স্ত্রীর অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে মিজান সাহেব তার স্ত্রীকে ফোন দিলো। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর উনার স্ত্রী নবনী ফোনটা রিসিভ করে নিচু স্বরে বললো,
-আমি মিটিংয়ে আছি। আমার আসতে দেরী হবে। তুমি বরং বাসায় চলে যাও। সুপ্তি আজ বাসায় একা আছে।
মিজান সাহেব চাবি দিয়ে দরজার লক খুলে বাসার ভিতর ঢুকলেন। সুপ্তির রুমে উঁকি দিয়ে উনি আঁতকে উঠলেন। উনার ১১ বছরের ছোট মেয়ে সুপ্তির নগ্ন শরীরটা বিছানায় পড়ে আছে। সাদা বিছানার চাদরটাতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে। মিজান সাহেব পাশে পড়ে থাকা ওড়নাটা দিয়ে মেয়ের নগ্ন শরীরটা ঢেকে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— মা, তোর এমন অবস্থা কে করেছে?
সুপ্তি ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে অস্পষ্ট স্বরে বললো,
আনিস আংকেল।
|
সুপ্তি ICU তে ভর্তি। ডাক্তার বলেছে ১২ ঘন্টার ভিতর কিছু বলা যাবে না। নবনী কাঁদতে কাঁদতে মিজান সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বললো,
— বাসার দারোয়ানটা আমাদের বাচ্চা মেয়েটার সাথে এমনটা করতে পারলো! এই নরপশুর বুকটা কি একটুও কাঁপলো না?
মিজান কিছু বললো না। শুধু পাথরের মূর্তির মত সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
রাত ১২টা বেজে ২১ মিনিট। মিজান সাহেবের খুব অস্বস্তি লাগছিলো। তাই তিনি ক্লিনিকের ছাদে গেলেন হাঁটার জন্য। হঠাৎ খেয়াল করলেন উনার মতই দেখতে কেউ একজন ছাদের কার্ণিশে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিজান সাহেব যখন ভয়ে চিৎকার দিবে ঠিক তখনি লোকটা বললো,
~ কি রে, ভয় পেয়েছিস না কি? আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তোরই ভিতরে বসবাস করা আরেকটা মানুষ। মেয়ের নগ্ন শরীর, বিছানার চাদরে রক্তের লাল দাগ আর মেয়ের ব্যথায় কাতরানো দেখে তোর কি কিছু মনে পড়ছে না? তোর মনে না পড়লে আমি তোকে মনে করিয়ে দিচ্ছি। অনেক বছর আগে তোর বাসায় শেফালি নামের একটা ১৩ বছরের কিশোরী কাজ করতো। তুই অফিস থেকে বাসায় এসে জানতে পারলি তোর স্ত্রী অফিসের কাজে দুইদিনের জন্য ময়মনসিংহ যাবে। আর তখনি তোর ভিতর আমার জন্ম হয়। মাঝরাতে শেফালির উপর ঝাপিয়ে পড়েছিলি তখন শেফালি বারবার তোর কাছে বাঁচার জন্য আকুতি-মিনতি করেছিলো। সেই রাতে শেফালির ব্যথার চিৎকার চার দেয়ালের মাঝেই আটকে গিয়েছিলো। সাদা বিছানার চাদর রক্তের দাগে লাল হয়ে গিয়েছিলো। অস্পষ্ট স্বরে শেফালি বারবার তোকে বলেছিলো,
” স্যার আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনার পায়ে পড়ি! আমাকে ছেড়ে দেন। ”
সেদিন তুই হেসেছিলি। আজ শেফালির জায়গায় তোর মেয়ের মুখটা কল্পনা করে দেখ। তোর মেয়েও হয়তো ব্যথায় এইভাবে চিৎকার করেছিলো। আর আনিস ঠিক ঐভাবেই হেসেছিলো সেদিন তুই যেভাবে হেসেছিলি। বুঝলি মিজান, এই জগৎ বড় রহস্যময়। এখন যতদিন তুই বেঁচে থাকবি, ততদিন নিজের মেয়ের এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দায়ী করবি। তারচেয়ে বরং চল, আমরা এই রহস্যময় জগৎ থেকে মুক্তি নেই।
পরদিন সকালে মিজানের লাশ পাওয়া গেলো ক্লিনিকের পিছনে আর ডাক্তার নবনীকে বললো,
” আপনার মেয়ের আর কোনো সমস্যা নেই। বিপদ কেটে গেছে।”
_________
টেবিলে বসে যখন একমনে পড়ছিলাম তখন হঠাৎ আমার রুমমেট (রাশেদ ভাই) আমায় বললো,
-পিয়াস, আনিকার ন্যূডপিক দেখবে?
আমি অবাক হয়ে বললাম,
আনিকা আপু তো আপনার গার্লফ্রেন্ড ছিলো।
রাশেদ ভাই মুচকি হেসে বললো,
– ছিলো! এখন তো আর নাই!
আমি রাশেদ ভাইকে বললাম,
— এখন আনিকা আপু আপনার গার্লফ্রেন্ড না দেখে মানুষকে উনার ন্যূডপিক দেখিয়ে বেড়াবেন? এটা তো ভাই ঠিক না। আপনাদের সম্পর্ক থাকাকালীন আপনার জোরাজোরিতে হয়তো আনিকা আপু আপনাকে বিশ্বাস করে একটা ন্যূডপিক দিয়েছিলো । এখন যেহেতু সম্পর্ক নেই সেহেতু আপনার উচিত হবে সেই পিকটা ডিলিট করে দেওয়া।
রাশেদ ভাই আমার উপর কিছুটা রেগে গিয়ে বললো,
– তুমি মিয়া সবসময় বেশি বুঝো। দেখতে ইচ্ছে না হলে দেখবে না। এত কথা বলার কি আছে?
এমন সময় রাশেদ ভাই আমার বন্ধু রাফিকে ডেকে বললো,
–রাফি, দেখে যাও তোমাদের ভার্সিটির বড় আপু আনিকার ন্যূডপিক।
কয়েক মাস পরের কথা। আমি ভার্সিটি থেকে এসে রুমে ডুকে দেখি রাশেদ ভাই নীরবে কান্না করছে। আমি ভাইয়ের হাতটা ধরে বললাম,
— ভাই কি হয়েছে আপনার?
রাশেদ ভাই কিছু না বলে চুপ করে রইলো। এমন সময় রাফি দৌঁড়ে এসে রাশেদ ভাইকে বললো,
– ভাই, আপনার বাড়ি জামালপুর নয়াবাড়ি না? আপনাদের এলাকার একটা মেয়ের ভিডিও ও ভাইরাল হয়ছে? মেয়েটা সেইরকম মাল ভাই। দেখলে আপনার মাথা নষ্ট হয়ে যাবে। দেখবেন না কি?
আমি যা বুঝার বুঝে গিয়েছিলাম। রাফিকে রুম থেকে বের করে রাশেদ ভাইয়ের হাতটা ধরে বললাম,
— ভাই, এই জগৎটা খুব রহস্যময়। এই রহস্যময় জগতে কেউ পার পেয়ে যায় না। আজ আপনি পাপ করে বের হয়ে আসলেও; সেই পাপের ফলটা আপনারই পরিবারের কাউকে না কাউকে ভোগ করতে হবেই….
________
রেহানা বেগম ছোট মাছের তরকারি দিয়ে ভাতগুলো মাখাতে মাখাতে উনার ছেলের বউকে বললো,
— বৌমা, আজ না গরুর গোশত রান্না করেছো? একটু গরুর গোশত দিবে। অনেক দিন গরুর গোশত দিয়ে ভাত খাই না।
ছেলের বউ সায়মা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো,
– গরুর গোশত রান্না করেছি এটা আপনাকে কে বললো?
রেহেনা বেগম করুণ দৃষ্টিতে ছেলের বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
— যখন রান্না করেছিলে তখন তরকারির ঘ্রাণ পেয়েছিলাম মা।
ছেলের বউ সায়মা রেগে গিয়ে বললো,
-গরুর গোশত শেষ হয়ে গেছে। আপনার তো এক পা কবরে চলে গেছে। তারপরও এত খাওয়ার ইচ্ছে হয় কেন?
বৌমার কথা শুনে রেহানা বেগম নীরবে কাঁদতে লাগলো। উনার চোখের পানি গাল বেয়ে খাবার প্লেটে পড়ছে। হঠাৎ উনার আগের কথা মনে পড়লো। একটা সময় উনার শ্বাশুড়িও উনার কথা শুনে খাবার প্লেটে চোখের জল ফেলতেন। বাসায় বড় বড় মাছ, গোশত রান্না হলেও উনি উনার শাশুড়িকে খেতে দিতেন শুটকির তরকারি আর বাসি ডাল। সময় পাল্টে গেছে। উনিও এখন বৌমা থেকে শ্বাশুড়ি হয়েছেন। আর তাই এখন উনি উনার কৃতকর্মের ফল ভোগ করছেন….
দুইদিনের এই দুনিয়ায় প্রতিটা মানুষেরই জীবনের একটা পর্যায়ে তার কর্মফল ভোগ করতে হবে,করে। তুমি আজ ভালো কাজ করলে আল্লাহ তা’লা তোমাকে সেই ভালোকাজের প্রতিদান দুনিয়াতে না দিলেও আখিরাতে কিন্তু ঠিকই দিবেন। কিন্তু তুমি যদি দুনিয়াতে পাপ করো, তাহলে তার ফল কিছুটা হলেও দুনিয়াতেই ভোগ করে যেতে হবে তোমায়..