আমি ৪ বছর চাকরীর জন্য ঘুরেছি। এতো জায়গায় অ্যাপ্লাই করেছিলাম, এক পর্যায়ে আমার এলাকার কম্পিউটার এর দোকানদার শুধু জিজ্ঞেস করতে কোথায় করতে হবে, আমার নাম ধাম সব তার মুখস্ত ছিলো। ইন্টারভিউ দিতে ঢাকায় যেতাম মাসে ২-৩ বার করে। কোথাও চাকরি হতো না। ফ্রেশার ছিলাম, কোন এক্সপেরিয়েন্স ছিলো না। বাবা মুদিখানার দোকান চালাতো, ঢাকা যেতে আসতে মাসে যে খরচ হতো, সেটা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে যেতো। ঢাকায় প্রথম এক মামার বাসায় থাকতাম। মামা এক রুমে সাবলেট নিয়ে থাকতো, সাথে মামী আর বাচ্চা। সেখানে আমার মতো প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে গিয়ে শোয়ার জায়গা থাকতো না, রুমের মেঝেতে একটা চাদর বিছিয়ে ঘুমাতাম। মামা মামী অনেক ভালোবাসতেন, কোনদিন বিরক্ত হন নি, ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার আগে সকালে মামী মামার শার্ট প্যান্ট ইস্ত্রি করে রাখতেন আমার জন্য। মামার অফিসের শু আমাকে দিতেন, বড় হতো, সেটা পড়েই যেতাম।
কিন্তু ২-৩ মাস এভাবে যাওয়ার পরে আমিও বুঝলাম আমার ছোট্ট চাকরী করা মামার জন্য এভাবে আরেকটা মানুষের খরচ চালানো কঠিন। উঠলাম এক বন্ধুর বাসায়। তারা ৬ জন ২ রুমের একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো, বন্ধুও চাকরীর চেষ্টায়। ২ রুমে ৪ জন, আর ২ জন ডাইনিং এ ঘুমাতো। সেখানেও জায়গার কষ্ট। প্রথমবার কেউ কিছু বলেনি, কিন্তু পর পর দুইবার যাওয়ার পরে বন্ধুর রুমমেটরা কেমন যেন চোখে তাকাতো। শেষে সেটাও বাদ দিলাম।
ঢাকায় নিজে কোথায় ভাড়া নিয়ে বা মেসে থেকে চলার ক্ষমতা আমার ছিলো না। শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এক কাজিন থাকতো। তার সাথে মাঝে মাঝে উঠতাম ইন্টারভিউ দিতে গেলে। তার সিঙ্গেল বেডে একসাথে ঘুমাতে খুব কষ্টদায়ক ছিলো।
শেষ পর্যন্ত ভাগ্য ঘুরে দাড়ালো। একটা ব্যাংকে জুনিয়ার অফিসার হিসাবে চাকরী পেলাম। শুরুতে যা বেতন দিতো, তাতে ঢাকায় ১ রুমের বাসা নেওয়াই কঠিন ছিলো। একটা মেসে উঠলাম, একা। সকালে অফিসে যেতাম, সন্ধ্যা রাতে ফিরতাম। মাঝে মাঝে বৃহস্পতিবার রাতের বাসে নাটোর আসতাম বাসায়, শনিবার রাতের বাসে ঢাকা।
কলেজ জীবন থেকেই এলাকায় একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম, সেও বাসতো। মফস্বল শহরে সেভাবে প্রেম করা কঠিন ছিলো, চুপে চাপে যেটুকু কথা হতো, তার নিজের ফোন ছিলো না, গোপনে মাঝে মাঝে কথা হতো।
চাকরী পাওয়ার পরে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম, মেয়ের বাবা প্রথমে রাজী ছিলেন, কিন্তু ব্যাংকে চাকরী করি শোনার পরে সাথে সাথে বললেন সুদের চাকরী ওয়ালা ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দেবেন না। ২ বছর তাকে নানা ভাবে নানা উপায়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করতে পারিনি। শেষে ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম, পায়ের নিচে চাকরীই খুঁটি ছিলো।
বিয়ের পর পরেই বাবা হটাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পুরো পরিবারকে ঢাকা নিয়ে আসলাম, ২ রুমের বাসায় বউ আর পরিবার নিয়ে কাটিয়েছি, ধিরে ধিরে অথনৈতিক মন্দা কেটেছে। ছোটভাইকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেছি, বাবা মাকে হজ করিয়েছি, নিজের একটা ছেলে হয়েছে। এখন নিজের বাসা আছে, একটা গাড়িও আছে।
হয়তো সুদের বেতনের চাকরী করেই এখানে এসেছি, কিন্তু এই চাকরীর কারনে পরিবারকে না খেয়ে মরা থেকে বাঁচিয়েছি, ছোট ভাইকে একটা ভবিষৎ দিয়েছি, বাবা মা’র চিকিৎসা করেছি, তাদের ইচ্ছা পুরণ করেছি।
এই সব কিছুর মধ্যে যদি চাকরী সুদের, এইটুকুই গুরুত্বপুর্ন হয়, তাহলে তারা টাকা কোথায় রাখেন, এই হিসেবটা এসে যেন আমাকে দিয়ে যায়”।
এর সাথে আমার ব্যাক্তিগত একটা মতামত, অনেকেই বলে শুধু ইসলামী ব্যাংকগুলোতে মুনাফা দেয়, অন্যগুলোতে সুদ দেয়। তাই দুইটা আলাদা। অর্থনীতির ভাষায় কেউ একটু বুঝায়েন দুইটা কিভাবে আলাদা !
(#সংগৃহীত)