সেদিন ছিল অমাবশ্যার রাত। চারিদিকে এতটাই ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল যে নিজের হাত নিজেই দেখতে পারছিলাম না। একহাত সামনে কি জিনিস আছে সেটাও আন্দাজ করতে পারছিলাম না। কোন রাস্তায় হাটছিলাম সেটাও দেখা যায়না। তখন প্রায় রাত ১২ টা ১৩মিনিট। বাম হাতের ঘড়িতে আলো জ্বালিয়ে দেখলাম। ঠিক তখনই শিহরণে আমার শরীরের লোমগুলো আচমকাই নাড়া দিল। ধমকা হাওয়ার মতো মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেল। গলাটা হঠাৎই যেন শুকিয়ে গেলো। মনের মধ্যে নানান রকম চিন্তাভাবনা ভিড় করতে লাগলো।। এ রাস্তা দিয়ে অনেক রাত অবধি একা একা হেটেছি। আজ কেন যেন সবকিছু এলোমেলো লাগছে। চারদিকটা হঠাৎই অপরিচিত লাগছে। রাহুলের বার্থডে পার্টি শেষ করে একা একা আসা উচিত হয়নি। স্বপনকে সাথে নিয় আসার দরকার ছিল। ও নিজে থেকেও আসতে চেয়েছিল। আমি নিজেই নিয়ে আসলাম না। আসলে হয়তো এরকম সন্ধিক্ষণে একটু সাহস পাওয়া যেত। প্রতিদিন সাথে সিগারেট থাকতো। আজকে সিগারেটও খুঁজে পাচ্ছি না।ভয়ে সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে খোঁজাখুঁজির পর একটি ভাঙা সিগারেট পেলাম। সিগারেটটি পকেটে রাখার পর ভেঙে গেছে। আসার সময় স্বপন দিয়েছিল। কলেজে সেকেন্ড বর্ষে উঠার পর থেকেই বন্ধুদের সাথে মিশে সিগারেটের সাথে গভীর সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি। সিগারেট জ্বালানোর সাথে সাথে মনে একটু সাহস এলো। যেটুকু ভয় পেয়েছিলাম অনেকটাই যেন মেঘের মত কেটে গেল। হাটতে লাগলাম কোন দিকে না তাকিয়ে।পথ এখনও অনেকটা বাকি। দ্রুত পা ফেলে হাটতে লাগলাম। সিগারেট যতই শেশেষ হয়ে আসছে ভয় যেন ততই পিছু পিছু হাটছে। সিগারেট শেষ হওয়ার সাথে সাথে সাপের মতো কোন একটা ফোসফাস শব্দে মাটিতে পরে গেলাম। মনে হলো কে যেন ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো। বাম পায়ের কনুই আঙুলে অনেকটাই ব্যথা পেলাম। এতো অন্ধকার যে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুজে পেলাম না।বুকটা ভয়ের বাতাসে আরও ভয়ানক রূপ নিল।শ্বাস নিতে কেমন যেন কষ্ট পেতে লাগলাম। আস্তে আস্তে উঠে আবার হাটতে শুরু করলাম।
কাছে যে দোকানপাট ছিল সব বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তায় শুধু বিক্ষিপ্ত ভাবে ২/১টা কুকুর ঘোরাফেরা করছে। কুকুরের ডাকও যেন আজ ভয়াবহ ভূতুরে লাগছে। অনেকটা ভৌতিক সিনেমার মতো শব্দ। যে শব্দ শুনলে বুকের ভিতরটা নড়েচড়ে উঠে। হাড় গুলো এমনিতেই ভাঙতে শুরু করে।
আমি মেইন রোড পার হয়ে গলিতে ঢুকলাম।
আমার বাসায় যেতে হলে এখন এই গলিটা পার হয়ে যেতে হবে। ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকার আওয়াজ আসতেছে। কেমন একটা গা ছমছমানি ভাব। আমার অবশ্য কখনোই ভুত প্রেতের ভয় ছিলনা। অনেক সময় রাত ২/৩টার দিকেও এই গলি দিয়ে এসে রাস্তার মোড়ের টং দোকান থেকে সিগারেট কিনে নিয়ে গেছি। সেদিনও এমন কোন ভয় আসেনি আমার মনের মধ্যে। গলি দিয়ে হাটছি। আজ মোবাইলেও চার্জ নেই। চালু করছি আর বন্ধ করছি।যেটুকু জ্বলে তার বেশি সময় লাগে অন করতে। চার্জ না থাকায় ব্যাটারি কামড়িয়ে আবার মোবাইলের মধ্যে উঠালাম।একটু মনে হয় চার্জ হলো। মোবাইলের আলোতে মাঝে মাঝে রাস্তা দেখে নিচ্ছি আর গুনগুন করে গান গাইছি।ঠিক তখন গলির মাঝামাঝি হঠাত্ শুনতে পেলাম কে যেন বললো এই যে ভাইয়া শুনছেন। বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করে উঠলো। এক সেকেন্ডে সমস্ত শরীর ভয়ে চুপসে গেল।। আমি মোবাইলের আলো আশেপাশে ধরে ধরে খুঁজতে লাগলাম কেউ আছে নাকি। তাকালাম আশে পাশে কিন্তু কোথাও কেউ নেই। মনে করলাম গলির দুই পাশের কোন বাসায় হয়তো কেউ কথা বলছে। এরূপ চিন্তা হওয়া সত্বেও মনের ভিতর ভয়ের ঝড় ঠিকই চলতে শুরু করেছে। আগের চেয়ে আরও জোরে পা বাড়াতে লাগলাম। কিন্তু কেন যেন আজ রাস্তা শেষ হচ্ছে না। যতই হাটছি মনে হচ্ছে আরও কত রাস্তা বাকি।মনে হচ্ছে কয়েক ঘন্টা হলে হাটছি কিন্তু পথ শেষ করতে পারছি না। কিছু দূর যাওয়ার পর আবারও সেই একইরকম কথায়র আওয়াজ পেলাম। বললো- ভাইয়া, আপনার সাথে কিছু কথা ছিল। কথা শোনার পর আবার পায়ের সাথে পা লেগে মাটিতে লুটে পরলাম। কে যেন মাথায় হাত রেখে টেনে তুলতে লাগলো। আমি উঠলাম না।নিজে নিজের সাহসে যখন উঠতে চেষ্টা করলাম ঠিক তখনই একটি সিগারেটের অর্ধেক অংশ খুঁজে পেলাম। ধুপ করে উঠে সিগারেট ধরালাম।কেউ হয়তো একটু টেনেই ফেলে দিয়েছিল।সিগারেট ধরানোর সাথে সাথে আবার মনে একটু সাহস পেলাম। এইবার দাড়িয়ে পড়লাম। হালকা পাতলা ভয় পেলাম তবে সেটা ভুতের না ছিনতাইকারীর। আবার চিন্তা করলাম আমি যদি এখন এইখান থেকে দৌড় দেই আর এটা যদি আমার পরিচিত কেউ হয় তাইলে তো দৌড়ের কথা সবাইকে বলে দিয়ে আমার সাহসের বলিদান দিয়ে দেবে।
গলা দিয়ে কথা আসছিলো না। তবুও কৃত্রিম সাহস এনে গম্ভির কন্ঠে বললাম কে?। উত্তর আসলো ভাইয়া আমি তোমার স্বপন বন্ধুর মতো। আমি খুবই অসহায় হয়ে পরেছি,। খুবই বিপদে পরেছি। তুমি আমাকে সাহায্য করলে আমার অনেক উপকার হবে। আমি এইবার কন্ঠে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে জিঙ্গেস করলাম, ঠি আছে। সেটা না হয় করা যাবে। কিন্তু তুমি না মানে আপনি এমন গুমরে মুখে ভুতের মত কথা বলছো কেন? উত্তর দিল, ভাইয়া আমিতো ভুতই। ভুতে হয়ে কি গরু ছাগলের মতো করে কথা বলবো? আমি কি বলবো কিছু খুঁজে পেলাম না।সাহস করে ধমক দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু আবার সাহস পেলাম না। যদি আবার মাথা চেপে ধরে। তখনতো কেল্লাফতে। ওরে কে কোথায় আছিস আমারে বাঁচা বলে একটা চিত্কার দেওয়ার চিন্তা কেবল করতাছি এমন সময় সে আবার বললো ভাইয়া তুমি তোমার হাতের সিগারেটের আগুনটা একটু নিভিয়ে ফেল। তুমিতো জানো ভুতেরা আগুনকে খুবই ভয় পায়। আর তুমিতো আমাকে দেখতে পারছো না। আগুন নিভিয়ে ফেললে আমি তোমার সামনে আসলে তুমি আমাকে চিনতে পারবে আর দেখতে পারতা।এইবার ভুতের কন্ঠটা কেমন যেন পরিচিত মনে হলো।কোথায় যেন শুনেছি আগে। কিন্তু ঠাওর করতে পারছি না।মনে মনে চেষ্টা করলাম খুঁজে বের করার জন্য কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। ডান পা বাড়াতেই টিনের মতো কিছু একটা জিনিসের শব্দ পেলাম। শব্দ পাওয়ার সাথে সাথে মনে পড়ে গেল সেই এক্সিডেন্টের কথা। এই গত সপ্তাহে তিন মাথায় মোড়ে ঘটে যাওয়া সদ্য ঘটনা। আমিও তার প্রত্যক্ষ একজন দর্শক ছিলাম। ঘটনাটি গত সোমবার সন্ধায় ঘটেছিল। মাগরিবের নামাজের সময়ে। লোকজনের তখন খুব একটা ভিড় ছিল না। প্রতিদিনের মতোই সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু হঠাৎ বিকট শব্দে সবকিছু যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। চারদিকে যেন শোকের মিছিলে শোকাহত হয়েছিল। কেউ একজন বলে উঠেছিল এক্সিডেন্ট হয়েছে রে এক্সিডেন্ট। মূহুর্তের মধ্যেই তিন মাথা সড়কে লোকজনের প্রচন্ড ভিড় হয়ে গেল। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে প্রায় প্রত্যেকটি দোকানই বন্ধ হয়েছিল। কেউ কেউ বলছিল এই ডাক্তার ডাক।কেউ কেউ বলছিল এই পানি নিয় আয়। আবার কেউ কেউ বেলছিল ভ্যান নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে। আমিও বসে ছিলাম না।দৌড়ে গিয়ে দেখি। রক্তের সাগরে ঢেউ খেলছে তিন মাথা সড়ক। লাল রক্তে সমস্ত সড়ক লালে ভরে গেছে। মনে হচ্ছিল এইমাত্র কে বা কারা যেন রং দিয়ে এঁকে দিয়ে গেছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। চারদিকে যানযটে ভরে গিয়েছিল। যে যার যার মতো কোলে তুলে ভ্যানে তুলছে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য। আট দশটা লাশের সমাহার। কয়েকজন মৃত্যুর মুখে, কেউবা এখনও লাফাচ্ছে। একটি ট্রাক, সিএনজি ও পথচারীর মধ্যে এক্সিডেন্ট হয়েছে। কে দোষী তাকে চিহ্নিত করা সম্ভব না। আগে তাদের যথাযথ সেবা দিতে হবে। হইহুল্লোড় করে সবাই লাশ নিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়েছে। এতক্ষণে এ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে। শেষ পর্যন্ত আমি যাকে কোলে তুলে ছিলাম তার বয়স খুব একটা বেশি হবে না। আমার থেকে দুই এক বছরের ছোট হবে। আমি তাকে চিনিনা। তবুও তার জন্য মনটা কেমন যেন করে উঠছিল। মনে হচ্ছিল সে আমার কতইনা আপন।কতইনা পরিচিত। চেহারাটা সাদামাটা ছিল। পরনে সাদা পাজামা পান্জাবী ছিল। মাথার টুপিটা রক্তে লাল হয়ে গেছে। রক্ত পরে পরে পুরো পান্জাবী লাল টকটকে হয়ে গেছে। ডান পায়ের গোড়ালি ভেঙে তুলার মতোই নরম হয়েছে। তার চেহারায় অদ্ভুত এক মায়া আছে। তার বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছিল সে হাফেজ। আরবী লাইনে পরে। যাইহোক দেহটা একা তুলতে আমার খুব বেশি কষ্ট হয়নি। কেমন করে তুলেছিলাম আমি নিজেও জানি না। আমিতো ভেবেছিলাম সেই ছেলেটি আমাকে ডাকছে। কিন্তু না সেরকম না। এতো ভুত।
আমি সিগারেট ফেলে না দিয়ে জোরসে একটা টান দিলাম। ভুতটা কিছুটা আকুতির মতো করে বললো -ভাইয়া আপনার পায়ে ধরি আমাকে এমন করে ভয় দেখাবেন না। আমার হার্টের প্রবলেম আছে। ভয় পেলে আমি আবার নিশ্বাস নিতে পারি না। দম নিতে পারিনা। খুবই কষ্ট হয়। আমি এবার আরেকটু সাহস পেলাম। আমি নিজে ভয় পেয়েছি সেটা ওকে না বুঝতে দিয়ে জোরে বললাম তুমি কে সত্যি করে বলো? আমি ভুত রাক্ষস বিশ্বাস করিনা।ভুত বলতে পৃথিবীতে কিছুই নেই। শুধুই মনের অন্ধকার কল্পনার জগত। আমি জানি তুমি আমার পরিচিত কেউ। আমার সাথে ফাইজলামি করতাছো। আমি আবার বলছি আমি ভুত বিশ্বাস করিনা। সে বললো ভাইয়া ধমক দিয়ে কথা বলনা। আমি ভুত বলে কি আমার কোন মান সন্মান নেই। আমি কি নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় চলাফেরা করতে পারিনা? কথা বলতে পারিনা। তুমি এইভাবে আমার আমাদের অস্তিত্বকে অবিশ্বাস করতে পার না। তোমার আব্বুও ভুত দেখে ভয় পেয়েছিল। সেটা তুমি জানো।আমি কি কখনো বলেছি যে মানুষ বলতে কিছু নাই, মানুষ বিশ্বাস করিনা? বুঝলাম বেশ আত্নমর্যাদা সম্পন্ন ভুত। আমি বললাম ঠিক আছে আমি আর বলবো না।এবার তুমি বলো আমার কাছে তোমার কি দরকার? আমি তোমাকে কিভাবে হেল্প করতে পারি? সে উত্তর দিলো ভাইয়া সব বলবো তার আগে আপনি দয়া করে আপনার হাতের সিগারেট টা ফেলে দিয়ে নিভিয়ে ফেলুন। ওটাতো এমনিতেই শেষ হয়ে গেছে। এইভাবে ধরে রাখলে তো একটু পর আপনার আঙ্গুলে ছেঁকা লাগবে।
আমি সিগারেটের দিকে তাকালাম। আসলেই এটা শেষ। একটু পর সত্যি ছেঁকা খাইতাম। ফেলে দিয়ে পা দিয়ে নিভিয়ে ফেললাম। তারপর বললাম এখন বলো কি সমস্যা তোমার? ভুত তার কাহিনী বলা শুরু করলো।
ভাইয়া আমার নাম ধর্মঘট। বেঁচে থাকতে আমার নাম ছিলো ধীনেশ, মরার পর ভুত হয়ে আমার নাম হয়েছে ধর্মঘট। আমি জিগ্যেস করলাম কত দিন আগে তুমি মারা গেছো? উত্তর দিলো তা তো ভাইয়া কয়েক হাজার বছর হবে। তারপর সে সবিনয়ে অনুরোধ করে বললো ভাইয়া চলেন চা খেতে খেতে গল্প করি। অথবা কোথাও গিয়ে একটু বসি। আমি যেন আকাশ থেকে পরলাম। সালার ভুত কয় কি? ব্যাপারটা আমার কাছে অনেক উপভোগ্য মনে হইলো। আমিতরা দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিগ্যেস করলাম ভুতেরা আবার চা খায় নাকি?উত্তরে ধর্মঘট বললো কেন খাবেনা? এমন অনেক ভুত যারা মানুষের চেয়ে বেশি চা খায়। ভুতেরা মানুষের চেয়ে চা বেশি খায় এর কারণও রয়েছে। মি বললাম, কি কারণ? ধর্মঘট বললো কারণ এদের রাত জেগে মানুষদের ভয় দেখাতে হয়। আমি শুধু একটু ঢোক গিলতে পছন্দ করি ।