শাড়ির আঁচল ঠিক করো।বেহায়ার মতো আমাকে শরীর দেখানোর প্রয়োজন নেই।
আফরানের কথায় বোকা হয়ে যায় মুনিরা।
জর্জেট এর শাড়ি পরেছে সে।কিন্তু পিন না দেওয়ার কারণে কখন যে আঁচলটা খানিকটা বুক থেকে সরে গিয়েছিলো বুঝতেই পারেনি।
তাই বলে আফরান এভাবে বলবে!সেতো আর পর পুরুষ নয়।তার স্বামী।ভালো করে বললেই হয়।অবশ্য ভালো ব্যবহার তার কাছ থেকে আশা করাও ঠিক হবেনা এখন।কেননা অন্য চার-পঁাচটা বিয়ের মতো তাদের বিয়েটা স্বাভাবিক নয়।
মুনিরা….
গ্রামের মেয়ে।মা-বাবার খুব বাধ্য মেয়ে।এইস.এস.সি পরীক্ষার পর পরই বাবা তার বিয়ে ঠিক করে।তার বাবার মতে গ্রামের মেয়েদের এতো পড়া-শোনা করে লাভ নেই।
তার সাথে যে ছেলের বিয়ে ঠিক হয় তার নাম আনাস,
ছেলেটি ডুবাই কাজ করে।বিয়ে করতেই দেশে এসেছে।
মুনিরাকে একবার দেখেই তার ভালো লাগে।
মুনিরার ও ছেলেটিকে পছন্দ হয়।দুই পরিবারের সম্মতিতে তাদের বিয়েও ঠিক হয়।
কিন্তু বিয়ের দিন এমন একটা পরিস্থিতির সমুক্ষীন হবে সে জানতোনা।
বিয়ের আসরে আসার পথেই মুনিরার হবু বর মারা যায়।তাদের গাড়িটি একটি ট্রাকের সাথে ধাক্কা লাগে।হবু বরের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয় মুনিরাকে।গ্রামের মানুষের মতে মুনিরা অপয়া বলেই আনাসের মৃত্যু হয়।আর তাই মুনিরাকে তাকে আর এই গ্রামে রাখতে চায়না,গ্রামের আর কোনো ছেলের সাথে তার বিয়ের চেষ্টা-ও করা যাবেনা।
ঘরের ভেতর থেকে এসব কথা শুনতে পায় মুনিরা।তার মা-বাবার সাথে গ্রামের মানুষের তর্ক হচ্ছে শোনা যাচ্ছে।আনাস মারা গিয়েছে,,এতে কি তার নিজেরও কষ্ট হচ্ছেনা!বর না হোক,হবু বরতো ছিলো।তার কষ্ট টাও কেউ দেখছেনা।উল্টো অপবাদ দিচ্ছে।এসব কি তার প্রাপ্য ছিলো!ভাবতে ভাবতে তার ঘরের ভেতর কয়েক জন মহিলা ঢুকে পরে।হাত ধরে তাকে বাহিরে নিয়ে যায়।এক ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে একজন বলে উঠে-
এই মাইয়ার এহানে কোনো জায়গা নাই।এ মাইয়া গ্রামের পোলা সব খায় ফেলবো।এহনি এরে বের করো।
মুনিরার বাবা সবার কাছে মেয়ের সম্মান রক্ষার জন্য আকুতি মিনতি করছিলো।গ্রামের চেয়ারম্যান,মেম্বার কেউ-ই তাকে সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি।
আর তখনি আফজাল খান এসে মুনিরার বাবার হাত ধরে বলেন-
তোমার মেয়েকে আমি নিয়ে যাবো।আমার একমাত্র ছেলের পুত্র বধু হবে মুনিরা,যদি তোমার আপত্তি না থাকে।
আফজাল খানের কথা শুনে অবাক হয়েছিলো মুনিরার মা-বাবা।তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছে আফরান!
আফজাল খান…..
চট্রগ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাঝে একজন।তার একমাত্র ছেলে আফরান খান।
আফরানের মতামত ছাড়া তার বাবা এমন একটা কথা বলে বসবে সে ভাবেনি।তাড়াহুড়ো করে বাবার হাত ধরে একটু দূরে নিয়ে বলে-
বাবা তুমি এমন করতে পারোনা।আমি এতো পড়াশোনা করেছি একটা গ্রামের মেয়ে বিয়ে করার জন্য?
-মেয়েটা এইস.এস.সি. পাশ করেছে।ওকে আমি আরো পড়াবো।
-না বাবা…
-কোনো কথা আমি শুনতে চাইনা আফরান।মেয়েটা অসহায়।আমার বন্ধুর এমন অবস্থায় আমি ওকে সাহায্য করবোনা!তাছাড়া মুনিরার বাবা তোমাকে ছোট বেলায় পুকুরে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে ছিলো বলেই আজ তুমি….
-তুমি অন্য কিছু করে ঋণ শোধ করো কিন্তু এটা আমি করতে পারবোনা।
-তুমি আমার কথার মান রাখবেনা আফরান?
কথা শেষ না হওয়ার আগেই একটি মহিলা চেঁচিয়ে উঠলো-
এরা কি এই মেয়েকে নিবে নাকি বের করবো এরে?
অসহায় দৃষ্টিতে আফজাল সাহেব তার ছেলের দিকে তাকালো।আর তখনি আফরান মাথা নেড়ে সাই দিলো।
অবশেষে হয়ে যায় আফরান আর মুনিরার বিয়ে।রওনা হয় তারা শহরের উদ্দেশ্যে।
ঘরে পৌছে কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে সায়নী।আফরানের পাশে লাল কাতান শাড়ি পড়া মেয়ে দেখতেই বুকটা ধুক করে উঠে তার।সাথে সাথেই আফজাল সাহেব বলে উঠে-আফরানের বউ এটা।বিয়ে খেতে গিয়ে বউ নিয়ে এসেছি,হাহাহাহা।
সায়নীর মাথায় কিছু ডুকছেনা।সে শুধুই আফরানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এক দৃষ্টিতে।
আফজাল খান ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলেন
-আফরান,মুনিরাকে তোর ঘরে নিয়ে যা।
আর সায়নী তোর খালাম্মার একটা শাড়ি এনে দে মুনিরাকে।
আফরান নতুন বউ নিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে।
কিভাবে কি হলো কিছুই বুঝতে পারছেনা সায়নী।
সায়নী….
আফরানের খালাতো বোন।৭বছর ধরে আফরানদের বাসায় থাকে সে।কারণ ৭বছর আগে এক্সিডেন্ট এ মা-বাবা,দু’জনকেই হারায় সায়নী।
সেদিনটা ছিলো তার জীবনে এক ভয়াবহ দিন।
সায়নীর পরিবার আফরানদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলো।তখন আফরানের মা ছিলো ৮মাসের প্রেগন্যান্ট।রাতের খাবার খেয়ে সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছিলো।সেই সময় হঠাৎ পেটে ব্যাথা করে উঠে আফরানের মায়ের।সায়নীর মা বুঝতে পারে তার পেইন উঠেছে।এদিকে আফজাল খান বাসায় ছিলেন না।তাই সায়নীর মা-বাবা ঠিক করে তারাই আফরানের মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে।
সায়নীর মা ড্রাইভার কে গাড়ি বের করতে বলে সায়নী আর আফরানের কাছে এসে বলে-
তোরা বাসায় থাক,অফিস থেকে দুলাভাই(আফজাল খান) এলে উনাকে নিয়ে হাসপাতাল চলে আসিস।
গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায় তারা।কিন্তু পথে এক্সিডেন্ট এ মৃত্যু হয় সকলের।
সেই সময় আফরানের পাশে ওর বাবা থাকলেও,সায়নীর পাশে ছিলোনা কেউ।তাই
আফজাল খান সায়নীর সব দায়িত্ব নেন।
সায়নী খালাম্মার একটা জর্জেট শাড়ি নিয়ে মুনিরার কাছে আসে।সে সময় রুমে আফরান কে দেখতে পায়নি সে।
-কেমন আছো মুনিরা?
-আমার আর ভালো থাকা!
-কেনো?
-যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো সে মারা গিয়েছে।অপয়া বলে তাড়িয়ে দিচ্ছিলো গ্রাম থেকে,আর তখনি আমাকে বিয়ে করে উদ্ধার করেছে উনি।
-ওহ।
-আপনি কে?
-সায়নী।আফরানের খালাতো বোন।এখানেই থাকি ৭বছর ধরে।কিন্তু চিন্তা করোনা খুব তাড়াতাড়ি চলে যাবো।
-কেনো?
-বিয়েতো সামনে।
-ও আচ্ছা।কিন্তু কিসের চিন্তা?
-কিছুনা।
আর কিছু না বলেই সায়নী নিজের রুমের দিকে রওনা হয়।
এদিকে আফরান নিজের ফোন-টি নিতে রুমে আসতেই দেখে শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুনিরা।কিন্তু আঁচল-টা ঠিক নেই।এমন দৃশ্য দেখে মাথাটা ঠিক রাখতে পারেনি সে।শুনিয়ে দেয় কয়েকটা কথা মুনিরাকে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইছে সায়নী।পেছন থেকে কেউ তাকে জড়িয়ে ধরে।এই স্পর্শ তার অচেনা নয়।
-সায়নী??
আফরানের ডাকে ঘোর কাটে সায়নীর।তার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে একটু দূরে গিয়ে বলে-
নতুন বউ ফেলে তুমি এখানে কেনো?
-তোমাকে কিছু বলার আছে আমার।
-শুনতে চাইনা কিছু আমি।
-বলতে না পারলে যে আমি শান্ত হতে পারবোনা।
-শুনলে হয়তোবা আমি শান্ত থাকতে পারবোনা।যাও প্লিজ তুমি তোমার বউ এর কাছে।
কথাটি বলেই সায়নী বারান্দা থেকে চলে যেতে যায় কিন্তু হাতের টান পড়ে চলে যায় আফরানের বুকে।আফরান তার হাত ধরে টেনে নিজের বুকে নিয়ে এসেছে সায়নীকে।
আফরানের বুকে মাথা রেখে ফুফিয়ে কেঁদে উঠে সায়নী।অনেকক্ষণের জমানো কান্না বের হয়ে আসে তার চোখ দিয়ে।আফরান সায়নীর মুখ তার বুক থেকে উঠিয়ে,চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে-
এই পাগলি,,আফরান শুধু সায়নীর।
-তাহলে এই বিয়েটা?
-বাবা কেমন তুমিতো জানোই।ওই মেয়েকে উদ্ধার করার জন্যই…
-শুনেছি আমি।কিন্তু সেতো তোমার বউ এখন সমাজের চোখে।
-আর তুমি?
-আমি??আমি তোমার খালাতো বোন সমাজের চোখে।
-এসব আমি মানিনা সায়নী।উদ্ধার করার দরকার ছিলো করেছি।এই মেয়েকে আমি ডিভোর্স দিবো।
-কিন্তু খালু?
-ওসব নিয়ে ভেবোনা,আমাকে কিছুদিন সময় দাও তুমি।
কথাগুলো বলে চলে যায় আফরান।কিন্তু সায়নী জানে যতটা সহজভাবে আফরান কথা গুলো বলেছে,ততটা সহজ কিছুই নয়।ওই মেয়েটা আফরানের পরিবারের,আইনের,
সমাজের চোখে তার বিয়ে করা বউ।এতই কি সহজ হবে সম্পর্ক-টা বিচ্ছেদ করা!
কিন্তু তার সম্পর্ক!সায়নী আর আফরানের সম্পর্ক-টা কি মিথ্যে ছিলো!
না,এতোদিনের মিষ্টি সম্পর্ক-টা মিথ্যে হতে পারেনা।কোথাকার কোন মেয়ে এসে আফরান
কে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারেনা এতো সহজেই।আফরান ঠিকই বলেছে, আফরান শুধু সায়নীর।
৭বছর আগে যখন সায়নীর মা-বাবা মারা যায়,
আফরানের বাবা সায়নীর দায়িত্ব নেয়।নিজের মেয়ের মতোই মানুষ করে তাকে।আফরানের সাথেও কখনো তুলনা করেনি।তখন তারা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ভার্সিটি-তে ভর্তির জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছিলো।দুজনেই সম-বয়সী ছিলো।সায়নী চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলেও আফরান পায়নি।সে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি-তে ভর্তি হয়।
সে সময় সায়নী বাসার হাল ধরে।আফজাল খান সায়নীকে পেয়ে খুবই খুশি ছিলেন।বাসার সমস্ত দায়িত্ব তিনি সায়নীকে দিয়েছিলেন।
এদিকে আফরান ছিলো দুষ্টু স্বভাবের।কিন্তু মা মারা যাওয়ার পর থেকেই তার স্বভাব অনেকটা বদলে যায়।সারাক্ষণ একা থাকতো সে,নিজেকে ঘর বন্দি করে রেখেছিলো সে।এদিকে এতো বড় বাড়িতে সায়নীর একা একা সময় কাটতো না।
একদিন বলেই বসে আফরানকে-
ভাইয়া??
-হুম সায়নী বল?
-একা একা ভালো লাগেনা।তুমি কথাও বলোনা আমার সাথে।কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবা প্লিজ??
সেদিন প্রথম আফরানের সাথে বাহিরে যায় সায়নী।সমুদ্রের পাড়ে তারা সময় কাটায়।
সেই থেকে আফরানের সাথে সায়নীর ভাব জমে।কিন্তু বুঝতে পারেনি সেদিনও এই আফরান-কে ছাড়াই একদিন সে অচল হয়ে যাবে।
-সায়নী মা??
খালুর ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বের হয় সায়নী।তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয় সে।
-খালু ডেকেছো?
-আরে ভাত খাবোতো।কটা বাজে খেয়াল আছে তোর?
-জ্বী দিচ্ছি।
রাতের খাবার খেয়ে আফজাল খান ও মুনিরা নিজের রুমে গেলেও ডাইনিং রুমেই দাঁড়িয়ে থাকে সায়নী-আফরান।
-যাচ্ছোনা কেনো নতুন বউ এর কাছে?
কিছু না বলেই আফরান এগিয়ে যায় নিজের রুমে।তা দেখে সায়নীর বুকে পাথর চাপা পরে।
১মিনিট-ও অপেক্ষা না করে নিজের রুমে চলে যায় সায়নী।মাটিতে বসে কাঁদতে থাকে অঝোর ধারায়।আফরান তার কথার জবাব না দিয়ে এভাবে ওই মেয়েটির কাছে চলে যেতে পারলো!
কিছুতেই শান্ত হতে পারছেনা সায়নী।নিজের পরণের কামিজ হাত দিয়ে টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলছে সে।আর তখনি তার হাত ধরে ফেলে আফরান।
-ছাড়ো আমাকে।
-এই পাগলি,এমন করছো কেনো?

-তুমি এমন করলে আমার কি হবে?আমাকে কে সাপোর্ট দিবে?
-কেনো!তোমার নতুন বউ দিবে।শারীরিক,মানসিক সব সা….
আর কিছু বলতে না দিয়ে সায়নীর গোলাপি ঠোঁট জুড়ো নিজের ঠোঁটের মাঝে ঢুকিয়ে নিলো আফরান।সে জানে কিভাবে সায়নীকে শান্ত করা যায়।খানিকক্ষণ ঠোঁট জোড়া শুষে নিয়ে আফরান বলে উঠে-
ওই মেয়েটাকে নিজের রুম থেকে সরিয়ে এসেছি।আমার সব কিছুতেই শুধু তোমার অধিকার।
-সত্যি?
-একদম।অনেক বেশি ভালোবাসি তোমায়।
কথাটি বলেই সায়নীকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় আফরান।নিজের শরীরের ভার টুকু ছেড়ে দেয় সায়নীর শরীরের উপরে।সায়নীর মন-টা তার শান্ত করতে হবে,অবশ্য নিজের মন-ও শান্ত করতে এখন সায়নীকে প্রয়োজন তার।

-“প্রতিদিন রাত হলে পাশের রুমে চলে যাবা।তোমার সাথে এক রুমে রাত কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।তাই রাতে যেনো তোমায় এই রুমে না দেখি।নিজ দায়িত্বে চলে যাবে।”
ঘুম ভেঙ্গে যায় মুনিরার।চোখ মেলে দেখে চারদিক আলোকিত হয়ে আছে।বাহিরে পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে।কিন্তু এই ভোর বেলা স্বপ্ন দেখছে সে!মাথাটা বোধহয় খারাপ হয়ে গিয়েছে।
শোয়া থেকে উঠে বসতেই মনে পড়ে যায় কাল রাতের ঘটনা।এসব কথা আফরান বলেছিলো তাকে।সারারাত এসব নিয়ে চিন্তা করেছে তাই হয়তো মাথা থেকে যায়নি।কিন্তু আফরানের এমন ব্যবহার করার কারণ কি হতে পারে।বিয়েটা হয়তো স্বাভাবিক-ভাবে হয়নি।কিন্তু যেভাবেই হোক সেতো এখন তার বউ।তাহলে কি আফরানের তাকে পছন্দ হয়নি বা তার কোনো প্রেমিকা আছে!
-এই উঠো?
-উহু পরে উঠবো।
-হুম তারপর কেউ আমাদের নিয়ে সন্দেহ করুক।
-করলে করুক।জানুক সবাই।
-আফরান যখন জানানোর সময় ছিলো তুমি জানাওনি, এখন এমনভাবে বলছো যেনো সব স্বাভাবিক আছে।
শোয়া থেকে বসে সায়নীর দিকে মুখ তুলে আফরান বলে-
আমি সবটা স্বাভাবিক করে দিবো।এবার আর ভূল হবেনা। তুমি যে স্বপ্ন গুলো দেখেছিলে সব সত্যি হবে।আমি,এই বাড়ি সব তোমার হবে।আমাদের জমজ বাচ্চা হবে।এসব তোমার স্বপ্ন-না?সব পূরণ হবে।একটু ধৈর্য্য ধরো।
-তোমার উপর ভরসা আছে আমার।
-হুম।
-এখন যাওতো।
-না যাবোনা।
-মানে?
-এদিকে আসো আরেক দফা….
-মাইর চালাবো এখন।যাওতো।
-তাড়িয়ে দিচ্ছো?
-দিচ্ছি।কেউ দেখে ফেলার আগে যাও প্লিজ।
-হুম হুম যাচ্ছিরে বাবা।
নিজের রুমে যেতেই আফরান দেখতে পায় মুনিরাকে।কালো রঙের সুতির শাড়ি পরেছে সে।কানে ছোট ঝুমকো,চুল গুলো খোপা করা,মাথায় শাড়ির আঁচল দিয়ে কাপড় দেওয়া সব মিলিয়ে বেশ লাগছে তাকে।
-বাহ,সুন্দর।
আফরান তার প্রশংসা করেছে!এমন কিছু হবে ভাবতে পারেনি মুনিরা।যদি জানতো আফরানের ভালো লাগবে তাহলে চোখে একটু কাজল,
ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে সেজে থাকতো সে।
মুখে হাসি নিয়ে আফরানের উদ্দেশ্যে বলে-
ধন্যবাদ।
-হুম,সবসময় এইরকম ভদ্র-ভাবে চলাফেরা করবা।কালকের মতো বেহায়াপনা যেনো আর দেখি।
কথাটি বলেই ড্রয়ার থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমে চলে যায় আফরান।
একটু আগেই যে মুখে হাসি ফুটেছিলো এক রাশ চিন্তায় মুনিরার হাসি গায়েব হয়ে যায়,মনে যা আশা জমেছিলো তা মিথ্যে হয়ে যায়।
শারীরিক সুখেই কি শান্তি পাওয়া যায়!যেখানে মানসিক সুখ-টা নেই।শাওয়ার টা ছেড়ে দিয়ে পানির নিচে বসে আছে সায়নী।আফরান শুধু তার এতে কোনো সন্দেহ নেই।তবে সকলের চোখে যে বিবাহিত বউ,তার কাছ থেকে আফরান কে সরানো কি সহজ হবে!কিন্তু আফরানের সাথে তার নিজের সম্পর্ক-টা অনেকটায় এগিয়ে গিয়েছে।সে কি করে মানবে মাঝপথে এসে আফরান থেকে দূরে সরে যেতে হবে!না সে পারবেনা,কিছুতেই না।
গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে আফরান।মুনিরা তারই অপেক্ষা করছিলো।তার জানতেই হবে আফরানের সমস্যা কি।
-শুনছেন?
-কি হয়েছে?
-আমি কি দেখতে খারাপ?
-তা আয়নায় দেখলেই পারো।
-নিজেকে খারাপ লাগেনা আয়নায়।

-কিছু বলছেন না কেনো?
-এসব ফালতু কথা বলার সময় নেই আমার।
কথাটি বলে আফরান চলে যেতে চাইলে মুনিরা তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে-
মানলাম আমাদের বিয়েটা স্বাভাবিক-ভাবে হয়নি।তাই বলে এমন করবেন আপনি!বিয়ে করা বউ হই আপনার আমি,নিজেদের একটা সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা কি করা উচিত না?
-অবশ্যই উচিত না।
-কোনো কারণ নিশ্চয় আছে।সেটা জানতে চাই আমি।আমাকে পছন্দ হয়নি নাকি প্রেমিকা আছে?
-ভালোবাসা আছে আমার।তাই তোমাকে পছন্দ করার কথা আমি ভাবতেই পারিনা।সে সময় মাথা কাজ করেনি আমার কি করবো মাথায় কিচ্ছু আসেনি,ভূল হয়েছে তোমাকে বিয়ে করে।প্লিজ দুরুত্ব বজায় রাখবে আমার থেকে।খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে ডির্ভোস দিবো আমি।
কথা গুলো বলেই আফরান চলে যায়।
মুনিরা দাঁড়িয়ে থাকে আগের জায়গাতেই।
তার জীবন-টা এতো এলোমেলো কেনো!সুখ কি তাকে ধরা দিবেনা!
-মুনিরা নাস্তা করতে এসো।
সায়নীর ডাকে ঘোর কাটে মুনিরার।সায়নীর দিকে তাকাতেই দেখে চুল বেয়ে পানি পরছে তার।
-আপু সকালে গোসল করলেন যে?
-অভ্যাস আমার।চলো তুমি,নাস্তা করবে।
-চুল ভালোভাবে মুছে নিয়েন নাহলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
-হুম।
মুনিরাকে নিয়ে সায়নী ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোয়।আর মনে মনে বলে,”হুম অভ্যাস এটা আমার,এই অভ্যাস যে আফরান করেছে।”
রাত ৯টা।আফরানের রুম-টা সাজানো হচ্ছে।
আফজাল খানের কথামতো বাসর ঘর সাজানো হচ্ছে।আফজাল খান সন্ধ্যায় ছোট-খাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নতুন পুত্র বধুর জন্য।
সায়নীকে দায়িত্ব দেয়া হয় মুনিরাকে সাজানোর।মুনিরাকে সে নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে দেয়,যেমনটা এমনদিনে তার সাজার ইচ্ছে ছিলো।তবে সে জানে যতই মুনিরাকে সাজানো হোক, আফরান তাকে স্পর্শ-ও করবেনা।
মুনিরাকে নিয়ে সায়নী আফরানের রুমে যায়।
খাটে গিয়ে বসিয়ে দেয় মুনিরাকে।সাজানো রুমটা দেখে তার বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটাতে শুরু করে মতো লাগে।বিছানায় ফুল দিয়ে লেখা দেখে A+M।এমন-টাকি লেখার কথা ছিলো!
মোটেও না।শুধুই A+S লেখার কথা,এই রুমটা সায়নীর জন্য সাজানোর কথা।আর খুব তাড়াতাড়ি এমনটায় হবে।সাজানো বাসর ঘর-টা এলোমেলো করে দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও করলোনা সে।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে পা বাড়িয়ে দেয় রুম থেকে বেরুনোর জন্য।আর তখনি আফরানের বন্ধুরা আফরানের সাথে মজা করতে করতে তাকে নিয়ে রুমের কাছে আসতেই সায়নী কে দেখে থেমে যায় তারা।সায়নী যে আফরানের ভালোবাসা এটা তাদের অজানা নয়।
-কি ভাইয়ারা থামলেন কেনো?বন্ধুর বাসররাতে এমন মজা করতে হয়।মজাতো আমিও করবো,আমিতো উনার খালাতো বোন।দেখি আফরান সাহেব টাকা দাও।
-কিসের টাকা?
-এই যে বাসর ঘরে ঢুকবে…
-হুম দিচ্ছি টাকা।
সায়নীর হাত ধরে টেনে রুম থেকে বের হয়ে যায় আফরান।একটু দূরে গিয়ে বলে-
প্লিজ লক্ষিটি মাথা ঠাণ্ডা রেখো।আজ বাসায় মেহমান আছে তাই আমাকে ওই ঘরেই থাকতে হবে।কিন্তু আমার মন-টা তোমার কাছেই থাকবে।বিশ্বাস করোনা আমাকে?
-করি।
আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে সায়নীর হাতে আলতো করে চুমু খেয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে চলে যায় আফরান।
সায়নীকে নিয়ে তার ওই ঘরে যাওয়ার কথা ছিলো,তাহলে কেনো তাকে ফেলে আফরান অন্য মেয়ের কাছে চলে গেলো!কি থেকে কি হয়ে গেলো!সামনে আরো কি হবে তার জানা নেয়।সে বিশ্বাস করে আফরান কে।কিন্তু তবুও যে ভয় করছে তার খুব।
আফরান কি পারবে আজ রাত ওই মেয়ে থেকে দূরে থাকতে!
দরজা বন্ধ করে খাটের দিকে তাকাতেই মুনিরাকে দেখতে পায় আফরান।গোলাপি রঙের কাতান শাড়ি পরা,ঠোঁটে লিপস্টিক,চোখে কাজল,
কপালে টিপ,ভারী গহনা পরে বসে আছে মুনিরা।
সাজটা ভালো মানিয়েছে তাকে।আফরান মুনিরার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে এগিয়ে যায় তার দিকে।আফরান কে এগিয়ে আসতে দেখে মুনিরার বুক ধুকধুক করে উঠে।সে ভেবেছিলো আফরান এই ঘরে আসবেনা বা তাকে তাড়িয়ে দিবে।কিন্তু দরজা লক করে সে এগিয়ে আসছে,,তাহলে কি আফরান সব ভূলে মনিরাকে মেনে নিবে নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে!

শরীরটা এলিয়ে দেয় সায়নী।চোখ জ্বলছে তার প্রচুর কিন্তু ঘুম আসছেনা।
জীবনটা এতো কষ্টের কেনো!মা-বাবা দুজনকেই হারিয়েছে সে।খালু আর আফরানের সাথে থাকতে থাকতে তাদের বড় আপন করে ফেলেছে।তাদের ছেড়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না,কিছুতেই না।শুধু স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চায়না সে।মানুষগুলোর সাথেই থাকতে চায় সে।
-বালিশ নিতে এসেছি।আমি সোফায় শোবো।
আফরানের কথায় আবারো মুনিরার আশায় মাটি চাপা পড়ে।তবুও নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলে উঠে-
একটু দাঁড়ান।
-কি?
মুনিরা খাট থেকে উঠে আফরানের কাছে গিয়ে তাকে সালাম করে বলে-
বাসর রাতে বউ থেকে জামাইকে সালাম করতে হয়।
-ওহ।কিন্তু দরকার ছিলোনা।
কথাটি বলেই আফরান এগুতে চাইলে মুনিরা আবার বলে উঠে-
আমার গিফট?
-কিসের?
-বাসর রাতে দিতে হয়তো বউ কে।
-আমিতো কিছু আনিনি।
-যেকোনো কিছু দিতে পারেন।কিন্তু দিতেই হবে।
আফরান চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে টেবিল থেকে একটি বই নিয়ে মুনিরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে-
এই নাও।এইটা তোমার উপহার।চলবে?
-দৌড়াবে।
মুচকি হেসে আফরান শুতে যায় সোফায়।
এদিকে মুনিরার মনটা খুশিতে নেচে উঠে।আফরান তার সাথে ভালো ব্যবহার করেছে,তাকে উপহার দিয়েছে।এটাই অনেক বড় পাওনা।যদিও আফরান ডির্ভোস দিবে বলেছে কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কি!আফরান হয়তো বুঝতেও পারে বৈধ সম্পর্কের জোর কতটুকু।ওসব প্রেমতো বৈধ নয়।বিয়ে করা বউ ফেলেতো একদম নয়।স্বামীর মনে জায়গা করতে,
তাকে সঠিক পথে আনতে চেষ্টা সে করবেই।
বালিশটা সায়নীর চোখের পানিতে ভিজে গিয়েছে প্রায়।কি করবে কি করা উচিত মাথায় কিছু আসছেনা তার।এমন হবে জানলে আফরানের জীবনে কখনো আসতোনা সে।মনে পড়ছে তার আগের দিনগুলি……
বিবিএ শেষ করে সুইডেন এ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে আফরান।ওখানেই এমবিএ করার ইচ্ছে আছে তার।
-তুমি সত্যি চলে যাবা?
-হুম সবতো রেডি।আর কিছুদিন পরেই….
ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠে সায়নী।
-কিরে কাঁদছো কেনো তুমি?সারাজীবনের জন্যতো যাচ্ছিনা আমি।চলে আসবো আবার।
-মিস করবো তোমায় অনেক।
-আমিও করবো।দেখি চোখ মুছো।
-হুম।
-এইতো ভালো মেয়ে।
-ঠিক আছে কি করছিলে করো,এখন যাই আমি।
-আচ্ছা।
-ও হে।খালু বাসায় নেই।অফিসের কাজে বাহিরে আছেন।কাল সকালে
আসবেন।
-ঠিক আছে।
অনেকক্ষণ যাবৎ সায়নীকে দেখছেনা আফরান।গেলো কোথায় মেয়েটা!
-আমাকে খুঁজছিলে?
সায়নীর ডাকে পেছনে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় আফরান।সায়নী বাদামি রঙের একটি সুতি শাড়ি পরেছে।হাটু সমান লম্বা চুলগুলি খোলা রেখেছে সে।হাতে কাচের চুড়ি,নাকে ছোট্ট একটা নাকফুল,চোখে হালকা কাজল
সবমিলিয়ে সুন্দর লাগছে তাকে।
বেশ কিছুক্ষণ আফরান মুগ্ধ দৃষ্টিতে সায়নীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
-এই আফরান ভাই?কি হলো তোমার?ভালো লাগছেনা আমায়?
-দেখছি তোমাকে।
-কি দেখছো?
-সব ঠিক ঠাক আছে কিনা।
-হেহে।তা আছে ঠিক?
-উম্ম….লিপস্টিক দাওনি তো।
-এইরে একদম ভূলেই গিয়েছিলাম।দাঁড়াও আমি দিয়ে আসি।
-না।
-কি না?
-তোমার ঠোঁট এমনেও গোলাপি,না দিলেও চলবে।
খানিকটা লজ্জা পেয়ে সায়নী বলে-
লালতো না আর,লাল দিতে চেয়েছিলাম।
-উফ দিতে হবেনা।এমনি ভালো লাগছে।
-আচ্ছা তুমি যা বলো।
-তা আজ শাড়ি পরলে যে?
-ইচ্ছা ছিলো বফ এর সাথে শাড়ি পরে চাঁদ দেখবো,তা বফ তো হয়নি ভাবছি তুমি বিদেশ যাওয়ার আগেই তোমাকে একদিনের জন্য বফ বানিয়ে নেয়…
-হাহাহা।গুড আইডিয়া।আমারো গফ নেই তবুও এমন ভাবনা মাথায় আসেনি।না চাইতেও গফ পেয়ে যাবো ভাবিনি।হোক না একদিনের জন্য!চলো।
দুজনে ছাদে গিয়ে দেখে আকাশটা মেঘলা হয়ে আছে।
-এই অসময়ে আকাশ মেঘলা কেনো!মনে হচ্ছে এখনি বৃষ্টি পড়বে।তোমার চঁাদ দেখাতো হলোনা।
-বৃষ্টি বিলাসতো হবে।
-মানে কি!তুমি ভিজবে বৃষ্টি হলে?
সায়নী জবাব দেওয়ার আগেই আকাশ থেকে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়ে।সে আফরানের দিকে তাকিয়ে একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে ছাদের মাঝখানে চলে যায়।
-এই সায়নী?চলে আসো ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
-লাগবেনা।তুমি চলে যাও।
সায়নী বৃষ্টিতে ভিজছে আর আফরান মুগ্ধ চোখে তাকে দেখছে।সায়নীর মতো মেয়ে তার পাশে ছিলো বলেই হয়তো সে কারো প্রেমে পড়েনি এতোদিন।তাহলে সে কি সায়নীর প্রেমে পড়ে গিয়েছে!
-আহ!
সায়নীর শব্দে ঘোর কাটে আফরানের।পা পিছলে পড়ে গিয়েছে সায়নী।আফরান দৌড়ে গিয়ে তাকে উঠায়।কিন্তু সে ভালোভাবে হাটতে পারছেনা।বাম পা-টা মচকে গিয়েছে তার।দেরী না করে আফরান তাকে কোলে তুলে নিয়ে নিচে নামতে নামতে বলে-
বলেছিলাম না ভিজতে।পেলেতো ব্যথা এখন।
-সরি।
-আমাকে সরি বলে কি হবে,ব্যথাতো তুমি পেয়েছো।
সায়নীকে নিজের রুমে নিয়ে যায় আফরান।
খাটে বসিয়ে তার বাম পায়ের মচ-টা সারাতে চেষ্টা করে।
-আমার পায়ে হাত দিওনা।
-চুপ একদম চুপ।একটা কথাও কেমনে এই মেয়ে শুনেনা!
আফরান নিমিষেই কিভাবে যে তার পায়ের ব্যথা সারিয়ে দিয়েছে বুঝতেই পারেনি সে।
-দেখি হেটে দেখাওতো।
সায়নী বিছানা ছেড়ে উঠে অল্প একটু হেটে দেখিয়ে বলে-
বাহ তোমার হাতে জাদু আছে!
-এখনো বোঝা যাচ্ছেনা,আছে নাকি নেই।পুরো রুম হেটে দেখাও আমাকে,তারপর বোঝা যাবে।
-আরে ঠিক আছিতো।
-উফ…বড্ড কথা বলো তুমি।হেটে দেখো পায়ে ব্যথা হয় কিনা।ডাক্তারের কাছে যেতে হবে ব্যথা থাকলে।
-হুম।
-কি হুম।তাড়াতাড়ি দেখিয়ে নিজের রুমে গিয়ে জামা বদলে নিবা,নাহলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
সায়নী হাটতে থাকে।পুরো রুমে হেটে এসে আফরানের কাছে আসতেই আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়।বিদ্যুৎ এর বিকট শব্দে ভয় পেয়ে সায়নী জড়িয়ে ধরে আফরান কে।আর তার ছোঁয়া পেয়ে আফরান নিজেকে সামলাতে পারেনি।কাধ থেকে সায়নীর ভেজা চুল গুলো এক পাশে সরিয়ে আলতো করে ঘাড়ে চুমু খায় সে।তার ঠোঁটের স্পর্শে সায়নীর সারা শরীর শিহরিত হয়ে যায়।না চায়তেও সে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আফরান কে।আফরান ও তার সায় পেয়ে সায়নীর ভেজা পিটে হাত বুলাতে থাকে।
এটা কি করতে যাচ্ছে সে!নিজের সম্মান,খালুর বিশ্বাস এভাবে নষ্ট করবে!সায়নী নিজেকে আফরানের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে চলে যায়।
এদিকে আফরান-ও নিজের কাজের জন্য লজ্জিত হয়।সে কি করে পারলো এমন একটা কাজ করতে!
সেদিন থেকে আফরান ও সায়নী আর মুখোমুখি হয়নি।
দুজনের মাঝেই অপমানবোধ কাজ করছিলো।
দেখতে দেখতে আফরানের সুইডেন যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসে।তার খুব ইচ্ছা করছিলো
যাওয়ার আগে সায়নীর সাথে একটাবার কথা বলতে।কিন্তু সায়নী তাকে এড়িয়ে চলছে।সত্যি বলতে তার নিজেরও সংকোচ লাগছে তার সামনে দাঁড়াতেও।
লাগেজ নিয়ে আফরান দাঁড়িয়ে থাকে সদর দরজায়।
আত্নীয়,বন্ধু-বান্ধব অনেকে এসেছে তার সাথে দেখা করতে।কিন্তু তার চোখ শুধু সায়নীকে খুঁজছে।হতাশ হয়ে বের হওয়ার আগে শেষ বারের মতো পেছনে তাকায় সে।
হুম এবার সে সায়নীকে দেখতে পায়।নিঃশব্দে একপাশে দাঁড়িয়ে কেঁদে চলেছে সে।কেনো যেনো তার কান্না আফরানের সহ্য হচ্ছেনা।এক মিনিট-ও না দাঁড়িয়ে পা বাড়ায় সদর দরজার দিকে।
এদিকে সায়নীর-ও ইচ্ছে করছিলো আফরানের সাথে কথা বলতে,কিন্তু সেদিনের ঘটনার পরে কোনোভাবেই সে আফরানের মুখোমুখি হতে পারছেনা।আবার আফরানের জন্য তার কষ্ট-ও হচ্ছে।
-সায়নী মা??
খালুর ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বের হয় সায়নী।আগের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে সকাল হয়ে গিয়েছে বুঝেনি।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সকাল ৬টা।এতো সকালে খালু কেনো ডাকছে!
তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠেই দরজা খুলে সে।
-খালু এতো সকালে তুমি?
-আরে একটা কথা বলতে একদম-ই ভূলে গিয়েছিলাম।পাবেল দেশে এসেছে।আজ সকাল ১০টাই বাসায় আসবে তোকে নিয়ে বাইরে কোথাও যাওয়ার জন্য।পরে যদি ভূলে যাই তাই এখনি তোকে বলতে এসেছি।
পাবেল দেশে এসেছে!এক বিপদের হাত থেকে না বাঁচতেই আরেক বিপদ হাজির।তার মোটেও ইচ্ছে করছেনা পাবেলের সাথে কোথাও যেতে।কি করা যায় এখন!
-কিরে কি ভাবছিস?
-খালু বাসায় এখন আত্নীয়-স্বজন রয়েছে,ওদের ফেলে কি করে যাই?
-হাহা,ওসব তোকে ভাবতে হবেনা।হাসির মাকে খবর দিবো আমি ও সামলাবে।তাছাড়া মেহমান আর তেমন কই আছে,চলেই যাবে সবাই।এখন একটা কাজও তুই করবিনা।আরাম কর।১০টার আগে তৈরি হয়ে থাকবি।পাবেল এসে নিয়ে যাবে তোকে।
খালু চলে যাওয়ার পর সায়নী দরজা বন্ধ করে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
এতো বাঁধা অতিক্রম করে সে কি আফরানের হয়ে থাকতে পারবে!

-আসতে পারি সায়নী আপু?
-আরে এসো মুনিরা।কিছু লাগবে তোমার?
-কেনো,কারণ ছাড়া আসতে পারিনা বুঝি?
-কেনো নয়!অবশ্যই আসবা।আর কোনো কিছু লাগলে আমাকে বলবা।
-হুম অবশ্যই।আসলে আমি এখন কারণ নিয়েই এসেছি।
-তাই!কি কারণ?
-এই শাড়িটা বাবা দিয়েছে।এটা নাকি মায়ের সবচেয়ে প্রিয় শাড়ি,যেটা বাবা সবসময় নিজের কাছে রাখতেন।
-হুম আমি জানি।তোমায় দিয়েছে এটা?
-নাহ।আপনাকে আজ এটা পরাতে বলেছেন বাবা।মানে শাড়িটা আপনাকে দিয়েছেন।আর আমাকে বলেছেন আপনাকে তৈরি হতে সাহায্য করতে।
-আরে তোমায় কষ্ট করতে হবেনা।
-আমি জানি আপনি অনেক ভালো সাজাতে পারেন।কাল আমাকে সাজিয়েছিলেন।আজ না হয় আমি আপনাকে সাজায় নিজের মতো?
-মুনিরা আমার সাজার ইচ্ছা নাই।কামিজ পরেই বের হবো।
-কিন্তু বাবা জানলে রাগ করবেন।আচ্ছা আমি আপনাকে সাজাবো না।নিজের মতোই সাজেন।আমি বসি এখানে।
-ঠিক আছে বসো।
আফরান আজ থেকেই অফিসে যাবে ঠিক করেছে।বাসায় তার ভালো লাগছেনা কিছু।
সায়নী,মুনিরা দুজনের সামনে পড়লেই নিজেকে তার অপরাধী মনে হয়।
মুনিরাকে কিভাবে নিজের লাইফ থেকে সরাবে সে বুঝছেনা।বাবাকে কি বলবে,বাবা কি মানবে!
উফ্ফ…..বিয়েটা করে আসলেই সে ভূল করেছে।সে সময় তার কি হয়েছিলো জানা নেই।বাবার কথার মান ও অসহায় মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে সায়নী কে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সে।তার ভূলের জন্যই তাদের ৩টা জীবন এখন এলোমেলো।
মাথা থেকে সব ঝেড়ে তৈরি হয় সে অফিসের জন্য।সকাল থেকে সায়নী-কে দেখেনি সে।
মেয়েটা-কি রেগে আছে তার উপর!নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এগিয়ে যায় সায়নীর রুমের দিকে।
-সায়নী??দরজা খুলো।
দরজা খুলে বের হয়ে আসে মুনিরা।
-আপনি?কিছু লাগবে?
-সায়নী কই?
-আপুতো ওয়াশরুমে।আমাকে বলতে পারেন কি লাগবে?
-কিছুনা,সায়নীকে বলিও আমি অফিস যাচ্ছি।
সায়নীর রুমে মুনিরাকে দেখেই মাথাটা খারাপ হয়ে যায় আফরানের।তাই সে হনহন করে বেরিয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে।
-কে এসেছিলো মুনিরা?
-উনি।
-উনি কে?
-আরে আমার উনি,আপনার আফরান ভাই।আপনাকে বলতে বলেছেন উনি অফিসে যাচ্ছেন।
আফরান ভাই!মুনিরার উপর প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলেও সায়নী স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে।এমনিতেই পাবেলের সাথে বের হতে তার ভালো লাগছেনা।আবার খালুর কথা অমান্য করা যাবেনা।সব মিলিয়ে নিজের উপরে রাগ হচ্ছে সায়নীর।
বিয়ের ৩দিনের মাথায় অফিসে কেনো যেতে হলো আফরানকে!আসলেই অফিসে গিয়েছে নাকি তার প্রেমিকার কাছে!গভীর চিন্তায় পড়ে যায় মুনিরা।
-কি চিন্তা করো?
-উনার কি কোনো প্রেমিকা আছে?
মুনিরার এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় সায়নী।হঠাৎ এমন একটা প্রশ্ন করে ফেলবে ভাবতে পারেনি সে।
-কি হলো আপু?আপনার সাথে ভালো ভাব তার,নিশ্চয় জানেন আপনি?
-হুম জানি।না নেই।
-তবে যে উনি বললেন?
-কি?
মুনিরা কিছু বলার আগেই দরজায় এসে উপস্থিত হয় আফজাল খান।
-সায়নী মা?হলো তোর?পাবেল এসেছে।
-জ্বী খালু আসছি।
-বাহ বেশ মানিয়েছে তোকে শাড়ি-টা।
-খালাম্মার স্মৃতি-টা আমাকে দিয়ে দিলে কেনো?
-তুই কি পর নাকি!বাদ দে যা মা তোর জন্য গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে পাবেল।
-আচ্ছা।
-একটু দাঁড়াতো?
-কি খালু?
-চুল গুলো ছেড়ে দে।খোপা করে রেখেছিস কেনো!পাবেল দেখুক তার হবু বউ…
-থাক না খালু।
-খুল বলছি?
খালুর কথায় সায়নী তার চুলগুলো ছেটে দেয়।
-বাহ তোকে একদম তোর খালার মতো লাগছে।তোর খালার চুল-ও লম্বা,ঘন ছিলো।
-হুম।
-আচ্ছা মা যা।
পাবেল….
সায়নীর ফুফাতো ভাই সে।পাবেল এর পুরো পরিবার আমেরিকায় থাকে।সায়নীর বাবা অনেক আগে থেকেই পাবেলের সাথে সায়নীর বিয়ে ঠিক করে রাখেন।বড়দের মাঝেই কথাটি সীমাবদ্ধ ছিলো।
পাবেলের মা সায়নীকে আমেরিকা নিয়ে যেতে চাইলেও পাবেলের বাবা এতে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন।তাড়াতাড়ি ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে তার ছিলোনা।আর বিয়ের আগে সায়নীকে তাদের সাথে রাখতেও রাজী ছিলেন না।আবার সায়নীর মতো মেয়ে হাত ছাড়া-ও করতে চান নি।সে সময় আফজাল খান সায়নীর দায়িত্ব নেন।আর তাদের ওয়াদা করেন তারা যখন-ই সঠিক সময় এসেছে মনে করবেন সায়নীকে পুত্র বধু করে নিয়ে যাওয়ার জন্য তখনি সায়নীকে তাদের হাতে তুলে দিবেন।যেহেতু এটা সায়নীর মা-বাবারও ইচ্ছে ছিলো।
-কি ব্যাপার কিছু খাচ্ছোনা যে সায়নী?
-আসলে আমার ভালো লাগছেনা।
-অন্য কিছু অর্ডার করবো?
-নাহ ধন্যবাদ।
রেস্টুরেন্ট এ বসে আছে পাবেল আর সায়নী।সায়নী শান্ত স্বভাবের সে জানতো কিন্তু এতোটা লাজুক তার জানা ছিলোনা।নিরবতা ভেঙে আবার বলে উঠে পাবেল…
-তোমার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে আগে জানলে যোগাযোগ-টা অন্তত রাখতাম।
-হুম।
-তুমি কি জানতে?
-এক বছর আগে খালু বলেছিলেন।
-আর আমি জানি ১মাস হলো।তখনি যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম আবার ভাবলাম একেবারে দেশে এসেই…
-ফুফুরা ভালো আছেন?
-আম্মু তোমাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন।আমাদের ঘোরা শেষ হলেই তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন বাসায়।
-ওহ তাহলে চলুন।আমারো ফুফুকে দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
সায়নীর খুব ইচ্ছা হলো পাবেল কে সব খুলে বলতে কিন্তু আফরানের সাথে এই ব্যাপারে কথা না বলে পাবেল-কে বলাটা কি ঠিক হবে!
কলিং বেল এর আওয়াজ হতেই মুনিরা দরজা খুলতে ব্যস্ত হয়ে যায়।ভেবেছে আফরান এসেছে।কিন্তু দরজা খুলেই অবাক হয়ে যায় সে।
-আম্মা তোমরা!
-কেনো আমরা আসতে পারিনা বুঝি?
-কেনো নয়!কিন্তু এভাবে না বলে?
-ঢুকতে বলবি নাকি বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবি?
-আরে আম্মা এসো।আব্বা তুমিও এসো।
মা-বাবাকে দেখে মুনিরা খুশিতে আত্নহারা হয়ে যায়।
আফজাল খান মুনিরার মা-বাবাকে দেখে অনেক খুশি হোন।২ বন্ধু জমিয়ে আড্ডা শুরু করে দেয়।এদিকে মুনিরা তার মাকে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।
-এটা তোর আর জামাইয়ের রুম?
-হুম আম্মা।
-বাহ সুন্দর তো।তা জামাই কই?
-অফিসে।
-বিয়ের ৩দিনের মাথায় সে অফিসে কেনো?
-কাজ আছে।
-কিছু লুকোচ্ছিস নাতো?দেখ গ্রামের হলেও তুই ভালো,
শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে।বিয়েটা স্বাভাবিক-ভাবে না হলেও তুই ওর বউ এখন।
বিয়েতো তোকে করেছে।আমরা কেউ করতে বলিনি।তাই তোর প্রতি ওর সব দায়িত্ব পালন করতে হবে।আর….
কথা শেষ না করার আগেই কলিং বেল বেজে উঠে।
মুনিরা দ্রুত পায়ে হেটে দরজা খুলতেই আফরানকে দেখতে পেয়ে ফিসফিস করে বলে-বাসায় আম্মারা এসেছেন।প্লিজ এমন কোনো আচরণ করবেন না যাতে তারা কিছু আন্দাজ করতে পারেন।
মুনিরাকে কিছু না বলে আফরান ঘরে ঢুকে শ্বশুর-শ্বাশুরী কে সালাম করে কথা বলে।
-আপনি ফ্রেশ হোন।আমি আম্মাকে নিয়ে অন্য রুমে যাই।
-না না তোমরা বসো এখানে।আমি কাপড় নিয়ে অন্য রুমে যাচ্ছি।
আফরান ড্রয়ার থেকে কাপড় নিয়ে রুম থেকে বের হয়।কিন্তু সোজা চলে যায় সায়নীর রুমে।
সারাদিন ফোন করে সায়নীকে পায়নি সে।
সমস্যা কি মেয়েটার জানতে হবে তার।কিন্তু রুমে গিয়েও সায়নীকে পায়নি।সায়নীর ফোন-টা টেবিলে দেখতে পায়।পুরো ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে সায়নীকে না পেয়ে চলে যায় সে মুনিরার কাছে।
-সায়নী কোথায়?
-আপুতো পাবেল ভাইয়ার সাথে বাইরে গিয়েছেন,উনার বাসায়ও যাবেন শুনেছি।
-পাবেল!ও কখন এসেছে,আর সায়নী ওর সাথে বাইরে কখন গিয়েছে?
-আপনি অফিসে যাওয়ার পরেই।ওই যে তখন আপনি এসেছিলেন না আপুর রুমে?আপু তখন বের হওয়ার জন্যই তৈরি হচ্ছিলেন।
-তুমি আমাকে তখন কেনো বলোনি সায়নী বাইরে যাবে পাবেলের সাথে?
-মানে?
আফরান খেয়াল করলো মুনিরার মা তার দিকে চেয়ে আছেন।নিজের রাগ সংযত করে কিছুনা বলে রুম থেকে বের হয়ে যায় সে।
ফুফিদের সাথে সারা দিন কাটানোর পর সায়নী ফিরে আসে আফজাল খানের বাসায়।ফুফি তাকে থাকতে বলেছিলো।কিন্তু সে থাকেনি।
পাবেল তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়।
সায়নী কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দেয় আফরান।আফরানের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

-ভেবেছিলাম থেকে যাবে আজ।থেকেই যেতে।
এসেছো কেনো?
আফরানের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সায়নী ঘরের ভেতরে পা বাড়াতেই মুনিরাকে দেখতে পায়।
-আপু একটু ডাইনিং রুম এ আসবেন?
-কেনো?
-আমার আম্মারা এসেছেন।দেখা করবেন না?
-হুম।চলো।
মুনিরা তাকে নিয়ে ডাইনিং রুমে চলে যায়।এদিকে আফরান রাগে গিজগিজ করতে থাকে।সায়নীর উপর প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ তার।
সায়নী কিভাবে পাবেলের সাথে বাহিরে গিয়েছে তাও আবার তাকে না বলে!না জবাব না পাওয়া অবধি শান্ত থাকা যাচ্ছেনা।
ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছেন মুনিরার মা-বাবা ও আফজাল খান।
-আসসালামু-আলাইকুম আঙ্কেল,আন্টি।
সায়নীর ডাকে তার দিকে চোখ পড়তেই তার দিকে কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মুনিরার মা-বাবা।দুজনেই সালামের জবাব দেন।
-ভালো আছেন আপনারা?
মুনিরার মা জবাব দেন…
-আছি,তুমি কেমন আছো?
-জ্বী ভালো।আপনারা বসেন।আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।
মুনিরার দিকে তাকিয়ে সায়নী আবার বলে-
উনাদের দিকে খেয়াল রেখো,আর কোনো কিছুর দরকার হলে বলিও আমায়।
সায়নী নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ফ্যান-টা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ে বিছানার উপরে।ফুফুরা কতো স্বাদ করে তাকে বউ বানাতে চায় আর সে কিনা তাদের ইমোশান নিয়ে খেলে এসেছে!একদম ঠিক হয়নি এসব।খালু,ফুফু,মুনিরা ওদের সাথে অন্যায় হয়ে যাচ্ছে।এমন একটা দিন তার জীবনে আসবে স্বপ্নেও ভাবেনি সে।
-বলোনা কেনো তুমি বহুদূর,,
কেনো আমি একা,,,
হৃদয়ে ভাংচুর…..
আফরানের গলার স্বরে চমকে যায় সায়নী।আফরান গান গাইছে।কিন্তু কোথায় সে!
ভাবতে ভাবতেই বারান্দা থেকে বেরিয়ে আসে আফরান।কিছুক্ষণ সায়নীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে-
বেগুনি রঙের জামদানি শাড়ি,ঘন কালো চুল ছেড়ে চোখে গাঢ় কাজল!বাহ ভালোই লাগছে।কিন্তু এতোসব কিছু আমার জন্য নয়।ওই পাবেলের জন্য।আমাকে না বলে ওর সাথে কেনো গেলে তুমি?
সায়নীকে চুপ থাকতে দেখে আফরানের মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যায়।সে সায়নীর কাছে গিয়ে হাত ধরে টান দিয়ে বসা থেকে উঠিয়ে দেয় তাকে।হাত দুটো শক্ত করে ধরে আবার জিজ্ঞেস করে-কেনো গিয়েছো?
-আহ আমার লাগছে আফরান।
সায়নীর কথায় তার হাত ছেড়ে দেয় আফরান।
শান্ত গলায় বলে-
সায়নী কেনো গিয়েছো?
-খালু বলেছেন।
-বাবা বললেই তোমাকে যেতে হবে?আমার বউ হয়ে কিভাবে তুমি পর পুরুষের সাথে ডেইট এ যেতে পারো?
আফরানের কথায় উচ্চস্বরে হেসে উঠে সায়নী।বাসায় মুনিরার মা-বাবা আছে মনে পড়তেই হাসি থামিয়ে বলে-
তুমি এখন যাও।পারিবারিক,
সামাজিক,আইনের চোখে যে তোমার বউ তার পরিবার আছে এখন বাসায়।জানতে পেলে খারাপ দেখাবে।খালাতো বোনের রুমে দরজা বন্ধ করে…
-কিসের বোন!তুমি আমার বউ।বুঝেছো তুমি?
-কে আমি তোমার!
-রহস্য করবেনা একদম।
-হুম আমি তোমার বউ।কিন্তু গোপণ বউ।সবার চোখে ওই মুনিরায় তোমার বউ।আমি নয়।আমি পারছিনা আর সহ্য করতে এসব।সামান্য পাবেলের সাথে বের হয়েছি বলে তুমি আমাকে কথা শোনাতে এসেছো।আর নিজে যে একটা বউ থাকা স্বত্তেও আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছো তাতে কিছুনা!কখন বলবে তুমি খালুকে আমাদের কথা?আগেও বলতে পারোনি।আদৌ বলতে পারবে,নাকি আমার রাস্তা আমি দেখবো?
সায়নীর কথাগুলো শুনে কোনো জবাব না দিয়ে আফরান তার রুমে পায়চারি করতে থাকলো।একপর্যায়ে দেয়ালের পাশে গিয়ে দেয়ালের উপর নিজের হাত মুঠো করে ঘুষি দিতে লাগলো।সায়নী তার দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে বললো-
আফরান ছাড়ো কি করছো কি তুমি?
-সব দোষ আমার আমি মানছি।আমি সঠিক সময় পাইনি সায়নী,সব ঠিক করে দিবো বিশ্বাস করো।প্লিজ তুমি আমাকে ছেড়ে যেওনা।এখনি বাবাকে বলবো আমাদের বিয়ের কথা,আমার প্রথম বউ তুমি।আর আজীবনের জন্য শুধু তোমাকেই চাই।
আফরান কেঁদে কেঁদে কথা গুলো বলছিলো।
খালার মৃত্যুর পর এই প্রথম সে আফরান কে কাঁদতে দেখে।তার কান্না দেখে সায়নীর বুকে চিনচিন ব্যথা করে উঠে।তাকে নিয়ে খাটে গিয়ে বসে সায়নী।আফরানের মাথা নিজের বুকের মাঝে লুকিয়ে বলে-
এই পাগল কাঁদেনা।আমি শুধু খালুর কথা রাখার জন্যই গিয়েছি ওখানে।তাছাড়া আমাকে খালু সকালেই বলেছেন পাবেল এসেছে,তার সাথে বাইরে যেতে হবে আমায়।তোমাকে বললে ঝামেলা করতে তুমি তাই বলিনি।আর ফোনটাও ইচ্ছা করে নিইনি।তবে আমার মনটাও খারাপ ছিলো।মুনিরা বলেছে আমাকে,আমার আফরান ভাই নাকি আমাকে বলে যেতে বলেছে সে অফিস যাচ্ছে।
সায়নীর বুক থেকে মাথা তুলে আফরান নিজের চোখ মুছে হেসে বলে-
আফরান ভাই!হাহা।
-উফ হেসোনা,এটা শুনে মাথা ঠিক ছিলোনা আমার।আসলেই সবার চোখেই আমরা ভাই-বোন।
-এখনি সবাইকে ক্লিয়ার করে দিবো।
-এখন না।এখন ঠিক হবেনা বলা।মুনিরার পরিবার আগে গ্রামে ফিরে যাক,খালুর সাথে কথা বলতে হবে।নিশ্চয় মাফ করে দিবেন তিনি আমাদের।আর উপায় ও বের করবেন কোনো।
-হুম এবার আর ভূল হবেনা।
মুনিরার মা মুনিরার ঘরে যেতেই দেখেন খাটের উপরে চুপচাপ বসে আছে মুনিরা।
তিনি মুনিরার পাশে বসে বলেন
-জামাই কই?
-আছে হয়তো কোথাও।
-কোথাও!জামাইরে চোখে চোখে রাখতে পারিস না?
-উনি কি বাচ্চা নাকি আম্মা দেখে দেখে রাখতে হবে!
-ঘরে যুবতী সুন্দরী মেয়ে মানুষ আছে একটা।সব কি বুঝিয়ে দিতে হবে তোকে?
-আপু ৭বছর ধরেই এখানে থাকেন।উনার মা,বাবা আর তোমাদের জামাই এর মা এক সাথেই রোড এক্সিডেন্ট এ মারা গিয়েছিলেন।
-ওহ এই মেয়েটা তাইলে সে মেয়ে!শুনছিলাম কিন্তু এক সাথে থাকে জানতাম না।ভালো করে যোগাযোগ ও ছিলোনা আফজাল ভাইয়ের সাথে।তোর বিয়েতে দাওয়াত দিয়েছি হিসেবে গিয়েছে আফরান কে নিয়ে।
-হুম।
-তাও জামাইকে চোখে চোখে রাখবি।তোর সাথে কেমন কটর কটর করে কথা বলছে ওই মেয়ে বাইরে গেছে বলিস নাই তাই।
-কই কটর কটর!
-করছে।মেয়েটাকেও সুবিধার লাগছেনা।
-না মা এই কয়েকদিনে যা বুঝেছি সায়নী আপু অনেক ভালো।
-তাও…
-উহু খুব তাড়াতাড়ি উনার বিয়েও হয়ে যাবে।এতো ভেবো নাতো তুমি।
মুনিরার মা আর কিছু না বললেও আফরানের আচরণে আফরান কে নিয়ে সন্দেহ ঢুকে তার মনে।
রাতের খাবার খেয়ে সবাই যে যার রুমে চলে যায়।মুনিরার মা-বাবাদের সায়নী একটি রুমে নিয়ে যায়।এদিকে আফরান আর মুনিরা এক রুমে…
-সবাই ঘুমিয়ে পরলে আমি চলে যাবো পাশের রুমে।
-দরকার নেই আজ এখানেই থাকো তুমি মুনিরা।
-কিন্তু..
-কোনো কিন্তু না।তোমার আম্মারা যতোদিন থাকবে এখানে থাকবা তুমি।
-তাহলে আমি আজ সোফায় শোবো।
-কেনো?
-আপনার রুমে আপনি আর কতো কষ্ট করবেন?
আফরান আর কিছু না বলে শুয়ে পড়ে বিছানায়।মুনিরা চুপচাপ বালিশ-টা নিয়ে এগিয়ে যায় সোফার দিকে।
মুনিরাকে সবটা জানানো দরকার কিন্তু বাবার সাথে পরামর্শ না করে কিছু করা ঠিক হবেনা এখন।
মানুষ মাত্রই ভূল।কিন্তু তার জীবনে সে এতো ভূল কিভাবে করলো।সেদিন হয়তো সায়নীকে গোপনে বিয়ে না করে বাবাকে জানিয়ে বিয়েটা করলে এতো কিছুর সম্মুখীন হতে হতোনা আজ।

১বছর আগে আফরান যখন সুইডেন থেকে দেশে ফিরে তখন জানতোই না তার জীবনে নতুন মোড় আসবে।এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই তার চোখ সায়নী কে খুঁজতে থাকে।বিদেশ থাকাকালীন সায়নী তার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেনি।সায়নী নিজের ফোন নাম্বার বদলে ফেলেছিলো আর ইন্টারনেট তো ব্যবহার-ই করতো না।একটা ভূলের জন্য সায়নী তার সাথে এমন করতে পারে জানা ছিলোনা তার।তবে আফরান বিদেশ গিয়ে,সায়নী থেকে দূরে গিয়ে অনুভব করতে পেরেছে সে ভালোবাসে সায়নীকে।
বাবাকে দেখে আফরান বাবার কাছে গিয়েই জড়িয়ে ধরে তাকে।
-বাবা আমি চলে এসেছি।
-তাতো দেখতেই পাচ্ছি মাই বয়!কোনো অসুবিধে হয়নিতো?
-না বাবা।
বাবাকে ছেড়ে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে আফরান বলে-
সায়নী আসেনি বাবা?
-তোর জন্য রান্না করতে ব্যস্ত সে।সেই ভোর সকালে উঠে রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
চল এখন।বাসায় গিয়ে সায়নীর হাতের রান্না মজা করে খাবি।
সায়নী তার জন্য রান্না করছে!কতোদিন সে সায়নীর রান্না খায়নি।
কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দেয় হাসির মা।অনেক পুরোনো কাজের লোক সে।
আফরান আশা করেছিলো সায়নীকে দেখবে কিন্তু সায়নী দরজা খুলেনি।হতাশ হয়ে হাসির মায়ের সাথে কথা বলে ভেতরের দিকে পা বাড়ায় সে।কয়েক পা এগিয়ে পেছনে ফিরে জিজ্ঞেস করে-
খালাম্মা সায়নী কই?
-আপা মনিতো রান্না সাইরা নিজের ঘরে গেছে।
-আচ্ছা বাবা লাগেজ নিয়ে ঢুকলে বলিও আমি সায়নীর সাথে দেখা করতে গিয়েছি।
গোসল মাত্রই সেরেছে সায়নী।হালকা গোলাপি রঙের একটি সুতির কামিজ পরেছে।
গামছা নিয়ে লম্বা চুলগুলো মুছছে সে।
এমন একটি দৃশ্য আসলেই মনোমুগ্ধকর।
আফরান দরজায় দাঁড়িয়ে তাকে এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে।
সায়নী পেছনে ফিরতেই দেখতে পায় আফরানকে।তাড়াতাড়ি নিজের উড়না-টা বিছানা থেকে নিয়ে বুকের উপরে দিতে দিতে বলে-
কখন এলে??
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আফরান বলে-
এতোদিন পর দেখা হয়েছে,কথা হচ্ছে আর তুমি শুধু জিজ্ঞেস করছো কখন এলে?
-আসলে এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেতো আমি হঠাৎ,মানে আসলে…
-হাহাহা।
-কি?
-তুমি এতো নার্ভাস হচ্ছো কেনো সায়নী?
-ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকলে নার্ভাস হবোনা?
-সুন্দর লাগছে তোমায়।
আর কিছু বলতে চেয়েও বাবার ডাকে বলতে পারেনি আফরান।
-আরে এতো গল্প করলে হবে?আগে দুপুরের খাবার খেয়ে নে।দুটিতে মিলে পরে গল্প করিস।যা আফরান ফ্রেশ হয়ে নে আর সায়নী তুই ভাত রেডি কর।
দুপুর ২টা……
ডাইনিং টেবিলে বসে ভাত খাচ্ছে আফজাল খান, আফরান,সায়নী।
-উম্ম…এত্তো মজা!জানো বাবা প্রতিদিন আমি সায়নীর হাতের রান্না মিস করতাম।এখন আমি চলে এসেছি আর মিস হবেনা।
-হবে হবে।
-কেনো?
-আরে সায়নীর তো বিয়ে দিতে হবে তাইনা?
বাবার কথায় থমকে যায় আফরান।
সায়নীর বিয়ে!বললেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছেনা।প্লেটে আঙুল নাড়াতে নাড়াতে আফরান বলে
-হুম বিয়েতো দিতে হবে।আগে রান্না মন ভরে খেয়ে নেই।
-আরে না সামনেই ওর বিয়ে।
-মানে?
-মানে সায়নীর বিয়ে পাবেলের সাথে।
-ওর ফুফাতো ভাই?
-হুম আগামী মাসেই তারা দেশে আসবে,এরপর দিন তারিখ ঠিক করে বিয়েটা হয়ে যাবে।
-ওহ।
খাবার টেবিলে আর কেউ কোনো কথা বলেনি।
দুপুরে সায়নীর রুমে যায় আফরান।সারা দিন কাজ করে সায়নী ঘুমোচ্ছিল বেহুঁশের মতো।
ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে দেখতে আরো বেশি সুন্দর লাগছিলো।কিন্তু আফরানের মনে অনেক প্রশ্ন যা না জানলে নিজেকে শান্ত থাকতে পারছেনা সে।
তাই সে সায়নীকে ডাকলো-
সায়নী এই সায়নী?
কোনো সাড়া না পেয়ে পাশের টেবিলে থাকা জগ থেকে পানি নিয়ে সায়নীর মুখে পানির ছিটকা দিতেই সায়নী উঠে বসে যায়।চরম ভয় পেয়েছে সে।তাই আফরান তার পাশে বসে হাত ধরে বলে-
এই সায়নী আমি আফরান।
সায়নী কিছুক্ষণ চুপ থেকে আফরানের দিকে তাকিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে-
এই অবেলায় তুমি?
-এতোদিন যোগাযোগ করোনি কেনো?ওই দিনের ঘটনার জন্য?যেদিন আমি তোমার…
-আফরান ভাইয়া ওসব কিছু না।তুমি যাওয়ার পর পরই খালু আমাকে জানিয়েছিলো আমার মা-বাবার ইচ্ছা,পাবেল কে যেনো আমি বিয়ে করি।
-হুম করবে।তাতে আমার সাথে যোগাযোগ না রাখার কি হলো?দেখো সায়নী সেদিন আমি ইচ্ছাকৃত কিছু করিনি।
-প্লিজ ভাইয়া বাদ দাও।
-আমাকে তুমি ক্ষমা করতে পারোনি তাই যোগাযোগ করোনি,নাম্বার বন্ধ করে দিয়েছো?কিন্তু একবার ভাবোনি আমার কষ্ট হবে এতে।
-কিসের কষ্ট?
-ছোট লাগে নিজেকে।এতোদিন কতোটা অপরাধবোধ কাজ করেছে নিজের মধ্যে তুমি বুঝবেনা।
-প্লিজ ভাইয়া…
-না বলতে দাও আমায়।আমি এতোই খারাপ যে তুমি আর কথাও বলোনি আমার সাথে,
এখনও দূরে দূরে থাকছো।এতোদিন হয়ে গিয়েছে ব্যাপারটা ভূলতে পারোনি তুমি।
-এসব কিছু নয়,আমি তোমার সাথে কথা বললে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবোনা তাই কথা বলিনি।
-মানে?
-মানে খালু যখন বলেছেন তুমি যাওয়ার পর আমার সাথে পাবেলের বিয়েটা হোক এটা বড়দের ইচ্ছা ছিলো,তখনি আমি ঠিক করি তোমার সাথে আর যোগাযোগ রাখবোনা।
রাখলে কষ্ট হবে কারণ আমি তোমাকে…
সায়নী থেমে যায় আর কিছু না বলেই।
-কি সায়নী বলো?তুমি আমাকে?
কিছুনা বলেই সায়নী রুম থেকে বের হয়ে যায়।
সায়নীও আফরানকে ভালোবাসে।আগে সে এটা উপলব্ধি করতে না পারলেও আফরান দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পরে পেরেছে।
কিন্তু খালু তাকে তার মা-বাবার ইচ্ছার কথা বলেছেন তার পরে সে কি করে পারবে আফরানের দিকে নজর দিতে!আর আফরান,সেও তো ভালো কাউকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেতে পারে কেনো সে সায়নীর মতো মেয়েকে নিজের জীবনে ঠাই দিবে যে তাদের বাড়িতে আশ্রিতা!এসব ভেবেই সে আফরানের সাথে যোগাযোগ রাখেনি।
রাত ২টা….
আফরানের চোখে ঘুম নেই।সায়নীও তাকে ভালোবাসে!পুরো কথাটা না বললেও সায়নীর কথায় এটাই বুঝা যাচ্ছে।তার মানে তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে।মাঝখানে এই পাবেল-টা কেনো আসবে!নাহ যেভাবেই হোক একে সরাতে হবে।
দেখতে দেখতে ৮দিন কেটে যায়।
আফরানের বাবা সায়নী আর আফরান দুজনকেই ড্রয়িংরুমে ডেকে আনেন।
-পাবেলরা কিছুদিন পরই দেশে আসবে।সময় বেশি নিয়ে আসবেনা।সায়নীর সাথে ওর বিয়েটা আমি দিয়ে দিতে চাই।আফরান তোর কিন্তু দায়িত্ব অনেক।
-হুম বাবা।
-সায়নী মা?তোর কিছু বলার আছে?
-না খালু,বলার নেই।
সারাটা দিন অস্থিরতায় কাটে আফরানের।খানিকক্ষণ পায়চারী করে পকেট থেকে মোবাইল-টা বের করে ফোন দেয় তার বন্ধু হাবিব কে।
-হ্যালো হাবিব?
-হুম দোস্ত বল।
-তোকে একটা মেসেজ দিচ্ছি ওই ঠিকানায় আমাদের আরো কয়েকজন বন্ধুদের সাথে নিয়ে আসতে পারবি এখন?
-এখনি?
-হুম।
-আচ্ছা পারবো।কিন্তু কেইসটা কি?
-এলেই দেখবি।
সায়নীকে রুমে দেখতে না পেয়ে তার রুমের জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করতে থাকে আফরান।
অবশেষে পেয়ে যায় একটি ফাইল যাতে সায়নীর জন্মসনদ-সহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পায়।তাড়াতাড়ি ব্যাগের ভেতরে ঢুকিয়ে নেয় সেটি।
-তুমি এখানে?
-আমার মেয়ে বান্ধবী একটা খুব বিপদে পড়েছে।তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে সায়নী প্লিজ।
-কি বিপদ?
-যেতে যেতেই বলবো চলো এখন।
গাড়ি বের করে সায়নীকে নিয়ে রওনা হয় আফরান।কিছুদূর গিয়ে রাস্তার পাড় থেকে তার বন্ধু হাবিবসহ কয়েকজন কে গাড়িতে তুলে নিয়ে সোজা চলে যায় কাজী অফিসের সামনে।গাড়ি থেকে নেমেই সায়নী প্রশ্ন করে
-কই তোমার বান্ধবী?
-সায়নী আজ আমরা বিয়ে করবো।
-আমরা মানে?
-তুমি আর আমি।
-মাথা ঠিক আছে তোমার!কেনো তোমাকে বিয়ে করবো আমি?
-কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো।বাসোনা?
সায়নীকে চুপ থাকতে দেখে আফরান বলে
-আমিও তোমাকে ভালোবাসি।
-কি?
-বললাম যে আমিও তোমাকে ভালোবাসি।
-সত্যি?
-একদম।
সায়নী বুঝে উঠতে পারছেনা এসব সত্যি নাকি!খানিকক্ষণ চুপ থেকে সে বলে
-কিন্তু পাবেলের…
-উফফ..ওই পাবেলের কথা তুমি চিন্তা করোনা।
-আর খালু?
-বাবা মেনে নিবে আমাদের।
-উনাকে না জানিয়ে?
-গিয়েই জানাবো।আগে বিয়েটা করে ফেলি।
উনি শুনলে হয়তো না মানতে পারেন।তুমি জানোই বাবা কাউকে কথা দিলে রাখেন।
তাই উনি চাইবেন পাবেলের সাথেই তোমার বিয়েটা হোক।এখন যদি আমরা বিয়ে করে নেই তাহলে বাবা মানতে বাধ্য।
-কিন্তু অনেক ফর্মালিটি থাকে বিয়ে করতে,আমিতো কিছুই আনিনি।
-আমি সব এনেছি।আমারো,তোমারো।
-আমার রুমে তুমি তখন এসব করছিলে?
-জ্বী ম্যাডাম,চলেন এবার বিয়েটা করেই ফেলি।
সেদিন আফরানের কথা সায়নী মেনে নেয়।
আফরান তাকে ভালোবাসে জেনে কোনটা ঠিক কোনটা ভূল কিছুই তার বোধগম্যে আসেনি।সে শুধুই তার ভালোবাসার মানুষের ডাকে সাই দিয়েছে।
আফরানের বন্ধুদের সাক্ষী করে বিয়ে করে নেয় তারা।
বাসায় ফিরে দুজনে এগিয়ে যায় আফজাল খানের রুমে।
-বাবা আসবো?
-হুম,কোথায় গিয়েছিলি তোরা?
-আমরা আসলে…
-যাকগে একটা কথা বলার ছিলো।
-কি?
-পাবেলরা আসতে পারছেনা দেশে ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে।
-কখন আসবে?
-সেটাও সঠিক করে বলেনি।
-ওহ।
-যা তোরা,এ ব্যাপারে আর কিছু জানলে তোদের বলবো।
পাবেল দেশে আসছেনা!এই কথাটা শোনার পর আফজাল খানকে তারা আর কিছু বলেনি।চলে যায় যে যার রুমে।
রাত ২টা….
সায়নীর দরজায় কড়া নাড়ে আফরান।

একবার কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দেয় সায়নী।তার চোখেও ঘুম ছিলোনা।যেনো সে আফরানের জন্যই অপেক্ষা করছিলো।
-তুমি এতো রাতে আফরান ভাইয়া?
আফরান দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করতে করতে বলে
-ভাইয়া!আমি তোমার ভাইয়া?
-না মানে…
-বসতে বলবেন?
-তোমার বাড়ি।যেখানে যখন খুশি বসতে পারো।
-ভূল বললে তোমারও বাড়ি।বাপের বাড়ি।
আর এখন শ্বশুর বাড়িও।
-হুম।
আফরান বিছানায় বসতে বসতে বলে
-আজ আমাদের বাসর রাত হওয়ার কথা না?
খানিকটা লজ্জা পেয়ে যায় সায়নী।
আফরান তার দিকে তাকিয়ে দেখে লজ্জায় মুখটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে।সায়নী নিচের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
নিরবতা ভেঙ্গে আফরান বিছানা থেকে উঠে সায়নীর কাছে গিয়ে তার মুখ বরাবর দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে
-তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি।নিজের হাতে পরিয়ে দিতে চাই।দিবো?
সায়নী হ্যা সূচকভাবে মাথা নাড়তেই আফরান তার পেছনে গিয়ে পকেট থেকে একটি লকেট বের করে পরিয়ে দেয় সায়নীর গলায়।আফরানের হাতের ছোঁয়া পেয়ে সায়নী কিছুটা কেঁপে উঠে।আফরান তা বুঝতে পেরে সায়নীকে হঠাৎ করেই কোলে তুলে নেয়।
-এই,কি করছো তুমি!
কোনো কথা না বলে আফরান তাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে তার পাশে নিজেও শুয়ে পড়ে।
-আজ থেকে আমিও তোমার সাথে থাকবো।
-ইশ বললেই হলো!
-কেনো হলোনা!তুমি আমার বউ,আমি তোমার জামাই।আমরা থাকতেই পারি।
সায়নী আফরানের দিকে ফিরে বলে
-খালুকে তো বলোনি কিছু?
-পাবেল তো আর আসছেনা এখন।পরে বলা যাবে।
-পরে বললে এভাবে লুকিয়ে রাতে আসতে হবে তোমায়।
-তার মানে আমার সাথে রাত কাটানোর ইচ্ছে আছে তোমার?
-না মানে আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে..
-কি?
-ইয়ে আরকি!
-ইয়ে!হাহা বুঝেছি।
-কি বুঝেছো?
-লুকিয়ে আসলেতো সমসময় নাও আসতে পারি।
-হুম তুমি এক লাইন বেশি বুঝো।আমিতো শুধু তোমার কষ্ট হবে এইভাবে আসতে আর বেশি দেরী হওয়ার আগে খালুকে সব বলে দেওয়ার জন্যই বললাম।
-হুম ঠিক আছে,তাহলে কাল বাবাকে বলবো আমাদের কথা।প্রথমে বলবো আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি।তাতে যদি না মানে তাহলে বিয়ের কথাটা জানিয়ে দিবো।
-খালু রাগ করবেনা তো?
-করলেও আর কতক্ষণ,ঠিক মেনে নিবে।
এসব কথা রাখোতো,লকেট টা খুলে দেখো পছন্দ হয় কিনা।
সায়নী লকেট-টা খুলে দেখে তাতে তার আর আফরানের ছবি।আফরানের ছবি এখন থেকে সে নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে রাখতে পারবে ভেবেই খুশি হয়ে যায়।
-ওয়াও এতো সুন্দর!
-পছন্দ হয়েছে তোমার?
-অনেক।
খুশিতে আত্মহারা হয়ে সে আফরানকে জড়িয়ে ধরে বলে
-এত্তগুলা ধন্যবাদ।
আফরান তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে
-শুধু ধন্যবাদ দিলে হবে?
-মানে?
-যেভাবে জড়িয়ে ধরেছো ওইভাবে একটু আদর দিলে ভালো হয় আর কি।
সায়নী মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করতে থাকে!খুশিতে সে আফরানকে কখন জড়িয়ে ধরে ফেলেছে বুঝতেই পারেনি।আফরানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সে বসে পড়ে বিছানার উপর।
আফরান ও বসে বলতে শুরু করে
-সেদিন কোনো বৈধতা ছিলোনা,কিন্তু আজতো আমরা স্বামী-স্ত্রী।আজও কি পালিয়ে যাবে সায়নী?
সায়নীকে চুপ থাকতে দেখে আফরান বিছানা ছেড়ে উঠতে থাকে কিন্তু হাতে টান পরে তার।
সায়নী তার হাত ধরে বলে
-আজ কেনো,আর কোনো দিনও পালাবো না।
১বছর আগের এসব কথা মনে পড়তেই চোখের কোণে পানি চলে আসে আফরানের।সেদিন বিয়ে করা,একসাথে রাত কাটিয়ে একজন আরেকজনের মাঝে ডুবে যাওয়া,এসব অনুভূতি গুলোই অন্যরকম ছিলো।
সায়নীকে স্বীকৃতি দেওয়ার বদলে কি করে সে আরেকটা বিয়ে করতে পারলো!নিয়তি কি এটাকেই বলে তাহলে….
বিছানা ছেড়ে উঠে যায় আফরান।তার চোখ যায় মুনিরার দিকে।সায়নীর মতো সুন্দরী না হলেও মেয়েটির চেহেরায় অসম্ভব মায়া।ঘুমের মাঝেও হাসি হাসি মুখখানা দেখতে আরো বেশি মায়াবী লাগছে।মুনিরার একবার আশা ভঙ্গ হয়েছে এবারো….
এই মেয়েটার সাথে অন্যায় হবে খুব।কিন্তু উপায় নেই।মায়াবী চেহারায় মায়া করা গেলেও ভালোবাসা শুধু সায়নীর জন্য।
সায়নী তার প্রথম ভালোবাসা ছিলো আর শেষ-ই থাকবে।কিন্তু মুনিরার কি হবে!তাকে ওই গ্রামে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবেনা।
এখানেই কোনো ভালো ছেলের সাথে তার বিয়েটা দিতে হবে।তবে যতটা সহজভাবে আফরান এসব ভাবছে ততটা সহজভাবেই কি সব সমাধান হয়ে যাবে!
সকালে ঘুম ভাঙতেই মুনিরার চোখ যায় বিছানায়।কিন্তু বিছানা শূন্য।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল ৬টা বাজে।কিন্তু এতো সকালে আফরান কই!মুনিরা সোফা থেকে উঠতেই খেয়াল করে বারান্দার দরজাটা খোলা।আফরানের খোঁজে সে পা বাড়ায় বারান্দার দিকে
-আমার সকল অভিযোগে তুমি,
তোমার মিষ্টি হাসিটা-কি আমি!
আফরানের গানের গলা শুনে থমকে যায় মুনিরা।সে এতো ভালো গান গাইতে পারে তার জানা ছিলোনা।অবশ্য জানবেই বা কি করে!
মাত্র কয়েকদিন হলো তাদের বিয়ে হয়েছে।তার উপর আফরান তার থেকে দূরে দূরে থাকে।একে অপরকে চেনার সুযোগটাও পায়নি।
-উঠেছো তুমি?
আফরানের কথায় ঘোর কাটিয়ে মুনিরা বলে
-আপনি এতো ভালো গান গাইতে পারেন!
-তুমি কখন শুনেছো?
-এইতো এখুনি।
-ওহ।
-আমাকে একটা গান শোনাবেন প্লিজ?
-শুনলেই তো।
-এইটুকু!তাও পেছন থেকে শুনেছি।
-সামনে পেছনে কি আবার?
-মানে ওটা আমার জন্য ছিলোনা।
-তোমার জন্য কখনই আমি গান গাইবোনা,কখনই না।
কথাটি বলে আফরান চলে যায় রুম থেকে আর মুনিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে নিজের জায়গায়।
আফরানের মনে সে জায়গা করতে চায় কিন্তু তার মন জুড়ে অন্য কেউ আছে তাকে সরানো কি সহজ হবে!
আর সরানোর চেষ্টা করাও কি ঠিক হবে!
কেনো ঠিক হবেনা!বিয়ের আগে যা হবার হয়েছে,এখন যেহেতু বিয়েটা হয়েই গিয়েছে একটু মানিয়ে নিতে চেষ্টা করতে ক্ষতি কি!আফরান কোনো চেষ্টায় করছেনা বরং তাকে আরো দূরে ঠেলে দেওয়ার প্লানিং করছে সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে।
গ্রাম ছাড়া,ডির্ভোসী মেয়েকে কেউ কি আপন করে নিবে!
না কিছু ভাবতে পারছেনা সে,রাগে ক্ষোভে দুচোখ দিয়ে তার টপটপ করে পানি পড়তে থাকে।
তার এই অবস্থার জন্য দায়ী হলো শুধুই আনাস।আনাস পরপারে চলে না গেলে হয়তো তার এই অবস্থা হতোনা।
হঠাৎ মুনিরা,তার কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করে।
-কি হয়েছে তুই কাঁদছিস কেনো!জামাই কিছু বলেছে?
মায়ের কথায় পেছনে ফিরে মুনিরা বলে-
না আম্মা,আনাসের কথা মনে পড়ছিলো।
-২দিন্না ছেলেটার জন্য কান্নার কি আছে মা?
এখন শুধু জামাইরে নিয়ে চিন্তা কর।
-আজ যদি বিয়েটা হতো তাহলে কি তুমি এমন বলতে?মরে গেলো বলেই কি পর হয়ে গেলো সে!আজ তোমাদের জামাই আমাকে বিয়ে করেছে বলেই শুধু সে আপন থাকবে?
মুনিরার মা মেয়ের কথায় খানিকটা বিরক্ত হয়ে কোনো জবাব না দিয়ে হনহন করে বের হয়ে যায় নিজের রুম থেকে।
সকাল ৯টা…..
আফরান অফিসের জন্য তৈরি হয়ে রুম থেকে বের হতেই হাসির মা এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলে
-আব্বাজান তোমারে তোমার আব্বাই ডাকে এখুনি।
-কেনো?
-ওইডা তো আমি জানিনা।
-আচ্ছা যাচ্ছি।বাবা কই?
-খাবার ঘরেই আছে।
ড্রাইনিং রুমে যেতেই আফরান দেখতে পায় সেখানে বাসার সকলেই উপস্থিত রয়েছে।
-বাবা ডেকেছো আমায়?
-হুম আয় বয় আমার পাশে।নাস্তা কর।
-আমি বাইরে করে নিবো আজ।
-সায়নী গরম গরম পরোটা বানিয়েছে,গরুর মাংসের ঝোল দিয়ে খেতেই অসাধারণ লাগছে।
আফরান চেয়ার টেনে বাবার পাশে বসতে বসতে বলে
-তাহলে তো খেতেই হবে।সায়নী দাও দাও আমাকেও দাও।
সায়নী একটি বাটি নিয়ে আফরানের সামনে দিয়ে তাতে মাংসের ঝোল দিতে থাকে চামচ কেটে।এদিকে মুনিরার খুব ইচ্ছা হচ্ছিলো,সে যদি সায়নীর মতো আফরানের পাশে দাঁড়িয়ে তার খাবার বেরে দিতে পারতো!সেই সময় আফজাল খান বলে উঠে
-তোরা হানিমুনে কোথায় যাবি?
কথাটি শুনেই সায়নীর হাত থেকে ঝোলসহ চামচ পড়ে যায় আফরানের প্যান্টের উপর।মুনিরা টেবিলের উপর থেকে টিস্যু নিয়ে আফরানের দিকে এগিয়ে আসার আগেই সায়নী নিজের উড়না দিয়ে আফরানের প্যান্টের উপরে থাকা ঝোল মুছতে মুছতে মুছতে বলে-
ওহ আমি খেয়াল করিনি।গরম ছিলো?
-নাহ ঠিক আছে।তুমি ঠিক আছো?
চোখে পানি টলমল করছিলো সায়নীর,গলাটা আটকে আসছিলো।এমন একটা কথা শুনে ঠিক থাকা যায়!কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে বলে
-শরীরটা ভালো লাগছেনা।
আফজাল খান সায়নীর উদ্দেশ্যে বলেন,
-মা তুই যা,আরাম কর একটু।
-জ্বী খালু।
সায়নীকে দূর্বল লাগছে দেখে মুনিরা হাত থেকে টিস্যু-টা টেবিলের উপর রেখে বলে
-আপু আমি তোমাকে তোমার রুমে নিয়ে যাই চলো।
-না তুমি এখানে থাকো,আমার তেমন কিছু হয়নি।
সায়নী চলে যেতেই আফজাল খান আবার বলে
-কোথায় যাবি হানিমুনে?
মুনিরা জানে আফরান তার সাথে যাবেনা কিন্তু এটা তার বাবাদের সামনে বললে তারা যে অনেক কষ্ট পাবে।
-বাবা আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো।পরে কথা হবে এই ব্যাপারে।
মুনিরার মা-বাবা থাকার কারণে আফরান তার বাবাকে হানিমুনের ব্যাপারে কিছু না বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে যায় ।
এদিকে মুনিরার মায়ের কাছে পুরো বিষয়টি হটকা লাগে।
তার মেয়ে চোখে কি কিছু দেখেনা!সায়নী আর আফরান দুজনকে নিয়েই তার সন্দেহ হচ্ছে।নাহ পুরো বিষয়টা তার জানতেই হবে।
নাহলে মুনিরাকে নিয়ে চিন্তা থেকেই যাবে।মেয়েটা এমনিতেই অনেক আঘাত সহ্য করেছে।
আফরান ওয়াশরুমের নাম করে সায়নীর রুমে আসে।রুমে কোথাও না পেয়ে বারান্দায় যেতেই দেখে সায়নী বারান্দার এক কোণায় জড়োসড় হয়ে মেঝেতে বসে কেঁদে চলেছে।তার এমন অবস্থা দেখে আফরানের বুকের ভেতরটা মচরে উঠে।
আস্তে আস্তে তার পাশে গিয়ে সেও বসে পড়ে মেঝেতে।
-আমি কি গিয়েছি নাকি যাবো বলেছি?এতো কান্নাকাটির কি আছে শুনি!
তার কথায় সায়নী নিজের চোখ উড়না দিয়ে মুছতে মুছতে বলে
-যাও না,গেলেও কি হবে আর।
-কি হবে?
-ঠ্যাং একটা ভেঙ্গে দিবো।তারপর দেখবো ওই
মেয়ে ঠ্যাং ভাঙ্গা ছেলের সাথে থাকে কিনা।
সায়নীর কথায় হো হো করে হেসে উঠে আফরান।উৎসুক দৃষ্টিতে সায়নীর দিকে তাকিয়ে বলে
-আমার পা একটা না থাকলে তুমি কি থাকবা আমার সাথে?
-একটা কেনো!২টাই না থাকলেও থাকবো।
-তাহলে কোনো চিন্তা নেই, তিনটা ঠ্যাং-ই ভেঙ্গে দিও।
মুচকি হেসে সায়নী বলে
-তিনটা পা কি আছে নাকি তোমার!
-ও তাইতো!
সায়নী নিজ থেকে তার পাশে গিয়ে বুকে মাথা রেখে বলে
-আমি আর কিছু সহ্য করতে পারবোনা।
-করতে হবেনা।মুনিরার বাবারা চলে গেলেই আমার বাবাকে জানাবো সব।
আফরানের বুকে মুখ লুকিয়ে সায়নী নীরবে কাঁদতে থাকে।যতদিন যাচ্ছে আফরান কে হারানোর ভয় তার মাঝে কাজ করছে।
আফরান কি হারাতে দিবে নিজেকে সায়নীর থেকে!
এদিকে মুনিরা এগিয়ে আসতে থাকে সায়নীর রুমের দিকে।বেশ দূর্বল দেখাচ্ছিলো তাকে।এখন শরীরের কি অবস্থা দেখে আসা উচিত।

-আসতে পারি সায়নী আপু?
মুনিরার ডাকে আফরানের বুক থেকে মাথা তুলে তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়ে সায়নী।
ফিসফিস করে আফরানকে বলে
-তুমি এখানেই থাকো।
সায়নী চোখ দুটো মুছে রুমে গিয়ে বলে
-আরে ভেতরে আসো মুনিরা।
মুনিরা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বলে
-তোমাকে দেখতে এসেছি আপু।
-কি দেখতে এসেছো?
-তোমাকে দূর্বল লাগছিলো তো….
-ওহ।তেমন কিছুনা ঠিক আছি।
-আমি কিন্তু তোমাকে তুমি করে বলা শুরু করেছি খেয়াল করোনি তুমি।
-তাই নাকি!হুম আসলেই খেয়াল করিনি।
-বলতে পারবো?
-বলেতো ফেলেছ।
-সরি আপু তোমার থেকে জিজ্ঞেস করে বলার দরকার ছিলো।
-হেহে,মজা করছিলাম।বলিও।
-আচ্ছা তুমি বিশ্রাম করো, আমি যাই।
-হুম।
মুনিরা এক পা বাড়াতেই বারান্দা থেকে ফোনের রিং টুনের আওয়াজ শুনতে পায়।
পেছনে ফিরে সায়নীকে বলে
-বারান্দায় কি তোমার ফোন?
সায়নী কিছু বলার আগেই সোজা হেটে চলে যায় বারান্দায় মুনিরা।আফরান কে ফোন হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে যায় সে।
-একি!আপনি এখানে?
থতমত খেয়ে আফরান বলে-
হুম আমিতো তোমার আগেই এসেছি।
-কেনো?
-তুমি যে কারণে এসেছো।মানে সায়নীকে দেখতে।তোমরা কথা বলছো বলে ডিস্টার্ব করিনি আর।
-ওহ।
আর কিছু না বললেও মুনিরার মনে প্রশ্ন আসে,সায়নীও কেনো তাকে বললো না যে আফরান এখানে আছে!
পরক্ষণেই মনে আসে বলেও কি হতো,হয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করছিলো দুজনে।
-মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে এতোদিন থাকা ভালোনা মুনিরার আম্মা।
স্বামীর কথায় খানিকটা বিরক্ত হয়ে মুনিরার মা জবাব দেন-
এতোদিন কই থাকলাম।এক রাত থাকছি এখনো।
-আমাদের চলে যাওয়া উচিত।
-না উচিত না।স্বাভাবিক অবস্থায় বিয়েটা হয়নাই।মেয়েকে সব কিছু গুছাতে, সাহায্য করার জন্যই আছি আমি।শ্বাশুরীতো নাই,
কে শেখাবে!
-সায়নী আছেতো।মেয়েটা বেশ ভালো।
-ভালো না ঘোড়ার ডিম।
-কেন?সে কি করছে আবার?
-উফ এতো কথা বলতে পারবোনা,তোমার ইচ্ছা হলে তুমি যাও।আমি যাচ্ছিনা কোথাও।
কথাটি বলেই মুনিরার মা বের হয়ে যায় রুম থেকে।এমনিতেই মেয়েকে নিয়ে টেনশনে আছে তার উপর স্বামীর প্যাঁচাল তার মোটেও ভালো লাগছেনা।যতদিন না মেয়ের একটা গতি হচ্ছে এই বাড়িতে,ততদিন সে কোথাও যাবেনা।
-বাবা আসবো?
আফজাল খান বিছানায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন।আফরানের গলার স্বরে পত্রিকাটা এক পাশে রেখে বলেন-
হুম আয়।
-কিছু কথা ছিলো তোমার সাথে।
-হুম বল।
-আমি এখন মুনিরাকে নিয়ে হানিমুনে যেতে পারবোনা।
-কিন্তু কেনো?
-তুমিতো জানোই এই বিয়েটা আমি করতে চাইনি।ওর সাথে আমি এখনও সহজ হতে পারিনি।
-একসাথে সময় কাটালে তোদের মাঝে…
-প্লিজ বাবা আমাকে জোর করবেনা।
দরজায় চোখ পড়তেই আফজাল খান দেখলেন সায়নী দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার পাশে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে।
-দাঁড়িয়ে আছিস কেনো মা?ভেতরে আয়।
সায়নী ভেতরে গিয়ে চায়ের কাপটা খালুর দিকে বারিয়ে বলে
-তোমার চা খালু।
আফজাল খান কাপটা হাতে নিয়ে লম্বা একটা দম ফেলে বলেন-
ভালোই হলো তুই এসেছিস মা।তুই বুঝাতো আফরানকে।
-কি বোঝাবো খালু?
সায়নীর দিকে তাকিয়ে আফরান বলে
-কিচ্ছুনা,ওসব কথায় কান দিওনা।
আফজাল খান এবার একটু কড়া গলায় বলেন-
তোকে বিয়েটা করতে অনুরোধ করেছিলাম।
জোর করে দিইনি।তাই মুনিরার দায়িত্ব তোর,ওকে খুশি রাখার দায়িত্বও তোর।ওর মা আমাকে নিজ থেকে এসে বলেছেন যে,মুনিরার মনের অবস্থা ঠিক নেই।বাইরে কোথাও থেকে ঘুরে আসলে হয়তো ভালো লাগবে তোর সাথে।উনারা যদি মনে কষ্ট নিয়ে গ্রামে ফিরে যায় এটাকি ভালো দেখাবে?
আফরান কে চুপ থাকতে দেখে শান্ত গলায় বলেন-
যা বাবা ওকে নিয়ে ঘুরে আয়।অন্তত কাছে কোথাও?
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে সায়নী খালুর উদ্দেশ্য বলে
-যাবে আফরান।
আফরানের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে
-খালুর কথা রাখো,যাও তুমি।কাছে কোথাও।
খানিকটা বিরক্ত নিয়েই আফরান বলে
-বিকেলে বের হবো,মুনিরাকে তৈরি হয়ে থাকতে বলিও।বসন্তের দিনে কেমন করে সেজে বের হওয়া যায় আফরানের সাথে….
আফরান মুনিরাকে নিয়ে বের হবে তা শোনার পর থেকেই কিভাবে সাজবে তা নিয়ে ভেবেই চলেছে সে।তার সব শাড়ি আলমারি থেকে বের করে বিছানার উপরে ছড়িয়ে রেখেছে।কোন শাড়ি-টা পরবে বুঝতেই পারছেনা।অনেক চিন্তা করে বাসন্তী রঙের একটা শাড়ি ঠিক করলো।বসন্তের এমন দিনে বাসন্তী রঙের শাড়ি,বাহ খারাপ না!
আচ্ছা,কপালে একটা টিপ দিলে-কি মানাবে তাকে!
ফোন বাজছে সায়নীর।আফরানের ফোন….
-হ্যালো?
-মুনিরাকে বের হতে বলো,আমি গাড়িতে আছি।
-বাসায় ঢুকবেনা?
-নাহ।
-ঠিক আছে।
-সায়নী,আমি আসলে…
-কিছু বলতে হবেনা,আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।
-একটা কথা রাখবা?
-কি?
-কাল বের হবা আমার সাথে?
-কাল কি করে…
-প্লিজ সায়নী না করবেনা।
-ঠিক আছে।
-আচ্ছা আপদ টাকে পাঠাও এখন,তাড়াতাড়ি গিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসি।
-হেহে।
মুনিরা গাড়ির পাশে যেতেই আফরান গাড়ির দরজা খুলে দেয়।সে ভালোভাবে তাকায় না মুনিরার দিকে।সারা রাস্তায় তারা চুপ ছিলো।গাড়ি গিয়ে থামায় একটা মেলার পাশে।
-আমরা কোথায় এসেছি?
-বসন্ত মেলায়।প্রতিবার হয় এই মেলাটা।সায়নী কখনো বাদ দেইনি,প্রতিবার আসতো।ও
আমাদের বাসায় আসার পরতো আমরা এক সাথেই আসতাম।
-ইশ!আগে বললে আপুকে নিয়ে আসতাম।
-হুম।চলো এখন।তোমার আম্মাদের জন্য কিছু নিও।
শপিং মলেও নিয়ে যাবো তোমাকে।
-না থাক।এখানে ঠিক আছে।
মুনিরার সাথে আফরানের আর কোনো জায়গায় যাওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা হলোনা।
মেলার ব্যস্ত পরিবেশে মুনিরারও নিজেকে একা মনে হবেনা।কোনো রেস্টুরেন্ট বা পার্ক এ গেলেতো একসাথে বসে কথা বলতে থাকতে হতো।
-এই চুড়ি গুলো সুন্দর না?
আফরান ভালোভাবে না দেখেই বলে-
হুম।
-সায়নী আপুর জন্য এগুলা।
সায়নীর নাম শুনে মুনিরার হাতে থাকা চুড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে-
ওর এই রংটা পছন্দ নয়।
-কোন রঙ পছন্দের?
-এটা ছাড়া যেকোনো রঙের নিতে পারো।
-আচ্ছা।
আফরানের ফোন আসে।পকেট থেকে মোবাইল-টা বের করে দেখে সায়নীর ফোন।
একটু দূরে গিয়ে রিসিভ করে সে।
-হ্যালো জান পাখিটা?
-বউ কই?
-ফোনের ওপারে।
-আরে মুনিরা কই?
-আছেতো,কেনাকাটা করছে।
-কোথায় গিয়েছো?
-বসন্ত মেলায়।
বসন্ত মেলার কথা শুনে সায়নীর মেজাজটায় বিগড়ে যায়।যে দুইজন মানুষের জন্য তার জীবনের রঙ হারিয়ে গিয়েছে তারাই নাকি বসন্ত মেলায় গিয়ে রং-তামাশা করছে!
প্রতিবার সায়নী যায় এই মেলায় আফরানের সাথে।এই মেয়ে ওর জায়গাটা এভাবে আস্তে আস্তে দখল করে ফেলবে!
-কি হলো সায়নী?!চুপ কেনো?
-তোমার সাথে সবসময় আমি বসন্ত মেলায় যেতাম।হোক সেটা খালাতো বোন হিসেবে।গতবছর তুমি সুইডেন ছিলে বলে আমি যাইনি।তুমি ওই মেয়েকে নিয়ে….
-সায়নী আমিতো শুধু..
-হুম তুমি যা করো তা শুধুই শুধু!
-কথাতো শোনো।
-এখুনি বাসায় আসো।কিচ্ছু শুনতে চাইনা আমি।
ফোনের লাইন কেটে দেয় সায়নী।আফরান পকেটে মোবাইল ঢুকিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখে মুনিরা নেই।কই গেলো এই মেয়েটা!
চারদিকে ভালোভাবে চোখ পড়তেই দেখে ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খেয়ে গল্প করছে সে।বেশ হাসি খুশি দেখাচ্ছে তাকে।বাসন্তী রঙের শাড়ি,হাতে রেশমি চুড়ি,
খোপা করা চুল,কপালে একটা টিপ।মনে হচ্ছে বসন্ত শুধু মুনিরার জন্যই এসেছে।কিছুক্ষণ তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে আফরান।মানুষ ২য় বারও প্রেমে পড়ে তবে তার বেলায় সে এটা হতে দিতে পারেনা।
কিন্তু এই মেয়েটার জন্য তার এতো মায়া কেনো কাজ করছে হঠাৎ করে!নিষ্পাপ মুখখানি দেখে হয়তো।
সায়নীর কথা মনে হতেই মুনিরার পাশে গিয়ে আফরান বলে-
চলো বাড়ি ফিরতে হবে।
-মাত্রই তো এলাম।
-আমার আসলে ভালো লাগছেনা।
-আচ্ছা যাবো কিন্তু….
-কি?
-ওই যে দেখুন পিঠে বানাচ্ছে।
-তো?
-চলুন না খাই।
-ওসব পিঠাই পেট খারাপ হবে।
-মোটেও না।জানেন আমাদের গ্রামেও অনেক বড় করে বসন্ত মেলা হয়।আমরা বান্ধবীরা পিঠা খাওয়ার প্রতিযোগিতা দিতাম।সবসময় আমি জয়ী হতাম।
-হাহা তাই নাকি!
-জ্বী,চলুন না খাই।
-তুমি খাবে,আমাকে জোর করবেনা।
-ঠিক আছে।
মুনিরা দোকানে গিয়ে বলে-
চাচা গরম গরম পুলি পিঠা দাওতো।
-কয়টা দিমু আফা?
-উম্ম…এক প্লেটে চারটে দাও।
-আইচ্ছা।
মুনিরা প্লেট হাতে নিয়ে গরম পুলি পিঠা ফু দিয়ে দিয়ে খাচ্ছে।মুনিরাকে দেখে আফরানেরও লোভ হলো খেতে।কিন্তু সেতো বলে ফেলেছে খাবেনা।
-এই যে হা করেন।
-কেনো?
-বুঝতে পারছি আপনার ইচ্ছে করছে খেতে।
কথা না বাড়িয়ে আফরান মুখ খুলে মুনিরার হাত থেকে পিঠায় এক কামড় বসায়।
-উম্ম..বেশ মজা মজাতো।
সায়নীর হাতের পিঠে ছাড়া
এখানেও এতো মজার পিঠে পাওয়া যায় জানতাম না।
মুনিরা হেসে বলে-
নিন একটা নিন,পুরো খান।
-একটা কেনো!অনেক গুলোই খাবো।
বাড়ি ফিরে আফরান খুঁজতে থাকে সায়নীকে।
কিন্তু সায়নী তাকে ধরাই দিচ্ছেনা।আফরান জানে,কাছে থাকলে রাগ করে থাকতে পারেনা সায়নী।দূরে থাকলেও রাগ ভাঙানোর কৌশল তার জানা আছে।
হাতে থাকা প্যাকেট-টা রেখে দেয় বিছানার উপরে।সায়নীর জন্য আগেই এনে রেখেছিলো সে উপহার।এসব দেখলে সায়নী কিছুতেই রাগ করে থাকতে পারবেনা।
একটু পরেই সায়নী নিজের রুমে গিয়ে বিছানার উপরে প্যাকেট দেখতে পায়।
প্যাকেট-টি খুলে সে।একটা লাল সিল্ক এর শাড়ি,এক জোড়া লাল পাথরের চুড়ি আর একটি কার্ড যাতে লেখা কাল সকাল ৮টাই তোমার জন্য সমুদ্রের পাড়ে অপেক্ষা করবো।আমি জানি তুমি আসবে।
সায়নী কার্ড-টা দূরে ফেলে দিয়ে বলতে থাকে
-আমি যাবোনা,কিছুতেই না।
মুনিরা মায়ের সাথে দেখা করতে যেতেই মা জিজ্ঞেস করেন-
কিরে?কেমন ঘুরলি?জামাই যত্ন নিছেতো?
মায়ের কথায় সামান্য লজ্জা পেয়ে মুনিরা বলে
-হুম আম্মা,ভালো লাগছে অনেক।
মুনিরার মা কিছুটা নিশ্চিত হন।মেয়েকে খুশি দেখে তার অস্থীরতা অনেকটায় কাটে।
কিছুসময় চুপ থেকে কোনো সংকোচ ছাড়াই আবার বলেন-
যত তাড়াতাড়ি পারিস বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে নে।একটা বাচ্চা হলে সম্পর্ক এক ধাপ আগায়।
জামাইয়ের মনে তোর উপর,তোদের বাচ্চার উপর আলাদা একটা টান থাকবে।
মুনিরা এখন বেশ লজ্জা পেয়ে মায়ের পাশ থেকে উঠে বলে-
বেশি বেশি বলো তুমি আম্মা,বিয়ে হতে না হতেই আবার বাচ্চাও!উফ গেলাম আমি।
মুখে এসব বললেও আইডিয়া-টা মন্দ লাগেনি মুনিরার।কিন্তু আফরান তো তার ধারে কাছে ঘেষতেই দেইনা।এক সাথে এক বিছানাই এখনো থাকতে পারেনি আর বাচ্চা!সেতো অনেক দূরের কথা।আচ্ছা যদি হয় তার নাম কি দিবে,আগে ছেলে হবে নাকি?উফ সে আবারো বোকা বোকা কথা ভাবতে শুরু করেছে।কেনো যে তার মাথায় মা এসব কথা ঢুকালো!
রুমে পা রাখতেই মুনিরা দেখতে পায় আফরান বিছানা আর সোফার ঠিক মাঝখান-টাই দাঁড়িয়ে আছে।
-আপনি না শুয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?
-তুমি কোথায় শোবে?সোফায় নাকি বিছানায়?
মুনিরা দরজা বন্ধ করতে করতে বলে
-বাহ!আমার ইচ্ছা জানার জন্য অপেক্ষা করছেন!কালকের মতো বিছানা ছেড়ে দিবো ভেবে?
তার কথায় খানিকটা চমকে যায় আফরান।এই মেয়ের আবার কি হলো!
মুনিরা বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে এক পাশে বসতে বসতে বলে-
আজ আমি বিছানাই থাকবো।তবে আপনি চাইলেও থাকতে পারেন।আমার কোনো অসুবিধা নেই।
আফরান কিছু না বলে লাইট অফ করে বালিস নিয়ে চলে যায় সোফায়।
মুনিরা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়ে বিছানায়।
রাত ২টা……
কারো কান্নার শব্দে আফরানের ঘুম ভেঙ্গে যায়।ডিম লাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে মুনিরা বসে আছে।তাহলে কি সে কাঁদছে?কিন্তু কেনো!
আফরান সোফা থেকে উঠে রুমের লাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে যায় মুনিরার দিকে।
মুনিরা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ চেপে কান্নার শব্দ না হওয়ার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আফরান তার পাশে বসে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে-
এতো রাতে এসবের মানে কি?

-কথা কেনো বলছোনা?
আকষ্মিকভাবে মুনিরা আফরানকে জড়িয়ে ধরে মুখটা তার বুকের মাঝে লুকিয়ে অনবরত কাঁদতে থাকে।তার কান্নায় আফরানের পরণের শার্ট-টা ভিজে যাচ্ছে।তার চোখের পানি আফরান-কে দূর্বল করে দিয়েছে তাই সে মুনিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে-
কি হয়েছে জানতে পারি?
কান্না জরিত কণ্ঠে মুনিরা বলে-
আমাকে সবাই জুতোর মালা পরিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরাচ্ছে।
আফরান বুঝতে পারে মুনিরা স্বপ্ন দেখছে।
নিজেকে মুনিরার থেকে ছাড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে পাশে থাকা ছোট টেবিল টার কাছে গিয়ে গ্লাসে পানি ঢালে সে।মুনিরার কাছে এসে গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলে-
এই নাও পানি খাও,ভালো লাগবে।
আফরানের হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে মুনিরা ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি সব খেয়ে ফেলে।
-আর খাবে?
-নাহ।
আফরান পানির গ্লাসটি তার হাত থেকে নিয়ে টেবিলের উপর রেখে এসে মুনিরার খুব পাশেই বসে হাত দিয়ে তার চোখের পানি মুছে দেয়।
-স্বপ্ন দেখেছো তুমি।ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
-কিন্তু এটাতো সত্যি হতে চলেছে।
লম্বা একটা দম ছেড়ে আফরান বলে-
এটা কখনই সত্যি হবেনা।তোমাকে ওই গ্রামে ফিরে যেতে হবেনা।এমনেই বেড়াতে যাবে তবে সম্মানের চোখেই দেখবে সবাই।
-সত্যি?
-হুম।দেখি এবার ঘুমাও।
আফরানের কথায় আশ্বাস পেয়ে মুনিরা নিশ্চিতে শুয়ে পড়ে।তার মানে আফরান তাদের সম্পর্ক-টা আগাতে চেষ্টা করবে!
একদিন সেও তার ভালোবাসার মানুষ হতে পারবে,এক বিছানায় থাকতে পারবে,আফরানের নিজস্ব সব কাজ সে করবে।এসব ভাবতেই হাসি ফুটে মুনিরার মুখে।
এদিকে তার হাসিমাখা মুখ দেখে আফরান বুঝতে পারে মুনিরা এখন স্বাভাবিক আছে।
তাই সে নিজের জায়গায় চলে যায়।
-লাইট অফ করবেন না?
-থাক তোমার ভয় লাগবে।
মুনিরাকে নিয়ে আফরানের এই ছোট্ট চিন্তাটাও তার মনে আনন্দের সৃষ্টি করছে।
তার সুখের দিনকি আসতে শুরু করবে তবে!
এদিকে আফরান চিন্তায় পড়ে যায়।কিভাবে সে মুনিরার একটা গতি করবে যাতে সে আফরানের থেকে দূরে যায় কিন্তু ওই গ্রামে ফিরে যেতে না হয়।মুনিরার জন্য এমন কাউকে সে কি পাবে!
সকাল ৬টা।
সায়নীর ফোনে মেসেজ আসে।
-৭টাই একটা লাল গাড়ি থাকবে বাসার সামনে।লাল শাড়ি পরে লাল গাড়ি করে চলে এসো লালবানু।অপেক্ষায় থাকবো।
সায়নী তার ফোন-টা বন্ধ করে দেয়।ঠিক করে,না সে আজ কিছুতেই যাবেনা।আফরানকে একটা শাস্তি দিতেই হবে।

#পর্ব_১০

সকাল সকাল সমুদ্র দেখার মাঝেও আলাদা একটা ভালো লাগা কাজ করে।আরো ভালো লাগে যদি প্রিয় মানুষটি সাথে থাকে।আফরানের ভালো লাগাটা দ্বিগুণ করতে সায়নী-কি আসবে!
অনেক চেষ্টা করেও আজ না এসে পারেনি সায়নী।আফরান তার সমস্ত মন জুড়ে রয়েছে।
কি করে তাকে কষ্ট দিবে সে,তাও আজকের মতো বিশেষ দিনে!
-আফরান?
পেছনে ফিরতেই সায়নীকে দেখতে পায় আফরান।
তার দেওয়া লাল শাড়ি পরে এসেছে সে।খানিকক্ষণ তাকে দেখে কাছে গিয়ে আফরান বলে-
লাল বানুর চোখও লাল কেনো?
-কেনো হতে পারে?
-কষ্ট পেয়েছো?আমি তোমার জায়গা কাউকে দিবোনা।
-আফরান আমি আর পারছিনা।কখন যাবে মুনিরার বাবারা!যাওয়ার নাম ঠিকানা নেই কোনো তাদের।উনারা যাওয়ার আগেই মনে হচ্ছে ওই মুনিরা তোমাকে কাবু করে ফেলবে।
-মনে হয় পারবে?
-না পারার কি আছে!আমিতো পুরোন হয়ে গিয়েছি….
-একটা থাপ্পড় দিবো ধরে।
-শুধু থাপ্পড় কেনো!মেরেই ফেলোনা তুমি আমাকে,মেরেই ফেলো।
শেষের কথাটা প্রায় চিৎকার করেই বলে সায়নী মাটিতে বসে পড়ে।এই অবস্থায় সায়নীকে দেখে আফরানের চোখেও পানি চলে আসে।কেনো সে সেইদিন গ্রামে গিয়েছিলো?কেনইবা মুনিরাকে বিয়ে করেছিলো?ছেড়ে দিবে ভেবে!পারছে কই!
সকলের চোখে বৈধ বউকে ছাড়া এতোটা সহজ নয় তার জানা ছিলোনা।কিভাবে কি হয়ে গেলো!এসবের মাঝে যদি সায়নী তাকে ছেড়ে দেয়!
হাটু গেড়ে আফরানও মাটিতে বসে পড়ে সায়নীর পাশে।সায়নীকে বুকে জড়িয়ে বলে
-শুভ ভালোবাসা দিবস।তবে আমার জন্য তোমাকে ভালোবাসার জন্য বিশেষ কোনো দিনের প্রয়োজন নেই।
কিন্তু প্রতিদিন তো স্পেশাল কিছু করার সুযোগ হয়না।তাই একটা দিবস উপলক্ষে আজকের দিনে না হয় এক সাথে সময় কাটিয়ে স্পেশাল কিছু করলাম।
সায়নী নিজেকে আফরানের কাছ থেকে ছাড়িয়ে অভিমানী স্বরে বলে-
আচ্ছা তাই!শুধু ভালোবাসা দিবসের কথা মনে আছে তোমার?
-হেহে কথা শেষ হয়নি।আরো আছে।
-কি?
-শুভ বিবাহ বার্ষিকী।
-মনে আছে তোমার?
-হুম।আজকের দিনটা কি ভূলে যাওয়া সম্ভব!আগামীবার থেকে সকলের সামনে, সকলের সাথে উদযাপন করবো।
-সত্যি?
-একদম।
চোখ দুটো মিটিমিটি করে খুলে মুনিরা।
কালকের রাতটি তার জন্য অনেকটায় স্পেশাল ছিলো।
আফরান তাকে আশ্বাস দিয়েছে।এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কি হতে পারে!বিছানা ছেড়ে উঠতেই চোখ যায় তার সোফার দিকে।
আফরানকে দেখতে পায়না সে।আবারো কি তিনি বারান্দায় আছেন?আজকে একটা গান শুনেই ছাড়বো,
আর গানটা আমার জন্যই হবে।এসব ভেবে মুনিরা বারান্দায় যেতেই তা শূন্য দেখতে পায়।আফরান কে না পেয়ে হতাশ হয়ে রুম থেকে বের হয় সে।কেনো যেনো এখুনি আফরানের সাথে তার সময় কাটাতে বড্ড ইচ্ছে করছে।হয়তো বাসায় কোথাও আছে ভেবে সারাবাড়ি খুঁজে মুনিরা।এতো সকালে গেলো কই!হঠাৎ মুনিরার মাথায় আসে আফরান,সায়নীর রুমে নাতো!দুজনে হয়তো গল্প করছে।তবে তাদের গল্পের আসরে তিনজন হলে মন্দ হয়না।
-আসবো সায়নী আপু?
কয়েকবার ডেকে সাড়া না পেয়ে সামান্য দরজাটা ফাঁক করে মুনিরা।ইদানিং সায়নীকে দূর্বল লাগে।ঠিক আছেতো সে!
দরজার ফাঁক দিয়ে সায়নীকে দেখতে না পেয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে সে।
এ কি!রুমে সায়নী নেই।বারান্দায়ও দেখে নেয় মুনিরা।এতো সকালে কই গেলো সায়নী!
হঠাৎ মুনিরার চোখ পড়ে বিছানার উপরে রাখা কার্ড-টার উপরে।কৌতুহলবশত হাতে নিয়ে দেখতে থাকে সে।একপর্যায়ে খুলে দেখে তাতে কি লেখা আছে।
-কাল সকাল ৮টাই তোমার জন্য সমুদ্রের পাড়ে অপেক্ষা করবো।আমি জানি তুমি আসবে।
এইরকম কার্ড সায়নীকে কে দিতে পারে?
হুম পাবেল ছাড়া কেউনা।তাহলে পাবেলের সাথেই আছে সায়নী!ইশ কি রোমান্টিক ওরা।ভালোবাসা দিবসের দিন এক সাথে আছে সমুদ্রের পাড়ে।আর আমার উনি!একদমই আনরোমান্টিক।আনরোমান্টিক কি একেবারেই ফালতু।এই সকাল সকাল কোথাও হাওয়া হয়ে গিয়েছে।আচ্ছা ছাদে যায়নি-তো!
সায়নীর চোখ দুটো রুমাল দিয়ে বন্ধ করে তাকে সমুদ্রের পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায় আফরান।
-উফ…হয়েছে তোমার?চোখ খুলি?
-খুলো।
চোখ থেকে কাপড় সরিয়ে সায়নী কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়।
ছোট-খাটো একটি অন্যধরনের রেস্টুরেন্ট।
চারপাশে রঙ-বেরঙের বেলুন দিয়ে সাজানো।মাটিতে ছিটানো ফুলের পাপরি।মাঝখানে একটি টেবিল,তাতে একটি কেক আর লাল গোলাপের তোড়া রাখা।
এসব দেখে সায়নী আনন্দিত হয়ে যায়।অবাক চোখে আফরানের দিকে তাকিয়ে বলে-
এসব আমার জন্য?
-হুম আমার লাল বানুর জন্য।সামান্য খুশি করার চেষ্টা।
-আর কাউকে দেখছিনা যে?
-আরে ম্যাম,বুকিং করে ফেলেছি।
-কি বলো!
আফরান কিছু বলার আগেই গান বেজে উঠে-
তুমি দূরে দূরে আর থেকোনা,
এই চোখে চেয়ে দেখোনা,,
তুমি ভালোবেসে আমাকে,,
ওই হৃদয়ে বেঁধে রাখোনা….
-তুমি মিউজিক এর ও ব্যবস্থা করেছো!এতো কিছু!কিন্তু আমিতো কিছুই করিনি,কিছু আনিনি তোমার জন্য।
-তুমি চাইলেই কিন্তু কিছু দিতে পারো আমাকে।
-কি?
সায়নীর কাছে গিয়ে তার গালে দুহাত দিয়ে ধরে কপালে একটা আলতো করে চুমু খেয়ে আফরান বলে-
আজ কি আমি একটা পেতে পারি?
-কি?
-না বুঝলে আমিও আর কোনোদিন দিবোনা আর কি।
আফরানের মুখে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে পালিয়ে যেতে চাইলে আফরান তার হাত ধরে টেনে নিজের বাহুডোরে বন্দী করে সায়নীকে।কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে-
হয়ে যাক একটা কাপল ডান্স?
এদিকে আফরান-কে কোথাও দেখতে না পেয়ে মুনিরা ফোন দেয় আফরানকে।কিন্তু ফোন বন্ধ পেয়ে আফরানের জন্য তার চিন্তা হতে শুরু করে।সকাল সকাল মানুষটা গেলো কই!ফোনটাও বন্ধ।সায়নীকে কি বলে গিয়েছে?তাকে নিশ্চয় বলেছে।সায়নীকে কি একটা ফোন দিয়ে দেখবে সে?কিন্তু সায়নীতো পাবেলের সাথে এখন।তাকে বিরক্ত করাতো ঠিক হবেনা।
আফরানের সাথে সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরে সায়নী।আফরান ওদিক থেকেই অফিসে চলে যায়।কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে দেয় মুনিরা।লাল শাড়িতে আসলেই সায়নীকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে।
-ওয়াও আপু!তোমাকে একদম লালবানু লাগছে।
মুনিরার কথায় থমকে যায় সায়নী।লালবানু তাকে আফরান ডাকে।মুনিরা কি করে জানলো!
প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে-
লাল বানু মানে?
-তোমার রুমে গিয়েছিলাম তোমার সাথে গল্প করতে,ওখানে পাবেল ভাইয়ার কার্ডটা পেয়েছি।উপর থেকে দেখতে এতোটা সুন্দর লেগেছে ভেতরে কেমন দেখার লোভ সামলাতে পারিনি।
স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে বাসার ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে সায়নী বলে-
ওহ।
-আপু উনি কোথায় জানো?সকাল থেকেই উনাকে দেখছিনা।ইয়ে মানে উনাকে ঘুম থেকে উঠে না দেখলে ভালো লাগেনা ইদানিং।
মুনিরার কথায় সায়নীর মেজাজটায় বিগড়ে যায়।বলে কি এই মেয়ে!৭দিন হয়নি বিয়ে হয়েছে,সকালে ঘুম থেকে উঠেই নাকি আফরানকে দেখতে হবে।এসব পটানি টাইপের কথা আফরান শুনলেতো আকৃষ্ট হয়ে পড়বে মুনিরার উপর।যতই সায়নীকে ভালোবাসুক সে,ছেলের মনতো!
-তোমাকে নিশ্চয় বলে গিয়েছে?
দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ সংযত করে সায়নী বলে-
কেনো তোমাকে বলেনি?
-বলেনি বলেইতো জিজ্ঞেস করলাম।আমাকে কিছু বলে নাকি!তুমি জানলে বলোনা প্লিজ।
-বন্ধুর সাথে বাইরে গিয়েছে,ওখান থেকেই অফিসে যাওয়ার কথা।
-ফোনটা অফ।অফিসের নাম্বারটা বাবার কাছ থেকে চাইতে লজ্জা লাগছিলো।তুমি দিবা প্লিজ?
সায়নী বেশ অবাক-ই হলো মুনিরার কাণ্ড দেখে।ওরে আমার লজ্জাবতীরে….
তার নাকি নাম্বার খুঁজতে লজ্জা লাগে!
সায়নী আর কিছু না বলে নিজের মোবাইল থেকেই আফরানের অফিসের ফোনে ডায়াল করে।
-হ্যালো আফরান?
-কি ব্যাপার মিস করছো?
-মুনিরা মিস করছে।
-মানে?
-ওকে না বলে চলে গিয়েছো কেনো?জানোনা সকালে ঘুম থেকে উঠে তোমাকে দেখতে হয় ওর।
-তোমাকে বলেছে সে এসব?
-না আমি বানিয়ে বলছি।
মুনিরার এসব কথায় যে সায়নীর মেজাজ খারাপ হয়েছে আফরান বুঝতে পারে।শান্ত গলায় বলে-
মুনিরাকে ফোনটা দাও।
সায়নী ফোন মুনিরার দিকে এগিয়ে দিতেই সে ফোনটা কানে লাগিয়েই বলে উঠে-
এইরকম আর না বলে যাবেন না।বুঝলাম যে আমি ঘুমোচ্ছিলেন তাই বিরক্ত করেন নি।কিন্তু পরেরবার থেকে বলেই যাবেন।
এসব কথা সায়নীর সামনে বলার কোনো মানে হয়!এমনিতেই মেয়েটার মনে তাকে হারানোর ভয় জমে আছে, এসব কথা শুনেতো ভাববে মুনিরার সাথে সম্পর্কটা এগুচ্ছে।ধমকের সুরেই আফরান বলে-
এই মেয়ে কখন তোমাকে বলে বের হয়েছি আমি!আর এসব কথা তুমি সায়নীকে কেনো বলতে গিয়েছো?আমি বাইরে থাকা অবস্থায় আর কখনও ফোন করবেনা আমাকে, কোনো দরকার হলেও না।
-আপনি রেগে যাচ্ছেন কেনো?
আর কিছু না বলে আফরান ফোনের লাইন কেটে দেয়।
মুনিরার কথা শুনে সায়নী বুঝেছে আফরান তাকে কটু কথা শুনিয়েছে।তার ছলছল দৃষ্টি সায়নীর ভালো না লাগলেও মনটা শান্ত লাগছে।
সন্ধ্যা ৭টা….
সকাল সকাল বের হওয়ার কারণে আফরানের শরীরটা ভালো লাগছেনা।তাই সে বাসায় ফিরে আসে।হাসির মা দরজা খুলতেই জিজ্ঞেস করে-
মুনিরার আম্মারা চলে গিয়েছেন?
-না আব্বাজান,আছেতো।
-ওহ।
বিরক্তি ভাব নিয়ে নিজের রুমে পা রাখতেই দেখতে পায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচি ঠিক করছে মুনিরা।আজ সে সায়নীর মতই সেজেছে চুল খোলা রেখে।
আজ প্রথম মুনিরাকে খোলা চুলে দেখছে আফরান।সায়নীর মতো লম্বা চুল না হলেও খোলা চুলে সুন্দর-ই লাগছে তাকে।কিন্তু তার সায়নীর মতো সাজার কারণ-টা কি!
-এসবের মানে কি?
আফরানের কণ্ঠ শুনে চমকে যায় মুনিরা।
পেছনে তার দিকে তাকিয়ে বলে-
আপনি এতো তাড়াতাড়ি?
-তোমার সমস্যাটা কি?তাড়াতাড়ি বের হলেও সমস্যা আসলেও সমস্যা!
-আমিতো এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম।
-করবেনা।আর হঁ্যা,সায়নীর মতো সাজে তোমাকে মানায়নি।ওর মতো হওয়ার চেষ্টা করবেনা।
মনটা ছোট হয়ে যায় মুনিরার।অভিমানী সুরে বলে-
ঠিক আছে।
আফরান বুঝতে পারে কষ্ট পেয়েছে সে।পরিস্থিতি ঠিক করতে আবার বলে-
নিজের মতোই সাজবা।খোপা করে,মাথায় কাপড় দিয়ে রাখলে ভালোই লাগে।
কথাটি বলেই আফরান ড্রয়ার থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্য চলে যায়।আর মুনিরা খুশিতে খোপা করতে থাকে।আফরানের যেমন পছন্দ তার-ই তেমন পছন্দ।
-আজ নাকি ভালোবাসা দিবস মুনিরার আব্বা!
-এগুলা কি আমাদের জন্য এসেছে নাকি!
-হুম তুমিতো এসব বলবাই।মানুষতো শখ করেও বউকে এই দিনে কিছু একটা দেয় আর তুমি….
-কিছু দিতে দিবস লাগে?
-দিবস ছাড়াও তো দাওনা।তাই তোমাদের মতো কিপ্টাদের জন্যই এই দিবস বের করছে যাতে একদিন হলেও বউরে একটু সময় দিতে পারো,কিছু একটা উপহার দিতে পারো।কিন্তু তোমরা এই দিনেও কিপ্টানি করবা।কিছু দেওয়ার ভয়ে বলবা,’আমার জন্য প্রত্যেকদিন দিনই ভালোবাসা দিবস।’
-হাহাহা,তুমি পারোও মুনিরার মা!বুড়ো বয়সে…..
-বুড়ি যখন ছিলাম না তখনও দাওনি।
তাই এখন শোক তুলি আরকি!
-আচ্ছা।
-আমার মেয়ের কপাল টাও আমার মতো।নতুন বিয়ে হইছে।জামাই কোথাও নিয়ে যায় নাই,উল্টো নিজে অফিস চলে গেছে,মেয়েটারে কিছু দেয়নাই ও।
-দিছে হয়তো।
-দেয়নাই।দিলে তোমার মেয়ে এসে বলতো।
ড্রয়িং রুমের উদ্দেশ্য আসছিলো আফরান।
মুনিরার মায়ের শেষের কথাটি তার কান স্পর্শ করে।আসলেইতো!মেয়েটার কি দোষ!এমন দিনে সে আরো খারাপ ব্যবহার করতে থেকেছে মেয়েটার সাথে যা ঠিক হয়নি।
আফরান আর অপেক্ষা না করে বাসার বাইরে চলে যায়।
বাড়ির পাশের গিফট শপ থেকে হলেও মুনিরার জন্য কিছু আনা উচিত।আজ মুনিরাকে কড়া কথা বেশি শুনিয়েছে,তার জন্য একটু মন ভালো করতে একটা উপহার দিতেই পারে।তাছাড়া উপহার না দিলে মুনিরার মা এটা নিয়েও তার বাবাকে অভিযোগ করতে পারে।
সায়নীর ফোন বাজছে।পাবেলের ফোন এসেছে।যা রিসিভ করতে তার একদমই ভালো লাগছেনা।না চাইতেও রিসিভ করে সে।
-হ্যালো?
-কেমন আছো?
-ভালো।আপনি?
-আছি ভালোই।
-ফুফুরা ভালো আছেন?
-হুম আছেন।আসলে দরকারে ফোন দিয়েছি তোমাকে।
-কি দরকার?
-মা চাচ্ছেন,যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা সেরে ফেলতে।বিয়ের কথা বলতে আমরা তোমাদের ওখানে আসবো।
কথাটি শুনে বুকটা ধুক করে উঠে সায়নীর।
লাইন কেটে ফোনটা বন্ধ করে দেয় সে।
কি বলবে সে পাবেল কে!ফুফু কতো আশা করে আছেন।সবার বিশ্বাস নিয়ে আর কতো খেলবে সে!কি করা উচিত তার!
-মুনিরা এটা তোমার জন্য।
ছোট একটা প্যাকেট আফরান তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে দেখে বেশ অবাক হয় সে।
-কি হলো নাও!
-এটা আমার জন্য?
-হুম,তোমার জন্য।
আফরানের হাত থেকে প্যাকেট-টি নিয়ে অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে মুনিরা বলে-
সত্যি?না মানে,কেনো?
-ভালো লেগেছে তাই।
কথা না বাড়িয়ে আফরান রুম ছেড়ে চলে যায়।এদিকে মুনিরা তাড়াতাড়ি করে প্যাকেট-টি খুলে।প্যাকেটের ভেতর থেকে একটা ছোট বক্স বের করে।বক্সটি খুলেই দেখে এক জোড়া পায়েল!যা দেখে খুশিতে মুনিরার চোখে পানি চলে আসে।পায়েল জোড়া হাতে নিয়ে দেখতে থাকে সে।
-এতো সুন্দর পায়েল জোড়া কে দিয়েছে তোকে?
-আম্মা তুমি!ভেতরে আসো।
মেয়ের কথায় মুনিরার মা ভেতরে গিয়ে তার পাশে বসে বলে-
কে দিয়েছে?
-তোমাদের জামাই।
-কি!আমি আরো তোর বাবাকে বলছিলাম আমাদের জামাই তোর বাবার মতো পানসে।
এখন দেখছি আমার ধারণা ভূল।ভালোবাসা দিবসে তোকে সময় দিতে না পারলেও উপহার দিয়েছে।
মায়ের কথা শুনে মুনিরার মনে আরো এক ধাপ আশা জেগে উঠে।মুখে কিছু না বললেও আজকের দিনে আফরান তাকে উপহার দিয়েছে মানে তাদের সম্পর্কটা এগুচ্ছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর সায়নী তার ফোনটা অন করে ডায়াল করে পাবেলের নাম্বারে।ঠিক করে আজ সে পাবেল-কে সব বলবেই।

-হ্যালো?
-ফোন অফ হয়ে গিয়েছে কেনো সায়নী?লাইন কেটে যাওয়ার পর কল ব্যাক করেছিলাম,অফ বলছে।
-আসলে একটু সমস্যা হয়েছিলো।
-মোবাইল এর সমস্যা?আমি তোমার জন্য নতুন মোবাইল পাঠাবো।
-আরে না।আমার মোবাইল ঠিক আছে।কোনো সমস্যা নেই মোবাইল এর।আসলে অন্য কারণে…মানে লাইন কেটে যাওয়ার জন্য আমি দুঃখিত।
পাবেল বুঝতে পারে সায়নী লাইন কেটে যাওয়ার কারণ তাকে বলতে ইচ্ছুক নয়।কতো কারণ-ই হতে পারে।সব বলতে হবে বলে কথা নেই।
সায়নীর কাছ থেকে আগে নাম্বার নেয়া হলেও তাকে ফোন দিয়েছে সে এই প্রথম।হয়তো হঠাৎ পাবেলের কণ্ঠ শুনে সে নার্ভাস হয়ে গিয়েছে।তাই সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে-
আরে ঠিক আছে সায়নী।আমার সাথে এতো ফর্মালিটি করার প্রয়োজন নেই।
-ধন্যবাদ।
-আহা!
-কি?
-এটাও কিন্তু…
-বুঝেছি আর বলবোনা।
-গুড।
-কি যেনো বলছিলেন তখন?
-ওহ,বলছিলাম আম্মুরা তোমাদের ওখানে যেতে চায়ছেন।আমাদের বিয়ের কথা আগানোর জন্য।কখন যাবে?
অনেক চেষ্টা করেও সায়নী পারছেনা পাবেল কে সব খুলে বলতে।আফরানের সাথে পাবেলের বিষয়ে কথা বলতে মনেই ছিলোনা তার।কিন্তু পাবেল কে অন্ধকারে রাখা কি ঠিক হবে!মোটেও না।
আবার পাবেল কে জানালে সে যদি রেগে গিয়ে গণ্ডগোল করে!উফ ভাবতে পারছেনা আর সে।কি করবে,কি করা উচিত!
-কোনো সমস্যা সায়নী?
-আসলে…
-বলতে পারো আমাকে তুমি।
-আমি এই বিয়েটার জন্য এখনও প্রস্তুত নয়।
-কিন্তু তোমাকে আগেই জানানো হয়েছে আমার কথা তবুও কেনো তুমি এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারোনি?
-তখন তো আর আপনার সাথে মিশতে পারিনি আমি।
-ওহ এই ব্যাপার!তা এখনও মিশছো কই?
-বুঝিনি।
-আমার সাথে কোথাও যাওয়া দূরের কথা।
একটা ফোনও দাওনি।
-আপনিও দিতে পারতেন।
-হাহা চালাক!
-হুম।
-তাহলে তোমার সময় লাগবে ভাবতে?
-হুম,কিছুদিন।
-ঠিক আছে নাও সময়।
-তবে ফুফুদের নিয়ে বেড়াতে আসেন।
বিয়ের কথা না হয় অন্য একদিন তুলবেন তারা।
-হুম আইডিয়া খারাপ না।আমি আম্মুকে বলবো।কাল আসবো আমরা দুপুরের আগে।
-ঠিক আছে,এখন রাখি।
-হুম।
পাবেলের মা যখন সায়নীর কথা পাবেল কে জানায় তখন থেকেই তার মনে সায়নীর জন্য একটু একটু করে ভালোবাসা জমতে থাকে।
শেষ দেখেছিলো সায়নীকে ৯বছর আগে।৯বছর আগেই পাবেল আমেরিকা চলে যায় পড়াশোনার জন্য।তার পরিবার দেশে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকলেও এই ৯বছরে সে একবারো আসেনি।
পড়াশোনার প্রচণ্ড চাপে প্রেম-ভালোবাসা এসব করার সুযোগও পায়নি।মা যখন সায়নীর কথা বলে তাকে,
যোগাযোগ করার ইচ্ছে থাকলেও করেনি সে।মায়ের দেখানো কিছু ছবিতে সায়নীকে দেখে সে।৯বছর আগের সায়নীর সাথে এই সায়নীর সব-ই মিল রয়েছে।দেখতে সুন্দরী,মেধাবী,মায়েরও পছন্দ।সায়নীর চেয়ে বেস্ট জীবন সাথী আর কেউ হতে পারেনা তার জন্য।সব কিছু ভেবে সেও বিয়েতে রাজী হয়ে যায়।কিন্তু সায়নীর কি হয়েছে হঠাৎ!
-আম্মা কি করো?
-আরে হাসির মা আসোনা ভেতরে।
-জানো আম্মাজান কি হইছে?
-কি হয়েছে?
-আব্বাজানে তার বউরে পায়েল উপহার দিছে দুইডা।
-মানে?
-কি জানি দিবস আছেনা?
-ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে দিয়েছে?
-হা।
-তুমি কি করে জানো?
-আমি ওই ঘরে গেছিলামতো।দেখছি।
-আফরান কে একটু বলতে পারবে আমি ডাকছি?
-আইচ্ছা।
আমাকে গিফট দিলে মুনিরাকেও দিতে হবে!তার মানে আমার সাথে সকালে সময় কাটালে রাতে মুনিরার সাথে….
নাহ,দুই নৌকায় পা দিয়ে আফরান চলতে পারবেনা।কিছুতেই না।
আফরান দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই সায়নী তার শার্ট এর কলার ধরে জিজ্ঞেস করে-
মুনিরাকে পায়েল দিয়েছো কেনো?
-ওর মা কথা টানছিলো, আজকের দিনে…
-ওদের সবাইকে খুশি রাখার দায়িত্ব তোমার?
-সায়নী পাগলামো করছো এখন তুমি।
আফরান থেকে খানিকটা দূরে সরে সায়নী আবার বলতে শুরু করে-
তোমার দুইটা বউ দরকার আসলে।নাহলে বিয়ে তুমি করতে না।আর ভূলেই যখন করেছো ওই মেয়ের সাথে আটকে যেতেনা।
সায়নীর পাশে গিয়ে আফরান তার কাঁধে হাত রেখে বলে-
সায়নী শোন প্লিজ?
সায়নী তার হাতটি সরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে-
গায়ে হাত দিবেনা একদম।কি শুনবো!খালুতো চায়বেন তার বন্ধুর মেয়েকে উদ্ধার করার জন্য বিপদ থেকে।তাই তোমাকে অনুরোধ করেছে বিয়েটা করার জন্য।তুমিও ঢ্যাংঢ্যাং করে বিয়েটা করে নিলে।কেনো?তুমি পারতেনা বিয়া ছাড়াই মেয়েটাকে বাড়িতে তুলে আশ্রয় দিতে?পরে না হয় দেখে শুনে পরে অন্য কোথাও বিয়ে দিতে।না তুমি তা করোনি।আসলে তুমি ওকে দেখে লোভ সামলাতে পারোনি।একদিকে আমাকে রেখেছো অন্যদিকে মুনিরাকেও।মেয়ের প্রতি এতো লোভ তোমার!তুমি একটা চরিত্রহীন পুরুষ।
এই কথাটি শুনে আফরান নিজের রাগ সংযত করতে না পেয়ে সায়নীর গালে কষে একটা চড় দেয়।
আফরানের এমন কাণ্ডে সায়নী বোকার মতো আগের জায়গাতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
সায়নীকে শান্ত অবস্থায় দেখে আফরান তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে-
আমি কেনো বিয়েটা করেছি আমি জানিনা।কিন্তু বিশ্বাস করো মুনিরাকে নিয়ে আমার মাথায় এসব ফালতু চিন্তা আসেনি।আমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো খুব তাড়াতাড়ি।
আর পায়েল জোড়া ওর মায়ের মুখ বন্ধের জন্য দিয়েছি।তাও আমার ভূল হয়েছে।
সায়নী কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
চোখে আস্তে আস্তে অন্ধকার দেখছে সে।
আফরানের শরীরের সাথে তার শরীর একেবারেই লেপ্টে যাচ্ছে।
-কি ব্যাপার সায়নী কথা বলছো না কেনো?

-এই সায়নী?
কোনো সাড়া না পেয়ে নিজের বুক থেকে সায়নীকে সরাতে গিয়ে আফরান বুঝতে পারে সায়নী বেহুঁশ হয়ে গিয়েছে।এমন অবস্থায় তার কি করা উচিত বুঝতে না পেরে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে আফরান।
তার চিৎকারে বাসার সবাই সায়নীর রুমে এসে দেখে সায়নীর মাথা কোলের উপর রেখে মাটিতে বসে আফরান কেঁদে চলেছে।
-আম্মু আসবো?
-হুম পাবেল আয়।
-সায়নীর সাথে কথা হয়েছিলো।
-কি বলেছে সে?
-বিয়ের কথা আর কিছুদিন পরে বললে ভালো হয়।
-এটা বলেছে সায়নী!কিন্তু কেনো?
-আসলে আমরা আগে একে অপরকে চিনতে চাই।
-নতুন করে চেনার কি আছে!
-না মানে….
-ওহ প্রেম করতে চাস বিয়ের আগে এটা বলনা।
-আম্মু!
-হাহা।ঠিক আছে কর তোরা প্রেম।কিন্তু এক মাসের বেশি সময় দিতে পারবোনা।
-হেহে।তাতেই হবে।তবে কাল ওদের বাসায় আমাদের সবাইকে যেতে বলেছে।
-তাই নাকি!বেশ ভালো হলো।
আফজাল ভাইয়ের সাথেও দেখা হবে।
-হুম তবে আম্মু প্লিজ বিয়ের কথা তুলোনা এখন।
-আরে বাবা তুলবোনা।মনে থাকবে।
-ধন্যবাদ আমার লক্ষি আম্মুটা।
আস্তে আস্তে চোখ খুলে সায়নী দেখতে পায় সে বিছানায় শুয়ে আছে।চারপাশে বাড়ির সকলে রয়েছে।মুনিরা তার পাশেই বসে আছে।
সায়নী চোখ খুলতে দেখে মুনিরা খুশিতে বলে উঠে-
আপু চোখ খুলেছে।
আফরান ডাক্তার আনার জন্য বের হচ্ছিলো সায়নীর জ্ঞান ফিরছেনা বলে,মুনিরার কথায় সে পেছনে ফিরে সায়নীকে দেখতে পায়।সায়নীর চোখ খোলা দেখে তার শরীরে প্রাণ ফিরে পায়।
আফজাল খান সকলের উদ্দেশ্য বলেন-
সায়নীকে এখন আরাম করতে দেওয়া উচিত আমাদের।
তার কথায় একে একে সবাই বের হয়ে গেলেও মুনিরা আর আফরান দাঁড়িয়ে থাকে।মুনিরা শ্বশুরের উদ্দেশ্য বলে-
আজ আমি আপুর সাথে থাকি?
আফজাল খান কিছু বলার আগেই সায়নী বলে ধীর গলায়-
না তুমি যাও।
আফজাল খান বলেন-
আফরান বউমা কে নিয়ে যা নিজের রুমে।
-কিন্তু সায়নী?
-সেটা আমি দেখছি।
না চাইতেও আফরানকে রুম থেকে বের হতে হয়।
সায়নীর পাশে বসে আফজাল খান বলেন-
তুই কি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত?
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সায়নী বলে-
না খালু।কদিন ধরে শরীরটা ভালো লাগছেনা।
-তাহলে একটা ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে তোকে।
-কোনো দরকার নেইতো খালু।
-আছে,আমি পাবেল কে বলবো।এখন ঘুমা,
আজ হাসির মাকে বাসায় যেতে নিষেধ করবো।তোর পাশেই থাকবে সে।
-হুম।খালু একটা কথা ছিলো।
-কি মা?
-কাল ফুফুরা আসবেন।
-এটাতো ভালো কথা!
-কিন্তু আমিতো অসুস্থ হয়ে পড়েছি।
-তাতে কি হয়েছে!উনাদের কোনো অযত্ন আমি হতে দিবোনা।
-না সেটা বলছিনা।
-আর কিছু বলিস নাতো।ঘুমা এখন।
এতোদিন নির্ঘুমে রাত পার করেছে সায়নী।
কিন্তু আজ তার খুব ঘুম পাচ্ছে।কোনো কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছেনা তার।হয়তো শরীর খারাপ তাই।
এদিকে আফরানের মন ছটফট করতে থাকে সায়নীর জন্য।এটা কি করলো সে!সায়নীর গায়ে হাত তুলছে সে!এই অপরাধের জন্য সায়নী যদি তাকে ছেড়ে চলে যায়?তার ভূলের পরিমাণ কি দিন দিন বেড়ে চলেছে!
আচ্ছা সায়নীর জায়গায় হলে সে নিজেই কি করতো!হয়তো মুনিরা নামক মেয়েটাকে মেরেই ফেলতো।
-আপু কিভাবে বেহুুঁশ হলো?
মুনিরার হঠাৎ প্রশ্নে আফরান চমকে যায়।আমতাআমতা করে বলে-
আমি ঠিক জানিনা।
-কিন্তু আপনিতো ওখানেই ছিলেন।মানে আপনার চিৎকার শুনেই আমরা সকলে আপুর রুমে যাই।
-আমি ওর সাথে কথা বলছিলাম।কথার মাঝে হঠাৎ করেই ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ওর এই অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
-ওহ!আপুকে ইদানিং অসুস্থ মনে হয়।একটা ডাক্তার দেখানো উচিত।
-ঠিক আছে,আমি কথা বলবো ওর সাথে এই বিষয়ে।
শুয়ে পড়ে মুনিরা।কিন্তু মাথায় তার একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে,সায়নীর জ্ঞান হারানোর কারণ কি!
সকাল ১১টা……
সায়নীর ঘুম ভাঙ্গে হাসির মায়ের ডাকে।
-আপা মনি?উঠো দেখি।তোমার হবু জামাই আসবেতো।
-উহু খালা,তোমাকে কতবার বলেছি আপা টাপা ডেকোনা আমায়।সায়নী ডেকো।
-আপা মনিতো আদরের ডাক।
সায়নী বিছানায় উঠে বসে।হাসির মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে-
নতুন বউ কে কি আদর করে আপা ডাকো?
-নাতো,তারে আমি ও বউ বলেই ডাকি।
-ও বউ!হাহা।
দুপুর ১২টা….
সায়নীর ফুফুরা তাদের বাসায় উপস্থিত হয়।
তাদের সাথে পাবেল আসেনি।তার এক বন্ধুর শরীর খারাপ হওয়ার কারণে তাকে বন্ধুর কাছে যেতে হয়।
বাসার সকলে বসে একসাথে গল্প করছে।
কিন্তু আফরান অফিসে।
এক পর্যায়ে সায়নীর খালা বলেন-
আজতো সায়নীর রান্না খেতেই এসেছি আমরা।সেই কবে খেয়েছি!এখন নিশ্চয় রান্না আরো বেশি ভালো হয়?
সায়নীকে চুপ থাকতে দেখে আফজাল খান বলেন-
আসলে ওর একটু শরীর খারাপ তাই দুপুরের রান্নাটা ও করতে পারেনি।তবে হুম রাতেরটা নিশ্চয় করবে।
-আমরা রাতের আগেই চলে যাবো।
-না না,তা হয়না।আজ থাকতে হবে।তাছাড়া পাবেলের সাথে দেখাই হয়নি।
-কিন্তু..
-আরে তাকেও সুযোগ করে দিন সায়নীর রান্না খাওয়ার জন্য।পাবেলকে ফোন করে ফ্রি হলে চলে আসতে বলুন।
-কথাটা মন্দ বলেন নি ভাই।
ওগো তুমি কি বলো?
পাবেলের বাবা হেসে বলেন-
তুমি যা বলো তাই।পাবেল আসলেই না হয় বিয়ের কথাটাও সেরে নিবো।
কথাটি শুনেই মুনিরার মায়ের মুখে হাসি ফুটে।আপদ দূর করতে পারবে ভেবেই
তিনি খুশিতে বলে উঠেন-
হুম ভাই সাহেব,সব যখন ঠিক হয়ে আছে আর দেরী কিসের জন্য!সায়নীর সাথে পাবেলের বিয়েটা সেরেই ফেলেন।
পাবেলের কাল রাতের কথা তার মায়ের মাথায় ঠিকই রয়েছে।
তাই তিনি সবার উদ্দেশ্য বলেন-
পাবেল চায় আগে কিছুদিন সায়নীর সাথে মিশতে।আর কিছুদিন পরেই না হয় বিয়ের কথা আগায় আমরা?কি বলেন আফজাল ভাই?
-আপনারা যা ভালো বুঝেন।
সায়নী কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে ফুফুর দিকে তাকাতেই ফুফু বলে উঠে-
এই যে,এতো বেশি রান্না করতে হবেনা।আবার শরীর খারাপ করবে।যেকোনো একটা আইটেম পাবেলের জন্য করলে হবে।
-জ্বী।
রাত ৮টা….
এতো লোকের মাঝে মুনিরার মনে পড়তে থাকে আফরানকে।
কেনো তার আফরানের প্রতি এতো ভালোলাগা কাজ করে!
যার জন্য এতো মানুষের ভিড়েও সে আফরানের কথা মনে করে চলেছে।
কলিং বেল এর শব্দ হয়।মুনিরা ভাবে আফরান এসেছে।সবাই ব্যস্ত থাকার কারণে সে তাড়াহুড়ো করে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়।
কিন্তু দরজার ওপারে আফরান নয়,দাঁড়িয়ে রয়েছে পাবেল।
কয়েক সেকেণ্ড মুনিরার দিকে তাকিয়ে পাবেল বলে উঠে-
মুনিরা!

অপরিচিত একটা ছেলের মুখে নিজের নাম শুনতে পেয়ে অনেকটায় অবাক হয়ে যায় মুনিরা।
-আপনি মুনিরা না?
-হুম।কিন্তু আপনি কে?
-আমি পাবেল।
-সায়নী আপুর ফুফাতো ভাই নাকি?ওহ দুঃখিত উনার হবু স্বামী?
-জ্বী।
-কিন্তু আপনি আমাকে কি করে চেনেন?
-আনাস আমার বন্ধু ছিলো।স্কুলে একসাথে পড়েছি আমরা।
মুনিরাকে চুপ থাকতে দেখে পাবেল আবার বলতে শুরু করে-
আসলে আনাস শহরের স্কুলে মামার বাসায় থেকে পড়াশোনা করতো।তখন আমরা ফ্রেন্ড হয়েছিলাম।যদিও সে গ্রামের ছেলে আমি শহরের,পরবর্তীতে সে ডুবাই চলে যায় আর আমি আমেরিকায় তবুও আমাদের মাঝে যোগাযোগ ছিলো।আর আনাস আমাকে আপনার ছবি দিয়েছিলো আপনাদের বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে।তাই আপনাকে দেখে চিনে ফেলেছি আমি।
-ওহ।
-কিন্তু আপনি এখানে?
-জ্বী সায়নী আপুর খালাতো ভাইয়ের সাথেই আমার বিয়ে হয়েছে।
-ও আচ্ছা।
-দুঃখিত অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছি আপনাকে।ভেতরে আসুন।
-আরে না ঠিক আছে,চলুন।
পাবেলের মুখে আনাসের কথা শুনে মুনিরার মনটা খারাপ হয়ে যায়।
আচ্ছা আনাস কি সত্যি সে অপয়া বলেই মারা গিয়েছে!
মুনিরা এক পা বাড়ানোর সাথে সাথে আবার কলিং বেল বেজে উঠে….
সে খুলে দিতেই আফরান কে দেখতে পায়।
-এসেছেন এতক্ষণে!জানেন আজ বাসায় মেহমান আছে?
-কেউ বললেইতো জানবো।
-বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনি ফোন দিতে নিষেধ করেছিলেন বাইরে থাকা অবস্থায়।
-কে এসেছে?
-সায়নী আপুর ফুফুরা।
ভ্রু জোড়া কুচকে আফরান প্রশ্ন করে-
পাবেল এসেছে?
-উনি মাত্রই আসলো।উনার বাবারা দুপুরের আগে এসেছেন।
-ওহ।
হাসির মা পাবেলকে দেখে ছুটে চলে যায় সায়নীর রুমে….
তার কাছে গিয়েই হাঁপাতে হাঁপাতে বলে-
আপা মনি?
-কি ব্যাপার হাঁপাচ্ছো কেনো?
শরীর খারাপ?
-আরেনা।তোমার হবু বর আইসা পরছে।
-পাবেল?
-হো।
-ও আচ্ছা।
-যে সুন্দর।আমেরিকার পোলার মতন।তোমার সাথে মানাইবো খুব।
-এটা বলার জন্য ছুটে আসতে হয়?পড়ে গেলে কি হতো শুনি!
-আমিতো তোমারে তাড়াতাড়ি বলতেই ছুইট্টা আসলাম।যাও উনার কাছে।
সায়নীর মোটেও ইচ্ছে করছেনা পাবেলের কাছে গিয়ে ফালতু প্যাঁচাল করতে।
-আপা মনি যাওনা।আমি আফরান ভাইরে ভেতরে চলে যায়তে বলি।
-আফরান এসেছে?
-হো,ভাইজান তো তোমার হবু বরের পাশেই আছে বসার ঘরে।
-বাকি সবাই?
-তোমার খালুর ঘরে।
-আচ্ছা থাক।যেতে বলিওনা ওকে।
সায়নী নিজের চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে চোখে হালকা কাজল দেয়।ঠিক করে আফরান কে তার শাস্তি দিতেই হবে।লম্বা একটা দম ফেলে এগিয়ে যায় ড্রয়িং রুমের দিকে।
-হ্যালো পাবেল?
সায়নীকে দেখেই দাঁড়িয়ে যায় পাবেল।
মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলে-
কেমন আছো সায়নী?
-এইতো ভালো।আপনি?
-ভালোই।
-দাঁড়িয়ে কেনো গিয়েছেন!প্লিজ বসুন।
-কিন্তু তুমি?
-হুম আমিও বসবো।
পাবেলের পাশে গিয়ে সায়নী বসতেই আফরানের চোখ দুটো লাল হয়ে যায়।
-আপনি এতো দেরী করে কেনো এলেন?
-আসলে আমার একটা বন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়ে যার জন্য…..
-ঠিক আছে।ভালোই হলো তখন আসেন নি।
-মানে?
-আসলে আমি তখন রান্না করিনি।এখন রান্না করবো আপনার জন্য।কি খাবেন বলুন?
-তোমার যা খুশি রাঁধো।
-আচ্ছা তাহলে আপনারা গল্প করুন,আমি আসি।
কি করে আমার সামনে সায়নী অন্য একটা ছেলের পাশে গিয়ে বসে এসব কথা বলতে পারছে!শুধু মাত্র আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য!হুম হুম শাস্তি,তবুও কেনো আমার এতো খারাপ লাগছে!এসব ভেবে ভেবে আফরানের বুকের ভেতর উতাল-পাতাল করছে।সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে করতে সায়নী যদি পাবেলের হয়ে যায়!না কিছুতেই না।সায়নী শুধু তার।
-আপু আমি সাহায্য করি?
-আসলে আমি আমার হবু বরের জন্য নিজেই কিছু করতে চাইছি।কোনো সাহায্য লাগবেনা আমার।
-কিন্তু তোমার শরীরটা দূর্বল।
-কিচ্ছু হবেনা।এতো ভেবোনা।তুমি বরং অন্য কিছু করো।ইলিশ মাছ আমাকে একা রান্না করতে দাও।
-হেহে।আচ্ছা।
আজ সায়নীকে অনেকটা হাসিখুশি দেখে মুনিরারও বেশ ভালো লাগছে।তাকে দেখে মনেই হচ্ছেনা সে অসুস্থ ছিলো।
-কি ব্যাপার হঠাৎ এভাবে চলে এলে যে আফজালের রুম থেকে?
-তোমার ইচ্ছা হলে তুমি থাকো নাই কেনো?
-তোমার আবার কি হলো মুনিরার আম্মা?
-সেই কখন থেকে উনাদের বুঝাতে চাইছি পাবেলের সাথে সায়নীর বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দেওয়ার জন্য।তারা পাত্তাই দিচ্ছেনা আমার কথা।
-হাহা!এই ব্যাপার!
তাদের ছেলের ব্যাপার তারা বুঝবে,তুমি কেনো এমন করছো?
-সময় হলে বুঝবে কেনো করছি আমি।আপাতত চাইছি ওই মেয়ে এই বাড়ি থেকে দূর হোক।যতদিন সে থাকবে, শান্তি নাই আমার।
রাতের খাবার খেয়ে সকলে বসে গল্প করছে….
পাবেলের বাবারা চলে যেতে চাইলেও আফজাল খান যেতে দেয়নি।আর পাবেল যায়নি সায়নীর কথা রাখতে।
-সায়নী তুই এতো ভালো রান্না কি করে করিস বলতো!
ফুফুর কথায় মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে সায়নী বলে-
ভালো লেগেছে তোমার?
-শুধু ভালোনা।অনেক বেশি।
বিয়ের পরে তোকে কোনো কাজ করতে হবেনা।শুধু রান্নাটাই করবি।রান্না কিন্তু আর কাউকে করতে আমি দিবোনা।তুই কি বলিস পাবেল?
-আমি আর কি বলবো।
-কেনো তোর ভালো লাগেনি রান্না?
সায়নীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সে বলে-
লেগেছে।
রাত বাড়ার সাথে সাথে বড়রা যে যার রুমে চলে যায়।
আফরান খেয়াল করে সায়নীকে দূর্বল লাগছে আবার।
-সায়নী?
-হুম?
-ঘুমিয়ে পড়ো।তোমার শরীর ভালো নেই।
-না আমার উনার সাথে গল্প করতে ভালোই লাগছে।তুমি আর মুনিরা যাওনা ঘুমোতে।
আমরা গল্প করি।
আফরান কিছু বলার আগেই পাবেল বলে উঠে-
শরীর খারাপ মানে?সায়নী তুমি অসুস্থ?
-নাতো!
-আফরান যে বললো?
-ওহ আসলে কাল একটু খারাপ লেগেছে।
-তার মানে অসুস্থ।প্লিজ তুমি আর রাত জেগোনা।
-আপনার সাথে গল্প করতে ভালোই লাগছে আমার।
-উহু গল্প পরে করা যাবে।এখন ঘুমোতে হবে।
-কিন্তু..
-কোনো কিন্তু নয়।চলো আমি তোমায় রুমে দিয়ে আসি।
আফরানে এমনিতেই সায়নীর পাশে পাবেলকে সহ্য হচ্ছেনা তার উপর বেড রুমে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে মাথাটা খারাপ হয়ে যায়।তবুও রাগ সংযত করে পাবেলের দিকে তাকিয়ে আফরান বলে উঠে-
না থাক।
-মানে?
-মানে আমি ওয়াশরুমে যাবো এমনিতেও।তো আমি ওকে দিয়ে আসি।তোমরা থাকো।এসে আবার গল্প করবো।
-ঠিক আছে।
সায়নীকে নিয়ে আফরান চলে যায় সায়নীর রুমে।
ভেতরে ঢুকে দরজাটা হালকা ঠেলে সায়নীকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে সে।
-উফ ছাড়ো আফরান।
-নাহ।
-লজ্জা করেনা তোমার?
-আমার বউকে আমি জড়িয়ে ধরেছি।কেনো লজ্জা লাগবে শুনি?
-কালকের থাপ্পড় আমি ভূলিনি।
-তাই আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য পাবেলের সাথে নাটক করছো?কিন্তু লাভ হয়নি।জেলাস হয়নি আমি।
-দেখেছি আমি।
-কি দেখেছো?
-তোমার লাল লাল চোখ।
-হাহা।
আফরানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সায়নী বলে-
পাবেল কে সব জানাবো?
-তোমার ইচ্ছা।
-ঠিক আছে।মুনিরার বাবারা চলে গেলেই কিন্তু খালুকে সব বলবা।
-হুম হুম বলবো।তুমি চাইলে আমি এখনও বলতে পারি।আগেও বলেছি তোমাকে যখন বলতে বলো মুনিরার কথা বাবাকে বলতে পারবো আমি।
বলিনি?
-হুম।
-তবুও তুমি রাগ দেখাচ্ছো আমার সাথে।
-কি করবো!ঠিক রাখতে পারিনা নিজেকে।
-আর একটু ধৈর্য্য ধরো সব ঠিক হয়ে যাবে।
-হুম।ঠিক আছে যাও এখন।
-যাচ্ছি,আগে বলো কাল কোন গালে যেনো মেরেছি?
-সেটাকি ভূলবো!ডান গালে।
-এতো আদর মনে থাকেনা,এই একটা…আচ্ছা তুমি আমাকে মারো আজ।মেরে প্রতিশোধ নাও।
-হয়েছে ঢং অনেক।যাওতো কেউ দেখে ফেলবে।
আচমকা সায়নীর ডান গালে চুমু খেয়ে আফরান দৌড়ে তার রুম থেকে বের হয়ে যায়।
আফরানের এমন কাণ্ডে সব রাগ চলে যায় সায়নীর।
-কি বলেন আজ সায়নীর জন্মদিন!
-জ্বী হুম আজ জন্মদিন।
-ইশ আরেকটু আগে বললেতো ঠিক রাত ১২টাই উইশ করতে পারতাম।
আফরান ফিরে এসে দেখে পাবেল আর মুনিরা এখনও বসে গল্প করছে।তা দেখে সে বসতে বসতে বলে-
কি নিয়ে কথা হচ্ছে পাবেল?
-আজ নাকি সায়নীর জন্মদিন?
পাবেলের মুখে সায়নীর জন্মদিনের কথা শুনেই আফরানের মেজাজ খারাপ হওয়ার অবস্থা।কোনোমতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে জিজ্ঞেস করে-
তোমাকে কে বলেছে?সায়নী?
-আরে না,মুনিরা।
মুনিরার দিকে তাকিয়ে আফরান প্রশ্ন করে-
তুমি কিভাবে জানো?
-বাবা সায়নী আপুর জন্য উপহার তৈরি করে রাখছিলেন।সেই সময় বাবার রুমে গিয়েছিলাম আমি।তার কাছ থেকেই শুনেছি।তাই ভাবলাম আপুর হবু বরকে বলি।উনি যেহেতু আছেন এখানে,আপুকে কোনো সারপ্রাইজ দিতে পারবেন।আপুতো সারপ্রাইজ অনেক পছন্দ করে শুনেছি।আপু সাথে সাথে ছিলো বলে এতোক্ষণ বলতে পারিনি।
-আরে সমস্যা নাই।আজ থেকে শুরু।পুরো দিন পরে আছে।এই আফরান ভাই আইডিয়া দাওনা কি করা যায়?আর তুমিতো ওকে আগে থেকেই চেনো।ওর কি পছন্দ তাও জানবে নিশ্চয়?
সায়নীর জন্য আগে থেকেই সারপ্রাইজ প্লান করে রেখেছিলো আফরান।কিন্তু মুনিরা আর পাবেলের জন্য সে একা তাকে সারপ্রাইজ দিতে পারবেনা ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে যায় তার।হতাশ হয়ে তার আইডিয়ার কথা পাবেলদের বলতে থাকে সে।
সকাল ৭টা…
এলার্ম বাজছে…..
কিন্তু সায়নীর যতদূর মনে আছে সে মোবাইলে এলার্ম দিয়ে ঘুমোয়নি।তাহলে কোথায় বাজছে!ঘুম ঘুম চোখে সে বিছানায় বসে পড়ে।চারদিক আলোকিত হয়ে আছে।কিন্তু বারান্দার দরজা কে খুলেছে আর জানালার পর্দাটা বা কে সরিয়েছে!
বিছানা থেকে একটু দূরে টেবিল-টার দিকে তাকাতেই দেখে একটি ছোট টেবিল ঘড়ি,যেটাতে এলার্ম বাজছে।এই ঘড়িটা এখানে কিভাবে আসলো সায়নীর মাথায় কাজ করছেনা।তবে আপাতত এটা বন্ধ করাই তার কাজ।
সায়নী ঘড়িটা নেওয়ার জন্য বসা থেকে উঠতেই অবাক হয়ে যায়।ভালো করে চারদিক তাকিয়ে দেখে তার রুমের দেওয়ালে রঙ-বেরঙের বেলুন লাগানো,ফ্লোরে ফুলের পাপড়ি ছিটানো।
টেবিলের পাশে গিয়ে ঘড়িটা হাতে নিয়ে এলার্ম বন্ধ করে সে।এই ঘড়িটা সে আগে দেখেনি এই বাড়িতে।লাভ শেইপ এর অনেক কিউট একটা ঘড়ি।
টেবিলের উপর একটা কার্ডও দেখতে পায় সে।
হাতে নিয়ে খুলতেই লেখা দেখে-
Happy Birthday Sayoni…
আফরান ছাড়া তার জন্য এসব আর কে করতে পারে!
তার মনে না থাকলেও আজকের দিনটা আফরান ঠিকই মনে রেখেছে ভেবে খুশিতে তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে।
সেই সময় হাত দিয়ে তার চোখ দুটো চেপে ধরে পাবেল।
সায়নী হাতের ছোঁয়া পেয়ে কিছু না ভেবেই বলে ফেলে-
তুমি আজকের দিনটা মনে রেখেছো আফরান!
সায়নীর মুখে আফরানের নাম শুনে চমকে যায় পাবেল।
তার সাথে চমকে যায় দরজার পাশে আফরানের সাথে দাঁড়ানো মুনিরা।

#পর্ব_১৩

পাবেল চোখ থেকে হাত সরাতেই তার দিকে ফিরে সায়নী।পাবেল কে দেখে থমকে যায় সে।
আমতাআমতা করে বলে-
প্রতিবার আফরান ভাই আমার জন্য…
-আমি কিছু জানতে চাইনি সায়নী।
-হুম।আপনি করেছেন এসব?
রুমের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে মুনিরা বলে-
হুম পাবেল ভাইয়া করেছে তোমার জন্য।
খুশি হওনি তুমি?
পাবেলের দিকে তাকিয়ে সায়নী বলে-
হয়েছি।ধন্যবাদ।
-আমি করলেও আইডিয়াটা কিন্তু আফরানের।
-ও আচ্ছা।
দুপুর ২টা…..
সবাই দুপুরের খাবার খাচ্ছে।
তবে আজ রান্না করেছে মুনিরা।সায়নীর জন্মদিন উপলক্ষে আজ সে তার জন্য রান্না করেছে।
-আপু রান্না ভালো হয়নি?
-বাহ মুনিরা!তুমি দেখি ভালোই রান্না পারো।
-এতোদিন বলেছিলাম আমি পারি টুকটাক কিন্তু তুমিতো আমাকে রাঁধতেই দিতেনা।শুধু বলতে অন্য কাজ করো।
-হেহে,এখন থেকে রেঁধো।
আফরানের দিকে তাকিয়ে মুনিরা জিজ্ঞেস করে-
আপনার ভালো লাগছে?
-আমি তোমার সায়নী আপুর মতো ওতো পাম্প দিতে পারিনা।মোটামুটি ভালো হয়েছে।
আফজাল খান ছেলের উদ্দেশ্য বলেন-
আহ আফরান!শিখে যাবে আস্তে আস্তে।
মুনিরার মনটা খারাপ হয়ে যায়।সকলের সামনে আফরানের তাকে এসব বলার কি কোনো দরকার ছিলো!সে কি কখনও আফরানের মন জয় করতে পারবেনা!
বিকাল ৫টা….
নাস্তা সারার পরে পাবেল চায় সায়নীকে নিয়ে শপিং মলে যেতে।যেহেতু আজ তার জন্মদিন সেহেতু তার সাথে সময় কাটিয়ে তার পছন্দের জিনিস-ই উপহার দেওয়া ভালো।
সায়নীর ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও সে বের হয় পাবেলের সাথে।দুজনে একটা শপিং মলে যায়।
-শুধু কি হাটলেই হবে?কিছু নিতে হবেনা?
-থাক না।অন্য আরেকদিন নিবো।
-এটা বললেতো হবেনা সায়নী,কিছুই নিতে হবে তোমার।
মুখে কিছু না বললেও মুনিরার আজ সকালের ব্যাপারটি মোটেও ভালো লাগেনি।সায়নী কেনো এখনো আশা করবে আফরান তার জন্য কিছু করুক?আর তাছাড়া সায়নী আজ আফরান কে ভাই না বলে কেনো শুধু আফরান বলেছে!আর আফরান?সে শুধু সায়নীর প্রশংসা করতে থাকে,
তার একটু করলে কি এমন ক্ষতি হতো!এমন কিছু কি আছে যা সে জানেনা?
নাহ কি ভাবছে এসব সে!সায়নীর সাথে অনেক আগে থেকেই পাবেলের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।আর সায়নী অনেকদিন এই বাসায় থাকে।আফরান শুধু সায়নীর খালাতো ভাই নয় ভালো বন্ধুও।তাই সবসময় ভাই ডাকতে হবে কথা নেই।আর স সায়নীর জন্য আফরানেরও আলাদা টান থাকবে স্বাভাবিক।একটু বেশি ভেবে ফেলেছে।
-সায়নী?
পেছনে ফিরতেই সায়নী দেখতে পায় তার বান্ধবী মিশিকা কে।
মিশিকা…..
সায়নীর সবচেয়ে ভালো বান্ধবী।এক সাথে একই স্কুল-কলেজে পড়েছে তারা।পরবর্তীতে সায়নী চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আর মিশিকা চট্রগ্রাম মেডিকাল কলেজে ভর্তি হলেও তাদের মাঝে যোগাযোগ বন্ধ হয়নি।
মিশিকার ডাকে পেছনে ফিরে তাকে দেখেই সায়নী জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে-
তুই এখানে?
-হুম।তোকে কাল রাতে মেসেজ দিয়েছিলাম।
আজ তোর জন্মদিন না!উইশ করেছিলাম।
-ওহ সরিরে।আমি মেসেজ চেক করিনি।
পাবেলের দিকে চোখ পড়তেই তাকে কিছুক্ষণ দেখে মিশিকা জিজ্ঞেস করে-
কে উনি?
-আমার কাজিন।
কথাটি শুনে পাবেল এগিয়ে এসে বলে-
শুধু কাজিন নয়,হবু স্বামী সায়নীর।
কথাটি শুনেই মিশিকা চোখ বড় বড় করে সায়নীর দিকে তাকিয়ে বলে-
উনি দেশে এসেছে বলিস নিতো?
সায়নী কিছু বলার আগেই পাবেল বলে-
তার মানে আগে আপনাকে আমার কথা বলেছে?
-হুম বলেছেতো।
-কি বলেছে?
-বিয়ে ঠিক আছে ওইটা।
সায়নীর হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠে।ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখে আফরানের ফোন।
-আপনারা কথা বলুন,আমি একটু আসছি।
পাবেল বলে-
হুম ঠিক আছে।
সায়নী একটু দূরে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে-
হ্যালো??
-শুভ জন্মদিন।
-এতোক্ষণ পরে?
-সবার আগেই করেছি।কার্ডটা আমার দেওয়া ছিলো।
-জানি সবই তুমি করেছো।ওই পাবেল শুধু হেল্প করেছে।
-হেহে,,মন খারাপ?
-নাহ।
-আচ্ছা বলো কি চায় তোমার?
কিছুসময় চুপ থেকে সায়নী বলে-
পরের জন্মদিন শুধু তোমার সাথে পালন করতে চাই।
পাবেল কে নিয়ে বাসায় ফেরে সায়নী….
কলিং বেল বাজাতেই মুনিরা দরজা খুলে দেয়।
ভেতরে ঢুকেই চমকে যায় সায়নী।ড্রয়িং রুমটা সাজানো।আফরানের দিকে চোখ পড়তেই দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে বলে-
তোমার জন্য সাজানো।সবাই মিলে আজ আমরা তোমার জন্মদিন পালন করবো।
-দরকার ছিলোনা।
আফজাল খান,সায়নীর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলেন-
খুব দরকার ছিলো।দেখি এটা নে।
-কি এটা?
-আরে নিয়েতো দেখ।
সায়নী হাতে নিয়ে বক্সটা খুলে দেখে তার খালার সোনার হার রয়েছে বক্সের ভেতরে।
-এটাতো খালাম্মার গয়না!
-হুম তোর জন্য।
-কিন্তু আমি এটা নিতে পারিনা খালু।
-তুই অবশ্যই নিতে পারিস।তুই আমার মেয়ে সায়নী।আজ জন্মদিনে একটা দিলাম।বিয়ের সময় তোর খালার যা আছে তার অর্ধেক পাবি।বাকি অর্ধেক মুনিরার।
-কিন্তু আমারতো মায়ের গয়না আছেই।
-উফ এতো তর্ক করিস কেনো বলতো তুই!আফরান কেকটা নিয়ে আয় কেক কাটুক সায়নী।
আফরান কেক এনে টেবিলে রাখে।সায়নী সবার সাথে কেক কাটে।কিন্তু প্রথমে কাকে খাওয়াবে তা নিয়ে সবাই কৌতুুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে।
-আপু তুমি আগে আমাকেই খাওয়াবে তাইনা?নাকি পাবেল ভাইয়াকে।
মুনিরার কথায় দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে সে আফজাল খান কেই কেক খাইয়ে বলে-
আমার খালুর উপর আমার কাছে কোনোদিন কেউ ছিলোনা,থাকবেও না।
সায়নীকে একে একে সবাই উপহার দিলেও আফরান থেকে সে কিছুই পায়নি।
মুনিরা বলে উঠে-
এইযে আপুর জন্য কি এনেছেন আমি দেখতে চাই।
-কিছু আনিনি।আনলেও তোমাকে দেখাতাম না।
-বারে আমি আপনার এতো কি ক্ষতি করলাম?সবসময় এতো মেজাজ দেখান কেনো?
-তুমি আমার জীবনটাই ত্যানাত্যানা করে দিয়েছো।
-ত্যানা!হাহাহাহা!
কি বেহায়া মেয়ে আবার হাসেও।আজ প্রথম আফরান খেয়াল করেছে মুনিরা হাসলে তার মুখে টোল পড়ে।বেশিক্ষণ না তাকিয়ে মুনিরার পাশ থেকে সরে যেতেই তার মা আফরানের সামনে দাঁড়ায়।
-তোমার বোনের জন্য কি উপহার এনেছো?
আমরা দেখতে চাই।
-কিছু আনিনি।
-এটাতো বিশ্বাস করা যায় না।
-কেনো?
-না মানে ও শুধু তোমার নয় ভালো বন্ধুও।
-দেখুন…..
আর কিছু বলতে না দিয়ে সায়নী বলে উঠে-
আসলে আমি বলেছিলাম কিছু না দিতে,আমি চেয়ে নিবো।
ভ্রু-জোড়া কুচকে মুনিরার মা জিজ্ঞেস করেন-
তা তুমি কি চাও শুনি?
আফরানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে সায়নী বলে-
একটা গান গাইবে আমার জন্য?
আফরান কে কিছু বলতে না দিয়ে মুনিরার মা আবার বলে উঠে-
কেনো গাইবেনা!নিশ্চয় গাইবে।কিন্তু একটা শর্ত আছে।
খিলখিল করে হেসে সায়নী বলে-
গান গাইবে ও আর শর্ত দিচ্ছেন আপনি!
-আচ্ছা আবদার বলতে পারো।
-কি আবদার?
-তোমাকে পাবেলের সাথে নাচতে হবে।
কি বলেন পাবেলের আম্মা?
-এটাতো ভালো কথা।আমরা সবাই দেখতে চাই।
সায়নী কিছু বলার আগেই পাবেল এসে তার হাত ধরে বলে-
সবাইকে খুশি রাখা কিন্তু আমাদের দায়িত্ব।শুরু করা যাক?
সায়নী মাথা নেড়ে সাই দিতেই মুনিরার মা আফরানের উদ্দেশ্য বলেন-
বাবা তুমিও শুরু করো।
এই প্রথম সায়নীর জন্য গান গাইতে তার মোটেও ইচ্ছে করছেনা।কারণ সায়নী তার গানেই অন্য আরেকজনের সাথে নাচবে।
কিন্তু এই মূহুর্তে কিছু করার নেই আর।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আফরান গান গাইতে শুরু করে-
যার হাসিতে এই হৃদয়ে পূর্ণিমা হয়,,
যে শুভ্র চাদরে সব করে স্বপ্নময়,,,
সে কি আমার নয়?
সে যদি আমার না হয় তবে,,,,
চারদিক কেনো মাতে কলরবে তার ইশারায়,,
সেতো আমারি আর কারো নয়।
রাত ১১টা….
বিছানার উপরে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে সায়নী।হঠাৎ তার মোবাইলে মেসেজ আসে।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে মেসেজটা পড়ে সে তাড়াতাড়ি উঠে বসে।
মেসেজে লেখা ছিলো-
তোমার টেবিলের ড্রয়ারে তোমার গিফট রাখা আছে।
আফরান উপহার রেখেছে!কিন্তু কি হতে পারে?দ্রুত পায়ে সে এগিয়ে গিয়ে ড্রয়ার টা খুলে।একটা ছোট বক্স তার পাশে একটা একটা খাম দেখতে পায়।
প্রথমে সে বক্সটা খুলে।খুব সুন্দর ডিসাইন এর একটা নাকফুল।বক্সের ভেতরে ছোট একটা চিরকুটও পায় সে।তাতে লেখা-
এই নাকফুলটায় তোমাকে একদম বউ বউ লাগবে।
সায়নী হেসে ড্রয়ার থেকে খামটা নেয়।
কিন্তু খামের ভেতর যা দেখে তা দেখে সে থমকে যায়।
ডির্ভোস পেপার ……..!
তাড়াতাড়ি পুরোটা পড়ে দেখে সে।মুনিরা আর আফরানের ডির্ভোস পেপার এটা।যা দেখে সায়নী নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী মনে করে।তার মানে আফরান ওই মুনিরাকে সত্যিই বিদায় করবে!তাদের মাঝে কেউ থাকবেনা!এর চেয়ে আনন্দের,এর চেয়ে ভালো উপহার আর কি হতে পারে এই দিনে!
সায়নীর ফোন বাজতে থাকে….
আফরান ভেবে খুশিতে সে না দেখেই রিসিভ করে বলে-
আফরান ধন্যবাদ এতোগুলা।
-ওরে আমি আফরান নয়,মিশিকা।
মিশিকার নাম শুনে জিভে কামড় দিয়ে সায়নী বলে-
তুই এতো রাতে?
-আরে একটা কথা ক্লিয়ার হওয়ার জন্য।
-কি?
-তুই হচ্ছিস আফরানের ভাইয়ার বউ।আফরান ভাইয়া আবার নতুন বিয়ে করে এনেছে।তুই পাবেলের সাথে বিয়ে করবি বলছিস,আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।
-আফরান মেয়েটাকে ডির্ভোস দিবে,এর আগে খালুকে সবটা জানাবে।তারপর আমি শুধু আফরানের থাকবো।
-তার মানে পাবেল কে তুই বিয়ে করবিনা?
-মাথা খারাপ নাকি!
-তাহলে পাবেলকে আমার জন্য ঠিক করে দে।
-মানে?
-তুই যখন করবিনা তাকে আমার জন্য ঠিক করে দে।ডাক্তারি পাশ করার জন্য বিয়ে করিনি।এখন ডাক্তারও হয়েছি।বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।কিন্তু কাউকে ভালো লাগেনা।
-হাহা।লাগবে কেমনে,ডাক্তার বলে কথা!
-ধ্যাত ওসব কিছুনা।এমনেই লাগেনি।কিন্তু আজ পাবেলকে দেখে….
-লাড্ডু ফুটেছে মনের ভেতর?
-হুম ফুটেছে।
-ঠিক আছে আমি কথা বলবো উনার সাথে।
আজতো তোকে দেখেছেন।তুই সুন্দরী,স্মার্ট,ডাক্তার।
আশা করি না করবেনা।
-সত্যি বলবি?
-আরে হুম বলবো।
পাবেল কে কিভাবে আফরানের ব্যাপারে বলবে তা নিয়ে ভীষণ চিন্তায় ছিলো সায়নী।মিশিকা তার চিন্তা অনেকটায় কমিয়ে দিয়েছে।সায়নী বিবাহিত জানার পরে পাবেল নিশ্চয় মিশিকাকে মেনে নিবে।হুম আর দেরী করা ঠিক হবেনা।
সায়নী ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করে পাবেলের নাম্বারে-
হ্যালো তুমি এতো রাতে সায়নী!
-এতো অবাক হওয়ার কি আছে?
-না মানে দিনেই ফোন দাওনা,এই সময়ে দেখে একটু অবাক হওয়ার কথা নয়?
-হেহে।আপনি একটু ছাদে আসবেন প্লিজ?
-এখন?
-হুম জরুরী কিছু কথা ছিলো আপনার সাথে।
-ঠিক আছে আমি এখুনি আসছি।
আফরানকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুনিরাও তার পাশে যায়।মুনিরাকে দেখেও আফরান কোনো কথা বলেনা।নিরবতা ভেঙে মুনিরা বলে-
আমার জন্মদিনেও একটা গান উপহার দিবেন প্লিজ?এমনি শোনাবেন না আমি জানি।
তবে জন্মদিনের উপহার হিসেবে শোনানো যায় তাইনা?যে গানটা শুধু আমার জন্যই হবে…
-কবে তোমার জন্মদিন?
-আরো ৫মাস আছে।
-তাহলে সম্ভব নয়।
-কেনো?
-ততোদিনে তুমি এই বাড়িতে থাকবেনা।
-বুঝলাম না?
ছাদে গিয়ে সায়নী দেখতে পায় পাবেল দাঁড়িয়ে আছে।পাবেল তাকে দেখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
সায়নী তার দিকে এগিয়ে গিয়েই বলে-
আমি যে কথা গুলো বলবো,জানিনা আপনি কিভাবে নিবেন।জানি দেরী হয়েছে কিন্তু খুব বেশি দেরী হয়নি।
-কি বলতে চাইছো তুমি সায়নী?
-আসলে…মানে…
-বলেছিলাম কোনো ফর্মালিটি অন্তত আমার সাথে নয়।বলো তুমি।
পাবেলের কথায় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সায়নী বলে-
-আমি এই বিয়েটা করতে পারবোনা।কারণ আমি আফরান কে ভালোবাসি।

সায়নীর কথা শুনে পাবেলের চোখ যেনো কপালে উঠে যায়।কি বলছে সায়নী!আফরান কে ভালোবাসে মানে!
-শুনছেন?
কোনরকমভাবে নিজেকে সামলিয়ে পাবেল প্রশ্ন করে-
আমি ঠিক বুঝলাম না তুমি কি বলছো?
-আফরান আর আমি একে অপরকে ভালোবাসি।
-তোমার মাথা ঠিক আছে সায়নী?আফরান বিবাহিত।
-আমিও বিবাহিত।
-কি!আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা।
-আমি বুঝাচ্ছি আপনাকে।আফরান আর আমি একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি একবছর আগেই।কিন্তু সেটা গোপনে।
-তাহলে ও মুনিরাকে কেনো বিয়ে করেছে?
-বাধ্য হয়ে।আপনিতো আনাসের বন্ধু,জানেনতো সে মারা গিয়েছে বিয়ের দিন কনের বাড়ি পৌছানোর পথেই।সেদিন গ্রামের সকলে মুনিরাকে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করতে থাকে।আর তখন খালু আফরানকে অনুরোধ করে মুনিরাকে বিয়ে করার জন্য।
-আর আফরান নাচতে নাচতে বিয়েটা করে নিয়েছে!
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সায়নী বলে-
ও চায়নি করতে।পরিস্থিতির চাপে পড়ে করতে বাধ্য হয়েছে।
-আর তুমি?কিসের চাপে পড়ে আমাকে বলোনি আগে?
-তখন আপনাকে আপনার বাসা থেকেও জানানো হয়নি বিয়ের ব্যাপারে।
-কিন্তু বড়দের মাঝে সব ঠিক ছিলো।আমার আম্মুতো কতো আশা করে আছেন।আম্মুর কাছে শুনেছিলাম তোমার বাবারা যখন মারা যান আমার বাবা চায়নি মা-বাবা ছাড়া কোনো মেয়েকে বাড়ির বউ করতে।বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে বাড়ির বউ করার সিদ্ধান্ত নেয় আম্মু।কেননা এটা তোমার মা-বাবার ও ইচ্ছে ছিলো।তাই সবসময় তোমার খবর নিতেন।শেষ এক বছরে তোমার তার সাথে যোগাযোগও ছিলো,আমার সাথে না থাকলেও।তুমি তাকে হলেও আগে বলতে পারতে?
-আসলে আমার মাথা কাজ করেনি।
-ওকে!আমার মায়ের কথা বাদ দাও।তোমার খালু তোমার অভিভাবক।তুমি তাকে অন্তত জানাতে?
-চেয়েছিলাম।যেদিন জানাতে যাই তার শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।ডাক্তার বলেছিলেন যেকোনো সময় খারাপ কিছু হতে পারে।
-তাই বলে….
-আমি কোনো ভূল করিনি।যখন যেটা সঠিক মনে হয়েছে তখন সেটাই করেছি।এখন মনে হয়েছে আপনাকে সব জানানোর দরকার তাই জানাতে এসেছি।
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে পাবেল জিজ্ঞেস করে-
আজ কেনো দরকার মনে করলে?
-কারণ আফরান,মুনিরাকে ডির্ভোস দেওয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে।
-ওহ।
ছলছল চোখে পাবেলের দিকে তাকিয়ে সায়নী বলে-
প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন।
লম্বা একটা দম ফেলে পাবেল বলে-
চোখের পানি আটকাও।প্রিয় মানুষদের চোখের পানি সহ্য হয়না আমার।
সায়নী উড়না দিয়ে তার চোখ মুছে পাবেলের পাশে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে বলে-
আপনি খালুকে প্লিজ বলবেন এই বিয়েটা আপনি করতে পারবেন না?
-যদি কারণ জিজ্ঞেস করে?
-বলবেন সেটা আপনি বলতে চান না।
-আফরান তো মুনিরাকে ডির্ভোস দিয়েই ফেলবে তখন তো বললেই হয়।
-আসলে আমি চাইছি আমি যে অসহায় এটা খালু বুঝুক।আপনি বিয়েটা করবেন না বললে আমার প্রতি খালুর আলাদা একটা টান হবে তখন মুনিরাকে সরানো আরো সহজ হবে।
-ঠিক আছে বলবো।
সায়নী তার হাত ছেড়ে বলে-
আপনাকে একটা নাম্বার মেসেজ করবো।
-কার?
-আজ দেখা হয়েছিলো আপনার সাথে,আমার বান্ধবী মিশিকা।ওর আপনাকে অনেক পছন্দ হয়েছে।আপনি চাইলে ওর সাথে বিয়ের কথা আগাতে পারেন।সুন্দরী,স্মার্ট,ডাক্তার আর ভালো ফ্যামিলির মেয়ে সে।
-দয়া দেখাচ্ছো?
-নাহ,মিশিকা বলেছে তাই বললাম।বাকিটা আপনার ইচ্ছে।আমি এখন যাই।আপনি কাল খালুকে বলবেন মনে করে।
আজ সায়নী প্রথম পাবেলকে স্পর্শ করেছে।
কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতিতে সায়নীর ছোঁয়া পেতে হবে তার জানা ছিলোনা।যে ছোঁয়াটা প্রথম ও শেষ।
সায়নী চলে যাচ্ছে…..
পাবেলের কষ্ট হচ্ছে অনেক।
নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে উঠে-
সায়নী শুনছো?
সায়নী পেছনে ফিরে তাকাতেই পাবেল বলে-
আমিও তোমাকে ভালোবাসি।শুধু মাত্র তোমার জন্য আমি দেশে এসেছি।যদি সম্ভব হয় ফিরে এসো।
আফরানের কথায় মুনিরার দমটা আটকে আসতে চায়ছে।এতোদিন পরিবেশ শান্ত ছিলো বড় কোনো ঝড় হবে বলে!কিন্তু কেনো!
তার সাথেই বারবার এমন হবে কেনো!
আফরানকে কিছু বলতে না দেখে সে হঠাৎ বলে উঠে-
আমি আপনাকে ভালোবাসি।
মুনিরার মুখে এমন একটা কথা শুনে থমকে যায় আফরান।
-আমি সত্যি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি।
আপনার সাথে থাকতে চাই আমি।
-এটা হয়না মুনিরা।
-কেনো হয়না?
-সময় এলে সব জানবে।
কথা না বাড়িয়ে আফরান সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।
এটা কি সেই আফরান যে তাকে আশ্বাস দিয়েছিলো তার সাথে অন্যায় কিছু হবেনা!
সেসব তাহলে মিথ্যে ছিলো সেইদিন!
হুম আফরান বলেছিলো তার ভালোবাসা আছে,কিন্তু সে ভেবেছিলো নিজের ভালোবাসার রঙে রাঙাতে পারবে আফরান কে।কিন্তু সে পারেনি,ব্যর্থ হয়েছে সে।
বারন্দায় বসে পড়ে মুনিরা, চোখ দিয়ে পড়তে থাকে তার অনবরত পানি।
একদিনে আফরান ও সায়নী নিজের ভালোবাসা পাবার আশায় প্রহর গুনছে,,
অপরদিকে পাবেল ও মুনিরা ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রনায় ছটফট করছে।
সকাল ৬টা….
আফরান সোফা থেকে উঠতেই চোখ যায় বিছানার দিকে।বিছানায় মুনিরাকে দেখতে পায়না সে।মুনিরা এতো সকালে কই গিয়েছে ভাবতেই চোখ যায় বারান্দার দিকে।
আফরানের অভ্যাস সকালে ঘুম থেকে উঠেই বারান্দায় যাওয়া।কিন্তু আজ সে উঠার আগেই বারান্দার দরজা খোলা।মুনিরা কি খুলেছে?
সোফা থেকে উঠে বারান্দায় যেতেই থমকে যায় সে।
মাটিতে শুয়ে আছে মুনিরা।সে কি কাল রাতে এখানেই ছিলো!
আফরান নিচু হয়ে তাকে ডাকতে থাকে-
মুনিরা?
সাড়া না পেয়ে গায়ে হাত দিতেই উপলব্ধি করে মুনিরার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর।তাই আর না ডেকেই সে মুনিরাকে কোলে তুলে নিয়ে শুইয়ে দেয় বিছানায়।
মুনিরার নিষ্পাপ মুখটা দেখে আজ তার ভীষণ খারাপ লাগছে।এই মেয়েটার কি দোষ!
সেতো তাকে জোর করেনি বিয়ে করতে তাহলে তার ভূলের শাস্তি এই মেয়েটা কেনো পাবে!
মুনিরার মাথায় হাত বুলাতে থাকে আফরান।
আস্তে আস্তে চোখ খুলে মুনিরা।আফরানকে তার পাশে দেখে খুশিতে চোখে পানি চলে আসে তার।মাথার উপর থেকে আফরানের হাতটি নিয়ে নিজের বুকের উপরে রাখে বলে সে-
আপনি এমন কেনো?আমার বান্ধবী,আপু অনেকের কাছে শুনেছি বিয়ের পর তাদের বর কতো আদর-সোহাগ করে।আর আপনি একটা ডাইনির জন্য আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন।
আফরান বুঝতে পারে জ্বরের ঘোরে মুনিরা আবোলতাবোল বলছে।
নিজের হাতটা সরিয়ে সে বলে-
ঠাণ্ডা এখনো যায়নি।তুমি কেনো কাল রাতে বারান্দায় শুতে গিয়েছো?
-আমারতো প্রথম থেকেই ওখানে শোয়ার দরকার ছিলো।তাহলে আপনাকে তখনি এতোটা কাছে পেতাম।
মুনিরার সাথে এখন আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই আফরান বুঝতে পারে।মুনিরার গায়ের উপর কাঁথা দিয়ে বলে-
ঘুমাও চুপচাপ এখন।পরে শুনবো সব কথা।
সকাল ৭টা….
সায়নী ঘুম থেকে উঠেই টেবিলের কাছে গিয়ে ড্রয়ার খুলে ডির্ভোস পেপারটা হাতে নিয়ে আরেকবার দেখে নেয় সে।তার স্বপ্ন খুব তাড়াতাড়ি সত্যি হতে চলেছে!
কিছুক্ষণ হাতে নিয়ে পেপারটা ঘাটাঘাটি করে সায়নী।পরক্ষণেই তার পাবেলের কথা মনে পড়ে।ছেলেটাকে কি খুব বেশি আঘাত দিয়ে ফেলেছে সে?আয়নার সামনে যায় সায়নী।নিজেকে ভালো করে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে ভাবে,সে কি এতোটায় সুন্দরী যে বিবাহিত জানার পরেও পাবেল তাকে ভালোবাসে বলেছে!
এই কয়েকদিনের মাঝে ভালোবাসা তৈরি হয় নাকি?অবশ্য প্রথম দেখাতেও হয় শুনেছে।তবে এসব আদৌ ভালোবাসা নাকি মৌহ?আচ্ছা মুনিরাও কি আফরানকে ভালোবাসে বলেছে?বিশ্বাস নেই ওই মেয়ের,বলতেই পারে।আফরান যদি ওর কথায় গলে যায়!
নাহ,তাড়াতাড়ি করতে হবে যা করার।পাবেল কে পুরোপুরি ঝাটায় করে তারপর মুনিরার ব্যবস্থা করতে হবে।
ফ্রেশ হয়ে নাস্তা বানানোর জন্য রান্নার ঘরে যায় সায়নী।মুনিরার মাকে চুলার পাশে দেখে চমকে যায় সে।
-আন্টি আপনি?
-কেনো!আমার মেয়ের শ্বশুরঘরের যেকোনো জায়গায় আমি যেতে পারিনা?
-কেনো নয়!কিন্তু আপনি মনেহয় কোনো কাজ করছেন।মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে কাজ করা কি ভালো দেখায়?আমাকে বলুন না,আমি করে দেয়।
-মুনিরার জন্য দুধ বানাতে আসছিলাম।জ্বরে শরীর পুরে যাচ্ছে।
-জ্বর!কখন থেকে?
-আমিতো এখুনি জানলাম।জামাই এর সাথে বসার ঘরে দেখা হয়ছে একটু আগে।তখন বলছে।
-আচ্ছা ঠিক আছে,আপনি যান আমি বানিয়ে নিয়ে যাবো

আফরানের হাত ধরে শুয়ে আছে মুনিরা…..
আফরান একটু সরলেই সে আবার ডাকাডাকি করে ব্যস্ত হয়ে যায়।বাধ্য হয়ে আফরানকে তার পাশে বসে থাকতে হয়।
ছোট একটা ট্রে এর উপর এক মগ গরম দুধ নিয়ে আফরানের রুমে হাজির হয় সায়নী।
আফরানের একটা হাত বুকের মাঝে নিয়ে মুনিরা গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে দেখে মেজাজটায় বিগড়ে যায় তার।দ্রুত পায়ে হেটে খাটের পাশের ছোট টেবিলটার উপর ট্রে-টা রাখে সে এক প্রকার শব্দ করে।
সায়নীকে দেখে আফরান তার হাতটি সরিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।আর তখনি মুনিরা বলতে থাকে-
আপনি আবার হাত সরিয়েছেন!আমার শান্তি লাগছেনা আপনার হাতটা না ধরলে,প্লিজ কাছে আসেন না প্লিজ।
চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করে সায়নী।মুনিরার পাশে বসে বলে-
আমার হাত ধরলে হবে?
চোখ দুটো মিটমিট করে খুলে মুনিরা বলে-
ও আপু তুমি!আমার ভালো আপুটা তুমি এসেছো!
আফরান আর না দাঁড়িয়ে রুম থেকে চলে যায়।
আফরানকে চলে যেতে দেখে সায়নী বলে উঠে মুনিরাকে-
আফরান তোমায় আদর করেছে কখনো?
খিলখিল করে হেসে মুনিরা বলে-
কোন একটা ডাইনির জন্য আমাকে ছেড়ে দিবে বলেছে।
মুনিরার মুখে নিজেকে ডাইনি ডাকা শুনলেও কথাটা শুনে অনেকটা শান্তি পায় সায়নী।
মুনিরাকে শোয়া থেকে বসানোর জন্য গায়ে হাত দিতেই চমকে যায় সে।
-এ কি জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে তোমার!হঠাৎ এমন কি করে হলো?
আফরান কি মুনিরাকে নিয়ে একটু বেশি ভেবে ফেলেছে?
হয়তো,,কিন্তু তার এখন শুধুমাত্র সায়নীকে নিয়ে ভাবতে হবে।কিভাবে বাবাকে সব বলা যায়…
ড্রয়িংরুমে আফরানকে পায়চারি করতে দেখে মুনিরার বাবা তার দিকে এগিয়ে যান।মুনিরার মায়ের কাছ থেকে শুনেছে তার জ্বর।মেয়েকে দেখতেই বের হন রুম থেকে।
-জামাই বাবা?
-জ্বী বলেন?
-আমার মেয়েটা খুব জ্বালায়ছে তোমাকে?আসলে ওর জ্বর উঠলে হুঁশ থাকেনা।
-নাহ ঠিক আছে।
-আমার মেয়েটা একটা ভালো স্বামী পায়ছে তাই আমি যে কতো খুশি তোমাকে বলে বুঝাতে পারবোনা।মুনিরার আম্মা আমাকে বলছে তুমি ওর যত্ন নিচ্ছো অনেক।শুনে শান্তি পেলাম বাবা।কি করে যে তোমাকে ধন্যবাদ দিবো….
-ধন্যবাদ এর কিছু নেই,আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি মাত্র।
-তুমি খুব ভালো বাবা।আমার মেয়েটাকে এভাবে সুখে রেখো।বড় ভালো মেয়ে সে।
কেউ বলতে পারবেনা কোনোদিন কারো খারাপ চেয়েছে বা ক্ষতি করেছে সে।কিন্তু বিয়ের দিন ওর সাথেই এমন কিছু হয়ে যাবে আমি ভাবতে পারিনাই।আফজাল আর তুমি না থাকলে যে কি হতো….
-থাক না ওসব কথা।
-ঠিক আছে।তবে জানো?যে গ্রামের মানুষ মুনিরাকে অপয়া বলেছিলো সেই গ্রামের মানুষ তাকে এখন ভাগ্যবতী বলে,যে গ্রামের মানুষ তাকে ওই গ্রামে রাখতে চায়নি আজ তারাই ওকে নিজের বাসায় নিয়ে দাওয়াত খাওয়াতে চায়।
সব তোমার জন্যই সম্ভব হয়েছে।একটা কথা রাখবা বাবা?
-কি?
-আমাদের সাথে ওকে নিয়ে গ্রামে চলো।
সবাই দেখুক আমার মেয়ে কতো সুখে আছে।
-আচ্ছা আগে সুস্থ হোক ও।
-আমি একটু দেখতে যাইতে চাইছিলাম মুনিরাকে এখন।
-ওখানে সায়নী আছে,ওর খেয়াল রাখছে।
যেতে পারবেন আপনিও।
-বড় ভালো সায়নী মেয়েটা।মুনিরাকে একদম বোনের মতোই দেখে।
-হুম।
-আচ্ছা থাক সায়নী থাক,আমি পরে যাবো।
সারারাত ঘুম হয়নি পাবেলের।কাল রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা স্বপ্ন নাকি সত্যি তার বুঝতে এখনো কষ্ট হচ্ছে।সায়নীকে কথা দিলেও এতো গুলো মানুষকে তার কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছেনা।সবচেয়ে বড় কথা সে নিজেও সায়নীর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে।বৈধ সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার জন্য আমেরিকা থেকে এসেছে সে।
তার জন্য অনেক মেয়ে পাগল হলেও প্রথম কোনো মেয়ের জন্য সে পাগল হতে রাজী ছিলো।সেই মেয়েটি সায়নী।আর এই সায়নী-ই তাকে অন্য একটা মেয়ের ফোন নাম্বার দিয়ে চলে গেলো!
জীবনটা বড়ই অদ্ভুত…..
কথা যখন দিয়েছে আফজাল খান কে সবটা জানাতে হবে।তার মায়ের কষ্ট,বাবার রাগ,
আফজাল খানের বিশ্বাস এসব নিয়ে ভাবা যাবেনা।সায়নীকে দেয়া কথাই তার রাখতে হবে।তাতে যদি সায়নী ভালো থাকে,থাকুক।
আর না ভেবে পাবেল এগিয়ে যায় আফজাল খানের রুমের দিকে……
সকাল সকাল পত্রিকা পড়া আফজাল খানের অভ্যাস।তবে সায়নীর হাতে বানানো এক কাপ চায়ের সাথে পড়তে না পারলে যেনো মজা পাওয়া যায়না।এতোক্ষণে চা নিয়ে আসার কথা সায়নীর।আজও উঠেনি সে,শরীর টা কি আবার খারাপ করেছে!কতো হাসি খুশি একটা মেয়ে ছিলো সে, তবে বেশ কিছুদিন তার ব্যবহার দেখে কেমন যেনো লাগছে।সায়নী কি কোনো কষ্টে আছে!
বুকটা ফেটে যাবে তবুও মুখ খুলবেনা সে।
পাবেলের সাথে বিয়েতে কি তার অমত রয়েছে?হওয়ার তো কথা নয়।বছর খানেক আগেই সায়নীকে বলা হয়েছিলো পাবেলের কথা।তাহলে কি অন্যকিছু!
নাহ,অযথায় ভাবছে।পাবেল অনেক ভালো একটা ছেলে।ওর মতো ছেলেকে ভালো না লেগে কি থাকা যায়!দুজনে ভালো থাকবে খুব।কিন্তু এই ঘরটা সায়নীকে ছাড়া শূন্য হয়ে যাবে।
-আসতে পারি?
পাবেলের গলার আওয়াজ শুনে ভাবনার জগৎ থেকে বের হন আফজাল খান।
-আরে তুমি!এসো বাবা।
পাবেল ভেতরে ঢুকে আফজাল খানের পাশে বসতে বসতে বলে-
ভালো আছেন?
-আছি,তুমি?
-জ্বী আমিও ভালো আছি।
-আমি তোমার কথায় ভাবছিলাম।
-কি ভাবছেন?
-সায়নীকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে একদম নিশ্চিতে থাকবো আমি।আমি জানি তুমি ওকে অনেক ভালো রাখবে।মেয়েটা বড় লক্ষি আমার।তোমাকেও সে সুখে রাখবে মিলিয়ে নিও আমার কথা।
আফজাল খানের কথা শুনে পাবেলের তাকে কিছু বলতে ইচ্ছে না হলেও সায়নীর কথা রাখতে বলে-
আমি সায়নীকে বিয়ে করতে পারবোনা।

পাবেলের কথা শুনে আফজাল খান তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন-
কি বলছো তুমি?
-আমাকে ক্ষমা করবেন প্লিজ।
-তুমি কি বলছো তুমি জানো?
-হুম।কিন্তু কিছু করার নেই।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে আফজাল খান-
পাবেল বাবা কি হয়েছে, আমাকে বলো তুমি?
মা-বাবা মরা মেয়েটাকে কি জবাব দিবো আমি?শেষ মুহূর্তে এসে এসব কি বলছো তুমি!
-আমি আম্মুদের নিয়ে এখুনি বাসায় চলে যাচ্ছি,দয়া করে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।
পাবেল তার পাশ থেকে উঠে চলে যেতে চাইলে আফজাল খান তার একটা হাত ধরে ফেলেন।ছলছল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলেন-
মেয়েটাকে কি জবাব দিবো আমি?এই বুড়ো মানুষটার কথাও কি ভাববেনা?
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আফজাল খানের হাত সরিয়ে পাবেল কিছু না বলেই বেরিয়ে পড়ে রুম থেকে।
.
.
এদিকে মুনিরা জ্বরের ঘোরে সেই তখন থেকে সায়নীর সাথে আবোলতাবোল বলে চলেছে….
-আপু উনি আমাকে কার জন্য ভালোবাসেনা?আমাকে ছেড়ে দিবে বলেছে,কিন্তু আমি যেতে চাইনা আপু।উনার সাথে থাকতে চাই।
মুনিরাকে শান্তনা দিতে সায়নী বলে-
ঠিক আছে থেকো,এখন একটু ঘুমাও দেখি।
-ঘুম আসেনা আপু,ঘুমালেই গ্রামের মানুষের কথা মনে পড়ে।কতো অপমান করেছিলো তারা আমায়।আজ আমার নাম থেকে অপয়া শব্দটা সরতে গিয়েও সরছেনা।উনিও আমাকে ছেড়ে দিবেন।আর কতো অপমান সহ্য করবো আমি!
সায়নী খেয়াল করলো মুনিরা কথা গুলো বলার সময় তার চোখ দিয়ে পানি বেয়ে বেয়ে পড়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে।আজ সায়নীরও এই মেয়েটার জন্য মায়া হচ্ছে।
হঠাৎ সায়নীর হাত ধরে মুনিরা বলে উঠে-
আপু প্লিজ তুমি উনাকে বুঝাও না!তোমার কথা শুনে উনি।আমাকে ছেড়ে না দিতে বলোনা প্লিজ।
-বলবো,যদি তুমি চুপচাপ ঘুমাও এখন।
-সত্যি?
-হুম।
.
.
পাবেল তার মাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।তার মাকে কারো সাথেই সে কথা বলতে নিষেধ করেছে।ভাগ্যিস তার বাবা গতকাল রাতেই এক বন্ধুর বাসায় চলে গিয়েছিলেন।নাহলে তাকে মায়ের মতো বোকা বানিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতোনা।
দরজার খুব কাছাকাছি যেতেই আফরানের গলার স্বর শুনতে পায় তারা।
-পাবেল তোমরা কোথায় যাচ্ছো এতো সকালে?
আফরানের কথায় পেছনে ফিরে পাবেলের মা বলেন-
কি জানি বাপু!ছেলেটার কি হলো বুঝলাম না।
আফজাল ভাইয়ের সাথেও দেখা করতে নিষেধ করলো।
-কিন্তু কেনো?
মাকে কিছু বলতে না দিয়ে পাবেল বলে-
আফরান আমাদের এখন যেতেই হবে।
পরে কারণ-টা না হয় জানবে।
-অন্তত সকালের নাস্তাটা করতে?
মৃদু হেসে পাবেল বলে-
খেয়েছি ভাই এতোদিন অনেক।কিন্তু এখন সম্ভব না।এখন যে যেতেই হবে।
.
.
আফজাল খান হাতের কাগজটা বিছানায় রেখে উঠে দাঁড়ালেন।খুবই অস্বস্তি হচ্ছে তার।
পাবেলের সাথে সায়নীকে বিয়ে দিবেন বলে সায়নীর জন্য অন্য কোথাও সম্বন্ধ দেখেননি।
মেয়েটাকে কতো বড় মুখ নিয়ে বলেছিলেন,পাবেল ভালো ছেলে তাকে খুব ভালো রাখবে।আর সেই পাবেল তাদের এতোবড় ধোঁকা দিয়ে চলে গেলো!মেয়েটার চোখাচোখি হবেন কি করে তিনি?কি বলবেন?শেষ মুহূর্তে এসে পাবেল বিয়েটা করবেনা বলেছে…
মানতে পারবেতো সায়নী এটা!
নাহ আর কিছু ভাবতে পারছেন না আফজাল খান।দু’চোখে ঝাপসা দেখছেন।
.
.
মুনিরাকে ঘুম পাড়িয়ে সায়নী ড্রয়িং রুমে এগিয়ে যেতেই আফরানকে দেখতে পায়।বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে।
-কি হয়েছে আফরান?
সায়নীর গলার স্বরে ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে আফরান বলে-
পাবেল এতো সকালে তার মাকে নিয়ে চলে গিয়েছে তাদের বাসায়।
-কি বলছো!এই সকালে!
-হুম।
-ফুফু চলে গেলেন!আমাকে ডাকোনি কেনো?
সকালের নাস্তাটাও করেননি।
-ডাকার সুযোগ কই পেলাম।সেতো আমাকেও বলেনি,চলে যাওয়ার সময় আমি দেখতে পেয়েছিলাম।থাকতে বলেছি কিন্তু তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়েছে।
-কালকের রাতের কথাগুলোর জন্য কষ্ট পেয়েছে বোধহয় পাবেল।
-কি কথা?
-আমি পাবেল কে সব জানিয়ে দিয়েছি।
-কি?আমাদের কথা?
-হুম।
-বাবাকে যদি বলে দেয়?
-আমাদের কথা বলবেনা।তবে এই বিয়েটা সম্ভব নয় তা বলবে।কারণ-টা কি বলতে নিষেধ করেছি।
-কি বলো!
-আরে হুম।
-যাক একটা দিক সামলানো গেলো।
-জ্বী আপনি এবার মুনিরাকে আমাদের মাঝখান থেকে বের করারও ব্যবস্থা করেন।
-হেহে,করবো।
-খালু সব মেনে নিবে আমার বিশ্বাস।
-বাবাকে যদি পাবেল কিছু বলে থাকে তাহলে বাবা এতো চুপচাপ কেনো!
-মন খারাপ হয়েছে হয়তো।তুমি যাও,দেখে আসো।
-হুম যাচ্ছি।ও হ্যাঁ?
-কি?
-মুনিরার কি খবর?
-ঘুমোচ্ছে এখন।
.
.
আফরান এগুতে থাকে বাবার রুমে…..
পাবেলের চ্যাপ্টার বন্ধ হয়েছে এটাও কম কিসের!সায়নীর সাথে অন্য কাউকে নিয়ে এখন আর কোনো চিন্তায় থাকলোনা।
মুনিরার বাবারা গেলেই তার বাবাকে সবটা জানাতে পারবে।
-বাবা আসবো?
আফজাল খান হাত দিয়ে ইশারায় আফরানকে ভেতরে আসতে বলেন।
কথা বলার শক্তি নেই তার।
আফরান এক পা বাড়াতেই আফজাল খান মাটিতে লুটে পড়েন।বাবাকে হঠাৎ এভাবে পড়ে যেতে দেখে হতভম্ব হয়ে যায় আফরান।
অসহায় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরে
চিৎকার করে বলে উঠে-
বাবা!
.
.
-ডাক্তার আমার বাবার কি অবস্থা?
-উনি হার্ট এট্যাক করেছেন।সঠিক সময়ে নিয়ে আসা না হলে বড় কিছু হতে পারতো।
.
.
আফজাল খান যখন মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন সেই সময় আফরানের চিৎকার শুনে আফজাল খানের রুমে মুনিরা ছাড়া সকলে উপস্থিত হয়।বাবাকে এমন অবস্থায় দেখে আফরান পাথর হয়ে যায়।সায়নী কোনমতে নিজেকে সামলিয়ে মুনিরার বাবা ও তাদের বাড়ির ড্রাইভারের সাহায্যে আফজাল খানকে হাসপাতাল আনতে সক্ষম হয়।মুনিরা অসুস্থ থাকায় তার সাথে তার মাকে থাকতে হয় বাসায়।
.
.
.
বেশ কিছুদিন পর………
আফজাল খানকে বাড়িতে আনা হয়।এ কয়েকদিন রাত-দিন এক করে সায়নী তার সেবা করেছে।মুনিরা সায়নীকে সাহায্য করতে চাইলেও সায়নী করতে দেয়নি।আফজাল খানের এই অবস্থার জন্য সায়নী নিজেকে দায়ী মনে করে।সেদিন যদি পাবেল এসব না বলতো তাহলে হয়তো তার খালু আজ সুস্থ থাকতো।আর পাবেলকে এসব বলার জন্য সে নিজেই বলেছিলো।
সে কি করে ভূলে গিয়েছিলো যে এক বছর আগেই ডাক্তার তাদের সাবধান করেছিলো যেকোনো মুহুর্তে আফজাল খানের খারাপ কিছু হতে পারে।সেদিনের কথা শুনে তারা এই এক বছর বিয়ের কথা গোপন করে রেখেছে।আর আজ এক বছর পর এসেই সেদিনের ভয়টা সত্যি হয়ে গেলো!
আফজাল খানের পায়ের কাছে বসে পা দুটো ধরে সায়নী অনবরত কাঁদতে থাকলো।
আফজালে খানের ঘুম ভেঙ্গে যায়।সায়নীকে পায়ের কাছে দেখতে পেয়ে তার পাশে ডাকেন তিনি।সায়নী তার পাশে গিয়ে বসতেই তিনি বলেন-
আমি তোর জন্য পাবেলের চেয়েও ভালো ছেলে এনে দিবোরে মা।ওই পাবেল একটা বজ্জাতের হাড্ডি।আমার এতো ভালো মেয়েটাকে বিয়ে করবেনা বলছে।
-খালু তুমি এসব নিয়ে ভেবোনা একদম।
-আমার লকারে তোর বাবার সম্পত্তির দলিল,মায়ের গহন এসব রয়েছে।আমার কিছু হলে ওগুলো নিয়ে নিস।এতোদিন তো আমি সামলিয়ে রেখেছি।
সায়নী তার হাত ধরে বলে-
সবসময় তুমি সামলাবে।তোমার কিচ্ছু হবেনা,
আমিও তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবোনা বলে দিলাম।আচ্ছা এসব এখন বাদ দাও আমি তোমার জন্য কিছু নিয়ে আসি,খেতে হবেতো তোমাকে।
-হুম।
-কি খাবা বলো?
-তোর যা খুশি বানিয়ে আন।
-উম্ম…চিকেন স্যুপ?
-ঠিক আছে।
সায়নী রুম থেকে বেরুতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আফজাল খান।তিনি কি কোনো ভূল করে ফেলেছেন!সায়নীকে নিজের কাছেই রাখতে পারতেন তিনি।শুধুমাত্র পাবেলের সাথে বিয়ে ঠিক ছিলো বলে এই ব্যাপারে কোনোদিন ভেবে দেখেননি।আজ যদি মুনিরার সাথে আফরানের বিয়েটা না হতো তাহলে সায়নীকে….
নাহ যেটা এখন হওয়ার না সেটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই।
.
.
রান্নাঘরে পা রাখতেই সায়নীর মাথাটা ঘুরে উঠে,মনে হচ্ছে এখুনি পড়ে যাবে সে।
কিন্তু খালুর জন্য কিছু একটা বানাতে হবে।
খালুর দায়িত্ব যে সে নিয়েছে।
ভেতরে ঢুকে চুলার পাশে যাওয়ার আগেই গলগল করে বুমি করে দেয় সে।
রান্নাঘরে মুনিরা বসে তরকারি কুটছিল।
সায়নীর হঠাৎ এমন অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি তার পাশে যায় সে।
.
.
-বাবা,আপু সবার শরীর খারাপ।এই সময়ে আমাকে ফেলে চলে যাবে তুমি আম্মা?
আর কটা দিন থাকোনা।
-তোর চাচার এই সময়ে শরীর খারাপ করে বসে থাকতে হয়ছে কি করবো বল!নাহলে ওই সায়নীর একটা গতি না করে আমি কি যেতাম!
-উফ আম্মা!তুমি শুধু আপুকে নিয়ে এসব কথা বলো কেনো!উনি তোমার কি ক্ষতি করেছে!
-ওরে বলদ তোর ক্ষতি করবে ওই মেয়ে।আমারতো মনে হয় ওই মেয়েই পাবেল কে শিখায় দিছে বিয়ে না করতে আর এসব ভাই সাহেব কে বলতে।নাহলে তুই বল শেষ সময়ে এসে উল্টানোর কারণ কি?
-এতো কিছু আমি জানিনা।আর হুম আম্মা আপুর নাম আছে একটা,সায়নী।ওই মেয়ে ওই মেয়ে করবেনা একদম।
-হুম এখন ভালো লাগবেনা মায়ের কথা।যেদিন সব হারাবি বুঝবি।
-মানে?
-সায়নীকে এর আগেও আমি কয়েকবার বুমি করতে দেখছি।সারাক্ষণ মাথা ঘুরে তার,দূর্বল লাগে।এসব কিসের লক্ষণ জানিস?
-কিসের?
-মা হওয়ার লক্ষণ।
-আম্মা!দোয়া করে থামো তুমি।চলেই যাও তুমি।তোমার এখানে থাকার দরকার নেই।
-যাবো যাবো,তবে সময় থাকতে সায়নীর পেটে কার বাচ্চা খবর নে।নাহলে কপাল পুড়বে তোর।
-আম্মা!
-আমি যাই,ব্যাগ গুছাই।জামাই এর সাথে দেখা হবেনা।একটু পরেই বের হয়ে যাবো,নাহলে পৌঁছাতে দেরী হয়ে যাবে।
মা কিসের ইঙ্গিত দিয়েছে তাকে?সায়নী এমন মেয়েই নয় বিয়ের আগে খারাপ কিছু করবে।তাছাড়া সায়নীর পেটে সন্তান আসলেও তার কেনো কপাল পুড়বে!
মা কি তাহলে তার স্বামীর সাথে সায়নীর….
নাহ,এসব কি ভাবছে সে।এমন জঘন্য চিন্তা সে করতে পারেনা।এটা অন্যায়।সায়নী তাকে নিজের বোনের মতোই দেখে।
এসব ভাবনা মাথা থেকে ফেলে বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে মুনিরা।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বিকাল ৫টা।
আফরান এখন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে বাবার অসুস্থতার জন্য।তাই মুনিরা তার জন্য কিছু বানাতে এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে।

সন্ধ্যা ৭টা……
আফরান বাসায় ফিরে এসে ফ্রেশ হয়েই বাবার রুমে যায়।দরজায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ভেতরে ঢুকে বাবার পাশে বসে সে।ভেবেছিলো তার বাবা ঘুমোচ্ছে।কিন্তু তিনি এমনিতেই চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন।
আফরানের উপস্থিতি বুঝতে পেরে চোখ জোড়া খুলে দেখলেন তিনি,তার ছেলে অন্য দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছে।
-বেঁচে আছিতো বাবা,মরে গেলে না হয় কাঁদিস।
বাবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে সে-
বাবা!এসব হাবিজাবি কথা তুমি একদম বলবা না।কিচ্ছু হবেনা তোমার।
-মনে হচ্ছে মরে গেলেই ভালো হতো।সায়নীর মুখোমুখি হতে বড্ড লজ্জা করে।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আফরান বলে-
তোমার কি কিছু করার আছে এতে!
-হয়তো না।কিন্তু এখন আছে।
-কি?
-ওর জন্য একটা ভালো পাত্র ঠিক কর বাবা।
এটার দায়িত্ব তোকে দিলাম আমি।
-হুম।
.
.
বাবার সাথে কথা বলা শেষে নিজের রুমে আসে আফরান।বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে এই অবস্থায় বাবাকে কিভাবে বলবে সায়নীর কথা!এদিকে সায়নীর জন্য পাত্র দেখতে বললেন তিনি।সায়নীকে পেয়েও কি সে পাবেনা!
-এই নিন আপনার কফি।
মুনিরার গলার স্বরে ভাবনার জগৎ থেকে বের হয় আফনার।কফির মগটা হাতে নিয়ে বলে-
ধন্যবাদ।
-আমি আপনার জন্য পায়েস বানিয়েছি।নিয়ে আসি?
খানিকটা বিরক্ত নিয়ে আফরান বলে-
আমি কি রোগী নাকি পায়েস খাবো!
-হাহাহা…
শুধু রোগীরা খায় নাকি পায়েস?
-আমার কাছে তাই মনেহয়।আমি পায়েস খাইনা।তবে হুম বাবা খুব পছন্দ করেন।
তাকে দিতে পারো।
.
কথাটি বলেই আফরান রুম থেকে বের হয়ে চলে যেতে লাগলো।
.
মুনিরার নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে।সায়নীকে জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয় তার পছন্দ,
অপছন্দ বলতে পারতো সে।
খামোখা পায়েস বানিয়ে লাভ কি হলো!
.
.
ড্রয়িংরুমে যেতেই সায়নীকে সোফায় বসে মোবাইল ফোনে কথা বলতে দেখে আফরান তার পাশে গিয়ে বসে।
মিশিকা ফোন দিয়েছে সায়নীকে।সে আফরানকে দেখে মিশিকাকে ফোনে বলে-
মিশি আমি তোর সাথে পরে কথা বলবো।
-আচ্ছা।
ফোন রেখে কিছুক্ষণ আফরানের দিকে তাকিয়ে সায়নী বলে উঠে-
আজ আমার জন্য খালুর এই অবস্থা।
কফির মগটা হাত থেকে টেবিলের উপর রেখে আফরান বলে-
সবই নিয়তির খেলা।নিজেকে দোষ দিওনা।
-নিয়তির খেলায় যদি আমাদের আলাদা হয়ে যেতে হয়?
-সেটা কখনো সম্ভব নয়।
-মুনিরার আম্মারা আজ বিকেলে চলে গিয়েছেন।
-হঠাৎ?
-মুনিরার চাচা অসুস্থ।
-ওহ।
-খালুকে বলার দরকার নেই এখন আমাদের বিষয়ে।
-হুম।
.
মুনিরা ড্রয়িংরুমে এসে দেখে আফরান আর সায়নী বসে কথা বলছে।
সেও তাদের পাশে গিয়ে বসতে বসতে বলে-
আমিও কি আপনাদের সাথে আড্ডা দিতে পারি?
মৃূদু হেসে সায়নী বলে-
কেনো নয়!
-জানো আপু উনি নাকি পায়েস খায়না।
-হুম জানিতো।আফরানের ঝাল খাবার অনেক পছন্দের।
-ইশ!আগে তোমাকে জিজ্ঞেস করলে ভালো হতো।
-কেনো?
-আরে আমি উনার জন্য পায়েস বানিয়ে ফেলেছি।আগে জিজ্ঞেস করলে ঝাল কিছুই না হয় বানাতাম।
-ও আচ্ছা।
সায়নীর বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা।
মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার।বসা থেকে উঠতে উঠতে আফরানের উদ্দেশ্যে বলে-
তোমরা গল্প করো,আমি একটু শোবো।
চিন্তিত দৃষ্টিতে আফরান তার দিকে তাকিয়ে বলে-
এই অসময়ে শোবে কেনো?শরীর খারাপ লাগছে?
-নাহ,এমনিতেই ভালো লাগছেনা।
-আমি নিয়ে যাবো তোমাকে রুমে?
-আরেনা,আমি পারবো।
-ঠিক আছে।
.
কয়েক পা বাড়াতেই সায়নী ফ্লোরে পড়ে যায় অজ্ঞান হয়ে।সায়নীকে পড়ে যেতে দেখে আফরান আর মুনিরা দৌড়ে এগিয়ে যায় তার দিকে।সায়নীকে কয়েকবার ডাকার পর সাড়া না পেয়ে আফরান তাকে কোলে নিয়ে সায়নীর রুমের দিকে এগুতে থাকে।
মুনিরাও তার পিছে পিছে যেতে থাকলো।
.
কয়েক মিনিট পর….
সায়নী জ্ঞান ফিরে দেখতে পায় আফরান তার ঠিক পাশে বসে আছে।চোখ দুটো ছলছল করছে তার।
তাকে দেখে সায়নী বলে উঠে-
ভয় পেয়েছো?
মুচকি হেসে আফরান বলে-
না পাইনি।
-সেতো দেখতেই পাচ্ছি।
-তুমি শরীরের একদম যত্ন নাওনা।এর আগেও বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলে।কাল তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।অফিসে যাবোনা।
-অফিস থেকে এসেই নিয়ো।বাসায় ভালো লাগছেনা,রাতে রিক্সায় চড়বো তোমার সাথে।
.
সায়নী এতোক্ষণ খেয়াল করেনি রুমে মুনিরাও আছে।একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে সে।
তাকে দেখে সায়নী আবার বলে-
খালুর শরীর খারাপ না হলে মুনিরাকেও নিয়ে যেতে বলতাম।এখন বাসায়তো কারো থাকতে হবে উনার দেখাশোনার জন্য।
.
.
রাত ১২টা….
সায়নীর রুম থেকে নিজের রুমে আসে আফরান।মুনিরাকে না ঘুমিয়ে সোফার উপরে বসে থাকতে দেখে বলে-
ঘুমাওনি কেনো?
-আসছেনা।
-আজ সোফায় শোবে?
-হুম আজ আমার পালা।
-ঠিক আছে,আমি তাহলে খাটে শুয়ে যাই।
-ঠিক আছে।আপুর শরীর কেমন এখন?
-ভালোতো বলছে।
-ঘুমিয়েছে?
-হুম।
.
মায়ের কথা গুলো কানে বাজছে মুনিরার।
আজ আফরান আর সায়নীর কথাগুলো শুনে তার কেমন যেনো লাগছে।তাদের মাঝে আসলেই কি অন্য কোনো সম্পর্ক আছে!
মায়ের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে কি করবে সে!
.
.
.
সকাল ৭.০০টা…..
ঘুম থেকে উঠে সায়নী আজ আবার ড্রয়ারের কাছে গিয়ে ডির্ভোস পেপারটা দেখতে থাকে।
এতোদিন তারা মুনিরার মা-বাবা চলে যাওয়ার অপেক্ষা করছিলো।এখন চলে গিয়েও খালুকে বলতে পারছেনা তাদের সম্পর্কের কথা।আজ যদি খালুর শরীরটা ভালো থাকতো…..!
ড্রয়ারের ভেতর থেকে সায়নী একটি লকেট বের করে,যে লকেট-টি তাকে আফরান উপহার দিয়েছিলো।হাতের মাঝে লকেটটি নিয়ে চুমু খায় সে।
সেই সময় সায়নীর ফোন বেজে উঠে।টেবিলের উপর পেপার আর লকেটটি রেখে এগিয়ে যায় বিছানার দিকে।বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটি নিয়ে দেখলো মিশিকার ফোন।
সায়নী ফোন রিসিভ করে বারান্দার দিকে যেতে যেতে বলে-
সরি কাল আমি তোকে কল ব্যাক করতে পারিনি।আসলে শরীরটা ভালো ছিলোনা।
-কি হয়েছে?
-তেমন কিছু নয়।তুই কি বলতে চেয়েছিলি কাল?
-পাবেল তো আমাকে ফোন দেয়নি।ওর ফোন নাম্বারটা আমাকে দে।
-ওরে ওরে!!মেয়ে হয়ে কল দিবি?
-উফফ..মজা নিবিনা।
-আচ্ছা নিলাম না।কিন্তু ফোন নাম্বার দিতে পারিনা।মাইন্ড করতে পারে।তুই বরং ফেবু আইডি নে।যদি কাজ না হয় তখন না হয় নাম্বারের কথা ভাবা যাবে।
-চলবে,বল।
-ইংরেজি তে লিখবি,পাবেল আহম্মেদ।ছবি আছে দেখতে পাবি।
-তুইনা ফেবু ইউজ করিসনা?
-আফরানতো করে।ওকে দিয়েছিলো,দেখেছি তখন।
-ওকে,থ্যাংকইউ বান্ধবী।
.
মিশিকার সাথে কথা বলা শেষে রুমে পা বাড়াতেই থমকে যায় সায়নী।
টেবিলের উপরে রাখা ডির্ভোস পেপার আর লকেটটা মুনিরার হাতে দেখে সে।সায়নীকে দেখে ডেবডেব করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মুনিরা।টেবিলের উপরে হাত থেকে পেপার আর লকেট রেখে সায়নীর পাশে গিয়ে বলে-
তুমি আমার ভালো আপু!তুমি??
-মুনিরা তুমি যা দেখেছো…
-বিশ্বাস করতে পারছিনা আমি।আমার আর উনার ডির্ভোস পেপার,উনার আর তোমার ছবি দিয়ে লকেট তোমার কাছে।বাহ!
আমাকে আম্মা অনেক আগে থেকেই তোমাকে নিয়ে বলেছিলো যে তোমাকে তার সুবিধার লাগেনা।আমি তার কথা শুনিনি।
আজ দেখছি সত্যি….!
-মুনিরা…
-তোমাদের মাঝে কিছু থেকে থাকলে আমাকে কেনো ঠকালে বলো?কেনো এতোদিন বলোনি!তাহলে আমি উনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম না আর।
-বলতে চেয়েছিলাম তোমাই।
-কি চেয়েছো!এই মেয়েটা তোমাকে কতটা আপন ভেবেছে তুমি জানো?আর তুমি ওর ঘর ভাঙ্গতে বসে আছো!
-আমাদের আগে থেকেই…
-কি আগে থেকে!সম্পর্ক ছিলো?মানলাম ছিলো।কিন্তু উনার বিয়ের পর কি তোমার সরে যাওয়া উচিত ছিলোনা!আরে আমার বিশ্বাসের মান রাখার জন্য হলেও তুমি দূরে থাকতে উনার থেকে।
-শুনো…
একপ্রকার চেঁচিয়ে মুনিরা বলে উঠে-
কি শুনবো কি আমি!এখন তো তুমি উনার বাচ্চার মাও হতে যাচ্ছো।
-বাচ্চা!
-হুম বাচ্চা।লজ্জা করেনা তোমার?এভাবে উনার সাথে অবৈধ সম্পর্ক করতে?
.
কথাটি শুনে সায়নী নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে কষে একটা চড় বসিয়ে দেয় মুনিরার গালে।
সায়নীর এমন কাণ্ডে মুনিরা স্তব্ধ হয়ে যায়।
মুনিরাকে শান্ত অবস্থায় দেখে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সায়নী বলে-
আমি কোনো অবৈধ সম্পর্কে জড়ায়নি।এক বছর আগেই আমার আর আফরানের বিয়ে হয়।
সায়নী কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় মুনিরা।
প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে সায়নীর দিকে তাকাতেই সায়নী বলে-
হুম এটা সত্যি।তুমি নিজের গুলোই বলে যাচ্ছো শুধু।অথচ তুমি জানো কোন পরিস্থিতিতে আফরান তোমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে।আর কি যেনো বলছিলে আমি কেনো সরিনি!আমি ওর প্রথম বউ।আমি কেনো সরবো!
মুনিরা এখনো কিছু বলছেনা,
শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।
.
সায়নী আবার বলতে শুরু করে-
বুঝতে পারছোনা এখনো?
আমি তোমাকে শুরু থেকেই সবটা খুলে বলছি।
.
মুনিরাকে শুরু থেকে সবটা খুলে বলে সায়নী।
সবটা শুনে কিছু না বলে চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমের দিকে এগুতে থাকে মুনিরা।
.
.
.
বিছানার উপর বসে আছে মুনিরা।প্রাণ থেকেও যেনো নেই তার।একটু আগে যা শুনেছে তা কি সত্যি!
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আফরান মুনিরার উদ্দেশ্যে বলে-
অফিস যাবো একটু পরে।সায়নীর শরীরতো খারাপ,নাস্তা আজ তুমি দাও।
বিছানা ছেড়ে উঠে আফরানের সামনে গিয়ে মুনিরা ছলছল চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে-
সায়নী আপু আপনার প্রথম বউ?
মুনিরার এমন প্রশ্নে চমকে যায় আফরান।
মুনিরা হঠাৎ এই প্রশ্নটা করেছে কেনো!ও কি কিছু জেনে গিয়েছে!
আফরান কিছু বলার আগেই মুনিরা বলে উঠে-
হুম আমি সবটা জেনে গিয়েছি।আপনারা এক বছর আগেই বিয়ে করেছেন।

-একটা প্রশ্নই শুধু করবো।আমি কি আপনার মনে আপনার জন্য আলাদা কোনো জায়গা বানাতে পারিনি?
আফরানকে চুপ থাকতে দেখে মুনিরা কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ে।
মুনিরার এমন অবস্থা দেখে তাকে শান্তনা দেওয়ার জন্য আফরান নিচু হয়ে নিজের পায়ে ভর দিয়ে হাটু গেড়ে তার পাশে বসে বলে-
দেখো মুনিরা যা হয়েছে অন্যায় হয়েছে আমি জানি।কিন্তু…
আফরানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মুনিরা হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে-
আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি।আমি আপুকে হিংসা করবোনা।কারণ আপুকেও আমি বোনের মতো ভালোবাসি।দয়া করে আমাকেও থাকতে দিন আপনার পাশে।যেভাবেই বিয়েটা হোক আমিও আপনার বউ।
.
আপাতত মুনিরাকে শান্তনা করার দরকার।পরে না হয় বুঝানো যাবে।এসব ভেবে আফরান তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে-
ঠিক আছে তুমি যা বলো তাই হবে এখন শান্ত হও।
.
এদিকে মুনিরার কি অবস্থা তা দেখার জন্য তাদের রুমে আসে সায়নী।কিন্তু আফরান ও মুনিরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে দেখে নিজেকে সামলাতে না পেরে চেঁচিয়ে বলে উঠে-
আফরান!
সায়নীকে দেখে আফরান ও মুনিরা দুজনি মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ায়।সায়নীর পাশে গিয়ে মুনিরা বলে-
আপু আমাকে মাফ করে দাও।অনেক কিছু বলেছি তোমাই না জেনে।
-এখনতো জেনেছো।এখন তোমার করণীয় কি নিশ্চয় জানো?
মুনিরা হঠাৎ করেই সায়নীর পা ধরে বলতে থাকে-
তোমাদের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়োনা আমায়।এই বাসার যেকোনো একটা কোনায় আমি পড়ে থাকবো।আমিও যে উনাকে ভালোবেসে ফেলেছি আপু।
.
আফরানের দিকে তাকিয়ে দেখে সায়নী,আফরানের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।এই পানি কি মুনিরার জন্য!কিন্তু সে আফরানের ভাগ কাউকে দিতে পারেনা,কিছুতেই না।
মুনিরাকে উঠিয়ে সায়নী বলে-
মনে হচ্ছে আমি তোমাদের মাঝে দাঁড়াল হয়ে দাঁড়িয়েছি এখন।আমার চোখের সামনে আফরানের জীবনে অন্য কারো উপস্থিতি আমি মেনে নিতে পারবোনা।তবে একটা কাজ করতে পারবো।নিজেই অনেক দূরে চলে গিয়ে তোমাদের মুক্তি দিতে পারবো।
.
আর কোনো কথা না বলে সায়নী দৌড়ে বাসার বাইরে চলে যায়।তার পেছনে ছুটে যায় আফরান আর মুনিরা।
আফরান ও মুনিরার ডাকে সায়নী থামেনা।
.
সায়নী বাসা থেকে বের হয়েই রাস্তায় নেমে ফুটপাত ধরে দৌড়াতে থাকে।তার পেছন পেছন ছুটতে থাকে আফরান আর মুনিরা।দূর্ভাগ্যবশত আফরান পা মচকে পড়ে যায় ফুটপাতে।কিন্তু মুনিরা সেদিকে ধ্যান না দিয়ে ছুটতে থাকে সায়নীর পেছনে।হঠাৎ সায়নী রাস্তার মাঝখানে যেতেই তার দিকে দ্রুত বেগে এগিয়ে আসতে থাকে একটি প্রাইভেট কার।
মুনিরা চেঁচিয়ে বলতে থাকে-
আপু সরো।
কিন্তু সায়নী ছুটতে থাকে দ্রুত গতিতে।
কোনো কথা যেনো তার কানে যাচ্ছেনা,কোনো কিছুই যেনো সে শুনছেনা।
এদিকে প্রাইভেট কারটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সায়নীর খুব কাছাকাছি চলে আসতেই দূর থেকে আফরান চেঁচিয়ে বলে উঠে-
সায়নী….!

প্রাইভেট কারটি যখন সায়নীর খুব কাছাকাছি চলে আসে তাকে সরাতে গিয়ে কারটির সাথে ধাক্কা লেগে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মুনিরা।সাথে সাথেই মুনিরার মাথা ফেটে পড়তে থাকে অজস্র ধারায় রক্ত।
ঘটনার আকষ্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় সায়নী।সে নিজে আত্নহত্যা করতে চায়নি।
কেনো যে সে রাস্তার মাঝখানটাই চলে গিয়েছিলো তার নিজেরি জানা নেই।
.
এদিকে আফরান ছুটে আসতেই দেখে সায়নী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিন্তু মুনিরা মাটিতে পড়ে আছে।
সায়নীকে সে ভালোবাসলেও মুনিরার এমন অবস্থা হোক কখনো সে চায়নি।
.
.
-ডাক্তার মুনিরার কি অবস্থা?
-উনি আপনার কি হন?
ডাক্তারের করা প্রশ্নে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আফরান বলে-
আমার স্ত্রী।
-আচ্ছা।মাথায় আঘাত পেয়েছে।হাতেও সামান্য আঘাত পেয়েছে।তবে ভয়ের কিছু নেই।
-জ্ঞান ফিরেছে?
-না,আপনারা আজ রাত উনাকে এখানে রাখলে ভালো হয়।
-ঠিক আছে।
.
ডাক্তারের কথায় যেনো শরীরে প্রাণ ফিরে পায় আফরান।মুনিরার কিছু হলে নিজেকে সে কখনো ক্ষমা করতে পারতোনা।
.
ঘটনার পর থেকেই সায়নী চুপচাপ হয়ে যায়।
এমন পাগলামি না করলে মুনিরাকে হয়তো বিপদে পড়তে হতোনা।আর মুনিরা!কোন মাটি দিয়ে তৈরি সে!এতো কিছু জানার পরেও প্রথমে আফরানের সাথে থাকতে চেয়েছে তাকে ভালোবাসে বলে।আবার নিজের জীবনের পরোয়া না করে তাকে বাঁচিয়েছে।
মুনিরার জায়গায় সে নিজে থাকলে কি করতো!মরেই যেতে দিতে হয়তো।
-সায়নী?
আফরানের ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বের হয় সায়নী।
আফরানকে দেখেই সায়নী বলে উঠে-
মুনিরা কেমন আছে?
-ভয়ের কিছু নেই বলেছে ডাক্তার।
স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে সায়নী।
হাসপাতালের করিডোরে রাখা একটি বেঞ্চে বসে ছিলো সে।আফরান তার পাশে বসে ডান হাতটি ধরে বলে-
এ কি!এতো গরম কেনো তোমার শরীর!
সে কথার জবাব না দিয়ে সায়নী বলে-
-আজ যদি মুনিরার কিছু হয়ে যেতো!
-নিজেকে দোষারোপ করছো মনে মনে?
-হুম।
-আসলেই তোমার দোষ।আজ যদি মুনিরা তোমাকে না সরাতো কি হতো?এইরকম পাগলামো কেউ করে!
-তোমার ভাগ কাউকে দিতে পারতাম না আমি।
-আমি কি বলেছিলাম দিতে?
-না।
-দিতে হবেনা কাউকে।
-কিন্তু আমি দিতে চাই।
-মানে?
-মুনিরাকে তুমি ডির্ভোস দিবেনা।
-সায়নী আমি তোমার কথা কিছু বুঝছিনা।
-মুনিরাও তোমার বউ হিসেবে থাকবে।ওতো সব জানার পরেও থাকতে চেয়েছে।
-কিন্তু আমিতো তোমাকে ভালোবাসি।
-মুনিরাকেও বাসবে।
-এসব কি বলছো তুমি!
-কেনো?এমন কি হয়না!সামর্থ্য থাকলে একাধিক বউ রাখা যায়।
-কিন্তু ভালোবাসা যায়না।
-এটা ভূল ধারণা।আস্তে আস্তে একসাথে থাকতে থাকতে ভালোবাসাটাও তৈরী হবে।
-আবেগ নিয়ে এসব বলছো তুমি সায়নী।
বাদ দাও এসব এখন।
-কি করে বাদ দিবো!ওই মেয়েটা আমার জন্য মরতেও ভয় করেনি।আর বলতে গেলে শুধু আমার জন্য নয়।তোমার ভালোবাসাকে বাঁচাতেও।
-আমরা দেখেশুনে ভালো জায়গায় না হয় বিয়ে দিবো ওর।
-যতটা সহজ ভাবছো ততটা সহজ নয়।একটা ডির্ভোসী মেয়ের স্থান সমাজের কোন পর্যায়ে থাকে তুমি জানো!একবার বিয়ে ভেঙেছে আর এখন তুমিও যদি ছেড়ে দাও সবাই কোন চোখে দেখবে ওকে বুঝতে পারছো?
-ওর সাথে আমার শারীরিক কিছু হয়নি।
-সেটা তুমি,আমি আর ও ছাড়া কেউ জানেনা।
-তাই বলে….
-আজ ওর কিছু হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না আফরান।আমি এতোটা স্বার্থপর যে কোনোদিন ওর কথা ভাবিনি।দুঃখী মেয়েটার পরিণতি কি হবে চিন্তা করিনি,শুধু নিজের চিন্তায় মজে ছিলাম।ডির্ভোসের পর তার কি হবে তাও ভাবিনি।তুমি বলো আমাদের ভূলের মাশুল ও দিচ্ছেনা আজ?
-সায়নী প্লিজ শান্ত হও।
-আমি চাইলে ওকে সবটা শুরুতেই জানাতে পারতাম।কিন্তু বলিনি।ওর যে একটা মন থাকতে পারে সেটা ভাবিনি।একটা আঘাত না সারতেই আরেকটা আঘাত দিতে তৈরি ছিলাম।আফরান আমি আসলেই খারাপ।
-ভূলতো মানুষ করে সায়নী।তাই বলে…
-আমার মনের সব হিংসে চলে গিয়েছে।
মুনিরা যদি পারে আমিও কেনো পারবোনা!আমি না হয় তোমার গোপন বউ-ই থাকবো।
.
আফরান খেয়াল করে সায়নী হাপিয়ে উঠেছে।
কথা বলার সময় সে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে।
সায়নীর মাথা নিজের বুকে নিয়ে বলে সে-
এসব দেখা যাবে।এতো চিন্তা করোনা।
-হু।
-এখন চলো তোমাকে ডাক্তার দেখায়।অনেক দূর্বল দেখাচ্ছে তোমাকে।
-পরে….
-কোনো পরে টরে না,অনেক অবহেলা হয়েছে চলো এখন।
-হুম।
.
.
বসা থেকে উঠতেই দেখা পায় তারা মিশিকার।
-সায়নী তুই এখানে?
-হুম,মুনিরার জন্য।
-কেনো?
-এক্সিডেন্ট করেছে সে।
-কি বলিস!এখন ঠিক আছে সে?
-ডাক্তার বলেছেন ভয়ের কিছু নেই।
-তোর এই অবস্থা কেনো?চোখের নিচে কালি,মুখ ফ্যাকাসে,মনে হচ্ছে এখুনি পড়ে যাবি।
কথাটি শুনে আফরান বলে উঠে-
পড়েতো কয়েকবার গিয়েছিলো।বুমিও করেছে অনেকবার।এখন দেখি শরীর টাও গরম।
তাই তোমার বান্ধবীকে ডাক্তার দেখাতে বলছিলাম।
-আরে আফরান ভাই আমাকে বললে আমি দেখে আসতাম বাসায় গিয়েই।
-হুম ভূল হয়ে গিয়েছে।
সায়নীর দিকে তাকিয়ে মিশিকা বলে-
মাথা কি ব্যথা করে তোর?
-হুম।
-এখন যখন এসেই পড়েছিস কিছু টেস্ট আর সিটি স্ক্যান করিয়ে নে।
আফরান বলে উঠে-
-তুমি ডাক্তার,যা বুঝো করো।
-ঠিক আছে।চলো আমার সাথে।
মিশিকার সাথে যেতে যেতে আফরানকে সায়নী বলে-
খালুর সাথে কে আছেন?
-হাসির মা আর তার স্বামীকে বলেছি থাকতে।
-আমাদের কি থাকতে হবে আজ?
-একরাত থাকলে ভালো হয় আর কি।মুনিরার অবস্থা স্বাভাবিক হয় কিনা…
-বুঝেছি।ঠিক আছে।
.
.
পরেরদিন দুপুরে….
মুনিরাকে নিয়ে বাসায় ফিরে সায়নী আর আফরান।মুনিরার মাথায় ব্যান্ডেজ করা হয়েছে।
.
.
বাসায় ফিরেই মুনিরা দেখা করতে যায় আফজাল খানের সাথে-
বাবা আসবো?
-আসো মা।
মুনিরা তার পাশে গিয়ে বসতেই তিনি বলে উঠেন-
কি করে হলো এসব?
-আমার অসাবধানতার জন্য।
-বাইরে কেনো গিয়েছিলে?
মুনিরা হঠাৎ তার এমন প্রশ্নে জবাব দিতে পারেনি।
মুনিরাকে চুপ থাকতে দেখে আফজাল খান বলেন-
তোমার আম্মাদের খবর দিবো?
-জ্বী না,দুশ্চিন্তা করবেন তারা।তেমন কিছু হয়নি আমার।
-ঠিক আছে।যাও এখন আরাম করো।
.
আফজাল খানের রুম থেকে বের হয়ে মুনিরা আফরানের পাশের রুমে গিয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো।
সেই সময় দরজায় এসে সায়নী বলে-
আসবো মুনিরা?
শোয়া থেকে বিছানায় বসতে বসতে মুনিরা বলে-
আপু আসো।
মুনিরার পাশে বসে সায়নী বলে-
তুমি শোয়া থেকে উঠতে গেলে কেনো!
-সমস্যা নেই আপু।
-হুম।
-আমি দুঃখিত আপু।
-কেনো?
-তোমাদের মাঝে আসতে চেয়েছিলাম।অথচ তোমার দিকটা আমি ভাবিনি।তুমি কি করে নিজের স্বামীকে অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখতে এতোদিন!আর আমি যখন সবটা জানলাম বেহায়ার মতো বললাম আমাকেও রাখো তোমাদের সাথে।আমার কারণে তুমি রাগ করে বেড়িয়ে পড়েছিলে।একটা বড় বিপদ হতে পারতো।
-তুমি হতে দাওনিতো।
-যদি হতো আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না।আমি চলে যাবো আপু।ডির্ভোস পেপারটা দিও,সই করে দিবো।
-তুমি চলে গেলে যে আমিও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা।
-মানে?
-আমি চাইনা তুমি এই বাড়ি ছেড়ে যাও।সবার চোখে যেমন তুমি বউ ছিলে,তেমনি থাকবে।
আমি না হয় আফরানের গোপন বউ হিসেবেই থাকবো।
-আপু!
-তুমি যদি নিজের স্বামীর ভাগ দিতে পারো আমি কেনো নয়!
মৃদুু হেসে মুনিরা বলে-
তা হয়না আপু।
-কেনো হয়না?
-তুমি কষ্ট পাবে।
-বিশ্বাস করো আমার মনে কোনো হিংসে নেই আর।
-শুধু তা নয়।উনি আমাকে ভালোবাসেনা।
কিসের জোরে থাকবো আমি বলতে পারো?
-বৈধ সম্পর্কের জোরে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুনিরা বলে-
সম্ভব না আপু।বাবাকে এবার সব জানিয়ে দাও।উনি নিশ্চয় মেনে নিবেন।তোমার টাও বৈধ সম্পর্ক,তুমি কেনো গোপন বউ হয়ে থাকবে!
-কিন্তু…
-আমাকে আর এই বিষয়ে কিছু বলোনা আপু।পেপারটা দিও।আমি থাকতে চাইনা এখানে।চলে যেতে চাই।প্লিজ আর বলোনা এসব।
.
সায়নী আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায় মুনিরার রুম থেকে।
.
.
রাত ৮টা…
কলিং বেল এর শব্দ হতেই সায়নী এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখতে পায় মিশিকাকে।
-আরে মিশি তুই এই সময়ে!ভেতরে আয়।
-ভেতরে ঢুকার আগেই মিশিকা জিজ্ঞেস করে-
আফরান ভাই কোথায়?
-আমাকে ফেলে আফরানকে কেনো!পাবেল কে বাদ দিয়ে এখন কি তোর আফরানের প্রতি…
-ধ্যাত ঢুকতে তো দিবি!
-আরে মজা করছিলাম।ভেতরে আয় আমি আফরান কে ডেকে দিচ্ছি।
.
.
আফরানকে নিয়ে সায়নী ড্রয়িংরুমে আসতেই মিশিকা বলে উঠে-
আজ কিন্তু আমি রাতের খাবার এখানে খাবো।
মুচকি হেসে সায়নী বলে-
তুই না বললেও না খেয়ে যেতে দিতাম না।
-তাহলে যা এখন।রান্না শুরু করে দে।তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে আমাকে।
-আজ এখানে থেকে গেলেই পারিস।
-নারে,আরেকদিন আসবো।
-আচ্ছা,ঠিক আছে।
সায়নী রান্নাঘরের দিকে এগুতে থাকে।
আর আফরান সোফায় বসতে বসতে বলে-
মিশিকা আমি তোমাকে এমনিতেই ফোন দিবো ভাবছিলাম।সায়নীর রির্পোটের জন্য।
-আমি ওটা নিয়েই এসেছি।
-তাই নাকি!দাও দেখি।
-দেখলে সহ্য করতে পারবেতো?
-বুঝলাম না মিশিকা।
ছলছল চোখে আফরানের দিকে তাকিয়ে মিশিকা বলে-
সায়নীর ব্রেইন টিউমার হয়েছে।
মিশিকার মুখে এমন একটা কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় আফরান।
মিশিকা ব্যাগ থেকে রির্পোট-টা বের করে আফরানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে-
ভেঙ্গে পড়োনা।শক্ত থাকতে হবে।তুমি ভেঙ্গে পড়লে সায়নীর কি হবে বলো!
.
আফরানের মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছেনা।শুধু চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে।
আফরানকে চুপ থাকতে দেখে মিশিকা আবার বলে-
সায়নীর দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করো।খুব বেশি দেরী হয়নি।
চোখ দুটো মুছে মিশিকার দিকে তাকিয়ে আফরান বলে-
ঠিক হয়ে যাবেতো সায়নী?
-হুম।
-গ্যারান্টি নেই?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিশিকা বলে-
আর দেরী করা ঠিক হবেনা।
-তুমি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছো মিশিকা।
তার মানে গ্যারান্টি নেই।
-আল্লাহ্‌ এর রহমত আর উন্নত চিকিৎসা পেলে সায়নী ঠিক হয়ে যাবে।আর ঠিক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
-আমি ওকে নিয়ে কোনো রিক্স নিতে চাইনা।দেশের বাইরে ওর চিকিৎসা করাতে চাই।কোন দেশে নিয়ে গেলে ভালো হবে?
-সিঙ্গাপুর নিয়ে যেতে পারো।
-ঠিক আছে।
রাত ১১টা……
রাতের খাবার খেয়ে ড্রয়িংরুমে আফরানের পাশে বসে টিভি দেখছে সায়নী।কিন্তু ছলছল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে আফরান।
-এভাবে হা করে কি দেখছো?
-তোমাকে।
-আমাকে হা করে দেখার কি আছে?
-তুমি বুঝবেনা।
-ঠিক আছে।মিশিকা কি বলেছে তোমাকে?রির্পোট এনেছে আমার?
.
সায়নীর করা প্রশ্নে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আফরান বলে-
বেশি চিন্তা করেছো তুমি ইদানিং তাই শরীর দূর্বল।আর কিছুন।
.
হঠাৎ মুনিরা এসে আফরানের উদ্দেশ্য বলে-
ডির্ভোস পেপারটা দিতে পারেন।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি চলে যেতে চাই।
.
আফরান কিছু বলার আগেই সায়নী বলে-
কোথায় যাবে?
-সেটা আমার বিষয়।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সায়নী বলে-
আজকের রাতটা ভেবে দেখো।
এপর্যায়ে মুনিরা কড়া গলায় বলে উঠে-
আমি কারো দয়া আর চাইনা।আজ এখুনি ডির্ভোস চাই।
সায়নী কিছু বলার আগে আফরান বলে-
নিজের রুমে যাও।আমি পেপার পাঠিয়ে দিচ্ছি।
.
হনহন করে হেটে মুনিরা নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়।
এদিকে আফরান,সায়নীর হাত ধরে বলে-
পাগলামি করেনা,আমার শুধু তোমাকেই লাগবে।পেপারটা তোমার কাছেনা?যাও ওর কাছে নিয়ে যাও।
সায়নী সোফা ছেড়ে উঠে এগিয়ে যায় সরাসরি মুনিরার রুমের দিকে।
মুনিরাকে বিছানায় বসে কাঁদতে দেখে তার পাশে বসে বলে-
মনের বিরুদ্ধে গিয়ে এই কাজ করাটা কি খুব দরকার?
মুনিরা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ দুটো মুছে বলে-
পেপার এনেছো?
-এতো তাড়া কিসের?
-আপু প্লিজ আর কোনো কথা না বলে পেপারটা দাও আমায়।আমি থাকতে চাইনা এখানে।তোমার সংসার তুমি সামলাও।
-আমি না থাকলে যে তোমাকে বড় দরকার এই সংসারে।আর কাউকে আমি ভরসা করতে পারবোনা মুনিরা।
-মানে?
লম্বা একটা দম ফেলে সায়নী বলে-
আমার ব্রেইন টিউমার হয়েছে।
.
সায়নীর কথা যেনো বিশ্বাস-ই হচ্ছেনা মুনিরার।
ছলছল চোখে সায়নীর দিকে তাকিয়ে বলে-
কি বলছো তুমি এসব!
-যা বলছি সত্যি।
-মজা নিচ্ছো তাইনা তুমি আমার সাথে?
-মৃত্যু পথযাত্রী কখনো মিথ্যে বলেনা মুনিরা।
-আপু!
-আফরানকে এটাই বলতে এসেছিলো মিশিকা।আমাকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হলেও আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটা শুনে নিয়েছি।
.
মুনিরাকে চুপ থাকতে দেখে সায়নী বলে-
আমি খালুর সাথে অন্যায় করেছি,তাকে না জানিয়ে গোপনে বিয়ে করেছি।
ফুফুর বিশ্বাস ভেঙেছি।
পাবেলকে ঠকিয়েছি,ওকে কষ্ট দিয়ে শান্ত হয়নি আবার খালুকে বলতে বলেছি আমাকে বিয়ে করতে সে পারবেনা বলার জন্য।এসব শুনে খালু অসুস্থ হয়ে যায়।আমি তোমার সাথেও অন্যায় করেছি মুনিরা।শুরু থেকে তোমাকে সবটা জানায়নি, তোমারো মন বলতে কিছু আছে তা ভাবিনি।ডির্ভোসের পর তোমার কি হবে তাও ভাবিনি।শুধু নিজেরটাই ভেবে গিয়েছি।যার শাস্তি স্বরুপ আল্লাহ্‌ আমাকে ব্রেইন টিউমার দিয়েছে।এতো গুলো মানুষকে কষ্ট দিয়ে ভালো থাকা যায়না,আসলেই না।
.
সায়নীর পাশে এসে মুনিরা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে-
আপু তোমার কিচ্ছু হবেনা।তুমি অনেক ভালো।তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলেও তুমি যা করেছো তাই করতো।
মুনিরাকে ছাড়িয়ে তার চোখের পানি হাত দিয়ে মুছতে মুছতে সায়নী বলে-
তুমি হলে মোটেও করতেনা।আমার একটা কথা রাখো বোন।
-কি?
-ডির্ভোস দিওনা আফরানকে।আমিতো অসুখ ধরা পড়ার আগেই তোমাকে থাকতে বলেছি।আমি সত্যি চেয়েছি তুমি থাকো।কিন্তু এখন আরো বেশি চাই।আমি মরে গেলে তোমার চেয়ে বেশি এদের কেউ ভালো রাখতে পারবেনা।
-আপু এসব বলবেনা।চুপ করো।
-জানো অনেক ইচ্ছা ছিলো,আমার ধুমধাম করে বিয়ে হবে।সবার চোখে আমি আফরানের বউ হবো।কিন্তু স্বপ্নটা পূরণ হলোনা।খালুকে সবটা বলার ইচ্ছে থাকলেও বলবোনা আর।মরার আগে আর কষ্ট দিতে চাইনা।আর যদি বেঁচেও যাই আফরান কে ছাড়তে না পারলেও ওর গোপন বউ হয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবো।
-আপু তুমি ঠিক হয়ে যাবে।
-হলেও আমি চাই তুমি থাকো।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মুনিরা বলে-
উনি আমাকে ভালোবাসেনা আপু।কিসের জোরে থাকবো আমি?
মৃদুু হেসে সায়নী বলে-
বৈধ সম্পর্কের জোরে।
.
.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের তারা দেখছে আফরান।একদিন হয়তো এই তারার সাথেই কথা বলে সময় কাটাতে হবে।
নাহ কি ভাবছে সে!সায়নীর কিছু হবেনা।এই আর তেমন কি রোগ!ভালো হয়ে যাবে সে।
কিন্তু এসব হওয়ার কি খুব বেশি দরকার ছিলো!তার যে ভয় করছে ভীষণ।
হয়তো এতো গুলো মানুষের সাথে অন্যায় করার কারণে শাস্তি পাচ্ছে সে।কিন্তু নিজের ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস আছে তার।
সায়নীর কিছু হবেনা।
.
.
মুনিরার রুম থেকে সায়নী চলে যেতেই মুনিরা নীরবে কিছুক্ষণ কাঁদতে থাকে।
সায়নীর শরীর খারাপ,মাথা ব্যথা,বুমি,অজ্ঞান হওয়া এসব দেখে ভেবেছিলো সে মা হতে চলেছে।কিন্তু মেয়েটা যে এতো বড় রোগ নিয়ে ছিলো কেউ বুঝতেই পারেনি।
তাদের ছেড়ে সত্যি-ই কি সে চলে যাবে!নাহ সায়নী সুস্থ হয়ে যাবে।তার সব স্বপ্ন পূরণ হবে।
আর সে স্বপ্ন পূরণ করবে মুনিরা।
চোখ দুটো মুছে মুনিরা এগুতে থাকে আফজাল খানের রুমের দিকে।
.
.
তারা দেখতে দেখতে কখন যে তারা গোনা শুরু করে দিয়েছে আফরান নিজেই জানেনা।
-আকাশের তারা গোনার বৃথা চেষ্টা করছো কেনো?
সায়নীর গলার স্বরে তার দিকে তাকিয়ে আফরান বলে-
কাজ হয়েছে?
-কি কাজ?
-ডির্ভোস।
-হবেনা।
-মানে?
-এতো অবাক হওয়ার কি আছে!তোমার দাদা ৩টা বিয়ে করেছিলো আমি জানি।উনি ৩জন বউকেই সমানভাবে ভালোবাসতো।
-হাহাহা!উনিতো প্রথম জনের সাথে প্রেম করে বিয়ে করেনি।
-আমরাও কোথায় প্রেম করলাম!হুট করেই বিয়েটা হয়েছে।
-ভালোবাসতাম তো।
-আবার বাসতে পারবে।
-কি যে বলোনা তুমি!
-শুধু একটা আফসোস থেকে যাবে।খালুকে কিছু জানাতে পারলাম না,তার কাছ থেকে স্বীকৃতি নিতে পারলাম না।
-আচ্ছ কাল সকালেই বাবাকে আমি সব বলবো।
-না,এখন তো একদমই না।
-বাবার শরীর খারাপ বলে?
মৃদু হেসে আফরানের কাছে গিয়ে সায়নী বলে-
বুকে নিবে আমাকে একটু?
-কেনো নিবোনা!
সায়নীকে জড়িয়ে ধরার সাথে সাথে সে বলে-
এত শান্তি কেনো তোমার বুকে আফরান?
-হেহে।
-আফরান আমি বাঁচতে চাই।
সায়নীর মুখে এই কথাটি শুনে থমকে যায় আফরান।
সায়নী আবার বলতে শুরু করে-
হুম আমি সবটা জানি।আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
আজ যদি এতোগুলো মানুষকে কষ্ট না দিতাম তাহলে আমায় এই শাস্তিটা পেতে হতোনা।তোমার কাছে একটাই চাওয়া,আমি যদি মরে যাই মুনিরাকে মেনে নিও।
আর যদি বেঁচে থাকি তবুও ওকে যেতে দিওনা।আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো।আমার জায়গা তুমি কাউকে দিতে পারবেনা।কিন্তু নতুন করে জায়গাতো বানাতে পারবে।হুম পারবে,বৈধ সম্পর্কের জোরে তুমি পারবে।
.
সায়নীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে আফরান-
কিচ্ছু হবেনা তোমার কিচ্ছুনা।মিশিকা বলেছে….
-কিছু বলোনা এখন।জড়িয়ে ধরে রাখো আমায়।
.
.
আফরানের দরজার পাশে এসে মুনিরা বলে-
তোমরা কি আছো?
সায়নী নিজেকে আফরানের কাছ থেকে সরিয়ে বলে-
দাঁড়াও আসছি।
সায়নী আর আফরান বারান্দা থেকে বের হতেই মুনিরা বলে উঠে-
বাবা তোমাদের ডাকছেন।
.
তারা মুনিরার সাথে আফজাল খানের রুমে যায়।তিনি বিছানায় বসে ছিলেন।মুনিরাদের দেখে তিনি বলেন-
সবাই এসে আমার পাশে বসো।
তারা সবাই আফজাল খানের পাশে বসতেই তিনি সায়নীর উদ্দেশ্যে বলেন-
আমি কি খুব খারাপ?
খালুর প্রশ্নে চমকে গিয়ে সায়নী উত্তর দেয়-
মোটেও না খালু।এসব কেনো বলছো?
-নিশ্চয় খারাপ।নাহলে তুই যে অনেক আগে থেকেই আফরানকে ভালোবাসিস আমাকে বলিস নি কেনো?
.
এবার বড়সড় একটা ধাক্কা খায় সায়নী আর আফরান।দুজনি চোখ বড় বড় করে তাকায় আফজাল খানের দিকে।
তাদের চুপ থাকতে দেখে তিনি সায়নীর দিকে তাকিয়ে বলেন-
মুনিরা আমাকে সবটা বলেছে।ভূল মানুষ করে তাই বলে মনে এতো বড় পাথর রেখে দিবি তুই?
-খালু….
-তোর কিছু হবেনা মা।তুই যে মুনিরাকে মেনে নিয়ে ওর অধিকার থেকে ওকে বঞ্চিত করতে চাসনি সেটার জোরেই তোর কিছু হবেনা।সুস্থ হয়ে যাবি তুই।
-খালু তুমি আমাকে মেনে নিয়েছো?
-সেটা আগে বললে মানতাম।কিন্তু মুনিরার সাথে আফরানের বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পর আমি অবশ্যই মানতাম না।এখন যেহেতু মুনিরা তোকে মেনে নিয়েছে,
তুইও তাকে মেনে নিয়েছিস আমার কি বলার থাকে বল!
-খালু আমার ভূল হয়ে গিয়েছে।
-একটা ভূল তুই সংশোধন করেছিস,কিন্তু আরেকটা যে বাকি আছে।
-কি?
-আমি তোর আর আফরানের আবার বিয়ে দিবো।সবার চোখে তুইও আফরানের বউ হবি।তোকে গোপন বউ হয়ে থাকতে হবেনা।আমাদের ধর্মে সামর্থ্য থাকলে ২টা বউ রাখা যায়।
-খালু!
আফজাল সাহেব খেয়াল করেন তার ছেলের চোখে পানি।তিনি তার দিকে তাকিয়ে বলেন-
এই যে গাঁধা যা হবার হয়েছে,চোখ মুছ দেখি এখন।
-বাবা তোমার কিছু হয়ে যাবে বলে আমি বলতে পারিনি এতোদিন।
-ভূল করেছিস।সেই ভূলটা শুধরে দিয়েছে মুনিরা।
-হুম।
-এখন এসব বাদ।
সায়নীর চিকিৎসা কোথায় করবি ঠিক করেছিস?
-সিঙ্গাপুর।ওখানে আমার বন্ধু দুলাল তার বউ নিয়ে থাকে।
ওর বাসায় উঠবো ভাবছি।
-ঠিক আছে।যাওয়ার ব্যবস্থা হতে হতে এখানেও চিকিৎসা চালিয়ে রাখিস।তোরা ফিরে আসার পরে আমি তোদের আবার বিয়ে দিবো।সায়নী আর তোর গোপন বউ থাকবেনা।
.
মুনিরার পাশে গিয়ে সায়নী তাকে জড়িয়ে ধরে বলে-
এতোদিন খালুকে কিছু বলতে পারিনি,আর হয়তো বলতে পারতাম না।তার স্বীকৃতি ছাড়া
মরেও শান্তি পেতাম না।
-আরেকবার মরার কথা বললে আমি কিন্তু চলে যাবো বলে দিলাম।
.
মুনিরার কথাটি শুনে সায়নীসহ সকলে উচ্চশব্দে হেসে উঠে।
.
.
.
সিঙ্গাপুর যাওয়ার দিন….
-আপু সব নিয়েছো?
-হুম নিয়েছি মুনিরা,সব নিয়েছি।
-শুনো আপু একদম ভাববেনা চিকিৎসা করতে গিয়েছো।
-কি ভাববো?
-হানিমুনে গিয়েছো।
-ওরে দুষ্টু…..
-নিজের যত্ন নিবা কেমন।
-তুমিও।বাবার খেয়ালও রেখো।
-হুম।
-মুনিরা আমি মরতে চাইনা।তোমাদের সাথে বাকি জীবনটা পার করতে চাই।
-তাই হবে আপু।
-তুমি আমার কথায় এই সংসার ছেড়ে যাওনি।
আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আফরানের মনে তোমার জন্য আলাদা একটা জায়গা বানাতে আমি সাহায্য করবো।আর যদি আমার কিছু হয়ে যায়….
-কিছু হবেনা তোমার।
.
.
লাগেজ নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে ড্রয়িংরুমে যেতেই সায়নী দেখতে পায় তার ফুফু,পাবেল আর মিশিকাকে।
ফুফুর কাছে গিয়ে সালাম করে সায়নী মাফ চাইতেই তিনি বলেন-
সুস্থ হয়ে ফিরে আয় মা।মনে কোনো ক্ষোভ নেই তোকে নিয়ে।
.
পাবেলের দিকে এগিয়ে যেতেই পাবেল হেসে বলে-
মিশিকার মতো কেউ একজন কে আমার লাইফে এনে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
সায়নী মৃদুু হেসে পাবেল আর মিশিকার উদ্দেশ্যে বলে-
আমি খুব খুশি হয়েছি তোদের জন্য।ভালো থাক এভাবে।
.
আফজাল খান এখন অনেকটায় সুস্থ।
সোফায় বসে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন তিনি।সায়নী তার পাশে বসে বলে-
আমি সুস্থ হয়েই ফিরে আসবো বাবা।
তিনি সায়নীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন-
তাই যেনো হয়।
আফরান নিজের রুম থেকে এসে বলে-
হলো তোমাদের?আমাদের ফ্লাইট এর টাইম হয়ে গিয়েছে।
সায়নী তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে-
হুম হুম হয়েছে,চলো।
আফরান সবাইকে বিদায় দিয়ে লাগেজ হাতে নিয়ে সায়নীর সাথে পা বাড়ায় দরজার দিকে।হঠাৎ পেছনে ফিরে মুনিরার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে-
বাবা আর নিজের খেয়াল রেখো।পৌঁছে দুলাল থেকে ফোন দিবো তোমাকে।
যখন খুশি তার নাম্বারে ফোন দিও।
.
আফরান তাকে ফোন দিতে বলেছে!এটা কি সেই আফরান যে কিনা তাকে প্রয়োজনেও ফোন দিতে নিষেধ করেছিলো?
মুনিরাকে চুপ থাকতে দেখে সায়নী বলে উঠে-
ওই কিছু বলো?
মুচকি হেসে মুনিরা বলে-
ঠিক আছে।
.
সায়নীকে নিয়ে বের হয়ে যায় আফরান।
মনে তার একটায় আশা,তার ভালোবাসা সায়নীর যেনো কিছু না হয়।
.
সায়নীর এখন আর কোনো চিন্তা নেই।সবই পেয়েছে সে।এখন শুধু সুস্থ হয়ে ফিরে আসার অপেক্ষা।যদিও সে আফরানের ভাগ কাউকে দিবে কখনো ভাবেনি।কিন্তু মুনিরাকে দিতে তার কোনো সমস্যা নেই।আর সে জানে আফরানও মুনিরাকে একদিন ভালোবাসতে পারবে।
.
মুনিরার বিশ্বাস সায়নী ঠিক সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে।কিন্তু সে জানেনা সে কখনো আফরানের ভালোবাসা পাবে কিনা।তবে সায়নী বলেছে বৈধ সম্পর্কের জোরে একদিন আফরান তাকেও ভালোবাসবে।আর এই বৈধ সম্পর্কের জোরেই তারা সুখে শান্তিতে সংসার করবে।