জীবনের গতিপথ

আমি যখন অষ্টম শ্রেনীতে পড়ি, তখন আমার হোম টিউটর একদিন রাতে আমায় প্রপোজ করেণ। আমি শুধু কেবলা কান্তের মতো স্যারের দিকে এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে ছিলাম। তখন আমার বয়স ১৩ কি ১৪ হবে।
আমি অন্যসব মেয়ের মতো অতো পাকা নয়।
প্রেম ভালোবাসা সম্পর্কে তেমন কিছুই বুঝতাম না। আমি স্যারের কথা না বুঝেই হেসে দিলাম। এর পর থেকে স্যার প্রতিদিন আমাকে রোমান্টিক কথা বলতো। এটা সেটা এনে আমাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করতো।
আমি স্যারের কথার কোনো জবাব দিতাম না। প্রচন্ড বিরক্ত লাগতো। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারতাম না। কারণ আমার ঘরে ছিলো সৎ মা। তার কাছে কিছু বললে উল্টো আমাকেই দোষারোপ করবেন।

এভাবে বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো। স্যারের আচরন আমার মোটেই ভালো লাগতো না। তিনি মাঝে মাঝেই আমার স্পর্শ কাতর স্থানে হাত দিতেন। আমি হাত সরিয়ে দিতাম। বলতাম, আপনি যদি এমন করেণ, আমি কিন্তু মাকে সব বলে দিবো।
স্যার আমাকে ভয় দেখাতেন; কাউকে কিছু বললে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দিবো। আমি চুপসে যেতাম।

স্যারের অত্যাচার যখন সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, আমি তখন মাকে জানালাম,
আমি স্যারের কাছে পড়বো না। কারণ জানতে চাইলে, আমি মাকে সব খুলে বলি।
মা আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। মা বলেন, এই স্যারের কাছে না পড়লে পড়ার দরকার নেই। আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না। তাছাড়া স্যার আমাদের স্কুল টিচার। তার কাছে না পড়লে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার সম্ভবনা আছে। তাই আমি আর কিছু বললাম। নীরবে সব হজম করলাম।
আমার বাবা প্রবাসী। তাই মায়ের সাথে স্যারের বেশ খাতির। আমার ছোট্ট মাথায় অতো কিছু বুঝি না। মাঝে মাঝে স্যার রাতে আমাদের বাসায় আসতেন। খাওয়া দাওয়া করতেন। বিষয়টা আমি স্বাভাবিক ভাবেই নিতাম। কিন্তু আমার দেখার অন্তরালে যে অন্যকিছু হতো সেটা এখন আমি বুঝতে পারি।

বাবা বাহিরে থাকায় আমি সবটাই মায়ের উপর নির্ভরশীল। বাবাকে কিছু বলতে পারতাম না। বললে আমার সৎ মা আমার উপর নির্যাতন করতো। ছোটবেলা থেকেই আমি তাকে মা বলে জানতাম। কিন্তু তিনি আমাকে কখনো সন্তানের চোখে দেখেন নাই।
লোকে ঠিকই বলে- পর কখনো আপন হয় না।

আমি এবার ক্লাস নাইনে উঠেছি। সবকিছু একটু একটু বুঝতে শিখেছি। আমার জীবনটা সবসময় বন্দী দশায় কাটে। সৎ মা আমার স্বাধীনতায় বাঁধা হয়ে দাঁড়াতো।
কিছুদিন পর আমাদের বাড়িতে আমার মামাতো ভাই মাফি আসে। আমি তাকে মাফি ভাই বলে ডাকি। ছোটবেলা থেকেই তার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। আমার মনের সব কথা গুলো তাকে শেয়ার করতাম। সেও আমাকে খুব ভালো বুঝতো। এবার সে এইচ.এস.সি দিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে তার সাথে আমার সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমার সমস্যা গুলো তাকে শেয়ার করি। একটা সময় আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছি।

আমার নবম শ্রেনীর পরীক্ষা শেষ। আমি নানু বাড়িতে বেড়াতে গেলাম। রোজ মাফির সাথে দেখা হতো। তার সাথে সম্পর্কটা অনেক গভীর হয়ে গেলো। একদিন রাতে মাফি আমাকে বলে, জানিস সন্ধ্যা আমি তোকে অনেক ভালোবাসি।
I love you!
আমি তার কথা শুনে দৌঁড়ে পালালাম। তারপর থেকে মাফির সাথে আমার নিয়মিত কথা হয়। নিজের অজান্তেই মাফিকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। উঠতি বয়সে মন সবসময় মাফির জন্য আনচান করতে থাকে। মাফি প্রায় সময় আমাদের বাড়িতে আসতো। স্যার মাফিকে দেখে বিরক্ত হতো। কারণ স্যারও আমাকে পছন্দ করেন। আমি ছোট থেকেই যথেষ্ঠ সুন্দরী। বড় হওয়ার সাথে সাথে আমার রূপ লাবণ্য আরো বেড়ে যায়।
সে হিসেবে অনেকেই আমাকে পছন্দ করেন।
স্যারকে আমার একদম পছন্দ হতো না। যথেষ্ঠ বয়স্ক লোক তিনি। সেদিন স্যার আমাকে হাত ধরে টান দিয়ে বুকে জাড়িয়ে ধরেন। আমি উনার হাত কামড়ে ধরে, গালে একটা চড় দিয়ে চিৎকার করে উঠি। দৌঁড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সেদিন আমার চিৎকার কেউ শুনেনি।

কারণ মা সেদিন বাড়ি ছিলো না। সে সুযোগে স্যার আমার সর্বনাশ করতে চেয়েছিলো। সারারাত অনেক কান্না করলাম। মেয়ে হয়ে জম্মনোটা বোধহয় অনেক বড় পাপ। পদে পদে তারা নির্যাতনের স্বীকার।

এর পরের দিন স্যার মাকে আমার নামে উল্টা পাল্টা নালিশ দিয়ে চলে যান। মা রেগে গিয়ে আমাকে বেদম পিটাইলেন। আমার পড়ালেখা বন্ধ করে দেন। আমার সকল বই পুড়ে ফেললো। তারপরেও আমি এসএসসি পরীক্ষা দিতে চেষ্টা করি। কিন্তু তার আগেই মা আমাকে জোর করে বয়স্ক একটা লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। মূহুর্তেই নষ্ট হয়ে গেলো আমার স্বপ্ন গুলো। ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে পড়ি। আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট হবে ভাবি নি।

আমি বিয়ের আগে মাফিকে সব জানাই। তার কিছুই করার ছিলো না। কারণ সে এখনো বেকার যুবক। পড়ালেখাও শেষ হয় নি। নিজের জীবনের ঠিক নেই, আমার জীবনের নিশ্চয়তা কি দিবে। তাছাড়া আমার বিয়েটাও তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।

নিজেকে সেচ্ছায় দুঃখের সাগরে সঁপে দিলাম। ভাগ্য যা ছিলো তা ই মেনে নিলাম।
বিয়ের পরে আমার জীবনটা দূর্বিষ হয়ে উঠে। স্বামীর কাছে আমি ছিলাম কেবল একটি ভোগপন্য। একটি বার জানতে চাইনি আমার মনের কথা। আমি কি চাই? আমার কি প্রয়োজন?

শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলাম, আমাকে বিয়ে করার জন্য আমার স্বামী মাকে অনেক টাকা দিয়েছে। কারণ তার এটা দ্বিতীয় বিয়ে ছিলো। দুটো বাচ্চাও আছে। এটা শুনার পর আমার পৃথিবীটা যেন উল্টে গেলো। আমার মা এতো জগন্য প্রকৃতির মহিলা। যে কিনা টাকার লোভে পড়ে নিজের মেয়েকে এভাবে জ্বলন্ত আগুলে ফেলে দিলেন। আজ যদি তার নিজের মেয়ে হতাম তাহলে কি আমার এমন সর্বনাশ করতে পারতেন।

তার উপর শ্বশুর বাড়ির নির্যাতন। নুন থেকে চুন খসলে হাজারো কটু কথা শুনতে হয়।
শুধু তাই নয়, শ্বশুর বাড়ির সবাই আমার সাথে বাজে ব্যবহার করতো। তাদের আচরনে আমার জীবনটা বিষিয়ে উঠল।

এর মাঝে হঠাৎ একদিন মাফির সাথে আমার কথা হয়। আমাকে হারিয়ে সে পাগল প্রায়।
আমার সাথে দেখা করতে চাই। আমিও সরল মনে তার সাথে দেখা করতে রাজি হয়ে যায়।
যথাসময়ে আমরা দেখি করি। সে আমাকে তার কাছে ফিরে যেতে বলে। আমি রাজি হই না। কারণ সে এখনো বেকার। নিজে ঠিক মতো চলতে পারে না। আমাকে কি চালাবে।
তাছাড়া আমার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী সংসার আছে। তাকে বিয়া করলে যদি তার পরিবার আমাকে মেনে না নেই। তাহলে তো আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

আমি রাজি হই না দেখে, সে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। জোর করে আমাকে ধর্ষণ করে। আমি নিরূপায়। চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। নিজেকে শান্তনা দিলাম।
অন্য কেউ তো না, নিজের ভালোবাসার মানুষই তো। মাফি ভেবেছিলো, সে আমাকে ধর্ষণ করলে আমি তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হবো।
কিন্তু না। তার উপর রাগ করে আমি বাবার বাড়ি চলে আসলাম। আর বলে আসলাম;
যদি কখনো একটা চাকুরী করতে পারো,
তাহলে আমার সামনে এসো। আমি অপেক্ষায় থাকবো।

আমার নিজের প্রতি ঘৃণা হতে লাগল। যাকে ভালোবেসে বিশ্বাস করলাম। সে আমার সাথে এমনটা করতে পারলো। পরবর্তীতে সে আমার কাছে অনেক ক্ষমা চাই। আমি তার সাথে কথা বলতাম না। তার প্রতি আমার মনে এখন আর কোনো রাগ নেই। কেউ ভুল করে ক্ষমা চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিতে হয়।
আমি তাকে এখনো ভালোবাসি, আর যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কখনো ঘৃণা করা যায় না।

কয়েকদিন পর আমার স্বামী এসে আমাকে বাড়ি নিয়ে যায়। আমি কান্নাকাটি করি। তাদের আচরনের জন্য তিনি লজ্জিত হোন।
জানি না কতোটুকু সুখী হতে পারবো জীবনে।
এখন আমি এক বাচ্চার মা। সবসময় বিষন্নতা আমাকে ঘিরে রাখতো। মাঝে মাঝে মাফির কথা ভেবে চোখের জলে বালিশ ভিজাই। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। এই জীবনে আমার কোনো চাওয়া পাওয়া ই পূর্ণ হয় নি। আজ যদি আমার মা বেঁচে থাকতো তাহলে আমার জীবনের গতিপথটা অন্যরকম হতো।

আজ সকালে মাফি কল করে বলল,
সে চাকুরী পেয়েছে।
আমি তাকে নিষেধ করে দেই।
কারণ আমি চাই না, আমার মতো আমার মেয়ের জীবনটাও এভাবে নষ্ট হয়ে যাক।