চক্র

আমরা যখন ছোট ছিলাম বাবাকে প্রায়ই ইফতারের সময় খুঁজে পেতাম না। মা বেসনের সাথে চালের গুড়া মিশিয়ে মচমচে বেগুনি ভাজতেন। আলুর চপ,ছোলা রেডি করে পেয়াজু ভাজতেন সবার শেষে। নানু গ্রামের বাড়ি থেকে টিনভর্তি মুড়ি ভেজে পাঠাতেন।আমি আর ছোটভাই জুলহাস আশায় থাকতাম বাবা গরম গরম জিলাপি নিয়ে এসে আমাদের সাথে ইফতার করতে বসবেন। বাবা জিলাপি কিনতে বাজারে যেতেন ঠিকই কিন্তু বাড়ি ফিরতেন তারাবি নামাজের পর। তখন শীতকালে ঈদ হত। আমরা তিন ভাইবোন ইফতারের পর পরই ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে কিছুক্ষণ পড়া তৈরি করে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরতাম। মা কুপির আলোয় কোরআন শরীফ পড়তেন।দরজায় ছিটকিনি খোলার শব্দ পেলে বুঝতাম বাবা এসেছেন।ভাইবোনদের মাঝে হ। বাবা মোড়া টেনে আমাদের বালিশের কাছে বসে চুলে বিলি কেটে দিতেন। আধো জাগরণে বাবার হাতের স্পর্শ পেয়ে মনে হত বাবা যেন সন্ধ্যার অভাব তার আদরমাখা ছোঁয়া দিয়ে পূরন করে দিতে চাইছেন।

সদর হাসাপাতালে পাশে বাম দিকের চত্ত্বরে বাবার ঔষুধের দোকান। নাম মীরা ফার্মেসী।আমি ক্লাসে সিক্সে উঠার পর বাবার সাথে দোকানে গিয়ে বসতাম। রমজান মাসে সন্ধ্যা নাগাদ দোকান বন্ধ করে বাপ-বেটা বাড়ির উদ্দেশ্য রিকশায় উঠে বসতেন।বাবা বলতেন,
-ভাই, রোযা রাখছেন?
রিকশাওয়ালা প্যান্ডেল ঘোরাতে ঘোরাতে উত্তর দিতেন,
-জ্বী, ভাই।
-রিকশা চালাইয়া রোযা রাখতে কষ্ট হয় না?
-গরীবের আর কষ্ট।

মিনিট দশেকের মধ্যে বাবা রিকশাওয়ালা চাচার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলতেন। তার কয় সন্তান,বাবা-মা বেঁচে আছেন নাকি, দিনে কয় পয়সা রোজগার হয় ইত্যাদি জেনে নেবার পর আচমকা বলে বসতেন,
-চলেন ভাই, আজ আপনার বাড়ি ইফতার করব।
রিকশাওয়ালা খানিকক্ষণ অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকত। তারপর খুশি হয়ে বলত,
-আপনে সত্যি যাইবেন ভাই? আপনার পোলার কষ্ট হইব।জুলেখার মা কি না কি রানছে। তবু চলেন।

সত্যি বলতে কি বাবার এই অযাচিত আবদার আমারো ভালো লাগত না।মা কতকিছু তৈরি করে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে আর আমাদের ইফতার করতে হবে কার না কার বাড়ি। মজার ব্যাপার হচ্ছে যাদের বাড়ি যাই তারা কেউই কখনও আতিথেয়তার কার্পণ্য করে নাই। ইফতারে খেজুর আর কলা ছাড়া আর কিছুই খাওয়াতে পারে নাই তারজন্যে বাড়ির মহিলারা লজ্জায় মরে যেতেন। আমাদের রাতের খাবার না খাইয়ে বাড়ি ফিরতে দিতেন না। আধময়লা জামাকাপড়ের বাচ্চাগুলো আমাকে ঘিরে বড় বড় চোখ করে তাকাত, সেই চোখে খানিকটা ভয় আর অশেষ কৌতুহল। বাড়ির গিন্নি ব্যতিব্যস্ত থাকত সবচেয়ে বেশি। মুরগি জবাই করে বটি নিয়ে কুটতে বসে যেত। রিকশাওয়ালা চাচা এক ফাঁকে গিয়ে পোলাওয়ের চাল নিয়ে আসত।ছোটদের চোখ সুস্বাদু খাবারের লোভে চকচক করত। সেই বাড়ির মায়েরা ঠিক আমার মায়ের মত। মুরগির রান আমার প্লেটে তুলে দিয়ে নরম গলায় বলতেন,
-বাবা, আরেক চামচ পোলাও দেই?
এমনিতে আমি কম খাই কিন্তু গুটিকয়েক সাঙ্গপাঙ্গর পাশে বসে গপাগপ দুই প্লেট ভাত খেয়ে ফেলতাম। বাড়ি
ফেরার সময় অপরিচিত কিছু মানুষ চোখ ছলছল করে তাকিয়ে থাকত। রিকশাওয়ালা চাচা বাবার হাত ধরে বলত,
-ভাইসাব,আপনে গরীবের বাড়ি আরেকদিন আইলে বড় খুশি হব।
আমারো কেন জানি একরাতের পরিচয়ে অচেনা একটা পরিচয়কে খুব আপন মনে হত। বলতাম,
-বাবা,ওরা খুব গরীব। ওদের কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করবে তুমি?
বাবা হো হো হেসে উত্তর দিতেন,
-এক চিলতে উঠোন আর ভাঙা ঘরে বাস করেও মানুষ ভালো থাকতে পারে যদি সে বড় মনের অধিকারী হয়। কিছু মানুষের প্রতিদানের আশায় থাকে না এরা এই দলের। তুমি যখন বড় হবে তুমি সাহায্য করো বাবা, আমার এত সার্মথ্য নেই।

বাবার এই কাণ্ডকারখানার সঙ্গী আমি একা হতাম না ভাইবোনেরাও মাঝে মাঝে যেত। রমজান মাসে মানুষ যেমন অপেক্ষা করে কবে ঈদ হবে আমরা তেমন অপেক্ষা করতাম কবে বাবা আমাদের নিয়ে অদ্ভুত ভ্রমনে বের হবেন।স্টেশনে কুলির কাজ করে, নাপিতের দোকান, ফেরিওয়ালা বাবা কত লোকের বাড়িতে যে নিয়ে গেছেন
। সব বাড়িতে অভিজ্ঞতা মধুর ছিল তা কিন্তু নয়। কোথাও খুব বিরূপ পরিস্থিতিতে পরতে হত। বাড়ি গিয়ে জানা যেত,বাড়ির কর্তা সারাদিন জুতা সেলাই করে আর রাতভর নেশা করে রাস্তায় শুয়ে থাকে।বউ পরের বাড়ি ঝিগিরি করে সংসার চালায়।এদের বাড়ি একটা খাবারের মুখ বেশি মানে বাড়তি যন্ত্রনা।এক গ্লাস পানি আর দুটো খেজুরের চেয়ে বেশি কিছু ইফতারে আশা করাই অন্যায়। বাবা কোনোরকম ইফতার সেরে হোটেলে ঢুকে কাচ্চি খাওয়াতেন কিংবা খাসির পায়া দিয়ে তন্দুর
রুটি। বলতেন,
-দেখ বেটা, আল্লাহপাক তোর রিজিকে রেখেছন কাচ্চি বিরিয়ানি তাই তো ওই বাড়িতে গিয়ে ইফতারে কিছু খেতে পারলি না। তোর মাকে আজকের কথা বলিস না, কষ্ট পাবে।

দেখতে দেখতে ঈদ চলে আসত। আজকালকার বাচ্চাদের মত চার বেলায় চারটে জামা চাইবার কথা কল্পনাও করতে পারতাম না৷জুলহাসের চাই হ্যান্ডলুমের শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট। ছোটবোন মীরার চাই টুকটুকে লাল জামা, পরীর মত দু’পাশে পাখা লাগানো। আমার অত জামাজুতার শখ নাই৷ বাবাকে বলেছি একটা সাইকেল কিনে দিতে।পৌনে দুই মাইল রাস্তা হেঁটে স্কুলে যেতে বড্ড কষ্ট হয়। আর একটা ক্যাসিও ঘড়ি হলে বন্ধুবান্ধবের কাছে মান বাঁচে।আমাদের সংসারে অভাব ছিল না, মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার। তাই এই ছোটখাট শখ গুলো বাবা পূরণ করতেই পারেন এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল৷ তিন ভাইবোন একসাথে হলেই গুজুরগুজুর করি।বাবা নিশ্চয়ই ঈদের দিন আমাদের সবাইকে চমকে দিবেন তাই আগেভাগে কিছু বলছেন না। ঈদের আগের দিন বাবা বাড়ি ফিরলেন অনেক রাত করে। উত্তেজনায় আমরা কেউ ঘুমচ্ছিলাম না। বাবার হাতে অনেকগুলো কাপড়ের ব্যাগ থেকে মীরা লেপ থেকে বের হয়ে লাফাতে লাফাতে শুরু করল।

বাবা মীরার জন্যে গজ কাপড়ের লাল-নীল ছাপার ফ্রক বানিয়ে নিয়ে এসেছেন। আমাদের দুই ভাইয়ের জন্যে সস্তা সুতি শার্ট। মায়ের জন্যে বাড়িতে পরার প্রিন্টের শাড়ি।মনটা এত খারাপ হল বলার মত না। আমাদের অার্থিক অবস্থা কি এতই খারাপ৷ কালকে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বেড়াতে গেলে দেখবে দুই ভাই ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙের শার্ট পরে আছি। পাড়ার ছেলেমেয়েরা তো এরচেয়ে অনেক ভালো ঈদ উপহার পায়। মীরা লাফালাফি ভুলে আমার জামার পাখা কই বলে ভ্যা ভ্যা কান্না শুরু করল। জুলহাসের চোখ ছলছল। আমি ভাত না খেয়েই শুয়ে পরলাম। বাবা ঠিক রোজকার মত আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-ক্লাস এইটে বৃত্তি পেলে আমার বড় ছেলের জন্যে সাইকেল কিনে নিয়ে আসব। হ্যান্ডলুমের শার্ট পরতে হলে বুদ্ধিশুদ্ধি লাগে। জুলহাস তো পড়াশোনায় গোবর গণেশ। আর মীরার পরীর মত জামা আগামী বছরই ছোট হয়ে যাবে।

বাবার মিথ্যা সান্ত্বনায় মনটা আরো ভারী হয়ে উঠল।পরদিন হলুদ শার্ট পরেই ঈদের নামাজ পরতে যেতে প্রস্তুত হলাম। লজ্জা লাগছিল পাড়ারা ছেলেরা নিশ্চয়ই আমাদের দুই ভাইয়ের ঈদের জামা দেখে হাসাহাসি করবে। তবুও তো নামাজ পরতে যেতেই হয়৷ তাই যাওয়া।দুই রাকাত নামাজ শেষ করে সালাম ফিরিয়ে দেখি আমার পাশে আরো কয়েকজন পরিচিত ছেলে একই কাতারে বসে নামাজ পরছে।রিকশাওয়ালা চাচার ছেলে, মুচি দোকানদারের ছোট ভাই যাদের পরনে হুবহু আমাদের দুই ভাইয়ের মতন হলুদ শার্ট। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি মুচকি হাসছেন৷ ঠিক সেই মুহূর্তে কেন জানি হলুদ রঙটা আর খারাপ লাগছিল না।