সাদাকালো

আমার স্ত্রী স্লিভলেস ব্লাউজটা পরতে পরতে বললো, ‘আজান দিয়ে দিছে, নামাজটা পড়ে নাও। তারপর বের হই। ততক্ষণে আমি একটু যত্ন করে লিপস্টিকটা লাগাই। দেখো কেমন দ্যাগড়া-ব্যাগড়া হয়ে গেছে।’

আমি মুখ পানসে করে বললাম, ‘নাহ। নামাজ পড়তে ইচ্ছে করছে না। পরে পড়বো।’
আইরিন ড্রেসিং টেবিলের সামনে আয়োজন করে বসতে বসতে বললো, ‘ঢঙের কথা বলবা না। যাও নামাজ পড়ো। ফ্রিই তো আছো। পরকালে হিসাব দিবা না?’

আমি টুলটা এগিয়ে নিয়ে ওর কাছে গিয়ে বসলাম। ও আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো, ‘ঝগড়া করতে চাও? সাবজেক্ট কী?’
আইরিনের বলার ঢঙে এবার আমি হেসে ফেললাম। বললাম, ‘মায়ের সাথে ঝগড়া করেছো কেন?’
আইরিন খুব স্বাভাবিকভাবে বললো, ‘ঝগড়া? কখন? এটা ঝগড়া না। সে তোমার আমার ঘুরে বেড়ানোকে দেখতে পারে না কেন?’
: কে বলেছে দেখতে পারে না?
: কে বলবে? আর বলতে হবে কেন? এটা বোঝা যায়।
: দেখো পৃথিবীতে অনেক মা আছে, একদম নির্জীব। বোকা। আবার অনেক মা আছে, একটু দজ্জাল টাইপের। সবাই কিন্তু মা।
: তো?
: তো তাই বলে তুমি মাকে অবহেলা করবে?
: উনি কেন এত জ্বালাতন করে?
: আমরাও তো ছোটোবেলা মাকে প্রচুর জ্বালাতন করেছি। মা কি আমাদেরকে ফেলে দিছে? ভালোবাসার কোনো কমতি করছে?

এবার আইরিন চুপ। লিপস্টিক আবার ‘দ্যাগড়া-ব্যাগড়া’ হয়ে গেছে ওর। আমি বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লাম। বললাম,
: একই তো মা। কিন্তু বড়ভাবির সাথে কোনো ঝামেলা নাই। ঝামেলা হচ্ছে তোমার সাথে। মায়ের পেছনে খরচ করলেই তুমি ক্ষেপে যাও। অথচ কিছু কিনে আনলে বড়ভাবি আগে জিজ্ঞেস করে, ‘আম্মার জন্য কী আনছো?’
: বড়ভাবি, বড়ভাবি করবা না তো এত!
: শান্ত হয়ে শোনো। তোমাকে কোনো কথা বলতে হবে না।

আইরিনের মুড অফ হচ্ছে। তবু আমি বললাম-
: তুমি তোমার মায়ের জন্য আট হাজার টাকা চাইলে। আমি দিলাম। তুমি দিয়ে এলে তার ভালো থাকার জন্য। আমি কিন্তু কিছুই বলি নাই। অথচ আমার মাকে আমি দিলেই তোমার সমস্যা। কেন এমন?

এবার আইরিনের গলায় শ্লেষ্মা।
: তোমার মা আমাকে দেখতে পারে না কেন? তোমার আমার মিল দেখতে পারে না কেন?
: আহহা! আমি তো বলছি, পৃথিবীতে এমন মা আছে। তাই বলে তাদেরকে ফেলে দিতে হবে? তাছাড়া একই বাড়ির দুটি বউ তোমরা। বড়ভাবিকে যদি মা সহ্য করতে পারে, তোমাকে কেন না? শোনো ভালো মা যেমন আছে, খারাপ মাও ধরলাম আছে। তেমনি ভালো বউ যেমন আছে, তেমনি খারাপ বউও আছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই মাকে অবহেলা করা যাবে না। আমরা মরে গেলেও না।
: তারমানে আমি কি খারাপ?
: তা বলছি না।

আইরিন চুলে চিরুনির ফিনিশিং দিতে দিতে আমার কাছে এসে বললো,
: শোনো বড়ভাবিকে যদি এতোই তোমার পছন্দ, তাহলে বড়ভাবিকে বিয়ে করে নাও।

আমি অবাক হলাম না। এমন করে কথা বলা আইরিনের অভ্যাস। উঠে বসলাম। বললাম,
: রাগ কোরো না। আমি কিন্তু মাকে সবই দিতে চাই। করতে চাই। তুমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অশান্তি করো বলে মাকে এড়িয়ে যাই। দেখো শুক্রবার আমরা বাইরে খেলাম। মায়ের জন্য স্যুপ আনতে দিলে না। অথচ কাকতালীয়ভাবে বাসায় ফিরে দেখলাম বড়ভাবি মায়ের জন্য ঠিকই স্যুপ রান্না করেছে। বড়ভাবি কোন মাটি দিয়ে তৈরি?
: আমি কি সাজগোজ নষ্ট করবো? তুমি নামাজ পড়বা কি না?
: না।
: নামাজ কেন পড়বা না?
: তোমার মুখে এসব কথা মানায় না।

আইরিন কান থেকে দুল খুলতে খুলতে বললো, ‘কোত্থাও যাবো না।’
আমি বললাম,
: দেখো তুমি পর্দা করতে জানো না। স্বামী-শাশুড়িকে যথাযথ সম্মান দিতে জানো না। তোমার মুখে ধর্মের কথা মানায় না। তুমি তো মূলত ধার্মিক না। মুখোশ পরো ধার্মিকের।
: ফালতু কথা বাদ দাও।
: ফালতু কীসের? এই যে স্লিভলেস পরে এত সেজে বাইরে যাবা, এটা কি ইসলামে আছে? ইসলামে কি আছে পরপুরুষকে এভাবে চেহারা দেখানো? শাশুড়ির সাথে এমন আচরণ?
: এমন জঘন্য করে কথা বলছো কেন? সবাই কি সবকিছু মানতে পারে? তাই বলে মুখে ধর্মের কথা মানাবে না?
: না মানাবে না। তুমি আল্লাহর সামান্য নির্দেশই যদি মানতে না পারো, তবে তোমার মুখে এসব মানায় না। খুব লজ্জাকর লাগে শুনতে। সাজগোজ না করে বাইরে যাওয়া, সবাইকে নিয়ে ভালো থাকা তো খুব কঠিন কিছু না। বড়ভাবি এর সবই করছে!
: দেখো আমার স্বাধীনতা বলতে একটা কথা আছে।
: তা আছে। এটাও মনে রেখো স্বাধীনতা মানে উচ্ছৃঙ্খলা না।

আইরিন সাজ নষ্ট করে ফেললো। আমি বিচলিত হলাম না। আবার একটু আদর করলেই ঠিক হয়ে যাবে। এসব ব্যাপারে ও যেমন কঠিন, তেমনি কোমল।
উঠে যেতে যেতে আইরিন অস্ফুট স্বরে বললো- “কুত্তার বাচ্চা কোথাকার।”

আমি চোখ বুজে শুয়ে রইলাম। একটা পরিবারে এতো রহস্য।

বড়ভাইয়ের অনেক আছে, অথচ মাকে দেখভাল করে না নিজ থেকে। কোনো দায়ও বোধ করে না। সেদিন হাসপাতালে নিতে হবে মাকে। ফোন দিলাম। বলে- তোরা নে। আমি বিজি।
অথচ বড়ভাবি, কী চমৎকার একজন মানুষ। নিজের মায়ের মতো সব করলো।
আমার অল্প আছে। কিন্তু মায়ের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা। এদিকে আমার স্ত্রী বড়ভাবির উলটো।
এই যে তুলনা করছি একে অপরের সাথে, তা তো যুক্তি আছে বলেই করছি। শখ করে তো আর তুলনা করছি না।
যার যার কাজের দিক থেকে বিবেচনা করে বড়ভাই আমার উলটো। আইরিন বড়ভাবির উলটো। কী রহস্য! কী রহস্য!

বড়ভাবি আইরিনকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। হাসতে হাসতে বললেন,
‘কী হইছে? ক্ষ্যাপাইছো কেন আইরিনকে?’
আমি চুপ করে রইলাম। ভাবি আইরিনকে বুঝিয়ে আবার সাজাতে বসলো। শুনলাম বসার ঘর থেকে আব্বার নামাজ পড়ার শব্দ আসছে। জোরে জোরে সূরা ফাতেহা পড়ছেন আব্বা। তিনি ছোটোখাটো একটা সরকারি চাকরি করেন। যেখানে দুই নম্বরি করার বেশ সুযোগ। করেনও সেটা তিনি। অথচ পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়েন।
এইযে নামাজ পড়ছেন, আবার কালই হয়তো রিলিফের চাউলের বস্তা বিক্রি করে ঘরে টাকা আনবেন কিছু। অথচ বাসায় থাকলেই বলবেন, ‘নামাজ কালাম কর। টাকা জমা। একসাথে তিন বাপবেটা হজ করে আসবো।’

আমি শুয়ে আছি। আইরিন ঝুমুরঝুমুর শব্দ তুলে আবার হাতে চুড়ি পরছে। বসার ঘর থেকে আব্বার কণ্ঠ ভেসে আসছে- “সামি আল্লাহু লিমান হামিদাহ্।”