বাসর ঘরে ঢুকার পরেই বউ বললো, “ আপনাকে একটা কথা বলে রাখি। আমার কিন্তু জামাই আছে! ”
হায় হায়, বলে কী? টানা একবছর কান্নাকাটি করার পর একটা বউ কপালে জুটলো! আর সেই বৌয়ের নাকি জামাই আছে! অসহায়ের মতো বললাম, “ কথাটা বিয়ের আগে বললে পারতে না? বিয়ের আগেও তো আমাদের কথা হয়েছে কয়েকবার! বিয়ের পরেই কেনো বলছো? ”
বউ ঘোমটা ভালো করে টেনে বললো, “ আমি বলেছিলাম তো মাকে। মা বলেছিলো ওরকম দুই একটা জামাই থাকলে কিছু হয় না! ”
হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো আমার। কতো স্বপ্ন নিয়েই না বাসর ঘরে ঢুকেছিলাম!
“ আপনার মা তো তাহলে কাজটা খুবই খারাপ করেছেন! এখন কী হবে? ”
সে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো, “ আমি আমার জামাইয়ের কাছে চলে যাবো। জামাইকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না! ”
শরীরে রক্ত চলাচল মনে হয় বন্ধ হয়ে যাবে আমার! কাঁপছি আমি।
“ জামাই ছাড়া থাকতে কে বলেছিলো? মাঝখান থেকে দিলে তো আমার জীবনটা নষ্ট করে! এখন আমার কী হবে? ”
সে কিছুক্ষণ ভেবে বললো, “ আপনি আমাকে জামাইয়ের কাছে দিয়ে আসুন। আমি আপনাকে পরে অনেক ভালো মেয়ে দেখাবো! ”
মুখ দিয়ে বেরিয়েই গেলো, “ আর তোমার অনেক ভালো মেয়ে দেখাতে হবে না! অনেক ভালো মেয়েই খুঁজে বের করেছিলাম। এখন তাঁর জামাই আছে! ”
সে এবার ঘোমটা সরিয়ে বললো, “ আমাকে যা ইচ্ছে বলুন। তবুও আমাকে জামাইয়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসুন প্লিজ। দেখুন, আমি তো আপনাকে জোর করতে পারবো না! আপনি চাইলে আমাকে ভোগ করতে পারেন। কিন্তু আমার মন জামাইয়ের কাছেই পড়ে আছে! ”
ভেবেছিলাম সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিবো। কিন্তু এখন দেখি সিগারেট আমাকে আর ছাড়লো না!
“ আজকেই যেতে হবে? না কালকে গেলেও চলবে? আমি তো অনেক ক্লান্ত। আর রাতও কম হয়নি! ”
সে সঙ্গে সঙ্গেই বললো, “ নাহ প্লিজ, আজকের রাত পার হয়ে গেলে যদি সে রাগ করে! তখন আমার কী হবে? ”
আমি নিরুত্তর! সে আবার বললো, “ একটু কষ্ট করুন না। আপনি তো ছেলে মানুষ। আপনি আরেকটা বিয়ে খুব সহজেই করতে পারবেন। কিন্তু আজকের রাত পার হয়ে গেলে তো আমার জীবন শেষ! ”
মেয়েটার জোরাজুরির কাছে আমার ক্লান্তি হার মানলো। বললাম, “ এখন বাড়ির বাহিরে গেলে মানুষজন যদি আটকায়? মানে যদি জিজ্ঞেস করে বউ নিয়ে বাড়ির বাহিরে কেনো যাচ্ছি? ”
“ বলবেন এটা আপনার ছোট বেলার স্বপ্ন। বাসর রাতে বউকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটার, ব্যাস হয়ে গেলো! ”
মেয়েটার মাথায় বুদ্ধি আছে বলতে হবে! কিন্তু তাতে কী? সে তো আর আমার সাথে থাকছে না!
দরজা খুলে বললাম, “ চলো তোমার জামাইয়ের কাছে দিয়ে আসি তবে। ”
সে প্রথমে বের হলো না। বললো, “ আপনি আগে আগে থাকুন না। নাহলে মানুষজন ভাববে আমি পালাচ্ছি! ”
আমি আগে আগেই থাকলাম। যেই কথা সেই কাজ। মা এখনো ঘুমায়নি। বললো, “ কীরে জামাল, বউ নিয়ে বাহিরে বের হলি কেনো? ”
আমি আমতাআমতা করে বললাম, “ নাহ মানে, আমার ছোট বেলার স্বপ্ন। বাসর রাতে বউকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটার। ”
মা কপালে হাত দিয়ে বললো, “ সারাদিন কান্নাকাটি করতে করতে মেয়েটা শেষ! আর তুই রাতে তাঁকে নিয়ে বের হচ্ছিস হাঁটতে? ”
“ বেশি দূর যাবো না তো। একটু গেটের আশেপাশে হেঁটে চলে আসবো! ”
মা আর বেশি কিছু বললো না। আমরা হাঁটতে হাঁটতে গেটের কাছে চলে আসলাম। বউ বললো, “ আপনি কিন্তু ভালোই মিথ্যা বলতে পারেন। ”
“ যাই গিয়ে মাকে সত্যি বলে আসি? ”
“ আরেহ না না, এমনটা করবেন না প্লিজ। এখন কোনো গাড়ির ব্যবস্থা করুন না। হেঁটে হেঁটে তো আমাদের বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া যাবে না! ”
আমি অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকালাম।
“ তোমাদের বাড়িতে কেনো? সে ঘরজামাই থাকে নাকি? ”
মেয়েটা যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো, “ এটা কেনো বললেন? সে ঘরজামাই থাকবে কেনো? আমাদের বাড়ির পাশেই উনার বাড়ি। ”
“ ওহ, আচ্ছা মাফ করবেন আমাকে। আসলে আমি বুঝতে পারছি না। আপনাকে তুমি করে বলবো? না আপনি করে? ”
“ তুমি করেই বলুন, সমস্যা নেই। আমি তো আপনার ছোটই! ”
এখন আরেক ঝামেলায় পড়লাম। এই রাতে কাকে ফোন দিয়ে বলি গাড়ির ব্যবস্থা করতে? ছোট কাকার মোটরসাইকেল আছে। কিন্তু এখন তিনি নিশ্চিত ঘুমুচ্ছেন! চাবি কীভাবে আনি?
বললাম, “ তুমি তাহলে এখানে একটু দাঁড়াও। আমি ছোট কাকার বাইকটা নিয়ে আসি! ”
“ তাড়াতাড়ি আসবেন, আমার একা একা ভয় লাগে! ”
আমি ছোট কাকার দরজায় এসে ঠকঠক করতেই তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, “ কে? কী চাস? ”
ঘুমের মধ্যে বিরক্ত করা ছোট কাকা একদম পছন্দ করেন না! বললাম, “ আমি জামাল, কাকা বাইকের চাবিটা একটু দাও না। ”
“ তুই? আজকে রাতে তোর বাইক লাগে কেনো? বিয়ে করেছিস না? এবার একটু টইটই কম কর! ”
“ নাহ, দাও না একটু। বেশিক্ষণ লাগবে না! ”
দরজার নিচ দিয়ে দেখলাম কাকা চাবি দিয়েছে। বাইক বাহিরেই থাকে। বাইকে চাবি লাগাতেই মা হাজির, “ কীরে, তুই না হাঁটবি বউকে নিয়ে! এখন বাইকের কী দরকার? ”
“ বউয়ের নাকি পা ব্যথা করছে। তাই বাইক দিয়েই হাঁটাহাঁটি করাই ভালো হবে না? ”
মা স্বস্তির শ্বাস নিলো, “ তোর মাথায় বুদ্ধি আছে! ”
উফ, ঝামেলা আর ঝামেলা।
গেটের কাছে বাইক নিয়ে আসতেই বউয়ের মুখে হাসি, বিশ্ব জয় করা হাসি! দারুণ লাগছে, কিন্তু যখন মনে হলো এই হাসিটা আজকের পর আমি দেখতে পারবো না। তখন বুকের মধ্যে কী যেন হয়ে গেলো!
হাসিমুখে সে বললো, “ বাইকের পিছনে বসতে আমার খুব ভালো লাগে জানেন? কিন্তু আমার জামাই না বাইক চালাতে পারে না! ”
আমি বললাম, “ উঠে বসো তো। জামাই জামাই আর করো না! ”
সে উঠে বসলো।
“ কেনো? আপনার বিরক্ত লাগছে? ”
“ নাহ, আমার সুখ লাগছে। বাসর রাতে বউকে তাঁর পুরনো স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছি। আমার সুখ লাগার কথা না? ”
সে আমাকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো, “ এরকম অনেকের জীবনেই হয়। চিন্তা করবেন না! ”
ধীরে ধীরে বাইক চালাতে শুরু করলাম। চোখে ঘুম, বুকে ব্যথা। বাতাস বইছে। বউ আবার বললো, “ বেশি জোরে আবার চালাবেন না। তাহলে আপনাকে ধরতে হতে পারে আমার! ”
আমি বাইকের গতি আরো কমিয়ে দিলাম। অন্যের স্ত্রীর স্পর্শ আমি চাই না।
কিছুক্ষণ পর আবার সে বললো, “ আচ্ছা আপনার কী ভালো লাগে? নদী না পাহাড়? ”
“ এসব জেনে তোমার কী কাজ? ”
আবার সে চুপ করলো। রাতের আঁধার কেটে সূর্যের আলো উঁকি দিচ্ছে। চোখ ব্যথা করছে আমার। বউয়ের বাপের বাড়ি, আমার অস্থায়ী শ্বশুর বাড়িতে এসে পৌঁছলাম।
শ্বশুর বাড়ির লোকজন এতো ভোরে আমাদের দেখবে এমন আশা করেনি!
না করারই কথা। সাধারণত বিয়ের পর একদিন মেয়েরা স্বামীর বাড়িতে থাকে। তারপর আসে। আমাকে দেখার পর তো তাঁদের জামাই আদরের শেষ নেই! আমার এসব একদম ভালো লাগছে না! বাড়ির উঠোনেই বউকে তাঁর মা জিজ্ঞেস করলো, “ ব্যাপার কী রে সানজিদা? রাত না পোহাতেই চলে এলি যে? একটা দিন থাকতে পারলি না? ”
বউ সরাসরি বলে দিলো, “ আমার জামাইয়ের কাছে চলে এসেছি! ”
শ্বাশুড়ি যেন ভূত দেখলেন! এরকম ভাব করলেন। আমার মনে হয় না এই অভিনয়টা করার কোনো দরকার আছে! আমি বললাম, “ আমি তাহলে যাই? ”
বউ মানা করলো।
“ আরেহ কোথায় যান? এতো কষ্ট করে এলেন আমার জামাইকে দেখে যাবেন না? ”
আমাকে আসতে দিলো না। বললো, “ পাশের বাড়িতেই জামাই থাকে। আমি বলেছিলাম তাঁকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না! এখন মনে হয় খুব রাগ করে আছে। আপনি সঙ্গে থাকলে তাঁর রাগটা ভাঙ্গাতে আমার জন্য সহজ হবে! ”
মনে মনে বললাম। চল ভাই। এটাও কর। এটা বাকি রাখবি কেনো?
আমাকে নিয়ে গেলো পাশের বাড়িতে। গেটে তালা দেওয়া। বউ বললো, “ আপনার ফোনটা দিন তো। শ্বাশুড়ির কাছে ফোন দেই। ”
আমি মোবাইল দিলাম। সে ফোন দিলো শ্বাশুড়ির কাছে।
“ হ্যালো, আমি সানজিদা। আমার জামাইটাকে নিয়ে একটু বের হোন না! ”
অপর পাশ থেকে কী বললো আমি শুনলাম না। আবারো সানজিদা বললো, “ নাহ নাহ, আমি চলে এসেছি। আপনি জলদি বের হোন তাঁকে নিয়ে! ”
কিছুক্ষণ পর একজন ভদ্রমহিলা বের হলেন। কোলে একটা ছোট্ট বাচ্চা! গায়ে তাঁর কোনোই কাপড় নেই! বাচ্চাটাকে নিয়ে বের হতেই সানজিদা তাঁকে কোলে নিলো!
আর বলতে লাগলো, “ ওরে আমার সোনাটা রে। আমি তোমাকে কত্ত মিস করছি তুমি জানো? কথা দিয়েছিলাম তোমাকে ছাড়া কাউকেই বিয়ে করবো না। কিন্তু মা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে। তুমি রাগ করো না প্লিজ! আমি আর কোথাও যাচ্ছি না! ”
বলতে বলতে বাচ্চার ঠোঁটে, চোখে, মুখে সে চুমু খেতে লাগলো! ভদ্রমহিলা মুচকি মুচকি হাসছেন! তিনি আমাকে নিশ্চয় কাল বিয়েতে দেখেছেন। দেখারই কথা! এদিকে আমার অবস্থা শেষ! হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না!
মাথায় হাত দিয়ে বললাম, “ এই তোমার জামাই? আগে বললে কী হতো? এরকম চার পাঁচটা বউ তো আমারও আছে! ”
সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “ তাহলে আমাকে বিয়ে করলেন কেনো? ”
আমি কী উত্তর দিবো এই কথার? উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তাঁদের কান্ড দেখছি, জামাই বৌয়ের কান্ড। জামাই বেচারা কিছু বলতে পারছে না। হাত পা নাড়িয়ে যাচ্ছে শুধু। মাঝে মধ্যে উঁ আঁ শব্দ করছে। মুখ দিয়ে লালা পড়ছে তাঁর। কী বলতে চাইছে কে জানে?
ভদ্রমহিলা বললেন, “ ভেতরে আসো বাবা। ও এমনই। ইউসুফ হওয়ার পর থেকেই ওকে জামাই ডাকে। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছো। কিন্তু আজকেই চলে আসবে আমি ভাবতে পারিনি! ”
ভদ্রমহিলার বাড়ির ভেতরে গেলাম। কিন্তু বউ আমার সাথে রাগ করে আছে! এতো কিছু করলাম আমি তাঁর জন্য! আর সে আমার সাথেই এখন কথা বলছে না! জিজ্ঞেস করলাম, “ কথা বলছো না কেনো? ”
“ আপনার না চার পাঁচটা বউ আছে? তাঁদের সাথে গিয়ে কথা বলুন যান! ”
“ মেজাজটা আর খারাপ করবে না। এমনিতেই তুমি আমার বাসর রাত মাটি করে দিয়েছো! এই বুড়ো জামাইয়ের কাছে কয়েকদিন পরে এলেও সে কিছু বলতে পারতো না! ”
সে আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে!