবা।
আরাফ তার উদ্দেশ্যে বললো-
নিচে সবাই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। তাই ডাকতে এসেছি।
-হু ব্যাগ গোছানো হয়ে গিয়েছে।
.
মেহেনুবার পাশে এসে আরাফ ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললো-
আসো।
-থাক আমি পারবো।
-সমস্যা নেই, আসো তুমি।
.
আরাফের সাথে সিড়ি বেয়ে নিচে নামছে মেহেনুবা।
হঠাৎ সে বলে উঠলো-
এক মাস পরে কি হবে আমরা কেউই জানিনা। তবে দোয়া করবো, তুমি যেনো তোমার ভালোবাসা ফিরে পাও।

মিশিকারা খান বাড়ি ছেড়ে বের হবার পরেই ড্রয়িংরুমে বসলো সায়নী ও মুনিরা।
মেহেনুবা উপমার ব্যাপারে সবটা জানে।
কথাটি শুনে যেনো বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গেলো মুনিরা। যে বিষয়টা সে আড়াল করতে চেয়েছিলো সেই বিষয়টা মেহেনুবা আগে থেকেই জানতো!
আর সবটা জেনেও সে এই বিয়েতে রাজি হয়েছে!
-আপু এসব তোমাকে আরাফ বলেছে?
.
মুনিরার কথা শুনে সায়নী জবাব দিলো-
হ্যাঁ।
-দেখেছো আপু, মেহেনুবা মেয়েটা একটা হিরার টুকরো।
-হুম। তাই তো সে আরাফ কে আরো ১মাস সময় দিয়েছে।
-এটা ঠিক হয়নি। আমি কথা বলবো মেহেনুবার সাথে। ওকে বোঝাবো, ১মাস সময়ের কোনো প্রয়োজন নেই।
-প্রয়োজন।
-কেনো?
-উপমা যদি ফিরে আসে!
-তো!
-তো মানে?
-তো মানে কি! তুমি এখনো উপমার নামের বিষটার কথা বলছো? যে আরাফের আসল মা কে জিজ্ঞাসা করে তোমাকে অপমান করেছে, যে আমাদের ছেলেকে কষ্ট দিয়েছে।
-কিন্তু তার মাঝেই আমাদের ছেলে সুখ খুঁজে পায়।
-আরাফ বলেছে?
-মা হয়ে এটাই বুঝছিস না?
-সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। মেহেনুবার সাথে কথা বলবোই আমি।
-সেটা আমিও জানি। কিন্তু আরাফের মনে যে আফসোস রয়ে যাবে।
-মেহেনুবা কে পেয়ে সব ভুলে যাবে।
-বিয়ের পরেই যদি উপমা ভুল বুঝে ফিরে আসে?
-আসবেনা।
-আসতেও তো পারে। তখন আমাদের আরাফের কি হবে চিন্তা করেছিস? দু টানায় পড়ে যাবে সে। একদিকে দায়িত্ব আর অপরদিকে ভালোবাসা। ভালোবাসার মানুষ যাই করুক না কেনো। তার চোখের পানি, আকুতি সহ্য করা যায়না। এটা তো মানিস?
-হুম।
-আরাফের ক্ষেত্রেও এটি হবে। এতো সহজে সে উপমা কে ভুলতে পারবেনা। মনে হবে এই বিয়েটা না করলে হয়তো ফিরে আসতো উপমা। এক সময় আমাদেরও দোষারোপ করতে পারে যে আমাদের জন্য তার ভালোবাসা হারিয়েছে। তাই বলছিলাম এই একটা মাস সময় আরাফ কে দেওয়াই উচিত। উপমা যে তার জন্য নয়, এটা নিয়ে যেনো মনে সংশয় না থাকে সেটার জন্য হলেও সময় দেয়া উচিত।
-আর যদি সত্যিই ভুল বুঝে ফিরে আসে উপমা?
-ক্ষমা মহৎ গুণ। কিন্তু আমার যা মনেহয়, উপমা ঠিক হবার নয়। আমি শুধু আরাফের জন্যই করছি এটা। নতুন জীবনে যেনো কোনো সংশয় না থাকে তাই করছি।
.
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুনিরা বললো-
হুম আপু। আরাফ কোনোদিন উপমার জন্য হা হুতাশ করুক আমিও চাইনা।
.
.
.
৮দিন পর……
মেহেনুবা বসে আছে নিজের রুমে।
এই ৮ দিনে আরাফের সাথে তার না হয়েছে দেখা, না হয়েছে কথা।
তাকে মনে যে পড়েনি এমন নয়। কিন্তু নিজেকে দমিয়ে রেখেছে মেহেনুবা।
উপমা ফিরে আসলে দূরে তো এমনিতেই যেতে হবে। এখন থেকেই হোক না সেই দুরুত্ব!
.
.
মেহেনুবাকে চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাসুর মনে হলো তার মনটা ভালো নেই।
তাই হাতে মোবাইল নিয়ে আরাফের ফোনে ডায়াল করলো তাসু।
তাসুর ফোন নাম্বার অচেনা নয় আরাফের।
রিসিভ করে বললো-
হ্যালো?
-হ্যালো ফিউচার দুলাভাই। কি অবস্থা?
-ভালো। তোমার?
-আমার তো ভালো। কিন্তু আপুর তো ভালোনা।
-কেনো! কি হয়েছে?
-হবু বর যদি খবর না নেই মন ভালো থাকার কথা?
-এসব সে বলেছে?
-নাহ! আমি বলছি। এখন আমি আপু কে ফোন দিবো। তুমি কথা বলবে। আর বলবে তুমিই আপুকে চেয়েছো।
-কিন্তু…
-যা বলছি করো তো। কেমন কাপল তোমরা বুঝিনা আমি। কোথায় বিয়ের আগে চুটিয়ে প্রেম করবে তা না, কথা পর্যন্ত হয়না। একজনের ফোন নাম্বার অন্য জনের কাছে আছে কিনা সন্দেহ।
উফফ…
সবটা আমাকেই সামলাতে হবে!
.
তাসুর কথা শুনে হাসলো আরাফ।
বারান্দায় এসে মেহেনুবার উদ্দেশ্যে তাসু বললো-
আরাফ ভাই তোর সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। ফোন দিয়েছে ভাইয়া।
.
অবাক হলেও তাসুর হাত থেকে মোবাইল টা নিলো মেহেনুবা।
তাসু ভেতরে চলে গেলে আরাফের উদ্দেশ্যে সে বললো-
ভালো আছো?
-যেমন থাকার কথা আছি। তুমি?
.
৮দিন পর আরাফের গলার স্বর শুনে মনের মাঝে ভালো লাগা কাজ করছে মেহেনুবার।
শান্ত স্বরে বললো-
-ভালো আছি।
-সত্যি?
-না থাকার কারণ নেই।
-তা অবশ্য ঠিক।
-আন্টিরা, আঙ্কেল ভালো আছেন?
-হুম। তোমরা আসোনা কেনো? বেড়াতে এসো।
-ঠিক আছে।
-আচ্ছা রাখি। ভালো থেকো।
-তুমিও।
.
.
৫০সেকেন্ড কথা হয়েছে। তবুও কতোই না ভালো লাগছে!
ভালোবাসা বুঝি এমনি হয়!
.
তাসুর পাশে এসে বসলো মেহেনুবা।
মৃদু হেসে বললো-
ধন্যবাদ।
.
ভ্রু জোড়া কুচকে তাসু জিজ্ঞাসা করলো-
হোয়াই?
-আমি জানি ফোনটা তুই দিয়েছিস। মোবাইলে তো দেখা যায় তাইনা?
.
জিভে কামড় দিয়ে তাসু বললো-
হ্যাঁ!
-তবে দরকার ছিলোনা।
-আরাফ ভাইয়াই কিন্তু দিতে বলেছে…
-হয়েছে আর মিথ্যে বলতে হবেনা।
-আতিক ভাইয়ার বিষয়টা আমি বুঝলেও এটা বুঝছিনা। কি সমস্যা তোদের?
-কিছুই না। বিয়ের পরেই চুটিয়ে প্রেম করবো।
.
কথাটি বলেই মেহেনুবা বেরিয়ে গেলো রুম ছেড়ে।
তাসুর উচ্চ শব্দে বললো-
অদ্ভুদ কান্ডকারখানা!
.
.
.
৫০সেকেন্ডে ফোন রেখে দেয়াটা কি ঠিক হয়েছে!
কিইবা বলবে আরাফ মেহেনুবাকে!
কথা যেনো খুজেই পাচ্ছিলো না।
দাঁড়িয়ে পড়লো আরাফ।
দাড়ি গুলো শেষ কবে কেটেছে মনে নেই আরাফের।
আয়নায় চোখ পড়তেই হেসে উঠলো সে।
আয়নার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো-
এই যুগে দেবদাস হবার কোনো মানে হয়?
.
উপমার কথা মনে হতেই মুহুর্তে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো তার।
উপমা কি পার্বতী না, তবে সে কেনো দেবদাস হবে!
.
আপনমনে এসব বলে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো সে দাড়ি ছাটার জন্য।
উপমা বলতো, চাপ দাড়িতেই ভালো মানাই তাকে।
.
.
.
সাদার মাঝে সোনালী কাজ করা লেহেঙ্গা পরেছে উপমা।
চুল গুলো খুলে এক পাশে এনে দেয়া, শরীরে ভারী গহনা। পুরো বাড়ি জমকালো ভাবে সাজানো সাথে নিজেও সেজেছে প্রচুর।
সবে মাত্র পার্লার থেকে এসে নিজের রুমে আসলো উপমা।
কেউ দেখলে বলবেনা, আজ তার এনগেজমেন্ট।
বলবে, আজ তার বিয়ে!
আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে চলেছে উপমা।
আজ রোমানের জায়গায় আরাফ থাকলে কি হতো?
সে বলতো, এতো সাজগোজের কি দরকার বলো তো?
তোমাকে এমনিতেই ভালো বেশি লাগে৷ বিয়েতেও সিম্পল সাজবে তুমি।
.
না চাইতেও আরাফের কথা হুট করে মনে এলো উপমার।
কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, আরাফ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। যে সময়ে তার পাশে থাকার কথা ছিলো সে থাকেনি।
তবে তার জন্য খারাপ লাগার কোনো মানেই হয়না।
.
-আপু চলো। রোমান ভাইয়ারা চলে এসেছে।
.
খালাতো বোনের ডাকে ঘোর কাটলো উপমার।
শান্ত গলায় বললো-
হু, চলো।
.
.
.
ডায়মন্ডের একটা রিং উপমার আঙ্গুলে রোমান পরিয়ে দিতেই মুখে হাসির ঝলক ফুটলো তার।
চারপাশে তাকিয়ে দেখলো,
মা বাবা সহ সকলের মুখেও হাসি।
রোমানের সাথে এনগেজমেন্ট হচ্ছে বলে পরিবারের সকলে খুশি। সেখানে আরাফের কথা ভেবে উপমার অখুশি থাকার প্রয়োজনই টা বা কি!
ভাববেনা উপমা আর আরাফের কথা। এখন থেকে শুধু রোমান কে নিয়েই ভাববে।
নতুন করে স্বপ্ন সাজাবে এবং তা বাস্তবে পূরণ ও করবে।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে রোমানের আঙ্গুলেও রিং পরিয়ে দিলো উপমা।
সকলের হাতের তালিতে মুখোরিত হয়ে উঠলো পুরো ঘরটা।
উপমা আজ হাসছে। তার ভালো থাকার মাধ্যম সে পেয়ে গিয়েছে।
একটা ভুল আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার কোনো মানেই হয়না।
সে কোনো অসহায় মেয়ে নয় যে আরাফের জন্য তার সব সহ্য করতে হবে। তার প্রাপ্য সে পেয়ে গিয়েছে, হ্যাঁ রোমানই তার উপযুক্ত জীবন সঙ্গী।
রোমান উপমার পাশে এসে ফিসফিস করে বললো-
লন্ডন থেকে এসেই বিয়েটা করে ফেলবো। অপেক্ষা করতে পারবেনা সুন্দরী কিছুদিন?
-কেনো নয়!
-ধন্যবাদ। আসো একটা সেলফি হয়ে যাক।
-হু।
.
.
.
ফেইসবুকিং করছিলো রুমানা।
উপমার সাথে তার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে।
কথাও হতো মাঝেমাঝে। সেই সুবাদে ফেইসবুকে এডও আছে সে।
উপমাকে ট্যাগ করে রোমান এনগেজমেন্ট এর ছবি আপলোড করেছে।
ছবিটা দেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ ছিলো রুমানা।
যে উপমার আশায় আরাফ এখনো আছে আর সে কিনা মাত্র ৮দিন পরেই এনগেজমেন্ট করে ফেললো!
রোমান ছবির ক্যাপশনে লিখেছে-
৮দিন আগে উপমার ইচ্ছে ছিলো, আজকের দিনেই যেনো বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে যায়। এতো তাড়াতাড়ি তো আর রাজকুমারী কে রাজরানী করার আয়োজন শুরু করতে পারিনা! তাই আজকে এনগেজমেন্টে আবদ্ধ হয়ে সম্পর্কে আরো এক ধাপ আগালাম। খুব তাড়াতাড়ি বিয়েটা হতে চলেছে আমাদের।
দোয়াপ্রার্থী সকলের কাছে।
.
ছবি আর ক্যাপশন দেখে রুমানার চোখ যেনো কপালে উঠে গেলো।
উপমার ইচ্ছে তে এনগেজমেন্ট টা হয়েছে!
আরাফের জন্য তার কি একটুও কষ্ট হচ্ছেনা?
হলে নিশ্চয় এভাবে ৩২দাঁত দেখিয়ে, এক গাল হেসে ছবি তুলতো না!
রুমানা উঠে দাঁড়ালো।
ছুটে গেলো সে আরাফের কাছে।
.
.
.
মাত্রই ওয়াশরুম থেকে বের হলো আরাফ।
নিচ থেকে শোরগোলের শব্দ ভেসে আসছে।
নিচে আসতেই সায়নীদের সাথে রুমানা কে দেখে সে বললো-
তুই আসলেই এইরকম শোরগোল শুরু হয়ে যায়, এটা কি করে ভুলে যাই আমি!
.
আরাফের উদ্দেশ্যে মুনিরা বললো-
যার জন্য অপেক্ষা করছিলি সে তো উড়াল দিলো।
-মানে?
-আজ উপমার আন্টি বদল হয়েছে। খুব ঘটা করে অনুষ্ঠান করলো।
.
আরাফের যেনো বিশ্বাসই হচ্ছেনা কথাটি।
রাগের বশে হয়তো উপমা অনেক কিছুই বলেছিলো তাই বলে এনগেজমেন্ট!
.
আরাফকে অবাক করে দিয়ে রুমানা বললো-
তুই তার নাম্বার ব্লক দিয়েছিলি আর সে তোকে সব কিছু দিয়েছে। তাই হয়তো আপলোডকৃত পিক গুলো চোখে পড়েনি তোর।
.
রুমানা এগিয়ে এসে আরাফকে ছবি দেখালো উপমা ও রোমানের।
সবটা দেখে চুপচাপ সে নিজের রুমে চলে আসলো আরাফ।
মেঝের উপর বসে পড়লো সে।
উপমার ছবি দেখে বড্ড আঘাত পেয়েছে সে।
তার হাসি, সাজগোজ এখন থেকে অন্য কারো জন্য।
তার বিয়ে করার এতো তাড়া!
এতোটা অসহ্য হয়ে গেলো আরাফ তার কাছে!
উপমা নতুন পথে পা বাড়িয়ে দিলো কিন্তু সে কেনো পারছেনা! এখনো কিসের আশা!
-আফসোস না হবার জন্য তোকে একটা মাস অপেক্ষা করতে বলেছিলাম। যাতে নিজেকে দোষী না ভাবিস তুই। আজ যদি তোর বিয়ের পরে উপমার এনগেজমেন্ট হতো, তুই ভাবতি তুই বিয়ে করেছিস বলেই সেও নিজের পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু দেখ, এমনটা কিন্তু নয়। হয়তো উপমা তোকে ভালোবাসে কিন্তু তোর মতো নয়। তার ভালোবাসায় খাদ রয়েছে।
.
সায়নীর কথার কোনো জবাব আরাফ দিলোনা।
মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো সে এক দৃষ্টিতে।
সায়নী আবারো বললো-
তুই চাইলে এবার মেহেনুবাকে বিয়েটা করে ফেলতে পারিস।
.
এপর্যায়ে মুখ খুললো আরাফ।
সায়নীর উদ্দেশ্যে বললো-
এতোটুক যখন সাথে থেকেছো আরেকটু থাকো বড় আম্মু। নিজেকে এক মাস সময় দিয়েছি। এর আগেই বিয়েটা করে ফেলতে চাইনা। এনগেজমেন্ট হয়েছে উপমার, বিয়ে না। আমি আরো ২২টা দিন দেখতে চাই। নাহলে তুমি যে বলেছিলে আফসোস? সেটা থেকে যাবে মনের মাঝে।
-হুম।
-তবে হ্যাঁ। আজ থেকে ঠিক ২২দিন পরেই বিয়েটা করবো আমি। আয়োজন শুরু করে দাও৷ যেমনটা তোমাদের ছেলের বিয়েতে করার ইচ্ছে ছিলো তেমন ভাবেই করো।
.
কোনো কথা বললো না সায়নী।
আরাফের জীবন। সে যা সিদ্ধান্ত নিবে তা মানতেই রাজি সে।
উপমাকে কতোটা ভালোবাসতো আরাফ, সে বুঝলো। এনগেজমেন্ট এর পরেও আরাফ আশা করছে তাকে নিয়ে!
ভালোবাসা ছাড়া এটা সম্ভব নয়।
আদৌ কি বুঝবে উপমা আরাফের ভালোবাসা? নাকি ২২দিন পরেই আরাফের জীবনে আসবে মেহেনুবা?

আজ আফরানের ছেলে আরাফ এর বিয়ে।
পুরো বাড়িটা জমকালো ভাবে সাজানো হয়েছে। এই বাড়ির একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা!
.
দেওয়ালে টাঙানো আফজাল খানের ছবির দিকে তাকিয়ে আফরান শান্ত গলায় বললো-
বাবা আজ তোমার নাতির বিয়ে। এই দিনটায় তোমায় খুব বেশি মনে পড়ছে। আর মনে পড়ছে…
-আব্বু?
.
ছেলের ডাকে পেছনে ফিরলো আফরান। বরের সাজে তার ছেলেকে দেখতে বেশ ভালোই লাগছে দেখে মুখে এক চিলতে হাসি ফুটলো আফরানের।
.
আফরানের পাশে এসে আরাফ তাকে জড়িয়ে ধরে বললো-
আগে গিয়ে আম্মুকে সালাম করে আসি। সবার পর তোমাকে করবো।
.
আরাফের কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো আফরান।
মৃদু হেসে সে বললো-
এতোদিন তো এমনি হয়ে আসছে। আজও এর ব্যতিক্রম হবেনা জানতাম।
.
আরাফ চলে যেতেই আফরান দেয়ালে টাঙানো বাবার ছবির পাশে মায়ের ছবি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো একটা।
বড্ড মনে পড়ছে আজ তার মা বাবাকে।
.
.
.
সায়নীর রুমে এসে আরাফ তাকে সালাম করলো।
সায়নী তাকে জড়িয়ে ধরে বললো-
সুখী হবি তুই ইনশাআল্লাহ।
-হুম বড় আম্মু। আজ আমার কোনো আফসোস নেই, নেই কোনো সংশয়।
.
আরাফের কপালে চুমু দিলো সায়নী।
আরাফ বললো-
এবার ছোট আম্মুকে সালাম করে তারপর আব্বুকে করে আসি।
-হুম তারপরেই মেয়ে আনতে যাবো আমরা।
.
.
.
লাল টকটকে কাতান শাড়ি, মাথায় সোনালী উড়না, গায়ে গহনা আর একেবারেই হালকা সাজে সেজেছে মেহেনুবা।
আজ তার বিয়ে! তবে এমন সাজে বিয়ের কনে কে স্টেজে বসে থাকতে দেখা যায়না।
তাকে দেখে থমকে গিয়েছিলো কিছুক্ষণ আরাফ।
এমন হালকা সাজে কোন বিয়ের কনে কে এতো ভালো লাগে আগে জানা ছিলোনা আরাফের।
.
স্টেজে পাশাপাশি বসে আছে মেহেনুবা ও আরাফ।
হ্যাঁ, ২২দিন কেটে গিয়েছে।
উপমা ফিরেনি। তাই কথানুযায়ী আরাফ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে মেহেনুবার সাথে।
আরাফের মনে কোনো সংশয় আর নেই।
জীবনে চলার পথে আমরা অনেক ভুল মানুষের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ি।
হয়তো তাদের মাঝে কাউকে একসময় ভালোওবেসে ফেলি।
কিন্তু ঠিকই একদিন তার আসল রূপটা প্রকাশ পায়।
ভালোবাসাকে সুযোগ দিবোনা এমনটা নয়! তবে ভুল মানুষকে বারবার সুযোগ দেয়ার কোনো মানেই হয়না। এতে বিপরীত হবে।
ভুল মানুষের সাথে জীবন জড়িয়ে একসময় সবই ভুল হয়ে যাবে!
উপমা তার জীবনের ভুল।
সবার ভালোবাসা পূর্ণতা পায়না। আরাফের টাও নাহয় অপূর্ণ থেকে গেলো!
.
.
পুরো ক্লাব শোরগোলে মেতে আছে।
প্রত্যেকটা মানুষই ভীষণ খুশি।
আরাফও আজ খুশি তার পরিবারের জন্য। তবে মেহেনুবা খুশি তো?
মেহেনুবার উদ্দেশ্যে ফিসফিসিয়ে আরাফ বললো-
ঠিক আছো তুমি?
.
মৃদু হেসে মেহেনুবা জবাব দিলো-
হু।
-ভালো আছো?
-হ্যাঁ।
-ঠিক আছে ভালো থেকো।
.
আরাফের কথা শুনে হেসে দিলো মেহেনুবা।
তার দিকে তাকিয়ে বললো-
আমরা কি এখন ফোনে কথা বলছি?
-কেনো?
-ভালো থেকো কি আবার?
-না মানে…
-ভালো রাখার দায়িত্ব তোমার আজ থেকে। আমি কিন্তু জোর করিনি তোমাকে। তাই ছ্যাকা খেয়ে ব্যর্থ প্রেমিকের মতো বসে থাকলে চলবে না। প্রেমিক থেকে বেরিয়ে আসবে, স্বামীর দায়িত্ব পালন করবে।
.
এ যেনো নতুন মেহেনুবা কে দেখছে আরাফ।
বউ রা বুঝি এমনি হয়!
.
.
রুমানা দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে তার হবু বরের সাথে।
মেহেনুবা ও আরাফকে ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে সে হবু বরের উদ্দেশ্যে বললো-
ভালো মানিয়েছে ওদের তাইনা?
-হুম। তবে আরাফ তার ভালোবাসা পায়নি।
-ভালোবেসেছে বলে কি ওই বাজে মেয়েটাকেই বিয়ে করতে হবে?
-না তা নয়। উপমা আরাফের যোগ্য নয়। তুমি আমার সবটা জেনে যেভাবে আমাকে সাপোর্ট করেছো, উপমাও পারতো সেভাবে সাপোর্ট করতে আরাফ কে। কিন্তু সে করেনি। উল্টো দিনের পর দিন অপমান করেছে।
তুমি দেখিও, একদিন উপমা বুঝবে তার ভুলটা।
-ওসব বাদ দাও। আমার বিয়েতে কিন্তু আমি এমন নরমাল সাজে সাজবো না। গর্জিয়াস সাজ দিবো। কালই বিয়ের শাড়ি কিনে দিবা আমাকে। আর ৬টা দিন বাকি মাত্র আমাদের বিয়ের।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
.

ঘন্টা খানেক পর…
নতুন বউকে সাদরে ঘরে প্রবেশ করালো সায়নী ও মুনিরা।
আরাফের পাশে মেহেনুবাকে দেখে মুনিরার দুচোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো।
তার কাধে সায়নী হাত দিতেই সে বললো-
খুশির অশ্রু আপু এটা! সঠিক মেয়েকে ছেলের জীবনসঙ্গী করতে পেরেছি। আজকের মতো খুশির দিন আর হতে পারে!
-হুম। তোর আশা পূরণ হয়েছে। আরাফকেও দেখ। সেও আজ সন্তুষ্ট।
-হ্যাঁ। তুমি ঠিকই বলেছিলে আপু। আরাফের মনে কোনো সংশয় না থাকার জন্য এই এক মাস প্রয়োজন ছিলো।
.
রুমানা মেহেনুবা কে নিয়ে এগিয়ে গেলো আরাফের রুমে।আরাফ হয়তো উপমার শোকে একটু আধটু ডং করবে। তুমি ওসব পাত্তা দিবেনা। নিজের অধিকার আদায় করে নিবা।
.
কথাটি বলেই মুচকি হেসে রুমানা বেরিয়ে গেলো।
বিছানার পাশেই নিজের স্যুটকেস দেখতে পেলো মেহেনুবা।
একটা সুতির শাড়ি বের করে এগিয়ে গেলো সে ওয়াশরুমের দিকে।
একটু পরেই রুমে প্রবেশ করলো আরাফ।
দরজাটা লাগিয়ে চুপচাপ বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে।
মেহেনুবা ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখা পেলো আরাফের। তার সামনে এসে আচমকা সালাম করে ফেললো আরাফ কে।
আরাফের কি করা উচিত বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ সে।
মেহেনুবা মৃদু হেসে বললো-
কিছু বলার দরকার নেই। আমি সম্পর্ক টা ধীরেধীরে আগাতে প্রস্তুত আছি। একটা সম্পর্ক মজবুত করতে বন্ধুত্ব করা খুবই প্রয়োজন। হবে আমার বন্ধু?
.
বউ বলছে বন্ধু হতে!
এতো ভালো কেনো মেহেনুবা টা!
আরাফ কি সত্যিই এই মেয়ের যোগ্য!
-কি হলো?
-হুম হবো।
-আমি কিন্তু বিছানায় শোবো বলে দিলাম৷
.
কথাটি বলে বিছানায় শুয়ে পড়লো মেহেনুবা।
সেরোয়ানি টা খুলে পাঞ্জাবি গায়েই তার পাশে শুয়ে পড়লো আরাফ।
আজ উপমা তার পাশে থাকলে হয়তো রাতটা অন্যরকম হতে পারতো৷ কিন্তু…
আর ভাবলোনা আরাফ।
চোখ জোড়া বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলো সে।
এদিকে মেহেনুবার চোখেও ঘুম নেই। তবে তার বিশ্বাস, তার ভালোবাসা আর বৈধ সম্পর্কের জোরে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আরাফও তাকে ভালোবাসবে।
.

সকালে মুনিরার ডাকে ডাইনিং রুমে আসতেই বাসার সকলের দেখা পেলো আরাফ।
সায়নী আরাফের উদ্দেশ্যে বললো-
আমরা সকলেই ঘুম ছিলাম। উঠে দেখি মেহেনুবা সকলের জন্য নাস্তা তৈরী করে ফেলেছে।
যেখানে আজ তার সকাল ১২টা পর্যন্ত ঘুমানোর কথা সেখানে দেখ! কি লক্ষি একটা মেয়ে মেহেনুবা।
.
মেহেনুবা হেসে বললো-
তোমরাই তো আমাকে মেয়ে এনেছো বলেছো, তাহলে কেনো আমি পুত্র বধু সেজে থাকবো!
-সেটাই।
-এখন বসো তো তুমিও। আমি সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছি।
.
আফরান বললো-
আমাকে আগে দাও। আমি কর্তা হই কিন্তু।
.
মুনিরা হেসে বললো-
কিসের কর্তা ফর্তা! আমি ওকে শুরু থেকেই বউ বানাতে ইচ্ছুক ছিলাম সো আগে আমাকে দিবে।
.
ওদের কথা শুনে মেহেনুবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
মুনিরা তার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো-
কর্তাকেই আগে দাও।
.
.
বাসার সকলের মুখে হাসি দেখে প্রাণ টা জুড়ে গেলো আরাফের।
থাক না সকলে মেহেনুবাকে নিয়েই ভালো, এতে করে উপমার করা অপমান হয়তো ভুলে থাকতে পারবে।
.
.
.
সকাল ১১টা….
রুমানা তার হবু বরের সাথে বিয়ের শপিং করতে এসেছে।
হঠাৎ একটা দোকানে চোখ পড়তেই দেখা পেলো উপমার।
সে লেহেঙ্গা দেখছে। দেখে মনে হচ্ছে সেও বিয়ের জন্যই লেহেঙ্গা দেখছে।
হবু বরকে দাড়াতে বলে রুমানা এগিয়ে গেলো উপমার কাছে।
-উপমা?
.
রুমানাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো উপমা।
তার উদ্দেশ্যে বললো-
আরে রুমানা তুমি! কেমন আছো?
-ভালোই। তুমি?
-অনেক ভালো। একা এসেছো?
-না। হবু বর এসেছে। তুমি?
-আম্মুর সাথে এসেছি৷ অন্য দোকানে সে।
-ওহ।
-আমি অনেক খুশি রুমানা।
-সে তো দেখেই বুঝছি। তা বিয়ের কেনাকাটা করছো নাকি?
-কি করে বুঝলে?
-মনে হলো।
-হুম। আরাফ কে ছাড়া আমি ভালোই আছি। বিয়েটা করে সেটা আরো বেশি ক্লিয়ার করবো।
-কিন্তু আরাফ তোমাকে ছাড়া ভালো ছিলোনা। জানো এই এক মাস সে কতো করে চেয়েছে তুমি ফিরে আসো, নিজের ভুল বুঝতে পেরে। কিন্তু তুমি ফিরোনি। বিয়ে ঠিক হওয়া স্বত্তেও নিজের ভালোবাসার জন্য এক মাস সময় দিয়েছে সে। কিন্তু তুমি ফিরোনি। আর তাই সে….
-কি?
-বিয়েটা করে ফেলেছে।
.
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে উপমা জিজ্ঞাসা করলো-
কোনো বস্তির মেয়েকে?
-বস্তির মেয়েদেরও তোমার মতো মানসিকতা নেই। যাই হোক, আরাফ বিয়ে করেছে মেহেনুবা কে।
.
কথাটি শুনে চুপ হয়ে গেলো উপমা।
রুমানা আবারো বললো-
আমার হবু বরের মা কি করেছে জানো? তার যখন দশ বছর বয়স, তাকে ও তার বাবাকে ছেড়ে তিনি অন্য একজন পুরুষের সাথে পালিয়ে গিয়েছেন।
এটা নিয়ে আমার দাদি ঝামেলা করলেও আমি তার সাথে থেকেছি। মানুষে কথা শোনালেও আমি ভরসা দিয়েছি। কেনো জানো? ও যেমনটা আমাকে ভালোবাসে ঠিক তেমনি আমিও ওকে ভালোবাসি। ওর পরিবারের এসব কারণের জন্য ওকে আমি ছেড়ে দিবো, এমনটা ভাবিনি। আমি ওকেই বিশ্বাস করেছি। সেই জায়গায় তুমি কি করেছো আরাফের সাথে! আরাফ কে কষ্ট দিয়ে নিজে সুখী হতে পারবে তো?
-কেনো নয়! রোমানও আমাকে ভালোবাসে।
-তাহলে আজ তুমি একা কেনো?
রোমান কই?
-ওর এসবের সময় আছে নাকি! ইঞ্জিনিয়ার ছেলে।
-আরাফও কিন্তু বুয়েটের স্টুডেন্ট। তবুও বাবার সাথে ব্যবসায় জয়েন দিয়েছে। মায়েদের কথায় সে মেহেনুবার সাথে কেনাকাটা থেকে শুরু করে সবকিছুতে সাথে ছিলো। আর তার ভালোবাসার সাথে বিয়ে হলে কি করতো বুঝতে পারছো কি?
শুধু আরাফ না। তোমাকে মাথায় করে রাখতো আন্টিরাও। তাদের একমাত্র ছেলের বউ হতে তুমি। আরাফের ভালোবাসা তুমি। আরাফকে তারা কতোটা ভালোবাসেন আর তার ভালোবাসাকে ভালোবাসবে না এটা কি করে হয়!
.
নিশ্চুপ হয়ে আছে উপমা।
রুমানা বললো-
তোমাকে আমি ব্লক করে দিয়েছিলাম। আজ খুলে দিবো। আরাফ ও মেহেনুবার সাথে পুরো খান পরিবারের ছবি দেখিও।
অবশ্য ভালোই হলো, তুমি আরাফের যোগ্য না। যে যোগ্য সে এসে এসেছে ওর লাইফে।
আমার বিশ্বাস। ধীরেধীরে মেহেনুবার প্রেমে আরাফ পড়বে, বৈধ সম্পর্কের জোরে।
.
.
রুমানা হনহনিয়ে চলে গেলো।
একটু পরে রুপা আক্তার আসলে উপমা বললো-
বাসায় যাবো আম্মু আমি।
-কেনো? আরে লেহেঙ্গা…
-পরে নেবো।
.

বাসায় এসে নিজের রুমের বিছানায় বসে পড়লো উপমা।
মোবাইল হাতে নিয়ে ফেবুতে রুমানার আইডি সার্চ দিলো সে।
আরাফের বিয়েতে হাসিমাখা সকলের মুখ দেখে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেললো উপমা।
রুমানার বলা কথাগুলো বড্ড আঘাত দিচ্ছে তাকে।
আরাফ তার জন্য আশা করে ছিলো!
আর সে কিনা বিয়ে করে আরাফ কে কষ্ট দিতে চেয়েছে। অথচ সেই কষ্ট আজ নিজে ভোগ করছে।
এ কি করে ফেললো সে! আরাফের ভালোবাসা কে অবহেলা করলো উপমা।
কিসের জন্য?
জেদ এর জন্য!
.
উঠে পড়লো উপমা। পায়চারী করতে লাগলো সারারুম জুড়ে।
যেখানে মেহেনুবার মতো ভালো পরিবারের মেয়ে আরাফের বউ হতে পেরেছে সে কেনো এমন ভুল করলো!
কেনো সে আরাফের সাথে এমন করলো!
.
মেঝেতে বসে পড়লো উপমা।
চোখ দিয়ে ঝরছে তার অনবরত পানি।
আজ সে বুঝতে পারছে। কতো বড় ভুল সে করেছে!
তবে এখন কি কিছুই করার নেই?
হুট করে মনে পড়লো রুমানার একটা কথা উপমার।
‘আমার বিশ্বাস। ধীরেধীরে মেহেনুবার প্রেমে আরাফ পড়বে, বৈধ সম্পর্কের জোরে।’
তারমানে আরাফ এখনো উপমাকেই ভালোবাসে!
সে ফিরে গেলে গ্রহণ করবে তাকে!
কেনো নয়!
হ্যাঁ সে যাবে। যাবে আরাফের কাছে উপমা।
আরাফ নিশ্চয় এই উপমাকে ফিরিয়ে দিবেনা, যে কিনা ভুল বুঝে অনুতপ্ত হয়ে ফিরে যাবে!
পরক্ষণেই তার মনে পড়লো মেহেনুবার কথা।
আরাফ কি নিজের ভালোবাসার জন্য ত্যাগ করতে পারবে মেহেনুবাকে!

কাল রাতে মেহেনুবা ও আরাফের জন্য বাসর ঘর সাজিয়েছিলো রুমানা।
গোলাপ ফুলে পুরো রুমটা সাজানো।
সারারাত সুগন্ধি তে ভরপুর ছিলো রুমটা।
মেহেনুবার ইচ্ছে করছেনা ফুলগুলো সরাতে তবুও সে রুম পরিষ্কারের কাজে হাত লাগালো।
পরক্ষণেই নিচে চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পেলো মেহেনুবা।
ছুটে গেলো সে নিচের দিকে।
.
.
-লজ্জা করেনা তোমার? কোন মুখে এখানে এসেছো তুমি?
.
মুনিরার করা প্রশ্নে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো উপমা।
সায়নী মুনিরার উদ্দেশ্যে বললো-
মুনিরা শান্ত হো। কেনো এসেছে মেয়েটা শান্তভাবেই জিজ্ঞাসা কর।
.
আরাফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উপমার দিকে।
তার চোখ দুটো ফুলে আছে, আবার সেই চোখ দুটোই ছলছলে, নাকটা লাল, কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে অনবরত, চুলগুলো এলোমেলো।
এই কি অবস্থা করেছে মেয়েটা নিজের!
.
মেহেনুবা নিচে এসে উপমা কে দেখে চিনতে পারলোনা।
আরাফের পাশে এসে সে জানতে চাইলো-
কে মেয়েটি?
-উপমা।
.
উপমা!
নামটি শুনেই বুকটা ধুক করে উঠলো মেহেনুবার।
সে কেনো এখানে এসেছে!
আর তার এই অবস্থা কেনো!
.
সায়নীর কথা অগ্রাহ্য করে উপমার দিকে তাকিয়ে মুনিরা ধমকের সুরে বললো-
চুপ করে আছো কেনো?
.
এপর্যায়ে মুখ খুললো উপমা।
ছলছলে নয়নে তাকিয়ে বললো-
আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। ক্ষমা চাইতে এসেছি আপনাদের কাছে।
.
কথাটি শুনে মুনিরার যেনো মনটা গলে গেলো। সে নরম সুরে বললো-
ওহ! তা নিজের এই অবস্থা করেছো কেনো?
সে কথার জবাব না দিয়ে আরাফের সামনে আসলো উপমা।
আরাফের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো-
বিয়েটা তবে করেই ফেললে?
বুকটা কাঁপলো না তোমার?
.
খুব স্বাভাবিকভাবেই আরাফ বললো-
তোমার কাঁপেনি?
-তুমি তো আমাকে ভালোবাসতে বলতে।
-সে তো তুমিও বলতে।
-আমি ভুল করেছি আরাফ। যা করেছি জেদের বসে। আমাকে কি ক্ষমা করা যায়না? তুমি আমাকে ক্ষমা না করলে আজীবন কষ্ট পাবো আমি।
-ভুল বুঝতে পেরেছো এটাই অনেক।
-সত্যি?
-হ্যাঁ।
-তাহলে আমার ভুলকে ভুলে গিয়ে তোমার জীবনে ঠাঁই দাও আমাকে৷ তাহলেই বুঝতে পারবো, তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো।
.
উপমার কথা শুনে পুরো খান বাড়ি যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো।
উপমা আরাফের দিকে তাকিয়ে বললো-
আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। মেহেনুবার সাথে তো তুমি জেদের বসে বিয়ে করেছো। আমি যখন ভুল বুঝে চলেই এসেছি এখন তো মেহেনুবার আর প্রয়োজন নেই। সে ভালো ফ্যামিলির মেয়ে। অন্য জায়গায় বিয়ে হতে তো সমস্যা নেই।
.
মুনিরা কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই সময়ই আরাফ বললো-
আমি জেদের বসে বিয়েটা করিনি উপমা।
আর তুমি কি করে ভাবলে এই প্রস্তাবে আমি রাজি হবো?
তুমি এসব বলছোই টাই বা কি!
আজ তুমি এসব বলছো উপমা!
তুমি! তোমার না আমার মা বাবার বিষয় নিয়ে সমস্যা ছিলো? আজ যদি আমি একটা বিয়ে করে তাকে ছেড়ে আরেকটা বিয়ে করি এটা নিয়ে কি আমার প্রজন্মের ক্ষতি হবেনা?
-আমিতো স্বীকার করলাম আমার ভুল হয়েছিলো!
তুমি আমাকে ভালোবাসো না বলো?
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আরাফ বললো-
নাহ। তোমার জন্য এখন যেটা কাজ করছে সেটা শুধুই মায়া। অন্য কিছু নয়। আমার মনে তোমার জন্য কোনো ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই। তবে ঘৃণাও নেই।
.
কথাটি শুনে উপমা আর স্থীর থাকতে পারলোনা।
অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে।
.

আফরান নিজের রুমেই ছিলো। কাল সবেমাত্র বিয়েটা হয়েছে। এতো ধকল গেলো, তাই আজ কেউ অফিসে যায়নি।
এতক্ষণ রুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সবটা শুনেছে আফরান।
এই কোন ঝড় আসতে চলেছে আরাফের জীবনে! সামাল দিতে পারবে তো সে? নাকি তার মতো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে!
.
আফরান এগিয়ে গেলো আরাফের রুমের দিকে।
তার সাথে কথা বলাটা প্রয়োজন এখন।
.
.
ছেলের রুমে আসলো আফরান।
তার পাশে বসে বললো-
আমার জীবনে প্রথম ভুল কি জানিস? বাবাকে না জানিয়ে সায়নীকে বিয়ে করা। দ্বিতীয় ভুল মুনিরাকে বিয়ে করা। তৃতীয় ভুল বিয়ে করে আনার পরেও তার কাছে সবটা গোপণ রাখা।
এর পরে যা হয়েছে সবটা আমার একার ভুলে নয়। কিছুটা তোর বড় আম্মু আর কিছুটা তোর ছোট আম্মুরও ভুল ছিলো।
যদিও বা আমরা ভালো আছি। কিন্তু কতোটুকুই বা ভালো আছি!
যখন সায়নীকে ভালোবাসতাম মুনিরা কি কষ্ট পেতোনা? পেতো।
আর যখন মুনিরার সাথেও স্বাভাবিক হতে শুরু করি তখন কি সায়নী কষ্ট পেতোনা? পেতো।
১৫দিন সায়নীর কাছে থাকলে আর ১৫দিন মুনিরার কাছে থাকতাম।
কিন্তু নিজেও হীনমন্যতায় ভুগতাম।
কার সাথে অন্যায় করছি আমি! চিন্তায় অস্থির হয়ে যেতাম। দুইজন স্ত্রী থাকা স্বত্তেও এখন একা থাকি আমি। ওই যে অপরাধবোধ কাজ করে। আমিতো দুজনেরই অপরাধী আরাফ!
কিন্তু পরিস্থিতির চাপে হলেও বৈধ সম্পর্কের জোরে আমি কারো কাছ থেকে আলাদা হতে পারিনি।
তুই আমাদের সম্পর্কে নতুন মোড় নিয়ে এসেছিলি। তোর জন্যই বন্ধন টা দৃঢ় হয়েছে আরো।
কিন্তু মাঝেমাঝে আফসোস থেকেই যায়।
সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে হয়তো আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। তোর ভালোবাসা কেও হারাতে হতোনা!
-আব্বু এসব বলোনা তুমি।
আমার জীবনে যেটা হবার ছিলো সেটাই হয়েছে। কিন্তু উপমা যে আমার বিয়ের পরের দিনই ভুল বুঝে ফিরে আসবে ভাবিনি।
-পরিস্থিতি মানুষকে কখন অসহায় করে তুলবে বোঝাই মুশকিল। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
নাহয় আমার মতো দুটানাময় হয়ে যাবে জীবন। যেটা কারো জন্যই কাম্য নয়।
.
বাবার দিকে তাকিয়ে আরাফ বললো-
হুম বাবা। আমি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিবোনা। বড় আম্মু নিজেকে এক মাস সময় নিতে না বললে হয়তো আজ আমি দুটানায় পড়ে যেতাম। কিন্তু না। আমি এমন কিছু করতেই পারিনা।
-উপমা যে তোর ভালোবাসা…
-হ্যাঁ। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত নিজেকে সময় দিয়েছিলাম।
উপমার ফিরেনি। এখন আমি অন্য একটা সম্পর্কে আবদ্ধ। এটা থেকে পিছপা আমি হতে পারিনা।
.
ছেলের কথা শুনে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললো আফরান।
তার সাথে যা হয়েছে সবটা সামাল দেয়া এতোটা সহজ ছিলোনা।
তার ছেলের সাথে এমন কিছু হোক সে চায়না।
.
.
.
উপমার জ্ঞান ফিরতেই দেখা পেলো মেহেনুবার।
বিছানার পাশেই বসে আছে মেহেনুবা।
উপমা উঠে তার পাশে এসে বসলো।
মেহেনুবা ভেবেছিলো সে হয়তো রাগ ঝাড়বে তার উপর।
কিন্তু এমন কিছুই হলোনা।
শান্ত স্বরে মেহেনুবার উদ্দেশ্যে উপমা বললো-
আমার আরাফ কে কি ফিরিয়ে দেয়া যায়না? তুমি বললে হয়তো সে ফিরে আসবে।
.
নিশ্চুপ হয়ে আছে মেহেনুবা।
উপমা বললো-
ভিক্ষা তো দেয়া যায় আমাকে?
-নিজের ভালোবাসা অন্যকে উপহার বা ভিক্ষা দেয়া যায়না উপমা।
-নিজের ভালোবাসা বলতে?
-আমিও ভালোবাসি আরাফ কে। কি করে ওকে তোমার হাতে তুলে দিবো বলতে পারো?
-কিন্তু আরাফ আমাকে ভালোবাসে।
-যদি তাই হয়, আরাফ যা সিদ্ধান্ত নিবে আমি মেনে নেবো। তবে আমি ওকে নিজ থেকে তোমার হাতে তুলে দিতে পারবোনা।
-আরাফ কে ডেকে দেবে একটু?
-হু।
.
.
আরাফের রুমে আসলো মেহেনুবা।
আরাফের উদ্দেশ্যে সে বললো-
ডাকছে তোমাকে উপমা।
-কেনো?
-জানিনা।
-চলো।
-আমি কেনো!
-যা কথা হবে তোমার সামনেই হবে মেহেনুবা।
.
.
বিছানার এক পাশেই উপমার ফোনটা রেখেছিলো মেহেনুবা।
তার ফোন বেজে উঠলে রিসিভ করলো সে।
ওপাশ থেকে রুপা আক্তার বললেন-
কোথায় গিয়েছিস তুই?
-আরাফের বাসায় আছি।
-মানে টা কি!
-আমি আরাফ কে ভালোবাসি।
তোমাদের কথায় এসে এতো ভুল আমি করেছি।
-রোমানের কি হবে উপমা! তাছাড়া তুই কি করে ভুলে গেলি? দুই সতীনের জন্য আরাফ তোর গায়ে হাত তুলেছে।
-আমি ভুলে যাইনি আম্মু। ভুলবোও না। কিন্তু তাদের জন্য আমি নিজের ভালোবাসা হারাতে পারিনা! আমি ভুল বুঝার ভান করে আরাফকে বিয়েটা করবো। তারপরেই নিজের মাঝে আরাফকে আসক্ত করে এই দেশ ছেড়ে চলে যাবো আমরা। থাকবোনা এখানে।
-এসব কি বলছিস তুই!
-হ্যাঁ। এই প্লানটা আমার আগে করাই উচিত ছিলো। তোমাদের কথা না শুনলে এই দিন দেখতে হতোনা। আরাফের বিয়ে টাও হতোনা। এখন আবার ডিভোর্স এর অপেক্ষা।
-আরাফের বিয়েও হয়েছে! আর তুই কি বলছিস এসব?
-আম্মু তোমরা চুপচাপ থাকো। নাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।
.
ফোনের লাইন কেটে বন্ধ করে দিলো উপমা।
পেছনে ফিরতেই আরাফ ও মেহেনুবাকে দেখতে পেলো সে।
আরাফ তার পাশে এসে বললো-
বাহ! খুবই ভালো প্লান তো! তুমি ভাবলে কি করে? তোমার কথায় গলে গিয়ে আমি আমার পরিবার কে অগ্রাহ্য করবো?
-আরাফ আমি আসলে….
-আর কতো বাহানা দিবে তুমি?
মনুষ্যত্ব বলতে একটা জিনিস আছে। এটা আছে তোমার মাঝে?
-আই এম সরি আরাফ!
-তুমি এখুনি বেরিয়ে যাবে। মেহেনুবাকে আমি ছাড়বো না।
-যে সম্পর্কে ভালোবাসা নেই সেই সম্পর্কে বন্ধন টা থাকবে তো?
-সিরিয়াসলি! ভালোবাসা বুঝো তুমি?
শুধু ভালোবাসলেই হয়না। বিশ্বাস ও সম্মানটাও থাকা চায়। আর এই বিশ্বাস, সম্মান থেকেই একে অপরকে মনে প্রানে ভালোবাসে এবং দুজন-দুজনকে কাছে পেতে চায়।
কি করেছিলে তুমি আমাকে? বিশ্বাস নাকি সম্মান? করেছো শুধুই অপমান।
-ভুল বুঝতে পেরেছি আরাফ আমি!
-ওহ রিয়েলি! তাই এসব প্লানের কথা বলেছিলে ফোনে?
.
কিছুক্ষণ চুপ থেকে উপমা বললো-
হ্যাঁ আমি মানছি যে আমি তোমার মায়েদের মেনে নিতে পারবোনা। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাই তোমার বিয়ের কথা শুনে ঠিক থাকতে পারিনি। ছুটে এসেছি। তোমার মায়েদের পছন্দ না মেহেনুবা? ঠিক আছে সে থাকুক। আমাকেও তুমি বিয়ে করো। মেহেনুবা তোমার দায়িত্ব আর আমি তোমার ভালোবাসা। দুজনেই থাকলাম তোমার সাথে।
তোমার বাবা তো দুটো বিয়ে করেছে। তোমার জন্য এটা কঠিন হবেনা আশা করি।
.
সায়নী এতক্ষণ যাবৎ দরজায় দাঁড়িয়ে সবটা শুনছিলো। এ পর্যায়ে প্রবেশ করলো সে।
সায়নী বললো-
আমাদের জন্য সবটা সামলানো এতোটা সহজ ছিলোনা উপমা।
মুনিরা অনেক সাধনার পরে আফরানের ভালোবাসা পেয়েছে। তার কি কষ্ট হতোনা তাকে ফেলে আফরান যে আমাকে নিয়ে মেতে থাকতো?
হ্যাঁ হতো। কিন্তু আস্তেধীরে যখন আফরান তাকেও অধিকার দেয় আমার মনে কতোটা জ্বালা করেছে সেটা বোঝার ক্ষমতা কারো নেই। আমি সবটা করেছিলাম সেই আমিই কিন্তু মানতে পারতাম না আফরান আর মুনিরার সহজ হওয়াটা। তবুও তাদের বুঝতে দিইনি এসব। আরাফের আগমনে আমাদের সম্পর্ক টা হয়তো সহজ হয়ে এসেছিলো। তবুও মনের মাঝে সবারই একটা আফসোস থেকেই যায়।
ইশ! যদি আগে ভুলটা না করতাম!
শুধু সমাজ নয়, নিজেদের মাঝেই এসব মেনে নেয়া এতোটা সহজ নয় উপমা।
আমরা পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। কিন্তু তুমি? বারবার সুযোগ এসেও কাজে লাগাওনি। আর সেই তুমি কিনা বলছো দ্বিতীয় বউ হতে রাজি!
পারবে তো এসব সামাল দিতে?
সমাজ, লোকের কথা, মেহেনুবাকে মেনে নিতে?
-হ্যাঁ। ভালোবাসার জন্য মানুষ কিনা পারে!
-কিন্তু আমি পারবোনা আরাফ কে ভাগ করে নিতে।
.
মেহেনুবার কথা শুনে তার দিকে দৃষ্টি দিলো সকলে।
সে আরো বললো-
আমরা কোনো পরিস্থিতির শিকার নয়। আরাফ সবটা বুঝেই আমাকে বিয়ে করেছে আর আমি আরাফকে। হয়তো ও আমাকে ভালোবাসেনা। কিন্তু আরাফ যদি উপমাকে ভালোবেসে থাকে, তার সাথে থাকতে চায় থাকতেই পারে। আমি পারবোনা থাকতে। আমি ডিভোর্স দিয়ে চলে যাবো।
নিজের ভালোবাসা অন্য কারো সাথে ভাগ আমি করে নিতে পারবোনা জেনে শুনে!
.
এই প্রথম মেহেনুবা সহজ সরল স্বীকারোক্তি দিলো তার ভালোবাসা নিয়ে।
মেহেনুবা ভালোবাসে আরাফকে!
এই ভালোবাসা পবিত্র ভালোবাসা। যেখানে সম্মান, বিশ্বাস, পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা সবই আছে।
উপমার পাগলামির জন্য মেহেনুবাকে হারাতে পারেনা আরাফ!
তার মনে উপমার জন্য এতক্ষণ একটু হলেও কষ্ট হচ্ছিলো তবে মায়ের সাথে উপমার ফোনের কথা শুনে যেনো তাও উধাও হয়ে গেলো।
সে ভেবেছিলো ভালোবাসাকে ত্যাগ করবে সম্পর্কের জন্য কিন্তু না এখন সে ভুল মানুষকেই ত্যাগ করবে।
আরাফ উপমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-
তুমি যাবে নাকি তোমার বাসায় খবর দিবো আমি? শুরুটা যেখান থেকে হয়েছিলো শেষটা সেখানে হবে ভাবলে কি করে!
তোমাকে বিয়ে আমি করবোনা। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি খান বাড়িতে আর হবেনা।
-হবেনা। উপমার মা এসেছে। ড্রয়িংরুমে আয়।
.
মুনিরার সাথে
সকলে ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখা পেলো রুপা আক্তারের।
তার পাশেই রয়েছে রুমানা।
রুমানা বললো-
মুনিরা আন্টির কথায় উনাকে এখানে নিয়ে আসলাম আমি।
.
রুপা আক্তারের উদ্দেশ্যে মুনিরা বললো-
খুব তো বলেছিলেন ২বউ এর পরিবারে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিবেন না। আজ আপনার মেয়েই কিন্তু আরাফের দ্বিতীয় বউ হতে চাইছে। আজ কই গেলো তার আত্নসম্মান?
-এভাবে কেনো বলছেন! উপমা ভালোবাসে আরাফ কে।
-ওহ তাই! আমার তো মনে হচ্ছে অনেক ভদ্র করেই বলছি। আপনার অতি ভদ্র মেয়েকে নিয়ে চলে যান খান বাড়ি ছেড়ে।
.
সায়নী বললো-
আমরা কোনো ঝামেলা চাইনা। আপনাদের অপমান করার ইচ্ছেও আমাদের নেই। যতোদ্রুত সম্ভব উপমার বিয়েটা সেরে নিন অন্য কারো সাথে।
.
রুপা আক্তার মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন-
আয় মা। বাসায় চল।
.
উপমা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো আরাফের দিকে।
এই দৃষ্টি আজ তাকে দূর্বল করতে পারছেনা।
তার আকুতিও তো দূর্বল করতে পারেনি উপমাকে!
উপমা বললো-
কিছুদিনের দুরুত্ব আমাদের সম্পর্ক টাকে শেষই করে দিলো!
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আরাফ বললো-
দূরে থাকলেই সম্পর্ক নষ্ট হয়না। অহংকার, অসম্মান, জেদ নষ্ট করে সম্পর্ক কে। এই তিনটাই তোমার মাঝে বিদ্যমান ছিলো। যাই হোক,
ভালো থেকো উপমা।
.
রুমানা উপমার পাশে এসে বললো-
আমি বলেছিলাম ধীরেধীরে আরাফ ভালোবাসবে মেহেনুবাকে৷ কিন্তু এটা বলিনি যে আরাফ তোমাকে এখনো ভালোবাসে। ভালোবাসা কে যত্ন করে ধরে রাখতে হয় উপমা। নাহলে তা হারিয়ে যায়। আজ তোমার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে।
এখন আসতে পারো তুমি।
.
উপমা চলে যাচ্ছে।
আরাফ নিজের রুমের দিকে ছুটে গেলো।
মুনিরা রুমানার উদ্দেশ্যে বললো-
কেনো যে উপমাকে ওসব বলতে গেলি তুই!
.
সায়নী বললো-
ভালোই হলো একদিকে। আরো একটা রূপ আমরা দেখতে পেলাম উপমার।
.

এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো আরাফ কে আমি হারিয়ে ফেলবো!
মনেহয়েছিলো সে বেছে নিবে উপমা কে।
যদি তার পরিবার নিয়ে কথা না বলতো উপমা তবে কি করতো আরাফ?
সে তবুও মেহেনুবার কেই বেছে নিতো বৈধ সম্পর্কের জন্য?
.
মনের মাঝে এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মেহেনুবার।
রুমের ভেতর প্রবেশ করে আরাফ কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলো সে।
মেহেনুবা তার সামনে এসে বললো-
তুমি হয়তো আজ তোমার পরিবারের কথা ভেবে নিজের ভালোবাসাকে ত্যাগ করেছো। যতোই মুখে বলোনা কেনো উপমাকে ভালোবাসোনা তুমি। কিন্তু তোমার চোখে ওর জন্য আমি ভালোবাসা দেখছি।
তবে আমার বিশ্বাস সম্পর্কের জোরে আমাদের মাঝেও সবটা ঠিক হয়ে যাবে।
.
মেহেনুবা বিছানার এক পাশে বসলো।
আরাফ ফোনটা হাতে নিয়ে ডায়াল করলো তাসুর নাম্বারে।
ওপাশ থেকে রিসিভ করতেই আরাফ বলে উঠলো-
তোমার ধারণাই সঠিক তাসু। তোমার বোন তো আমাকে ভালোবাসে এবং তা আগে থেকেই।
.
তাসু উৎসুকভাবে বললো-
আপু বলেছে?
-একেবারে সহজ সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছে।
.
এই যা! তাসুকে এসব কি বলছে আরাফ! লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার।
সে বারান্দায় চলে গেলো।
এদিকে তাসুর সাথে ফোনে কথা বলা শেষে বারান্দায় আসলো আরাফ।
মেহেনুবার উদ্দেশ্যে বললো-
মানুষ ভালোবাসার মানুষটাকে হারাতে চায়না, ভুলতে চায়না।
কিন্তু আমি চাই। কারণ আমার টা ভালোবাসা ছিলোনা। ছিলো ভুল। তুমি তোমার ভালোবাসা দিয়ে পারবেনা আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতে? পারবেনা যেভাবে বাসার সবার মনে জায়গা করেছো সেভাবে আমার মনেও জায়গা করতে?
এই মনে শুধু একজনকেই রাখতে চাই আমি। আর সে হলো আমার বৈধ স্ত্রী। ভালোবাসো, বন্ধুত্ব করেছো। এখন দায়িত্ব এটাও নাও। পারবেনা বলো?
.
মুচকি হেসে মেহেনুবা বললো-
পারবো।
.সকাল সকাল চোখটা খুলতেই নিজেকে আফরানের বুকে আবিষ্কার করলো মুনিরা।
কাল রাতে প্রথম সে আর আফরান কাছাকাছি এসেছে।
আফরান তাকে স্ত্রীর অধিকার দিয়েছে।
নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে মুনিরার।
আফরানের ঘুম না ভাঙে মতো তার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে দিলো মুনিরা।
বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইলে হাতের টান পড়ে আবারো আফরানের বুকে ফিরে আসলো সে।
আফরান জেগে আছে!
নিজের কর্মের জন্য লজ্জা পেলো মুনিরা।
আফরান বললো-
লজ্জা পেলে তোমাকে আরো ভালো লাগে মায়াবতী।
.
.
আফরান ও তার আগের সময়ের কথা মনে পড়তেই মুখে মৃদু হাসি ফুটলো মুনিরার।
সম্পর্ক সে তো এক আলাদা শক্তি।
নাহলে এতো সহজ ছিলোনা আফরানের ভালোবাসা পাওয়া।
ভুল করে সম্পর্কে জড়ালেও বৈধ সম্পর্কের জোরে সে আজও এই বাড়িতে আছে।
ঠিক এভাবে মেহেনুবাও আরাফের মনে জায়গা করে নিবে দৃঢ় বিশ্বাস তার।
.

মুনিরা উঠে এগিয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে।
রান্নাঘরে এসে সায়নী ও মেহেনুবাকে দেখে বললো-
শুভ সকাল। কিন্তু মেহেনুবা তুমি নতুন বউ হয়ে এতো সকালে কেনো উঠো! কাজ করার সময় অনেক আছে। আগে তো একটু এনজয় করো বিবাহিত লাইফ টা।
-না ছোট আম্মু সমস্যা নেই। আমার ভালোই লাগছে করতে।
.
মুনিরা ভেতরে এসে বক্স থেকে ময়দা ঢালছে গামলায়।
মেহেনুবা বললো-
একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?
.
সায়নী বললো-
হুম করো।
-বাবা একা থাকেন কেনো?
-এমন সে আগেও করতো। ওই রুমেই থাকা শুরু করে দিতো।
-কিন্তু কেনো?
-হীনমন্যতা কাজ করে আফরানের মনে। সে ভাবে আমাদের সাথে অন্যায় করছে সে।
-আমি আম্মুর কাছে আপনাদের পুরো কাহিনী শুনেছি বড় আম্মু।
আপনাদের সাথে যা ঘটেছে তাতে কিন্তু কারো দোষ ছিলোনা। পরিস্তিতির শিকার ছিলেন আপনারা। কিন্তু জানেন আম্মু?
এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে একের অধিক বউ আছে। তাদের স্বামী প্রথম বউ কে ঠকিয়ে বিয়ে করে অন্যজনকে। একাধিক বিয়ে করার ফলে সমান অধিকার দিতে পারেনা। একজন কে অধিকার দিয়ে অপরজনকে বঞ্চিত করে। শুধুমাত্র ভোগের জন্যই আরেকটা বিয়ে করে।
আব্বু কিন্তু এমনটা করেন নি।
পরিস্থিতির চাপে পড়ে ছোট আম্মুকে বিয়েটা করেছিলেন। হ্যাঁ মানলাম সবারই কিছুনা কিছু ভুল ছিলো। কিন্তু আপনাদের মাঝে যে বন্ধন টা আছে অন্য কোন দুই সতীনের পরিবারে সে বন্ধন টা নেই। কেনো জানেন? তাদের স্বামী ঠিক নেই। ঠকিয়ে বিয়ে করা, দায়িত্ব পালন না করা, দুই সতীনের মাঝে হিংসাপরায়ণতা এসবের জন্যই ভালো থাকতে পারেনা তারা।
আব্বু সেইসব লোকের মধ্যে পড়েনা যারা ভোগের জন্য আরেকটা বিয়ে করেছে। আরেকটা বিয়ের পরেও বড় আম্মুকে ভুলে যাননি তিনি।
আবার ছোট আম্মুর সাথেও অন্যায় তিনি করেন নি।
ভালোবাসা টা এতো সহজ না। তাই একটু সময় লেগেছে ছোট আম্মুকে মনে জায়গা দিতে।
তাহলে কেনো তিনি হীনমন্যতায় ভুগবেন!
.
মেহেনুবার কথা শুনে একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সায়নী ও মুনিরা।
.
মেহেনুবা আরো বললো-
কাল যদি আরাফ উপমার সাথে থাকতে চাইতো আমি চলে যেতাম। আবার যদি আরাফ আমাকে না জানিয়ে উপমাকে বিয়ে করে আনতো আমি হয়তো যেতাম না।
জেনে শুনে হয়তো আমি আরাফের ভাগ কাউকে দিতে পারতাম না। কিন্তু পরিস্থিতির শিকার হলে ঠিকই দিতাম। তবে তোমাদের মতো মিলেমিশে উপমার সাথে কখনোই আমি থাকতে পারতাম না।
.
মেহেনুবার মাথায় হাত বুলিয়ে সায়নী বললো-
কতো কিছু বুঝো তুমি!
আমরা অনেক খুশি তোমার মতো একটা মেয়ে পেয়ে।
.
মুনিরাও মৃদু হেসে বললো-
আসলেই।
.

সকাল সকাল দরজার কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে দরজা খুলে সায়নীর দেখা পেলো আফরান।
দুজনে পাশাপাশি বসলো বিছানার উপরে।
সায়নী বললো-
আমাদের সাথে যা হয়েছে আরাফের সাথে হয়নি বলে আমি অনেক খুশি। এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো আরাফ হয়তো উপনার জন্য কষ্ট পাবে। তাকে আবার ফিরে পেতে চাইবে। কিন্তু এমনটা হয়নি।
জানো মেহেনুবা কি বলেছে?
নিজের ভালোবাসার ভাগ সে দিতে পারবেনা জেনে শুনে।
-কিন্তু তুমি দিয়েছিলে।
-জেনে শুনে? না। পরিস্থিতি টাই এমন ছিলো। আমি তো ভেবেছিলাম আমি মরেই যাবো…..
-সায়নী!
-তারপরের সব কিছু তো অজানা নয়। আসলে আমাদের নিয়তিই হয়তো এমন ছিলো। ভুলে হোক, মায়ায় পড়ে হোক, সম্পর্কের টানে হোক আমরা তিনজন এক সুতোয় গেঁথে গিয়েছি।
-হুম।
-কিন্তু তুমি এখন যা করছো আমাদের সাথে তা কিন্তু অন্যায়।
-আমি কি করলাম?
-এই যে নিজে বাবার রুমে থাকো। অথচ তোমার দুটো বউ আছে।
-সবটা আমার জন্য হয়েছে। আমিই তো তোমাদের দুজনের জীবনটা এতোটা জটিল করে দিলাম।
-মানিয়ে নিয়েছিলাম আমরা। তুমি বুড়ো বয়সে এসে একা থাকছো কেনো! আজব!
আগের মতো থাকবা। ১৫দিন ১৫দিন করে।
-হুম।
-আজ মেহেনুবা কি বলেছে শুনবে?
-কি?
-আমরা ছাড়াও আরো পরিবার আছে যেখানে দুটো বউ আছে। অনেক পুরুষ প্রথম বউ কে ঠকিয়ে আরো বিয়ে করে শুধুমাত্র ভোগের জন্য। একজনকেই প্রাধান্য দেয় অপরজনকে বঞ্চিত করে।
আসলেই তো! আমাদের সাথে এমন কিছু কিন্তু ঘটেনি। আমরা সবাই পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। মুনিরা তোমার বউ হওয়া স্বত্তেও তার প্রতি তুমি আসক্ত ছিলেনা। আস্তেধীরে সেও তোমার মনে জায়গা করে নিয়েছে। আর মুনিরার কথা কি বলবো!
সে কোনোদিন চেষ্টা করেনি তোমার আমার মাঝে ফাটল সৃষ্টি করতে। যা হয়েছে সবটাই নিজেদেরই কিছুনা কিছু ভুল ছিলো। কিন্তু তুমি আদর্শ স্বামীর দায়িত্ব পালন করেছো আফরান। কেনো তুমি হীনমন্যতায় থাকবে!
.
চোখ জোড়া ছলছল করছে আফরানের।
সায়নীর হাত ধরে বললো-
তুমি যদি ঠিক না থাকতে সবটা এতোটা সহজ হতোনা সায়নী।
.

আরাফ এখনো শুয়ে আছে।
তার পাশে এসে বসলো মেহেনুবা।
হালকা ঝুঁকে সে আরাফের কপালে নিজের ঠোঁটের ছোয়া বসিয়ে দিতেই চোখ জোড়া খুলে ফেললো আরাফ।
অবাক হলোনা মেহেনুবা।
আরাফের নাকের সাথে নাক লাগিয়ে বললো-
ভালোবাসার প্রথম স্পর্শ কপালে দিলাম তোমার। বলেছিলে না তোমার মনে জায়গা করে নিতে?
আজ থেকে মিশন শুরু।
.
মৃদু হেসে আরাফ বললো-
আমি জেগে ছিলাম কি করে বুঝলে?
-চোখ দুটো বন্ধ থাকলেও মিটমিট করছিলো তাই।
.
উঠে বসলো মেহেনুবা।
আরাফও বসলো।
তার উদ্দেশ্যে বললো-
তুমি আমার আম্মু আব্বুর সবটা কি করে এতো সহজে মেনে নিলে?
-আমি ছোট থেকেই আম্মুর কাছে এই কাহিনী শুনতাম।
আব্বু বড় আম্মুকে আগেই গোপনে বিয়ে করে রেখেছিলেন।
কেননা দাদাভাই বড় আম্মুর সাথে আমার আব্বুর বিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন।
বিয়ে করার পর দাদাভাইকে জানাতে চায়লেও তারা নানা কারণে পারেনি।
কিছুদিন পর আব্বু গ্রামে গিয়ে দাদাভাইয়ার কথা রাখতে গিয়ে অসহায় ছোট আম্মুকে বিয়ে করে। পরে বিভিন্ন কারণে তাকে বড় আম্মুর কথা জানাতে পারেনি।
কিছুদিন পর ছোট আম্মু নিজেই সবটা জানতে পারে।
প্রথমে না যেতে চাইলেও পরে চলে যেতে চান।
কেননা তার জন্য বড় আম্মুর বড় ধরনের এক্সিডেন্ট হতে পারতো। তবে সেই এক্সিডেন্টের হাত থেকে তাকে ছোট আম্মুই বাঁচিয়েছে।
এই ঘটনার পরে ছোট আম্মুর জন্য বড় আম্মুর মনে ভালোবাসা জন্ম নেয়।
এর পরেই বড় আম্মুর অসুখের খবর পেলে বড় আম্মু ভাবে সে হয়তো মারা যাবে। তাই ছোট আম্মুকে যেতে দেন না তিনি। কারণ ছোট আম্মুর চোখে যে ভালোবাসাটা তিনি দেখেছেন আব্বুর প্রতি, তার অবর্তমানে যে তিনিই আব্বুকে ভালো রাখতে পারবেন বুঝেছেন তিনি।
তবে আল্লাহ এর রহমতে বড় আম্মু সুস্থ হয়ে যায়।
কথানুযায়ী দুজন বোনের মতো থাকলেও আব্বু বড় আম্মুকেই ভালো বাসতো।
বড় আম্মু প্রেগন্যান্ট হয়।
ঠিক সেই সময় ছোট আম্মুর বাবা মারা যান।
বাবার মরদেহ দেখতে গিয়েও গ্রামের মানুষের কাছে অপমানিত হয়েছিলো ছোট আম্মু। কেননা সবাই তাকে অলক্ষী ভাবতো।
আব্বু সেই সময় তার পাশে ছিলো। ছোট আম্মুর অনেক খেয়াল রাখতো। এভাবে একসাথে থাকতে থাকতে তার প্রতিও ভালোবাসা জন্ম নেয় আব্বুর মনে। কেনোই বা নিবেনা! ছোট আম্মুও তার বৈধ স্ত্রী।
কিন্তু তখন বড় আম্মুর মনে ছোট আম্মুকে নিয়ে সংশয় আসে।
ছোট আম্মু তা বুঝতে পেরে চলে যেতে চায়। আর তখনি বড় আম্মুর একটা দূর্ঘটনায় পেটের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়।
বড় আম্মু সুস্থ হয়ে নিজের ভুল বুঝতে পারে৷ ছোট আম্মুকে যেতে দেয়না।
দুজনে মিলেমিশে থাকার চেষ্টায় ছিলো।
ছোট আম্মু যখন প্রেগন্যান্ট হয় তার মনেও সংশয় আসে।
কিন্তু একটু পরেই তার পেইন উঠলে ডাক্তারের কাছে নেয়া হয় তাকে। ডাক্তার জানায় যেকোনো একজন বাঁচবে। পরবর্তীতে রোগী আর মা হতে পারবেনা।
বড় আম্মু দুজনের কথা বললে ডাক্তার জোর দিয়ে বললেন, যেকোনো একজনের নাম বলতে। তখন আব্বুও কিন্তু ছিলোনা। তবুও বড় আম্মু ডাক্তার কে জানায়, ছোট আম্মুকে যেনো বাঁচানো হয়।
কথাটি শুনে ছোট আম্মুর মনের সংশয়ও চলে যায়।
বড় আম্মুর জায়গায় অন্য সতীন থাকলে হয়তো বাচ্চাকে বাঁচাতে বলতো!
আল্লাহ এর কি অশেষ রহমত!
তুমি সুস্থভাবে জন্ম নিলে।
.
নিশ্চুপ হয়ে আছে আরাফ।
মেহেনুবা বললো-
আমি এসব সবটা জানি আরাফ। এখানে কার দোষ বেশি কম এসব ধরার উপায় নেই।
সবটাই পরিস্থিতির শিকার আর নিয়তির খেলা। তারা নিজেরা মানিয়ে নিয়েছে আমার কেনো আপত্তি থাকবে! হুম থাকতো, যদি আব্বু ভোগের জন্য আরেকটা বিয়ে করতো বা একজনকে অধিকার দিয়ে আরেকজন কে বঞ্চিত করতো।
অন্য কোনো দুই সতীনের পরিবারের মতোন না তোমাদের পরিবার টা। যারা সবটা জানবেনা তারাই এটা নিয়ে কথা বলবে।
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আরাফ বললো-
উপমাও জানতো সবটা। শুধু আমি কার ছেলে এটা কখনো বলিনি। কারণ আমার কাছে দুজনি সমান।
-সবার মন মানসিকতা এক নয় আরাফ। দুই বিয়ে এটা সহজে কেউ মেনে নিতে পারেনা। মানা উচিতও না। কিন্তু মা বাবার জন্য ছেলে মেয়েদের ভুগতে হবে, কথা শুনতে হবে এমনটাও মানা যায়না।
উপমা যা করেছে ভুল করেছে। তোমার পরিবার অন্য পরিবারের মতো নয়। যারা ভোগ বা স্বার্থের জন্য একাধিক বিয়ে লিপ্ত হয়।
আর হলেও এতে পরের প্রজন্মের দোষটা কি! তারা কেনো মা বাবাদের কর্মের জন্য কথা শুনতে থাকবে! আর বাইরের মানুষও কেনো শুনাবে!
-সবাই যদি তোমার মতো বুঝতো তাহলে তো উপমা কে হারাতে হতোনা আমার।
-হুম।
.
মেহেনুবার হাতটা ধরে আরাফ বললো-
তুমি সব জানো এতে আমি অবাক হইনি। কিসে হয়েছি জানো?
-কিসে?
-এতো তাড়াতাড়ি তুমি সবাইকে আপন করে নিলে। আমার আব্বুকে আব্বু, আম্মুদেরও বড় আম্মু, ছোট আম্মু ডাকছো।
.
মৃদু হেসে মেহেনুবা বললো-
তোমাকেও আপন করে নিয়েছি।
-আসবো?
.
মুনিরার গলার শব্দ শুনতে পেয়ে মেহেনুবার হাত ছেড়ে আরাফ বললো-
হুম ছোট আম্মু আসো।
-তোর নানী তো অসুস্থ শরীর নিয়ে এখানে আসতে পারেনি তোর বিয়েতে। আজ বউ ভাত ও হয়ে যাবে। তারপর তো সবাই ফ্রি।
-হুম।
-ভাবছিলাম গ্রামে যাবো সকলে মিলে।
-হ্যাঁ আম্মু। দাদা,দাদী,নানা কারো সঙ্গই তো পেলাম না। একমাত্র নানি আছে, সেও অসুস্থের জন্য আসতে পারলোনা। নতুন বউ নিয়ে আমরা যাবো তার কাছে।
-ঠিক আছে এখন খেতে আয় তোরা।
.
.
কাল রাত থেকে কিছু খায়নি উপমা।
রুপা আক্তার খাবার নিয়ে তার পাশে বসে বললেন-
নিজের শরীরকে কষ্ট দিয়ে লাভ কি?
.
উপমা শান্ত স্বরে বললো-
আরাফের সাথে আমার বিয়েটা হলে ভালোই থাকতাম আমরা। ওর দুই মাও আমাকে ভালোবাসা দিতো। এটা আগে কেনো বুঝিনি আমি! ওইদিন আমি এমন না করলে আরাফ আমার গায়ে হাত তুলতো না। নিজের দোষ না দেখে শুধু এক তরফাই ভেবে গেলাম! আজ আমি মেহেনুবার জন্য ওদের সকলের টান দেখে বুঝেছি আম্মু। তারা আমাকে কষ্ট দিতোনা। আর আরাফও দুটো বিয়ে করতো না। করার হলে সে তো আমাকে করতেই পারতো। আমার প্রস্তাবে রাজি হতো। তাইনা?
.
নিশ্চুপ হয়ে আছেন রুপা আক্তার।
তার কোলে মাথা রেখে উপমা বললো-
আমি আমার ভুলটা এখন বুঝতে পারছি আরাফ কে হারিয়ে। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। অনেকটা দেরী হয়ে গেলো। আরাফের মায়ের কথায় ফললো।
যেদিন আমি আমার ভুল বুঝতে পারবো, দেরী হয়ে যাবে সেদিন!
.
আড়াল থেকে মেয়ের অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফখরুল মোবারক।
খুব তাড়াতাড়ি মেয়েটার বিয়ে দেয়া প্রয়োজন। তাহলে হয়তো এসব থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে সে।
.
৩বছর পর….
আজ আরাফ ও মেহেনুবার মেয়ে আরনুবার ১ম জন্মদিন।
আফরান তার নাতনীর জন্মদিন উপলক্ষে বিশাল আয়োজন করেছে।
এই তিন বছরে অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে।
মিশিকারা এখন দেশে থাকে।
তাসুর বিয়ে হয়েছে বাংলাদেশেরই একটা ছেলের সাথে।
আরাফ তো মেহেনুবা বলতেই পাগল। নিজের ভালোবাসা ও সম্পর্কের শক্তি দিয়ে আরাফ কে পুরোপুরি নিজের করে নিয়েছে মেহেনুবা।
রুমানা ও রাকিবেরও সন্তান আচ্ছে।
তবে মুনিরার মাও আগের থেকে সুস্থ।
তার কথা হলো-
আরাফের ছেলে মেয়ের বিয়ে না দেখে এই পৃথিবী ত্যাগ করবেন না তিনি। যদিও শরীরটা অনেক দূর্বল।
আজ বাড়িতে মিশিকার পুরো পরিবার, রুমানার পুরো পরিবার, তাসুর শ্বশুড় বাড়ির লোক, মুনিরার মা সকলেই উপস্থিত আছেন।
সায়নী ও মুনিরা ব্যস্ত মেহমানদের নিয়ে।
মেহেনুবাও তাদের সাথে ছিলো এতোক্ষণ। তবে সায়নীদের জোরাজুরিতে সে তৈরী হতে গিয়েছে নিজের রুমে।
নিজের রুমে এসে আরনুবাকে বিছানার উপর রেখে তৈরী হতে থাকলো মেহেনুবা।
ঘুমিয়ে পড়েছে আরনুবা।
লাল টকটকা একটা শাড়ি পরেছে মেহেনুবা।
ড্রেসিংটেবিলের দিকে তাকিয়ে চোখে কাজল লাগাতে থাকলো সে।
আচমকা তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো আরাফ।
মেহেনুবার কানের পাশে মুখটা নিয়ে ফিসফিসিয়ে আরাফ বললো-
তোমার ওই কাজল চোখ ছাড়াই পাগল হয়ে যাই আমি, কাজল লাগিয়ে কি নেশায় ফেলতে চাও?
.
মুচকি হেসে মেহেনুবা বললো-
হু চাই তো।
-তাহলে আর নিচে নামতে হবেনা। নেশায় ডুব দিই আমি।
.
আরাফের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মেহেনুবা বললো-
এই না!
-এই হ্যাঁ!
-আরাফ! আজ আমাদের আরনুবার বিশেষ দিন ভুলে গেলে চলবে?
-ও হ্যাঁ তো!
-ওকে ঘুম থেকে তুলে রেডি করো।
-মেয়েটা কিভাবে আরাম করে ঘুমোচ্ছে। থাক না!
-সবাই ওয়েট করছে আরাফ। ওকে তুলে লাল ফ্রকটা পরাও। আমি একটু সেজে নিই।
-আমি সাজবো না?
-মজা নিচ্ছো! তুলোনা প্লিজ আরনুবাকে।
.
মৃদু হেসে আরাফ বললো-
হু তুলছি।

সিড়ি বেয়ে নিচে নামছে মেহেনুবা ও আরাফ।
আরাফের কোলেই রয়েছে আরনুবা।
সকলের দৃষ্টি তাদের দিকে।
মুনিরার মা থুথু ছিটিয়ে বললেন-
নজর না লাগে যেনো আমার নাতি পুতির উপর।
.
মুনিরা হেসে বললো-
নাতির বউ এর উপরেও যেনো না পড়ে।
.
.
তারা নিচে নামতেই তাসু মোবাইলে তাদের কিছু ছবি তুলে নিলো।
মেহেনুবা সায়নীদের দিকে তাকিয়ে বললো-
আব্বু ও আম্মুগণ? একটা ফ্যামিলি পিকচার হয়ে যাক?
.
আফরান মৃদু হেসে বললো-
কেনো নয়!
.
আফরান তাদের দিকে এগিয়ে যেতেই তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো আরনুবা।
আফরান কোলে নিলো তাকে।
সায়নী ও মুনিরা এসে যোগ দিলে তাদের সাথে।
তাসু ছবি তুলছে তাদের।
সকলের মুখেই হাসি।
যেমন পরিস্থিতিতেই তাদের সম্পর্ক টা জড়াক না কেনো, প্রত্যেকের মাঝেই আজ ভালোবাসা বিদ্যমান বৈধ সম্পর্কের জোরে।
.
(সমাপ্ত)
.