কাছের মানুষ

ছোট বেলায় যখন রিদির চুলের মুঠো ধরে মারতাম মেয়েটা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাদতো আমার যে কি পৈশাচিক আনন্দ লাগতো আমি নিজেও জানি না,

রিদি ছিল আমার খেলার সাথি,ওর সাথে কেউ খেলবে সেটা আমি কখনোই মেনে নিতে পারতাম না,অন্যকেউ ওর সাথে খেল্লে আমি গিয়ে রিদিকেই মারতাম আর বলতাম তুই ওর সাথে খেল্লি কেনো?
মেয়েটি প্রতিবাদ না করে শুধু কাদতো,এজন্য অবশ্য আমার মায়ের কাছে কম মার খাইনি।

রিদি সম্পর্কে আমার ফুফাতো বোন।আমার ফুফুর বাসা আমাদের বাসার ঠিক দুই বাসা পরেই,শুনেছিলাম ফুফু নাকি প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন,তাই আমাদের কাছাকাছি ওনার বিয়ে,আমার বাবারা দুই ভাইবোন, ফুফুর বাসায় তাই সহসা যাতায়াত ছিলো।
আমার নিজের কোন ভাই বোন নেই,রিদির একটি ছোট বোন আছে,
ছোট বেলায় ওকে যখন মারতাম ওর ফর্সা গালে লাল দাগগুলো দেখতাম,ওকে যতই মারি ঠিক কিছুক্ষন পর আবার চোখে,নাকে পানি নিয়ে আবার আমার কাছে আসতো,এসে ফোকলা দাতে হাসি দিতো।

মানুষ বড় হয়,সময় ও পাল্লা দিয়ে চলে যায়,

যেবার মাধ্যমিক দিলাম রেজাল্ট ও ভালো হয়েছে,দুষ্টুমি করলেও ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলাম,বাবা তাই জোর করে শহরের কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলেন।হোষ্টেলের দিনগুলোতে খুব মনে পরতো সবাইকে,
যেদিন আমি চলে আসি সেদিন টা খুব মনে পড়ে, আগের দিন রিদি আমাকে বলেছিলো
-তুই যাস না শিশির,আমি সেদিন কিছু বলতে পারি নি,আমার প্রতি তার তীব্র অভিমান হয়।
যাওয়ার দিন সে আমার সামনে আসেই নি।
মন খারাপ ছিল,সেটাই ওর কাছাকাছি থাকার শেষ সুযোগ ছিলো।
এদিকে শহরের জীবন আমার খুব খারাপ লাগতো প্রথম প্রথম তারপর ধীরে ধীরে সেটা মানিয়ে নেই।দেখতে আমার ইন্টার শেষ, ভার্সিট ভর্তির জন্য প্রিপারেশন নিচ্চিলাম।ইতিমধ্য ইন্টার এর ফলও ভালো হয়।
রিদি ও তখম মনে হয় তখন কলেজে ভর্তি হয়েছিলো।

আমার ভার্সিটির পরীক্ষা দেওয়ার পর খুব ভালো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই।আমার মন তখন ফুরফুরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠলে যেমন পাখনা গজায় আমার ও তেমন গজানো শুরু হয়েছিলো।

প্রথম ক্লাসে শুরুর সময় নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রাখলেও আস্তে আস্তে বন্ধুবান্ধব জুটে যায়।
এ সকলের ভিড়ে এক অপ্সরির চোখে আমার মন আটকে যায়,দিন রাত কল্পনা,আমার মনের আকশে শুধু মেয়েটি যেন ঘুরে রেড়াতো।
সকলের
কথার মাঝে তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা যেন আমার নিত্যদিনের রুটিন হয়ে গিয়েছিল।
মেয়েটির নাম ছিল মালিহা,জীবনে প্রেম নামক শব্দ টার সাথে পরিচিত না হওয়া আমি ছেলেটা কিভাবে আরেকজনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি আমি নিজেও জানি,তার কথা বলার সময় বাকানো ঠোট,বিশাল চুলের কেশ,চোখের কাজল যেন আমায় তীব্র ভাবে টানতো।
মেয়েটিও হয়তো আমায় ধরে ফেলেছিলো,একদিন আমাকে দাড় করিয়ে জিজ্ঞাস করলো
-শিশির আমি প্রায় সময় দেখি তুমি হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন বলতো?
আমি কি জবাব দিবো মালিহা আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে আমি কিছু বলতে গিয়েও আমার মুখে কথা ধলা বেদে আসে।
-কি হলো কিছু বলো?
আমি তারপরও নিরুত্তর
মেয়েটি চোখ মুখ লাল করে চলে যায়।
পরে একদিন সাহস করে তাকে আমার মনের অব্যক্ত কথা গুলো বলার জন্য তৈরি হলাম আজ যেভাবেই হোক বলবো আমি।
ক্যাম্পাসে গিয়ে ডাকলাম,
-মালিহা তোমাকে কিছু বলার ছিলো,
-কি বলবে বলো
-আসলে আমি তোমাকে,আমি তো তো মাকে,
আমার মুখ দিয়ে আর কিছু বের হচ্চিলো না।
মেয়েটি ও যেন আশাহত হলো।

পরের দিন দেখি মালিহা আমাদের ক্যাম্পসের বড় একভাইয়ের হাত ধরে ঘুরছে,আমার মাথা যেন একটা চক্কর দিলো,আমি মনে হয় এখনই পড়ে যাবো,রাগে তীব্রতায় আমার গা ফেটে যাচ্ছিলো,
মালিহাও এই সময় আমায় দেখে,ওই বড় ভাই কে বিদায় দিয়ে আমার কাছে আসে,
-দেখো শিশির তুমি কি চাও সেটা আমি অনেক আগ থেকেই জানি,আমরা মেয়েরা চোখের ভাষা বুঝতে পারি, কিন্তু আমার ও যে একজন মনের মানুষ আছে,যে আমাকেও তীব্র ভাবে চায়,আমি জানি তুমি খুব ভালো ছেলে,দেখো একদিন তোমার জন্য খুব করে চাওয়ার মানুষ আসবে যে তোমাকে খুব করে চাবে।

সেদিন সেখানে থেকে চলে আসি আমি,ভাগ্যিস মাথা নিচে দিয়ে ছিলাম,না হলে আমার চোখের পানিটা দেখে পেলতো।রুমে এসে প্রচুর চোখের বর্ষন করলাম,জীবনে সেদিন প্রথম নিকোটিনের কাছে গিয়েছিলাম,একটা নয় দুটো গুলো ২০ টার মত খাই তাও যেন মনের ভিতরের কষ্ট লাগব ই হয় না।
তারপর থেকে চুপচাপ হয়ে যাই,ক্যাম্পাসে শুধু ক্লাস,আর বন্ধুদের সাথে কিছুক্ষন আড্ডা এভাবেই চলছিলো,

সেবার ছুটিতে বাসায় গিয়েছিলাম,

মাঝে যখন বাসায় যেতাম রিদি শুধু আমার পাশে ঘুরঘুর করতো,জানতে চাইতাম কিরে কিছু বলবি?ও কিছুই বলতো না, রিদি ততদিনে ইন্টার দিয়েছিলো মনে হয়।

সেদিন কি এক কারনে জানি রিদিদের বাসায় গিয়েছিলাম,ফুফু খাওয়ার টেবিলে বল্লো
– কিরে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছিস কেন?খাওয়া দাওয়া করিস না ঠিক মত?
বল্লাম -না ফুফি পড়াশোনার চাপ একটু বেশি তো।আসলে তখন ও যে আমার মনের মাঝে বৃহৎ ক্ষত তা তো কাউকে বলতে পারবো না।
যাক খাওয়ার পর রিদি রুমে গেলাম,মেয়েটা আসলেই পরিপাটি রাখে তার রুম,হঠাৎ পড়ার টেবিলে চোখ গেলো,
একটি অর্ধপৃষ্টা লিখা ডায়েরি পরে আছে,কৌতুহল মনে হয় মানুষের স্বভাব জাত, আমারো হল,ডায়েরি টা নিলাম,কভার পেজ এর লেখা পড়ে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম।
কভার পেজে লিখা”আমার শিশির”।
ডায়েরিটা আস্তে করে বাসায় নিয়ে এলাম।
আস্তে আস্তে একপেজ করে পড়তে শুরু করলাম।

প্রথম পাতা
-আমার শিশির টা না কেমন যেনো ও আমকে বুঝতেই চায়না ,এত করে ওর আশেপাশে ঘুরাঘুরি করি ও যেন বুঝ মতেই চায় না,আমার হাবলু টাকে দেখলে আমার হ্রদয় যেন শীতল হয়,অথচ হাবলু টা কিছুই বুঝে না,যেদিন ও হোষ্টেলে চলে যায় আমি ওকে যেতে বারন করি, পরদিন অভিমানে আর কথা বলি না,ও নাকি আমায় খুজেছিলো,ও চলে যাওয়ার পর কি যে কান্না করেছি আমিই জানি,ও চলে গেলে আমার হ্রদয়ের ক্ষত টাই যে বাড়তে থাকে,ওকে প্রতি রাতে কল্পনা না করলে আমার ঘুম হয় না,প্রতিদিন
ওর পড়ার টেবিলে যাই,ওর রেখে যাওয়া পুরোনো জিনিস গুলোতে হাত বুলাই,ওর রুম ঘুচাই,ওর সব কিছুতে যেন স্মৃতি আটকে আছে,

একে একে পৃষ্টা উল্টাচ্ছি আর আমার নিজের চোখের কোনে জল জমা হচ্ছে,

এভাবে শেষে পৃষ্টার অর্ধ লেখা টার দিকে দিকে দেখলাম
-আচ্ছা আমার গাধাটা এখন সিগারেট ও খায়,কি এমন কষ্ট ওনার,হু এসেছে সিগারেট খেতে,ইচ্ছা করছিলো নাক বরাবর দুটো দিয়ে বলি,কি এমন কষ্ট তোর?আমাকে বল আমি না হয় তোর কষ্টের ভাগিদার হই,আমি তোর সাথে আমার স্বপ্ন কে একসাথে দেখতে চাই,তুই কি কখনই বুঝবি না গাধা,তোর সামনে এত সাজুগুজু করে যাই,আমাকে কি তোর চোখে লাগে না?হাদারাম কে আমার ইচ্ছা মারতে ইচ্ছা করে।আজ রাত আমার আর ঘুম হবে না,হাদারামের মনে হয় মন খারাপ তাই সিগারেট খায়,আজ আমার ও মন খারাপ,আজ আমি অনেক কাদবো,হাদারামের সাথে তো আমার আত্মা টা যুক্ত।,আজ হয়তো নির্ঘুম রাত হবে আমার,আজ আর লেখবো না।

ডায়েরির এটুকু দেখে আমার নিজের মনটাও খারাপ হয়ে গেলো।আমার নিজের প্রতি ঘৃনা জন্মালো,একটা মানুষ আমাকে এত করে চায় আর আমি কিনা যে আমাকে চায় ই না তার পিছনে আমি ঘুর ঘুর করেছিলাম,তার জন্য শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিলাম,
আসলে মালিহা ঠিকই বলেছিলো আমার জন্য কেউ একজন পথ চেয়ে আছে অথচ মানুষ টা যে আমার এত কাছে আমি নিজে ও চিনলাম না,
অথচ রিদি মালিহা থেকে কয়েকগুন সুন্দরী।

দুদিন থেকে দেখলাম রিদি খুব অস্থির,জিজ্ঞাস করিছিলাম কিরে তোর এত মন খারাপ কেনো?
কিছু বলেনি,
পরদিন ছাদে ওকে ডাক দিলাম
-রিদি,তুই কি কিছু খুজছিস?

-কিরে?
পিছন থেকে ডায়েরিটা বের করে দিলাম,
মেয়েটা দেখার সাথে সাথে খপ করে আমার হাত থেকে নিয়ে নিল।
চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে,মাথা নিছে দিয়ে,
আমি বল্লাম-কিরে কিছু বলবি
ও আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো,

সেই চোখ দেখে যেন আমার মন ঝলসে গেলো,এত গভিরতা হয় একটা চোখের,মেয়েটার রুপ এতদিন আমার চোখে লাগেনি,তার নাক,গালের দুপাশ লাল হয়ে গেলো,ভালো লাগার সর্ব কিছু দিয়ে এক হুরপুরি আমার সামনে কান্না করছে

আমি আবার ডাকলাম- রিদি,
মেয়েটি এক মুহুর্তে ও দাড়ালো না,দৌড়ে চলে গেলো।
সূর্য ডুবছিলো,
আমার এখন খালি একটি ছন্দ মনে পড়ছে
“বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপর
একটি শিশির বিন্দু”।

না আজ নিজ মনেই আক্ষেপ হচ্ছে আমার কাছের জনকেই আমি চিনলাম না, রাতে দাঁড়িয়ে নিকোটিন এর ধৌয়া ছাড়ছি আর ভাবছি আর কখনো রিদির চোখের পানির কারন হবোনা ,এই নিকোটিন ও আমার রিদির চোখের পানি হয়েছে একেউ আজ বিদায় জানালাম।

পরিশেষঃ

-কি গো কি ভাবছো?
-না কিছু না।

জানালার গ্রিল ধরে পূনির্মার চাঁদ দেখছিলাম সাত বছর আগের সৃতিচারন ও করছিলাম। আজ যদি ডায়েরিটা না পেতাম হয়তো আমার জীবনের চাঁদ টাকে হারিয়ে ফেলতাম।আজ আমাদের একটি রাজকন্যাও আছে,রাজ কন্যার মা এখন আমার কাধে মাথা দিয়ে চন্দ্রবিলাস দেখছে,আর গুনগুনিয়ে গান গাইছে।