মানবতা

সেই মা টি ও ছিল মৃত্যু পথযাত্রী।এতো বেশী মেডিসিন খাচ্ছিলো যে বুকের দুধ বাচ্চার জন্য বিষ হয়ে যেতো।অথচ বাচ্চাটির সচেতন বাবা চাইলো বাচ্চাটি যাতে শালদুধ পায়।পাশের রুমে আমাকে তখন আর্তচিৎকার করতে শুনছে সবাই, আমার বাচ্চা কই? কেউ আমার বাচ্চার মুখ দেখাতে পারেনি কারণ জন্মের সাথে সাথেই বেবির সাফোকেশন হচ্ছিল, তার উপর ছয়মাসের প্রি ম্যাচিউর বেবি।যাকে জন্মের সাথে সাথেই আগে থেকেই রেডী করে রাখা বারডেম এর ইনকিউবেটরে নিয়ে যাওয়া হলো।আমি পোস্ট – অপারেটিভ থেকে স্থানান্তরিত কেবিনে চোখ খুলে বেবিকে তো নয় ই, বেবির বাবা, আমার ভাই- বোন কাউকে দেখতে পেলাম না।শুধু দরোজার বাইরে আমার প্রানপ্রিয় অধ্যাপক বাবা আর খালাকে দেখতে পেলাম।

আসলে মরণপ্রায় বেবির তখন অপারেশন চলছে।আমার পাশে না থেকে সকলে তখন বারডেমে ব্যস্ত ছিলো।এসময় পাশের কেবিন থেকে ওরা এসে আমার বাবাকে অনুরোধ করে ওদের বেবিকে যাতে দুধ খাওয়ানোর জন্য আমাকে রাজী করান উনি বাচ্চাটিকে বাঁচানোর স্বার্থে।শারীরিক ও মানসিক সীমাহীন কষ্টের ভেতর দিয়ে যাওয়া আমার যা বেগতিক অবস্থা তাতে আমার খালা রাজী হতে ভয় পাচ্ছিলেন।আব্বা তবু ও আমাকে অনুরোধ করেন।আমি রাজী হয়ে খালাকে বলি বাচ্চাটি আমার কাছে আনতে।

চোখের পানি যে হাত খালি ছিল সেই হাতের তালুতে মুছে নেই।নার্স এগিয়ে এসে শোয়া অবস্থা থেকে পেছনে দুটো বালিশ দিয়ে আমাকে হালকা হেলান দিয়ে বসানোর চেষ্টা করে।হাতের ক্যানুলাতে স্যালাইন চলছিল।আমার কোলের উপর আরো দুটো বালিশ রাখা হয়।তারপর ক্ষুধার্ত ক্রন্দনরত নবজাতক কন্যাসন্তানটিকে পাশের কেবিন থেকে কেউ একজন নিয়ে এলেন আমার কাছে।খালা, নার্স এবং সেই মহিলার সহায়তায় বাচ্চাটি আমার বাচ্চার প্রাপ্য শালদুধের স্বাদ পায়।তারপর থেকে প্রতি দু’ঘন্টা বাদে কেউ একজন নিয়ে আসে বাচ্চাটিকে বুকের দুধ পান করাতে। এভাবে টানা সাতদিন চলতে লাগলো। এর ভেতর কখন যেন পাশের কেবিনের মা রোগীনি বাচ্চাসহ কেবিন ছেড়ে চলে গেলো জানতে পারিনি। অন্যদিকে টানা চারদিন মৃত্যুর সাথে লড়ে আমার বাচ্চাটির অবস্থাও বেগতিক। স্ক্যাবোর ১৯ টি ইনকিউবিটরে থাকা বাচ্চাদের মধ্যে আমার বেবিটি ছিল সবচেয়ে সংকটাপন্ন।বার বার কাঁটাছেড়া হচ্ছিল আমার নবজাতকের উপর।হার্টে রেস্পিরেটর পড়ানো সহ নাকে রাইসটিউব,হাতে ও পায়ে চলতে লাগলো স্যালাইন।শ্বাসকষ্টের কারণে বুকের দুধ নিতে না পারায় স্যালাইন ই তার একমাত্র পথ্য ছিল। বারডেম হসপিটালের সাত তলার স্ক্যাবো ইউনিটের আলাদা রুমের ইনকিউবেটরে থাকা নবজাতককে দূর থেকে দেখতে পাবার জন্য তার বাবার অনুমতি ছিল দিনে মাত্র একবার,আর কাউকে দেখতে ঢুকতে দিতোনা।এ অবস্থায় স্বামী বিচারক (সরকারী কর্মকর্তা) হওয়ায় আমাকে দ্রুত
বারডেমের এগারোতলার কেবিনে শিফট করা হয়। আমাকে সেখানে নেওয়া হলে ও যেহেতু আমার বাচ্চাটির অবস্থা ছিলনা বুকের দুধ খাওয়ার, তাই স্ক্যাবোতে থাকা বাকী আঠারোটি বাচ্চাকে বুকের দুধ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি।কিনে আনা হলো পাম্প। সেই বাচ্চাগুলোর কোন মা ই কিন্তু বারডেমে ছিলো না।কাজেই কর্তব্যরত চিকিৎসক এর পরামর্শে একজন নার্স এসে নিয়ে যেতেন পাম্পকৃত দুধ আর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাচ্চাকে ফিডারে করে খাওয়ানো হতে লাগলো। পাশাপাশি গুড়াদুধ ও দেওয়া হতো।এভাবে টানা বাইশদিন বুকের দুধ নিজের বাচ্চার বদলে বাকী বাচ্চাগুলোকে খাওয়াতে খাওয়াতে দুধ মা হয়ে গেলাম ওদের।কলিজায় টান লাগতো ওদের জন্য।সময়ের আগেই ব্যস্ত হয়ে যেতাম ওদের দুধ দেবার জন্য।

এতোদিন পরে বিধাতা ফিরে তাকালেন আমার দিকে।সাততলায় ডাক এলো আমার।আজ বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা হবে।যদি বমি না করে তবে এখন আমার কেবিন থেকে সাত তলায় গিয়ে দু’ঘন্টা পর পর বাচ্চাকে মা দুগ্ধপান করাতে পারবে।আনন্দে আমি কেঁপে উঠেছিলাম। আমার বিশ্বাস এই শিশুদের দোয়ায় আজ আমার বাচ্চার দিন ফিরেছে।আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো বেবির ইনকিউবেটরের কাছে।একটি চেয়ারে বসানো হল।দুটি বালিশ কোলে দিয়ে দুজন নার্স যখন ‘বেবি অফ নাঈমা’ লেখা ইনকিউবেটর থেকে কতশত তারে জড়ানো বাচ্চাটিকে প্রথম আমার কোলে তুলে দিলো,আমি কাঁদতে ও কাঁপতে থাকলাম।বেবি পুরো সময় দুধ খাওয়ার আগেই নার্সরা ওকে তুলে নিলো।কারণ ওটা এক্সপেরিমেন্টাল ছিলো।ও সাক করতে পারবে কিনা, বমি করবে কিনা তা দেখবার জন্য সময় নিলো ডাক্তার।কারণ টানা স্যালাইন দিয়ে রাখা বেবিটার আর কোন জায়গাই বাকী ছিলনা।দুই হাত এবং দুই পা দিয়ে স্যালাইন দিতে দিতে সব ভেইনগুলো ততদিনে অকেজো হয়ে গিয়েছিল।সর্বশেষ ওর দুইকানের পেছন দিয়ে ও স্যালাইন দেয়া শেষ। মাথার পেছনে কাটাছেঁড়া করতে করতে আর শুয়ে থাকতে থাকতে মাথার পেছনে ও ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল।শেষ উপায় হিসেবে মায়ের দুধ ই তার নিরাপদ ব্যবস্থা ভেবেছে ডাক্তারগণ।আলহামদুলিল্লাহ, বাচ্চাটার দুধ খাওয়া শুরু সেখানেই।ওকে আরো অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে বেঁচে থাকার জন্য।সে গল্পটা আরেকদিন বলবো।

বেশী কষ্ট পেয়েছি যে কারণে সেটি হল, নিজের বাচ্চাকে জন্মের পর দেখতে না পেয়ে ও প্রথম কোলে তুলে নিয়ে দুধ দিয়েছি মুখে টানা সাতদিন আমার পাশের কেবিনের যে বাচ্চাটিকে,তার ও তার অসুস্থ মাকে বাঁচাতে গিয়ে, সেই পরিবারটি আমাকে কোনদিন আর সেই মেয়ে বাচ্চাটিকে দেখতে পর্যন্ত দেয়নি।অথচ শুনি মেয়েটি ভিকারুননিসা স্কুলের সারাজীবন first girl.শুনেছি Dhanmondi তেই আমার বাসার কাছাকাছি ই থাকে ওরা।

আমার মেয়ে নেই।দুটো ই ছেলে।জানেন, দুই বিনুনী দুলিয়ে কোন কিশোরীকে হেটে যেতে দেখলে প্রায়ই আমার মনে খচখচ করে উঠে,ওটিই সেই মেয়েটি নয়তো।আমি মেয়েটির নামটা ও জানতে পারিনি কোনদিন।

মনে মনে আমার জগত জুড়ে একটা মেয়ে হাসে,খেলে,ছবি আঁকে,বই পড়ে,গান গায়, নাঁচে, কবিতা আবৃত্তি করে,আমার গলা জড়িয়ে ধরে!আমি ওর কৈশোরকে উপভোগ করি,নিবিড় মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরে বাঁচি।জানি না,এ কেমন আকুতি! দোকানে ঝুলানো ঘটি হাতা ফ্রক দেখলেই মন ছুটে আমার দামাল কন্যার জন্য,পাশেই বুঝি খামচে ধরে আমার শাড়ীর আঁচল, বায়না ধরবে বলে।

অবচেতন মন! কি চায় আর কি পায় কে রাখে তার হিসাব? হতে পারে শিশুবয়সে মাকে হারিয়ে সেই ভালোবাসার বঞ্চনা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।ভালোবাসার আঁচল উড়িয়ে অদৃশ্য মায়াবিনী কেউ একজন হাতছানি দিয়ে যায়।

শুধু এটুকুই জানতাম মেয়েটির বাবা মগবাজার কেন্দ্রের কোয়ান্টাম মেডিটেশন ফাউন্ডেশনের একজন পরিচালক। আমি একবার ওই বাচ্চাটির জন্য জামা কিনে ঈদের উপহার দিতে চেয়ে জানিয়েছিলাম ওই মহিলাকে যিনি আদতেন বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াতে,তার কাছেই ফোন করে বলেছিলাম বাচ্চাটির মুখটি একবার দেখবো।তিনি ওই ফাউন্ডেশনেই কর্মরত একজন গ্রাজুয়েট। আমাকে জানানো হয়েছিল মেয়েটি এসব কিছুই জানেনা।আর ওর পরিবার ও চায়না আমি কোন যোগাযোগ রাখি বা আগ্রহ দেখাই।

গতকাল কালের কন্ঠ পত্রিকার পিপিই পড়া দেবীরূপী দুইজন নার্সের কোলে করোনা আক্রান্ত এক মায়ের তিনমাসের শিশুটিকে ফিডার দিয়ে দুধ খাওয়ানোর ছবির ভারতীয় একটি নিউজ আমাকে অভিভূত করেছে।তারা মায়ের পাশাপাশি শিশুটিকে হসপিটালে রেখে শিশুটির দায়িত্ব নিয়েছে। সেটিই মনে করিয়ে দিয়েছে আমার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার কথা।কাল থেকে এসব ক্ষত আবার জেগে উঠেছে নিউজটা পড়ার পর।আহা, কেন যে সেই আঠারোটি বাচ্চার নাম ঠিকানা রাখলাম না!খুব দেখতে ইচ্ছে করছে সেইসব শিশুগুলোর মুখ!

বোধের শূণ্যপুরে যত শূণ্যতা সবই আমাদের মনুষ্যসৃষ্ট।ভালোবাসা যেমন মানুষের বিবেকের উদারতার একটি দিক তেমনি আঘাত দেওয়া,অকৃতজ্ঞতা ও মানুষের ই বিবেকহীনতার আরেকটি দিক।মনুষ্যত্ব দিয়ে যদি পশুত্ব ই না জয় করলাম, তবে আমরা কিসের মানুষ? মানুষ ও পশুশ্রেণীকে তো বিধাতা বিবেক ও চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়েই পার্থক্য করে দিয়েছেন।আমরা যদি মানবিকতা ও বিবেচনাবোধকে নিজেদের জীবনে সংযুক্ত করতে না পারি,সংকীর্ণতার উর্ধে উঠতে না পারি,দেবী দুর্গা বা মাদার তেরেসার মর্মস্পর্শী হাত এগিয়ে দিতে না পারি নিপীড়িত মানবতার জন্য, তাহলে মানবতা লংঘিত হবে,ক্ষমা পাবোনা মানুষেরই ভুলভ্রান্তিতে সৃষ্ট বিপর্যস্ত আক্রান্ত মহামারী পরিস্থিতি থেকে।

তাই তো মমতাময়ী নার্সদের এই তিনমাসের শিশুটির প্রতি গভীর ভালোবাসা আমার মাথা অবনত করে দিয়েছে। করোনাকালে অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তাকালেও দেবতারূপী কিছু মানুষের ভালোবাসা আমাদের জয়ী হতে শেখায়,আশায় বুক বাঁধতে শেখায়।জননীরূপে আবির্ভূত নার্সদ্বয়কে আমার লক্ষ-কোটি স্যালুট!
Hats Off to them !!!