এগুলোকে যৌতুক বলা হয় না

আমার বড় মেয়ের মোহর এগারো লাখ ছিলো। এখন সেই হিসেবে ছোটটার পনেরো লাখের কম হলে মানুষের সামনে বলবো কীভাবে? তাছাড়া মোহর তো আর আদায় করতে হচ্ছে না আপনাদের। কাগজে কলমে লেখা থাকবে শুধু। স্বর্ণ ও কম করে হলেও দশ ভরি দেওয়া লাগবে। আমার ছোট মেয়েটার বিয়ে, সেই হিসেবে সবকিছুই যেনো পাকা-পোক্ত শক্তরকম ভাবে হয় সেইটা আমাকে মাথায় রাখতেই হবে।

কথাগুলো এক নিমিষে বলে গেলেন রহমান চৌধুরী।
শেষমেশ তাওফিক সাহেব বললেন, ঠিক আছে। আপনার কথায় আমরা রাজি। আমার ছেলের আপনার মেয়েকে পছন্দ হয়েছে আমার আর কিচ্ছু চাই না। আর এসব বিয়ে-শাদিতে এগুলা কোন শর্তই হয় না। আপনার মেয়েকে আপনি যত ভালো জিনিস সম্ভব আপনি দিবেন।
কথা প্রসঙ্গে রহমান চৌধুরীকে ছেলের বাবা তাওফিক সাহেব বললেন,
তা ভাই সাহেব আমারও মেয়ের বিয়ে হয়েছে গত বছর। জামাই আমেরিকান সিটিজেন। তাদের ফুল ফ্যামিলি সেখানে থাকে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি বিশাল কনভেনশন সেন্টারে। সেখানে জামাই বাড়ির দাওয়াতি ছিলেন দুই হাজার। হাতিলের ভালো ফার্ণিচারও দিয়েছি। একমাত্র মেয়ে আমার বুঝেন তো।
তামাটে দাত বের করে মেয়ের বাবা রহমান চৌধুরী বললেন, হে হে হে। বুঝতেছি বেয়ান সাহেব। এসব মেয়েদের বিয়েতে খরচা পাতি অনেক। আচ্ছা ইয়ে বলছিলাম যে, বিয়ের কাপড়-চোপড় এসব যদি ইন্ডিয়া থেকে আনিয়ে দিতেন তাহলে ভালো হতো। আমার মেয়ের এসবে ঝোক একটু বেশি।
আচ্ছা আচ্ছা বেয়ান সাহেব এ আমি ভালোই বুঝি। আমার ছেলেও বউকে যাই দিবো সব তো আমার। সুন্দর আমার হলে আমার ছেলের-ই নাম হবে। এসব নিয়ে আপনি কিচ্ছুটি ভাববেন না বেয়ান সাহেব।
ছেলের বাবা তাওফিক সাহেব আবার শুরু করলেন তার মেয়ের বিয়ের পুঁথিপাঠ। মেয়ের বিয়েতে মেয়ে জামাইয়ের কাপড়-চোপড় এসবের জন্য এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন তিনি। বিয়ের পর তাদের হানিমুনের জন্যও ব্যাংককের টিকিট আর একটা রিসোর্টের এক সপ্তাহ বুকিং বাবদ দুই লাখ টাকা দিয়েছিলেন মেয়ে জামাইকে।
এবার রহমান চৌধুরী একটা কাশি দিলেন। ভেতরে ডাক দিলেন, জান্নাতের মা, চা-নাস্তা-মিষ্টি নিয়ে আসো। মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে।
মেয়ের মা মিষ্টি নিয়ে আসলেন। বেয়ান কে সালাম করলেন। তারপর রহমান সাহেবের পাশে বসে শুরু করলেন মেয়ের গুণপুঁথি পাঠ। আমার জান্নাতের মতো মানুষ হয় না বেয়ান সাহেব। আপনার ঘরকে আলো করে রাখবে আমার মেয়েটা। কাজ-কাম সব পারে সে। দেখবেন কোন কম্প্রোমাইজের সুযোগ আসবে না আপনাদের।
হে হে হে। না না কম্প্রোমাইজের সুযোগ আমরাই দিবো না। ভালো ঘরে সম্বন্ধ করা মানেই সবকিছু ভালো হওয়া। জানেন আমার ছোট শালা বিয়ে করেছিলো গরীব ঘরের এক মেয়েকে। তারপর সবকিছুতেই শুধু কমতি আর কমতি। আমি বাবা তার পর থেকে এক প্রকার শপথ করে বসে আছি। ছেলে মেয়েকে বিয়ে করালে বড় ঘরেই করাবো। বড় ঘরের বাপ মায়েরা এসব আচার নিয়ম ভালোই জানে।
.
এবার রহমান চৌধুরী বললেন, তা বেয়ান সাহেব গহনা কি আগে দিয়ে দিবেন? না মানে আগে দিয়ে দিলে ভালো হতো আরকি।
আরেহ কী যে বলেন আপনি। আমার মেয়ের বিয়েতেও আমি আগে গহনা নিয়েছি। তারপর শ্যাকরা দিয়ে যাচাই করিয়েছি সেগুলো। খাটি সিঙ্গাপুরের ২৪ ক্যারেট গোল্ড ছিলো। আপনার মেয়ের গহনাও আমরা আগে আগেই পাঠিয়ে দিবো।
বেয়ান সাহেব, ভুল বুঝলেন মনে হয়। আসলে শ্যাকরা দিয়ে যাচাই করাতে চাই না আমি। মেয়ে বিয়ে দিবো আর যদি ভরসাই না থাকে তাহলে কীভাবে হয় বলেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ। ভরসা তো অবশ্যই। আচ্ছা আমাদের বিয়েতে বর পক্ষের দাওয়াতি থাকবে এক হাজারের মতো। আপনাদের চাপ দেওয়াতে চাচ্ছি না তো, তাই মানুষ কম দাওয়াত দিবো।
আচ্ছা আচ্ছা। আপনি যেমন ভালো বুঝেন বেয়ান সাহেব। আর আরেকটা কথা বলে নেই, মেয়ের বিয়ের ফার্ণিচার কিন্তু আধুনিক ডিজাইনের হাতিল দিবো না ভাবছিলাম। কাঁঠাল কাঠ দিয়ে এক সেট পোক্ত কাঠের ফার্ণিচার দিবো ভাবছিলাম। কেমন হয়?
এগুলা আর বলা লাগে নাকি বেয়ান সাহেব। আপনার মেয়ে বললাম ই তো আপনি যেভাবেই দিবেন সেভাবেই হবে। আমার মেয়েকে অবশ্য ৪২” টিভি, বড় দুই পার্টের চার হাজার লিটারের ফ্রিজ সব দিয়েছিলাম।
আচ্ছা আচ্ছা সব থাকবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
তা বিয়ের তারিখ?
আহা! ভালো কাজে দেরি কিসের? আগামী সোমবারেই হয়ে যাক। কী বলেন? আপনি অবশ্য মেয়ের বাবা আপনার আপত্তি বা সমস্যা থাকলে জানাতে পারেন। আমি সোনার গহনা আজ সন্ধ্যার পরই ছেলের মা’কে দিয়ে পাঠিয়ে দিবো আপনাদের বাসায়।
না বেয়ান সমস্যা নেই। আগামী সোমবারেই থাকুক।
তাহলে আমি এবার আসি রহমান সাহেব?
খাবার খেয়ে যান?
না না। কত দাওয়াত, ইফতারি এখনও বাকি আছে। সবকিছু খাবো তবে আজ না।
.
এভাবেই মেয়ের বাবা দশ ভরি স্বর্ণ, পঁণেরো লাখ টাকা মোহর, ইন্ডিয়া থেকে কাপড় কেনার শর্ত দিয়ে মেয়ে বিক্রি করলেন। আর ছেলের বাবা নিজের মেয়ের উদাহরণ দিয়ে, ভালো ফার্ণিচার, ফ্রিজ, টিভি, বিয়ে শেষে ছেলের হানিমুন টিকেট, ছেলের কাপড় কেনার জন্য লাখ খানেক টাকা, কনভেনশন সেন্টারে হাজার মানুষ খাওয়ার ফর্দ দিয়ে মেয়ে আনার সম্মতি দিলেন। এগুলোকে আবার যৌতুক বলে না। এগুলো বড়লোকের ফ্যাশন।