প্রথম দেখা ফার্মগেটে মাহফুজ স্যারের কাছে ম্যাথ পড়বার সময়। মনিকা পড়ে হলিক্রসে, শোভন তখন ঢাকা কলেজে। একই ব্যাচে পড়বার সৌভাগ্য হয় নি, মনিকাদের ব্যাচ ছুটি হলে শুরু হত শোভনদের। সে মনিকা যতটা আগ্রাসী ছিল, এই মনিকা ততটাই সুস্থির, যদিও এখনও জেদ কমেনি, যা বলে তাই। বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক হল। পুরদস্তুর সংসারি মেয়ে এখন মনিকা। শোভনের মাঝে পরিবর্তন আসে নি, ব্যাপার কিন্তু তেমন নয়। কলেজে থাকতে কাঁধে গিটার নিয়ে ঘুরে বেরাত, এখন হাতে ফাইল ভর্তি ব্যাগ। একটা বায়িং হাউজে ভাল বেতনে চাকরি করে। সে দিন গুলোতে মেয়ে দেখলে, শিস বাজাত, এখন চুপচাপ আগ্রহহীন চোখে কাউকে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে আসে। ঘরে বউ আছে, ওসব এখন মানায় না। কলেজের দিন গুলোতে, দুই টাকা বাস ভাড়া না নিলে কন্ডাক্টরকে বলে দিত, ঢাকা কলেজের সামনে দিয়ে যাবি না? পা ভাইঙ্গা হাতে ধরাইয়া দিব।
এখন কন্ডাক্টর খুচরা পয়সা না নিতে চাইলে, মানিব্যাগে কাগজের টাকা খুঁজে বেরায়, কথা বাড়ায় না।
.
মনিকাকে দেখে কখনও শিস বাজিয়েছিল কিনা মনে নেই শোভনের। তবে একবার মাহফুজ স্যারের কাছে মনিকা বিচার দিয়েছিল, স্যার, আপনার ঢাকা কলেজের ব্যাচের গিটারওয়ালা ছেলেটা আমাকে খুব ডিস্টার্ব করে।
মাহফুজ স্যারের বকা শুনে এক বিন্দু রাগও জমে নি মনিকার প্রতি, তবে মাহফুজ স্যারের টাক মাথা এক বাড়ি দিয়ে ফাটিয়ে দিতে বড় ইচ্ছে করছিল শোভনের। তবে শেষমেশ ফাটায় নি। যত হোক শিক্ষক মানুষ।
শীত ঝেঁকে বসেছে। হালকা একটা কুয়াশার চাদরে মোড়ানো চারপাশ। টঙের দোকান থেকে ফিরে বাসায় আসবার পথে, পকেটে হাত দিয়ে মাউথ ওয়াশ খুঁজে বের করে, বেশ চমকে উঠল শোভন। মাউথ ওয়াশ শেষ হয়ে যাবার কথা, আজ নতুন একটা কেনার কথা, সে কথা ভুলে গিয়েছে শোভন। কিন্তু শোভনের পকেটে সম্পূর্ণ নতুন একখানা মাউথ ওয়াশ। অথচ শোভনের স্পষ্ট মনে আছে, গতকাল তলানিতে একটুখানি জমে ছিল, তা দিয়ে মুখ কুলি করে বাসায় গিয়েছিল। অত ভাবার কিছু নেই। এটা এতো ভাববার মত কোন বিষয় না। মাউথ ওয়াশ দিয়ে মুখ কুলি করে বাসায় চলে এল। রাত এখন দশটা। কলিং বেল বাজাতেই মনিকা খুলে দিল দরজা। শোভন হাত বাড়িয়ে রজনীগন্ধার স্টিকটা মনিকার হাতে দিল। মনিকার রজনীগন্ধা বড় পছন্দ। শোভনও সে পছন্দের জিনিসটা, প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে নিয়ে আসে। সব ভুলে গেলেও এ জিনিস ভুলে যায় না। শোভন ড্রেস চেঞ্জ করে ড্রয়িং রুমে আসতেই মনিকা তোয়ালে বাড়িয়ে দিল, যাও গোসল করে আসো।
শোভন একটু নাক উঁচু করে বলল, আজ না করি? ঠাণ্ডা লাগছে।
– জ্বি না, আজকেও করেন। গোসল না করলে খাওয়াও নাই, আমার সাথে ঘুমানোও নাই।
– তুমি তো একটু গরম পানি দিয়েও গোসল করতে দাও না।
– এতো গরম পানি দিয়ে গোসল করতে হয় না। যাও গোসল করে আসো। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
সারপ্রাইজের কথা শুনে শোভনের মুখ শুকিয়ে গেল। মনিকার সারপ্রাইজ মানে আসলেই সারপ্রাইজ। ভয়ংকর কিছু। শোভন তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। বালতি ভরে বসে রইল অনেকটা সময়। পানি বরফের মত ঠাণ্ডা। এরচেয়েও ঢের ঠাণ্ডাভাবে সারপ্রাইজ দিবে মনিকা। খুব ঠাণ্ডা মাথায় বলবে সারপ্রাইজের কথা, কোন রাগ দেখাবে না, কোন তর্ক জুড়বে না, কেন করলে এটা বলে কোন অনুযোগও হাজির করবে না। এইতো কয়েকদিন আগেই, এমন করেই বলেছিল, আজ তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
খেতে বসে মনিকা মোবাইলটা বাড়িয়ে দিয়েছিল শোভনের দিকে। শোভনের দুটো মোবাইলের একটা সেদিন বাসায় ফেলে রেখে গিয়েছিল। ও নাম্বারে বার কয়েক কল এসেছিল একটা নাম্বার থেকে। মনিকা রিসিভ করতে ওপাশ থেকে কোন উত্তর আসে নি। খানিক পরে এসেছিল একটা মেসেজ। সে মেসেজটাই শোভনকে দেখাচ্ছিল মনিকা। খুব শান্তস্বরে বলছিল, পার্সোনাল জিনিস, পার্সোনের কাছেই থাকা উচিৎ। এভাবে ফেলে রেখে যাওয়া ভাল না।
শোভন মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে ফারিহার মেসেজ। ফারিহা লিখে পাঠিয়েছে, আমি তোমার সাথে কাটানো সময় গুলো বড্ড মিস করি। যদি সময় বের করতে পারো একটু আমাকে জানাইও। একদিন আমরা সারাদিন ঘুরব।
ভাত খাওয়া বাদ দিয়ে শোভন শূন্য দৃষ্টি ছুড়ে তাকিয়ে ছিল মনিকার দিকে। মনিকা এক মনে খাবার খেয়ে যাচ্ছে। শোভন বলেছিল, দেখো মনিকা, ব্যাপারটা অমন না।
মুখের খাবার শেষ করে, শোভনের দিকে তাকিয়ে বলেছিল মনিকা, আমি কোন ব্যাপার জানতে চাচ্ছি না। আমি তোমাকে কিছু বলছিও না। শুধু বললাম, পার্সোনাল জিনিস নিজের কাছে রাখাই ভাল।
.
– দেখো মনিকা, আসলে অমন কিছু…
– খাবার শেষ কর। ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাব। খাবার সময় এতো কথা বলা ঠিক না।
শোভন খেয়ে যায়। কথা বাড়ায় না। তবে ফারিহার প্রতি প্রচণ্ড রাগ হয়। এই মেয়ে আর সময় পেলো না। হিসাব করে একদম যে দিনটাতে মোবাইল বাসায় রেখে গিয়েছে শোভন, সেদিনটাতেই কল করতে হবে? মেসেজ দিতে হবে?
ফারিহার সাথে শোভনের পরিচয় ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং করবার সময়। একই ব্যাচে ক্লাস করত। মাঝে মাঝে দেখা হত। ক্লাসে প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পটাপট দিয়ে দেয়াতে ক্লাসে একটা ভাল ছাত্রের তকমা জুটে গিয়েছিল শোভনের। এই ঐ করে টুকটাক কথা হত দুজনের। এক সময় মোবাইল নাম্বার বিনিময়। কম বয়সী আবেগে কথা বলতে বলতে দুজনের ভাল সম্পর্ক হয়ে গেল। সে ভাল সম্পর্ককে ভালবাসা বলা যায় কিনা বলা মুশকিল। তার চেয়ে বরং চরম আবেগ বলাটাই শ্রেয়। ফার্মগেটে কোচিং শেষে দুজন একসাথে মাঝে মাঝেই রেস্টুরেন্টে বসে কফি খেত, লাচ্ছি আর ফালুদা খেত। ঘন্টার পর ঘণ্টা গল্প করে কাটাত। রিকশা করে ফার্মেগেট থেকে ল্যাব এইড, ল্যাব এইড থেকে ফার্মগেট ঘুরে বেরাত। আর দেখা না হওয়া বেশিরভাগ সময়টা মোবাইলে কথা বলে আর মেসেজ করেই কেটে যেত। প্রতি নিয়ত এই দেখা সাক্ষাতের মাঝে কোন ঝামেলা হবার কথা ছিল না, তবু ঝামেলা হত। সময় যত গড়াল ধীরে ধীরে অকারণ ঝামেলা গুলো বাড়তে লাগল। কোচিংএ কোন মেয়ে শোভনের সাথে কথা বললে ঝামেলা হত, কোন ছেলে ফারিহার সাথে বললেও এক। ফারিহাদের বাসায় ফারিহার কোন মামাত, খালাত ভাই আসলেও শোভনের ভাল লাগত না। একটানা কল করে যেত, সে কল সবসময় রিসিভ করা সম্ভব হত না ফারিহার। এই নিয়েও ঝগড়া হত। ফারিহা বলত, ওরা আমার ভাই। তোমার মন মানসিকতা এতো বাজে কেন?
– হ্যাঁ ভাই। আপন ভাই তো না।
– শোভন, আমি তো ওদের সাথে প্রেম করতে যাচ্ছি না। আর ওদের সাথে আমার ভাই বোনের মতই সম্পর্ক। এগুলা নিয়ে আর কোন বাজে কথা বলবে না।
.
– ওরা বাসায় আসলে, ওদের সাথে তুমি আর কথা বলবে না।
– আজব কথা বল তুমি। ওরা আমার আত্মীয়, ওদের সাথে আমি কথা বলব না কেন?
এমন ঠুনকো কিছু বিষয় নিয়ে মনমালিন্য চলতেই থাকে। সম্পর্কে ধীরে ধীরে ফাটল ধরে। কোচিং এর শেষ দিকে দুজনের ঝগড়া বেশ খারাপ পর্যায়ে চলে যায়, কথা বলা বন্ধ। ফারিহাকে তখন দেখা যেত আর একটা ছেলের সাথে। শোভনের তা দেখে রাগে হাত পা কাঁপত। একবার ভেবেছিল ঐ ছেলেকে ধরে পিটাবে ইচ্ছামত। সে ইচ্ছাও পূরণ করে নি শোভন। মাঝে মাঝে কল করলে ফারিহার নাম্বার পাওয়া যেত সবসময় ওয়েটিং। সে সময়টা কতটা কষ্টের, কতটা অসহায়ত্বের ছিল তা শুধু শোভনই জানত। এ অসহায়ত্ব কাটাবার জন্য শোভন নেশা করা শুরু করল। সিগারেটে পুরে গাঁজা খেতে লাগল প্রতিদিন। মাঝ দিয়ে কিছুই হল না, শুধু পড়ালেখার বারোটা বাজল। চান্স পেলো না বুয়েটে শোভন। বুঝতে শেখার পর থেকে যেখানে পড়বার স্বপ্ন দেখে এসেছে, তা পূরণ হল না। টনক নড়ে তখন, একটা মেয়ের জন্য এভাবে নিজেকে শেষ করার, নিজের ক্যারিয়ার ধ্বংস করার কিছুই নেই। নিজেকে বুঝায় শোভন। তখনও সময় ছিল। একটানা পরিশ্রমের ফলটাও পেল। এখন যে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হল, বুটেক্সে ভর্তি হল তখন, সবটাই ছিল এই পরিশ্রমের ফল। একেবারে ভুলে যেতে পেরেছিল ফারিহাকে ব্যাপারটা তেমন নয়। ফারিহা ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ওভাবে পুরোপুরি প্রিপারেশন নেবার সময় না পেয়েও পদার্থ বিজ্ঞানে চান্স পেয়েছিল শোভন। একবার ভেবেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হবে। ফারিহার সাথে দেখা হবে। শেষমেশ নিজেকেই বুঝিয়েছে, ফারিহার থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। আর কখনও পা বাড়ায় নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। ফারিহার সাথেও হয় নি আর দেখা সাক্ষাত। বছর চারেক আগে একবার শোভনকে কল করে জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন আছ, কী কর?
এক দুই কথার পর আর কোন কথা খুঁজে না পেয়ে, আচ্ছা রাখি। আবার কথা হবে পরে। ভাল থেকো।
এই বলে রেখে দিয়েছিল। আর কখনও হয় নি কথা, দেখা। এতদিন পর আবার সেদিনটায় মোবাইলে মেসেজ দিল। তাও আবার দেখে ফেলল মনিকা। মনিকা জানত ফারিহার কথা। শোভন বলেছিল ফারিহা নামে একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল কোচিং করবার সময়। মনিকা বেশ স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিল ব্যাপারটা। শোভনের অতীত নিয়ে মনিকার কোন মাথা ব্যথা ছিল না, তবে বর্তমানটা পুরোটাই চাই মনিকার।
খাবার টেবিলে বসে সেদিন মনিকার দিকে বার বার তাকাচ্ছিল শোভন। মনিকার চোখে মুখে কোন ভাবান্তর ছিল না। ফারিহা বর্তমানে এসে দেখা করতে চায় শোভনের সাথে, এ নিয়েও কোন উচ্চবাচ্য করে নি মনিকা। হয়ত ভিতরে ভিতরে অভিমান করছিল, তা প্রকাশ করে নি। এই থমকে থাকা মনিকাকেই বরং বেশ ভয় শোভনের। সেদিন বিছানায় শুয়েও শোভন বলেছিল মনিকাকে, দেখো মনিকা, ফারিহার সাথে আমার অমন কিছুই নেই। আমার ওর সাথে কথা হয় না।
– আমি তোমাকে কিছুই বলছি না শোভন। তুমি নিজে নিজেই বলছ। আর আমাদের বিয়ে হয়েছে, এখন এসব বিষয় নিয়ে আমি কেন তোমার সাথে অযথা ঝামেলা করব? তোমার যদি মনে হয় ফারিহার সাথে দেখা করা উচিৎ, করবে।
– আমি করব না দেখা।
– ভালবাসি শোভন।
– ভালবাসি।
– ঘুমাও এখন, কাল সকালে তোমার অফিস আছে।
ফারিহাকে জড়িয়ে ধরে সে রাতটায় ঘুমিয়ে গিয়েছিল শোভন। পরের দিনটা ছিল একদম স্বাভাবিক।
.
আজকের সারপ্রাইজ সম্পর্কে কোন ধারণাই করতে পারছে না। গোসল করে বেরিয়ে এসে খাবার টেবিলে বসল দুজন। আজ মুরগী ভুনা হয়েছে, শোভনের বড় পছন্দের খাবার। খাবার খেতে খেতে বার বার তাকাচ্ছে মনিকার দিকে। মনিকা কখন সারপ্রাইজের কথা বলবে। মনিকা সে ব্যাপারে কিছু বলে না। শোভনের আঁকুপাঁকু ভাব দেখে বলে, কিছু বলবে?
আমতা আমতা করে বলে শোভন, না মানে, কী এক সারপ্রাইজের কথা বললে তুমি।
– আচ্ছা। খাওয়া শেষ হোক, তারপর।
খাওয়া শেষ হল। খাবার শেষে মনিকা বেসিনের উপর থেকে খালি একটা মাউথ ওয়াশের বোতল নিয়ে এনে শোভনের সামনে রাখল।
– তোমার মাউথ ওয়াশ শেষ হয়ে গিয়েছিল। আজ সিগারেট খেয়ে কী দিয়ে মুখ ওয়াশ করে আসবে ভেবে নতুন একটা মাউথ ওয়াশ কিনে তোমার পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। পেয়েছিলে?
কথাটা বলে সুস্থির দৃষ্টি ছুড়ে তাকিয়ে থাকে শোভনের দিকে। শোভনের কী বলা উচিৎ ভেবে পাচ্ছে না। মনিকাকে বলেছিল আর কখনও সিগারেট খাবে না। শোভন প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে সিগারেট খায়। টঙের দোকান থেকে সিগারেট খেয়ে, মাউথ ওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে বাসায় আসে, যেন কিছুই টের না পায় মনিকা। মনিকা টের পেয়ে গেল। বেশ ভালভাবে ধরা খেয়ে গেল শোভন। শোভনকে সেদিন বলেছিল মনিকা, শোভন আমাকে ছুঁয়ে বল আর কখনও সিগারেট খাবে না।
শোভন মনিকার পাশ ঘেঁষে বলেছিল, ছোঁয়াছুঁয়ির কী আছে? তুমি মানা করছ সেটাই যথেষ্ট, খেলাম না আর। সিগারেট না খেলে তাই কী হবে?
.
মনিকা মেনে নিয়েছিল, ভেবে নিয়েছিল আর কখনও খাবে না সিগারেট শোভন। শোভন মানে নি, শোনেনি সে কথা। মনিকা নিশ্চয় বড় কষ্ট পেয়েছে। মনিকা রুমে চলে গেল। কাপড় চোপড় গুছাতে লাগল। শোভন পাশে দাঁড়িয়ে বলল, এ কী? চলে যাচ্ছ নাকি রাগ করে?
মনিকা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে শান্তস্বরে বলে, কই চলে যাব? আর আমি রাগ করেছি কে বলল? তুমি ছাড়তে পারছ না সিগারেট খাওয়া, খাবে। মাউথ ওয়াশ শেষ হয়ে গেলে, আমি আবার কিনে আনিয়ে তোমার পকেটে রেখে দিব।
– সর্যিো আমি মনিকা।
– সর্যিো বলার মত কিছু হয় নি। ঘুমাবে চল।
শোভন চুপচাপ মনিকার পাশে বসল। মনিকার একটা হাত ধরল আলতো করে। মনিকার হাত ধরার সময়টায় প্রতিবারই সেই প্রথম দিনের মত মনে হয়। সেই অনুভূতি, সেই ছোঁয়া। মাহফুজ স্যারের কাছে পড়বার সময় মনিকাকে দেখে মাঝে মাঝেই “সুন্দরী, সুন্দরী” বলে চিৎকার করত। রেগে যেত মনিকা। মনিকা রেগে গেলেই শোভন এক দুই লাইন করে গান গেয়ে শুনিয়ে দিত। মনিকার রাগ তাতে কমত না, আরও বেড়ে যেত। এই টুকটাক রাগিয়ে দেয়া আর মনিকার ঝাড়ি শুনতে শুনতেই দিন কেটে গেল। মাহফুজ স্যারের কাছে হুট করেই মনিকা পড়া ছেড়ে দিল। মনিকার সাথে আর দেখা সাক্ষাত নেই। মনিকার প্রতি তখনও কোন আগ্রহ জন্মেনি, তাই আর খোঁজ খবর নেয় নি শোভন। কেটে যাওয়া দিন গুলোর মাঝে ফারিহার সাথে পরিচয়, একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠা আবার তাতে ভাঙন। শোভনের জীবনে অপ্রত্যাশিতভাবে আবার মনিকা চলে এসেছিল। শোভন বুটেক্সে চান্স পেল, ক্লাস শুরু হল। লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে শোভন বসে পড়ত কোনমতে ঘুম ঘুম চোখে সকাল বেলা। ক্লাসের এটেন্ডেন্স দিয়ে আবার পিছনের দরজা দিয়ে এক ফাঁকে লাপাত্তা। ক্লাসমেট কে, কে কে পড়ে সাথে, ওভাবে দেখাও হত না। প্রায় মাস খানেক যাবার পর, একদিন ক্লাস শেষে বেরিয়ে একটা মেয়েকে দেখে চমকে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আরে সুন্দরী, এখানে কী করে?
পরিচিত সেই সুন্দরী ডাক শুনে মনিকা পিছন ফিরে তাকিয়েও বেশ চমকে গিয়েছিল। শোভন দাঁড়িয়ে আছে সামনে। এবার আর রেগে গেল না মনিকা। বেশ স্বাভাবিকভাবে কথা বলল, দুজনে একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে, অথচ শোভনের চোখে কখনও মনিকা পড়ল না এটা ভেবেই অবাক হল শোভন। দুজনের মাঝের সেই কলেজ জীবনের উত্তপ্ত সম্পর্ক ধীরে ধীরে গলতে লাগল, গলে গলে জল হল। শোভন নিয়মিত ক্লাসে আসতে লাগল। ক্লাস করতে লাগল মনোযোগ দিয়ে। ফাঁকে ফাঁকে মনিকাকে দেখে, মাঝে মাঝেই মনিকাকে বলে, সুন্দরী চল, আজকে কোথাও ঘুরতে যাই।
প্রথম প্রথম মনিকা অবিশ্বাসের চোখে তাকাত শোভনের দিকে। সে অবিশ্বাস ধীরে ধীরে বিশ্বাস হল। দুজন ঘুরে বেরায়, আড্ডা দেয়, সবার মাঝে আলাদা করে শোভনের সাথে মিশে মনিকা। শোভনের গানের গলা ভাল। ভার্সিটির প্রোগ্রাম গুলোতে গান করে শোভন। নাচের শখ মনিকার। নাচ করে প্রোগ্রামে মনিকা। মনিকা দেখতে বেশ সুন্দরী, মাঝে মাঝেই কয়েক জন বড় ভাই বিরক্ত করে মনিকাকে। ভার্সিটির বড় ভাইদের বলা যায় না কিছু। শোভন বলতে পারে না কিছু। শুধু মাঝে মাঝে কয়েক জন বড় ভাইয়ের কাছে জবাবদিহি দিতে হয়, মনিকার সাথে সম্পর্ক কী?
একটা ‘না সম্পর্ক’ একসময় ‘ভাল সম্পর্ক’ হয়ে গেল। বেশ মধুর সে সম্পর্ক। বড় বোঝাপড়ার সে সম্পর্ক। শোভন সে সময় বুঝতে পারে, শোভন আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিণত, শরীরে এবং মনে। যে বিষয় গুলো নিয়ে ফারিহার সাথে হরহামেশা ঝগড়া বাধিয়ে দিত, সে বিষয় গুলো এখন শোভন বড় স্বাভাবিকভাবে নেয়। মনিকাও কোন বিষয় নিয়ে কখনও ঝামেলা করে না। সম্পর্ক গড়িয়ে গড়িয়ে চার বছর হয়, শোভন এবং মনিকা দুজনেই তখন শেষ বর্ষে। মনিকার বাসায় বেশ ভাল ভাল বিয়ের প্রস্তাব আসে, মনিকা না করে দেয়। ওদিকে শোভনকেও বলে, শোভন আমি কতদিন এভাবে না করব বাসায়?
শোভন বলে দেয়, দেখো, আমার ফিউচার তো ব্রাইট, তাই না? একটা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারের ফিউচার না থাকলে, আর কারও নাই বাংলাদেশে। এ ব্যাপারটা বাসায় বুঝাও। আমি চাকরিতে একটা ঢুকে গেলেই সব ঝামেলা শেষ।
মনিকা বাসায় বুঝাতে পারে না। সমবয়সী ভালবাসা পরিবার থেকে মেনে নিবে না। মনিকা যখন পাশ করবে, শোভনও তখন। যদি এমন হত, মনিকা পাশ করার সময় শোভনের চাকরির দু বছর তাও মেনে নেয়া যেত। বাসা থেকে মোটামুটি জোর করে বিয়ে করিয়ে দেবার জন্য তোড়জোড় শুরু করে তখন বাসা থেকে।
.
শোভনের সিগারেট খাবার বিষয়টা সে রাতেই শেষ। মনিকার সাথে কাটানো দিন গুলোর কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গেল শোভন, টের পেল না। পরদিন সকাল থেকে আবার নতুন একটা দিন। শোভন অফিসে যাবার সময় মনিকাকে বলে যায়, আজ ফিরতে দেরী হবে।
মনিকা শুধু “আচ্ছা” বলে। কেন দেরী হবে জানতে চায় না। মনিকার এ বাসাটায় একা কাটে সারাদিন। শোভন ওর বাবা মাকে নিয়ে এসে থাকতে চেয়েছিল। শোভনের বাবা মা গ্রাম ছেড়ে শহরে আসবেন না। মনিকা গল্পের বইয়ে বুঁদ হয়ে থাকে সারাদিন। কখনও শোভনকে অভিযোগ করে না, আমার একা ভাল লাগে না বাসায়।
বেলা তখন দুইটা। ল্যান্ডফোন বেজে উঠল। মনিকা ফোন ধরল। ওপাশ থেকে বেশ ভারী গলার একজন বললেন, এটা কি শোভন সাহেবের নাম্বার?
– জ্বি, আমি ওনার স্ত্রী বলছি।
– আসসালামু আলাইকুম। আমি ওনার অফিস থেকে বলছি। স্যারের কি শরীর খারাপ? উনি তো আজ অফিসে আসলেন না। বড় স্যার খোঁজ নিতে বললেন।
মনিকা কিছু সময় চুপ করে রইল। এরপর বলে দিল, হ্যাঁ, সকাল থেকে খুব মাথা ব্যথা করছে। ঘুমাচ্ছে। আমি ঘুম থেকে উঠলে আপনাদের ফোন করতে বলব।
ফোন রেখে দেয় মনিকা। শোভনের নাম্বারে কল করে, তিনবার রিং হয়, ধরে না। চতুর্থবার ধরার পর মনিকা বলে, শোভন, আজ একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারবে?
শোভন উত্তর দেয় ওপাশ থেকে, অফিসে অনেক কাজ, আজ দেরী হবে। কেন কোন সমস্যা?
– না না, ঠিক আছে। এমনি বললাম।
মনিকা কেটে দেয় কল। চুপচাপ জানালার কাছে গিয়ে বসে। জানালা থেকে দেখতে পাওয়া পার্কে অনেক মানুষ এই দুপুর বেলাতেও হেঁটে বেরাচ্ছে, শরীর নিয়ে সচেতন। কম বয়সী ছেলে গুলো ক্রিকেট খেলছে, আবার কোথাও কোথাও জোড়ায় জোড়ায় বসে ছেলে মেয়েরা চুটিয়ে প্রেম করছে। মনিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রান্না ঘরে চলে যায়। রান্না করতে শুরু করে।
রাতের বেলা শোভন আসে যখন, রাত তখন সাড়ে এগারটা। হাতের ব্যাগটা, টেবিলের উপর রেখে রুমে চলে যায়। আজ শোভন মনিকার জন্য রজনীগন্ধার স্টিক আনেনি। হয়ত এতো রাতে বন্ধ হয়ে গিয়েছে দোকান, কিংবা ভুলে গিয়েছে শোভন। মনে মনে ভাবে মনিকা। হাত মুখ ধুয়ে শোভন বিছানায় শুয়ে পড়ে। মনিকা পাশে এসে বসে বলে, গোসল করবে না?
শোভন একবার শুধু তাকায় মনিকার দিকে। কোন উত্তর দেয় না। মনিকা বলে, তোমার অফিসে কোন ঝামেলা হচ্ছে?
উঠে বসে শোভন বলে, না তো।
– কেউ বোধহয় তোমার সাথে শত্রুতা করছে।
– কেন?
– আজ কে একজন ফোন দিয়ে বলল, তুমি অফিসে যাও নি। তুমি তো অফিসেই ছিলে তাই না?
শোভন চুপচাপ মনিকার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। উঠে দাঁড়িয়ে তোয়ালেটা হাতে নিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলল, না আমি অফিসে ছিলাম না। আমার এক কলিগের বাসায় ছিলাম। ওনার ওখানে পার্টি ছিল জন্মদিনের।
.
মনিকার চোখে মুখে কোন ভাবান্তর হল না। খুব আস্তে করে বলল, আচ্ছা। খাবার দিচ্ছি, গোসল করে খেতে আসো।
শোভন বাথরুমে চলে গেল। গোসল শেষ করে বেরিয়ে এসে ঘড়িটার দিকে তাকাল। বারোটা বাজতে দুই মিনিট বাকি। মনিকা খাবার নিয়ে খাবার টেবিলে বসে। এক দৃষ্টিতে খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে কিছু ভাবছে। পিছন থেকে এসে শোভন মনিকাকে জড়িয়ে ধরল। চমকে উঠল মনিকা। মনিকাকে ঘুরিয়ে কপালে একটা চুমো খেয়ে বলল, হ্যাপি ম্যারিজ এনিভার্সারি। একটা মানুষের এতোটা ভাল না হলেও চলে। আর এই ভাল মানুষটাকে বউ হিসাবে পেয়ে, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ মনে করি নিজেকে।
মনিকা ডান হাত দিয়ে নিজের নিচের ঠোঁটটা টেনে ধরে শোভনের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকটা সময়। শোভন ভুলে যায় নি, আজ ওদের বিয়ের দুই বছর হল। মনিকা শোভনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল, বাচ্চা মেয়ের মত ফ্যাতফ্যাত করে কাঁদতে লাগল। শোভনকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে বলল, কই ছিলা আজকে তুমি সারাদিন?
শোভন মনিকার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল, অফিসেই ছিলাম। হালিমকে দিয়ে আমিই দুষ্টামি করে ফোন করিয়েছিলাম, তোমাকে রাগাবার জন্য। তুমি তো রাগলেই না।
– কেন, কেন? আমাকে এতো রাগাতে হবে কেন? কিছু বলি না বলে কি আমার কখনও কষ্ট হয় না নাকি?
শোভন মনিকাকে জড়িয়ে ধরল এবার। এ মনিকা অন্য রকম মনিকা। বহুদিনের জমে থাকা অভিমান একবারে সব চোখের জলে বের করে দিতে চাচ্ছে। শোভন আলতো করে কানের কাছে বলল, আচ্ছা সর্যিব, আর এমন হবে না।
এর মধ্যেই কলিং বেল বেজে উঠল। শোভন মনিকাকে ছেড়ে দৌড়ে চলে গেল দরজা খুলতে। দুজন দারোয়ানের হাত ভর্তি অনেক গুলো রজনীগন্ধার স্টিক। ওরা তা এনে টেবিলের উপর রেখে চলে গেল। মনিকা অবাক বিস্ময়ে সে দিকে তাকিয়ে রইল। শোভন বলল এসে কাছে, তোমার ম্যারিজ ডের উপহার।
– এতো ভালবাস কেন আমাকে?
– তুমি যে এর চেয়েও অনেক বেশি ভালবাস তাই।
.
কীভাবে কীভাবে বিয়ের দুটি বছর চলে গেল, ভাবতেই কেমন লাগে। অথচ মনে হচ্ছে এই সেদিন মনিকাকে বিয়ে করল, কত কাঠখড় পুড়িয়ে। শোভন আর মনিকা তখন সবে মাত্র পাশ করে বেরিয়েছে। শোভন কয়েক জায়গায় চাকরির চেষ্টা করেছে, হয়ে যাবে অতি সত্ত্বর। মনিকার তখনও বাসায় বিয়ের প্রস্তাব আসে অহরহ। মনিকার বাসায় আর ভাল লাগে না। বাসায় বুঝাতেও পারে না। একটু দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে চায় মনিকা। শোভন মনিকাকে বাইকের পিছনে বসিয়ে জাহাঙ্গীরনগর নিয়ে যায়। সারাদিন ঘুরে বেরায়। মনিকা বার বার বলে, শোভন, বাসায় আমি মানাতে পারব না।
শোভন বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি চাকরিতে ঢুকে যাচ্ছি। তুমি এতো চিন্তা কোরো না।
ফিরে আসবার সময় ঘটনাটা ঘটে। সন্ধ্যার দিকে, জাহাঙ্গীরনগর থেকে সাভারে আসার পথে বাইকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে শোভন। বাইক একপাশে পড়ে ছিটকে, একপাশে শোভন, মনিকা রাস্তার উপর। দ্রুত গতিতে একটা বাস চলে যায় মনিকার বাম পায়ের উপর দিয়ে। মনিকা চিৎকার করে উঠে। সে চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আসে। শোভন হাসপাতালে নিয়ে যায় মনিকাকে। কিছু হয় না, কিছুই না। অনেক দিন হাসপাতালে ভর্তি থেকেও মনিকার পা আর ঠিক হয় না। ডাক্তার জানিয়ে দেয়, মনিকা ওর বাম পা হারিয়েছে। সে পায়ে আর কখনও চলাচল করতে পারবে না।
শোভনের পৃথিবী কেমন একটা অন্ধকার হয়ে আসে। এরপর অনেক চেষ্টা চালিয়েও বাম পায়ের কোন গতি করতে পারে নি। মনিকার কাছে, মনিকার পরিবারের কাছে আজন্ম অপরাধী হয়ে যায় শোভন। তবুও মনিকাকে ভালবাসে, মন থেকেই ভালবাসে শোভন। নিজের পরিবার আর মনিকার পরিবারকে বহু কষ্টে মানিয়ে নিজের ভালবাসার মানুষটাকেই বিয়ে করে আজ থেকে দুই বছর আগে। মনিকা পঙ্গু একটা মেয়ে, এ ভাবনা মনিকার মনে না আসুক চায় সবসময় শোভন। মনিকার কখনও মনে না হোক, একটা বোজা হয়ে চেপে আছে শোভনের উপর, চায় শোভন। নিজের হাজারটা দোষ, দেখিয়ে দেয় শোভন মনিকাকে। অন্তত মনিকার মনে আসুক একবারের জন্যও বিরক্তি। একবারের জন্য হলেও মনিকা বলুক, তোমাকে বিয়ে করে আমি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছি। তোমাকে সহ্য করা অসম্ভব।
শোভনের মাঝে দোষ গুলো খেলা করুক, মনিকা ভাবুক, শোভনের সাথে মানিয়ে নেয়া কষ্ট। শোভন ইচ্ছে করেই মাউথ ওয়াশের বোতল পকেটে রাখে, মনিকা দেখুক তাই। ইচ্ছে করেই মোবাইল রেখে নিজেই মেসেজ করে ফারিহা সেজে, মনিকা দেখুক তাই। অফিসে বসেও অন্যকে দিয়ে কল করায়, শোভন অফিসে যায় নি, তা মনিনাকে শুনাবার জন্য। ঠিক আগে যেমন মনিকা বলত মাঝে মাঝে প্রেমের সময়টায়, তুমি একটা অসহ্য। কত ভাল ভাল পাত্রের বিয়ের প্রস্তাব আসে, আমি অযথাই তোমার সাথে লেগে আছি। অন্য কেউ হলে কবেই চলে যেত।
মনিকা তেমন কিছুই বলে না। শত চেষ্টাতেও শোভনের প্রতি বিরক্তি আনতে পারে না। হয়ত ভালবেসে গিয়েছে খুব একান্তভাবে, ঠিক যেমন ভালবেসেছে শোভন।
মনিকা জানে, শোভন যা করেছে, মনিকাকে যেভাবে গ্রহণ করেছে অন্য কেউ সেভাবে কখনই করত না গ্রহণ। ভালবাসায় বড় নিঃস্বার্থ হয়েছে শোভন। এই শোভনের সাথে রাগ দেখানো যায় না, শুধু ভালবাসা যায়। যে মানুষটা মনিকা আর কখনও নাচতে পারবে না তাই নিজের সবচেয়ে ভাললাগার জিনিস গান গাওয়াটা ছেড়ে দিয়েছে, সে মানুষটার সাথে অভিমান করা যায় না, কোন অনুযোগ এনে হাজির করা যায় না।
তবুও শোভনের মাঝে মাঝেই মনে হয়, সেদিন শোভন ইচ্ছে করেই এক্সিডেন্ট করেছিল, মনিকাকে পাবার নেশায় অন্ধ হয়ে চাচ্ছিল, মনিকা পঙ্গু হোক, মনিকার আর কোন বিয়ে প্রস্তাব না আসুক, মনিকাকে শোভনই বিয়ে করুক। ভালবাসার চরম স্বার্থটুকু হয়ত সেদিন শোভন দেখেছিল। একা একা ভেবে শোভনের তা মনে হয় মাঝে মাঝেই।
.
শোভন মনিকাকে নিয়ে ছাদে উঠল। আজ একটা পূর্ণিমার চাঁদ থাকলে বেশ হত। অমন আধখানা চাঁদ কেমন অসম্পূর্ণ লাগছে। মনিকা শোভনের হাত জড়িয়ে আকাশ দেখে। আস্তে করে বলে, শোভন।
– বল।
– একটা গান শুনাবে প্লিজ।
– আমি আর কখনও গান গাব না মনিকা।
– আমি জানি কেন তুমি গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছ, তবুও একটা গান আজকে শেষবারের মত শুনাও। আমাকে মাঝে মাঝে আগে যে গানটা শুনাতে। আমাদের ভার্সিটির বড় ভাই তাহসিন ভাইয়ের ঐ গানটা।
শোভন ভার্সিটিতে তাহসিন ভাইয়ের সাথেই গান করত। উনি এখন দেশের নামকরা শিল্পীদের একজন। নিয়মিত এ্যালবাম বের হয়, সিনেমায় প্লেব্যাক করেন। শোভন অনিচ্ছা নিয়েও আকাশের দিকে তাকিয়ে গুণগুণ করে গেয়ে উঠে,
‘খোলা জানালা দখিনের বাতাসে
থেকে যায় পর্দার আড়ালে।
কখন তুমি এসে হেসে বলে দাও
আছি তোমার পাশে।
বহুদূর পথ ভীষণ আঁকাবাঁকা
চলতে ভীষণ ভয়,
তুমি এসে বলে দাও, আছি আমি পাশে
কোরোনা কিছুতেই ভয়।”
শোভন গান গেয়ে যায়, মনিকা নিশ্চুপে মুগ্ধ হয়ে সে গান শুনে যায়। অবারিত ভালবাসার এ পৃথিবীটাকে বড় মধুর, বড় সুন্দর মনে হয়।
.
এ অবিশ্বাসের শহরে কেউ কেউ সত্যি এখনও ভালবাসতে জানে, বিশ্বাস করতে জানে, সে বিশ্বাসের মূল্যও দিতে জানে। ঘোলাটে হয়ে যাওয়া মেঘের আড়ালে থাকা চাঁদকে দেখতে জানে, ঝড়ো হাওয়ার দিনে শক্ত করে হাত ধরে পাশে থাকতে জানে। এ শহরে ভালবাসা বলে কিছু নেই, কথার বিপরীতে গিয়ে মন থেকে ভালবেসে দেখিয়ে দিতেও জানে। শুধু একটু মনের সাথে মনের মিল দরকার, সে মনে একটু জোর দরকার। অতঃপর তাহারা ভাল থাকতে জানে।
.
অতঃপর